পরমব্রহ্ম শিবের রূপ নেই ঠিকই কিন্তু ভক্তদের জন্য তিনি দিব্য দেহ ধারণ করেন

 



ভূমিকা — 

বর্তমান কালে অনেকেই বলে থাকেন যে, নিরাকার ব্রহ্ম কখনোই রূপ ধারণ করেন না, অথবা অনেকে বলেন যে নিরাকার ব্রহ্মের দ্বারা প্রকট করা একটা রূপ মাত্র হলেন শিব। ওই নিরাকার ব্রহ্ম শুধু শিব নয়, বিষ্ণুও নিরাকার ব্রহ্মের একটি রূপ মাত্র। অনেক অসনাতনী বিধর্মী নিন্দুকেরা বলে থাকেন যে, সনাতন ধর্মের পরমেশ্বর হলেন নিরাকার, তাহলে সনাতনীরা কেন সাকার রূপের পূজা করে ?! 

এর উত্তর অনেকের কাছেই অজানা। তাই এই প্রবন্ধে আমরা তার উত্তর আমাদের সনাতন ধর্মের শাস্ত্রের বচন থেকেই উপস্থাপন করেছি ।

________________________________________________

পরমব্রহ্ম শিবের রূপ নেই ঠিকই কিন্তু ভক্তদের জন্য তিনি দিব্য দেহ ধারণ করেন 

শিবমহাপুরাণে মাতা পার্বতী ঋষিদের উদ্দ্যেশ্যে বললেন — 

শিবো ব্রহ্মাবিকারঃ স ভক্তহেতোর্ধৃতাকৃতিঃ ।

প্রভুতাং লৌকিকীং নৈব সন্দর্শায়িতুমিচ্ছতি ॥ ৬৪

[শিব মহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/পার্বতীখণ্ড/২৫ অধ্যায়] 


অর্থ — পরমেশ্বর শিব স্বয়ং ব্রহ্ম, তিনি সকল বিকার থেকে মুক্ত, তিনি নিজের ভক্তদের জন্যই শরীর ধারণ করেছেন। সেই প্রভু শিব সেই কখনোই জাগতিক সংসারে নিজের প্রভুত্ব দেখাতে ইচ্ছুক নন ।


ভাবার্থ — প্রভু শিব স্বয়ং সাক্ষাৎ ব্রহ্ম নামে পরিচিত। তিনি সকল প্রকার দুঃখ, হিংসা, কামাদি বিকার জনিত প্রভাব থেকে মুক্ত। কোনো বিকার ঐ প্রভু শিবকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় না। সেই পরমেশ্বর পরমব্রহ্ম শিব‌ই নিজের ভক্তদের শিবমার্গে পরিচালিত করে আনবার জন্য দেহের রূপ কল্পনা করে নিজের জন্য দিব্য শরীর ধারণ করেন, ঐ সাকার দিব্যদেহধারী রূপে ঐ নিরাকার নির্গুণ শিব‌ই সকলকে শিবতত্ত্ব অবগত করিয়ে শিবে লীন হবার পথ‌ই দেখিয়ে দেন, অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্ম শিব নিজের ভক্তদের জন্য‌ই সাকার রূপ ধারণ করেন।

নশ্বর জগতের জীবেদের কাছে শিব নিজেকে প্রভু বলে উপস্থাপন করেন না, কিন্তু বিষ্ণু, ব্রহ্মা সহ অন্য সকল দেবতা তথা জীবগণ সকলেই নিজেকে  শ্রেষ্ঠ ভেবে কখনো না কখনো গর্ব বোধ করে থাকেন, যা বৃথা প্রলাপ মাত্র। পরমেশ্বর শিব সকলের উৎপত্তিকর্তা হয়েও, সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়েও নিজেকে খুব‌ই সাধারণ করে রাখেন, ফলে শিবের মাহাত্ম্য সহজে কোনো পাপী ব্যক্তি বুঝতে সক্ষম হনন না, তারা মহাদেবকে সাধারণ দেবতা মনে করতে থাকেন।


এবার ঐ নিরাকার ব্রহ্ম শিব যে দিব্য শরীর ধারণ করেন, সেই পরমতত্ত্ব ব্রহ্মের শরীর নির্দিষ্টভাবে কেমন দেখতে হয়, সে বিষয়টিও শাস্ত্র নির্ণয় করে রেখেছে, দেখুন 👇 


কল্পনার অতীত যে নির্বিকল্প পরমতত্ত্ব ব্রহ্ম রয়েছেন, তিনি নিজের জন্য যে লীলাবিগ্রহ রূপ কল্পনা করেন তা মূলত — তিনটি চক্ষু যুক্ত, অর্ধচন্দ্র জটাতে ধারণকারী, অম্বিকা (পরাশক্তি)-র সাথে অবস্থিত — ‘সদাশিব রূপ‌’ ই বটে।

প্রমাণ এখানে 👇 

স্কন্দপুরাণের সূতসংহিতার যজ্ঞবৈভবখণ্ডের উপরিভাগের অন্তর্গত সূতগীতার ২য় অধ্যায়ের ১৫নং শ্লোক থেকে ৫০নং শ্লোকে বলা হয়েছে 👇

নির্বিকল্পে পরে তত্ত্বে শ্রদ্ধা যেষাং বিজায়তে ।

অযত্নসিদ্ধা পরমা মুক্তিস্তেষাং ন সংশয় ॥ ৪৫

নির্বিকল্পং পরং তত্ত্বং নাম সাক্ষাৎ শিব পরঃ ।

সোঽয়ং সাম্বস্ত্রিনেত্রশ্চ চন্দ্রার্ধকৃতশেখরঃ ॥ ৪৬

স্বাত্মতত্ত্বসুখস্ফূর্তিপ্রমোদাৎ তাণ্ডবপ্রিয়ঃ ।

রুদ্রবিষ্ণুপ্রজানাথৈরুপাস্যো গুণমূর্তিভিঃ ॥ ৪৭

ঈদৃশী পরমা মূর্তির্যস্যাসাধারণী সদা ।

তদ্ধি সাক্ষাৎ পরং নান্যৎ সত্যং ময়োদিতম্ ॥ ৪৮

বিষ্ণুং ব্রহ্মাণমন্যং বা স্বমোহান্মন্বতে পরম্ ।

ন তেষাং মুক্তিরেষাঽস্তি ততস্তে ন পরং পদম্ ॥ ৪৯

তস্মাদেষা পরা মূর্তির্যস্যাসাধারণী ভবেৎ ।

স শিবঃ সচ্চিদানন্দঃ সাক্ষাৎতত্ত্বং ন চাপরঃ ॥ ৫০

[তথ্যসূত্র : স্কন্দ পুরাণ/সূতসংহিতা/যজ্ঞবৈভবখণ্ড/উপরিভাগ/সূতগীতা/২য় অধ্যায়/৪৫-৫০]

♦️ অর্থ — 

নির্বিকল্প পরমতত্ত্বতে যার শ্রদ্ধা হয়, তিনি বিনা প্রয়াস করেই মোক্ষ পেয়ে যান ॥৪৫
নির্বিকল্প পরম তত্ত্ব হলেন স্বয়ং প্রভু শিব , তিনি নিজের লীলাবিগ্রহ তে সাম্ব(অম্বা সহিত), ত্রিলোচন, চন্দ্রমৌলি রূপধারী ॥৪৬
নিজ আত্মরূপ, সুখাভিন্ন, স্ফুর্তিলক্ষণ প্রমোদ দ্বারা তিনিই তাণ্ডব প্রিয়, রুদ্রাদি গুণোপাধি মূর্তির‌ও তিনি(শিব‌ই) উপাস্য [অর্থাৎ গুণাত্মক অবতার সংহার কর্তা রুদ্রদেব নিজের উপাস্য হিসেবে নিজের সেই পরমতত্ত্ব ব্রহ্মস্বরূপ পরমেশ্বর শিবের‌ই উপাসনা করেন]॥৪৭
এরকম পরমমূর্তি যার তিনিই সাক্ষাৎ পরমতত্ত্ব, অন্য কেউ নয় ॥৪৮
ব্রহ্মাদি কে পরতত্ত্ব ভাবা মূলত অজ্ঞান, তাই এমন অজ্ঞানতার বিষয় ভাবতে থাকা ব্যক্তি কখনোই মুক্তি লাভ করতে পারে না ॥৪৯
অতঃ শিব , যার সাম্ব আদি মূর্তি বিশেষ রয়েছে তিনিই সচ্চিদানন্দরূপ সাক্ষাৎ পরমতত্ত্ব, অন্য কেউ নয় ॥৫০

________________________________________________

সিদ্ধান্ত 

 নিরাকার পরমব্রহ্ম বলতে যাকে বোঝানো হয়, সেটি মূলত পরমেশ্বর শিব কেই বোঝানো হয়, শিব থেকে ভিন্ন অন্য কোন নিরাকার পরমব্রহ্ম নেই। প্রভু শিব‌ই ব্রহ্মা-বিষ্ণু ইত্যাদি বিভিন্ন অনিত্য দেবতা স্বরূপ ধারণ করে জগতে লীলা করছেন মাত্র, সেই নির্বিকল্প নিরাকার শিব নিজের জন্য যে সাকার দিব্য শরীরের কল্পনা করেন, সেই শরীর ত্রিনেত্রধারী, ত্রিশূলধারী, নীলকন্ঠ, পার্বতীর পতি হিসেবে পরিচিত। সুতরাং, অম্বিকাপতি শিব ছাড়া অন্য আর কেউ নিত্য সত্ত্বাস্বরূপ নিরাকার পরমব্রহ্ম নন, শুধুমাত্র নিজের ভক্তকে মোক্ষ প্রাপ্তির মার্গ দেখিয়ে দেবার জন্য‌ই সেই নিরাকার পরমব্রহ্ম শিব দিব্য শরীর ধারণ করেন । তাই শাস্ত্রে নিরাকার ব্রহ্ম শিবের সাকার রূপের পূজা করা হয়। পরমেশ্বর শিব অবশ্যই সাকার রূপ ধারণ করেন। 

________________________________________________

এইখানে প্রবন্ধ টি সম্পূর্ণ হল ।


শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩 

হর হর মহাদেব 🚩 


তথ্য সংগ্রহে ও লেখনীতে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী 

কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ