বয়স নাকি জ্ঞান — কোনটি ‘গুরু’ নির্বাচনের মাপদণ্ড ?
ভূমিকা —
বর্তমান কলিযুগে মানুষ চমকপ্রদ বিষয়কেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে, জ্যেষ্ঠ হলেই তাকে শ্রেষ্ঠ ভাবে, বয়সে বৃদ্ধ হলেই তাকে জ্ঞানী মনে করে। আর এভাবেই বর্তমানে অনেক মায়ায় মোহিত জীব আছেন আমাদের সমাজে যারা বয়সের উপর নির্ভর করে গুরু হবার যোগ্যতা বিচার করেন। যেমন, অনেকেই মনে করেন বৃদ্ধ বয়স্ক ব্যক্তি গুরু হবার যোগ্য, বালক বা যুবক বা অল্পবয়সী ব্যক্তি কখনোই গুরু হবার যোগ্য নয়। যার বয়স অধিক হবে সেই বৃদ্ধ বয়স্ক ব্যক্তিই গুরু বলে গ্রহণযোগ্য - এমন ধারণা বর্তমান সমাজে অনেকেরই রয়েছে। অনেকে মনে করেন, নিজের চেয়ে কম বয়সী ব্যক্তি কখনোই গুরু হতে পারেনা, নিজের চেয়ে অধিক বয়স্ক ব্যক্তি গুরু বলে গণ্য করাই আত্মতৃপ্তির মতো বিচার। এমন ধরণের ধারণার যৌক্তিকতা কতখানি আছে আমাদের ধর্মে, তা এবার শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বিশ্লেষণ করবো ।
বয়স নাকি জ্ঞান কোনটি গুরু নির্বাচনের মাপদণ্ড ?
উত্তর :
এই বিষয়ে বিস্তারিত জানবার জন্য মহাভারতের একটি প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করছি। মহাভারতের শল্য পর্বের ৪৭ অধ্যায়ে জনমেজয় জিজ্ঞাসা করেছেন বৈশম্পায়ন কে - সারস্বত মুনি বালক হয়েও, নিজের চেয়েও বয়ঃজেষ্ঠ্য ঋষিদের বেদ অধ্যয়ন কিভাবে করাতে সক্ষম হলেন ?
এর উত্তরে বৈশম্পায়ন বিস্তারিত ঘটনাটি বর্ণনা করেন।
দধীচি মুনি ও সরস্বতী নদীরূপী দেবীর পুত্র হলেন ‘সারস্বত মুনি’ ১২ বছর অনাবৃষ্টি হলে জীবন রক্ষার জন্য ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঋষিগণ এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগলেন, তখন সারস্বত মুনিও চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু সরস্বতী দেবী তাকে খাদ্যরূপে মাছ দিলেন। তা আহার করেই বেদ অধ্যয়ন করে জীবন যাপন করতে লাগলেন । তারপর অনাবৃষ্টি দূর হলে মুনিগণ আবার ফিরে এলেন, কিন্তু তারা বেদ বিস্মৃত হয়েছিলেন।
তাদের মধ্যে কোনো একজন ঋষি সারস্বত মুনির কাছে গিয়ে সারস্বত মুনিকে নির্জন বনের মধ্যে বেদপাঠে রত দেখে এই বৃত্তান্ত সকল ঋষিগণের মাঝে বললেন, তখন সকলে সেই বিষয়ে অবগত হয়ে সারস্বত মুনির কাছে গিয়ে বললেন, আমাদের বেদ অধ্যায়ন আপনি করিয়ে দিন। এমন ভাবে বলে তারা বেদ জ্ঞান লাভের জন্য প্রার্থনা করলেন। এবার শ্লোক সহ বিষয়টি তুলে ধরা হচ্ছে।
ততঃ সর্বে সমাজগ্মুস্তত্র রাজন! মহর্ষয়ঃ ।
সারস্বতং মুনিশ্রেষ্ঠমিদমূচুঃ সমাগতাঃ ॥৪৫॥
অস্মানধ্যাপয়স্বেতি তানুবাচ ততো মুনিঃ।
শিষ্যত্বমুপগচ্ছধ্বং বিধিবদ্ধি মমেত্যুত ॥৪৬৷৷
তত্রাব্রুবন্ মুনিগণা বালস্তমসি পুত্রক!।
স তানাহ ন মে ধৰ্ম্মো নশ্যেদিতি পুনর্মু নীন্ ॥৪৭॥
যো হ্যধর্ম্মেণ বৈ ব্রূয়াগৃহ্ণীয়াদ্বাপ্যধৰ্ম্মতঃ।
হীয়েতাং তাবুভৌ ক্ষিপ্রং স্যাতাং বা বৈরিণাবুভৌ ॥৪৮॥
ন হায়নৈর্ন পলিতৈর্ন বিত্তেন ন বন্ধুভিঃ।
ঋষয়শ্চক্রিরে ধর্মং যোঽনূচানঃ স নো মহান্ ॥৪৯॥
এতচ্ছ্রত্বা বচস্তস্য মুনয়স্তে বিধানতঃ।
তস্মাদ্বেদাননুপ্রাপ্য পুনর্ধর্মং প্রচক্রিরে ॥৫০॥
ষষ্টির্মুনিসহস্রাণি শিষ্যত্বং প্রতিপেদিরে।
সারস্বতস্য বিপ্রর্ষের্বেদস্বাধ্যায়কারণাৎ ॥৫১॥
মুষ্টিং মুষ্টিং ততঃ সর্বে দর্ভাণাং তে হ্যুপাহরন্।
তস্যাসনার্থং বিপ্রর্ষের্বালস্যাপি বশে স্থিতাঃ ॥৫২॥
তত্রাপি দত্ত্বা বসু রৌহিণেয়ো মহাবলঃ কেশবপূর্বজোঽথ।
জগাম তীর্থং মুদিতঃ ক্রমেণ তং বৃদ্ধকন্যাশ্রমমেব বীরঃ ॥৫৩৷৷
(মহাভারত/শল্যপর্ব/৪৭ অধ্যায়/৪৫-৫৩ নং শ্লোক)
অর্থ — এ রাজশ্রেষ্ঠ ! তখন সেই মহর্ষিরা সেখানে সারস্বত মুনির কাছে গিয়ে তাকে এই কথা বললেন — ॥ ৪৫
“আপনি আমাদের বেদ অধ্যয়ন করান” । তখন সারস্বত মুনি তাদেরকে বলেছিলেন, ‘আপনারা যথাবিধানে প্রথমে টসসসস শিষ্য হোন’ ॥ ৪৬
তখন সেই মুনিরা বললেন, - ‘হে পুত্র ! তুমি তো বালক।’ তখন এই কথা শুনে সারস্বত মুনি তাদেরকে বললেন — ‘আপনারা আমার শিষ্য না হলে আমার ধর্ম নষ্ট হবে ॥ ৪৭
যিনি গুরু শিষ্যের ধর্ম অনুসরণ না করে, অধ্যায়ন করান ; কিংবা যিনি সেই ধর্ম পরিত্যাগ করে অধ্যয়ন করেন ; তারা দুই জনই ক্ষতিগ্রস্ত হন ; কিংবা পরস্পর শত্রু হয়ে থাকেন ॥ ৪৮
ঋষিগণ কখনোই বয়স, বার্ধক্য, ধন ও সহায় অধিক হলেই তাকে গুরু বলে স্বীকৃতি দেওয়ার নিয়ম নির্ণয় করেননি। বরং, যিনি অধিক শাস্ত্রজ্ঞ, তিনিই হলেন একমাত্র মহান তথা প্রধান অর্থাৎ গুরু বলে স্বীকৃত ॥ ৪৯
সেই মুনিরা সারস্বতের এই কথা শুনে যথাবিধানে তার কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তার কাছে বেদ অধ্যয়নপূর্বক পুনরায় ধর্ম আচরণ করতে লাগলেন ॥ ৫০
ষাট হাজার মুনি সম্যগ্ বেদ অধ্যয়ন করবার জন্য ব্রহ্মর্ষি সারস্বতের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন ॥ ৫১
সেই মুনিরা বালক সারস্বতের বশীভূত থেকে, তার উপবেশন করবার জন্য এক এক মুট করে কুশ আনয়ন করতেন ॥ ৫২
♦️ বিশ্লেষণ : উপরোক্ত শ্লোকে স্পষ্টভাবেই বর্ণিত হয়েছে, সারস্বত মুনি বালক হয়েও তার চেয়ে অধিক বয়স্ক ঋষিদের গুরু হয়েছিলেন। পরমজ্ঞান দ্বারা জীবের অজ্ঞান দূর হয়, তাই যিনি জ্ঞান দাতা তিনিই গুরু হবার যোগ্য, এতে বয়স কোনোভাবেই মাপকাঠি হতে পারে না। বয়স অধিক হলেই যে তার কাছে পরমজ্ঞান থাকবে, আর কম বয়স হলে সে কিছুই জানে না - এমন ভাবনা করা অজ্ঞানতা ছাড়া আর কিছুই নয়। যিনি বয়স্ক হয়েও পরমজ্ঞান অর্জন করতে পারেননি, তিনি অন্য জীবের অন্ধকারও দূর করতে সক্ষম নন। কিন্তু যদি কোনো বালক বা যুবক বা অল্পবয়সী কোনো ব্যক্তির মধ্যে সেই পরমজ্ঞান থাকে, তবে তিনিই গুরু বলে স্বীকৃত। গুরু নির্বাচনে জ্ঞান হল মাপকাঠি, বয়স নয় ।
তাই সারস্বত মুনি বলেছেন, কারোর বয়স দেখে অজ্ঞানী, গুরু হবার অযোগ্য বলে ভেবে নেওয়া উচিত নয়, কারোর অধিক বয়স দেখে তাকে জ্ঞানী ও গুরু হবার যোগ্য ভাবা উচিত নয়, কারোর অধিক ধনসম্পত্তি আছে বলে তাকেই জ্ঞানী ও গুরু ভাবা উচিত নয়, কারোর যদি অধিক লোকবল অর্থাৎ ক্ষমতা থাকে - তা দেখে তাকে জ্ঞানী ভেবে গুরু বলে ধারণা করা উচিত নয়।
বরং, যিনি শাস্ত্রের গূঢ় রহস্য সম্পর্কে অবগত আছেন, যিনি পরম জ্ঞানী - সেই ব্যক্তিই হলেন গুরু - এমনটিই জানা উচিত।
যারা অল্পবয়সী কিন্তু জ্ঞানী, এমন প্রকৃত গুরু কে ছেড়ে, বয়স দেখে গুরু নির্বাচন করে তারা নিজেই নিজেকে প্রতারণা করে বসে থাকে, কারণ, প্রকৃত গুরু শিষ্যকে জ্ঞান প্রদান করে মোক্ষের পথ সম্পর্কে অবগত করিয়ে দেন। কিন্তু জ্ঞানহীন বয়স্ক ব্যক্তির শিষ্য প্রকৃত জ্ঞান লাভ করতে না পেরে হয়রানির শিকার হন মাত্র।
কিন্তু একথাও সত্য যে, জ্ঞান যে কোনো বয়সের ব্যক্তি মধ্যে উৎপন্ন হতে পারে, তাই জ্ঞান সম্পন্ন বয়স্ক ব্যক্তিও গুরু বলেই গণ্য। কিন্তু কম বয়সের ব্যক্তি গুরু নন - এমন ভাবনা শুধু মাত্র অজ্ঞানতার পরিচয়।
এছাড়াও, আরো একটি বিষয় এখানে শিক্ষণীয় হিসেবে উল্লেখ হয়েছে, যদি কোনো অধিক বয়স্ক ব্যক্তি কম বয়সী গুরুর কাছে দীক্ষিত হন, তবে গুরুর কাছে সেই শিষ্যরও সর্বদা শিশুর ন্যায় আচরণ করা উচিত, নিজেকে অধিক শ্রেষ্ঠ বা বয়সের অভিমান দেখানো উচিত নয়, ৫২নং শ্লোকে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে বালক গুরুর জন্য অধিক বয়সী শিষ্যগণ কুশ আনয়ন করতেন, যে কুশের আসনের উপর বালক গুরু বসবেন। অর্থাৎ, গুরুকে সমীহ করে চলাই শিষ্যের ধর্ম। গুরুর কাছে শিষ্যের কখনোই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করা উচিত নয়।
________________________________________________
উদাহরণ হিসেবে :
(১) মহর্ষি উপমন্যু শৈবাচার্য বালক হয়েও সকলের গুরুদেব হয়েছিলেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে শিবজ্ঞান প্রদান করে শৈবদীক্ষা দিয়েছিলেন।
(২) গোরক্ষনাথ জী বালক ছিলেন, তথাপি তিনি সকল শৈব নাথ যোগীদের আদর্শ গুরু ছিলেন।
(৩) কলিযুগে অশৈব হয়েও স্মার্ত আদি শঙ্করাচার্য কম বয়সী হয়েও, নিজের চেয়েও অধিক বয়সী ব্যক্তিদের গুরু হয়েছিলেন।
সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল, যদিও প্রভু শিবের কোনো বয়স গণনা হয় না, তবুও শাস্ত্র মতে তিনি যখন সাকার রূপ ধারণ করেন তখন তিনি ১৬ বছর বয়সী যুবকের ন্যায় দিব্যদেহ ধারণ করে ব্রহ্মা-বিষ্ণু ইন্দ্র আদি সকল দেবদেবী তথা সমস্ত মুনিঋষিদের জ্ঞান প্রদান করেন।
তাই এক্ষেত্রে গুরু নির্বাচন করবার সময় সর্বদা জ্ঞানকে প্রাধান্যতা দেওয়া বাধ্যতামূলক, বয়স কে প্রাধান্যতা দেওয়া উচিত নয়।
________________________________________________
সিদ্ধান্ত : বয়সের চেয়ে জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ হওয়ায় গুরুকে বয়সের ভিত্তিতে বিচার করা অনুচিত। যিনি জ্ঞানী তাকেই গুরু বলে স্বীকার করে নেওয়া উচিত, তাতে তার বয়স কম হোক অথবা অধিক হোক।
________________________________________________
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
তথ্য সংগ্রহে ও লেখনীতে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য গুরুদেব জী
কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT


মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন