বিশ্বকর্মা সূক্ত (বৈদিক)

 


॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥

ভূমিকা — 

 আমাদের সনাতনীদের বিভিন্ন পূজা পার্বণের মধ্যে বিশ্বকর্মা পূজা একটি বিশেষ অনুষ্ঠান, কিন্তু ধারাবাহিকভাবে এই পূজা হয়ে আসবার কারণে বেশ কিছু মন্ত্র ও গুচ্ছ রহস্য সম্পর্কে বহু সনাতনী অবগত নয়, তাই বেদ মন্ত্রে উল্লেখিত বিশ্বকর্মা সূক্ত এখানে উপস্থাপন করেছি, যা অবশ্যই পাঠ করা উচিত। 


ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৮১ ও ৮২ নম্বর সূক্ত উভয়ই *বিশ্বকর্মা সূক্ত* নামে পরিচিত। প্রতিটি সূক্তেই সাতটি করে মন্ত্র রয়েছে। এ সমস্ত মন্ত্রের ঋষি ও দেবতা হলেন *ভুবনপুত্র বিশ্বকর্মা*। এই চৌদ্দটি মন্ত্রই আবার শুক্ল যজুর্বেদের ১৭তম অধ্যায়ে ১৭ থেকে ৩২ নম্বর মন্ত্র পর্যন্ত পাওয়া যায়। এর মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ দুটি মন্ত্র হল ২৪তম ও ৩২তম। 


বিশ্বকর্মা পূজার সময়, প্রতিটি *মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান*, যেমন যজ্ঞ, গৃহপ্রবেশ, কোনো নতুন কাজের শুভারম্ভ, বিবাহ ইত্যাদি সংস্কারের সময় এই মন্ত্রগুলির পাঠ অবশ্যই করা উচিত।

________________________________________________


♦️১♦️ বিশ্বকর্মা সূক্ত — (১)

ঋগ্বেদের শাকলশাখার ১০ম মণ্ডলের ৮১ সূক্ত —


 [বিশ্বকর্মা (সদাশিব) দেবতা। বিশ্বকর্মা ঋষি। ত্রিষ্টুপ ছন্দ।]

॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥

য ইমা বিশ্বা ভুবনানি জুহ্বদৃষিহোতা ন্যসীদৎ পিতা নঃ।

স আশিষা দ্রবিণমিচ্ছমানঃ প্রথমচ্ছদববাঁ আ বিবেশ ॥ ১

কিং স্বিদাসীদধিষ্ঠান মারম্ভণং কতমৎস্বিৎ কথাসীৎ।

যতো ভূমিং জনয়ন্বিশ্বকর্মা বি দ্যামৌর্ণে। ন্মহিনা বিশ্বচক্ষাঃ ॥ ২

বিশ্বতশ্চক্ষুরুত বিশ্বতোমুখো বিশ্বতোবাহত বিশ্বতপাৎ।

সং বাহুভ্যাং ধমতি সং পতত্রৈদ্যাবাভুমী জনয়ন্দেব একঃ । ৩

কিং স্বিদ্বনং কউস বৃক্ষ আস যতো দ্যাবাপৃথিবী নিষ্টতক্ষঃ।

মনীযিণো মনসা পৃচ্ছতেদ তদ্যদধ্যতিষ্ঠদ্ভবনানি ধারয়ন ॥ ৪

যা তে ধামানি পরমাণি যাবমা যা মধ্যমা বিশ্বকর্মসুতেমা।

শিক্ষা সখিভ্যো হবিষি স্বধাবঃ স্বয়ং যজস্ব তন্বং বৃধানঃ ॥ ৫

বিশ্বকর্মন হবিষা বাবৃধানঃ স্বয়ং যজস্ব পৃথিবীমূত দ্যাম্। মুহাম্মন্যে অভিতো জনাস ইহাস্মাকং মঘবা সুরিরস্তু ॥ ৬

বাচস্পতিং বিশ্বকর্মাণমুতয়ে মনোজবং বাজে অদ্যা হবেম। স নো বিশ্বানি হবনানি জোষদ্বিশ্বশম্ভর বসে সাধুকর্মা ॥ ৭

[ঋগ্বেদ/শাকলশাখা/১০ম মণ্ডল/৮১ সূক্ত]

অর্থ —  

১। আমাদের পিতা সে যে ঋষি, যিনি বিশ্বভুবনে হোম করতে বসেছিলেন, তিনি অভিলাষসহকারে ধনের কামনা করে প্রথমাগত ব্যক্তিদের আচ্ছাদন-পূর্বক পশ্চাদাগতদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করলেন। 

২। সৃষ্টিকালে তাঁর অধিষ্ঠান অর্থাৎ আশ্রয়স্থলে কি ছিল? কোন স্থান হতে কিরূপে তিনি সৃষ্টি কার্য' আরম্ভ করলেন? সে বিশ্বকর্মা, বিশ্বদর্শনকারী দেব কোন স্থান থেকে পৃথিবী নির্মাণ-পূর্বক প্রকাণ্ড আকাশকে উপরে বিস্তারিত করে দিলেন। 

৩। সে এক প্রভু, তাঁর সকল দিকে চক্ষু, সকল দিকে মুখ, সকল দিকে হস্ত, সকল দিকে পদ, ইনি দু হস্তে এবং বিবিধ পক্ষ সঞ্চালনপূর্বক নির্বাণ করেন, তাতে বৃহৎ দ্যুলোক ও ভুলোক রচনা হয়। 

৪। সে কোন বন? কোন বৃক্ষের কাষ্ঠ? যা হতে দ্যুলোক ও ভুলোক গঠন করা হয়েছে? হে বিদ্বানগণ! তোমরা একবার আপন আপন মনে জিজ্ঞাসা করে দেখ, দেখ তিনি কিসের উপর দাঁড়িয়ে ব্রহ্মাণ্ড ধারণ করেন ? 

৫। হে বিশ্বকর্মা! হে যজ্ঞভাগগ্রাহী! তোমার যে সকল উত্তম ও মধ্যম ও নিম্নবর্তী ধাম আছে, যজ্ঞের সময় সেগুলি আমাদের বলে দাও। তুমি নিজে নিজের যজ্ঞ করে নিজ শরীর পুষ্টি কর। 

৬। হে বিশ্বকর্মা! কি পৃথিবীতে, কি স্বর্গে, তুমি নিজে নিজে যজ্ঞ করে নিজ শরীর পুষ্টি কর। চতুর্দিকের সকল লোক নির্বোধ। ইন্দ্র আমাদের প্রেরণকর্তা হোন, অর্থাৎ বুদ্ধি-স্ফূর্তি' করে দিন। 

৭। অদ্য এ যজ্ঞে সে বিশ্বকর্মাকে রক্ষার জন্য ডাকছি, তিনি বাচস্পতি অর্থাৎ বাক্যের অধিপতি, মন তাতে সংলগ্ন হয়, তিনি সকল কল্যাণের উৎপত্তিস্থান, তাঁর কার্য মাত্রই চমৎকার, তিনি আমাদের সকল যজ্ঞ স্বীকারপূর্বক আমাদের রক্ষা করুন।



__________________________

♦️২♦️ বিশ্বকর্মা সূক্ত — (২)

ঋগ্বেদের শাকলশাখার ১০ম মণ্ডলের ৮২ সূক্ত —


[ঋষি ও দেবতা বিশ্বকর্মা (সদাশিব)। ত্রিষ্টুপ ছন্দ।]


চক্ষুষঃ পিতা মনসা হি ধীরো ঘৃতমেনে অজনম্নম্নমানে।

যদেদন্তা অদদহন্ত পূর্ব আদিদ্যাবাপৃথিবী অপ্রথেতাম্ ॥ ১

বিশ্বকর্মা বিমনা আদ্বিহায়া ধাতা বিধাতা পরমোত সন্দক।

তেষামিষ্টানি সমিষা মদন্তি যত্রা সপ্তঋষীন্ পর একমাহঃ । ২ 

যো নঃ পিতা জনিতা যো বিধাতা ধামানি বেদ ভুবনানি বিশ্বা। যো দেবানাং নামধা এক এব তং সংপ্রশ্নং ভুবনা যস্ত্যন্যা ৷ ৩

ত আয়জন্ত দ্রবিণং সমস্মা ঋষয়ঃ পূর্বে জরিতারো ন ভুনা।

অসূর্তে সূর্তে রজসি নিষত্তে যে ভূতানি সমকৃস্বপ্রিমানি । ৪

পরো দিবা পর এনা পৃথিব্যা পরো দেবেভির সুরৈর্য দস্তি। 

কং স্বিদ্ধর্ভং প্রথমং দণ্ড আপো যত্র দেবাঃ সমপশ্যন্ত বিশ্বে ॥ ৫

তমিম্পর্ভং প্রথমং দপ্ত আপো যত্র দেবাঃ সমগচ্ছন্ত বিশ্বে। অজস্য নাভাবধ্যেকমর্পিতং যস্মিন্বিশ্বানি ভুবনানি তম্বুঃ ॥ ৬

ন তং বিদাথ য ইমা জজানান্যদা স্মাকমন্তরং বভব। নীহারেণ প্রাবৃতা জ্যা চাসুতৃপ উত্থশাসশ্চরন্তি । ৭

[ঋগ্বেদ/শাকলশাখা/১০ম মণ্ডল/৮২ সূক্ত/১-৭ নং মন্ত্র]


অর্থ — 

১। সে সুধীর পিতা উত্তমরূপে দৃষ্টি করে, মনে মনে আলোচনা করে জলাকৃতি পরস্পর সম্মিলিত এ দ্যাবাপৃথিবী সৃষ্টি করলেন। যখন এর চতুঃসীমা ক্রমশ দূর হয়ে উঠল তখন দু্যুলোক ও ভুলোক পৃথক হয়ে গেল। 

২। যিনি বিশ্বকর্মা, তাঁর মন বৃহৎ, তিনি নিজে বৃহৎ, তিনি নির্মাণ করেন, ধারণ করেন, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সকল অবলোকন করেন, সপ্তঋষির পরবর্তী যে স্থান সেখানে তিনি একাকী আছেন, বিদ্বানগণ এরূপ বলেন; সে বিশ্বানদের অভিলাষ সকল অম্লদ্বারা পরিপূর্ণ হয়। 

৩। যিনি আমাদের জন্মদাতা পিতা, যিনি বিধাতা, যিনি বিশ্বভুবনের সকল ধাম অবগত আছেন, যিনি একমাত্র অথচ সকল দেবের নাম ধারণ করেন, অন্য সকল ভুবনের লোকে তাঁর বিষয়ে জিজ্ঞাসাযুক্ত হয়। 

৪। স্থাবরজঙ্গমস্বরূপ এ বিশ্বভুবন গঠিত হবার পর যে সকল ঋষি এ সমস্ত প্রাণী সৃষ্টি করেছিলেন, সে প্রাচীন ঋষিগণ প্রভৃত স্তব করতে করতে অনেক ধন ব্যয় করে যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন। 

৫। যা দ্যুলোকের অপর পারে, যা এ পৃথিবী অতিক্রম করে বিদ্যমান আছে, যা অসুর দেবগণকে অতিক্রম করে আছে, জলগণ এমন কোন গর্ভ ধারণ করেছিলেন, যার মধ্যে তাবৎ দেবতা অন্তভূতি থেকে পরস্পরকে একস্থানে মিলিত দেখছে? 

৬। সে অজাত পুরুষের নাভিদেশে যে সৃষ্টি সংস্থাপিত হয়েছিল, তাতে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড অবস্থিত আছে, এই জলগণ আপন গর্ভস্বরূপ ধারণ করেছিল, এর মধ্যেই দেবতারা পরস্পর সাক্ষাৎ করেন। 

৭। যিনি এ সৃষ্টি করেছেন, তাঁকে তোমরা বুঝতে পার না, তোমাদের অন্তঃকরণ তা বুঝবার ক্ষমতা প্রাপ্ত হয় নি। কুল্কটিকাতে আচ্ছন্ন হয়ে-লোকে নানা প্রকার জল্পনা করে, তারা আপন প্রাণের তৃপ্তির জন্য আহারাদি করে এবং স্তব স্তুতি উচ্চারণ করে বিচরণ করে।


টীকা: ১। বিশ্বভুবন প্রথমে জলাকৃতি ছিল একথা অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রে যেরূপ দেখা যায়, বেদেও সেরূপ দেখা যায়। ২। ভিন্ন ভিন্ন দেবগণ কেবল এক পরমেশ্বর শিবের ভিন্ন ভিন্ন নাম মাত্র, তা এ ঋকের ঋষি অনুভব করেছেন। ৩। মূলে 'দেবেভিঃ অসুরৈঃ', আছে। অর্থাৎ বলবান দেবগণ। ৪। সৃষ্টির ও সৃষ্টিকর্তার কথা আলোচনা করে ঋগ্বেদের ঋষি চার সহস্র বৎসর পূর্বে যা বলে গিয়েছেন, অদ্য সভ্য জগতের ধীশক্তিসম্পন্ন পণ্ডিতগণ সে কথাই বলছেন, মনুষ্যেরা তাঁকে বুঝতে পারে না, কুজঝটিকাতে আচ্ছন্ন হয়ে লোকে নানা প্রকার জল্পনা করে।


________________________________________________

♦️(১)♦️ শুক্ল-যজুর্বেদের ১৭ অধ্যায়ের ২৪নং মন্ত্র —


বিশ্বকর্মন্ হবিষা বর্ধনেন ত্রাতারমিন্দ্রমকৃণোরবধ্যম্ ।

তস্মৈ বিশঃ সমনমন্ত দৈবীরয়মুগ্রো বিহব্যো যথাসৎ ॥২৪

[শুক্ল-যজুর্বেদ/১৭ অধ্যায়/২৪নং মন্ত্র]

অর্থ — 

হে বিশ্বস্রষ্টা পরমেশ্বর! হবির দ্বারা শক্তি লাভকারী সেই ইন্দ্রদেবকে আপনি(শিব) বিশ্বরক্ষক ও অপরাজেয় করেছেন।

প্রাচীন ঋষিদের মতো আমরাও সেই ইন্দ্রদেবকে নতশিরে প্রণাম করি। এই পরাক্রান্ত ইন্দ্রদেব আপনার(শিবের) শক্তির বলেই সকল বিষয়ে সক্ষম হয়েছেন। আমরা তাঁরই আহ্বান করি। ॥ ২৪॥



♦️(২)♦️ শুক্ল-যজুর্বেদের ১৭ অধ্যায়ের ৩২নং মন্ত্র —


বিশ্বকর্মা হ্যাজনিষ্ট দেব । 

আদিদ্গন্ধর্বোঽভবদ্ দ্বিতীয়ঃ ।

তৃতীয়ঃ পিতা জানিতৌষধীনামপাং

গর্ভং ব্যদধাৎপুরুত্রা ॥ ৩২ ॥

[শুক্ল-যজুর্বেদ/১৭ অধ্যায়/৩২নং মন্ত্র]

অর্থ — সৃষ্টি-ক্রমে সর্বপ্রথমে ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রক দেবগণ প্রকাশিত হলেন। এর পরে পৃথিবীকে ধারণকারী (অগ্নি ও সূর্য) দেবতার আবির্ভাব ঘটল। তৃতীয় ক্রমে ঔষধি ও উদ্ভিদের উৎপাদক ও পালনকারী প্রাণ–পর্জন্যের উদয় হল।

তিনি (বিশ্বস্রষ্টা শিব) সমস্ত জলের গর্ভকে নানা রূপে ধারণ করেন। ॥ ৩২॥

________________________________________________


শিবঃ ॐ তৎ সৎ ॥

শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩 

হর হর মহাদেব 🚩 

তথ্য উপস্থাপনে : শ্রীগুরু নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী 

কপিরাইট ও প্রচারে : International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT 










মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ