শ্রুতি মন্ত্র ' তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্ ' — প্রকৃপক্ষে কার পদ ?
ভূমিকা —
বর্তমান সময়ে শাস্ত্রজ্ঞানহীন মানুষেরা নিজেদের ইচ্ছামতো যা ভাবনা বা ধারণা করছে, সেটিকেই সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, এমনকি বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যা না বুঝেই আক্ষরিক অর্থ কে সত্য বলে ভেবে সেটিকেই প্রচার করে থাকে, এতে সমাজে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়, এভাবেই পরমেশ্বর শিবের পরমত্বের সিদ্ধান্ত থেকে ছিটকে গিয়ে অনান্য অনিত্য বিষ্ণু ইত্যাদি অনান্য দেবতাকে নিজের অন্ধভক্তির দ্বারা সর্বোচ্চ ভাবতে শুরু করে সনাতন ধর্মকে বিভিন্ন মতপথে ভাগাভাগি করে ফেলেছে মানুষ।
এই প্রবন্ধে একটি খুবই চর্চিত বিষয়ের উপর আলোকপাত করছি, ঋগ্বেদ ও কঠ উপনিষদের ‘তদ্ বিষ্ণোঃ পরমং পদম্’ শ্রুতি মন্ত্রটিকে ব্যবহার করে বৈষ্ণবেরা দাবী করে থাকেন যে, বৈষ্ণবদের আরাধ্য বিষ্ণুই হল সকলের অন্তিম গতি, একমাত্র লক্ষ্মীপতি বিষ্ণুর পদই পরম।
এই দাবী করে তারা সকলকে একপ্রকার জোরপূর্বক হরির পরমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু এই ধারণা কতটা সত্য তা এখানে বিশ্লেষণ করবো।
আসলেই কি ঋগ্বেদ ও কঠ উপনিষদের শ্রুতির উক্ত বেদমন্ত্রে লক্ষ্মীপতি বিষ্ণুকেই বোঝানো হয়েছে ? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
শ্রুতি মন্ত্র ' তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্ ' — প্রকৃপক্ষে কার পদ ?
উত্তর : কৃষ্ণ-যজুর্বেদের অন্তর্গত কঠ উপনিষদের ১ম অধ্যায়ের ৩য় বল্লীর ৯নং মন্ত্রে উল্লেখিত হয়েছে এই ‘তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্’ পদ টি —
বিজ্ঞানসারথির্যন্ত মনঃপ্রগ্রহবান্ নরঃ।
সোহধ্বনঃ পারমাপ্নোতি তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্ ॥ ৯
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/কঠ উপনিষদ/১ম অধ্যায়/৩য় বল্লী/৯ নং মন্ত্র]
অর্থ — উত্তম সারথির মতো বুদ্ধি যাকে সঠিক পথে চালিত করে, যাঁর মন বুদ্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এ দুয়ের যোগে যিনি ইন্দ্রিয়গুলিকে বশীভূত করেছেন তিনি এই সংসার মার্গের পরপারে যেতে সক্ষম। সেখানে তিনি বিষ্ণুর পরম্পদ লাভ করেন ।
আবার এই মন্ত্রটি ঋগ্বেদের শাকল শাখার ১ম মণ্ডলের ২২তম সূক্তের ২০নং মন্ত্রে বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে, যা বর্তমানে বহুল প্রচলিত ও ব্যবহৃত হয় —
তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সুরয়ঃ।
দিবীব চক্ষুরাততম্ ॥ ২০
[ঋগ্বেদ/শাকলশাখা/১ম মণ্ডল/২২তম সূক্ত/২০নং মন্ত্র]
অর্থ — আকাশে সর্বত্র বিচরণকারী যে চক্ষু যে রূপ দৃষ্টি করে, বিদ্বানেরা বিষ্ণুর পরমপদে সেরূপ দৃষ্টি করেন।
________________________________________________
🔶 বৈষ্ণবেরা “তদ্ বিষ্ণু পরমং পদম্” — এই কঠ উপনিষদের মন্ত্র উচ্চারণ করে মনে করেন, এটি বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মীপতি বিষ্ণুর মন্ত্র। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
জেনে নিন স্কন্দমহাপুরাণে উক্ত শ্রুতি মন্ত্রের সম্পূর্ণ অর্থ ও ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয়েছে প্রজাপতি ব্রহ্মার দ্বারা —
শ্রীব্রহ্মা উবাচ ।
সোহধ্বনঃ পারমাপ্নোতি তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্ ॥২২
পদং যৎপরমং বিষ্ণোস্তদেবাখিলদেহিনাম্ ।
পদং পরমমদ্বৈতং স শিবঃ সাম্ববিগ্রহঃ ॥২৩
রুদ্রবিষ্ণু প্রজেশানামন্যেষামপি দেহিনাম্ ।
ঋতে সাম্বং মহাদেবং কিং ভবেৎপরমং পদম্ ॥২৪ "
(তথ্যসূত্র : স্কন্দমহাপুরাণ/সূতসংহিতা/যজ্ঞবৈভবখণ্ড/ উত্তরভাগ/ব্রহ্মগীতা/অধ্যায় নং ১১/২২-২৪ নং শ্লোক)
অর্থ — সবকিছুর ঊর্ধ্বে সেই বিষ্ণু অর্থাৎ ব্যাপক ব্রহ্মই পরম প্রকৃষ্ট পদ, সেই পরম অদ্বৈত পদই মূলত সাক্ষাৎ শিব, তিনিই সাম্ববিগ্রহ (অম্বিকা সহিত সদাশিব)। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র প্রমুখ দেহধারীদের জন্যও সেই অদ্বিতীয় মহাদেবের পদই পরমপদ। সেই 'ঋতং সত্যং পরমব্রহ্ম পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গল অম্বিকা সহিত সদাশিব ছাড়া পরমপদ আর কেইই বা হতে পারে ? ॥ ২২-২৪ ॥
সুতরাং স্কন্দ মহাপুরাণের সূত সংহিতার মাধ্যমে কঠ উপনিষদের "তদ্ বিষ্ণু পরমং পদম্" শ্রুতি দ্বারা মূলত পরমেশ্বর শিবকেই বোঝায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
♦️ পুরাণ দ্বারাই বেদের মন্ত্রের ব্যাখ্যা বোঝা উচিত।
এমনই নির্দেশ রয়েছে মহাভারতে 👇
ইতিহাসপুরাণাভ্যাং বেদং সমুপবৃংহয়েৎ।
বিভেত্যল্পশ্রুতাদ্বেদো মাময়ং প্রহরিষ্যতি ॥২২৯
[তথ্যসূত্র : মহাভারত/আদিপর্ব/অধ্যায় ১]
অর্থ — ইতিহাস ও পুরাণ দ্বারা বেদকে বর্ধিত করবে; নইলে ‘এ আমাকে প্রহার করবে’ এটি ভেবে বেদ অজ্ঞ লোক হতে ভয় পেয়ে থাকেন ॥২২৯
☝️ব্যাখ্যা - ইতিহাস ও পুরাণশাস্ত্র পাঠ করলে তা থেকে বিভিন্ন পুরাতন কাহিনী জানা যাবে, যেমন - প্রাচীন ঋষি-মুনি সহ বিভিন্ন মহাপুরুষদের জীবন যাপন, তাদের বেদ পাঠের মাধ্যম, বেদবাণীর সঠিক প্রয়োগ, দেবতা তথা পরমেশ্বরের বিভিন্ন লীলা ও রীতিনীতি সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। এই পুরাণ সম্পর্কে অবগত না হয়ে যে ব্যক্তি বেদ পাঠ করে, সে বেদবাণীর ভুল অর্থ বের করে, ভুল ব্যাখ্যা বের করে এবং সেই নিজস্ব ধারণায় পুষ্ট ভ্রমটিকেই সত্য বলে ভাবে। ফলে বেদ বানীর অর্থ বিকৃত হয় ও ধর্মের অবনতি হয়। তাই উপমা হিসেবে বলা হয়েছে যে এধরণের ব্যক্তিদের কে স্বয়ং বেদ ভয় পেয়ে থাকেন। কারণ বেদের বাণী বিকৃত করার অর্থ বেদের উপর আঘাত করা।
☘️ বেদাঙ্গও বলছে পুরাণের ভিত্তিতে ন্যায় বিচার হওয়া উচিত।
তস্য চ ব্যবহারো বেদোধর্মশাস্ত্রাণ্যঙ্গান্যুপবেদাঃ পুরাণম ॥
[তথ্যসূত্র : গৌতম ধর্মসূত্র(বেদাঙ্গশাস্ত্র)/১১/১৯]
অর্থ — বেদ, ধর্মশাস্ত্র (স্মৃতি), অঙ্গ (কল্প বেদাঙ্গ) ও পুরাণশাস্ত্রের ভিত্তিতে ন্যায়বিচার হওয়া উচিত ।
এবার দেখুন নৃসিংহ পূর্বতাপনী উপনিষদে তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্ শ্রুতিতে বর্ণিত পরম পদটি আসলে কার পদকে চিহ্নিত করেছে ?
🔶 নৃসিংহপূর্বতাপনী উপনিষদ থেকে প্রমাণ দেখুন —
তদ্বা এতৎপরমং ধাম মন্ত্ররাজাধ্যাপকস্য যত্র ন সূর্যস্তপতি যত্র ন বায়ুর্বাতি যত্র ন চন্দ্রমা ভাতি যত্র ন নক্ষত্রাণি ভান্তি যত্র নাগ্নির্দহতি যত্র ন মৃত্যুঃ প্রবিশতি যত্র ন দুঃখং সদানন্দং পরমানন্দং শান্তং শাশ্বতং সদাশিবং ব্রহ্মাদিবন্দিতং যোগিধ্যেয়ং পরমং পদং যত্র গত্বা ন নিবর্তন্তে যোগিনঃ ॥ ২০
তদেতদৃচাভ্যুক্তম্ — তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ । দিবীব চক্ষুরাততম্ । তদ্বিপ্রাসো বিপন্যবো জাগৃবাংসঃ সমিন্ধতে । বিষ্ণোর্যৎ পরমং পদম্ । তদেতন্নিষ্কামস্য ভবতি য এবং বেদেতি মহোপনিষৎ ॥ ২১
(অথর্ববেদ/নৃসিংহ পূর্বতাপনী উপনিষদ/পঞ্চমোপনিষদ/২০-২১ নং মন্ত্র)
🔴 অর্থ — এই মন্ত্ররাজ জপ করে জপকারী ব্যক্তি সেই পরমধাম প্রাপ্ত করেন, যেখানে বায়ু গমন করে না, যেখানে সূর্য তাপ দেয় না, যেখানে চন্দ্রের প্রকাশ নেই, সেখানে নক্ষত্র চমকায় না, যেই স্থানে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয় না তথা যেখানে মৃত্যুর প্রবেশ নেই, যে স্থান সর্বদা দুঃখরহিত, যেখানে সর্বদাই আনন্দ বিরাজ করে, যা পরমানন্দদায়ক স্থান, শান্ত, শাশ্বত, যেখানে স্বয়ং প্রভু সদাশিব বিরাজমান, সেই প্রভু শিবই ব্রহ্মা সহ সকল দেবতাদের দ্বারা বন্দনীয় হন, তিনি যোগীব্যক্তিদের একমাত্র পরম লক্ষ্যবস্তু, যা পরমপদ নামে বিখ্যাত, যেখানে সাধকেরা পৌঁছে গেলে সংসার থেকে মুক্ত হয়ে যায়, আর কখনো সংসারে ফিরতে হয় না ॥ ২০
এই পরমপদ বিষয়ে ঋগ্বেদের ঋচাতেও বলা হয়েছে — যেমন সাধারণ চোখে আকাশে অবস্থিত সূর্যদেবকে সহজেই দেখা যায়, তেমনি জ্ঞানীগণ তাঁদের জ্ঞানচক্ষু দিয়ে বিষ্ণুর (ব্যাপকরূপী পরমেশ্বর সদাশিবের) পরমপদের শ্রেষ্ঠ স্থান দর্শন করেন । সচেতন ও জাগ্রত বিদ্বান স্তোত্রপাঠকগণ বিষ্ণুর (ব্যাপকরূপী পরমেশ্বর সদাশিবের) সেই পরম পদকে প্রকাশিত করেন (অর্থাৎ সাধারণ মানুষের জন্য উন্মোচিত করে দেন)। যে ব্যক্তি এভাবে জানে, সেই কামনা-শূন্য সাধকই সেই দিব্য পদ লাভ করে। — এটিই এই মহান নৃসিংহ পূর্বতাপনী উপনিষদের উক্তি ॥ ২১ ॥
[এছাড়াও এই একই মন্ত্র বৃহৎজাবাল উপনিষদের ৮ম ব্রাহ্মণের ৮-১০ নং মন্ত্রে উপস্থিত রয়েছে]
সুতরাং, পুরাণ সহ বেদ থেকেও প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে যে, বেদের তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্ শ্রুতি দ্বারা পরমেশ্বর শিবের পরমপদকেই বোঝানো হয়ে থাকে ।
________________________________________________
সিদ্ধান্ত
তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্ শ্রুতি দ্বারা ব্যাপকস্বরূপে সর্বত্র ছড়িয়ে বিদ্যমান থাকা পরমেশ্বর শিবকেই বোঝানো হয়েছে, বৈষ্ণবদের আরাধ্য বৈকুণ্ঠবাসী লক্ষ্মীপতি বিষ্ণুকে বোঝানো হয়নি।
________________________________________________
(প্রশ্ন) বিষ্ণুর পরম পদ বলতে যদি শিবকেই বোঝানো হয়ে থাকে, তবে আপনারা শৈবরা পূজার সময়ে ‘তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং’ মন্ত্রে স্মরণ ও আচমন করতে নিষেধাজ্ঞা দেন কেন ?
🌷 উত্তর — দেখুন ! আমি বা অন্য কেউ ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা ইচ্ছের উপরে নির্ভর করে যেমন ইচ্ছে তেমন একটি মন্ত্রকে পূজার্চনার বিধিবিধানে প্রবেশ করাতে পারেন না, এমন কার্য নীতিবিরুদ্ধ। শাস্ত্রে যে কার্যের জন্য যে নির্দিষ্ট মন্ত্র ব্যবহার করবার নির্দেশ দিয়েছেন, আমাদের উচিত সেই নির্দেশ অনুসরণ করে শাস্ত্রের বচনকে সম্মান প্রদর্শন করা।
কিন্তু আমরা যদি তা না করি তবে শাস্ত্রের অনাদর হয়, ফলে এটি অনৈতিক তথা অধর্মের বিষয় হিসেবে গণ্য হয়। অধর্ম করলে পাপ হয়, পাপের দ্বারা নরকে পতন নিশ্চিত।
তাই সর্বদা শাস্ত্রের দেখানো মার্গে এগিয়ে যেতে হবে।
বেদের ভস্মজাবাল উপনিষদে পূজার প্রথমেই কোন মন্ত্রে, কাকে স্মরণ করতে হবে, এই বিষয়ে পরমেশ্বর শিব নির্দেশনা দিয়েছেন, প্রমাণ দেখুন 👇
অথ ভুসুণ্ডো জাবালো মহাদেবং সাম্বং প্রণম্য পুনঃ পপ্রচ্ছ কিং নিত্যং ব্রাহ্মণানাং কর্তব্যং যদকরণে প্রত্যবৈতি ব্রাহ্মণঃ । কঃ পূজনীয়ঃ । কো বা ধ্যেয়ঃ । কঃ স্মর্তব্যঃ । কথং ধ্যেয়ঃ । ক্ব স্থাতব্যমেতদ্ব্রূহীতি ॥ ১
[অথর্ববেদ/ভস্মজাবাল উপনিষদ/২য় অধ্যায়/১নং মন্ত্র]
অর্থ — এরপর ভুসুণ্ডো জাবাল ঋষি নমস্কার করে ‘অম্বিকা সহিত মহাদেব অর্থাৎ সাম্ব’কে আবার জিজ্ঞাসা করলেন — ব্রহ্মজ্ঞান লাভে ইচ্ছুক ব্রাহ্মণ গণের জন্য নিত্য কর্তব্য কী ? যা না করলে ব্রাহ্মণ পাপী হয়ে যায় ?
কে পূজনীয় ? কাকে ধ্যান করতে হবে ? কাকে স্মরণ করতে হবে ? কীভাবে ধ্যান করতে হবে ? কোথায় অবস্থান করা উচিত ? হে প্রভু ! এই সব আমাকে বলুন ॥ ১ ॥
শিবলিঙ্গং ত্রিসন্ধ্যমভ্যর্চ্য কুশেষ্বাসীনো ধ্যাত্বা সাম্বং
মামেব ‘বৃষভারূঢ়ং হিরণ্যবাহুং হিরণ্যবর্ণং হিরণ্যরূপং
পশুপাশবিমোচকং পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলমূর্ধ্বরেতং বিরূপাক্ষং বিশ্বরূপং সহস্রাক্ষং সহস্রশীর্ষং সহস্রচরণং বিশ্বতোবাহুং বিশ্বাত্মানমেকমদ্বৈতং নিষ্কলং নিষ্ক্রিয়ং শান্তং শিবমক্ষরমব্যয়ং হরিহরহিরণ্যগর্ভস্রষ্টারমপ্রমেয়মনাদ্যন্তং রুদ্রসূক্তৈরভিষিচ্য সিতেন ভস্মনা শ্রীফলদলৈশ্চ ত্রিশাখৈরার্দ্রৈরনার্দ্রৈর্বা’।
নৈতত্র সংস্পর্শঃ। তৎপূজাসাধনং কল্পয়েচ্চ নৈবেদ্যম্।
ততশ্চৈকাদশগুণরুদ্রো জপনীয়ঃ। একগুণোঽনন্তঃ॥ ৩
[অথর্ববেদ/ভস্মজাবাল উপনিষদ/২য় অধ্যায়/২নং মন্ত্র]
অর্থ — (পরমেশ্বর শিব বলছেন) ত্রিসন্ধ্যায় (ভোর, মধ্যাহ্ন, সন্ধ্যা) কুশের আসনে বসে শিবলিঙ্গের অর্চনা করতে হবে, অর্চনার সময় স্মরণপূর্বক ধ্যান করতে হবে এই বর্ণনা অনুসারে আমাকে অর্থাৎ সাম্ব শিবকে —
যিনি বৃষভ নন্দীকে বাহন বানিয়ে তার উপর আরূঢ় হন, যার বাহু হিরণ্য অর্থাৎ স্বর্ণালী বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল, দিব্যদেহ স্বর্ণালী বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল, যার রূপ মাধুর্য স্বর্ণালী বর্ণের ন্যায়, যিনি জীবরূপী সকল পশুর পাশরূপী বন্ধন কে মোচন করেন, যিনি স্বয়ং ব্রহ্মপুরুষ, কৃষ্ণপিঙ্গলরূপী অর্ধনারীশ্বর হিসেবে একই দেহে শক্তিদেবী উমা কে ধারণ করেন, যিনি ঊর্ধ্বরেতরূপে দেহের অভ্যন্তরের ঊর্ধ্বে সহস্রারচক্রে সকল শক্তির উৎস স্থিত, যার অসাধারণ বিরূপ ত্রিনেত্র রয়েছে, বিশ্বের সকল রূপ যার, চারিদিকে যার হাজার হাজার নেত্র রয়েছে, হাজার হাজার মস্তক রয়েছে, হাজার হাজার চরণ রয়েছে, যার বিশ্বের সকল দিকে হস্ত রয়েছে, যিনি বিশ্বের সকলের আত্মা, যিনি এক ও অদ্বিতীয় সত্ত্বা, যিনি সমস্ত কলার অতীত হিসেবে নিরাকার সত্ত্বা, যিনি সকল কিছুর স্রষ্টা ও পরিচালনাকারী হয়েও হয়েও নিজে নিষ্ক্রিয়ভাবে(কর্ম-অতীত ভাবে) স্থিত তথা শান্ত রূপে সমস্তদিকে সমানভাবে শান্ত তথা স্থির, সেই প্রভু হলেন স্বয়ং শিব, এই প্রভুই অক্ষরব্রহ্ম ॐ-কার, এই প্রভুই অব্যয় অর্থাৎ বিনাশহীন, এই প্রভু শিব(সদাশিব)ই ত্রিদেবরূপী হরি(বিষ্ণু), হর(কৈলাসপতি রুদ্র) ও হিরণ্যগর্ভ(ব্রহ্মা)-র সৃজন কর্তা, তিনি অপ্রমেয়রূপে অসীম, তিনি অনাদি, তার অন্ত নেই, রুদ্রসূক্ত (শতরুদ্রিয়) পাঠপূর্বক তার (দুধ তথা জল দ্বারা) স্নান-অভিষেক করা হয়, সাদা বর্ণের ভস্ম প্রদান করা হয়, শ্রীফল রূপী বেলগাছের বেলফল ও ত্রিশাখাযুক্ত ভেজা বা শুকনো বেলপাতা, (ধুতরা প্রভৃতি বন্য)ফুল তাকে অর্পন করা হয় (আমি সেই প্রভু পরমেশ্বর শিবের ধ্যানে মগ্ন) ।
যে বস্তু এই পূজার উপযুক্ত নয় (যা পবিত্র নয়), তা স্পর্শ না করাই শ্রেয়।
পূজা করবার জন্য নির্ধারিত ও উপযুক্ত পূজাসামগ্রী ব্যবহার করতে হবে, নৈবেদ্য তৈরি করে নিবেদন করতে হবে। পূজার্চনার পর একাদশ বার রুদ্রসূক্ত (শতরুদ্রিয়) জপ করতে হবে, প্রত্যেক গুণ জপে অনন্ত ফল লাভ হয় ।
অর্থাৎ, বেদ থেকে প্রমাণিত হল যে, যে কোনো পূজার পূর্বে শিবস্মরণ করা বাধ্যতামূলক।
এবার বৈদিক আচমনের ক্ষেত্রে কোন মন্ত্র ব্যবহার করা উচিত, তা দেখুন 👇
আচমনন ত্র্যম্বকেণ চ ॥ ১৯
[শিবমহাপুরাণ/বিদ্যেশ্বর সংহিতা/২০ অধ্যায়/১৯ নং মন্ত্র]
অর্থ — ‘ত্র্যম্বক’ মন্ত্রে আচমন করাতে হবে।
ত্র্যম্বক মন্ত্র অর্থাৎ বেদের মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠ করে আচমন করতে হবে।
সুতরাং, স্মরণ করবার সময় বা আচমন করবার সময় কখনোই ‘তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্’ এই মন্ত্র ব্যবহৃত হবে না। কারণ এই মন্ত্র দ্বারা স্মরণ ও আচমন করবার নির্দেশ শাস্ত্রে নেই। বরং স্মরণ করবার জন্য মহাদেব কে তার নির্দিষ্ট ভস্মজাবাল উপনিষদে বর্ণিত মন্ত্রে স্মরণ করতে হবে, আচমন করবার ক্ষেত্রে শাস্ত্রে বর্ণিত নির্দেশ অনুসারে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র উচ্চারণ করে আচমন করতে হবে।
তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্ শ্রুতি দ্বারা পরমেশ্বর শিবকেই বোঝানো হয়, কিন্তু বর্তমান সমাজ তা অবগত নয়, বিষ্ণুর পরম পদ উল্লেখ হওয়া মাত্র জনগন লক্ষ্মীদেবীর স্বামী বিষ্ণুকে ধারণা করে নেয়, ফলে অর্থের অনর্থ ঘটে, সাধারণ মানুষ তখন লক্ষ্মীদেবীর স্বামী বিষ্ণুর চরণকেই সর্বোচ্চ ভাবতে আরম্ভ করে। তাই যাতে মানুষ বিভ্রান্তির শিকার না হন আর তারই সাথে যাতে শাস্ত্রের নির্দেশিত সঠিক নিয়মে পূজার পূর্বে স্মরণ ও আচমন কার্য সম্পাদন হয়, তারই জন্য আমরা শাস্ত্রের বচনের সম্মান বজায় রাখার জন্য পূজার্চনার সময়ে ‘তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম্’ শ্রুতিকে ব্যবহার করতে নিষেধ করি । কিন্তু এই মন্ত্র অন্য সময়ে পাঠ করতে কোনো দ্বিধা নেই। শৈবরা এই মন্ত্রকে পরমেশ্বর শিবের বলে জেনে পাঠ করতেই পারেন, কিন্তু এর অর্থ না বুঝে পাঠ করলে দুর্গতি লাভ হয়। তাই যেখানে যে মন্ত্র ব্যবহার করবার নির্দেশ রয়েছে, আমাদের প্রত্যেক সনাতনী ব্যক্তির উচিত শাস্ত্রের বচন অনুসারে সেই নির্দেশ পালন করে মন্ত্র পাঠ করা।
________________________________________________
☘️ অনেক ব্যক্তি আছেন যারা শাস্ত্র দ্বারা প্রমাণিত তথা শাস্ত্রীয় নির্দেশিত বিষয় সম্পর্কে সব জেনেও সত্য স্বীকার করতে চাননা, তাদের জন্য ভগবদ্গীতা এটি বলেছেন 👇
যঃ শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ততে কামকারতঃ ।
ন স সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্ ॥ ২৩ ॥
[তথ্যসূত্র – ভগবদ্ গীতা/অধ্যায় ১৬/শ্লোক ২৩]
🔶অর্থ — যে ব্যক্তি শাস্ত্রের দেওয়া বিধি মান্য না করে নিজের ইচ্ছে মত কার্য করে, তিনি তো সিদ্ধিলাভ করতে পারেনই না, না সুখ পান আর না তার কোন পরমগতি হয় ॥২৩
সুতরাং, এই কারণেই, সমস্ত বৈষ্ণব তথা সমস্ত সনাতনীদের বলছি শাস্ত্র অনুযায়ী সঠিক ব্যাখ্যা প্রচার করুন, সঠিক নিয়মনীতি মেনে চলুন। শাস্ত্রের দেওয়া নির্দেশের উপর ভিত্তি করেই ধর্ম পালন করুন। অপব্যাখ্যা ও নকল অর্থ প্রচার করে অধর্মে প্রবৃত্ত হয়ে নরকে যাওয়ার পথ নিশ্চিত করবেন না।
প্রবন্ধ টি এখানে সমাপ্ত হল ।
পরমেশ্বর শিবের জয়
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
✍️ লেখনীতে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য (ISSGT প্রতিষ্ঠাতা)
Copyright from International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT


মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন