বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকে নারায়ণ সূক্তের “নারায়ণ” - নামটি বিষ্ণুর না শিবের ?
ভূমিকা —
এক বিশেষ সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবগণ কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের মহানারায়ণ উপনিষদের নারায়ণ সূক্ত এবং শতপথ ব্রাহ্মণের কিছু নারায়ণ শব্দের উপর নির্ভর করে নারায়ণ শব্দটিকে ‘লক্ষ্মীপতি বিষ্ণু’ - বলে দাবী করছে, আর এরই ভিত্তিতে বৈষ্ণবেরা দাবী করে বলছে যে একমাত্র পরমেশ্বর হল শুধুই বিষ্ণু।
বৈষ্ণবেরা সমগ্র বেদের বিভিন্ন মন্ত্রে উল্লেখিত বিষ্ণু বিষয়ক শব্দ দ্বারা যখন বিষ্ণুর পরমত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম হয় না। তখন তাদের শেষ ভরসা হল এই — নারায়ণ সূক্ত।
বহুদিন ধরে বৈষ্ণবদের অপযুক্তি আমরা শৈবরা সহ্য করেছি, কিন্তু এই প্রবন্ধে তাদের সকল দাবীকে যুক্তি তর্ক দ্বারা খণ্ডন করা হল । প্রবন্ধটি অনেকটা দীর্ঘ হয়েছে, কেননা বৈষ্ণবদের অপপ্রচারও লম্বা চওড়া। তাই সব দিক থেকেই উত্তর উপস্থাপন করে দেওয়া হয়েছে, বহুকালের অপেক্ষায় থাকা বিষয়টি আজ সমাধান করা হল।
________________________________________________
🚫 বৈষ্ণব দের দাবী করা নারায়ণ সূক্ত টি হল —
" সহস্রশীর্ষং দেবং বিশ্বাক্ষং বিশ্বশংভুবম্ |
বিশ্বৈ নারায়ণং দেবং অক্ষরং পরমং পদম্ || ১ ||
বিশ্বতঃ পরমান্নিত্যং বিশ্বং নারায়ণং হরিম্ |
বিশ্বং এব ইদং পুরুষঃ তদ্বিশ্বং উপজীবতি || ২ ||
পতিং বিশ্বস্য আত্মা ঈশ্বরং শাশ্বতং শিবমচ্যুতম্ |
নারায়ণং মহাজ্ঞেয়ং বিশ্বাত্মানং পরায়ণম্ || ৩ ||
নারায়ণ পরো জ্যোতিরাত্মা নারায়ণঃ পরঃ |
নারায়ণ পরং ব্রহ্ম তত্ত্বং নারায়ণঃ পরঃ |
নারায়ণ পরো ধ্যাতা ধ্যানং নারায়ণঃ পরঃ || ৪ ||
স ব্রহ্ম স শিবঃ স হরিঃ স ইন্দ্রঃ সোঽক্ষরঃ পরমঃ স্বরাট্ || ৫ || "
(তৈত্তিরীয় আরণ্যক/ ১০ম প্রপাঠক/ নারায়ণ সূক্ত)
________________________________________________
বৈষ্ণবপক্ষ দাবি করে যে,
তৈত্তিরীয় আরণ্যক নারায়ণসূক্ত বাক্য দ্বারা শ্রীলক্ষ্মীপতি নারায়ণকেই বোঝানো হয়েছে। তারা এটিকে ঈশ্বরের পরম রূপ বা পরব্রহ্ম হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু এই দাবিটি তর্কীয় এবং শাস্ত্রবিরুদ্ধ। কারণ এটি একটি অননুগ্রাহ্য প্রতিজ্ঞা মাত্র, যা ন্যায়শাস্ত্র ও ঋষিবাক্যের যুক্তিব্যবস্থায় টেকসই নয়। বৈষ্ণবরাই বলেছে “ যুক্তিহীন বিচারেন ধর্মহানি প্রজায়তে”। তবে এবার যুক্তি দ্বারা বিচার করা হবে, বৈষ্ণবদের যুক্তি কতটা যৌক্তিক।
🔵ন্যায়সূত্রের পরিপ্রেক্ষিত—
“প্রতিজ্ঞা-হেতু-দাহরণ-উপনয়ন-নিগমনানি অবয়বাঃ।”
[ন্যায়/১/১/৩২]
“প্রতিজ্ঞা (দাবি), হেতু (কারণ), উদাহরণ, উপনয় (প্রয়োগ), নিগমন (উপসংহার) এই পাঁচটি যুক্তির অঙ্গ।”
এই পাঁচটি অঙ্গ উপস্থিত না থাকলে সেই যুক্তি ত্রুটিযুক্ত বলে বিবেচিত হয়।
যেখানে প্রতিজ্ঞা (দাবি) থাকলেও হেতু বা উদাহরণ না থাকে, সেখানে সেই যুক্তিকে বলা হয় “অননুগ্রাহ্য প্রতিজ্ঞা” (unsupported assertion)।
🔵তাহলে যুক্তি বিচার করা যাক—
◾প্রতিজ্ঞা— নারায়ণ = লক্ষ্মীপতি বিষ্ণু।
◾হেতু— নেই — কোথাও উল্লেখ নেই যে এখানে নারায়ণ মানেই শ্রীলক্ষ্মীপতি বিষ্ণু বোঝানো হয়েছে।
◾উদাহরণ— নেই — শাস্ত্র বা প্রসঙ্গ থেকে কোনও রেফারেন্স দেওয়া হয়নি যাতে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, নারায়ণ মানেই এখানে লক্ষ্মীপতি নারায়ণ।
অতএব, এটি "অননুগ্রাহ্য প্রতিজ্ঞা" (unsupported assertion) কারণ এতে প্রতিজ্ঞা থাকলেও হেতু, উদাহরণ, উপনয় বা নিগমন অনুপস্থিত। ন্যায় মতে, এরূপ যুক্তি ত্রুটিপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য নয়।
শ্রুতি কেবলমাত্র সর্বব্যাপী ঈশ্বরের কথা বলছে, সেখানে লক্ষ্মীপতি নাম বা রূপের কোনও উল্লেখ নেই।
বরং শেষে "বিরূপাক্ষ" ও “কৃষ্ণপিঙ্গল” বলা হয়েছে, যা শিবের লক্ষণ। পূর্বে “ঋতং সত্যং….বিশ্বরূপায় বৈ নমো নমঃ” তৈত্তিরীয় আরণ্যক/ মহানারায়ণ /জাবাল দর্শন/ ভস্মজাবাল উপনিষদের উদ্ধৃত দিয়ে দেখানো হয়েছে উক্ত মন্ত্র দ্বারা প্রতিপাদ্য হলো একমাত্র শিবই এবং তার সাথে স্মৃতির একাত্মতাও দেখানো হয়েছে। এবং তা কিছু স্মৃতি শাস্ত্র দ্বারা শ্রুতি খণ্ডানো যাবে না যা, জৈমিনি পূর্বমীমাংসা ১/৩/৩ দ্বারা তা দৃঢ় ভাবে স্থাপিত। অর্থাৎ বিরূপাক্ষ এবং কৃষ্ণপিঙ্গল অর্থে কেবল শিবকেই বোঝায়, কেননা লক্ষ্মীপতি নারায়ণের এমন কোনো লক্ষণ নেই। এবং উক্ত শ্লোকের উপর অন্যান্য শাস্ত্রের সমর্থনের সাথে বিভিন্ন আচার্যের (সায়ণ/ বৃষভেন্দ্র শাস্ত্রী) মান্যতাও রয়েছে। যা ন্যায় ১/১/২৫ মতে দৃষ্টান্ত যা খণ্ডনীয় নয়। তাই “নারায়ণঃ পরং ব্রহ্ম” বলতে সেই বিরূপাক্ষত্ব ও কৃষ্ণপিঙ্গলত্ব লক্ষণধারী পরমেশ্বর শিবই।
🔘বৈষ্ণব দাবী অনুযায়ী ‘নারায়ণ’ অর্থে শুধুই ‘লক্ষ্মীপতি বিষ্ণু’। কিন্তু শ্রুতিতে সেই পরিচায়ক নেই, ফলে এটি অস্পষ্ট হয়ে পড়ে।
এমন অস্পষ্ট বাক্যকে "মন্ত্রাধিকরণ ন্যায়" অনুসারে পরিষ্কার অর্থে বিশ্লেষণ করা দরকার, যেখানে বলা হয়েছে—
“অভিজ্ঞেয়াৎ” [পূর্বমীমাংসা /১/২/৩৮]
“যে শব্দ বা বাক্য প্রত্যক্ষভাবে অর্থ দেয় না, বা যার অর্থ অনির্ধারিত থাকে, তা সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গ ও লক্ষণ বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করতে হবে।”
এক্ষেত্রে, পরবর্তী শ্লোকের “বিরূপাক্ষ”, “কৃষ্ণপিঙ্গল” প্রভৃতি শিবলক্ষণ যুক্ত মন্ত্রসমূহই সেই নির্দেশক উপাদান।
উক্ত নারায়ণসূক্ত ঋষিদের দ্বারা ঋষিদের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত হয়েছে, অর্থাৎ জ্ঞানীজনদের উদ্দেশ্য করে।
পূর্বমীমাংসার বলছে—
“বুদ্ধশাস্ত্রাৎ” [পূর্বমীমাংসা ১/২/৩৩]
“যদি কোনো বাক্য জ্ঞানীজনদের জন্য উচ্চারিত হয়, তাহলে সেটির অর্থ অত্যন্ত নির্ভুল, সুসংগত ও প্রসঙ্গসিদ্ধ হতে হবে।”
সেই হিসেবে, এখানে "নারায়ণঃ পরং ব্রহ্ম" এই বাক্য যদি লক্ষ্মীপতি বিষ্ণুকে বোঝাতো, তাহলে বাক্যটির পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রসঙ্গে তার লক্ষণ থাকত। কিন্তু "বিরূপাক্ষ", "কৃষ্ণপিঙ্গল", ইত্যাদি উচ্চারণই বলছে যে এখানে ‘নারায়ণ’ মানে শিবই।
আরও বিস্তারিত ভাবে যদি বলতে হয় তাহলে এখানে পূর্বমীমাংসার “ছাগপশুন্যায়” উদ্ধৃত দেওয়া হচ্ছে— “অগ্নিষোমীয়ং পশুমালভেত” [তৈত্তিরীয় সংহিতা/৬/১/১/৬] “পশুচোদনায়াম্ অনিয়মঃ অবিশেষাৎ” [মীমাংসা ৬/৮/৩০]— অগ্নিষোমীয় যজ্ঞে পশুবলি দেওয়া উচিত, এই নির্দেশক (বিধি) বাক্যে ‘'পশু’ এমন একটি সাধারণ পদ হওয়ায়, তা চার পায়ে চলা কোনো পশু বলি দেওয়ার কথা বলে, কোনো নির্দিষ্ট পশুর কথা বলে না।
এই কারণে, সেই অগ্নিষোমীয় যজ্ঞে বলি দেওয়ার জন্য ঠিক কি পশু, সে বিষয়ে সন্দেহ হয়। কিন্তু, “ছাগস্য হবিশো বপায়া মেদসঃ” [তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩/৬/৮/১]— অর্থাৎ ছাগলের চর্বি দিয়ে হোম করতে হবে, এই অর্থবোধক বিনিয়োগ মন্ত্র থেকে এবং এই মন্ত্রে ‘ছাগ’ নামক বিশেষ পদ থাকার কারণে, সাধারণ ‘পশু’ শব্দের অর্থ ‘ছাগ’ নির্ধারিত হয়।
এইভাবে, সাধারণ 'পশু’ শব্দের ‘ছাগ’ অর্থ না করলে, ‘'অগ্নিষোমীয়’’ এই বিধিবাক্য ও ‘ছাগস্য হবিশঃ’ এই বিনিয়োগ বাক্যের মধ্যে একতা থাকবে না। তাই সাধারণ ‘পশু’ শব্দের ‘ছাগ’ এই বিশেষ অর্থ গ্রহণ করা উচিত।
এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য পূর্বমীমাংসার “ছাগো বা মন্ত্র বর্ণাত্” [মীমাংসা ৬/৮/৩১]— এই সূত্র প্রবৃত্ত হয়। একেই ছাগপশুন্যায় বলা হয়।
তাই এই ন্যায় দ্বারা সিদ্ধ হয়, ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রে যেসব বিশেষ পদ এসেছে, সেগুলির উপর ভাবনা করে, সাধারণ পদগুলোর অর্থ নির্ধারণ করা উচিত। তাই তৈত্তিরীয় আরণ্যক শ্রুতিতে— বিরূপাক্ষ ও কৃষ্ণপিঙ্গল দ্বারা যদি শিবকে মানা না হয় তবে, কৈবল্য, অথর্বশির, কঠবল্লী ইত্যাদি অনেক উপনিষদে যেসব বিশেষ শব্দ এসেছে যেমন— শিব, অমৃত, উমাসহায়, উমার্দ্ধদেহং’ পরমেশ্বর, নীলকণ্ঠ, ত্রিলোচন, জাতবেদ, ঈশান ইত্যাদি, সেগুলো শিবেই প্রতিষ্ঠিত বিশেষ শব্দ, তারাও বৃথা হয়ে যাবে। অর্থাৎ তৈত্তিরীয় শ্রুতিতে উল্লেখিত “বিরূপাক্ষ, কৃষ্ণপিঙ্গল” বিশেষ অর্থ অন্যান্য শ্রুতি বর্ণিত “ত্রিলোচন, উমাসহায়, উমার্দ্ধদেহং” বিশেষ অর্থের একাত্মতা থাকবে না। তাই ন্যায় অনুযায়ী “বিরূপাক্ষ, কৃষ্ণপিঙ্গল” বিশেষ অর্থ অন্যান্য শ্রুতিতে যে ত্রিলোচন, উমাসহায়ং আদি যে বিশেষ অর্থ আছে, তাতে শিবই সিদ্ধ হয় অন্য কোনো দেবতা নয়। এটাই মেনে নেওয়া ন্যায় সঙ্গত।
অতএব, যদি প্রসঙ্গ শিবের হয়, তাহলে "নারায়ণ পরং ব্রহ্ম" বাক্যও সেই সর্বব্যাপী শিব বোঝায়, লক্ষ্মীপতি নারায়ণ নয়।
সুতরাং, বৈষ্ণবদের দাবী "নারায়ণ অর্থই শ্রীলক্ষ্মীপতি নারায়ণ" — এই প্রতিজ্ঞাটি হেতুহীন ও উদাহরণহীন।
তা অননুগ্রাহ্য প্রতিজ্ঞা।
ন্যায়দর্শনে অগ্রাহ্যযোগ্য।
এবং ষড়লিঙ্গবিরোধী।
তাই "নারায়ণ = লক্ষ্মীপতি" এই দাবীটি যুক্তিতত্ত্ব ও শাস্ত্র উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে ত্রুটিপূর্ণ, অযৌক্তিক।
🔘শ্রুতি কেবলমাত্র সর্বব্যাপী ঈশ্বরের কথা বলছে—
যেমন "বিশ্বং নারায়ণং", "আত্মা নারায়ণঃ", "নারায়ণঃ পরং ব্রহ্ম" কিন্তু, কোথাও লক্ষ্মীপতি, চতুর্ভুজ, শঙ্খ-চক্র-গদাধারী বা কৈশোরবয়স্ক বিষ্ণু রূপের উল্লেখ নেই।
অতএব, এখানে ‘নারায়ণ’ শব্দটি দ্ব্যর্থবোধক হয়ে দাঁড়ায়- নারায়ণ মানে কি শিব, না কি বিষ্ণু?
🔘এই দ্ব্যর্থকতা দূর করতে পূর্বমীমাংসার সূত্র—
“অর্থবিপ্রতিষেধাৎ” [পূর্বমীমাংসা/১/২/৩৬] প্রযোজ্য হয়।
যেখানে বলা হয়েছে, যদি একটিই শব্দ দুই বিপরীত অর্থ বোঝায়, তখন প্রসঙ্গ ও প্রাসঙ্গিক লক্ষণ দেখে অর্থ স্থির করতে হবে।
এক্ষেত্রে, সেই প্রসঙ্গসূচক লক্ষণ কী ?
"বিরূপাক্ষ", "কৃষ্ণপিঙ্গল" এই বিশেষণগুলি একমাত্র শিবের ক্ষেত্রেই খাটে। লক্ষ্মীপতি বিষ্ণুর এমন চিহ্ন বা বর্ণনা শ্রুতিতে নেই।
অতএব, পূর্বমীমাংসার “অর্থবিপ্রতিষেধাৎ” সূত্র অনুসারে, এই দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ‘নারায়ণ’ এর অর্থ বিষ্ণু নয়, বরং শিবই।
সম্পূর্ণ তৈত্তিরীয় আরণ্যক জুড়ে নারায়ণ সূক্তে উল্লেখিত পরব্রহ্মটি যে লক্ষ্মীপতি নারায়ণ তার উল্লেখ তৈত্তিরীয় আরণ্যক শ্রুতিতে কোথাও নেই। তাহলে কিসের ভিত্তিতে পরমেশ্বর শিবের বিশেষণ লক্ষ্মীপতি নারায়ণ হয়? কিসের যুক্তিতে ?
তাহলে “যুক্তিহীন বিচারেন ধর্মহানি প্রজায়তে” এটা কে করছে ? বৈষ্ণবেরা করছে।
এবার কার উপস্থাপন করা যুক্তিই সম্পূর্ণ শাস্ত্র সম্মত ও যৌক্তিক তা জনসাধারণই বিচার করবে।
তবে আসুন বৈষ্ণবগণ আপনদের সাথে আরও যুক্তির খেলা খেলি —
🔵নারায়ণ সুক্তে প্রতিপাদিত ব্রহ্ম লক্ষ্মীপতি নারায়ণ এমন কোনো শব্দপ্রমাণ নেই। এবং নারায়ণ সুক্তে উল্লেখিত ব্রহ্মটা যে শিবই তা পূর্বেই ন্যায়, মীমাংসা দ্বারা প্রমাণিত করা হয়েছে। কিন্তু, অনেকের মনে এই সন্দেহটা থাকবে যে—"ঋতং সত্যং পরমব্রহ্ম পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলম্। ঊর্ধ্বরেতং বিরূপাক্ষং বিশ্বরূপায় বৈ নমো নমঃ" এই মন্ত্র দ্বারা নারায়ণসুক্তে উল্লেখিত ব্রহ্মটা যে শিব তা কীভাবে প্রমাণ হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে পূর্বমীমাংসা বলছে- সমীপের পদ ছেড়ে যদি দূরবর্তী পদের আশ্রয় নেওয়া হয় তবে "অপরিমিতাধিকরণ ন্যায়" এর বিরোধ হয়৷ আর নারায়ণ সুক্তের নিকটবর্তী মন্ত্র হলো "ঋতং সত্যং" মন্ত্র। তাই "অপরিমিতাধিকরণ ন্যায়" অনুযায়ী এক্ষেত্রে নারায়ণ সুক্তকে ব্যাখ্যা করতে "ঋতং সত্যং" এই মন্ত্রের আশ্রয় নেওয়ায় ন্যায় সঙ্গত।
সুতরাং, নারায়ণ সূক্তে উল্লেখিত ব্রহ্মটা একমাত্র শিব, লক্ষ্মীপতি নারায়ণ নয়, পূর্বমীমাংসা অনুসারে—
"অপরিমিতে শিষ্টস্য সংখ্যানিষেধঃ তচ্ছুতিত্বাৎ”
[পূর্বমীমাংসা সূত্র /৬/৭/২১]
যখন কোনো বেদ বা শাস্ত্রে বলা হয় "অপরিমিত" (অসীম, সীমাহীন), তখন পূর্বে বলা যে কোনও সংখ্যা বা নির্দিষ্ট গুণ গ্রহণযোগ্য থাকে না, কারণ এই “অপরিমিত” শব্দটি পূর্বের সীমাকে বাতিল করে দেয়।
🔵বিষয়টিকে একটি সাধারণ উদাহরণের সাহায্যে বুঝি।
উদাহরণ—
ধরা যাক, একজন শিক্ষক ক্লাসে বললেন—
"এই দলে ৫ জন ছাত্র থাকবে, যারা প্রজেক্ট করবে।"
তারপর পরে গিয়ে বললেন—
"প্রকৃতপক্ষে, প্রজেক্টে যে কাজ করবে তার সংখ্যা অসীম হতে পারে, নির্দিষ্ট করা যাচ্ছে না।"
এখন, যদি আমরা বিচার করি, প্রকৃত প্রজেক্ট সদস্য কতজন?
নির্বাচিত নিয়ম অনুসারে, আমরা বলব—
"যেহেতু পরে বলা হয়েছে ‘অসীম’ বা ‘অপরিমিত’, তাই আগে বলা ৫ জন সীমিত সংখ্যাটি আর গৃহীত হবে না। ‘অসীম’ কথাটি সেটা বাতিল করে দিয়েছে।"
🔵নারায়ণসূক্ত (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১০) প্রথমে বলা হয়—
"নারায়ণ পরো জ্যোতিরাত্মা নারায়ণঃ পরঃ।
নারায়ণ পরং ব্রহ্ম তত্ত্বং নারায়ণঃ পরঃ।
নারায়ণ পরো ধ্যাতা ধ্যানং নারায়ণঃ পরঃ।।"
(অর্থাৎ নারায়ণই পরম ব্রহ্ম, নারায়ণই আত্মা, নারায়ণই পরম জ্যোতি........ ইত্যাদি)
দেখে মনে হয় এখানে "নারায়ণ" শব্দ দিয়ে লক্ষ্মীপতি নারায়ণ বোঝানো হয়েছে। কিন্তু, এরপরের মন্ত্রেই বলা হয়েছে —
"ঋতং সত্যং পরব্রহ্ম পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলম্।
ঊর্ধ্বরেতং বিরূপাক্ষং বিশ্বরূপায় বৈ নমঃ॥"
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০]
🔵এই মন্ত্রে —
"বিরূপাক্ষ" = তিন চোখের রং অসম, অদ্ভুতদর্শন — একমাত্র শিবের লক্ষণ “ নমো বিরূপেভ্যো” [শুক্ল-যজুর্বেদ/১৬/২৫]।
"কৃষ্ণপিঙ্গল" = কৃষ্ণ ও পিঙ্গল বর্ণ মিলিত — শ্রুতির সাথেও পুরাণে এটি শিবের একচেটিয়া বর্ণনা।
"ঋতং সত্যম্ পরব্রহ্ম পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলম্" [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/১২], [মহানারায়ণ উপনিষদ/২৩], [ভস্ম জাবাল উপনিষদ/২/৩]।
"একো রুদ্রঃ পরং ব্রহ্ম পুরুষঃ কৃষ্ণপিঙ্গলঃ" [শিবমহাপুরাণ/বায়বীয় সংহিতা/অধ্যায় ৬/১৩]।
সত্যং ব্রহ্ম মহাদেবং পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলম্" [লিঙ্গমহাপুরাণ/উত্তরভাগ/অধ্যায় ১৮/৩৮], [সৌরপুরাণ/অধ্যায় ৪৫/৬০]
"ঊর্ধ্বরেতঃ" = যিনি রেতঃ (বীর্য) ঊর্ধ্বে ধারণ করেন — শ্রুতি ও পুরাণতত্ত্বে এটি একমাত্র শিবের গুণ।
ঊর্ধ্বরেতং বিরূপাক্ষং বিশ্বরূপায় বৈ নমো নমঃ।।
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/১২], [মহানারায়ণ উপনিষদ/২৩], [জাবালদর্শন উপনিষদ/৯/১-২]
"বিশ্বরূপ" = সমস্ত সত্তায় যিনি ব্যক্ত — আবার শিবের চিহ্ন। “ নমো বিশ্বরূপেভ্যো বো নমঃ” [শুক্ল-যজুর্বেদ/১৬/২৫]। “বিভর্ষি সায়কানি ধন্বা অর্হন্ নিষ্কং যজতং বিশ্বরূপম্" [ঋগবেদ/২/৩৩/১০]। "বিশ্বরূপায় বৈ নমো নমঃ" [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/১২], [মহানারায়ণ উপনিষদ/২৩], [জাবালদর্শন উপনিষদ/৯/১-২]
🔵এই সকল গুণ যে শিবেরই তা নিম্নোক্ত শ্রুতি প্রমাণ দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায়—
বৃষভারূঢ়ং হিরণ্যবাহুং হিরণ্যবর্ণং হিরণ্যরূপং পশুপাশবিমোচকং পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলং ঊর্ধ্বরেতং বিরূপাক্ষং বিশ্বরূপং সহস্রাক্ষং সহস্রশীর্ষং সহস্রচরণং বিশ্বতোবাহুং বিশ্বাত্মানং একং অদ্বৈতং নিষ্কলং নিষ্ক্রিয়ং শান্তং শিবং অক্ষরং অব্যয়ং হরি-হর-হিরণ্যগর্ভ-স্রষ্টারং অপ্রমেয়ং অনাদ্যন্তং।।
[ভস্মজাবাল উপনিষদ/২/৩]
🔵উক্ত এসব শব্দ, শ্রুতির ও পুরাণের সাক্ষ্য, আচার্যের মান্যতা অনুসারে শিবের মধ্যেই স্থাপিত অসাধারণ গুণ। যা ন্যায় ১/১/২৫ মতে শিবের মধ্যেই দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়, যার দ্বারা এসব পদ লক্ষ্মীপতি নারায়ণ বা অন্যান্য কোনো দেবতার বৈশিষ্ট্য না হওয়ায় কেবল শিবের মধ্যেই রূঢ় সিদ্ধ হয়। যা, শাস্ত্রের অপপ্রয়োগ দ্বারা খণ্ডানো যাবে না।
🔵এখন আসি মূল প্রয়োগের জায়গায়। আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি—
প্রথমে "নারায়ণঃ পরং ব্রহ্ম" বলা হয়েছে কিন্তু, সেখানে "নারায়ণ" শব্দটির কোনও বিশেষ চিহ্ন (যেমন— লক্ষ্মীসংযুক্ততা, শঙ্খচক্রধারিতা, পদ্মনাভতা) উল্লেখ নেই।
পরবর্তীতে যখন "বিরূপাক্ষ", "কৃষ্ণপিঙ্গল" প্রভৃতি শিব-বাচক গুণাবলি আসে, তখন আমরা নিম্নরূপ সিদ্ধান্তে পৌঁছাই—
প্রথমে "নারায়ণ" শব্দ এসেছে কিন্তু তা নির্দিষ্ট নয়, কেবল সর্বব্যাপী ঈশ্বর বোঝাতে।
পরে এসেছে শিবের একচেটিয়া গুণ বিরূপাক্ষ, ঊর্ধ্বরেতা, কৃষ্ণপিঙ্গল ইত্যাদি।
“অপরিমিতে শিষ্টস্য...” সূত্র অনুসারে পূর্বে যদি কিছু নির্দিষ্টতা থাকে, তা পরবর্তীকালে আসা। “অসীমতর” (বিশ্বরূপ/বিরূপাক্ষ/কৃষ্ণপিঙ্গল) গুণ দ্বারা বাতিল হয়।
সুতরাং “নারায়ণ” শব্দটি আসলে শিবকেই বোঝায়, লক্ষ্মীপতি নয়।
🔵পরবর্তী সূত্রে বলেছে—
"কল্পান্তরং বা তুল্যবৎ প্রসংখ্যানাৎ"
[পূর্বমীমাংসা/৬/৭/২২]
"যদি পরবর্তী অংশ পূর্বের থেকে ভিন্ন অর্থ বা নতুন মাত্রা দেয়, এবং সেটা পূর্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে সেটাকেও মূল হিসেবে ধরা হয়।"
তাহলে নারায়ণসূক্তে পরবর্তী অংশে (যেখানে শিবের গুণ বলা হয়েছে) সেটি নতুন ও নির্ণায়ক ব্যাখ্যা হিসেবে গৃহীত হবে, এবং পূর্ববর্তী অনির্দিষ্ট "নারায়ণ" শব্দটি তার অধীনেই ব্যাখ্যিত হবে।
✅ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত—
যেহেতু নারায়ণসূক্তের প্রথমাংশে “নারায়ণ” শব্দটি নির্দিষ্টভাবে লক্ষ্মীপতি বোঝায় না, এবং পরবর্তী অংশে শিবের গুণাবলি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তাই পুর্বমীমাংসার “অপরিমিতে শিষ্টস্য সংখ্যানিষেধঃ” সূত্র অনুসারে, নারায়ণসূক্তের "পরব্রহ্ম নারায়ণ" আসলে শিবই। এটি ব্যাকরণ, ন্যায়, মীমাংসা ও যুক্তি সব দিক থেকে টেকসই সিদ্ধান্ত।
🔵এই ন্যায় শুধু শাস্ত্রপাঠ নয়, তত্ত্ব নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। এটা দেখায়— “নারায়ণ = লক্ষ্মীপতি” বললেই সেটা যথেষ্ট নয় মন্ত্রের ধারাবাহিকতা ও নিকটবর্তী গুণ সবচেয়ে নির্ধারক পরব্রহ্ম কে, তা নির্ধারিত হয় শুধুমাত্র নাম দিয়ে নয়, বরং তার গুণ ও প্রসঙ্গবাচকতা দিয়ে। এখানে নারায়ণ শব্দটির ব্যবহার শিবের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক ও ন্যায়সিদ্ধ। এটাই মূল ন্যায়মীমাংসার সুনির্দিষ্ট প্রয়োগ।
🔵“নারায়ণ” শব্দটি দেবতার রূঢ় নাম নয়, গুণ বা কর্মবাচক মাত্র—
🔵যাস্ক নিরুক্তের মূল সূত্র—
"ব্যঞ্জনমাত্রং তু তত্তস্যাভিধানস্য ভবতি।"
(নিরুক্ত ৭।৩।১০।১২)
যথা-ব্রাহ্মণায় বুভুক্ষিতায়ৌদনং দেহি স্মাতায়ানুলেপনং পিপাসতে পানীয়মিতি"
অর্থ— দেবতার গুণ বা কর্ম বোঝানো শব্দগুলি (যেমন— “পর”, “জ্যোতি”, “নারায়ণ” ইত্যাদি) শুধুমাত্র বিশেষণমাত্র। এসব শব্দ তত্ত্বের বা দেবতার রূঢ় নাম নয়।
যেমন বলা হয় —
“ব্রাহ্মণায় বুভুক্ষিতায়ৌদনং দেহি স্মাতায়ানুলেপনং পিপাসতে পানীয়মিতি" এখানে “ব্রাহ্মণ” হল বিশেষ্য (রূঢ় নাম), আর "বুভুক্ষিত", "স্নাত", "পিপাসু" হল গুণবাচক বিশেষণ। এই গুণ বা অবস্থাগুলিকে আলাদা ব্যক্তি বলা যায় না। এগুলি একই ব্যক্তির বিভিন্ন অবস্থা মাত্র।
🔵“নারায়ণ” শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হয়—
"আপঃ নারাঃ" (জলই হল 'নার'),
"আপঃ বৈ নরাঃ সুনবঃ" (জলকেই নর বলা হয়েছে),
"অয়নং তস্য তাঃ প্রোক্তাঃ" (জল যেখানে থাকে তা-ই তার 'অয়ন' বা আশ্রয়), তাই 'নারায়ণ' বলা হয়েছে।
এই সব অর্থেই “নারায়ণ” হল ব্যুৎপত্তিনির্ভর গুণ বা কর্ম বাচক শব্দ —
এটি কোনো রূঢ় দেবতার নাম নয়।
যেহেতু রূঢ় নাম নয়, তাই এটি বিশেষ্য নয়,
বরং যাস্কাচার্যের ভাষায় “বিশেষণমাত্র”।
🔵গুণ বা কর্ম দিয়ে দেবতাকে ব্যাখ্যার নিয়ম—
যাস্ক বলেন—
“ভুয়াংসি তু সমায়ানাত্” (নিরুক্ত ৭।৩।১০।৭)
অর্থ— দেবতার বিভিন্ন গুণ বা কর্মবাচক নামসমূহ একত্রভাবে, একই দেবতার বিভিন্ন অবস্থা বা রূপ বোঝায়।
অতএব,“নারায়ণ”, “জ্যোতি”, “ধ্যেয়”, “ব্রহ্ম” এসব শব্দে কোনো ভিন্ন দেবতা বোঝানো হয় না, বরং তারা এক পরম সত্তার গুণমাত্র।
🔵কে সেই রূঢ় দেবতা?
নিঘন্টু (যাস্কের আলোচ্য গ্রন্থ) অনুযায়ী বলা হয়েছে—
“এক এব রুদ্র অবস্ততে ন দ্বিতীয় " (নিঘন্টু ১।২।৪।৯)
অর্থ— রুদ্রই একমাত্র দেবতা, দ্বিতীয় কেউ নেই। একই মত শ্রুতিরও- "এক হি রুদ্র ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য" [শ্বেতাশ্বতর/৩/২], [তৈত্তিরীয় সংহিতা/১/৮/৬]।
সুতরাং, নিরুক্ত অনুযায়ী “নারায়ণ” শব্দটি যেই দেবতার গুণ বোঝায়, তিনি রূঢ় নামবিশিষ্ট একমাত্র রুদ্র অর্থাৎ শিব।
🔵সুতরাং—
নিরুক্ত ৭.৩.১০.১২ গুণ ও কর্ম বাচক পদ (যেমন "নারায়ণ") দেবতার বিশেষণমাত্র।
নিরুক্ত ৭.৩.১০.৭ এই সব গুণবাচক শব্দ একই দেবতার বিভিন্ন অবস্থা বোঝায়।
নিঘন্টু ১.২.৪.৯ রূঢ় দেবতা একমাত্র রুদ্র (শিব)।
🔵নারায়ণ শব্দটি গুণবাচক, রূঢ় নয়, এবং একমাত্র রূঢ় সত্তা = রুদ্র।
ফলে, এই দুই যুক্তি মিলিয়ে নারায়ণসূক্তে ‘নারায়ণ’ বলতে একমাত্র শিবই বোঝায়। যুক্তি, শ্রুতি, মীমাংসা, নিরুক্ত সব দিক থেকেই অবিচল সিদ্ধান্ত। শিবই নারায়ণ, শিবই পরব্রহ্ম।
🔵তৈত্তিরীয় আরণ্যকে সায়ণ আচার্যও তাঁর ভাষ্যে নারায়ণকে শ্রীহরি বিষ্ণু বলে যাননি। নারায়ণ সূক্তের এই ' নারায়ণ ' শব্দের অর্থ নিরূপণ প্রসঙ্গে সায়ণাচার্য বলছেন -
সায়ণভাষ্য - " অতো নারাযণঃ পর এবাহহত্মা ন ত্বপরা মূর্তিবিশেষঃ ।
তস্মান্নারাযনঃ পরমাত্মা ।
পুনরপি নারায়ণস্য সর্বাত্মকত্বমুচ্যতে । "
অর্থাৎ সায়ণ ভাষ্য মতে ' নারায়ণ ' শব্দের অর্থ হল আত্মা বা পরমাত্মা, কোন মূর্তি বিশেষ নয় । ' নারায়ণ ' শব্দের দ্বারা পরমেশ্বর এর সর্বাত্মকতাকে বোঝানো হয়েছে।
আচার্য ভট্টভাস্করের ভাষ্য অনুযায়ীও “নারায়ণ” শব্দটি কোনো সাকার পুরুষ নয়, বরং সমস্ত জীব ও জড়ের উৎস, আশ্রয় ও উপাদানতত্ত্ব। তিনিই পরমাত্মা। এ-কারণে নারায়ণ শব্দটি এখানে ব্যক্তিবাচক নয়, বরং তত্ত্ববাচক—
তস্য অপত্যানি নারাঃ সর্বে চেতনাঃ অচেতনাশ্চ। তেষাং অয়নং উপাদানস্থানং নারায়ণঃ পরমাত্মা।
[ভট্ট ভাস্কর ভাষ্য/ তৈত্তিরীয় আরণ্যক /৬/৭]
তাঁর সন্তানরূপে (তাঁর থেকেই উৎপন্ন) সব চেতন ও অচেতন সত্ত্বা মানে, জীব ও জড় সবই তাঁরই সৃষ্টি। সেই সমস্ত সত্ত্বার আশ্রয় এবং বস্তুগত উপাদান (যা দিয়ে গঠিত হয়েছে) হলেন নারায়ণ, যিনি পরমাত্মা।
তাহলে, এই 'নারায়ণ' সংজ্ঞা আসলেই কার প্রতি প্রযুক্ত হয়েছে এবং সেই পরমাত্মা/পরমব্রহ্ম টি আসলে কে সেটা এবার আমরা সেই তৈত্তিরীয় আরণ্যকের নারায়ণ সূক্তের পরবর্তী শ্লোকগুলি থেকেই শব্দপ্রমাণ সহ দেখে নেবো, সাথে সায়ণ ভাষ্য থেকেও -
"ঋতং সত্যং পরং ব্রহ্ম পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলম্ ।
ঊর্ধ্বরেতং বিরুপাক্ষং বিশ্বরূপায় বৈ নমো নমঃ ॥ "
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/ তৈত্তিরীয় আরণ্যক/ ১০ ম প্রপাঠক- পরিশিষ্ট /২৩ নং অনুবাক]
সায়ণ ভাষ্য - " যদেতৎপরং ব্রহ্ম তৎসত্যমবাধ্যম্ । সত্যত্বং চ দ্বিবিধং ব্যাবহারিকং পারমার্থিকং চ । .... তাদৃশং ব্রহ্ম ভক্তানুগ্রহাযোমা-মহেশ্বরাত্মকপুরুষরুপং ভবতি । তত্র দক্ষিণে মহেশ্বরভাগে কৃষ্ণবর্ণে উমাভাগে বামে পিঙ্গলবর্ণঃ । স চ যোগেন স্বকীয়ং রেতো ব্রহ্মরন্ধ্রে ধৃত্বোর্ধ্বরেতা ভবতি । ত্রিনেত্রত্বাদ্বিরুপাক্ষঃ । তাদৃশং পরমেশ্বরং অনুশ্রুত্যেতি শেষঃ । "
ভাষ্যানুবাদ ও মর্মার্থ - যিনি সেই পরমব্রহ্ম তিনিই সত্য স্বরূপ। তাঁর সেই সত্যত্ব দ্বিবিধ, ব্যবহারিক এবং পারমার্থিক। সেই (নির্গুণ) ব্রহ্ম (পারমার্থিক) ভক্তানুগ্রহের নিমিত্তে ( ব্যবহারিক পর্যায়ে) উমা-মহেশ্বরাত্মক স্বরূপ ধারণ করেন (অর্থাৎ নিরাকার পরমশিব থেকে অর্ধনারীশ্বর সদাশিব স্বরূপে প্রকটিত হন)। তাঁর দক্ষিণভাগ মহেশ্বর ভাগ কৃষ্ণবর্ণের এবং বাম ভাগ উমা ভাগ পিঙ্গল বর্ণের।
তিনি যোগের দ্বারা (ঊর্ধ্বরেত অর্থাৎ) নিজের তেজঃ শক্তিকে (অর্থাৎ কুণ্ডলিনী পরাশক্তি) ব্রহ্মরন্ধ্রের (সহস্রার পদ্ম) দিকে প্রেরণকারী, সেই পরমেশ্বর বিরূপাক্ষ অর্থাৎ ত্রিনেত্রধারী। পরমেশ্বরের এইরূপ স্বরূপই অনুশ্রুতি অর্থাৎ শ্রুতিলব্ধ জ্ঞান।
"ব্রহ্ম" মানে সেই পরমসত্তা, যিনি নিজে অনন্তভাবে ব্যাপ্ত (বৃহৎ), এবং আবার সেই সত্তা থেকেই জগতের বহির্প্রকাশ হয় (বৃহণ)। অর্থাৎ, যিনি জগৎ হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন, তিনিই ব্রহ্ম। জগৎ হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন বলেই শ্রুতিতে শিবকে “জগতাম পতয়ে নমঃ” [শুক্ল-যজুর্বেদ/অধ্যায় ১৬/১৮] — “তস্যাবয়ভূতৈস্তু ব্যাপ্তং সর্ব্বমিদং জগৎ” [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৪/১০] বলা হয়েছে। এবং অথর্বশির উপনিষদ ২ নং অনুবাক ও রুদ্রহৃদয় আদি উপনিষদেও যিনি জগৎ স্বরূপে প্রকাশিত তিনিই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর শিব। আর পরমেশ্বর শিব ব্যাপক থেকেও ব্যাপক বলেই শ্রুতিতে বলছে— "সর্বব্যাপী স ভগবান্ তস্মাৎ সর্বগতঃ শিবঃ" [কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/শ্বেতাঃ উঃ/৩/১১] । — “যো বৈ বেদাদিষু গায়ত্রী সর্বব্যাপী মহেশ্বরাৎ”[ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২১]
“সর্বস্থিতং সর্বগতং সর্বপব্যাপ্তং তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্প মস্তু,[ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২২]— “স সর্বব্যাপী, যঃ সর্বব্যাপী সোঽনন্তঃ….স ভগবান মহেশ্বর” [অথর্ববেদ/অথর্বশির উপনিষদ/৩]। এবং ব্যাপক থেকেও ব্যাপক হয়ে তিনি প্রপঞ্চ রূপে বদলে যায় তাই তো শ্রুতি বলছে—
"সর্বো বৈ রুদ্রস্তস্মৈ রুদ্রায় নমো অস্তু ।
পুরুষো বৈ রুদ্রঃ সন্মহো নমো নমঃ ।
বিশ্বং ভূতং ভুবনং চিত্রং বহুধা জাতং জায়মানশ্চ যৎ ।
সর্বো হ্যেষ রুদ্রস্তস্মৈ রুদ্রায় নমো অস্তু ॥ "
(কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/ তৈত্তিরীয় আরণ্যক/ ১০ ম প্রপাঠক- পরিশিষ্ট /২৪ নং অনুবাক)
সায়ণ ভাষ্য - " যো রুদ্রঃ পার্বতীপতিঃ পুরাণেষু প্রসিদ্ধঃ স এব সর্বো জীবরুপেন সর্বশরীরেষু প্রবিষ্টত্বাৎ | তস্মৈ সর্বাত্মকায় রুদ্রায় নমো অস্তু |........যজ্জড়ং বিশ্বমস্তি যচ্চ ভূতং চেতনং প্রাণিজাতমস্তীতি চেতনাচেতনরুপেন বিচিত্রং যদ্ভুবনং জগৎ, ....সর্বোহপি প্রপঞ্চ এষ রুদ্রো হি |.... তদৃশায় সর্বাত্মকায় রুদ্রায় নমস্কারো অস্তু | "
ভাষ্যানুবাদ - যে রুদ্রদেব পুরাণে পার্বতীপতি হিসেবে উক্ত হয়েছেন ( অর্থাৎ সদাশিব অর্থে) তিনিই জীবাত্মা রূপে অর্থাৎ প্রত্যগাত্মা রূপে সকল জীবের শরীরে প্রবিষ্ট হয়ে রয়েছেন। সেই সর্বাত্মক রুদ্রকে নমস্কার জানাই, যার থেকে জড় জগৎ, ভূত, চেতন, অচেতন, ভুবন , প্রাণী সকলই জাত হয়েছে। সমগ্র বিশ্ব প্রপঞ্চ সেই এক রুদ্র স্বরূপই বটে। সেইরূপ সর্বাত্মক রুদ্রকে নমস্কার জানাই।
অর্থাৎ এর থেকে বিষয়টি স্পষ্ট যে, যিনি জগত স্বরূপে প্রকাশিত, বৃহৎ থেকেও বৃহৎ এবং যিনি সর্বব্যাপী হয়ে প্রপঞ্চ রূপে বদলে যায় সেই “পরং ব্রহ্ম” বস্তু এক অদ্বিতীয় শিবই বটে।
🔵নারায়ণ”একটি নাম, একটি তত্ত্ব এবং একটি বিতর্ক।
প্রচলিত ধারণায়, “নারায়ণ”নামটি প্রায়শই বিষ্ণুর সঙ্গে যুক্ত। বহু বৈষ্ণব পণ্ডিত ও ভক্তরা দাবি করেন, এই নামটি শুধুমাত্র বিষ্ণুকেই বোঝায়। অথচ বৈদিক ও পুরাণীয় সাহিত্যে “নারায়ণ” শব্দটি শুধুমাত্র বিষ্ণুর নয়, বরং ব্রহ্মা, রুদ্র, এমনকি সর্বব্যাপী পরশিবের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে।
👉পাণিনিসূত্র ও ব্যাকরণিক প্রেক্ষাপট
পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে একটি বিখ্যাত সূত্র আছে —
পূর্বপদাৎ সংজ্ঞায়ামগঃ ॥ ৮.৪.৩ ॥
👉এটির ব্যাখ্যায় ভট্টোজি দীক্ষিত বলেন—
সমস্তপদে যদি প্রথম অংশে ‘র’ বা ষ’ থাকে, এবং তা যদি কোনো নামের (সংজ্ঞা) অংশ হয়, তবে দ্বিতীয় অংশে উপস্থিত 'ন' অক্ষর 'ণ' হয়ে যায় (ণত্ব প্রাপ্ত হয়), যদি মাঝখানে গ-কার না থাকে।
এর বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায় ‘শূর্পনখা’, ‘বার্ধীণসঃ’ ইত্যাদিতে। এগুলো proper noun না হয়েও, শুধুমাত্র নাম (সংজ্ঞা) হওয়ায় ণত্ব লাভ করেছে।
তাহলে এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি—
Proper noun না হলেও কোনো “name” যদি সমাস হয়, এবং রেফ বা ষ থাকে প্রথম পদে, তবে ণত্ব ঘটে,
অর্থাৎ নারায়ণ শব্দে ন > ণ হওয়াটা একেবারে নিয়মসিদ্ধ৷ অতএব, যারা বলেন "নারায়ণ" শব্দে "ণ" থাকার মানে এটি proper noun (Vishnu) তারা ভুল ব্যাখ্যা করছেন।
🔵সব শব্দই পরমেশ্বর শিবের প্রকাশ—
শব্দ, নাম, রূপ — সবই পরম শিবের বিকাশিত শক্তি (শব্দশক্তি/শক্তি-তত্ত্ব)।
“নাম” মানেই কোন সত্তার বৈশিষ্ট্য প্রকাশ।
যেহেতু শিব সকল বৈশিষ্ট্যের আধার, তাই সব নামই শিবকে প্রকাশ করে।
তাই শ্রুতিতে ‘নারায়ণ’ নাম দ্বারা প্রতিপাদ্য বস্তু এক পরশিবই।
🔵ব্যাখ্যা—
‘নার’ + ‘আয়ন’ – শৈব দৃষ্টিতে অর্থ
‘নারায়ণ’ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে পাই
‘নার’ = জীব/জল/সত্তা
‘আয়ন’ = আশ্রয়, গতি, গমনস্থান
অর্থ— “যার মধ্যে সমস্ত ‘নার’ (জীবসত্তা/জ্ঞান/জল) আশ্রয় নেয়” — তিনিই নারায়ণ।
এই প্রসঙ্গে শাস্ত্রে বলেছে—
"নরাণামানং যম্মাতেন নারায়ণঃ স্মৃতঃ।।"
[ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ/প্রক্রিয়াপাদ/অধ্যায় ৫/৩৬]
নরগণের একমাত্র গতি/আশ্রয় বলেই পরমাত্মাকে নারায়ণ বলে।।
🔵এই সংজ্ঞা শিবের সাথেই মিল খায়, কেননা —
১. শিব সর্বব্যাপী—
"সর্বব্যাপী স ভগবান্ তস্মাৎ সর্বগতঃ শিবঃ"
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/শ্বেতাঃ উঃ/৩/১১]
অর্থাৎ সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিবই সর্বব্যাপী।
এ প্রসঙ্গে ঋগবেদে বলা আছে —
সর্বস্থিতং সর্বগতং সর্বপব্যাপ্তং তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্প মস্তু।।
[ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২২ এবং ঋগ্বেদ খিলভাগ/৪/২২]
২. শিব সব কিছুর গতি ও গন্তব্য —
তস্মাদহং রুদ্রো যঃ সর্বেষাং পরমা গতিঃ।।৮।।
[ভস্মজাবাল উপনিষদ/২/৮]
এই (সংসারের বন্ধন থেকে উৎপন্ন হওয়া দুঃখ থেকে মুক্ত করবার) কারণেই আমিই হলাম রুদ্র যে রুদ্র সকলের পরম গতি ও গন্তব্য ॥ ৮ ॥
এবং শ্রুতিতে আরও বলা আছে—
সর্ব্বতঃ পাণিপাদং তৎ সর্বতোহক্ষিশিরোমুখম্।
সর্ব্বতঃ শ্রুতিম শ্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি ॥ ১৬
সর্ব্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং সর্ব্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্।
সর্বস্য প্রভুমীশানং সর্বস্থ্য শরণং সুহৃৎ ॥ ১৭
[শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৩ অধ্যায়/১৬-১৭ নং মন্ত্র]
পরমেশ্বর ঈশান শিবের সর্বত্র পাণিপাদ, সর্বত্র চক্ষুঃ শির ও মুখ, সর্বত্র শ্রবণ, এবং তিনি সংসারে সকলকেই ব্যাপিয়া অবস্থিতি করিতেছেন।।।১৬।।
পরমেশ্বর ঈশান শিবের শরীর অপ্রাকৃত, অতএব উহার প্রত্যেক অবয়বে সকল ইন্দ্রিয়ের ধর্মই প্রকাশ পেয়ে থাকে। তাঁর প্রাকৃত কোন ইন্দ্রিয়ই নাই। তিনি সকলের প্রভু ও নিয়ন্তা; তিনি সকলের সুহৃৎ ও আশ্রয়।।১৭॥
শ্রুতিতে বলা আছে— "সর্বে বৈ রুদ্রঃ" [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/২৪/১] ইত্যাদি শ্রুতি বাক্য দ্বারা এটা জানা যায়, সর্ব কিছুই রুদ্র দ্বারা পরিচালিত।
তাই নারায়ণ বলতে, পরম শিবই।
নারায়ণ একটি গুণবাচক, অবস্থাবাচক, ও দর্শনবাচক শব্দ। এর অর্থ শুধুমাত্র “বিষ্ণু” দেবতা নয়, বরং সেই সর্বসত্তার আশ্রয়, যিনি সকল নরের গন্তব্য। শ্রুতি ও স্মৃতি শাস্ত্র সমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শিবই সেই চূড়ান্ত আশ্রয়, চূড়ান্ত গতি, ও সর্বজ্ঞ সর্বব্যাপী সত্তা।
অতএব —
নারায়ণ বলতে বোঝানো হয় পরমেশ্বর শিবকেই, যিনি রুদ্র রূপে জীবের সমস্ত গতি, গন্তব্য ও শরণ।
🔵ঋগ্বেদের শিবসঙ্কল্পসূক্তে ‘নারায়ণ’ নামের ব্যবহার
ঋগ্বেদের শিবসঙ্কল্প সূক্ত —
ॐকারং চতুর্ভুজং লোকনাথং নারায়ণম্।
সর্বস্থিতং সর্বগতং সর্বপব্যাপ্তং তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্প মস্তু ॥ ২২
[ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২২ এবং ঋগ্বেদ খিলভাগ/৪/২২]
এই মন্ত্রে ‘নারায়ণ’ নামটি শিবসঙ্কল্পের (অর্থাৎ শিব-ইচ্ছার) অংশ হিসেবে প্রার্থনা করা হয়েছে।
এর দ্বারা বোঝা যায়—
ঋগ্বেদের মতো প্রাচীন স্তোত্রেও ‘নারায়ণ’ নামটি শিবের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।
এটি শৈব দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রমাণ, যা বলে, শব্দটি যাকে নির্দেশ করে তা প্রেক্ষাপটভিত্তিক।
🔵 পুরাণসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি —
লিঙ্গ পুরাণ (১/১৮/২৫)—
“সর্বায় চ নমস্তুভ্যং নমো নারায়ণায় চ ।”
শিবের উদ্দেশে প্রার্থনা করে বলা হচ্ছে, তোমাকেই নারায়ণ বলা হচ্ছে।
কূর্ম পুরাণ (১/৬/৩) ও বিষ্ণু পুরাণ (১/৩/৪)—
"ब्रह्मा नारायणाख्यस्तु सुष्वाप सलिले तदा"।
“नारायणाख्यो भगवान् ब्रह्मा लोकपितामहः।”
ব্রহ্মাকেও নারায়ণ নামে সম্বোধন করা হচ্ছে।
অর্থাৎ শাস্ত্র বলছে, নারায়ণ নামটি কেবল বিষ্ণুর ‘ব্যক্তি’ নয়, বরং একটি ‘তত্ত্ব’ যে তত্ত্ব শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, সকলেই ধারণ করতে পারেন।
🔵শৈবাগমে ও কাশ্মীর শৈব দর্শনে বলা হয়—
শব্দ (nāma) ও রূপ (rūpa) সবই পরম শিবের বিকাশ
বহু মুখে শিব বিভিন্ন ধর্ম, মূর্তি, নাম, অথচ এক সত্তা
সুতরাং “নারায়ণ” নাম শিবের মুখেও প্রকাশ পেতে পারে।
শিবসূত্র (১.১)—
“চৈতন্যমাত্মা” চৈতন্যই আত্মা
এই চৈতন্য, এই সর্বব্যাপী আত্মা শিব।
আর ‘নারায়ণ’ শব্দেও এই সর্বচৈতন্যের আশ্রয় ভাবনা প্রকাশ পায়।
🔵‘নারায়ণ’ নাম কেবল proper noun বা বিষ্ণুর ব্যক্তিনির্দেশ নয়। এটি এক সর্বব্যাপক পরশিবেরই তত্ত্ব, যা বিভিন্ন উপাসনায় নানা রূপে ব্যবহৃত। ব্যাকরণ ও অর্থভেদ অনুসারে, এই নাম শিবের জন্য প্রযোজ্য। শাস্ত্রতে তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। শৈব দর্শন বলে সব নাম, সব রূপ, সব শব্দ শেষ পর্যন্ত শিবেরই প্রকাশ।
🔵শাস্ত্রে বলা হয়েছে—
আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র (৪/৯/২৭) বলছে—
"সর্বাণি হ বা অস্য নামধেয়ানি"
সব নামই রুদ্রের।।
এই প্রসঙ্গে শ্রুতিতে পরমেশ্বর শিব বলছেন—
সোঽহং সর্বাকারঃ ॥ ৮
[ভস্মজাবাল উপনিষদ/২/৮]
সেই আমিই সকল রূপের আকারের ধারক ॥ ৮ ॥
অর্থাৎ, পরমতত্ত্ব পরশিবের সব নামই এক চেতনার বিভিন্ন রূপ, যার কেন্দ্রে রয়েছেন রুদ্র। কেননা, জগতের যত নাম ও রূপ তা বস্তুত রুদ্রেরই, কারণ রুদ্র'ই সর্বব্যাপী।
যেমন—
‘সূর্য’ মানে কেবল আকাশের রোদ নয়, সে ঈশ্বররূপেও পূজিত হন।
‘গঙ্গা’ শুধু নদীর নাম নয়, সে এক দেবী।
তেমনই—
‘নারায়ণ’ কেবল বিষ্ণুর নাম নয় —
এটি শিব, ব্রহ্মা ও সর্বজনের আশ্রয়রূপ এক পরম সত্যের বহুবচন। সেই পরম সত্য এক পরশিবই।
🔵তাই সিদ্ধান্ত হলো—
ব্যাকরণে যেভাবে বলা হয়েছে, সেইমতো ‘নারায়ণ’ শব্দে ‘ণ’ আসা স্বাভাবিক।
এই শব্দ কোনো একক দেবতার একচেটিয়া নাম নয়।
ধর্ম, দর্শন ও ভাষা এই তিনের মিলেই ‘নারায়ণ’ শব্দের পূর্ণতা। তাই সকলদিক বিবেচনা করে এটাই জানা যায় যে, শ্রুতিতে 'নারায়ণ' বলতে সেই এক সর্বব্যাপী পরমেশ্বর পরশিবই।
🔴এখানে বৈষ্ণবদের ব্যাকরণের অনেক অসঙ্গতি রয়েছে—
১. উদাহরণগুলোকে ভুলভাবে রূঢ়ি হিসেবে ব্যাখ্যা করা—
লেখায় বলা হয়েছে “বার্ধীণসঃ”, “শূর্পণখা” প্রভৃতি উদাহরণে রূঢ়ি (proper noun) হিসেবে ণত্ব হয়েছে।
অসঙ্গতি—
এগুলি descriptive/সমাসিক সংজ্ঞা, যা কোনো ব্যক্তিবিশেষ বোঝায় না।
বার্ধীণসঃ = "যে বার্ধিন নদীর নিকটে থাকে বা সেখানকার গন্ডার" এটি জেনেরিক শ্রেণীনাম।
শূর্পণখা = চালনি-সদৃশ নখবিশিষ্ট এক নারী একটি সাধারণ বর্ণনা, রূঢ়ি নয়।
সুতরাং, এই উদাহরণগুলির মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে সংজ্ঞা ≠ Proper Noun, বরং এটি common noun এর মধ্যেও ঘটে।
২. (৮.৪.১) ও (৮.৪.৩) সূত্রদ্বয়ের প্রয়োগ বিভ্রান্তিকরভাবে উপস্থাপন—
বৈষ্ণবদের দাবী— "যেহেতু 'র' থাকার পরে 'ন' নিজেই 'ণ' হয়, তাই এই সূত্রই যথেষ্ট ৮.৪.৩ এর প্রয়োজন রূঢ়ি বোঝাতে।"
অসঙ্গতি—
৮.৪.১ (রষাভ্যাং নো ণঃ সমান পদে) কেবল একপদে (compound নয়) প্রযোজ্য।
৮.৪.৩ কেবল সমাসপদে প্রযোজ্য (পূর্বপদাত্ কথাটিই সেই প্রমাণ)।
তাই অভ্যন্তরীণ ণত্ব (৮.৪.১) ও সমাসজনিত ণত্ব (৮.৪.৩) এদের গুলিয়ে ফেলা পাণিনীয় ভুল।
৩. শাস্ত্রীয় তথ্য অগ্রাহ্য করা হয়েছে—
বহু পুরাণ, উপনিষদ, ব্রাহ্মণ গ্রন্থ, স্মৃতি প্রভৃতি গ্রন্থে ‘নারায়ণ’ শব্দটি ব্রহ্মা, রুদ্র প্রভৃতির জন্য ব্যবহার হয়েছে এর কোনো উল্লেখ নেই বৈষ্ণবদের দাবীতে। এই তথ্যগুলির প্রমাণ গুলি কে এড়িয়ে চেপে গিয়ে কেবল রূঢ়ি অর্থে নারায়ণ = বিষ্ণু ধরে নেওয়া হয়েছে যা একপাক্ষিক, শাস্ত্রবিরুদ্ধ।
৪. ব্যুৎপত্তিগত দৃষ্টিকোণ উপেক্ষিত—
বৈষ্ণবদের লেখায় ‘নারায়ণ’ শব্দের ব্যুৎপত্তি (নর + অয়ন, জল+আয়ন, যা ultimate refuge) সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত। ব্যুৎপত্তি অনুসারে বিভিন্ন প্রয়োগ (বিষ্ণু, রুদ্র, ব্রহ্মা) স্বাভাবিক, তা উপেক্ষা করা একধরনের শাস্ত্রের সংকোচন।
৫. সিদ্ধান্তে রূঢ়ি-তর্কের মাধ্যমে শাস্ত্রাক্রম অমান্য করা হয়েছে—
পাণিনি ও অন্যান্য ব্যাকরণাচার্য কখনোই বলেননি যে কোনো একটি শব্দের অর্থ যদি রূঢ়ি হয়, তবে অন্য প্রয়োগ অবৈধ হয়ে যায়।
পাণিনির পরিভাষা, নিঘণ্টু, ব্রাহ্মণ গ্রন্থ, উপনিষদ ইত্যাদি সবই শব্দবহুবিধ অর্থের প্রয়োগ মেনে নেয়।
অথচ বৈষ্ণবদের দাবী একেবারে কঠোরভাবে "একমাত্র অর্থই বৈধ" এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চায় যা শব্দশাস্ত্রসম্মত নয়।
এসব অসঙ্গতিপূর্ণ দাবী গুলোর সঠিক ব্যাখ্যা নেই বৈষ্ণবদের কাছে। একচেটিয়া ভাবে বৈদিক শাস্ত্রে উল্লেখিত নারায়ণ পদকে কেবল পৌরাণিক বিষ্ণু মেনেই অহেতুক তর্ক করছে।
🔴বৈষ্ণবদের মিথ্যাচারের মধ্যে আরেকটি অন্যতম হলো— ‘নারায়ণ’ শব্দটি “সংজ্ঞা”, অর্থাৎ রূঢ়ি নাম (Proper Noun), তাই ‘ণ’ হয়েছে। যার জন্য পাণিনীয় ৮/৪/৫ নং সূত্র উদ্ধৃত দেয়।
🔵কিন্তু, সূত্রের সঠিক ভাবার্থ হলো—
প্র-নি-রন্তঃ-শর-ইক্ষু-প্লক্ষ-আম্র-কার্ষ্য-খদির-পীযূক্ষাভ্যোऽসংজ্ঞায়াম্ অপি।
[অষ্টাধ্যায়ী ৮/৪/৫]
সূত্রের ব্যাখ্যা—
এই সূত্রে পাণিনি বলছেন—
যদি ‘বন’ শব্দের পূর্বে ইক্ষু, আম্র, খদির, ইত্যাদি শব্দ থাকে, তাহলে 'ন' → 'ণ' হবে সংজ্ঞা অর্থে হোক বা না হোক, অর্থাৎ সংজ্ঞায়াম্ অপি “নামবাচক নয় এমন ক্ষেত্রেও।”
🔵উদাহরণে প্রমাণ—
ইক্ষুবণম্ = আখের বন (নির্দিষ্ট নামবাচক — সংজ্ঞা) ণ হয়েছে।
প্রবণম্ = প্রবণতা/ঝোঁক (গুণ বা ভাব — অসংজ্ঞা) এখানেও ণ হয়েছে।
এখান থেকে বোঝা যায় —
ণত্ব হওয়ার জন্য “সংজ্ঞা” হওয়া আবশ্যক নয়।
আরও স্পষ্টভাবে বললে, সংজ্ঞা ≠ সমস্ত অর্থবোধক শব্দ।
🔵নারায়ণ শব্দ প্রসঙ্গে প্রয়োগ—
বৈষ্ণব পক্ষ থেকে দাবি করা হয়—
‘নারায়ণ’ শব্দটি “সংজ্ঞা”, অর্থাৎ রূঢ়ি নাম (Proper Noun), তাই ‘ণ’ হয়েছে।
কিন্তু পাণিনির ৮.৪.৫ সূত্র থেকে প্রমাণিত পৃথকভাবে ‘সংজ্ঞা’ ও ‘অসংজ্ঞা’ বলে কিছু আছে, আর সংজ্ঞা মানেই রূঢ়ি নয়, কারণ না হলে পাণিনিকে “অসংজ্ঞায়াম্ অপি” বলার প্রয়োজনই পড়ত না।
অতএব, ‘নারায়ণ’ শব্দে ণত্ব ঘটেছে মানেই এটি রূঢ়ি (proper noun) এই ধারণা ভুল ব্যাকরণিক সিদ্ধান্ত।
পাণিনির নিজস্ব ভাষায়ই (৮.৪.৫ সূত্রে) পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে যে, “সংজ্ঞা” ও “অসংজ্ঞা” আলাদা ব্যাকরণিক শ্রেণি, এবং কোনো শব্দে ণত্ব ঘটেছে মানেই সেটা proper noun এমন রূঢ় ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।
সুতরাং, ‘নারায়ণ’ শব্দে ণত্ব ঘটেছে দেখে তাকে অবশ্যই রূঢ়ি নাম বলে ধরা যাবে না, বরং এর পেছনে গুণবাচক বা ব্যুৎপত্তিগত অর্থই মূল বিবেচ্য যা শিবসহ সমস্ত সর্বব্যাপক ব্রহ্মতত্ত্বের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
——————————————————————————————————————————
🟢বৈষ্ণবদের ব্যাকরণের অপদাবীর খণ্ডন করা যাক এবার—
🔴 বৈষ্ণব দাবী—
“৮/৪/৩ সূত্রে ‘সমানপদ’ মানে proper noun। তাই কেবল সংজ্ঞাবাচক নামবিশেষ (proper noun) পদের মধ্যেই ণত্ব হয়, সাধারণ পদের মধ্যে নয়।”
✅ শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন ভাষ্যভিত্তিক অসঙ্গতি উন্মোচন—
🔴অসঙ্গতি— সূত্রে ‘সংজ্ঞা’ শব্দ নেই, অথচ বৈষ্ণবরা বলছে “সমানপদ = সংজ্ঞা = proper noun”।
ভাষ্যকাররা বলেন—
🔵কাশিকা (৮/৪/৩)—
“समाने पदे इति किम्? र न पुङ्गवः, न भवति। एषु हि रषनकाराः भिन्नपदवर्ती। चरन्यः, भवति।”
এখানে কাশিকা “সমানপদ” শব্দের মানে করেন, একই পদের মধ্যে র/ষ ও ন থাকা।
কোথাও সংজ্ঞা বা proper noun বলা হয়নি।
উদাহরণ—
“র-ন-পুংগবঃ” – পৃথক পদে র ও ন থাকলে ণ-ত্ব হয় না।
“চরণ্যঃ” একপদে র ও ন থাকলে ণ-ত্ব হয়।
অতএব, “সমানপদ = proper noun” বলাটা ভাষ্যবিরোধী।
🔴অসঙ্গতি— সমানপদ মানেই যদি সংজ্ঞা হয়, তবে যে সকল শব্দ সংজ্ঞা নয়, সেগুলিতে ণত্ব হওয়া উচিত নয়।
কিন্তু, বহু অসংজ্ঞা পদেও ণত্ব হয়।
🔵সিদ্ধান্তকৌমুদীর উদাহরণ—
“চরণ্যঃ”, “বর্ণ”, “সুবর্ণ”, “বিষ্ণু” এদের অনেকগুলোই সংজ্ঞা নয়, সাধারণ বিশেষ্য।
🔵ন্যাস বলে—
“সামান্যপদত্বং তু সংজ্ঞাবাচকতা নহি”
অর্থাৎ, সমানপদ মানে সংজ্ঞাবাচকতা নয়।
🔵পদমঞ্জরী ব্যাখ্যা দেয়—
“পদসংজ্ঞায় মান্যমান সমাসেও ণত্ব হয়, সংজ্ঞা হওয়া জরুরি নয়।”
অতএব, সংজ্ঞা না হয়েও যদি ণত্ব হয়, তাহলে সমানপদ মানেই proper noun এই দাবি মিথ্যা।
🔴অসঙ্গতি— সমানপদ শব্দগুচ্ছটি ব্যাকরণিক অবস্থা বোঝায়, কিন্তু বৈষ্ণবরা এটিকে দৃষ্টান্ত (proper noun) বানিয়ে নিচ্ছে।
🔵কাশিকা ও ন্যাস বারবার বলেন —
“সমানপদ” অর্থাৎ “একই পদের মধ্যে র/ষ এবং ন থাকলে” তবেই ণত্ব হবে।
“সুবর্ণ”, “চরণ্যঃ”, “পদ্বর্ণ”, “সত্করণম্”, “স্মরণম্” এগুলোতে নামবাচকতা নেই, তবুও ণত্ব হয়।
অতএব, সমানপদ মানে proper noun এই দাবি আপাদমস্তক ভুল।
🔵S.C. Vasu নিজে proper noun তত্ত্ব খণ্ডন করেন, অথচ বৈষ্ণবপক্ষ তাঁর টীকাই খণ্ডন না করেই দাবী করছে সমানপদ মানে নামবিশেষ।
🔵S.C. Vasu (on 8.4.3)—
“Same word” is the key. The substitution of ण् takes place when र/ष and न are within the same word.
No mention of it being a proper noun.
উদাহরণ—
“Suvarna” not a name, still gets ‘ṇ’.
তাঁর ভাষ্যেই স্পষ্ট proper noun না হলেও সমানপদ হলেই ণত্ব হয়।
🔵পদমঞ্জরী স্পষ্ট বলে — সংজ্ঞা ≠ proper noun।
পদমঞ্জরীর ভাষ্য—
“সমানপদ মানে, সমাসপদ, যেখানে শাস্ত্রোক্ত পদসংজ্ঞা আছে, তা সংজ্ঞাবাচক নাম না হলেও চলে।”
অর্থাৎ, সমানপদ = ব্যাকরণিক পদ (grammatical word unit)
সংজ্ঞা = শাস্ত্রবদ্ধ পদসংজ্ঞা, কিন্তু সংজ্ঞা মানে নামবিশেষ নয়।
অতএব, বৈষ্ণবপক্ষের সংজ্ঞা = নামবিশেষ তত্ত্ব শব্দত, শাস্ত্রত ও ভাষ্যত ভুল।
সমানপদ মানে ব্যাকরণিক একক পদ যার মধ্যে র/ষ ও ন থাকে। সংজ্ঞা মানে শাস্ত্রসম্মত শ্রেণিবিভাগ, নামবিশেষ নয়। ভাষ্যসমূহ এই ব্যাখ্যাই প্রতিষ্ঠা করে।
——————————————————————————————————————————
🔴বৈষ্ণবদের যে দাবিটি করেছেন —
“৮/৪/৪ বা ৮/৪/৫ সূত্রে ‘সংজ্ঞা’ মানে কেবল proper noun (সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য); তাই শৈবদের পক্ষের মত যে ‘সংজ্ঞা’ বলতে সাধারণ বিশেষ্যও বোঝে, তা ভুল।”
🔴 বৈষ্ণব দাবি—
“৮/৪/৪-এ সংজ্ঞা শব্দ মানে শুধুই proper noun বা নামবিশেষ (সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য)। তাই পুরগাবণম্, মিশ্রকাবণম্ এগুলো যেহেতু নির্দিষ্ট গাছের নাম, তাই ণ-ত্ব হয়েছে। সংজ্ঞা মানে সাধারণ বিশেষ্য নয়।”
✅ শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন—
🔵পাণিনীয় টীকা ও ভাষ্য অনুযায়ী—
🔵S.C. Vasu এর টীকা (৮/৪/৪)—
“The ‘न’ of ‘वन’ is replaced by ‘ण’… when the whole compound is a name. The substitution of ‘ण’… would have taken place by the preceding rule. The separate enunciation of this rule with regard to the word ‘वन’ shows this is a restrictive or नियम rule… Though ‘अग्रेवणम्’ is not a Name, yet the rule applies…”
“বন” শব্দের 'ন' → 'ণ' হয়, যদি উপপদসমূহ (পুরগা, মিশ্রকা ইত্যাদি) তার আগে থাকে এবং যদি সমগ্র পদটি সংজ্ঞা হয়।
তবে “অগ্রেবণম্” কোনো proper noun বা নামবিশেষ নয়, তবুও এখানে ণ-ত্ব হয়েছে। এই সূত্রটি বিশেষভাবে (restrictively) বন শব্দের জন্য প্রযোজ্য করা হয়েছে।
S.C. Vasu নিজেই বলেন অগ্রেবণম্ সংজ্ঞাবাচক নয়, তবুও ণ-ত্ব বিধি প্রযোজ্য।
অতএব, সংজ্ঞা ≠ proper noun, বরং এটি একটি ব্যাকরণিক শ্রেণি।
🔵কাশিকা ভাষ্য—
“সংজ্ঞায়াম্ বিষয়েই ণ-ত্ব হয়… সিদ্ধ হলে এটি একটি নিয়মমূলক সূত্র… অন্য শব্দে ণ-ত্ব হবে না…
উদাহরণ—পুরগাবণম্, মিশ্রকাবণম্, কোটরাবণম্, অগ্রেবণম্ কিন্তু, কুবেরবনম্, শতধারবনম্ এদের মধ্যে ণ-ত্ব হয় না।”
‘সিদ্ধে সতি’ মানে- পূর্ব সূত্রে (৮/৪/৩) ণত্ব অনুমেয় হলেও, এখানে বিধি পৃথকভাবে দেওয়া হয়েছে নিয়ম রূপে।
“অগ্রেবণম্” কোনো proper noun নয়। তবুও কাশিকা তা উদাহরণ হিসেবে রেখেছেন।
“সংজ্ঞা” শব্দটি এখানে কোনো নামবিশেষ বোঝায় এমন বলা হয়নি। অসংজ্ঞা পদেও এই ণ-ত্ব প্রযোজ্য হয়, যদি তা ব্যাকরণীয়ভাবে প্রযোজ্য হয়।
🔵সিদ্ধান্তকৌমুদী—
“বন শব্দের পরবর্তী পদ যদি পুরগা, মিশ্রকা ইত্যাদি হয়, তাহলে শুধুমাত্র এই গুচ্ছে (এভ্যঃ) ‘ণ’ হয়; অন্য পদে হয় না। কোটরান্ত ইত্যাদি পদে যখন দীঘ (দীর্ঘস্বর) হয়, তখনই এই বিধি কার্যকর। ‘অগ্রে’ শব্দটি though proper noun নয়, তবুও বিধি দ্বারা হয়।”
সিদ্ধান্তকৌমুদী স্পষ্ট বলে—
“অগ্রে” শব্দটি সংজ্ঞা নয়, তবুও বিধি দ্বারা ণ-ত্ব হয়।
‘এভ্যঃ’ (এইগুলির পরেই মাত্র) এটি একটি নিয়মবাচক সীমা (restrictive rule)। সংজ্ঞায়াম্ মানে সব সময় proper noun নয়। কৌমুদী নিজেই ব্যতিক্রম দেখান।
🔵ন্যাস—
“অগ্রেবণম্ উদাহরণটি ষষ্ঠী সমাস, কিন্তু ‘অগ্রে’ কোনো সংজ্ঞা নয়। তবুও ণত্ব হয়েছে। ‘সংজ্ঞা’ না হলেও বিধি চলছে এর মানে হল, সংজ্ঞা মানে proper noun নয়। বরং যেখানে দীর্ঘস্বর হয়, সেখানে ণ-ত্ব হয়।”
ন্যাস জানায়— সংজ্ঞা না হলেও, ণত্ব প্রযোজ্য হয়, যদি দীর্ঘ হয়।
অর্থাৎ সংজ্ঞা বলতে কোনো ব্যক্তিনাম নয়, বরং একটি ধ্বনিগত বা ব্যাকরণিক ধারা।
সংজ্ঞা ≠ proper noun।
সংজ্ঞা মানে ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্যবিশিষ্ট সমাস, যা কখনো proper noun, কখনো নয়।
🔵পদমঞ্জরী—
“‘অগ্রে’ সংজ্ঞা নয়। তবুও ‘অগ্রেবণম্’ ণ-ত্ব পেয়েছে বিধির জন্য। যদি সংজ্ঞা মানে কেবল proper noun হয়, তাহলে এই উদাহরণগুলো চলতো না। সংজ্ঞা না হয়েও যখন ণ-ত্ব হয় তখন স্পষ্ট হয়, সংজ্ঞা মানে নামবিশেষ নয়।”
পদমঞ্জরী স্পষ্টভাবে বিভাজন করেছে—
সংজ্ঞা ≠ proper noun। ‘অগ্রে’ শব্দের পূর্বপদ দীর্ঘ হলেও, সেটি সংজ্ঞা নয়। তবুও নিয়মবলে ণত্ব হয়েছে। পদমঞ্জরী দ্বারা নিশ্চিত হয়, সংজ্ঞা মানে ব্যাকরণিক শ্রেণি, নাম নয়।
✅সিদ্ধান্ত—
পাণিনীয় ব্যাকরণে “সংজ্ঞা” বলতে বোঝানো হয় এমন শব্দ যা শাস্ত্র দ্বারা সংজ্ঞায়িত বা শ্রেণিভুক্ত, কিন্তু তা সব সময় proper noun নয়।
“অসংজ্ঞা” মানে যা কোনো নির্দিষ্ট শাস্ত্রীয় সংজ্ঞাভুক্ত নয়। কিন্তু তা এখনও বিশেষ্য, যেমন ভাববাচক, গুণবাচক শব্দ।
অতএব, বৈষ্ণবদের এই যুক্তি “সংজ্ঞা মানে কেবল proper noun, তাই সংজ্ঞায়াম্ পদে সাধারণ বিশেষ্য চলে না” এটি ভ্রান্ত, কারণ—
S.C. Vasu নিজে বলেন ‘অগ্রেবণম্’ নাম নয়, তবুও ণ-ত্ব হয়।
কাশিকা, ন্যাস, কৌমুদী, পদমঞ্জরী সকলেই ‘অগ্রে’ ইত্যাদি non-name পদেও ণ-ত্ব গ্রহণযোগ্য বলেছেন।
অতএব, শৈব ব্যাখ্যাটি সংজ্ঞা মানে proper noun নয়, বরং ব্যাকরণিক শ্রেণি, এই দাবিই যথার্থ ও ভাষ্যসমর্থিত।
——————————————————————————————————————————
🚫 বৈষ্ণবদের দাবী—
"৮/৪/৫ নং পাণিনি সূত্রে ‘সংজ্ঞা’ ও ‘অসংজ্ঞা’ এই দুইয়ের সকল উদাহরণই ‘বিশেষ্য’ পদ। সুতরাং ‘সংজ্ঞা’ মানেই নামবিশেষ (proper noun), আর ‘অসংজ্ঞা’ মানে এমন কিছু যা নাম নয়। শৈবরা যদি বলেন যে ‘সংজ্ঞা’ মানে proper noun নয়, তাহলে ‘অসংজ্ঞা’ দ্বারা আর কী বোঝানো হচ্ছে? তারা কি নতুন কোনো বিশেষ্য আবিষ্কার করতে চলেছে?"
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন —
🔵পাণিনি সূত্র—
"প্র-নি-রন্তঃ-শর-ইক্ষু-প্লক্ষ-আম্র-কার্ষ্য-খদির-পীযূক্ষাভ্যোঽসংজ্ঞায়াম্ অপি"
(৮/৪/৫)
এটি একটি ণত্ব-প্রত্যয়বিধি, যেখানে বলা হয়েছে—
যদি “বন” শব্দের পূর্বে এই দশটি উপপদ থাকে, তবে 'ন' এর পরিবর্তে 'ণ' হবে। সংজ্ঞা ও অসংজ্ঞা, উভয় ক্ষেত্রেই এই বিধান প্রযোজ্য।
🔵এস.সি. বাসু এর ভাষ্য—
"বন শব্দের ন-ধ্বনি, নামবিশেষ না হলেও, এই উপপদের পরে আসলে ‘ণ’ হয়ে যায়। যেমন: প্রবণে, নির্বণে ইত্যাদি।"
অর্থাৎ, এস.সি. বাসু সরাসরি বলেছেন, এই সূত্রে ‘সংজ্ঞা’ মানেই proper noun নয়, এবং ‘অসংজ্ঞা’ মানেও নামবর্জিত কিছু নয় বরং বাক্যপ্রয়োগভেদে এর তাৎপর্য নির্ধারিত হয়।
অতএব, “সংজ্ঞা = proper noun”এই বৈষ্ণব দাবিটি এখানেই ভেঙে পড়ে।
🔵কাশিকা ভাষ্য—
"সংজ্ঞায়াম্ অসংজ্ঞায়াম্ অপি ণ-কারাদেশঃ ভবতি।"
উদাহরণ—
প্রবণম্, নির্বণম্, অন্তর্বণম্, শরবণম্, ইক্ষুবণম্…
প্রবণম্, নির্বণম্: এগুলো ভাববাচক / গুণবাচক বিশেষ্য, কোনো নাম নয়।
শরবণম্, ইক্ষুবণম্: এগুলো নামবিশেষ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, যেমন কোনো বিশেষ বন।
অর্থাৎ, সংজ্ঞা মানে এখানে proper noun নয়, বরং প্রসঙ্গভিত্তিক স্বীকৃত নামধারক শব্দ, এবং অসংজ্ঞা মানে সাধারণ গুণ/ভাব/বস্তুবাচক বিশেষ্য যেগুলোও বিশেষ্য, কিন্তু কোনো "সংজ্ঞা" নয়।
🔵সিদ্ধান্তকৌমুদী —
"এভ্যো বনস্য ণত্বং স্যাত্। প্রবণম্, কার্ষ্যবণম্। ইহ ষাট্-পরত্বাত্ ণত্বম্।"
অর্থ— এখানে ‘ষষ্ঠী সমাস’ হলেই, সংজ্ঞা হোক বা না হোক, ‘ণ’ হবে।
অতএব, কৌমুদীতে কোথাও বলা হয়নি ‘সংজ্ঞা’ মানে শুধুই proper noun।
বরং ব্যাকরণগত সমাস-প্রসঙ্গ ও শব্দের প্রয়োগভিত্তিক নিয়ম প্রাধান্য পাচ্ছে।
🔵ন্যাস—
“অত্র প্রবণম্, নির্বণম্ — অব্যয়ীভাব সমাস, সংজ্ঞা নয়।
আর শরবণম্ ইত্যাদি — ষষ্ঠী সমাস, কিছু কিছু নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।”
ন্যাস ভাষ্যে পরিষ্কার বলা হয়েছে, এখানে "সংজ্ঞা" বলতে শুধুই নাম বোঝানো হচ্ছে না। অসংজ্ঞা শব্দও বিশেষ্যই, যেমন গুণবাচক বা ভাববাচক পদ।
“সংজ্ঞা ≠ proper noun” এই সিদ্ধান্ত ন্যাস-এর ভাষ্যেই সুস্পষ্ট।
✅সিদ্ধান্ত—
“সংজ্ঞা মানেই proper noun” এই বৈষ্ণব ধারণা পুরোপুরি ভুল, পক্ষপাতদুষ্ট এবং পাণিনীয় ব্যাকরণ ও ভাষ্যসাহিত্যের বিরুদ্ধে। ‘অসংজ্ঞা’ পদও নিজে নিজেই একটি সাধারণ বিশেষ্য (noun) এটি কোনো নাম নয়, তবে তাত্ত্বিকভাবে গঠন করা যায় এমন শব্দ।
অতএব, শৈবদের ব্যাখ্যা যে “সংজ্ঞা” বলতে কেবল proper noun বোঝানো হয় না, এই ধারণাই যথার্থ ও শাস্ত্রসম্মত।
🔥চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত —
“নারায়ণ” শব্দটি কেবলমাত্র রূঢ়ি অর্থে লক্ষ্মীপতি বিষ্ণুকে বোঝায় এই দাবী পাণিনীয় ব্যাকরণ, নিরুক্ত, নিঘন্টু, উপনিষদ, পুরাণ এবং মীমাংসা কোনো শাস্ত্রীয় ভিত্তিতেই একচেটিয়া বা একমাত্র সিদ্ধান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নয়।
🔵পাণিনীয় সূত্র ৮.৪.৩ (“পূর্বপদাত্ সংজ্ঞায়ামগঃ”) ও ৮.৪.১ (“রষাভ্যাং নো ণঃ সমানপদে”) উভয়ই প্রমাণ করে যে ‘সংজ্ঞা’ শব্দের অর্থ কেবল রূঢ়ি নয়, বরং অর্থবোধক বিশেষণ বা পরিচয়বাচক শব্দও হতে পারে।
“নারায়ণ” শব্দটি নিজেই একটি ব্যুৎপত্তিনির্ভর গুণবাচক শব্দ (নর/জল + অয়ন), যা এক পরম আশ্রয় সত্তার নির্দেশ করে, এবং শ্রুতি, স্মৃতি ও পুরাণ অনুসারে তা বিষ্ণু, শিব, ব্রহ্মা সকল সত্তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
🔵নিঘন্টু (১.২.৪.৯) অনুসারে —
“এক এব রুদ্র অবস্ততে ন দ্বিতীয়" একমাত্র রূঢ় দেবতা রুদ্র (শিব), অতএব যেসব শব্দ অর্থবোধক ও বহুবিধ প্রয়োগযোগ্য (যেমন “নারায়ণ”), সেগুলি পরম রূঢ় সত্তা শিব এর ক্ষেত্রেই সর্বাধিক প্রযোজ্য।
যাস্কাচার্যের নিরুক্ত, পাণিনি, এবং মীমাংসাকারগণ কখনোই কোনো শব্দের একমাত্র রূঢ় অর্থকেই একমাত্র বৈধ বলে মানেননি। বরং গুণবাচক ও প্রসঙ্গনির্ভর অর্থবোধই সবচেয়ে শাস্ত্রসম্মত।
🔵সুতরাং, “নারায়ণ” ≠ কেবল লক্ষ্মীপতি বিষ্ণু।
বরং “নারায়ণ” শব্দটি একটি ব্যুৎপত্তিনির্ভর, গুণবাচক, বহুব্যাপ্ত পদ, যা শিব-সহ সকল সর্বেশ্বরতত্ত্বে প্রযোজ্য হলেও, শ্রুতি ও পুরাণভিত্তিক গুণনিরূপণে এটি মূলত শিবকেই বোঝায়।
🙏“সর্বে হ্যেষ রুদ্রস্তস্মৈ রুদ্রায় নমো অস্তু”🙏
নমঃ শিবায় 🙏
নমঃ শিবায়ৈ🙏
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে ✊🚩
✍️অপপ্রচার দমনে— অন্তিক ভট্টাচার্য্য (শম্বরনাথ শৈব)
🌻বিশেষ কৃতজ্ঞতা— আমার গুরু শ্রী নন্দীনাথ শৈবাচার্য ও আমার আদর্শ শ্রী রোহিত কুমার চৌধুরী শৈবজী।
কপিরাইট ও প্রচারে— আন্তর্জাতিক শিবশক্তি জ্ঞান তীর্থ (International Shiva Shakti Gyan Tirtha)
বিঃ দ্রঃ — লেখাটি অনুকরণ করলে সম্পূর্ণ করবেন, কোনো রকম কাটছাট গ্রহণযোগ্য নয়।
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ একটি কাজ করেছ অন্তিক, যেটা অনেক ডিগ্রিধারী পণ্ডিত তথা আচার্য্যরা এত বছরেও করতে পারেনি। ন্যায়, মীমাংসা তথা ব্যাকরণগত সূত্রগুলিকে কিভাবে শাস্ত্রীয় যুক্তি তর্কের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হয় সেটা দেখছি তুমি ভালোভাবেই রপ্ত করে ফেলেছ। সত্যিই তুমি ISSGT এর গর্ব। অনেকদিন পর ISSGT থেকে এমন এক রকমের তথ্যবহুল পোস্ট দেখতে পেলাম।
উত্তরমুছুনআপনিই আমার অনুপ্রেরণা শৈবজী 🙏
মুছুনসাথে শিবের ও গুরুজীর আশীর্বাদ।