মা তারা কি সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিবকে নিজের বক্ষের স্তন্য পান করিয়ে বিষ থেকে বাঁচিয়েছিলেন ?

॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥


ভূমিকা —

বর্তমান সময়ে অনেক শাক্তবেশধারী তারাভক্ত ব্যক্তি দাবী করে থাকেন যে মা তারা বিষপানকারী শিবকে নিজের বক্ষের স্তন্য-দুগ্ধ পান করিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। তাই মা তারা শিবের‌ও জননী। কিন্তু শাস্ত্র অনুযায়ী প্রভু শিব হলেন পরমেশ্বর। তাহলে এমন কাহিনীর সত্যতা কতটুকু ? নাকি অন্ধবিশ্বাস‌ই এর ভিত্তি ?

সঠিক শাস্ত্রসম্মত সত্য বিষয়টি নিশ্চিত করবার জন্য এই প্রবন্ধটি উপস্থাপন করা হল।

________________________________________________


(প্রশ্ন) শিব যখন সমুদ্র মন্থনে উত্থিত হলাহল বিষ পান করে ছিলেন তখন সেই বিষের জ্বালায় শিব,  ছটফট করছিলেন, তখন দেবী পার্বতী তারা রূপ ধারণ করে শিবকে কোলে তুলে নিয়ে নিজের বক্ষের স্তন্য পান করিয়ে দেন, ঐ অমৃততুল্য দুগ্ধ পান করেই তারপর শিব সুস্থ হলেন। মা তারা এসে না বাঁচালে শিব মারা যেতেন। তাই মা তারা সর্ব শ্রেষ্ঠ, শিব শ্রেষ্ঠ নন। আপনারা শিবভক্ত শৈব রা যে শিবের পূজা করেন তিনি সর্বশক্তিমান নন, মা তারার কৃপা ছাড়া শিবও মরেই যেতেন। তাহলে অমন অসহায় অক্ষম শক্তিহীন শবতুল্য শিবের ভক্তি করে কি হবে ?


 উত্তর ঃ এমন ঘটনা আমাদের সনাতন ধর্মের শাস্ত্রগুলির মধ্যে কোথাও উল্লেখ নেই। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, পরমেশ্বর শিব হলাহল বিষ পান করে কন্ঠে ধারণ ছিলেন, ফলে পরমেশ্বর শিবের কন্ঠ নীল বর্ণ ধারণ করে, এই কারণে পরমেশ্বর শিবের ‘নীলকন্ঠ’ নামে পরিচিত হন।

এই ঘটনায় মা পার্বতীর ‘মহাবিদ্যা দেবী তারা’ রূপের ভূমিকা নেই। পরমেশ্বরী ভগবতী পার্বতীর‌ ‘তারা দেবী’ রূপে প্রকট হবার কাহিনী ভিন্ন।

তারাদেবী নিজের বক্ষের স্তন্য-দুগ্ধ পান করিয়েছিলেন ঠিক‌ই, কিন্তু তা সরাসরি স্বয়ং পরমেশ্বর শিবকে নয়। বরং তারা দেবী যখন ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে বিশ্বসংসার ধ্বংস করতে উদ্যত হন, তখন তারাদেবীর ক্রোধকে পান করে শান্ত করবার জন্য পরমেশ্বর শিবের থেকে প্রকট হ‌ওয়া ক্ষেত্রপাল ভৈরব বালক কে শ্মশানে কাঁদতে দেখে মাতৃদেবী তারা মাতৃত্বের স্নেহ স্বভাববশে তাকে সন্তান হিসেবে কোলে নিয়ে দুগ্ধপান করিয়েছিলেন, আর সেই অবসরে বালক ক্ষেত্রপাল ভৈরব  দুগ্ধপানের অছিলায় তারাদেবীর ক্রোধকে পান করে নিঃশেষ করে ফেলেন।

এই লীলা স্বয়ং পরমেশ্বর শিব ও মাতা পার্বতী দেবী কৈলাসে বসে দেখছিলেন। বিভূতিরূপ ধরে পার্বতী ও মহেশ্বর এই মাতা-সন্তানের লীলা ঘটিয়ে সমগ্র সমাজকে মাতৃস্নেহের মাহাত্ম্যকে গৌরবান্বিত করেছেন মাত্র।

পরমেশ্বর শিব অজন্মা, একথা বেদ-পুরাণ ইত্যাদি সকল শাস্ত্রের বচন। তার মৃত্যু সম্ভব নয়, তিনি নিজেই মৃত্যুঞ্জয়। তার মহামৃত্যুঞ্জয় মহামন্ত্র জপ করে মহর্ষি শ্বেত, মহর্ষি দধীচ, মহর্ষি মার্কণ্ডেয় অকাল মৃত্যু কে জয় করেছিলেন। তাই আবেগবশত শাস্ত্রবিরুদ্ধ কাহিনী রচনা করলেই তা ধর্মের সত্যবচন বলে গ্রহণযোগ্য হবে না। একটু বিচার বিবেচনা করে নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন, সামান্য হলাহল বিষ কিভাবে সমগ্র জগতের সকল বস্তুর উৎপত্তিকর্তা মহেশ্বরকে দগ্ধ করতে সক্ষম ? 

মহাদেবের থেকে কি বিষের শক্তি অধিক ?

না, কখনোই সামান্য বিষের প্রভাব সমগ্র জগতের একমাত্র পরমেশ্বর শিবের কোনো ক্ষতি করতে সক্ষম নয়, এমনকি সামান্যতম বিচলিত করতে সক্ষম নয়। কারণ, তিনি সকলের প্রভু, তার প্রভু আর কেউই নেই। সকলের চেয়ে তার ক্ষমতা শক্তি অধিক। তাই তার ক্ষমতার কাছে বিষের প্রভাব তুচ্ছের থেকেও তুচ্ছ। 

 পরমেশ্বর শিবের ইচ্ছায় বিষ‌ও অমৃত হয়ে যায়, এই কথা পরমেশ্বর শিব স্বয়ং বলেছেন। প্রমাণ দেখুন পদ্মপুরাণ   থেকে  👇

সদাশিব উবাচ।

"মদ্বাক্যাদখিলংশুদ্ধ্যেন্মদ্বাক্যাদমৃতং বিষম্ । মদ্বাক্যাদখিলাবেদা মদ্বাক্যাদ্দেবতাদয়ঃ ॥২২৭  মদ্বাক্যাদ্ধর্মবিজ্ঞানং মদ্বাক্যান্মোক্ষ উচ্চত্যে । পুরাণন্যাগমাশ্চৈব স্মৃতয়ো মম বাক্যতঃ ॥২২৮  "

(তথ্যসূত্র - পদ্মপুরাণ/পাতাল খণ্ড/১১৪ নং অধ্যায়)

অর্থ — সদাশিব বললেন - আমার বাক্য মাত্রই অখিল বিশ্বসংসার শুদ্ধ হয়ে যায়। আমার বাক্যে বিষও অমৃত হয়ে যায়। আমার বাক্যই হল সমগ্র বেদ শাস্ত্র । আমার বাক্যেই দেবতারা দেবত্ব প্রাপ্ত হন। আমার বাক্যই সাক্ষাৎ ধর্ম ও বিজ্ঞান স্বরূপ। আমার বাক্যেই জীব মোক্ষলাভ করে। সমগ্র পুরাণ, আগম এবং স্মৃতিশাস্ত্র সবই আমার বাক্য । 

 তাহলে যেখানে পরমেশ্বর শিব নিজে ইচ্ছে করলেই বিষকে পরিবর্তন করে অমৃত বানিয়ে দিতে পারেন, সেখানে তিনি বিষের জ্বালায় ছটফট করে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছিলেন, এমন কথা কি কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে ?

আর পরমেশ্বর শিবের‌ বিমর্শতাকেই শক্তি বলা হয়, তাই শক্তি কখনোই শিব থেকে ভিন্ন নয়, তাই ভিন্ন হবার পরিণাম ভেবে শিবকে শব বলাটাও অযৌক্তিক। শিব হলেন ব্রহ্ম আর দেবী হলেন ঐ ব্রহ্মের শক্তি হলেন, তাই দেবীকে ব্রহ্মবিদ্যা বলা হয়ে থাকে। ঐ ব্রহ্মবিদ্যা লাভ হলেই জীব শিবভক্ত হয়ে জ্ঞান লাভ করে শৈব হয়ে ওঠেন। 
তাই যারা শৈব হন তারা দেবীর কৃপাতেই শৈব হবার পথে উপনীত হয়ে শিবলোক তথা শিবকে লাভ করেন, প্রমাণ দেখুন 👇 

যশ্ছদ্মনাপি কুরুতে ব্রতমেতদিত্থং
চণ্ডীপ্রিয়ং সুরপতে মুনিসিদ্ধজুষ্টম্ । রুদ্রাঙ্গনাকুলবরাকুলিতং বিমান
মারুহ্য যাতি স সুখেন শিবস্য লোকম্ ॥ ৪৩
গায়ান্তি যে গিরিসুতাঞ্চ বিলোকয়ন্তি
ধ্যায়ন্তি বামলধিয়শ্চ শিবাং স্মরন্তি।
গৌরীং উমাং ভগবতীং জগদেকদেবীং
তে বৈ প্রয়ান্তি পরমং পদমিন্দুমৌলেঃ ॥ ৬৩
[তথ্যসূত্র : সৌরপুরাণ/৫০ অধ্যায়/৪৩,৬৩ নং শ্লোক]

অর্থ — হে সুরপতে! যে মানব ছল করেও সিদ্ধ ও মুনিগণের পূজ্য এই চণ্ডীপ্রিয় ব্রতের আচরণ করেন, সেই ব্যক্তি‌ও রুদ্রাঙ্গনাপরিপূর্ণ বিমানে আরোহণপূর্ব্বক পরমসুখে শিবলোক প্রাপ্ত করে থাকেন ।
 অধিক কি কহিব, - যারা জগদেকদেবী ভগবতী পার্বতীর গুণগান করে কিংবা তাঁহাকে ধ্যান, বিলোকন বা স্মরণ করেন, সেই সকল বিমলচিত্ত মানবগণ পরমেশ্বর চন্দ্রশেখর শিবের পরমপদ প্রাপ্ত করেন।

 🔶 আরো দেখুন,পরমেশ্বর শিবকে লাভ করলে আর অন্য কোনো দেবদেবীকে লাভ করা অবশিষ্ট থাকে না, শিবলাভ হ‌ওয়াই অন্তিম লক্ষ্য সকলের । পরমেশ্বর শিবকে লাভ করলে আর অন্য কোনো দেবতার কাছে যেতে হয় না, করণ শিব‌ই অন্তিম গতি। প্রমাণ 👇 

অন্যং ভজন্তি যে নিত্যং তস্মিংস্তে লীনতাং গতাঃ ।

তেনৈব রুদ্রং তে প্রাপ্তাঃ কালেন মহতা বুধাঃ ॥১৬
রুদ্রভক্তাস্তু যে কেচিত্তৎক্ষণং শিবতাং গতাঃ ।
অন্যাপেক্ষা ন বৈ তেষাং শ্রুতিরেষা সনাতনী ॥১৭

[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্রসংহিতা/অধ্যায় ৪২]

অর্থ - যে সমস্ত ব্যক্তি অন্য দেবতাকে নিত্য ভজনা করেন তারা সেই দেবতাতেই লীন হয়ে বহু সময় অতীত হলে অবশেষে সেই দেবতার মাধ্যমে পরমেশ্বর শিব কে প্রাপ্ত করার সৌভাগ্য লাভ করেন। কিন্তু যারা শিবভক্ত তারা ওই সময়েই সরাসরি শিবতত্ত্ব কে প্রাপ্ত করে নেন কেননা তাদের অন্য কোন দেবতার প্রয়োজন পড়ে না, ইহাই সনাতন শ্রুতি ॥১৬ – ১৭
 

         — বর্তমানকাল সময়ের হিসেবে যদি লোকমুখে প্রচলিত কথাকেও ধরি, তবে বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূম জেলার মহাপীঠ তারাপীঠের বিখ্যাত তারাসিদ্ধ মহাযোগী বামাক্ষ্যাপার গুরু ছিলেন শৈব নাথপরম্পরার একজন সিদ্ধযোগী সাধক, তার নাম ছিল শ্রী কৈলাসপতিনাথ। তিনি একজন শৈব সাধক ছিলেন, তাই তার উদ্দেশ্যে বর্তমান বীরভূম জেলার ডাবুকে কাশ্মীরের রাজা ডাবুকেশ্বরের উন্মত্তেশ্বর শিবমন্দির গড়ে দেন।
আবার শৈব নাথ পরম্পরার মহাযোগী শৈবসাধক‌ শ্রীবশিষ্ঠনাথ জীও এই তারাপীঠে সাধনা করেছিলেন। কালক্রমে, জনসাধারণ বশিষ্ঠনাথের নামটি ব্রহ্মার মানসপুত্র মহর্ষি বশিষ্ঠের নামের সাথে গুলিয়ে ফেলে বলতে শুরু করেছেন যে ঋষি বশিষ্ঠ তারাপীঠে এসে সাধনা করেছিলেন, যা ভ্রান্ত ধারণা তথা গুজব মাত্র। কারণ, মহর্ষি বশিষ্ঠ সাধারণ মনুষ্য ছিলেন না, তিনি মানসপুত্র ছিলেন, শাস্ত্রে কোথাও তার মৃত্যুর উল্লেখ নেই, তাই সেই হিসেবে তার মৃত্যুও হয়নি বলেই নিশ্চিত হ‌ওয়া যায়। অথচ তারাপীঠে বশিষ্ঠের সমাধী রয়েছে বলে স্মৃতিসৌধ উপস্থিত রয়েছে। তাহলে সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে এই তারাপীঠের সাধক বশিষ্ঠ আর মহর্ষি বশিষ্ঠ এক নয়, ভিন্ন ভিন্ন। যদিও শাস্ত্র মতে, মহর্ষি বশিষ্ঠ স্বয়ং শৈব আচার্য ছিলেন । 
তাই সব দিক থেকে বিচার করলে সকল দেবদেবীর সাধক অন্তিমকালে শিবকেই লাভ করে চিরতরে মুক্তি পেয়ে যান। তাহলে আমরা শিবভক্ত শৈব হবো না কেন ?
অবশ্য‌ই শিবভক্ত শৈব হয়েই কৈবল্য মুক্তি পাওয়া সম্ভব, তাই আমরা সর্বশক্তিমান পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর শিবের‌ই উপাসক ।


অথচ, এই কলিযুগে পরমেশ্বর শিবের মায়ার কারণে প্রায়শ‌ই বহু অজ্ঞানী ব্যক্তি নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনাকে বেদবচন বলে ভাবতে শুরু করে, আর তা প্রচার করে জনসমাজে নিজের ঐ ধারণাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, বিপুল পরিমাণে জনসমর্থন পাবার জন্য এমন বিভ্রান্তিকর কাহিনী প্রচার করে থাকে, যা শাস্ত্রের বচনের বিপরীত। এই ধরণের অসত্য কাহিনীকে প্রচারকারী ব্যক্তির শেষগতি নরক প্রাপ্তির জন্য নিশ্চিত কারণ।

এবার মা কালীরূপে তারাদেবীর প্রকট হবার কাহিনীর প্রসঙ্গে আসা যাক।


দারুকাসুরের বিনাশের জন্য ভগবান শিব নিজের শরীর থেকে কালীরূপে তারা দেবী ও অষ্টভৈরবকে প্রকাশ করা এবং শিবের তাণ্ডব নৃত্যের কাহিনী 

[লিঙ্গ মহাপুরাণ/পূর্বভাগ/১০৬ অধ্যায়]


ঋষিগণ বললেন— [হে সূতজী !] আমরা স্কন্দের অগ্রজের প্রাদুর্ভাব তো শুনে নিয়েছি; এখন আপনি আমাদের প্রকৃতরূপে বলুন যে, শম্ভুর নৃত্যের আরম্ভ কেমন করে হল এবং কেন হল ? ॥ ১ ॥

সূতজী বললেন, রাক্ষসদের মধ্যে দারুক নামের এক রাক্ষস জন্মগ্রহণ করেছিল। তপস্যা দ্বারা পরাক্রম প্রাপ্ত হয়ে সে কালাগ্নির ন্যায় [অসুর] দেবতাদের এবং উত্তম দ্বিজদের পীড়িত করতে লাগলো ॥ ২॥

সে সময় সেই দারুক ব্রহ্মা, ঈশান, কুমার, বিষ্ণু, যম, ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতাদের নিকট গিয়ে তাদের পীড়িত করতে লাগল, এতে দেবতারা অত্যন্ত পীড়িত হলেন। ‘এই অসুরটি স্ত্রীবধ্য’—এমন ভেবে স্ত্রীরূপ ধারণ করে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে সেই স্তুতিযোগ্য ব্রহ্মা প্রভৃতির সঙ্গে অসুর যুদ্ধ করতে লাগলো ॥ ৩-৪ ॥

হে দ্বিজগণ! তখন তার দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত সেই সকল দেবতারা ব্রহ্মার কাছে গিয়ে সব কিছু নিবেদন করে পুনরায় তাকে [ব্রহ্মাকে] সঙ্গে নিয়ে উমাপতির নিকট গিয়ে, পিতামহ ব্রহ্মাকে সামনে রেখে শিবের স্তব করতে লাগলেন। এর পরে দেবেশের নিকট গিয়ে অত্যন্ত বিনয় সহকারে প্রণাম করে ব্রহ্মা বললেন —‘হে ভগবন্! দারুক মহাভয়ঙ্কর; আমরা তার কাছে পূর্বেই পরাজিত হয়েছি। স্ত্রী (নারী) দ্বারা বধ্য সেই দানব দারুকের সংহার করে আপনি আমাদের রক্ষা করুন’ ॥ ৫-৭ ॥

ব্রহ্মার প্রার্থনা শুনে, ভগের নয়ন বিনষ্টকারী ভগবান দেবেশ শিব হাসলেন এবং দেবী গিরিজাকে বললেন—‘হে শুভে! হে বারাণসী! আজ সমস্ত লোকের কল্যাণের জন্য আমি এই স্ত্রীবধ্য দারুকের বধের জন্য আপনার কাছে প্রার্থনা করছি’ ॥ ৮-৯ ॥

তখন, তাঁর কথা শুনে, সংসারের সৃষ্টিকারিণী দেবী জন্মের (আবির্ভূত হওয়ার) জন্য প্রস্তুত হয়ে শিবের শরীরে প্রবেশ করলেন। তিনি (পার্বতী) দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, নিজের ষোড়শাংশে প্রবিষ্ট হলেন ; কিন্তু সেই সময় ব্রহ্মা, ইন্দ্র প্রভৃতি প্রধান দেবতারা এই বিষয় টি জানতে পারলেন না। মঙ্গলময়ী পার্বতী দেবীকে পূর্বের ন্যায় শম্ভুর নিকটে অবস্থান করতে দেখে, সব কিছু জানেন এমন ব্রহ্মাও তাঁর মায়ায় মোহিত হলেন ॥ ১০-১২ ॥

সেই দেবদেব মহাদেবের শরীরে (সূক্ষ্মরূপে) প্রবিষ্ট হয়ে পার্বতী তাঁর কণ্ঠে অবস্থিত বিষ দ্বারা নিজের শরীর তৈরি করলেন ॥ ১৩ ॥ এর পরে পার্বতীকে বিষভূতা হয়েছেন বলে জেনে, কামের শত্রু ভগবান শিব তাঁর তৃতীয় নয়ন (তারা) থেকে সেই দেবী কালীরূপী দেবী তারা কে জন্ম দিলেন, যাঁর কণ্ঠ কালো। ॥ ১৪ ॥

যখন বিষের কারণে কৃষ্ণবর্ণ কণ্ঠবিশিষ্ট কালী (দেবী তারা) প্রাদুর্ভূত হলেন, তখন বিপুল বিজয়শ্রীও উৎপন্ন হল। এখন অসিদ্ধির কারণে দানবদের পরাজয় নিশ্চিত, এতে ভবানী ও পরমেশ্বর (শিব) আনন্দিত হলেন ॥ ১৫ ॥

বিষ দ্বারা অলঙ্কৃত কৃষ্ণবর্ণ কণ্ঠবিশিষ্ট এবং অগ্নিসদৃশ স্বরূপবতী সেই প্রাদুর্ভূত কালীকে দেখে, সকল দেবতা, সিদ্ধগণ এবং বিষ্ণু-ব্রহ্মা-ইন্দ্র প্রভৃতি প্রধান দেবতারা তখন ভয়ের কারণে পালিয়ে গেলেন ॥ ১৬ ॥

তাঁর ললাটে ভগবান শিবের ন্যায় একটি [তৃতীয়] নয়ন ছিল, তাঁর শিরে একটি অত্যন্ত উজ্জ্বল চন্দ্ররেখা ছিল, তাঁর কণ্ঠে ছিল কালকূট বিষ, তাঁর হাতে ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল ত্রিশূল, এবং তিনি অলঙ্কার হিসাবে সাপের হার ও কুণ্ডল পরিধান করেছিলেন ॥ ১৭ ॥

কালীর সঙ্গে দেবীসমূহ, যারা দিব্য বস্ত্র পরিধান করেছিলেন এবং সকল অলঙ্কারে বিভূষিত ছিলেন, সিদ্ধদের স্বামী, সিদ্ধগণ এবং পিশাচগণও উৎপন্ন হলেন ॥ ১৮ ॥

তারপর পার্বতীর আজ্ঞায় পরমেশ্বরী তারা [কালী]—সুরাধিপদের হত্যাকারী অসুর দারুককে বধ করলেন ॥ ১৯ ॥

হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ! তাঁর (তারা দেবীর) অত্যধিক বেগ এবং ক্রোধের অগ্নি দ্বারা সমগ্র বিশ্ব ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। তখন ভগবান ভবও মায়া দ্বারা একটি বালকের রূপকে প্রকট করেন, কালীর ক্রোধের অগ্নি পান করার জন্য কাশীর শ্মশানে ঐ বালক গেলেন এবং কাঁদতে লাগলেন ॥ ২০-২১ ॥

হে দ্বিজগণ! সেই বালরূপ ঈশানকে দেখে, তাঁর মায়ায় মোহিত কালী (তারা দেবী) তাঁকে তুলে নিয়ে শিরসুগন্ধ গ্রহণ করে নিজের বক্ষে অবস্থিত স্তন্য পান করালেন ॥ ২২ ॥

তখন সেই বালরূপে শিব দুধের সঙ্গে তাঁর ক্রোধও পান করলেন এবং এইভাবে সেই ক্রোধ থেকে ক্ষেত্রগুলির রক্ষাকারী হলেন। সেই বালকরূপী জ্ঞানী ক্ষেত্রপাল [ভৈরব]-এরও আটটি মূর্তি হল। এইভাবে সেই কালী সেই বালকের দ্বারা ক্রোধমূর্ছিত (অচেতন) হলেন ॥ ২৩-২৪ ॥

এর পরে প্রীতিযুক্ত দেবদেব শিব এই [কালীরূপী তারা দেবীর শান্ত হবার ঘটনায়] প্রসন্নতা হবার উপলক্ষ্যে সায়ংকালে শ্রেষ্ঠ ভূত ও প্রেতদের সঙ্গে তাণ্ডব [নৃত্য] করলেন ॥ ২৫ ॥

ভগবান শম্ভুর নৃত্যের অমৃত (পরম আনন্দ) গলাধঃকরণ কর, দেব-দেবীগণ শ্মশানে আনন্দে নৃত্য করতে লাগলেন এবং যোগিনীরাও তাঁদের সঙ্গে নৃত্য করতে লাগলেন ॥ ২৬ ॥

সেখানে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-ইন্দ্রসহ সকল দেবতারা চারদিক থেকে কালীকে এবং পুনরায় দেবী পার্বতীকে প্রণাম করলেন এবং তাঁদের স্তব করলেন ॥ ২৭ ॥

[হে ঋষিগণ!] এইভাবে আমি ত্রিশূলধারী ভগবানের নৃত্যের সংক্ষেপে বর্ণনা করলাম; অন্যেরা বলেন—‘যোগের আনন্দ ভগবান [শিব] -এর নৃত্যের কারণ’ ॥ ২৮ ॥

              — উপরোক্ত শাস্ত্র বচনে নব্য শাক্তদের সকল দাবীর বিপরীত ঘটনা প্রকট হয়েছে।

♦️ বিশ্লেষণ :

(১) দেবী পার্বতীর একটি স্বরূপভূত দেবী কালী, পরমেশ্বর শিবের কন্ঠে থাকা হলাহল বিষ দ্বারা নিজের জন্য শরীর তৈরী করলেন।

(২) শ্লোকে দেবী কালী নামে বিখ্যাত ঐ দেবী, তিনি মহাদেবের ত্রিনয়ন অর্থাৎ মহাদেবের কপালের চক্ষু থেকে প্রকটিত হয়েছেন। চক্ষুর মনি কে তারা বলা হয়, তাই ঐ কালী দেবীকে তারা বলা হয়। তাই আমরা দেখতে পাই যে, দেবী তারার শারীরিক গঠন অনেকটাই মাতা কালীর মতোই এক‌ই রকম দেখতে। তাই এখানে কালী বলেই সম্বোধন করা হয়েছে।

(৩) দেবী তারা নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম হননি, তখন পরমেশ্বর শিব বাধ্য হয়ে একটি ভৈরব রূপকে প্রকট করেছিলেন, যার নাম ক্ষেত্রপাল। প্রভু শিবের ওই একটি বিভূতি স্বরূপ বলে এই বালকরূপী ক্ষেত্রপাল ভৈরবকে ঈশান নামেও সম্বোধন করা হয়েছে। সেই ক্ষেত্রপাল‌ই শান্ত করেছেন দেবীকে। অর্থাৎ পরমেশ্বর শিব ছাড়া অন্য আর কেউ ত্রাতা নেই, তিনিই সর্বশক্তিমান, এই কারণেই সকল বিপদে তিনিই শেষ ভরসা । তাই আধ্যাত্মিক জগতের খুঁটিনাটি না জেনে পরমেশ্বর শিবকে তুচ্ছ বলা ব্যক্তিবর্গ নিতান্তই শিশু মাত্র। 

(৪) দেবী তারার কোলে স্তন্যপানে রত থাকা ক্ষেত্রপাল ভৈরব পরমেশ্বর শিবের মতোই এক‌ই বেশভূষাধারী হয়ে থাকেন, তাই শাস্ত্র জ্ঞানহীন ব্যক্তিরা ভ্রমবশত বালক ক্ষেত্রপাল ভৈরব কে আর পরমেশ্বর শিব কে গুলিয়ে ফেলে ভুল কাহিনী প্রচার করে বলতে থাকেন যে, সাক্ষাৎ শিবকে দেবী তারা দুগ্ধপান করিয়েছিলেন, যা কি না ভ্রান্ত ধারণা থেকে এই কাল্পনিক বিশ্বাস জন্মেছে। 

(৫) যেহেতু দেবী তারা এই ক্ষেত্রপালকে সন্তান হিসেবে স্নেহ করেছেন তাই, দশমহাবিদ্যার সাধনায়, প্রথমে দেবীর এই সন্তানরূপী বালক ক্ষেত্রপাল ভৈরব কে প্রসন্ন করা হয়ে থাকে, ফলে দেবীকে প্রসন্ন করতে অধিক বাধার সম্মুখীন হতে হয় না।

________________________________________________

সিদ্ধান্ত

 মা তারা দেবী আমাদের শৈবদেরই আরাধ্যা দেবী পরাশক্তির মহাবিদ্যারূপ, কারণ আমাদের ইষ্ট আরাধ্যদেব পরমেশ্বর শিবের দশমহাবিদ্যাপতি ‘তার’ ভৈরবের মহাবিদ্যা হলেন ‘তারা’। শিবমহাপুরাণের শতরুদ্রিয় সংহিতার ১৭তম অধ্যায়ের ৩নং শ্লোকে বলা হয়েছে, 

তারনামা দ্বিতীয়শ্চ তারাশক্তিস্তথৈব সা ।
ভুক্তিমুক্তিপ্রদৌ চোভৌ স্বসেবকসুখপ্রদৌ ॥ ৩

[শিবমহাপুরাণ/শতরুদ্র সংহিতা/১৭ অধ্যায়/৩ নং শ্লোক]

অর্থ — পরমেশ্বর শিবের প্রকটিত দ্বিতীয় বিদ্যাপতি ‘তার’ নামে প্রসিদ্ধ। এনার মহাবিদ্যাশক্তির নাম তারাদেবী। দেবী তারা দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয়তম মহাবিদ্যা। (ইনি পার্বতী দেবীর প্রকটিত একজন শক্তিস্বরূপা) ‘তার’ ও ‘তারাদেবী’ এই দুজন ভুক্তি-মুক্তি প্রদাতা এবং সেবকদের জন্য সুখদায়ক।


তাই তারা মাতা একাধারে আমাদের ইষ্টদেবীই বটে, কিন্তু যারা শক্তি উপাসনার অহংকারে পরমেশ্বর শিবের পরমত্বকে ক্ষুণ্ণ করবার চেষ্টা করেন, শাক্ত সেজে থাকা সেই সকল নকল শাক্ত (নব্য/ছদ্মবেশী) দের অপপ্রচারের মূলকে শাস্ত্রের প্রামাণিক সত্য বচন দ্বারা উপড়ে ফেলা হল। পরমেশ্বর শিবের পরমত্ব অক্ষুন্ন রইল ।


[বিশেষ দ্রষ্টব্য : শাক্ত সাধক ব্রহ্মানন্দ বিরচিত ‘তারা রহস্যম্’পুস্তকের ১ম পটলের ২০ নং শ্লোকে তারা দেবীর  ‘তার ভৈরবঅক্ষোভ্য নামে চিহ্নিত হয়েছেন]


জয় মা তারা

জয় মা পরাশক্তি পার্বতীদেবী

জয় ক্ষেত্রপাল

শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩 

হর হর মহাদেব 🚩 


লেখনীতে — ©শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী 

কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT


#ॐনমঃশিবায় #সনাতনধর্ম #হরহরমহাদেব #সদাশিব #ISSGT #শৈবধর্ম #হিন্দুধর্ম #শৈব #Sadashiva #Sadashiv #তারা #তারাপীঠ #কালী #দশমহাবিদ্যা

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ