কুষাণ রাজারা শিবভক্ত শৈব ছিলেন (৩০-৩৭৫ খ্রিষ্টাব্দ)
ভূমিকা —
পহ্লবদের পরে ইউয়েহ চিহ্ন বা তুষার (তোখারিয়) নামে একটি গোষ্ঠী মধ্য এশিয়ার তৃণভূমি থেকে আসে, এদের পরিচয় কুষাণ নামে। এদের আদি বাসভূমি ছিল চিনের কাছাকাছি। কুষাণরা প্রথমে ব্যাকট্রিয়া দখল করে শকদের সেখান থেকে হটিয়ে দেয় ও পরে কাবুল গান্ধার হয়ে হিন্দুকুশ পার হয়ে সিলিউকিড ও পহ্লবদের তাড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে সিন্ধু নদীর দক্ষিণে গাঙ্গেয় উপত্যকার অধিকাংশ ভূভাগ দখল করে। এরা যে অঞ্চল অধিকার করেছিল তার পরিধি অক্সাস (বেদে উল্লিখিত বক্ষু নদী) থেকে গঙ্গা ও মধ্য এশিয়া থেকে বারাণসী পর্যন্ত, আজকের পুরো পাকিস্তান ও পুরো উত্তর ভারত। এই ব্যাপ্তির ফলে একটি বৃহৎ অঞ্চলে নানা গোষ্ঠীর মানুষের পরস্পরের মধ্যে জাতিগত, ভাষাগত, শিল্পগত, সংস্কৃতিগত অন্তমিশ্রণ ঘটে, এই সমস্ত অঞ্চল জুড়ে একটি বৃহৎ সভ্যতা গড়ে ওঠে। কিন্তু এদের মধ্যে সবথেকে বড় পরিবর্তন হয়েছিল ধার্মিক দিক থেকে। প্রায় প্রত্যেক রাজা শৈব ধর্ম অনুসরণ করতেন, প্রত্যেকে শিব ভক্ত ছিলেন। তাদের বিষয়ে কৃতিত্ব সম্পর্কে অল্প কিছু তথ্য উপস্থাপন করে শৈবধর্মের প্রাচীনত্ব বিশালতার বিষয়ে সকলকে জানাবার প্রয়াস করা হয়েছে এই প্রবন্ধে ।
___________________________________________________________________________________
কুষাণ রাজারা শিবভক্ত শৈব ছিলেন
(১) কুষাণ প্রথম রাজা কুজুল কদফিসেস শৈব ছিলেন (২৯-৮০ খ্রিষ্টাব্দ)
কুষাণদের প্রথম রাজা কুজুল কদফিসেস শৈব ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন ; তিনি কুষাণ সাম্রাজ্যের কৃতিত্ব শর্ব (শিব), চন্দ্রবীর (চন্দ্রশেখর শিব)-এর প্রতি উৎসর্গ করেন। তিনি “সত্যধর্মস্থিত” উপাধি গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর মুদ্রায় পরমেশ্বর শিবের বাহন বৃষভ-নন্দী ও নন্দীপাদ চিহ্ন ব্যবহার করেছিলেন।
বিপরীত দিকে (reverse) দেখা যায় যে, মুদ্রার লিপি ইতিমধ্যেই খরোষ্ঠী (Kharoṣṭhī) লিপিতে লেখা আছে —
“Kujula Kasasa Kuṣana yavugasa dhramathidasa”
অর্থাৎ — “কুজুল কাসা, কুষাণ যবগু (নেতা), যিনি ধর্মে অবিচল”।
“ধ্রমথিদ” (dhramathida = ধর্মস্থিত, অর্থাৎ ‘ধর্মে স্থিত’) এই উপাধিটি পরবর্তী এক সংস্করণে আরও সম্পূর্ণ রূপে দেখা যায় —
“sacadhramathita” → satyadharmasthita — অর্থাৎ “সত্যধর্মে অবিচল”।
আগে ইতিহাসবিদেরা মনে করতেন, এই উপাধির কারণে কুজুল কডফিসেস (Kujula Kadphises) ছিলেন একজন বৌদ্ধ, কিন্তু এখন পরিষ্কার হয়েছে যে তা নয়।
মথুরা শিলালিপিতে দেখা যায়, হুভিষ্ক (Huvishka) একই উপাধি satyadharmasthita বহন করেছেন, এবং সেখানে উল্লেখ আছে যে, রাজ্য তাঁকে প্রদান করেছিলেন সর্ব (Sarva) ও স্কন্দবীর (Scandavira/Candavira) — অর্থাৎ তিনি ছিলেন শিবের ভক্ত।
এটি আশ্চর্যের যে এত প্রাচীন সময়েই কুজুল কডফিসেস শিবোপাসনা গ্রহণ করেছিলেন এবং খরোষ্ঠী লিপা ব্যবহার করেছিলেন। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, ভারতীয় ধর্মীয় চিন্তা ও উপাসনা পদ্ধতির বিস্তার উত্তর-পশ্চিম ভারতে শুরু হয়েছিল গ্রিক-বাখ্ত্রিয়ানদের আমলেই।
ইন্দো-গ্রিক রাজারা— যেমন আপোলডোটাস I, অ্যান্টিমাখাস ও মেনান্দার— নিয়মিতভাবে গান্ধারী প্রাকৃত ভাষায় ও খরোষ্ঠী লিপিতে লেখা মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন। পরবর্তী ইউক্রাটিডিস তাঁর মুদ্রার পশ্চাতে কাপিশার (Kāpiśa) নগর-দেবীর প্রতিমা ব্যবহার করেছিলেন।
___________________________________________________________________________________
(২) কুষাণ বংশের ৩য় রাজা - ভীম কদফিসেস শৈব ছিলেন (৮৫-৯৫ খ্রিষ্টাব্দ)
ভীম কদফিসেস একজন নিবেদিত শৈব উপাসক ছিলেন; তিনি তাঁর মুদ্রায় “মহেশ্বর” (শৈব ধর্ম) শব্দ খোদাই করিয়েছিলেন। তিনি ডায়োস্কুরি মন্দিরকে রূপান্তরিত করে শিব ও উমা-মহেশ্বরের চিত্রসহ এক শিবমন্দিরে পরিণত করেন এবং আরও বহু মন্দির ও দেবমূর্তি নির্মাণ করেন।
___________________________________________________________________________________
(৩) কুষাণ বংশের ৪র্থ রাজা — কনিষ্ক শৈব ছিলেন (৯৫-১৫১ খ্রিষ্টাব্দ)
তিনিও শিব-প্রকারের মুদ্রা জারি চালিয়ে যান (সমস্ত মুদ্রার প্রায় ২৬%), আর বুদ্ধ-প্রকারের মুদ্রা ছিল মাত্র ১%। বৌদ্ধ গ্রন্থগুলো কনিষ্ককে বৌদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করলেও, বুদ্ধ-প্রকারের মুদ্রা এত কম পাওয়া যায় যে এই দাবিটি খুব নির্ভরযোগ্য নয়। কনিষ্ক মূলত এক সমন্বয়বাদীরাজা ছিলেন, তবে তাঁর ব্যক্তিগত ধর্ম ছিল শৈবধর্মের শিব উপাসনা।
তবুও, ভারতের গুরুত্ব এবং ভারতীয় ধর্মবিশ্বাস — বিশেষ করে শিব উপাসনা — কুষাণ যুগে অপরিবর্তিত রইল।
কনিষ্ক-এর মুদ্রার পশ্চাতে (reverse side) দেখা যায় শিবের প্রতিমা, যার নাম লেখা ছিল “Oešo” (ওচ্ষো) — এটি এসেছে প্রাচীন সংস্কৃত শব্দ “Vṛṣa” (প্রাকৃত: “Veṣa”) থেকে। এই মুদ্রাই প্রথম যেখানে শিবকে স্পষ্টভাবে শিলালিপির মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়েছে।
যদি Mioro, Mao, Aušo, ও Nana কুষাণ রাজবংশের প্রাচীন দেবতা হয়ে থাকেন, তবে শিব তাঁদের দেবসমষ্টির অংশ হয়ে যান ভীম কডফিসেস-এর আমল থেকেই। ফলে, কনিষ্কের মুদ্রার পশ্চাতে যে বিভিন্ন দেবতা দেখা যায়, সেগুলি মূলত কুষাণ রাজবংশের নিজস্ব রাজকীয় দেবসমূহের প্যান্থিয়ন নির্দেশ করে — যার উদ্দেশ্যে সুরখ কোটাল (Surkh Kotal)-এর মন্দির উৎসর্গিত ছিল।
___________________________________________________________________________________
(৪) কনিষ্কের শিলালিপিতে শিবের উল্লেখ —
কনিষ্কের রাবতক শিলালিপিতে ভারত-ইরানীয় দেবদেবীদের উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু বুদ্ধের নাম কোথাও উল্লেখ নেই। সেখানে ‘মুজদ্বান’ (শিব)-এর উল্লেখ পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে যে, কনিষ্ক ছিলেন শিবের ভক্ত, অর্থাৎ তিনি ব্যক্তিগতভাবে শৈব উপাসনায় বিশ্বাসী ছিলেন।
এই দেবতাদের মধ্যে দুটি—মুঝদ্বান ও উম্মা—রাজা কনিষ্ক রাবতক মন্দিরের শিলালিপির শুরুতে উল্লেখ করেছেন, সেই তালিকায় যাদের থেকে রাজা রাজ্যলাভ করেছিলেন বলে বলেছেন। তালিকার পাঁচজন দেবতা জরথুস্ত্র ধর্মের প্যান্থিয়নের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু মুঝদ্বান ও উম্মা নন। “মুঝদ্বান” নামটি বাখ্ত্রিয়ান ভাষার, যার অর্থ “অনুগ্রহশীল”—যা শিবেরও একটি অর্থ। আসলে, কুষাণ মুদ্রায় মুঝদ্বানের বিরল চিত্রে ত্রিশূল এবং দ্বিমুখী অশ্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা শিবের দ্বৈত প্রকৃতির প্রতীক। তবে সামগ্রিকভাবে দেবতাটিকে ইউয়েজি অশ্বারোহী হিসেবে দেখানো হয়েছে, স্কিথীয়দের মতো টুপি পরা অবস্থায়, এবং অনুমান করা যায় কানিষ্ক তাঁর নিজস্ব পারিবারিক দেবতাদের মধ্য থেকেই এই ব্যক্তিগত রক্ষকদেবতাকে গ্রহণ করেছিলেন।
তথাপি, কুষাণ রাজারা ধর্মজীবনের চলমান ধারাগুলি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং সেগুলিকে অনুসরণও করতেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ধর্মসমন্বয় (syncretism)। মহৎ ধর্মগুলি একে অপরকে প্রভাবিত করে স্থানীয় উপাসনাগুলিকেও ধীরে ধীরে আত্মসাৎ করেছিল। বাখ্ত্রিয়ায় শিবের এই সমন্বিত উপাসনা বিশেষ সাফল্য লাভ করেছিল; এবং শেষ মহান কুষাণ রাজা বাজোদেও (বাসুদেব)-এর মুদ্রায় শিবই একমাত্র দেবতা হিসেবে দেখা যায়—যিনি গ্রিক, ইরানি ও অশিবীয় ভারতীয় উপাদানের সংমিশ্রণে গঠিত এক রূপ।
___________________________________________________________________________________
(৫) কনিষ্কের পুত্র - হুভিষ্ক ছিলেন শিবভক্ত (১৫০-১৯০ খ্রিষ্টাব্দ)
ভীম কদফিসেস-এর নির্মিত শিব মন্দির পুনরুদ্ধার করেন কনিষ্কের পুত্র - হুভিষ্ক এবং ব্রাহ্মণদের অনুদান দেন। তাঁর মুদ্রা ও সিলমোহর থেকে জানা যায়, তিনি শিব সহিত উমা ও স্কন্দেরও ভক্ত ছিলেন, স্কন্দের অনুচর বিশাখ -মুদ্রায় স্থান পেয়েছিল।
মথুরাতেও হুবিষ্কের অনুরূপ কার্যকলাপ দেখা যায়। বিমা কদফিসেস নির্মিত কুষাণ রাজবংশের দেবমন্দিরটি যখন জীর্ণাবস্থায় পৌঁছেছিল, তখন হুবিষ্ক এক মহান সেনানায়ক (মহাদণ্ডনায়ক) প্রেরণ করেন, যিনি সেই মন্দির পুনর্নির্মাণ করে দেবকুলে হুবিষ্কের একটি মূর্তি স্থাপন করেন এবং ব্রাহ্মণদের জন্য সভাগৃহে নিয়মিত ভোজনব্যবস্থারও প্রবর্তন করেন। যদিও শিলালিপিতে তারিখ সংরক্ষিত নেই (বা উল্লেখ করা হয়নি), তবে এই পুনর্নির্মাণ কাজ সম্ভবত পরবর্তী সময়ে, অর্থাৎ ৪০তম বর্ষের পরে সম্পন্ন হয়েছিল, যখন হুবিষ্ক ইতিমধ্যেই “রাজাধিরাজ” উপাধি ধারণ করছিলেন।
অন্যদিকে, মিশর ছিল কুষাণ সাম্রাজ্য বা তার মধ্য দিয়ে আসা পণ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ বাজার। প্রাচীন ইরানি যুদ্ধদেবতা অর্লাগ্নো-এর উল্লেখ এখানে অনুপস্থিত, কারণ তাঁর স্থানটি দখল করেছে ভারতীয় যুদ্ধদেবতাদের একগুচ্ছ — স্কন্দ (Skando), কুমার (Komaro), মহাসেন (Maaseno), বিশাখ (Bizago), এমনকি উমা (Ommo) — যারা যুদ্ধ ও শক্তির প্রতীক হিসেবে সমাদৃত ছিলেন।
___________________________________________________________________________________
(৬) হুভিষ্কের পুত্র - প্রথম বাসুদেব শিবভক্ত ছিলেন (১৯১-২৩২ খ্রিষ্টাব্দ)
এরই সাথে কৃষ্ণ তার প্রিয় ছিল। তাঁর শাসনকালে শিবের পূজা প্রচলিত ছিল এবং বহু দেব-প্রতিমার রূপ শিবের সঙ্গে একীভূত হয়েছিল।
এটি ছিল এক সংকোচনের যুগ — কপার মুদ্রার ওজন ১৬ গ্রাম মানদণ্ড থেকে নেমে এসে প্রায় ১০–১১ গ্রামে পৌঁছায়। তাঁর উত্তরসূরি বাসুদেব প্রথম, যিনি প্রায় খ্রিস্টাব্দ ১৮৮ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং “মহান কুষাণ” রাজাদের মধ্যে শেষ, তাঁর শাসনামলে মুদ্রার গুণমান ও ওজন আরও কমে প্রায় ৯ গ্রামে নেমে আসে। “বাসুদেব” নামটি জনপ্রিয় হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর (বাসুদেব কৃষ্ণ) নামের সঙ্গে সম্পর্কিত; তিনিই ছিলেন প্রথম কুষাণ রাজা যিনি এইভাবে দেবতার নাম গ্রহণ করেন।
তবুও, কুষাণ রাজারা সেই সময়ের ধর্মীয় প্রবণতাগুলি ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন এবং তা অনুসরণ করেছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সমন্বয়বাদ (syncretism) — যেখানে বড় বড় ধর্ম একে অপরকে প্রভাবিত করে স্থানীয় উপাসনাগুলিকে ধীরে ধীরে আত্মসাৎ করছিল। বাকত্রিয়ায় (Bactria) শিবের সমন্বিত পূজা-পদ্ধতি বিশেষভাবে সফল হয়েছিল; এবং বাজোদেও (বসুদেব)-এর মুদ্রাগুলিতে শিবই ছিলেন একমাত্র পূজিত দেবতা — এমন এক রূপে, যা গ্রিক, ইরানি এবং অ-শৈব ভারতীয় উপাদানের এক সমন্বিত প্রকাশ বলে মনে হয়।
___________________________________________________________________________________
এই প্রবন্ধটি এখানে সমাপ্ত হল ।
প্রকৃত শিবভক্তদের উচিত পরমেশ্বর শিবের জন্য প্রতিষ্ঠিত করা এই সকল শৈব বীরদের ঐতিহাসিক গাথা গুলিকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া। শেয়ার করুন প্রচুর পরিমাণে.. যাতে সকলে সত্য জানতে পারে —
শৈবরা চিরকাল শাসন করে এসেছে বিশ্ব। শৈবরাই ধর্মে অদ্বিতীয়, বীরত্বে সূর্যের ন্যায় শৌর্যবীর্যের একমাত্র আদর্শ দৃষ্টান্ত।
নন্দী মহারাজের জয়
পরমেশ্বর শিবের জয়
পরমশৈব কুজুল কদফিসেসের জয়
পরমশৈব ভীম কদফিসেসের জয়
পরমশৈব কনিষ্কের জয়
পরমশৈব হুভিষ্ক জয়
পরমশৈব প্রথম বাসুদেবের জয়
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
লেখনীতে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
#শৈবধর্ম #ISSGT #শৈবরাজা #শৈববীর #শৈববিপ্লব #শৈবইতিহাসওঐতিহ্যসংস্কৃতি #শৈবইতিহাস #শৈব #কুষাণ #কুষাণবংশ #কুষাণসাম্রাজ্য #কণিষ্ক








মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন