শিবের কাছে কোনো জাতের বিচার নেই, শিবভক্ত মাত্রেই শিবের প্রিয়
ভূমিকা — প্রভু শিব হলেন সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর, কিন্তু তিনি কি জীবের জাতের কর্তৃত্ব বা অবস্থা দেখে তার উপর বিচার করে কৃপা করেন ? নাকি যে কোনো ব্যক্তিই তার শরণাপন্ন হলে তিনি কৃপা করেন ? এবিষয়ে শাস্ত্র কি বলছে তা আমরা দেখবো।
________________________________________________
সপ্তর্ষি যখন মা পার্বতী কে মহাদেব বিষয়ে নিন্দা করেছিল, তখন মা পার্বতী বিভিন্ন উত্তর দিয়ে ছিলেন, তার মধ্যে তিনি এই বিষয়ে একটি বচন বলেছেন, দেখুন 👇
গুরোরনুগ্রহেণৈব শিবং জানামি তত্ত্বতঃ ॥ ৬৭॥
[শিব মহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/পার্বতীখণ্ড/২৫ অধ্যায়]
অর্থ — মা পার্বতী বললেন — হে দ্বিজগণ! জাতের ধর্ম ইত্যাদির দ্বারা শম্ভুর কৃপা লাভ হয় না ; আমি তো গুরুর অনুগ্রহ দ্বারাই শিবকে তত্ত্বতঃ (সত্যভাবে) জানতে পেরেছি।
শ্রী নন্দীনাথশৈবাচার্যকৃত ব্যাখ্যা :
পরমেশ্বর শিব মায়ার দ্বারা নিজের অন্তরেই জগত সৃষ্টি করেছেন, তাই সমগ্র জগতের উৎপত্তিকর্তা হলেন প্রভু শিব, তিনি বিভিন্ন রূপ প্রকট করে নিজেকেই ব্রহ্মা-বিষ্ণু রুদ্র শক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন নামে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। মায়ার জগতে অজ্ঞানের বশীভূত জীব সত্তাকে পুনরায় এক ও দ্বিতীয় শিবস্বরূপে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি এই দেবদেবীর স্বরূপ গুলি ধারণ করে তাদের মাধ্যমে শিবজ্ঞান অর্জনের পথ প্রশস্ত করেন, জীব নিজের যোগ্যতা অনুসারে কোন না কোন এক জন্মে পূর্ণ লাভের কারণে সেই পথের সন্ধান পেয়ে ধীরে ধীরে শিব তত্ত্বের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে সক্ষম হয়। তখন তিনি সর্বত্র শিবময় দেখেন, অদ্বিতীয় শিব ছাড়া আর কিছুই নেই, এই উপলব্ধির দ্বারা তিনি বুঝতে পারেন আত্মা কোনো দেহ নয়, আত্মা যখন দেহ ধারণ করে তখন সেই দেহের লক্ষণ বৈশিষ্ট্য ও আকৃতির উপর নির্ভর করে তাকে পশু, পাখি, কীট, পতঙ্গ, বৃক্ষ, মনুষ্য অথবা যেকোনো জীবের শ্রেণীর অন্তর্গত বলে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু সকলের মধ্যে আত্মা একই, দেহই হল বিভিন্নতার কারণ। তাই আত্মার যেহেতু বিভিন্নতা নেই, বরং ওই আত্মাকেই শিব বলা হয়, এই কারণে কর্ম বা জাতের উপর নির্ভর করে পরমেশ্বর শিব তাকে মোক্ষ প্রদানের কৃপা দেবার নির্ণয় করেন না। দেহ নশ্বর, আজ একরকম দেহ, পরজন্মে আরেক রকম দেহ লাভ হবে, কিন্তু আত্মার পরিবর্তন হয় না। সেই করাণে আত্মাকে দেখে শিব কৃপা করেন, কেমন প্রকার দেহ ঐ প্রাণীর, তা দেখে প্রভু শিব কৃপা প্রদানের নিশ্চয় করেননা।
সর্বত্রই শিব তত্ত্ব রয়েছে, অজ্ঞানের কারণে শিব তত্ত্ব লাভের পথ থেকে হয়তো জীব কোনো জন্মে দূরত্বের শিকার হয়েছে, কিন্তু সে কোন না কোন এক জন্মে ধীরে ধীরে পুণ্য লাভ করতে করতে শিবলাভের পথে অবশ্যই চলে আসবেন। তাই যারা আজ মহাদেবের বিরোধিতা করছে, অথবা মহাদেব নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না, তা মূলত অজ্ঞানতার কারণেই করছে। যেদিন তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে এবং সে কিছু পূণ্য অর্জন করবে, সেই দিন থেকে তার শিবের প্রতি আকর্ষণ অনুভব হতে শুরু করবে, ধীরে ধীরে প্রত্যেক জন্মে তার এই শিবের প্রতি আকর্ষণ ভাব আরো শক্তিশালী হবে, একসময় সেই শিববিরোধী ব্যক্তিই শৈব মার্গে উপনীত হবে, অবশেষে শিবত্ব লাভ করে চিরকালের মতো জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।
তাই প্রভু শিব কখনোই কারোর জাত বিচার করে অনুগ্রহ করেন না। শিবভক্তি পরায়ণ হলেই সেই ব্যক্তি শিবের প্রিয় হন।
শিব মহিমা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা খুবই দুঃসাধ্য বিষয়। কারণ, কোটি কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র কয়েকজনের অভ্রান্তভাবে পূর্ণ শিবতত্ত্বের আভাস হওয়া সম্ভবপর হয়। বাকিরা মায়ায় পড়ে শিব থেকে দূরেই থাকেন। যারা শিবভক্তি লাভ করে শিব জ্ঞান অর্জনের জন্য আগ্রহী হয়ে চলেছে তারা ধন্য, তাদের হৃদয় বিশুদ্ধ, সকলের মধ্যে তারা শিবকেই দেখেন, কিন্তু যারা শিব জ্ঞান লাভ করেননি তারা এই মার্গের মহিমাও বোঝেননা, তারা এই পথকে সাধারণ বা তুচ্ছ বা অনান্য সম্প্রদায়ের মতো একটা সম্প্রদায় মাত্র মনে করেন। যা আসলেই অজ্ঞানতা ছাড়া আর কিছু নয়।যেদিন সঠিক গুরুর দর্শন লাভ হবে সেদিন গুরু কৃপায় জীব শিবতত্ত্বকে বুঝতে সক্ষম হবে ও চিরতরে মুক্তি লাভ করে শিবে লীন হবে।
ধর্ম বলতে এখানে কোনো ব্যক্তি যে আচার আচরণ, রীতিনীতি ধারণ করে মেনে চলেন তাদের সেই মান্যতা গুলিকে ধর্ম আখ্যা দেওয়া হয়েছে। যেমন, কেউ কুমোর, কেউ মেথর, কেউ কৃষক, কেউ পুরোহিত, কেউ চিকিৎসক, কেউ গণিকা, কেউ ভাঁড়, কেউ মন্ত্রী, কেউ চণ্ডাল ইত্যাদি ইত্যাদি বিভিন্ন কর্ম ও আচরণের ভিন্নধর্মী মানুষ রয়েছেন। প্রভু শিব এনাদের কারোরই ঐ সকল সামাজিক ধর্ম বা জাত দেখে বিচার করেন না, তার কাছে সকলেই সমান। এই কারণেই তিনি সকলের আরাধ্য মহাদেব, এই কারণেই তিনি সকল বিধিনিষেধের ঊর্ধ্বে থাকা এক ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বর।
বর্তমানকালে নাস্তিক, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান বা যেকোনো মতবাদধর্মী ব্যক্তিও যদি প্রভু শিবের ভক্তি সম্পন্ন হয়ে শিবের প্রকাশিত শৈব সনাতন ধর্মের পথে অগ্রসর হন তবে তিনিও শুদ্ধ হয়ে শিবকৃপা লাভ করে মোক্ষ লাভ করতে সক্ষম। মনে রাখতে হবে অসত্যের মতবাদের পথে শিবলাভ হয় না, একমাত্র সত্যের পথেই শিব লাভ সম্ভব। তাই মন থেকে সত্যের পথ অনুসরণ করলে যেকোনো জীবের শিভকৃপা লাভ সম্ভব।
এবিষয়ে শিবধর্ম পুরাণের ১ম অধ্যায়ে প্রভু শিব স্বয়ং শিবভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেছেন —
শিবধর্মস্য সারোঽয়ং শিবে ভক্তি সুনিশ্চলা ।
সা চ অষ্টাঙ্গীং শিবেনোক্তা কার্যা নিত্যং প্রয়ত্নতঃ ॥ ২৬ ॥
(শিবধর্ম পুরাণ/১ম অধ্যায়/২৬ নং শ্লোক)
অর্থ : শিবধর্মের সার এইটিই — এর মাধ্যমেই শিবের প্রতি অচঞ্চল ভক্তি জন্মায়। শিবভক্তি অষ্টাঙ্গী অর্থাৎ আট প্রকারের, যেভাবে ভগবান শিব নিজেই বলেছেন। যে ব্যক্তি সেই শিবোক্ত অষ্টভক্তি প্রতিদিন অধ্যবসায়ের সঙ্গে অনুশীলন করেন, তিনিই প্রকৃত শিবভক্ত (অন্যরা নয়) ॥ ২৬ ॥
শ্রীভগবানুবাচ ।
মদ্ ভক্তজন বাৎসল্যং পূজায়ামনুমোদনম্ ।
স্বয়মভ্যর্চনং ভক্ত্যখ মমার্থে চাঙ্গচেষ্টিতম্ ॥ ২৭ ॥
মৎ কথাশ্রবণে ভক্তিঃ স্বরনেত্রাঙ্গ বিক্রিয়া ।
মমানুস্মরণং নিত্যং যশ্চ মাং চোপজীবতি ॥ ২৮ ॥
(শিবধর্ম পুরাণ/১ম অধ্যায়/২৭-২৮ নং শ্লোক)
অর্থ : পরমেশ্বর শিব বললেন, “(১) আমার ভক্তদের প্রতি স্নেহ (বাৎসল্য) রাখা, (২) আমার পূজার প্রশংসা বা অনুমোদন করা, (৩) নিজে ভক্তিভরে আরাধনা ও পূজা করা এবং (৪) শিবভক্তি অর্জনের জন্য আন্তরিক চেষ্টা করা।
এইভাবে (৫) আমার কথার (শিবকথার) শ্রবণে ভক্তি রাখা ; (৬) নিজের বাক্য, দর্শন ও সকল ইন্দ্রিয়ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে থেকে সে সবের সর্বদা আমারই (শিবের) অঙ্গসমূহের সেবায় নিয়োজিত থাকা। (৭) জীবিত থাকা কালেও যেন সর্বদা আমার স্মরণেই মন নিবিষ্ট থাকে — এইভাবে (৮) আমার (শিবের) জন্যই জীবিত থাকবার ভাবনা করা ॥ ২৭-২৮
ভক্তিরষ্টবিধা হ্যেষা যস্মিন্ ম্লেচ্ছেঽপি বর্ততে ।
স বিপ্রেন্দ্রো মুনিঃ শ্রীমান্স যতিঃ স চ পণ্ডিতঃ ॥ ২৯ ॥
(শিবধর্ম পুরাণ/১ম অধ্যায়/২৯নং শ্লোক)
অর্থ : উপরোক্ত আট প্রকারের ভক্তি। এই গুলি যদি ম্লেচ্ছরাও (অর্থাৎ অ-আর্য বা অনার্য জাতির লোকরাও) এর পালন করে, তবে সেই ভক্তির আচরণের ফলে তারা শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ বা বিপ্রদেরও উপরে স্থান লাভ করে। তাঁরাই প্রকৃত মুনি, তাঁরাই সত্যিকারের শ্রীমান্, তাঁরাই সংযমী যতি (যোগী) এবং তাঁরাই সত্য জ্ঞানসম্পন্ন পণ্ডিত ॥ ২৯ ॥
ন মে প্রিয়শ্চতুর্বেদী মদ্ ভক্তঃ শ্বপচোঽপি যঃ ।
তস্মৈ দেয়ং ততো গ্রাহ্যং স চ পূজ্যো যথাহ্যহম্ ॥ ৩০ ॥
(শিবধর্ম পুরাণ/১ম অধ্যায়/৩০ নং শ্লোক)
অর্থ : আমার কাছে সেই ব্যক্তি চতুর্বেদী (অর্থাৎ চার বেদে পারদর্শী) ব্রাহ্মণের মতো প্রিয় নয়, যতটা প্রিয় আমার ভক্ত। সে যদি শ্বপচ (অর্থাৎ নিম্নজাতি বা কুকুরভোজী) হয় তবুও তার সঙ্গে শ্রদ্ধার সহিত আচরণ, সৌজন্যমূলক আদান-প্রদান করা উচিত; কারণ সে আমারই মতো পূজনীয় — যতটা আমি পূজনীয় ॥ ৩০ ॥
অর্থাৎ প্রভু শিবের কাছে কোনো জাত বা সামাজিক ধর্মমতবাদের পরিপন্থী ব্যক্তির ঐ সকল অবস্থান দেখে বিচার করে কৃপা করেন না, বরং তিনি যে কোনো অবস্থার জীবকে উদ্ধার করেন, যদি সেই জীব সম্পূর্ণরূপে শিবের প্রতি ভক্তি সম্পন্ন হন, এই ভক্তির লক্ষণ সনাতন শৈবধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠত্ব মার্গ অনুসারেই হতে হবে। যার মধ্যে প্রভু শিবের ঐ সকল প্রকার ভক্তিভাব উদয় হয়, আর যিনি এগুলি পালন করেন, তিনিই শিবের প্রিয়। শিবভক্তিহীন চারবেদের পণ্ডিত ব্যক্তিও শিবের প্রিয় হতে সক্ষম নন, বরং শিবভক্তির দ্বারা শিবভক্ত ব্রাহ্মণের চেয়েও শ্রেষ্ঠ হয়ে যান। কেউ যদি ভাবেন যে, ব্রাহ্মণরাই একমাত্র শিবকৃপা লাভ করতে পারবে, অন্য কেউ শিবকৃপা লাভ করতে পারবে না, একথা সম্পূর্ণ ভাবে ভুল আর তা স্বয়ং প্রভু শিব নিজ শ্রীমুখে বলে প্রমাণ করে দিয়েছেন। যে কেউ শিবের প্রিয় হতে পারেন, শিবকৃপা লাভ করতে পারেন, আমাদের পরমেশ্বর শিব সকলের প্রভু। এই কারণে প্রভু শিবের শৈব মার্গ সকলের জন্য সমানতার সর্বশ্রেষ্ঠ মার্গ। এখানে জাতপাতের গোঁড়ামিতা নেই, আছে শিবভক্তির দ্বারা উদার আত্মজ্ঞান উপলব্ধি, যার দ্বারা সকলের মধ্যে গড়ে ওঠে সমানতার শিবময় আত্মীয়তা।
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
তথ্য সংগ্রহে ও লেখনীতে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য গুরুদেব জী
কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT


মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন