পরমেশ্বর শিব কেন অনান্য দেবদেবীর মতো অলংকার পরিধান করেন না ?

 



ভূমিকা —

 সনাতন ধর্মে সকল দেব-দেবী একদিকে, পরমেশ্বর শিব আরেক দিকে। এটি বলবার তাৎপর্য হল, সকল দেবদেবীর বৈশিষ্ট্য ও গুণ একই পর্যায়ের, কিন্তু প্রভু শিবের লীলা, বৈশিষ্ট্য, গুণ ও চরিত্র বিচিত্র ধরনের। সাধারণত আমরা দেখতে পাই প্রায় সকল দেবদেবী বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান অলংকার ও সামাজিক উজ্জ্বল বস্ত্র ধারণ করে থাকেন, তারা সুন্দর মহলে বসবাসরত, তাদের সেবায় বহু সুন্দর অনুচর ও অনুচরী অবস্থান করেন। কিন্তু প্রভু শিবের দেহে তাদের মত বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না, বরং প্রভু শিবের শরীরে থাকে ভস্ম, অগণিত সাপ জড়িয়ে থাকে, সামাজিক বস্ত্রের জায়গায় থাকে বাঘের ছাল, বাঘ ও হাতির ছাল দ্বারা তৈরি উত্তরীয় আবৃত, অন্যান্য দেবতাদের মত দুটি চোখের জায়গায় শিবের তিনটি চক্ষু থাকে, তিনি বিকৃত অঙ্গধারী অসংখ্য প্রমথগণ সহ ভূত-প্রেতেদের অনুচর বানিয়েছেন। তিনি থাকেন তুষারাবৃত পর্বতে। কিন্তু প্রশ্ন হল এমন বিচিত্রতা কেন ? 


অনেকেই বলেন সব দেবদেবী আর শিব সবাই এক সমান, কোনো রকমের‌ই ভেদ নেই। কিন্তু সত্যিই যদি তাই হতো, যদি ব্যবহারিক ভেদ নাই থাকতো তবে এমন চরিত্রগত ও দেহগতভাবে প্রভু শিব ও অনান্য দেবদেবীর মধ্যে এমন আকাশ পাতাল পার্থক্য কেন ? 

প্রভু শিব ও অনান্য দেবদেবীর মধ্যে এমন আকাশ পাতাল পার্থক্য কেন ? 

এবিষয়ে কৌতুহল হয়ে থাকে জিজ্ঞাসু ব্যক্তিদের। তাই  এমন বিচিত্রতার পেছনে কি কারণ বা সংকেত লুকিয়ে আছে তা জেনে নেবার জন্য শাস্ত্রের বচনে আলোকপাত করবো। চলুন জেনে নেওয়া যাক।

________________________________________________


পরমেশ্বর শিবের কেন অনান্য দেবদেবীর মতো অলংকার পরিধান করেন না ?


উত্তর :

 এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মাতা পার্বতী। প্রসঙ্গ টা হল - মা ভগবতী পার্বতী দেবী যখন ভগবান রুদ্রকে প্রতী রূপে পাবার জন্য তপস্যা করছিলেন, তখন প্রভু রুদ্র সপ্তঋষিকে পাঠিয়েছিলেন দেবীর পরীক্ষা নেবার উদ্দেশ্যে। দেবীর কাছে গিয়ে সপ্ত ঋষি মহাদেব সম্পর্কে বিভিন্ন কটু বচন বলেন যাতে দেবীকে শিবের তপস্যা থেকে বিরত করা যায়, কিন্তু দেবী তাদের বলা প্রত্যেকটি কথার সমচিত জবাব দিয়েছিলেন। সপ্ত ঋষিগণ দেবীকে বলেছিলেন, শিব নিজের শরীরের ছাইভস্ম মেখে থাকেন, শিবের কাছে কোন ধনসম্পত্তি নেই, তাই শিবের কোন মূল্যবান অলংকারও নেই। তখন দেবী পার্বতী মাতা জবাব দিয়ে যা বলেছিলেন, সেখানে লুকিয়ে আছে শিবের অলংকার ধারণ না করবার গুহ্যরহস্য।


মাতা পার্বতী বললেন,

ভূষণাদিরুচির্মায়ালিপ্তানাং ব্রহ্মণো ন চ।
স প্রভুর্নির্গুণোঽজো নির্মায়োঽলক্ষ্যগতির্বিরাট্‌ ॥ ৬৬

[শিব মহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/পার্বতীখণ্ড/২৫ অধ্যায়/৬৬ নং শ্লোক] 

অর্থ — যারা মায়ায় লিপ্ত থাকে, কেবল তারাই অলংকার প্রভৃতি ভোগ্যবস্তুর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। কিন্তু যিনি ব্রহ্ম তিনি এমন কোনও ভোগ্যবস্তুর আকর্ষণে জড়ান না। কারণ সেই প্রভু শিব নির্গুণ, অজ (অজন্মা), মায়ারহিত, অলক্ষ্যগতি (যাঁর গতি বা উদ্দেশ্য বোধগম্য নয়) এবং বিরাট্ (সর্বব্যাপক) রূপ।

[খেয়াল করুন, মা পার্বতী সরাসরি বললেন "ব্রহ্মের জাগতিক ভোগ্য বস্তুতে আসক্তি নেই, অর্থাৎ শিবই ব্রহ্ম, কারণ শিবেরই কোনো আসক্তি নেই সাংসারিক বস্তুতে", অনান্য দেবদেবীর মধ্যে এই লক্ষণ দেখা যায় না, কারণ তাদের মধ্যে ব্রহ্মের এই লক্ষণ নেই।]

♦️ নন্দীনাথ কৃত ব্যাখ্যা : যারা জাগতিক সংসারের মায়ায় আবদ্ধ তারা জাগতিক বস্তুর প্রতি আসক্ত হয়ে থাকে, যারা সাধারণ জীব তারা ধাতুর তৈরি নশ্বর অলংকারের আভুষণ ধারণ করাকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখ বলে মনে করে, আর সেই বস্তু লাভের জন্য সৎ উপায় বা অসদ উপায় অবলম্বন করে, সত উপায়ে ওই অলংকার লাভ করলেও সেই অলংকার চুরি হয়ে গেলে বা হারিয়ে গেলে ফলস্বরূপ দুঃখ লাভ হয়ে থাকে, তাছাড়া ওই বস্তু প্রকৃতপক্ষে চিরকাল জীবের সাথে থাকে না, জীবের মৃত্যু হয়ে গেলে জীবকে ওই বস্তু ত্যাগ করতেই হয়। তাই জাগতিক যেসব বস্তু জীবের জন্য নিত্য সঙ্গী নয়, বরং মোহে আবদ্ধ করবার কারণ, সেই সকল বস্তুকে পরমেশ্বর শিব ধারণ করেননা। কারণ তিনি স্বয়ং মায়ামোহের প্রভাব থেকে মুক্ত, তিনি স্বয়ং ব্রহ্ম, ব্রহ্ম মায়ার প্রভাব থেকে মুক্ত, তাই প্রভু শিবের মধ্যেই সেই ব্রহ্মলক্ষণ স্পষ্ট। তিনি গুণের অতীত (মায়ামুক্ত) তাই তাকে নির্গুণ বলা হয়, তিনি অজন্মা অর্থাৎ তার জন্ম হয়নি, এই গুণগুলি ব্রহ্মের‌ই, তাই শিব‌ই ব্রহ্ম।

 অনান্য দেবদেবী স্বয়ং‌ই মায়ামোহে আবদ্ধ এবং তারা তাদের উপাসকেদের‌ও সকাম ভক্তিতে তাদের‌ও ইচ্ছার পূর্তি করবার মাধ্যমে জাগতিক বস্তুর প্রতি আকর্ষণ বজায় রাখেন।

কিন্তু, প্রকৃত শিবভক্ত সর্বদাই প্রভু শিবের মতোই জাগতিক নশ্বর বস্তুর প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন না, বরং ভস্ম রুদ্রাক্ষ ইত্যাদিতেই স্বাভাবিকভাবে প্রেম করেন। ফলে তারা সাক্ষাৎ নির্গুণ অজন্মা পরমব্রহ্ম শিবকেই লাভ করেন। অর্থাৎ প্রভু শিব মায়ামুক্ত হবার কারণেই জাগতিক বস্তুর মোহ থেকে মুক্ত, এই কারণে তিনি অনান্য দেবদেবীর মতো নশ্বর অলংকার ধারণ করেন না।


________________________________________________

শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩

🔥 লেখনিতে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী

© কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ