ক্ষত্রিয় কুল শ্রেষ্ঠ — শৈব মহারাজাধিরাজ ভোজ পরমার (১০১০-১০৫৫ খ্রিষ্টাব্দ)
ভূমিকা —
প্রাচীন রাজধর্ম কেবল শাসননীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না—তা ছিল ধর্ম, তত্ত্ব ও সাধনার এক গভীর মিলনক্ষেত্র। সেই ধারায় মহারাজাধিরাজ ভোজ পরমারের নাম বিশেষভাবে উজ্জ্বল। মধ্যযুগের এই মহামতি রাজা কেবল রাজনীতি ও সাহিত্যেই অগ্রগণ্য নন, তিনি ছিলেন এক অনন্য শৈব উপাসক, যাঁর শাসন ও সাধনা পরস্পরবিরোধী নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক। তাঁর রাজসভা ছিল শৈব দর্শন, শৈবতন্ত্র ও আধ্যাত্মিক শৈব সাধনার এক প্রাণকেন্দ্র।
আজ যখন শৈব আদর্শকে অনেকেই কেবল পৌরাণিক বা গূঢ় বলে দূরে সরিয়ে রাখেন, তখন রাজা ভোজের জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শৈব তত্ত্বই ছিল ভারতীয় সাম্রাজ্য ও সংস্কৃতির একমাত্র প্রাণশক্তি। রাজশক্তি ও শিবতত্ত্বের ঐক্যই আমাদের অতীতের মহিমাকে গঠন করেছিল। সেই চিরন্তন ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করাই আজকের সময়ের দাবি।
প্রায় প্রত্যেক রাজা শৈব ধর্ম অনুসরণ করতেন, প্রত্যেকে শিব ভক্ত ছিলেন। তাদের বিষয়ে কৃতিত্ব সম্পর্কে অল্প কিছু তথ্য উপস্থাপন করে শৈবধর্মের প্রাচীনত্ব বিশালতার বিষয়ে সকলকে জানাবার প্রয়াস করা হয়েছে এই প্রবন্ধে ।
ক্ষত্রিয় কুল শ্রেষ্ঠ — শৈব মহারাজাধিরাজ ভোজ পরমার
🕉️ পরিচয়
নাম: রাজা ভোজ (Bhoja-deva / Bhoja Paramāra)
বংশ: পরমার (Paramāra dynasty)
রাজধানী: ধারানগরী (বর্তমান মধ্যপ্রদেশের ধারা)
শাসনকাল: আনুমানিক খ্রিস্টীয় ১০১০ – ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দ
ধর্ম: শৈব সনাতন (শ্রী উপাসক),
উপাধি: শৈব মহারাজাধিরাজ, ব্রহ্মাক্ষত্র, সরস্বতী কণ্ঠাভরণ
🔱 ধর্ম ও দর্শন
ভোজ ছিলেন একনিষ্ঠ শৈবভক্ত — তিনি পাশুপত শৈব দর্শন অনুসারী ছিলেন, তিনি পরমেশ্বর শিবের উপাসনা করতেন।
তিনি নিজেকে কেবল রাজা নয়, “শৈব যোগেশ্বর রাজা” হিসেবে ভাবতেন। তাঁর রাজপ্রাসাদে তন্ত্র, আগম, বেদান্ত ও যোগশাস্ত্রের পণ্ডিতদের সমাবেশ হত। তিনি শুধু মাত্র একজন রাজাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, শৈবপরম্পরার জন্য তিনি শৈব সিদ্ধান্তের উপরে ভিত্তি করে ২৮ টি শৈব আগম শাস্ত্রের তথ্য নিয়ে শৈবপুস্তক রচনা করেন, যা আমাদের সনাতনী শৈবদের জন্য অমূল্য সম্পদ তুল্য ।
🏰 রাজনীতি ও শাসন
ভোজ পরমার রাজবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন।
তিনি মালবদেশ (বর্তমান মালওয়া) শাসন করতেন, তাঁর প্রভাব উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃত ছিল।
তাঁর রাজধানী ধারা ছাড়াও, ভোজপুর (বর্তমানে ভোপাল) তাঁর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।
ভোজপুরে তিনি নির্মাণ করেন বিখ্যাত —
-
ভোজেশ্বর মন্দির (ভোজেশ্বর মহাদেব) — অসমাপ্ত হলেও এটি এক বিশাল শৈব মন্দির, যেখানে একটি একখণ্ড পাথরের শিবলিঙ্গ রয়েছে (উচ্চতা প্রায় ৭.৫ ফুট)।
-
এছাড়া, তিনি বহু সারস্বত মন্দির, বিদ্যাপীঠ, ও সৌধ নির্মাণ করেন।
________________________________________________
(১) পরম শৈব রাজা ভোজ (১০১০-১০৫৫ খ্রিষ্টাব্দ)
রাজা ভোজ পরমার ছিলেন পরমার বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও যোদ্ধা রাজা; তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ শৈব (শিবভক্ত),
নিজ রচনাসমূহে রাজা ভোজ পরমার শিবকে “জগদগুরু” নামে উল্লেখ করেছেন এবং নিজের সকল বিদ্যার উৎস হিসেবে শিবকেই কৃতিত্ব দিয়েছেন —
(২) রাজা ভোজ -এর গুরু একজন শৈব আচার্য ছিলেন —
অঘোরশিব শিবাচার্য, যিনি মহারাজ ভোজের ‘তত্ত্বপ্রকাশ’-এর উপর ভাষ্য (ব্যাখ্যা) রচনা করেছিলেন, তিনি ভোজের গুরু হিসেবে “উত্তুঙ্গশিব শিবাচার্য”-এর নাম উল্লেখ করেছেন।
________________________________________________
(৩) রাজা ভোজ - শৈব পুস্তক “তত্ত্বপ্রকাশ” লিখেছিলেন
মহারাজ ভোজ পরমার সিদ্ধান্ত শৈব দর্শনে এতই পারদর্শী ছিলেন যে তিনি ২৮টি শৈব আগমের উপর ‘তত্ত্বপ্রকাশ’ নামে একটি ভাষ্য (টীকা) রচনা করেছিলেন।
________________________________________________
(৪) রাজা ভোজ - নিজ পুস্তকে শিবলিঙ্গ গড়নের বর্ণনা করেছেন ও শিবের দর্শন লাভ করেছিলেন —
রাজা ভোজ পরমার তাঁর লিখিত গ্রন্থ “সমরাঙ্গণ সূত্রধার”-এ শিবলিঙ্গের সঠিক গঠনের পদ্ধতির ও বর্ণনার জন্য একটি পৃথক অধ্যায় উৎসর্গ করেছেন।
‘গণরত্ন মহাবোধি’ গ্রন্থে রাজা ভোজের প্রশংসা করা
হয়েছে এই বলে যে, তিনি শিবকে তাঁর মূল (স্বরূপ)
রূপে দর্শন করেছিলেন।
________________________________________________
(৫) “পানহেরা শিলালিপি”তে মহারাজ ভোজ ও শৈবতন্ত্রের উল্লেখ —
জয়সিংহদেব প্রথম পরমারের (খ্রিষ্টাব্দ ১০৫৯) “পানহেরা শিলালিপি”তে মহারাজ ভোজের উল্লেখ রয়েছে এবং সেখানে “চণ্ডী দামর” তন্ত্র ও “ডাকিনী”-র মতো তান্ত্রিক শৈব উপাদানেরও উল্লেখ পাওয়া যায়।
________________________________________________
(৬) মহারাজ ভোজের সময় কালে “তিলকওয়াড়া শিলালিপিতে” কাপালিক ও শিবের নাম উল্লেখ —
রাজা ভোজ পরমারের সময়কার (প্রায় খ্রিষ্টাব্দ ১০৪৭) তিলকওড়া শিলালিপিতে “দিনকর” নামে এক মহাব্রতী কাপালিকের উল্লেখ আছে এবং সেখানে “কপালি” নামক শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে — এই নামটি কাপালিকরা শিবকে সম্বোধন করবার জন্য ব্যবহার করে থাকেন।
________________________________________________
(৭) “বঙ্গড় শিলালিপি”তে পাণ্ডিত্যের তর্কে জয়ী শৈবাচার্যের মহারাজ ভোজের দ্বারা পুরস্কার প্রাপ্তির উল্লেখ —
বঙ্গড় প্রশস্তি শিলালিপিতে “রূপশিব শিবাচার্য”-এর উল্লেখ রয়েছে, যিনি বহু পণ্ডিতকে পরাজিত করেছিলেন ; এই ঘটনাটি রাজা ভোজ নিজে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং পরে তাঁকে পুরস্কৃত করেন।
________________________________________________
(৮) “উদয়পুর প্রশস্তি”তে পরমশৈব মহারাজ ভোজের দ্বারা বহু শিব মন্দির নির্মাণের উল্লেখ —
উদয়পুর প্রশস্তিতে রাজা ভোজ পরমারের শিবমন্দির নির্মাণের উল্লেখ রয়েছে, যেগুলির নাম ছিল: কেদারেশ্বর, রামেশ্বর, সোমনাথ, সুন্দর, কালা, অনল এবং রুদ্র।
________________________________________________
(৯) মহারাজ ভোজ পরমারের শাসনকালের কেবলমাত্র দুটি অবশিষ্ট থাকা শিবমন্দির —
___________________________________________________________________________________
এই প্রবন্ধটি এখানে সমাপ্ত হল ।
প্রকৃত শিবভক্তদের উচিত পরমেশ্বর শিবের জন্য প্রতিষ্ঠিত করা এই সকল শৈব বীরদের ঐতিহাসিক গাথা গুলিকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া। শেয়ার করুন প্রচুর পরিমাণে.. যাতে সকলে সত্য জানতে পারে —
শৈবরা চিরকাল শাসন করে এসেছে বিশ্ব। শৈবরাই ধর্মে অদ্বিতীয়, বীরত্বে সূর্যের ন্যায় শৌর্যবীর্যের একমাত্র আদর্শ দৃষ্টান্ত।
নন্দী মহারাজের জয়
পরমেশ্বর শিবের জয়
পরমশৈব ক্ষত্রিয় কুল শ্রেষ্ঠ মহারাজাধিরাজ ভোজ পরমার জয়
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
লেখনীতে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
#শৈবধর্ম #ISSGT #শৈবরাজা #শৈববীর #শৈববিপ্লব #শৈবইতিহাসওঐতিহ্যসংস্কৃতি #শৈবইতিহাস #শৈব #কুষাণ #কুষাণবংশ #কুষাণসাম্রাজ্য #কণিষ্ক











মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন