পুরাণ শাস্ত্র কি কাল্পনিক ও মনুষ্য রচিত ?
ভূমিকা —
সনাতন শাস্ত্র চর্চায় “প্রমাণ” একটি মৌলিক ও অপরিহার্য তত্ত্ব। প্রমাণ -এর অর্থ হল এমন নির্ভরযোগ্য জ্ঞানসূত্র যা দ্বারা সত্য ও ধর্ম নির্ধারিত হয়। অথচ আজকের দিনে কিছু কৃত্রিম বিদ্বান ও মতবাদ অনুসারী স্বার্থান্বেষী প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার নাম আর্যসমাজ, তারা পুরাণশাস্ত্রকে কল্পনা, অলঙ্কার, প্রক্ষিপ্ত বা অশাস্ত্রসঞ্জাত আখ্যা দিয়ে এর প্রামাণ্যতা খণ্ডন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। তারা পুরাণকে কাল্পনিক ইতিহাস বা ধর্মীয় কাহিনী হিসেবে দেখাতে চায়, অথচ এদের দেওয়া মতবাদের বিরুদ্ধে গিয়েই বরং সকল প্রাচীন শাস্ত্র ও দর্শন একবাক্যে স্বীকার করে, পুরাণ শাস্ত্রসমান এবং প্রমাণযোগ্য জ্ঞানমাধ্যম।
এবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে তথ্য উপস্থাপন ও যুক্তি সহ, যার দ্বারা দয়ানন্দ সরস্বতীর প্রতিষ্ঠিত আর্যসমাজের মতবাদ কে খণ্ডন করা হয়েছে।
পুরাণ শাস্ত্র কি কাল্পনিক ও মনুষ্য রচিত ?
উত্তর :
🔥ঋগ্বৈদিক ও ধর্মসূত্রীয় শাস্ত্রে পুরাণ, ইতিহাস, গাথা ও নারাশংসীর মর্যাদা ও স্বীকৃতি—
পুরাণের উদ্দেশ্য শুধু ধর্মীয় কাহিনী বলা নয়, বরং এর মাধ্যমে জগৎ, সৃষ্টি, ধর্ম, কর্ম, পুনর্জন্ম ও মোক্ষের মতো গূঢ় বেদার্থের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, যা শ্রুতি ও স্মৃতির ব্যাখ্যাকে পরিপূর্ণ করে। অষ্টাদশ পুরাণ বেদব্যাস কর্তৃক সংকলিত হওয়ায় এগুলো ঐশ্বরিক মন্ত্রসমূহের অর্থপ্রকাশ এবং শাস্ত্রানুগ সাধনার পথপ্রদর্শক। ন্যায়, মীমাংসা, বেদাঙ্গ ও দর্শন শাস্ত্রে পুরাণকে প্রমাণরূপে গৃহীত দেখা যায়, যদি তা বেদের বিরোধী না হয়।
পুরাণের নিজস্ব লক্ষণও একে প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সহায়তা করে—সর্গশ্চ প্রতিসর্গশ্চ বংশো মন্বন্তরানি চ। বংশানুচরিতং চেতি পুরাণং পঞ্চলক্ষণম্।। [বায়ু পুরাণ /৪/১০]—এই শ্লোক অনুযায়ী পুরাণে যে পঞ্চলক্ষণ বিশিষ্ট বিশ্লেষণ পাওয়া যায়, তা কোনো সাধারণ কল্পনা নয়, বরং শাস্ত্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও নৈতিক উপাদানের সংমিশ্রণ।
অতএব, বেদানুগ পুরাণ শুধু বিশ্বাসের বিষয় নয়, তা শাস্ত্রতাত্ত্বিক দৃষ্টিতেও প্রামাণ্য। এই প্রবন্ধে আমরা দর্শন ও শাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে পুরাণের এই প্রামাণ্যতা বিশ্লেষণ করে দেখব, এবং প্রমাণ করব যে পুরাণ অন্যান্য শাস্ত্রের ন্যায়ই একটি গ্রহণযোগ্য জ্ঞানমাধ্যম।
👉অথর্ববেদ সংহিতা – মহাদেব স্বরূপ ব্রাত্য ও ইতিহাস-পুরাণ সৃষ্টি—
তর্মিতিহাসচং পুরাণং চ গাথাংশ্চ নারাশুংসীশ্চাংনুব্য চলন ॥ ১১
ইতিহাসস্য চ বৈ স পুরাণস্য চ গার্থাংনাং চ নারাশুংসীনাংঞ্চ প্রিয়ং ধামং ভবতি য এবং বেদং ॥ ১২
[অথর্ববেদ (শৌনক শাখা)/পঞ্চদশ কাণ্ড/ষষ্ঠ সূক্ত/১১-১২ নং মন্ত্র]
তিনি (ব্রাত্য, যিনি মহাদেব) যখন প্রস্থান করলেন, তখন ইতিহাস, পুরাণ, গাথা ও নারাশংসী তাঁকে অনুসরণ করলেন।
যে ব্যক্তি এই জ্ঞান জানে, সে ইতিহাস, পুরাণ, গাথা ও নারাশংসীর প্রিয় আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে।
👉 ॐ-কার এর ৩য় মাত্রা ‘ম’কার থেকেই সৃষ্টি পুরাণ—
তস্য মকারশ্রুত্যেতিহাসপুরাণং বাকোবাক্যং গাথা নারাশংসীরুপনিষদোহনুশাসনানীতি।।
[অথর্ববেদ/গোপথব্রাহ্মণ/পূর্বভাগ/১ম প্রপাঠক/২১]
সেই (ব্রহ্মের) ব্যঞ্জনান্ত 'মকার' থেকে সৃষ্টি হল ইতিহাস-পুরাণ, বাক্যগাথা, নারাশংসী উপনিষদ, অনুশাসনসমূহের।
👉‘ম’কার হলো স্বয়ং শিব—
যা সা তৃতীয়া মাত্রৈশানদেবত্যা কপিলা বর্ণেন। যস্তাং ধ্যায়তে নিত্যং, স গচ্ছেদৈশানং পদম্।।
[অথর্ববেদ/গোপথব্রাহ্মণ/পূর্বভাগ/১ম প্রপাঠক/২৫]
ঈশান তার তৃতীয়মাত্রার (অর্থাৎ ম কার) দেবতা এবং বর্ণে কপিল। ঐ মাত্রার নিত্য ধ্যানকারী ঈশান পদ লাভ করে।
🔥অর্থাৎ উপরিউক্ত শ্রুতিবাক্য থেকেই প্রমাণিত হয়, সকল শাস্ত্রের প্রকটকর্তা সাক্ষাৎ শিবই। [বৃহদারণ্যক উপনিষদ ২/৪/১০] অনুযায়ী বেদ হলো পরমেশ্বর এর নিশ্বাস স্বরূপ। সায়ণাচার্যও একই সিদ্ধান্তকে মেনে বলেছে— "যস্য নিঃশ্বসিতং বেদা যো বেদেভ্যোঽখিলং জগৎ। নির্মমে তমহং বন্দে বিদ্যাতীর্থ মহেশ্বরম্"॥ অর্থাৎ শিবের নিশ্বাস থেকে বেদের প্রাকট্য। ইহার একই শব্দপ্রমাণ উপলব্ধ হয় পুরাণেও— “নিগমং শ্বাসরূপেণ দদৌ তস্মৈ ততো হরঃ”।। [শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সৃষ্টিখণ্ড/৯নং অধ্যায়/৫]। এবং পদ্মপুরাণেও একই সিদ্ধান্তকে মেনে চলে একটু অন্যভাবে— “মদ্বাক্যাদখিলাবেদা মদ্বাক্যাদ্দেবতাদয়ঃ”।।
[পদ্মপুরাণ/পাতাল খন্ড/১১৪ নং অধ্যায়/২২৭] অর্থাৎ উক্ত সকল প্রামাণিক শাস্ত্র প্রমাণ থেকেই এটা সিদ্ধ হয় যে সকল শাস্ত্রের প্রকটকর্তা সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিব নিজেই। এবং শিবই হলো সেই বেদের বিষয়বস্তু যাকে সকলেই জানতে চায় — “বেদৈরনেকৈরহমেব বেদ্যো বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্”।। [কৈবল্য উপনিষদ/২/২২] সমস্ত বেদ-উপনিষদাদি দ্বারা আমি জানার যোগ্য বিষয়বস্তু, আমি(শিব) বেদান্তের কর্তা এবং বেদবেত্তাও স্বয়ং আমি নিজে।
শিবই বেদ প্রকট করেছে সর্বপ্রথম —
“প্রভুং বরেণ্যং পিতরং মহেশং যো ব্রহ্মাণং বিদধাতি তস্মৈ । বেদাংশ্চ সর্বান্ধহিণোতি চাগ্র্যং তং বৈ প্রভুং পিতরং দেবতানাম্ ॥ [শরভ উপনিষদ/২নং মন্ত্র] অর্থ – সেই প্রভুই সর্বপ্রথম প্রজাপতি ব্রহ্মা কে ধারণ করেন, সেই প্রভুই বরণের যোগ্য, তিনিই প্রভু, তিনিই পিতা মহেশ্বর, তিনিই শ্রেষ্ঠ। এবং তিনিই বেদের প্রথম প্রেরক পরমেশ্বর, তিনিই সবার প্রভু এবং সমস্ত দেবতাগণেরও পিতা।”
মহাভারতেও বলা হয়েছে সকল শাস্ত্রের মধ্যে যিনি অতীব গূহ্য ভাবে অবস্থান করেন তিনিই শিব [মহাভারত/দ্রোণপর্ব/অধ্যায় ১৭০/৮৯]।।
"শিবই সর্ববেদের মূল স্রষ্টা। তিনি স্বয়ং সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর, যাঁর অনন্ত নিঃশ্বাস থেকে চতুর্বেদ আবির্ভূত হয়েছে। ঋষিগণ কেবলমাত্র ঐশ্বরিক অনুগ্রহে সেই মন্ত্রগুলির দর্শন লাভ করেন, কিন্তু বেদের স্রষ্টা নন। যেমন আমরা বায়ুপ্রবাহ ছাড়া এক মুহূর্তও বাঁচতে পারি না, তেমনি শিবের নিঃশ্বাসরূপ জ্ঞানপ্রবাহ, অর্থাৎ বেদ ছাড়া মানব সভ্যতা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। এই জন্যই কল্পে কল্পে মহাদেব স্বয়ং বিভিন্ন ঋষির অন্তরে জ্ঞানের প্রভা বিস্তার করে থাকেন, তাঁদের মাধ্যমে বেদজ্ঞানের পুনরুজ্জীবন ঘটান। এইভাবে শিবই আদ্যন্ত জ্ঞানের উৎস, যাঁর শ্বাসপ্রবাহ থেকেই অনাদি, অনন্ত ও অপরিবর্তনীয় বেদসমূহ উৎসারিত হয়েছে।" তাই শ্রুতি বলছে — “ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাং ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং” [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০ম প্রপাঠক] পরমেশ্বর শিবই সকল বিদ্যা ও সর্বভূতের অধিপতি। শিবই সর্ববিদ্যার তীর্থ।।
🔴 ব্রাহ্মণ গ্রন্থ নিয়ে বর্তমান সমাজে একদল অসাধু ব্যক্তিবর্গের আগমন হয়েছে, তারা হলেন দয়ানন্দ সরস্বতী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আর্য'সমাজের অনুসারী, যাদের ব্যক্তিগত মান্যতা ব্রাহ্মণ বেদ নয়। এটি পৌরুষেয়। এবং ব্রাহ্মণকে বেদ বলে অস্বীকার করতে শাস্ত্রের অপপ্রয়োগ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিথ্যা ছড়িয়ে দিয়েছে। তাই তাদের দেখানোর জন্যই দুটো শাস্ত্র প্রমাণ দিলাম যে, ব্রাহ্মণ হলো বেদ—
👉মহর্ষি জৈমিনী তাঁর পূর্ব মীমাংসা সূত্রের (ধর্ম মীমাংসা) ২.১.৩৩ এ অর্থাৎ 'ব্রাহ্মণনির্বাচনাধিকরণ' এ বলছেন -
" শেষে ব্রাহ্মণশব্দঃ "
[মীমাংসা সূত্র/২/১/৩৩]
সূত্রার্থ - (শেষে) মন্ত্র- সংহিতা বাদে অবশিষ্ট অংশের এর জন্য (ব্রাহ্মণশব্দঃ) ব্রাহ্মণ শব্দ এর ব্যবহার হয়ে থাকে।
👉এবং আরও বলা আছে যে—
" মন্ত্রব্রাহ্মণযোর্বেদনাম ধ্যেযম্ ॥ "
(আপস্তম্ব শ্রৌতসূত্র/২৪ নং প্রশ্ন/প্রথম কণ্ডিকা/৩১ নং সূত্র)
মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ উভয়কেই বেদ নামে অভিহিত করা হয়।
👉ঋষি বোধায়ন ব্রাহ্মণের বেদত্ব বিচার সম্পর্কে বলছে—
" মন্ত্রব্রাহ্মণং বেদ ইত্যাচক্ষতে ॥ ২ ॥
মন্ত্রব্রাহ্মণযোর্বেদনাম ধ্যেযম্ ॥ ৩ ॥ "
(বোধায়নীয় গৃহ্যসূত্র/ ২য় প্রশ্ন/ ৬নং অধ্যায়)
কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় শাখার একটি কল্প বেদাঙ্গ শাস্ত্র হল বোধায়ন গৃহ্যসূত্র। এখানেও স্পষ্টভাবেই সংহিতা ও ব্রাহ্মণ উভয়কেই বেদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
🔥অর্থাৎ এর থেকে স্পষ্ট হয়ে গেলো ব্রাহ্মণ হলো স্বয়ং বেদ। আর বেদের বাণী অকাট্য। তাই এখানে আর বেদে উল্লেখিত পুরাণকে ব্রাহ্মণ বলে চালাতে পারবে না।
⚠️এবার সেই অসাধু ব্যক্তিবর্গের দাবী হলো বেদ শাস্ত্রে উল্লেখিত পুরাণ বলতে- ১৮ পুরাণকে নয়, বরং ব্রাহ্মণকেই বোঝায়। যার জন্য তারা শাস্ত্রের অনর্থ তো করেছে, তা সাথে অপযুক্তিও খাটিয়েছে। কিন্তু স্বয়ং বেদ নিজেই বলছে যে ব্রাহ্মণ ও পুরাণ সম্পূর্ণ দুটি আলাদা শাস্ত্র।
👉পুরাণ এবং ব্রাহ্মণ দুই আলাদা শাস্ত্র—
এবমিমে সর্বে বেদা নির্মিতাঃ সকল্পাঃ সরহস্যাঃ সব্রাহ্মণাঃ সোপনিষৎকাঃ সেতিহাসাঃ সাম্বাখ্যানাঃ সপুরাণাঃ সম্বরাঃ সসংস্কারাঃ সনিরুক্তাঃ সানুশাসনাঃ সানুমার্জনাঃ সবাকোবাক্যাঃ।।
[অথর্ববেদ/গোপথব্রাহ্মণ/পূর্বভাগ/২য় প্রপাঠক/১০]
সে রকম সমস্ত বেদগ্রন্থ, কল্পগ্রন্থ, রহস্যগ্রন্থ, ব্রাহ্মণগ্রন্থ, উপনিষদরাজি, ইতিহাস, ব্যাখ্যানগ্রন্থ, পুরাণ, স্বর, সংস্কার, নিরুক্ত, অনুশাসন, সংশোধনী, আলোচনা শাস্ত্র- (সবই) যজ্ঞে প্রযুক্ত হলে নিজস্ব সত্তা ছিন্ন হয়।
🔥অর্থাৎ যারা অপযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পুরাণকে ব্রাহ্মণ দাবী করছে তাদের পর্দা এখানেই ফাঁস হয়ে গেলো। প্রথমে আমি শাস্ত্র থেকে প্রমাণ দেখিয়েছি যে ব্রাহ্মণ হলো বেদ এবং বেদই বলছে পুরাণ বলতে ১৮ পুরাণকেই বোঝাচ্ছে। কারণ এখানে স্পষ্ট শব্দপ্রমাণ আছে ব্রাহ্মণ আর পুরাণ দুই ভিন্ন গ্রন্থ। তাই এখানে আর তাদের পুরাণকে ব্রাহ্মণ দাবী করার অপযুক্তি খাটবে না। কেননা শাস্ত্রে বলা হয়েছে— বুদ্ধিপূর্বা বাক্যকৃতির্বেদ" [বৈশেষিক দর্শন /৬/১/১] বেদ বাক্য রচনা বুদ্ধিপূর্বক। এখানে সৃষ্টিক্রম বিরুদ্ধ কোনো কথা নেই। অতএব ইহা ঈশ্বরীয় জ্ঞান। অর্থাৎ এর থেকে জানা যায়- গোপথ ব্রাহ্মণের বাক্য সাক্ষাৎ পরমেশ্বর বাক্য তাই পুরাণ শাস্ত্রও পরমেশ্বর বাক্য হওয়ায় ইহা মান্য। আর যারা পরমেশ্বর বাক্য (বেদ বচন) মানে না তাদের জন্য বলা হয়েছে— "শ্রুতি বিরোধাত্র কুতর্কাপসদস্যাত্মলাভঃ" [সাংখ্যায়ন দর্শন/৬/৩৪] শ্রুতি (বেদ) বিরুদ্ধ কুতর্ককারীরা কখনোই আত্মজ্ঞান প্রাপ্ত হন না। অর্থাৎ যারা বেদ বিরোধী মান্যতা দেয় তারা অবশ্যই আত্মজ্ঞানী নয়। নাহলে বেদের বচনকে প্রক্ষিপ্ত বলে ঘোষণা করতো না। শুধু বেদের বচন কেন, সাক্ষাৎ ব্রাহ্মণ শাস্ত্রকেই বেদ বলে স্বীকার করে না এসব অজ্ঞানী আর্য সমাজীরা। কিন্তু, যারা জ্ঞানী ব্যক্তি তারা বেদের বচনকে সমর্থন ও সদা সম্মান করেই চলে— “মন্ত্রায়ুর্বেদ প্রামাণ্যবচ্চ তত্প্রমাণ্যমাপ্তপ্রামাণ্যাত্" [ন্যায় দর্শন/২/১/৬৭] জ্ঞানী ব্যাক্তি যিনি তার মন, কথা ও কাজে সত্যকে প্রতিপালন করেন তিনি সর্বদাই বেদের প্রামাণ্যতা স্বীকার করেছেন।। যারা প্রকৃত জ্ঞানী তারা বেদকে সবদিকে বেদের জ্ঞানকে প্রতিপালন করেই চলেন, কদাপি বেদ বিরুদ্ধ কার্যক্রম করেন না।
কারণ তারা জানেন যে— “বেদোহখিলো ধর্মমূলম্” [মনুসংহিতা- ২/৬] বেদই সকল ধর্মের মূল। "চোদনালক্ষণোহর্থ ধর্মো " [মীমাংসা দর্শন/১/১/২] যা বেদবিহিত তাই ধর্ম আর যা বেদবিরুদ্ধ তা অধর্ম। তাই এখান থেকে স্পষ্ট বোঝায় যায় বেদবিহিত ধর্মই শ্রেষ্ঠ ও সদা মান্য এবং বেদবিরুদ্ধ ধর্ম অমান্য। আর যারা পুরাণ শাস্ত্রকে মানেনা তারা বেদবিরুদ্ধ কার্য করছে। তাই তাদের বেদের বিরোধী বলা যায়। কেননা সাক্ষাৎ বেদই বলছে পুরাণ প্রামাণিক শাস্ত্র যা স্বয়ং পরমেশ্বরই সৃষ্টি করেছেন। তাই যারা পরমেশ্বর এর বিরুদ্ধ কাজ করে তারা বেদবিরুদ্ধ পাষণ্ড। আর এখন তারা অন্য কোনো অপযুক্তি দ্বারা পুরাণকে খণ্ডন করতে পারবে না। কেননা পুরাণের প্রমাণ সাক্ষাৎ বেদই দেয় আর বেদ সাক্ষাৎ উমাপতি পরমেশ্বর শিবের বাণী তাই তা অবশ্যই প্রামাণ্য। তাই শাস্ত্রে বলছে— "তদ্ বচনাদাম্নায়স্য প্রামাণ্যম্" [বৈশেষিক দর্শন /১০/১/৩] বেদ পরমেশ্বরের বাণী তাই তা প্রামাণ্য। অতএব যারা পুরাণ শাস্ত্রকে প্রক্ষিপ্ত বা মনুষ্য রচিত গল্প কাহিনী বলেন তাদের দাবী অমান্য ও মিথ্যাচার বলেই ঘোষণা করা হলো। তাই এখানেই পুরাণের প্রামাণিকতা সিদ্ধ হয়ে যায়।
👉শুধুই বেদ নয় মহর্ষি আশ্বলায়ণও বলছে ব্রাহ্মণ এবং পুরাণ ভিন্ন দুই শাস্ত্র। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র – পাঠযোগ্য গ্রন্থের তালিকায় পুরাণ ও ইতিহাস—
অথ স্বাধ্যায়মধীয়ীত ঋচো যজুংষি সামান্যথর্বাঙ্গিরসো ব্রাহ্মণানি কল্পান্ গাথা নারাশংসীরিতিহাস পুরাণানীতি ॥ ১ ॥
[আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র/তৃতীয় অধ্যায়/তৃতীয় কণ্ডিকা/প্রথম সূত্র]
এরপর স্বাধ্যায়ের জন্য অধ্যয়ন করা উচিত—ঋক, যজুষ, সাম, অথর্ব ও অঙ্গিরস ঋষিদের স্তোত্র, ব্রাহ্মণ, কল্পসূত্র, গাথা, নারাশংসী, ইতিহাস ও পুরাণ।
🔥দেখুন তবে মহর্ষি আশ্বলায়ণও বলছে ব্রাহ্মণ এবং পুরাণ ভিন্ন দুই গ্রন্থ। এখানে বলে রাখা ভালো যে মহর্ষি আশ্বলায়ণ আপ্ত পুরুষ। তাই আপ্তবাক্য অবশ্যই মান্য কেননা শাস্ত্রে বলছে —
" আপ্তোপদেশঃ শব্দঃ ॥ ৭ ॥ "
[ন্যায়সূত্র ১/১/৭]
আপ্ত পুরুষ অর্থাৎ প্রাচীন ঋষি মুনিগণ কর্তৃক সংকলিত শাস্ত্র বাক্যই শব্দ প্রমাণ।
" মন্ত্রাযুর্ব্বেদ প্রামাণ্যবচ্চ তৎপ্রামাণ্যমাপ্ত প্রামান্যাৎ || " [ন্যায়সূত্র ২/১/৬৮]
মন্ত্র ও আয়ুর্বেদের প্রামাণ্যের ন্যায় আপ্ত পুরুষের প্রামাণ্যবশত , সেই ব্যক্তি কর্তৃক কথিত বেদস্বরূপ শব্দের প্রামাণিকতা সিদ্ধ হয়।
👉একই সিদ্ধান্তকে মান্যতা দিয়ে মহর্ষি পাতঞ্জলি বলছেন যে—
“প্রত্যক্ষানুমানাগমাঃ প্রমাণানি”। ৭।
[পাতঞ্জল যোগদর্শন/সমাধিপাদ/৭ নং সূত্র]
প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আগম - এই তিন প্রকার মাত্র প্রমাণ বৃত্তি আছে।
🔥অর্থাৎ প্রমাণ তিন ভাবেই হতে পারে প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আগম। এখানে আগম বলতে মহর্ষি পতঞ্জলি শৈবাচার্য আপ্তবাক্যকে বুঝিয়েছে (পরমেশ্বর শিবের মুখ নিঃসৃত বানীকে এই কারণে আগম বলা হয়েছে, যা সাধারণত শৈব আগম নামে বিখ্যাত, কারণ পরমেশ্বর শিবের বচন হল সর্বোচ্চ আপ্ত বচন)। তাই এখান থেকেই প্রমাণিত হয় যে আপ্তপুরুষ বাক্যও প্রমাণ এবং মান্য। তাই মহর্ষি আশ্বলায়ণ এর বাক্য অনুসারে ব্রাহ্মণ এবং পুরাণ ভিন্ন দুই গ্রন্থ যা অবশ্যই মান্য। কেননা যদি ইহা অমান্য বলে তাহলে তাদের শাস্ত্রের বিরোধী বলেই ঘোষণা করা হবে।
👉এবার আসা যাক শাস্ত্রে পুরাণের প্রমাণ নিয়ে। পুরাণ প্রসঙ্গে শ্রুতি শাস্ত্র বলছে—
“অথ যেঽস্যোদঞ্চো রশ্ময়স্তা এবাস্যোদীচ্যো মধুনাড্যোঽথর্বাঙ্গিরস এব মধুকৃত ইতিহাসপুরাণ পুষ্পং তা অমৃতা আপঃ ॥”
[ছান্দোগ্য উপনিষদ/৩/৪/১]
অর্থ — এবার সূর্যের যে উত্তরদিকের রশ্মিগুলি (উত্তরের দিকে যেগুলি বিস্তার লাভ করে), সেগুলিই হল 'উত্তরের মধুকোষের' স্নায়ু বা রন্ধ্র। অথর্ব ও অঙ্গিরা ঋষিদের মন্ত্রসমূহ হল মৌমাছি, ইতিহাস ও পুরাণ হল ফুল, এবং জল (যজ্ঞজল বা সোম) হল অমৃত।
⚠️ শংকা— এখানে ইহিহাস ও পুরাণ বলতে ফুল বলা হয়েছে। তাহলে ফুল পুরাণ শাস্ত্র কীভাবে হতে পারে?
🔥শংকা নিবারণ— এখানে ফুল রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ— ইতিহাস ও পুরাণ (পুষ্পং) –
এগুলো হল সেই ফুল, যেখান থেকে মৌমাছিরা (মন্ত্র) রস সংগ্রহ করে। অর্থাৎ, আমাদের ঐতিহ্য, কাহিনি ও জ্ঞানগ্রন্থগুলিই জ্ঞানের উৎস।
এই উপনিষদীয় অংশে বলা হচ্ছে, জ্ঞান (বেদ, মন্ত্র, পুরাণ, ইতিহাস) সূর্যের (প্রকাশক চেতনা বা আত্মার) রশ্মির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে প্রবাহিত হয়। এই রশ্মি একটি মৌচাকের মতো কাঠামো গঠন করে।
যেখানে—ইতিহাস-পুরাণ ফুল, মন্ত্র মৌমাছি, এবং সেই থেকে আহরিত বোধ বা জ্ঞান হল অমৃত।
এই রূপকের মাধ্যমে উপনিষদ বোঝাতে চাইছে,
সমস্ত ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক জ্ঞান-উৎস, সূক্ষ্ম বোধ ও চিন্তার মাধ্যমে, আত্মজ্ঞানের (ব্রহ্মবিদ্যা) দিকে নিয়ে যায়।
👉শ্রুতিতে বিভিন্ন শাস্ত্রের উল্লেখ এর মধ্যে পুরাণের বিশেষ উল্লেখ —
নাম বা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদ আথর্বণশ্চতুর্থঃ ইতিহাসপুরাণঃ পঞ্চমো বেদানাং বেদঃ পিত্র্যো রাশিরবো নিধির্বাকো বাক্যমেকয়নং দেববিদ্যা ব্রহ্মবিদ্যা ভূতবিদ্যা ক্ষত্রবিদ্যা নক্ষত্রবিদ্যা সর্পদেবজন নামবৈ তন্নামোপাস্ব ইতি ॥
[ছান্দোগ্যোপনিষদ /৭/১/৪]
অর্থ — নারদ বললেন, “গুরু, আমি সব কিছু শিখেছি। ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ - এই চার বেদ, পঞ্চমবেদ স্বরূপ এই ইতিহাস, পুরাণ, গণিত, যুদ্ধবিদ্যা, দেববিদ্যা, ভূতবিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র, নৃত্য, গান, সব কিছু জানি। কিন্তু... আমার মনে শান্তি নেই। আমি জানি না 'আত্মা' কী।”
🔥এখানে ঋষি নারদ যখন শিক্ষাগুরুকে বলেন যে তিনি অনেক কিছু জানেন, কিন্তু 'আত্মা' জানেন না, তখন গুরু তাকে শেখান, "এই সমস্ত বিদ্যা কেবল নামমাত্র, প্রকৃত জ্ঞান বা পরমাত্মজ্ঞান (আত্মজ্ঞান) এর চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে।"
👉অথর্ববেদ – বেদসমূহ, পুরাণ ও দেবতাদের উৎপত্তি—
ঋচঃ সামানি চ্ছন্দাংসি পুরাণং যজুষা সহ ।
উচ্ছিষ্টখজ্জজ্ঞিরে সর্বে দিবি দেবা দিবিশ্রিতঃ ॥ ২৪
[অথর্ববেদ (শৌনক শাখা)/একাদশ কাণ্ড/অষ্টম সূক্ত]
ঋক, সাম, ছন্দ, পুরাণ ও যজু—সবই দেবতাদের উচ্ছিষ্ট বা গূঢ় অংশ থেকে উৎপন্ন। এই দেবতারা স্বর্গে অবস্থান করেন।
👉বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র – ইতিহাস ও পুরাণ দিয়ে বেদকে শক্তিশালী করা —
ইতিহাসপুরাণাভ্যাং বেদং সমুপবৃহয়েৎ ।
বিভেত্যল্পশ্রুতাদ্বেদো মাময়ং প্রহরিষ্যতি ॥ ৬
[বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র/সপ্তবিংশতি অধ্যায়/ষষ্ঠ সূত্র]
অর্থ — ইতিহাস ও পুরাণ দ্বারা বেদকে দৃঢ় করা উচিত। কারণ বেদ অল্পশ্রুত ব্যক্তি দেখে আশঙ্কা করে—"এই ব্যক্তি আমাকে বিনষ্ট করবে।"
👉শাঙ্খায়ন গৃহ্যসূত্র – তর্পণে ইতিহাস-পুরাণের অন্তর্ভুক্তি —
বাকোবাক্যং ইতিহাসপুরাণম ॐ সর্বান বেদোং ত্বয়ী দধাম্য অসৌ স্বাহেতি বা
[শাঙ্খায়ন গৃহ্যসূত্র/প্রথম অধ্যায়/চতুর্বিংশতি খণ্ড/অষ্টম সূত্র]
অর্থ — বাক্য, ইতিহাস ও পুরাণ — সব বেদ তোমাতে দান করি, এইভাবে তর্পণ সম্পন্ন হয়।
👉আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র – অগ্নির সামনে রাত্রিকালে পুরাণ পাঠ —
তং দীপায়মানা আসন আ শান্তরাত্রাদায়ুষ্মতাং কথাঃ কীর্তয়ন্তো মাঙ্গল্যানঘতিহাসপুরাণানীত্যাখ্যাপয়মানাঃ ॥ ৬ ॥
[আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র/চতুর্থ অধ্যায়/ষষ্ঠ খণ্ডিকা/ষষ্ঠ সূত্র]
অর্থ — তারা অগ্নি জ্বালিয়ে বসে থাকে শান্ত রাত্রির শেষ পর্যন্ত, তখন তারা মঙ্গলজনক ইতিহাস ও পুরাণ শ্রবণ করে, আয়ুষ্মানদের কাহিনি উচ্চারণ করে।
👉বৌধায়ন ধর্মসূত্র – আচরণে পুরাণ ও ইতিহাসের স্মরণ —
যৎ প্রথমং পরিগাষ্টি তেনাঽথর্ববেদঃ ।
যদ্ দ্বিতীয়ং তেন ইতিহাসপুরাণम् ॥ ৪ ॥
[বৌধায়ন ধর্মসূত্র/চতুর্থ প্রশ্ন/তৃতীয় অধ্যায়/চতুর্থ সূত্র]
অর্থ — যখন প্রথমবার (মুখ মোছেন বা স্পর্শ করেন), তখন অথর্ববেদকে তুষ্ট করেন; দ্বিতীয়বার ইতিহাস ও পুরাণকে তুষ্ট করেন।
👉আপস্তম্ব ধর্মসূত্র – নীতিবচনে পুরাণের ভূমিকা—
যো হিংসার্থমভিক্রান্তং হন্তি মন্যুরেব মন্যুং স্পৃশতি ন তস্মিন্ দোষ ইতি পুরাণে ॥ ৭ ॥
[আপস্তম্ব ধর্মসূত্র/প্রথম প্রশ্ন/দশম পটল/ঊনবিংশতি খণ্ড/৭ নং শ্লোক]
অর্থ — যদি কেউ আত্মরক্ষার্থে আগত আক্রমণকারীকে বধ করে, তবে এটি পাপ নয়, এটি "ক্রোধের বিপরীতে ক্রোধ"। এই নীতিবচন পুরাণে বলা আছে।
এবার দেখুন 👉 আপস্তম্ব ধর্মসূত্র বলেছে যে, যে যেমন ব্যবহার করবে তার সাথে সেই ব্যবহার করতে হবে এমনটা নাকি পুরাণে বলা আছে।
চলুন দেখে নিই সত্যিই এমন কথা পুরাণে বলা আছে কি না ? 👇
কৃতে চৈবাত্র কর্তব্যমিতি নীতির্গরীয়সী । ৫৯
[তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/রুদ্র সংহিতা/কুমারখণ্ড/অধ্যায় ১৪]
☘️সরলার্থ - যে যেমন ব্যবহার করে তার সাথে তেমনই ব্যবহার করা উচিত - এই নীতিই সর্বশ্রেষ্ঠ ।৫৯
— এবার পাঠকবৃন্দ ভেবে দেখুন ! শাস্ত্রের বচনের সাথে পুরাণেও মিল পাচ্ছেন।
👉উপরে উল্লেখিত সকল শাস্ত্রে পুরাণ বলতেই অষ্টাদশ পুরাণকেই বোঝায়। এই মত আচার্য মিতাক্ষরও স্বীকার করে গেছেন —
বাকোবাক্যেতিহাসপুরাণকুশলঃ ॥ ৬ ॥
[গৌতম ধর্মসূত্র/১ম প্রশ্ন/৮ম অধ্যায়/৬নং সূত্র]
মিতাক্ষর ভাষ্য : বেদশাস্ত্রোপযোগোনি তর্কোক্তিপ্রত্যুক্তিরূপাণি বাক্যানি।
যথা মহাভারতে — “কঃ স্বিদ্ একাকী চরতী? সূর্য একাকী চরতি” ইত্যাদীনি বাকোবাক্যম্।
ভারতরামায়ণাদীনি ইতিহাসঃ।
পুরাণং বিষ্ণুপুরাণশিবপুরাণাদ্যষ্টাদশবিধম্।
তেষু কুশলঃ সমর্থঃ ॥ ৬ ॥
মিতাক্ষর ভাষ্যের অনুবাদ : যে ব্যক্তি বেদ ও শাস্ত্রের প্রয়োগ, তর্ক, যুক্তি ও প্রতিউত্তরের রূপে প্রকাশিত বাক্যসমূহে (বাকোবাক্য) পারদর্শী,
যেমন— মহাভারতে বলা হয়েছে — “কে একাকী বিচরণ করে?” — “সূর্য একাকী বিচরণ করে”— এইরূপ বাক্যসমূহই “বাকোবাক্য” নামে পরিচিত।
ভারত ও রামায়ণ প্রভৃতি গ্রন্থসমূহকে বলা হয় ইতিহাস,
এবং বিষ্ণুপুরাণ, শিবপুরাণ প্রভৃতি আঠারো পুরাণই “পুরাণ” নামে প্রসিদ্ধ।
যে ব্যক্তি এসব বিষয়ে কুশল ও সমর্থ — সে প্রকৃত পণ্ডিত।
শ্লোকের অর্থ — বাকোবাক্য (বেদশাস্ত্র-সম্পর্কিত তর্কোক্তির বচন), ইতিহাস (মহাভারত ও রামায়ণ), তথা পুরাণসমূহের পণ্ডিত হও ॥ ৬ ॥
🔥আচার্য মিতাক্ষরের ব্যাখ্যা—
যিনি বাক্য ও বাক্যার্থ অর্থাৎ বেদ, শাস্ত্র, উপযোগিতা, তর্ক, যুক্তি ও প্রত্যুক্তির দ্বারা গঠিত বাক্যসমূহের (যেমন— ‘कः स्विदेकाकी चरति? सूर्य एकाकी चरति’ ইত্যাদি মহাভারতের সংলাপ) গভীর জ্ঞান রাখেন যিনি ইতিহাস মহাভারত ও রামায়ণ ইত্যাদি গ্রন্থসমূহের অর্থ ও উদ্দেশ্য বুঝতে পারদর্শী, এবং যিনি পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, শিবপুরাণ সহ আঠারোটি মূল পুরাণ ইত্যাদির মর্মজ্ঞ, তাঁকেই বলা হয় “वाकोवाक्येतिहासपुराणकुशलः” অর্থাৎ, যিনি বাক্যতত্ত্ব, ইতিহাস ও পুরাণে পারদর্শী ও পণ্ডিত।
এই গুণ একজন আদর্শ পণ্ডিত বা তাত্ত্বিকের মধ্যে থাকা প্রয়োজন, কারণ এঁরাই শাস্ত্রানুসারে যুক্তিপূর্ণভাবে তর্ক-বিতর্ক ও সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম হন।
অর্থাৎ— যিনি বেদ ও শাস্ত্রের বাক্যগুলির (যুক্তি ও প্রতিযুক্তি সহ) গভীর অর্থ বোঝেন, রামায়ণ-মহাভারতের ইতিহাস জানেন এবং পুরাণসমূহে পারদর্শী, তিনিই প্রকৃত 'বাকোবাক্যেতিহাসপুরাণকুশলঃ'।
🔥অর্থাৎ ব্যাপারটা এখন দিনের আলোর ন্যায় পরিস্কার বেদে উল্লেখিত পুরাণ বলতে অষ্টাদশ পুরাণই।
👉ইতিহাস শাস্ত্র মহাভারতেও পুরাণের আলাদা মাহাত্ম্য বলেছে —
গান্ধর্বশাস্ত্রঞ্চ কলাঃ পরিজ্ঞেয়া নরাধিপ।
পুরাণমিতিহাসাশ্চ তথাখ্যানানি যানি চ॥১৪৭৷৷
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/৯১/১৪৭]
অর্থ — আর নরনাথ! গান্ধর্ব্বশাস্ত্র, কলাশাস্ত্র, পুরাণ, ইতিহাস এবং যে কিছু উপাখ্যান আছে, তাহাও তুমি শিক্ষা করিবে ॥১৪৭৷৷
অর্থাৎ পুরাণ যদি ব্রাহ্মণ গ্রন্থ হতো তবে আলাদা ভাবে বলতো। কিন্তু কোথাও ব্রাহ্মণের সাথে পুরাণকে এক করে বলেনি। এবং পুরাণ ও ইতিহাস সবসময় একসাথেই উল্লেখ করেছে শাস্ত্রে। ব্রাহ্মণ যদি পুরাণ হতো তবে ইতিহাসের সাথে তুলনা করে বলতো না। কিছু সাধারণ বিষয় সহজেই বুঝে নেবার জন্য থাকে। জেনেও যদি না বোঝার ন্যায় করে তাহলে তাদের, জ্ঞানপাপী বলাটাই যুক্তিযুক্ত হবে।
👉আর এই পুরাণই যে অষ্টাদশ পুরাণ তা মহাভারতেরই প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ হয় যায়—
অষ্টাদশ পুরাণানি ধর্ম্মশাস্ত্রাণি সর্বশঃ ।
বেদাঃ সাঙ্গাস্তথৈকত্র ভারতং চৈকতঃ স্থিতম্ ॥৪৫॥
শ্রূয়তাং সিংহনাদোঽয় মৃষেস্তস্য মহাত্মনঃ ।
অষ্টাদশ পুরাণানাং কর্ত্তুর্বেদমহোদধেঃ ॥৪৬॥
[মহাভারত/স্বর্গারোহণপর্ব/অধ্যায় ৫/৪৫-৪৬]
নীলকন্ঠ টীকা - ভারতকৌমুদী—
অষ্টাদশপুরাণানি ব্রাহ্ম- পাদ্মাদীনি, ধৰ্ম্মশাস্ত্রাণি মম্বাদীনি অঙ্গৈঃ শিক্ষা - কল্পাদিভিঃ সহেতি সাঙ্গাঃ, বেদা ঋগাদযশ্চত্বারঃ। এতৎ সর্ব্বম্ একত্র তুলাদণ্ডলম্বিত একস্মিন্ পাত্রে এতদ্ ভারতঞ্চ, একত একত্র তদ্ দ্বিতীয়পাত্রে স্থিতম্ । তত্র মহাভারতমেবাধিক জাতমিত্যশয়ঃ ॥৪৫
শ্রূয়তাং। অষ্টাদশপুরাণানাং কর্ত্তু প্রণেতুঃ, বেদানাং মহোদধেঃ সর্ব্ববেদ নিধে-রিত্যর্থঃ। মহাত্মনস্তস্য ঋষের্বেদব্যাসস্য, অয়ং সিংহনাদঃ সিংহনাদবদ্ গর্বসূচক উচ্চরবঃ, শ্রুয়তাং ভবদ্ভিঃ ॥৪৬
অর্থ — অষ্টাদশ পুরাণ, সমস্ত ধর্মশাস্ত্র এবং অঙ্গশাস্ত্রের সহিত চারটি বেদ তুলাদণ্ডলম্বিত এক পাত্রে ছিল, আর এই মহাভারত তাহারই অন্য পাত্রে রহিয়াছিল (তখন মহাভারতই ভারে অধিক হইয়াছিল) ॥৪৫॥
অষ্টাদশপুরাণ প্রণেতা, বেদের মহাসাগর সেই মহাত্মা বেদব্যাসের এই সিংহনাদ আপনারা শ্রবণ করুন ॥৪৬॥
🔥যেসব জ্ঞানপাপীরা বলেন পুরাণ বলতেই অষ্টাদশ পুরাণকে বোঝায় না তাদের উদ্দেশ্যে বলি— ব্রাহ্মণ বলতেই বেদ। ব্রাহ্মণ গ্রন্থের সংখ্যা (প্রধান)—
ঋগ্বেদ— ২টি
যজুর্বেদ— ৫টি (প্রায়)
সামবেদ— ৪-৫টি
অথর্ববেদ— ১টি
এভাবে প্রত্যেকটা কোথাও আলাদা করে উল্লেখিত করে না। তা নিজ জ্ঞানে বুঝে নিতে হয়। ইতিহাস বলতেও বেদের মধ্যে কোথাও রামায়ণ/ মহাভারত/ শিবরহস্য মহা ইতিহাস এভাবে বলা থাকে না সেটাও নিজ জ্ঞান ও আচার্যদের ভাষ্য দ্বারা বুঝে নিতে হয়। ঠিক একই ভাবে বেদে পুরাণ বলতে অষ্টাদশ পুরাণকেই বুঝে নিতে হবে। তার জন্য আমাদের পূর্ব আচার্যরা নিজেদের ভাষ্য দিয়ে গেছে বিভিন্ন শাস্ত্রে। তাই একচেটিয়া সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে বিষয়টা ভাবতে হবে যে- আচার্য্যরা কেন বলে গেছেন, নিশ্চয় তারা জ্ঞানহীন ছিলেন না।
——————————
🔴আপত্তি — বর্তমানের আর্যসমাজের মতো অসনাতনী ব্যক্তিরা শাস্ত্র বাক্যের অর্থকে বিকৃত করে প্রচার করছে পুরাণ হলো ব্রাহ্মণ গ্রন্থ। তাই বেদে পুরাণ বলতে ১৮ পুরাণ নয়, কেবল ব্রাহ্মন গ্রন্থকেই বোঝানো হয়েছে। কারণ ব্রাহ্মণ গ্রন্থেও প্রাচীন সময়ের ঈশ্বরের লীলার বিভিন্ন উল্লেখ আছে। তাই পুরাতন ঘটনার উল্লেখ আছে বলেই নাকি ব্রাহ্মণ গ্রন্থই হলো পুরাণ। বেদব্যাস কতৃক সংকলিত পুরাণ নাকি প্রক্ষিপ্ত অর্বাচীন। এবং তাদের এই মনগড়া দাবীকে স্থাপিত করতে নিরুক্ত ও তৈত্তিরীয় আরণ্যক এর খণ্ডিতাংশ দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে পুরাণকে কাল্পনিক প্রমাণ করছে।
👉তার এই প্রমাণকে স্থাপিত করতে তৈত্তিরীয় আরণ্যকের যে উদ্ধৃত ব্যবহার করে তা হলো—
তৈত্তিরীয় আরণ্যক এর ২/৯ এ স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে---
"ব্রাহ্মণানোতিহাসান্ পুরাণাদি কল্পানি
কল্পনা গাথানারাশংসীরিতি"।।
অনুবাদঃ ব্রাহ্মণ গ্রন্থসমূহেরই পুরাণ, ইতিহাস, কল্প, গাথা ও নারাশংসী এই পাঁচ নাম।।
{[{ সুতরাং এটা পরিস্কার যে--- বেদ, উপনিষদ ও মহাভারতে উল্লেখিত পুরাণ হলো "ব্রাহ্মণগ্রন্থসমূহ"। যা প্রমাণ্য এবং নির্ভরযোগ্য।
✅ আপত্তি নিরসন — প্রথমে বলে রাখা ভালো যে, আমি শুরুতেই পুরাণ যে স্বতন্ত্র একটা শাস্ত্র তা সকল প্রকার শাস্ত্র প্রমাণ দ্বারা দেখিয়েছি। যদি না দেখে থাকেন, তাহলে আরও একবার দেখে নিতে পারেন। তাই এখানে আবারও অপযুক্তি কাজে লাগিয়ে পুরাণকে ব্রাহ্মণ প্রমাণ করার কায়দা আর চলবে না। যাইহোক! এবার দেখে নেবো তৈত্তিরীয় আরণ্যকে মূলত কি বলা হয়েছে এবং সেই সাথে সায়ণভাষ্যও দেখে নেবো—
যহ চে অধ্যগীষত তাঃ পৰ্য আহুতয়ো দেবানামভবন্।
যদ্ যজুংষি ঘৃতাহুতয়ো যদ্ সামানি সোমাহুতয়ো
যদ্ অৰ্থবাঙ্গিরসো মধ্বাহুতয়ো
যদ্ ব্রাহ্মণানীতিহাসান্ পুরাণানি কল্পান্ গাথা নারাশংসোঃ মেধাহুতয়া দেবানামভবন্তাভিঃ শ্ৰুধং পাশ্জ্ঞানমাঘ্নন্ন্ অপহতপাপ্মানা দেবাঃ স্বর্গলোকমায়ন্।
ব্রহ্মণঃ সায়ুজ্যম্মৃর্ষয়োঽগচ্ছন্ন্ ॥ ৬ ॥
[তৈত্তিরীয় আরণ্যক/২/৯/৬]
অর্থ— এই যজ্ঞ-অংশে (আ-হুতি/আহুতি) যখন দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রদান করা হয়, তখন যজ্ঞে যেসব যজু: মন্ত্র ব্যবহৃত হয়, যেসব সাম গান গাওয়া হয়, যেসব ঋচা ও অর্থব শব্দ (ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদের মন্ত্র), যেসব বাণী আঙ্গিরস ঋষিরা উচ্চারণ করেন, মধুর বাণী ও হুত (আহুতি), এবং ব্রাহ্মণ, ইতিহাস, পুরাণ, সংহিতা, গাথা, নারাশংসি, এই সবই যেন ইন্দ্রের (বা ঈশ্বরের) উদ্দেশ্যে আহুতি স্বরূপ হয়ে দেবতাদের কাছে পৌঁছায়। এই সমস্ত শ্রুতি ও আখ্যান দ্বারা পাপ নাশ করে দেবতারা স্বর্গলোকে প্রবেশ করেন, এবং ব্রহ্মার সহিত একাত্ম হয়ে পরম গন্তব্যে পৌঁছান।"
👉সায়ণাচার্য এই প্রসঙ্গে কি বলেছেন তা দেখে নেবো—
পাদবদ্ধমন্ত্রাঃ 'ঋচঃ', 'তা অধ্যগীষত' যে তে ঋষযোঽধীতবন্ত ইতি যদস্তি তা অধ্যয়নক্রিয়াঃ, 'দেবানাং', চোরদ্রব্যাহতযঃ 'অভবন্', তদাইত্যা যা তুষ্টিঃ সা তেষাম্ মৃগধ্যয়নেন সম্পন্না। এতদন্যচাপি যোজ্যং॥ অথর্বভিরঙ্গিরোভিশ্চ দৃষ্টা মন্ত্রাঃ 'অথর্বাঙ্গিরসঃ'। 'ব্রাহ্মণানি' কর্মচোদনা, বায়ব্যঃ শ্বেতমালভেতে ত্যাদয়ঃ। 'দৃতিহাসাঃ' মহাভারতাদয়ঃ। 'দেবা সুরাঃ সংযত্তা আসন্' ইত্যাদয়ঃ। 'শ্রাত্মা বা ইদমেক এবাগ্র আসীন্নৈবেহ কিঞ্চনায়' ইত্যাদীনি সৃষ্ট্যাদিপ্রতিপাদকানি 'পুরাণানি'। 'কল্পাঃ' কল্পসূত্রাণি প্রয়োগপ্রতিপাদকানি। 'গাথাঃ' 'গায়তি চোদিতা মন্ত্রবিশেষাঃ', 'যাস্য কোষ্ট্যেত্যাদয়ঃ'। 'যমগাথাভিঃ পরিগায়তীতি' বিধানাৎ। 'নারাশংসীঃ' নারাশংস্যঃ, 'হোতা যব্যন্নরাশংসমিত্যাদ্যাঃ'। 'ব্রাহ্মণান্তপঠিতানামপি পুনরুক্তিঃ ফলাতিশযদ্যোতনায়েং'। 'মদাউতযঃ' মাংসাহতয়ঃ, 'তাভিঃ' আজতিভিঃ, 'দেবাঃ' ক্ষুদ্রূপং 'পাপ্মানং' বিনাশিতবন্তঃ। 'স্বাধ্যায়জন্যত্তৃপ্যা' ক্ষুধং বিস্মৃতবন্তঃ ততঃ ক্ষুদ্রূপপাপরহিতাঃ 'দেবাঃ' সুখমনুভবিতুং 'স্বর্গং', গতাঃ। 'ঋষযঃ' চ পুত্রীক্ত, অধ্যয়নেন ব্রহ্মযজ্ঞেন জগৎ কারণস্য 'ব্রহ্মণঃ' 'মসায়ুজ্যং' প্রাপ্তাঃ। 'ব্রহ্মজ্ঞানোৎপাদনদ্বারা মুক্তিহেতুত্বং ব্রহ্মযজ্ঞস্য যুক্তং'। অতএব 'জ্ঞানসাধনেষু' 'প্রাথম্যেন বেদানুবচনে' 'বাজসনেয়িনঃ' সমামনন্তি — 'তমেতং বেদানুবচনেন ব্রাহ্মণা বিবিদিষন্তি, যজ্ঞেন দানেন ন তপসা নাশকেন' ইতি ॥
"ঋচঃ", "তা অধ্যগীষত" — এই শব্দগুলো থেকে বোঝায়, ঋষিরা (যাঁরা মন্ত্র রচনা করেছেন) তারা ঋক্ মন্ত্রগুলি অধ্যয়ন করেছেন। " তা অধ্যয়ন ক্রিয়াঃ" মানে সেই অধ্যয়নের কর্ম। "দেবানাং অভবন্" — এর দ্বারা বোঝায়, দেবতাদের তুষ্টি (সন্তুষ্টি) লাভ হয়েছে, ঠিক যেমন কোনো চোরের জিনিস ফেরত পেলে সে সন্তুষ্ট হয়। "মৃগধ্যয়নেন সম্পন্না" — এই তুষ্টি বা লাভ, যেন মৃগ শিকার করে যেরকম তৃপ্তি পাওয়া যায়, সেইরকম অর্জিত হয়েছে। “অথর্বাঙ্গিরসঃ” — 'অথর্ববেদ' এবং 'অঙ্গিরস' ঋষিদের দ্বারা দৃষ্ট মন্ত্র বোঝানো হচ্ছে। “ব্রাহ্মণানি” — ব্রাহ্মণ গ্রন্থসমূহ, যা কর্মের নির্দেশ দেয়; যেমন — 'বায়ব্য শ্বেতমালভেত' ইত্যাদি নির্দেশ।
"इतिहासाः" — মহাভারত ও অনুরূপ গ্রন্থাদি। “পুরাণানি” — যেমন: “আত্মা বা ইদমেক এবাগ্র আসীৎ…” — এই ধরণের আদি সৃষ্টির বর্ণনা যা পুরাণে পাওয়া যায়। “কল্পাঃ” — কল্পসূত্র বা নিয়মের গ্রন্থ যা যজ্ঞ প্রয়োগ ও আচরণ বোঝায়। “গাথাঃ” — গীত বা মন্ত্রবিশেষ, যেমন — 'যাস্য কোষ্ঠী' ইত্যাদি; এগুলো গাথা নামে পরিচিত। "নারাশংসীঃ" — 'নারাশংস্য' বচনসমূহ, যা হোতা পুরোহিত উচ্চারণ করেন, যেমন — "যব্যন্নরাশংসম্"।
পুনরুক্তি (পুনরাবৃত্তি) — যদিও এগুলো ব্রাহ্মণ অংশেও থাকে, তবে এখানে আবার বলা হয়েছে ফলবিশেষ স্পষ্ট করার জন্য। “মধ্বাহুতয়ঃ” — 'মধুর' আহুতি; আবার এর অর্থ 'মাংসের আহুতি'ও হতে পারে। এগুলির দ্বারা দেবতারা পাপ-রূপ ক্ষুধাকে দমন করেন। “স্বাধ্যায় জন্য তৃপ্ত্যা” — আত্মপাঠ বা স্বাধ্যায়ের মাধ্যমে তৃপ্তি লাভ করে দেবতারা ক্ষুধা ভুলে যান এবং পাপ থেকে মুক্ত হন। "স্বর্গলোকম্" — পাপমুক্ত হয়ে দেবতারা স্বর্গলোকে গমন করেন। "ঋষয়ঃ" ব্রহ্মযজ্ঞের মাধ্যমে “ব্রহ্মণঃ সায়ুজ্যং” প্রাপ্তাঃ — অর্থাৎ ঋষিরা ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মতা (মুক্তি) অর্জন করেন।
ব্রহ্মজ্ঞান ও মুক্তির সম্পর্ক — এই বক্তব্য দ্বারা বলা হচ্ছে, ব্রহ্মজ্ঞানই মুক্তির উপায় এবং এজন্যই জ্ঞানসাধনে বেদ শ্রবণ, অধ্যয়ন, ও অনুশীলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে যজুর্বেদের বেদানুবচন বা পাঠ প্রক্রিয়াকে প্রধানভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেমন — “তমেতং বেদানুবচনেন ব্রাহ্মণা বিবিদিষন্তি, যজ্ঞেন দানেন ন তপসানাশক্যেন। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ/৪/৪/২২” — ব্রাহ্মণেরা এই ব্রহ্মতত্ত্বকে বেদানুবচনের মাধ্যমে জানতে চান, যজ্ঞ বা দান বা কঠিন তপস্যার মাধ্যমে নয়।
আচার্য সায়ণ নিজের ভাষ্য দ্বারা বোঝাতে চেয়েছেন যে, যজ্ঞের মাধ্যমে পাঠিত বিভিন্ন বেদ, ইতিহাস, পুরাণ, মন্ত্র সবই একপ্রকার আহুতি, যেগুলো পাপ নাশ করে, দেবতাদের তুষ্ট করে, এবং ঋষিদের ব্রহ্মজ্ঞান ও মুক্তি লাভের পথ প্রশস্ত করে। এটি আত্মজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব এবং বেদপাঠের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
🔥এখানে সায়ণাচার্য বিষয়টা পরিস্কার করে বলে দিয়েছে। এবং ব্রাহ্মণ ও পুরাণের আলাদা মাহাত্ম্যও তুলে ধরেছে। ব্যাপারটা দিনের আলোর মতো পরিস্কার যে- ব্রাহ্মণ এবং পুরাণ দুইটা আলাদা গ্রন্থ। তাহলে দেখা যাচ্ছে সেসব অসাধু আর্যসমাজী ব্যক্তিগণ ধর্ম প্রচারকে ঢাল বানিয়ে কেবল মিথ্যাচার ছড়াচ্ছে। অর্থাৎ অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী।
👉এবার দেখে নেওয়া যাক মহর্ষি যাস্ক কি বলছেন—
“ পুরাণ নামান্যুত্তরাণি ঘটু। ২৮।
পুরাণং কস্মাৎ পুরা নবং ভবতি। ২৯। ”
[যাস্ক নিরুক্ত/৩/১৯]
অনুবাদ : ‘পুরাণ’ শব্দের অর্থ — প্রাচীন হলেও তা নতুনভাবে উপস্থাপিত জ্ঞান, ইতিহাস বা কাহিনি। এটি ধর্মীয় ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং এর মূলে রয়েছে সমাজের সাংস্কৃতিক স্মৃতি।
👉সেই অসাধু ব্যক্তিরা উক্ত নিরুক্ত প্রমাণকে দৃশ্যমান করেই নিজেদের অবান্তর দাবীকে জোরপূর্বক স্থাপন করার বৃথা প্রয়াস করে। কেননা, তাদের যে দাবী যে- ব্রাহ্মণ গ্রন্থে প্রাচীন ঘটনা আছে বলেই ব্রাহ্মণকে পুরাণ বলা হয়। আমিও বলি হ্যাঁ ঠিক আছে প্রাচীন ঘটনা আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এমন হলে বেদের মন্ত্রভাগ ও উপনিষদকেও পুরাণ বলেই মানতে হবে। কেননা ওখানেও বহু প্রাচীন ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই, এখানে কেবল একচেটিয়া ভাবে ব্রাহ্মণকে পুরাণ বললে তা গ্রহণ যোগ্য হবে না। যাইহোক এবার আসা যাক মূল বিষয়ে —
🔴 কেন ব্রাহ্মণ ≠ পুরাণ ?
উদ্দেশ্যগত পার্থক্য —
মূল উদ্দেশ্য —
ব্রাহ্মণ — যজ্ঞবিধান, আচার ও মন্ত্রের ব্যাখ্য
পুরাণ — সৃষ্টিতত্ত্ব, ধর্ম, নৈতিকতা ও ইতিহাস ব্যাখ্যা
মন্ত্রের প্রয়োগ—
ব্রাহ্মণ— বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে
পুরাণ— সচরাচর ব্যাখ্যা করে না
কাহিনীর ভূমিকা—
ব্রাহ্মণ— যজ্ঞের ব্যাখ্যায় সাহায্যকারী মাধ্যম
পুরাণ— মূল আখ্যান বা তত্ত্ব ব্যাখ্যার উপকরণ
রচনাশৈলী—
ব্রাহ্মণ— আচারনির্দেশে পূর্ণ, প্রায়শঃ জটিল যুক্তিবিন্যাসে রচিত।
পুরাণ— কাহিনিমূলক ; বৃহৎ বর্ণনা, অলঙ্কার ও নৈতিক উপদেশপূর্ণ।
সাহিত্যিক স্তরভেদ—
ব্রাহ্মণ হল বৈদিক সাহিত্যের অংশ
(সংহিতা → ব্রাহ্মণ → আরণ্যক → উপনিষদ),
আর পুরাণ হল উত্তরবৈদিক বা স্মৃতি সাহিত্য।
ঐতিহাসিক উপাখ্যানের উপস্থিতি—
ব্রাহ্মণে যে কাহিনি থাকে, যেমন নচিকেতা, মনু, ইন্দ্র, যজ্ঞের ফল, তা সবই আচারসংক্রান্ত শিক্ষা ও দর্শনের ব্যাখ্যা — এগুলো কল্পরূপে ব্যবহৃত হয়, ইতিহাস হিসেবে নয়।
পুরাণ কাহিনিকে অনেকাংশে লোকস্মৃতি ও নৈতিক ইতিহাস হিসেবে দেখায়।
যদিও ব্রাহ্মণ গ্রন্থে কিছু পুরাণসুলভ কাহিনি থাকে, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ও কাঠামো একেবারেই আলাদা। সেইজন্য ব্রাহ্মণকে কখনোই পুরাণ বলা যাবে না, ঠিক যেমন উপনিষদকে মহাকাব্য বলা যায় না, যদিও তাতে উপাখ্যান আছে।
প্রশ্ন—তাহলে এখানেও একটা প্রশ্ন উপস্থিত হয় যে নিরুক্ত মতে তবে পুরাণ বলতে কি বুঝিয়েছে?
উত্তর— আমি ইতিমধ্যেই পুরাণ আর ব্রাহ্মণের ভেদ টা দেখিয়েছি। কেন ব্রাহ্মণ পুরাণ নয়, এবং শুরুতেই বিভিন্ন শাস্ত্র থেকেও শব্দপ্রমাণ দেখিয়েছি ব্রাহ্মণ হলো বেদ পুরাণ নয়। তারপরেও এখানেও ছোট্ট একটু ব্যাখ্যা৷ করবো —
‘পুরাণের পাঁচ লক্ষণ আছে— সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বন্তর, বংশানুচরিত।
এইগুলি ব্রাহ্মণে অনুপস্থিত বা অপ্রধান।
ব্যুৎপত্তিগত অর্থে, “পুরাণ” শব্দ এমন জ্ঞান বোঝায় যা পুরাতন হয়েও নতুনভাবে প্রাসঙ্গিক, এই দৃষ্টিকোণে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের কিছু অংশ পুরাণধর্মী বলা যায়। যেমন—
"দেবদত্ত সিংহ সদৃশঃ" বললেও যেমন, দেবদত্ত সিংহ হয়ে যায় না, তেমনি- ব্রাহ্মণকে পুরাণধর্মী বললেও ব্রাহ্মণ পুরাণ হয়ে যায় না।
সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক শ্রেণিবিন্যাস অনুসারে, ব্রাহ্মণ কখনো পুরাণ নয়।
কারণ তারা আলাদা শ্রুতি ও স্মৃতি ধারার প্রতিনিধিত্ব করে।
🔴 অসঙ্গতি— পুরাণ অমান্যকারী ব্যক্তিদের মতানুযায়ী যদি, ব্রাহ্মণকে পুরাণ মানা হয় তবে তাতে ন্যায় বিরোধ দোষ আরোপিত হয়। কেননা মহর্ষি জৈমিনি পূর্বমীমাংসাতে বলেছেন—
" বিরোধে ত্বনপেক্ষ্যং স্যাদ্ অসতি হ্যনুমানম্ "
[পূর্বমীমাংসা সূত্র/১/৩/৩]
শ্রুতি আর স্মৃতির বিরোধ বাঁধলে স্মৃতিশাস্ত্র অপেক্ষার যোগ্য নয় অর্থাৎ স্মৃতিকে প্রমাণ হিসেবে ধরা যাবে না, এক্ষেত্রে স্মৃতি শাস্ত্র অপ্রমাণ হিসেবে পরিগণিত হবে। শ্রুতি আর স্মৃতির বিরোধ (অসতি) না হলে তবেই তা (স্মৃতি) অনুমানের যোগ্য অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য।
এবং এই একই সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিয়েছেন মহর্ষি বেদব্যাস। উনিও ব্যাস সংহিতা ১/৪ এ বলেছেন—
"শ্রুতি স্মৃতি পুরাণানাং বিরোধো যত্র দৃশ্যতে।
তত্র শ্রৌতং প্রমাণন্তু তয়োর্দ্বৈধে স্মৃতির্ব্বরা।।"
যেখানে শ্রুতি, স্মৃতি ও পুরাণের বিরোধ দেখা যায়, সেখানে শ্রুতির কথনই বলবান এবং যে স্থলে স্মৃতি ও পুরাণের বিরোধ দেখা যায়, সেখানে স্মৃতির কথনই বলবান।
👉এই মান্যতা মনুও স্বীকার করেছেন। এবার পুরাণ অমান্যকারীদের মতানুযায়ী ব্রাহ্মণ যদি পুরাণ হয়, তবে স্মৃতি শাস্ত্র দ্বারা ব্রাহ্মণ খণ্ডিত হয়ে যাবে। কারণ ন্যায় ও স্মৃতি একই মান্যতাকে মেনে চলে। আর যদি ব্রাহ্মণ খণ্ডিত হয় তবে, বেদের বচন মিথ্যা প্রমাণিত হবে এবং আপ্ত পুরুষবাক্যও খণ্ডিত হবে। আর যদি এমন হয়, তবে শাস্ত্র পরস্পর স্ববিরোধী হয়ে যাবে। কারণ ব্রাহ্মণ হলো বেদ আর বেদের বচন সর্বোচ্চ ও অকাট্য। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় স্মৃতি দ্বারা যদি ব্রাহ্মণ খণ্ডিত হয়, তবে কি পরমেশ্বর এর বচন মিথ্যা? আপ্তবাক্য মিথ্যা? বেদ শাস্ত্রই মিথ্যা? তাহলে এর উত্তরে কি বলবেন?
তাছাড়াও পুরাণের সম্পর্কে যেসব শাস্ত্র প্রমাণ উপস্থাপন করেছি এবং ব্রাহ্মণ গ্রন্থও বেদ তাও শাস্ত্র থেকে দেখিয়েছি, সেই শাস্ত্রকে যদি না মানে তাহলে আপনাদেরও নিকৃষ্ট গতিই হবে। কেননা ভগবদ্ গীতার ১৬ অধ্যায়ের ২৩/২৪ বলাই হয়েছে— মানুষের কর্তব্য অকর্তব্য নির্ধারণে শাস্ত্রই প্রমাণ। যারা শাস্ত্রের বাক্য মানবেনা তাদের পরাগতি অর্থাৎ সর্বোচ্চ মুক্তি প্রাপ্ত হবেনা। এবার তাদের বিষয়টা ভাবতে হবে তারা কি পরাগতি চায় ? নাকি চায় না ? !
আর্যসমাজীদের গুরু দয়ানন্দ সরস্বতী জী শুক্রনীতিকে মান্য শাস্ত্র হিসেবে বৈধতা দিয়েছেন সত্যার্থ প্রকাশ নামক পুস্তকের ষষ্ঠ সমুল্লাসের ১২৯ নং পৃষ্ঠায়। সেই হিসেবে শুক্রনীতির বচন মেনে নিতে বাধ্য আর্যসমাজীরা।
এবার দেখুন, পৌরাণিক ব্যক্তির লক্ষণ বলতে গিয়ে শুক্রনীতি বলছেন যে, পৌরাণিক ব্যক্তি পুরাণের সর্গ আদি পাঁচ লক্ষণ জানবেন, তবেই তিনি পৌরাণিক বলে গণ্য হবেন। প্রমাণ 👇
সাহিত্যশাস্ত্রনিপুণঃ সঙ্গীতজ্ঞশ্চ সুস্বরঃ ।
সর্গাদিপঞ্চকজ্ঞাতা স বৈ পৌরাণিকঃ স্মৃতঃ ॥ ১৭৯
[শুক্রনীতি/অধ্যায় ২]
অর্থ - যিনি 'কাব্যশাস্ত্রে সুনিপুণ, সঙ্গীতবেত্তা, মধুর স্বরশালী, এবং সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বন্তর, ও বংশানুচরিত, পুরাণের এই পাঁচ প্রকার লক্ষণ জ্ঞাতশীল হয়েন, তাহার নাম পুরাণ পাঠক পৌরাণিক ॥ ১৭৯
এবার প্রশ্ন হল পুরাণের পাঁচটি লক্ষণ কি কি ?
শুক্রনীতি পুরাণের পাঁচটি লক্ষণের প্রথম লক্ষণ ‘সর্গ’ বলে উল্লেখ করেছেন। সর্গ শব্দের অর্থ - সৃষ্টি। সুতরাং, সায়ণাচার্য তৈত্তিরীয় আরণ্যকের উক্ত মন্ত্রে উপস্থিত থাকা পুরাণ শব্দের ভাষ্যে ‘সৃষ্ট্যাদিপ্রতিপদকানি পুরাণানি’ অর্থাৎ সৃষ্টি ইত্যাদি প্রতিপাদিত হওয়া লক্ষণ সমন্বিত শাস্ত্রকেই পুরাণ বলা বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
এখন ব্রাহ্মণ গ্রন্থ যদি পুরাণ হয়ে থাকতো তবে শুক্রনীতি অনুসারে পুরাণের পাঁচটি লক্ষণ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে কোথায় আছে ?
পুরাণে পাঁচটি লক্ষণ ব্রাহ্মণের কোথাও নেই, বরং বর্তমানে পরিচিত ১৮টি পুরাণেই তা রয়েছে। যা বায়ুপুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে বলে প্রথমেই উল্লেখ করেছি, বায়ুপুরাণকে শিবপুরাণের বায়বীয় সংহিতার সমার্থক বলে। তাই এটি শিবমহাপুরাণের বায়বীয় সংহিতাতেও রয়েছে । দেখুন 👇
সর্গশ্চ প্রতিসর্গশ্চ বংশো মন্বন্তরাণি চ ।
বংশানুচরিতং চৈবং পুরাণং পঞ্চলক্ষণম্ ॥ ৪১
[শিব মহাপুরাণ/বায়বীয় সংহিতা/পূর্বখণ্ড/১ অধ্যায়/৪১ শ্লোক]
অর্থ — সৃষ্টি, সৃষ্টির প্রলয়, বংশ মন্বন্তর তথা বংশানুচরিত - এই পাঁচটি হল লক্ষণ হল পুরাণের।
আর্যসমাজীগণ শুক্রনীতির বচন মান্য করতে বাধ্য। আর এই কারণে শুক্রনীতির বচনের উপরে ভিত্তি করেই ব্রাহ্মণ যে পুরাণ নয় তা প্রমাণিত হয়।
——————————————————————————————————————————————
🔻পুরাণ ও ব্রাহ্মণ প্রসঙ্গে পাণিনীয় ব্যাখ্যা🔻
🔘 প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রসমূহের শ্রেণীবিন্যাস নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে “ব্রাহ্মণ” ও “পুরাণ” শব্দদ্বয়কে নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। অনেক সময় দেখা যায়, পুরাণকে ব্রাহ্মণকর্মের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু পাণিনীয় ব্যাকরণ, কাশিকা ভাষ্য এবং মহাভাষ্যের বিশ্লেষণ স্পষ্ট করে জানায়- ব্রাহ্মণ এবং পুরাণ এক নয়। ব্রাহ্মণ গ্রন্থ যজ্ঞ ও আচারকেন্দ্রিক, অপরদিকে পুরাণ আখ্যান, ইতিহাস ও দর্শনভিত্তিক। পাণিনী অষ্টাধ্যায়ীর সূত্র এবং ভাষ্যকারদের ব্যাখ্যা এই পার্থক্য সুস্পষ্ট করে।—
“পুরাণপ্রোক্তেষু ব্রাহ্মণকল্পেষু”
[পাণিনী /৪/৩/১০৫]
🔘 কাশিকা ভাষ্য—
“প্রত্যয়ার্থবিশেষণমেতত্। তৃতীয়াসমর্থাত্ প্রোক্তে ণিনিঃ প্রত্যয়ো ভবতি। যৎ প্রোক্তং পুরাণপ্রোক্তাশ্চেদ্ ব্রাহ্মণকাল্পাস্তে ভবন্তি। … প্রতিপদং ব্রাহ্মণেষু যঃ প্রত্যয়ঃ, তস্য তদ্বিষয়তা বিধীয়তে ণিনেঃ। অযঃ যাজ্ঞবল্ক্যশব্দস্য কণ্বাদিশু পাঠাদণ। … পুরাণ ইতি নিপাতনাত্ তুডভাবঃ। ন চাত্যন্তবাধৈব, তেন পুরাতনমিত্যপি ভবতি।”
এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে “ব্রাহ্মণেষু” যে প্রত্যয় প্রযোজ্য, তা শুধুমাত্র ব্রাহ্মণগ্রন্থের বিষয়বস্তুর জন্যই।
কিন্তু “পুরাণ” শব্দটি নিপাত (particle), অর্থাৎ এটি কেবল ‘প্রচলিত বা প্রাচীন’ নির্দেশক। তাই পুরাণকে ব্রাহ্মণগ্রন্থ বলে ধরার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
🔘 মহাভাষ্য—
“পুরাণপ্রোক্তেষ্বিতি যাজ্ঞবল্ক্যাদিভ্যঃ প্রতিষেধো বক্তব্যঃ। যাজ্ঞবল্ক্যাদি ব্রাহ্মণানি… তুল্যকালত্বাত্। এতান্যপি।”
অর্থাৎ ব্রাহ্মণের মতো সময়-নির্ধারিত নিয়ম পুরাণে প্রযোজ্য নয়।
মহাভাষ্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে যাজ্ঞবল্ক্যাদি ব্রাহ্মণ গ্রন্থের ক্ষেত্রে তুল্যকাল ভিত্তিক বিধি প্রযোজ্য। কিন্তু পুরাণের ক্ষেত্রে তুল্যকাল নেই, তাই পুরাণকে ব্রাহ্মণ বলে গণ্য করা যায় না।
◾ব্রাহ্মণগ্রন্থ আলাদা শাস্ত্র (যাজ্ঞিক, শৌলভ, ঐতরেয়িক)।
◾পুরাণ পৃথক শাস্ত্র, যেগুলি গল্প, ইতিহাস, দার্শনিক বর্ণনা এবং প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠানের বর্ণনা বহন করে।
পাণিনীর ভাষ্য স্পষ্টভাবে বলে- পুরাণ “নিপাত” অর্থে প্রাচীন বা প্রচলিত, ব্রাহ্মণ গ্রন্থের সাথে এটি যুক্ত নয়।
🔘 পাণিনী অষ্টাধ্যায়ীর অন্য আরেকটি সূত্রে বলা হয়েছে—
“ক্রতুক্থাদিসূত্রান্তাঠক্”
[পাণিনী /৪/২/৬০]
🔘 কাশিকা ভাষ্য—
“ক্রতুবিশেষবাচিভ্য উক্থাদিভ্যশ্চ সূত্রান্তাত্ চ ঠক্ প্রত্যয়ো ভবতি। …আখ্যানাখ্যায়িকেতিহাসপুরাণেভ্যষ্ঠগ্ বক্তব্যঃ। যাবক্রীতিকঃ, প্রৈযঙ্গভিকঃ, যায়াতিকঃ। আখ্যান… আখ্যায়িকা — বাসবদত্তিকঃ, সৌমনোত্তরিকঃ। ঐতিহাসিকঃ। পৌরাণিকঃ।”
🔘 মহাভাষ্য—
“উক্থাদিৎযুচ্যতে, যদ্যেং সামগমাত্রে ঔক্থিক ইতি প্রাপ্নোতি… ইহাস্মাভিস্ত্রৈশব্দ্যং সাধ্যম্ —উক্থান্যধীতে, ঔক্থিক্যমধীতে। … আখ্যানাখ্যায়িকেতিহাসপুরাণেভ্যষ্ঠক্। … ঐতিহাসিকঃ। পৌরাণিকঃ।”
এখানে পুরাণকে স্পষ্টভাবে আখ্যান/পৌরাণিক হিসাবে আলাদা করা হয়েছে। ব্রাহ্মণশাস্ত্রের মতো এটি নির্দিষ্ট যাজ্ঞিক নিয়মে আবদ্ধ নয়।
অর্থাৎ, পুরাণকে ব্রাহ্মণ বলে দাবি করা ভুল।
◾ব্রাহ্মণশাস্ত্র = নির্দিষ্ট রীতি ও যাজ্ঞিক বিধি।
যেমন— ভাল্লব, শাট্যায়ন, ঐতরেয় আদি ব্রাহ্মণ গ্রন্থ।
◾পুরাণ= আখ্যান, ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনী, প্রাচীন নির্দেশক বা নিপাত (“পুরাতন”)।
◾পাণিনী ৪/৩/১০৫ কাশিকা ভাষ্য- “পুরাণ ইতি নিপাতনাত্…..ন চাত্যন্তবাধৈব্ব…।”
পুরাণ শুধু প্রাচীন, ব্রাহ্মণ নয়।
◾পাণিনী ৪/২/৬০ কাশিকা ভাষ্য—
“আখ্যানাখ্যায়িকেতিহাসপুরাণেভ্যোষ্টক….পৌরাণিকঃ”
পুরাণকে আখ্যান বা পৌরাণিক শাস্ত্র হিসেবে আলাদা করা হয়েছে।
পুরাণকে ব্রাহ্মণশাস্ত্র বলা শাস্ত্রীয়ভাবে ভুল। পাণিনী ও মহাভাষ্য উভয়ই স্পষ্টভাবে ব্রাহ্মণ ও পুরাণকে আলাদা শাস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
◾ব্রাহ্মণ = নির্দিষ্ট রীতিসম্পন্ন, যাজ্ঞিক বিধি।
◾পুরাণ = আখ্যান, পৌরাণিক কাহিনী ও দর্শনমূলক শাস্ত্র।
✅ সিদ্ধান্ত—
পুরাণ এবং ব্রাহ্মণকল্প একে অপরের সমার্থক নয়।
পুরাণ মূলত কাহিনী ও ইতিহাসমূলক, ব্রাহ্মণকল্প মূলত যজ্ঞ ও ধর্মকর্মমূলক।
মহাভাষ্য স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছে, ‘ঠক্’ প্রত্যয় প্রয়োগের বিধান অনুযায়ী পুরাণ এবং ব্রাহ্মণকর্মের মধ্যে পার্থক্য স্থাপন করা যায়।
অতএব, পাণিনীয় শাস্ত্র ও কাশিকা ভাষ্য অনুযায়ী, পুরাণ কখনোই ব্রাহ্মণকর্ম বা ব্রাহ্মণকাল্পিক গ্রন্থ হিসেবে গণ্য হবে না।
পুরাণ ও ব্রাহ্মণকল্পের মধ্যে পার্থক্য বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। পাণিনী, কাশিকা ভাষ্য এবং মহাভাষ্যের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, পুরাণ শাস্ত্র মূলত কাহিনী, আখ্যান এবং ইতিহাস। এটি ব্রাহ্মণকর্মের উদ্দেশ্য বহন করে না। সুতরাং, পুরাণকে কখনও ব্রাহ্মণ বা ব্রাহ্মণকর্মমূলক গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করা যায় না।
——————————————————————————————————————————————
🔥তাই সকল শাস্ত্রের মন্থন করে জানা যায় ব্রাহ্মণ হলো বেদ, পুরাণ স্বতন্ত্র শাস্ত্র।
তাই—
ব্রাহ্মণ ≠ পুরাণ ❌
পুরাণ - এর অর্থ = সত্যযুগের অদ্বিতীয় একটি পুরাণই দ্বাপরযুগে বেদব্যাস দ্বারা বিভক্ত করে সংকলিত ১৮ পুরাণই ✔️
☀️ উপসংহার—
ঊর্ধ্বে উল্লিখিত সমস্ত বেদীয় ও স্মৃতিগত সূত্র, গৃহ্যসূত্র, ধর্মসূত্র এবং ঋষিদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে— পুরাণ, ইতিহাস, গাথা ও নারাশংসী গ্রন্থসমূহ শুধুমাত্র সাহিত্যিক উপাদান নয়, বরং এগুলি ধর্ম, নৈতিকতা, আচরণ ও বেদবাহ্য জ্ঞানের অনুষঙ্গ। এদের প্রতি সম্মান, পাঠ এবং আচরণে প্রয়োগ শ্রুতির পাশাপাশি স্মৃতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
দর্শনশাস্ত্র অনুসারে জ্ঞানের উৎস বা প্রমাণ ছয়টি— প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ, উপমা, অনুমান, অর্থাপত্তি ও শব্দ। এদের মধ্যে শ্রুতি তথা বেদীয় শব্দপ্রমাণ সর্বোচ্চ। মীমাংসা ও ন্যায় দর্শন এই ‘শব্দপ্রমাণ’-কে আপ্তবাক্য বলেই গ্রহণ করে, যা স্বয়ং পরমেশ্বর অথবা তাঁর দ্বারা প্রেরিত ঋষিদের জ্ঞান থেকে উদ্ভূত।
পরমেশ্বর বাক্য — পরম আপ্ত
ঋষি বাক্য — আপ্ত
এই প্রেক্ষিতে পুরাণ ও ইতিহাস যখন বেদসম্মত গ্রন্থ হিসেবে প্রতিপন্ন হয়, তখন সেগুলিও দর্শনের বিচারধারায় প্রামাণ্য রূপে স্থাপিত হয়।
গোপথব্রাহ্মণ, ঋগ্বেদ, উপনিষদ, গৃহ্যসূত্র প্রভৃতি শাস্ত্রে যেহেতু ‘ইতিহাস’, ‘পুরাণ’, ‘গাথা’ এবং ‘নারাশংসী’-কে বেদসমূহের অঙ্গ বা সমান্তরাল জ্ঞানধারা বলে অভিহিত করা হয়েছে, সেহেতু দর্শন মতে এগুলোও শব্দপ্রমাণ হিসেবে স্বীকৃত হয়। দর্শনের ভাষায়, যদি কোনো জ্ঞান উৎস আপ্ত হয় এবং তাতে বৈরুদ্ধ্য না থাকে, তবে তা অনর্থক নয়, বরং অব্যভিচারী প্রমাণ।
নৈয়ায়িকেরা যেমন যুক্তির মাধ্যমে তর্ক করেন, তেমনি তাঁরা শব্দপ্রমাণ দ্বারা যুক্তির সীমা অতিক্রম করেন। যেহেতু পুরাণ ও ইতিহাস শাস্ত্রগম্য ও আপ্তবাক্যসম্মত, তাই তাদের অবমূল্যায়ন দর্শনের মূলনীতির বিরোধীতা। তদুপরি, দর্শনের আর এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ হলো—
“সত্যং শিবং সুন্দরম্” যা সত্য, তা শুভ এবং যা শুভ, তা সুন্দর। পুরাণ এই ত্রয়ীর পরিপূর্ণ প্রকাশ, কারণ এটি কেবল তথ্য নয়, ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, আধ্যাত্মিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষাও প্রদান করে।
অতএব, দর্শন মতে যেকোনো প্রমাণযোগ্য ও অনবস্য যথার্থ জ্ঞান যদি বেদে ও আপন জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তা পরমার্থতঃ গ্রহণীয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে নির্ভয়ে বলা যায়—
পুরাণ ও ইতিহাস, এগুলি নিছক লোকরঞ্জনের উপকরণ নয়, বরং বেদসম্মত, শব্দপ্রমাণসমর্থ এবং দর্শনসম্মত শাস্ত্র, যা পরমার্থসাধনায় অমূল্য সহায়ক।
✅ সিদ্ধান্ত—
১. পুরাণ সম্পূর্ণ মান্য স্বতন্ত্র শাস্ত্র।
২. যারা পুরাণের প্রামাণিকতা স্বীকার করেনা তারা বেদবিরুদ্ধ, ন্যায় বিরুদ্ধ।
৩. সকল শাস্ত্রের প্রাকট্য পরমেশ্বর শিব থেকে।
৪. ব্রাহ্মণ হলো বেদ তাই ব্রাহ্মণকে পুরাণ বলা অযৌক্তিক ও শাস্ত্র বিরুদ্ধ।
——🙏সর্বে হ্যেষ রুদ্র তস্মৈ রুদ্রায় নমো অস্তু🙏——
শ্রীগুরু দক্ষিণামূর্তয়ে নমঃ 🚩
ॐ সাম্বসদাশিবায় নমঃ 🚩🙏
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে ✊🚩
হর হর মহাদেব 🚩
✍️অপপ্রচার দমন ও লেখানীতে — অন্তিক ভট্টাচার্য্য (শম্বরনাথ শৈব),
সম্পাদনায় — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য গুরুদেব জী,
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ— আমার গুরু শ্রী নন্দীনাথ শৈবাচার্য জী ও আমার আদর্শ শ্রী রোহিত কুমার চৌধুরী শৈবজীকে 🙏
কপিরাইট ও প্রচারেঃ— International Shiva Shakti Gyan Tirtha (আন্তর্জাতিক শিব শক্তি জ্ঞান তীর্থ)
বিঃ দ্রঃ— লেখাটি কপি করলে সম্পূর্ণ কপি করবেন, কোনো রকম কাটাছেঁড়া করা যাবে না।
শিবঃ ॐ.......🙏


পুরাণের প্রামাণিকতার উপর পুরো ভাষ্য লিখে ফেলেছ তো। আর্যসমাজী গুলো তো এরপর সমাজ থেকে বহিষ্কৃত না হয়ে যায় গণ প্যাদানি খেয়ে। অঙ্গ (বেদাঙ্গ) আর উপাঙ্গ (ইতিহাস, পুরাণ, ন্যায় আর মীমাংসা) দ্বারাই বেদ বিচার্য, তাই অঙ্গের পাশাপাশি উপাঙ্গও মান্য সনাতন পরম্পরায়। সেক্ষেত্রে উপাঙ্গ শাস্ত্রের কিছু জিনিস কে মানবো (যেমন - ন্যায়, মীমাংসা, ইতিহাস) আর বাকি গুলিকে মানবো না, প্রক্ষিপ্ত বলে চালাবো (পুরাণ), সেটা তো আর্যনামাজী গুলোর মামার বাড়ির আবদার নয়, এতে ওদের উপর অর্ধজড়তীয়তা দোষ লাগে, ফলত ওদের এসব দাবী স্বতঃ ত্রুটিপূর্ণ ও খণ্ডিত।
উত্তরমুছুন