ঈশ্বর নামটি শুধুমাত্র শিবের‌, অন্য আর কারো নয়

 


ভূমিকা —

 বর্তমানে মানুষ এতটাই অজ্ঞানের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে, যার দরুন নিজ ধর্মের উচ্চ স্তরের মান্যতাগুলিকে সার্বজনীন করে ফেলেছে। যেমন, ঈশ্বর নামটি যে কোনো দেবদেবীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত করা যেন একটা সাধারণ বিষয় হয়ে গিয়েছে।

কেউ বলে বিষ্ণু ঈশ্বর, কেউ বলে কৃষ্ণ ঈশ্বর, কেউ বলে রাম ঈশ্বর, কেউ বলে রাধা ঈশ্বর, কেউ বলে শক্তি ঈশ্বর, কেউ বলে গণেশ ঈশ্বর, কেউ বলে সূর্য ঈশ্বর, কেউ বলে সবাই হল ঈশ্বর — অর্থাৎ মুড়ি মুড়কির মতো ঈশ্বর বলছ সম্বোধিত হচ্ছে। বিরম্বনা তো আরো হয়েছে, যেমন আজকাল অনেক ঈশ্বর শব্দটিকে এমন ভাবে ব্যবহার করছে যেন ঈশ্বর শব্দটা সনাতন ধর্মের নয়, উদাহরণ হিসেবে - কেউ কেউ বলছে খ্রিষ্টানদের ঈশ্বর, কেউ কেউ বলছে মুসলমানের ঈশ্বর। 

অর্থাৎ পরমসত্তাকে ‘ঈশ্বর’ নামে চিহ্নিত করে, খ্রিষ্টানদের মান্য পরমসত্তাকে ‘ঈশ্বর’ নামে চিহ্নিত করছে, অনান্য দের ক্ষেত্রেও এক‌ই অবস্থা।


তাই ‘ঈশ্বর’ সম্পর্কে আমাদের শাস্ত্র কি বলে তা সংক্ষিপ্ত ভাবে উপস্থাপন করছি।

________________________________________________

ঈশ্বর নামটি শুধুমাত্র শিবের‌, অন্য আর কারো নয়


 ‘ঈশ্বর’ শব্দটি মূলত ‘ঈশ’ বা ঈশান শব্দের থেকে এসেছে। ‘ঈশান’ শব্দটি বহুবার বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। এর আক্ষরিক অর্থ "শাসক", "ঈশ্বর", বা "ঐশ্বর্যসম্পন্ন পুরুষ"। তবে প্রশ্ন দাঁড়ায়, এই বিশেষ্য পদটি কাকে নির্দেশ করে ? শুধু সাধারণ ঈশ্বরতুল্য গুণসম্পন্ন যেকোনো দেবতা, নাকি এটি রূঢ় অর্থে কোনো নির্দিষ্ট দেবতার নাম ? চলুন তবে দেখে নেওয়া যাক — 


🔵নিরুক্ত অনুযায়ী—

নিঘন্টু/৬/২০/১ — অনুযায়ী ঈশান অর্থ ঈশ্বর বা পরমেশ্বরকেই বোঝানো হয়েছে।

নিঘন্টু হল প্রাচীন বৈদিক শব্দভাণ্ডার বা ধাতুকোষ। এখানে ‘ঈশান’ শব্দটি ‘ঈশ্বর’ অর্থে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। তবে ঈশ্বর শব্দ সাধারণ নয় এটি সর্ব্বোচ্চ নিয়ন্ত্রককে নির্দেশ করে। বেদের ভাষায় ‘ঈশান’ এমন সত্তা যিনি সৃষ্টিজগতকে ঈশীতুম্ (শাসন) করেন, যার ঈশনা বা শক্তি দ্বারা সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় হয়। এই ক্ষমতা একমাত্র শিবের মধ্যেই শাস্ত্রমতে নিহিত।

 "শম্ভুরীশঃ"
[অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১]

শম্ভু, ঈশ মানেই পরমেশ্বর শিব

"ঈশ্বর সর্ব্ব ঈশানঃ"
[অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১]

অর্থাৎ পরমেশ্বর শিবের ঐশ্বর্যকে প্রতিপাদিত করে।"

এখানে ‘ঈশান’ শব্দটি রূঢ়ভাবে ‘শম্ভু’ তথা শিবকেই বুঝিয়েছে। এটি সাধারণ ‘ঈশ্বর’ নয়, বরং ‘সর্ব্ব ঈশ্বর’ অর্থাৎ সকল ঈশ্বরেরও ঈশ্বর। ‘শম্ভুর ঈশঃ’ অর্থে বোঝায় শম্ভুই প্রকৃত ঈশান। অতএব, ঈশান শব্দ কেবলমাত্র শিবের প্রতিপাদক।

🔵তিহাস শাস্ত্র মহাভারত বলছে —

ঈশান ঈশ্বরঃ কালো নিশাচারী পিনাকবান্।
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৬/৭৫] 

টীকা—"ঈশান ঈশ্বরশ্চ ঐশ্বর্য্যবত্বাৎ" "পিনাকবান্ পিনাকাখ্যধনুর্ণধরঃ"।।

তিনি ঈশান, ঈশ্বর, কাল, নিশাচারী ও পিনাকধারী।
টিকার অর্থ: ঈশান মানে ঈশ্বর যিনি সমস্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী; এবং তিনি পিনাক (ধনুষ) ধারণ করেন।

এখানে ঈশান শব্দটি যে কেবলমাত্র শিবের বাচ্য, তা তিনটি উপায়ে পরিষ্কার —

ঈশ্বরশ্চ ঐশ্বর্য্যবত্বাৎ’ অর্থাৎ সর্বঐশ্বর্য সম্পন্ন হওয়ায় তিনি ঈশ্বর।

পিনাকবান্ধনুর্বিশেষ পিনাক কেবলমাত্র শিবের অস্ত্র।
‘কালো’ ও ‘নিশাচারী’ এই গুণাবলীও কেবল শিবেই প্রযোজ্য, বিষ্ণু বা অন্য কারো নয়।

স এব ব্যাপৃতো নিত্যং ত্রৈলোক্যনস্ত্য শুভাশুভে। 
ঐশ্বর্য্যাচ্চৈব কামানামীশ্বরঃ পুনরুচ্যতে ॥২৭৷৷
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৯/২৭] 

অর্থ - তিনিই সর্বদা সৃষ্টির মধ্যে ব্যাপৃত, তিনিই ত্রৈলোক্যের শুভ ও অশুভের অধিষ্ঠাতা। এবং ঐশ্বর্যের দ্বারা তিনি কামনাদের ঈশ্বর নামে খ্যাত।


এখানে ‘ঈশ্বর’ বলা হয়েছে সেই সত্তাকে যিনি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কে পরিচালনা করেন। যেহেতু এই অধিকার একমাত্র শিবের, তাই ‘ঈশান’ পদবাচ্য তিনিই। মহাভারতের টীকা মতে, এই শ্লোক মহাদেবকে উদ্দেশ করেই রচিত।


🔵পুরাণ বলছে —


ব্রহ্মোবাচ —

জানে ত্বামীশং বিশ্বস্য জগতো যোনিবীজয়োঃ।

শক্তেঃ শিবস্য চ পরং যত্তদব্রহ্ম নিরন্তরম ।।

[ভাগবত পুরাণ ৪/৬/৪২] 

অর্থ — আমি (ব্রহ্মা) জানি, আপনি (শিব) বিশ্ব ও জগতের কারণ; শক্তিসহ যে শিব যে পরমতত্ত্ব, সেই অনন্ত ব্রহ্ম আপনি।

শিব এখানে ঈশ বলা হয়েছে, যিনি জগতের কারণতত্ত্ব, শক্তিরও উৎস। ঈশান শব্দ দ্বারা সেই একমাত্র পরমতত্ত্বই বোঝানো হচ্ছে যিনি শিবতত্ত্ব।


🔵শ্রুতি বলছে—

 তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরং ত্বং দেবতানাম পরমঞ্চ দৈবতম্ ।

পতিং পতিনাং পরমং পরস্তাদ বিদাম্ দেবম্ ভুবনেশমীড্যম্।।

[শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৬/৭] 

আপনি ঈশ্বরদেরও পরম ঈশ্বর মহেশ্বর, দেবতাদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ, সমস্ত পতিদের মধ্যে পরম পতি, আপনিই সেই পূজ্য দেবতা।

অর্থাৎ পরম ঈশ্বর তথা ‘ঈশান’ স্বরূপ সত্তা একমাত্র শিবই। বৈদিক উপনিষদে এই পদ অন্য দেবতার জন্য ব্যবহৃত হয়নি।


🔵এই প্রসঙ্গে ঋগবেদ বলছে —

 "শ্রেষ্ঠো জাতস্য রুদ্র শ্রিয়াসি"
[ঋগবেদ/শাকল শাখা/১/৩৩/৩] 

হে রুদ্র! তুমি সমস্ত জন্মগ্রহণকারী জীবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, ঐশ্বর্যে পূর্ণ।

এখানে রুদ্রকেইশ্রেষ্ঠো শ্রিয়াসি’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্ট জীবের চেয়ে তুমি শ্রেষ্ঠ, ঐশ্বর্যবান, সর্ব্বশক্তিমান। এই সর্বঐশ্বর্যশালিতা ‘ঈশান’ শব্দের মূল নির্যাস। অতএব, ঈশান পদ একমাত্র রুদ্রেই প্রযোজ্য।

🔵এ নিয়ে মহাভারতে বলছে —

ভগবত্যুত্তমৈশ্বর্য্যং ব্রহ্মবিষ্ণুপুরোগমম্।। 
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩/২০৩]

উত্তম ঐশ্বর্য যা ব্রহ্মা-বিষ্ণু প্রমুখ দেবতাদের দেয়, তা একমাত্র শিব প্রদান করেন, তিনিই সর্ব্বভৌম ভগবান।

এখানে ঐশ্বর্যদাতা কেবল শিব, যিনি নিজে ভগবান এবং বাকিদের ঐশ্বর্য দান করেন। ‘ঈশান’ শব্দ যার একচ্ছত্র অধিকার, তিনিই এই শম্ভু। বিষ্ণু এখানে ঈশান নন তিনি ঐশ্বর্য গ্রহণকারী।

🔵তাই শ্রুতি বলছে —

"ভগেশং" [শ্বেতাঃ উঃ/৬/৬] 

তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ, যিনি সকল শক্তির উৎস, যিনি ঐশ্বর্যের অধিপতি, যিনি 'ভগেশ' ঈশ্বরদেরও ঈশ্বর, তিনিই শিব।

🔵এই প্রসঙ্গে ঋগবেদের বক্তব্য — 

পরাৎপরতরো ব্রহ্মা তৎপরাৎপরতো হরিঃ ।
তৎপরাৎপরতো হ্যেষ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত ॥ ১৮ 
[ঋগবেদসংহিতা /খিলানি/অধ্যায় ৪/১১ নং খিলা], [আশ্বলায়ণ শাখা/১০/১৭১] 

ব্রহ্মার উপরে পরম হলেন হরি, হরির উপরে পরম এই পরমাত্মা ঈশান শিব, আমার মন এই শিবের প্রতি সংকল্পিত হোক।

এখানে শিবই হলো পরমাত্মা, সর্ব্বোচ্চ ব্রহ্ম। সুতরাং 'ঈশান' শব্দে যা ‘সর্বশাসক/সর্বোচ্চ শাসক’ বোঝায়, তা দ্বারা কেবল শিবই প্রতিপাদিত।

🔵শ্রুতি আরও বলছে —

তৎ পরং ব্রহ্ম যৎ পরং ব্রহ্ম স একঃ যঃ একঃ স রুদ্রঃ যো রুদ্রঃ স ঈশানঃ যঃ ঈশানঃ স ভগবান মহেশ্বর।।৩ [অথর্ববেদ/অথর্বশির উপনিষদ/৩]

যে পরম ব্রহ্ম, তিনি এক, তিনি রুদ্র, সেই রুদ্রই ঈশান, আর সেই ঈশানই ভগবান মহেশ্বর।


এই উপনিষদে সরাসরি বলা হয়েছে ঈশান মানেই রুদ্র = শিব = পরম ব্রহ্ম।
অতএব, ঈশান শব্দটি শিব ছাড়া আর কারও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

ঈশানস্য জগতঃ স্বদর্শমীশানমিন্দ্রতস্থুর্য ইতি তস্মাদুচ্যতে ঈশানঃ”।।
[অথর্ববেদ/অথর্ব্বশির উপনিষদ/৪] 

জগতের ঈশ্বর শিবেরই সদৃশ ঈশ্বর আর কেউ নেই, তাই তিনি 'ঈশান' নামে খ্যাত।

উপনিষদ নিজেই বলছে ঈশান পদ একমাত্র তাঁরই জন্য যিনি জগতের সদৃশহীন একমাত্র নিয়ন্তা। অতএব, এই শব্দের কোনও প্রকারে বিষ্ণুতে প্রয়োগ চলবে না।

🔵তাই তো শ্রুতি বলছে —

"একো রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্মৈ য ইমাল্লোকানীশত ঈশানীভিঃ"।।
[অথর্ববেদ/অথর্বশির উপনিষদ- ৫]

 একো হি রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য ইমাল্লোকানীশত ঈশনীভিঃ। 
প্রত্যঙ জনাংস্তিষ্ঠতি সঞ্চুকোপান্তকালে সংসৃজ্য বিশ্বা ভুবনানি গোপাঃ।।২
[শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৩/২]

রুদ্রই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর দ্বিতীয় কেউই নেই। তিনিই ঈশানী শক্তি দ্বারা এই সমস্ত জগত শাসন করেন। অন্তকালে তিনি রোষে পৃথিবীকে লয় করেন এবং পুনরায় সৃষ্টি করেন।

যিনি দ্বিতীয়হীন, যিনি জগতের স্বশক্তিতে শাসক তিনি ‘ঈশান’। শিব ছাড়া অন্য কেউ এই যোগ্যতায় পৌঁছান না।

🔵তাই শাস্ত্রে বলেছে—

একমেবাদ্বিতীয়ম”  [ছান্দোগ্য উপনিষদ/৬/২/১]

অর্থাৎ পরমেশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। সেই পরমেশ্বর হলো শিব।

"শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্ চতুর্থং মন্বন্তে স আত্মা স বিজ্ঞেয়" [মাণ্ডুক্য উপনিষদ/৭], “সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্ৰহ্ম[তৈত্তিরীয় উপনিষদ/২/১] 

এই চতুর্থ পদ (তুরীয়) হল শান্ত, শিব ও অদ্বৈত; তিনিই আত্মা এবং তিনিই জ্ঞেয়।


‘শিব’ শব্দ তুরীয় ব্রহ্মের সমার্থক। অর্থাৎ যিনি পরম চেতনা ও নিয়ন্তা তিনি একমাত্র শিব। সুতরাং ‘ঈশান’ শব্দের প্রকৃত গন্তব্য তিনিই।

🔵ইতিহাস বলছে—

ঈশানায় ভবঘ্নায় নমোহস্ত্বন্ধকঘাতিনে।
নমো বিশ্বায় মায়ায় চিন্ত্যাচিন্ত্যায় বৈ নমঃ
 [মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩/৩১৪]

ঈশান, ভবনাশক, অন্ধক-বিনাশকারী, বিশ্বরূপ, মায়াবাদী, চিন্তনযোগ্য ও অচিন্তনীয় শিবকে প্রণাম।

এখানে শ্লোকের শুরুতেই 'ঈশানায়' বলে শিবের বন্দনা করা হয়েছে। তিনি ভবঘ্ন (সংসারনাশক), মহামায়ী ও অদ্বৈত বিষ্ণু নয়। ঈশান শব্দ আবারও শুধু শিবের সাথেই সংযুক্ত। 

 যঃ শুক্র ইব সূর্যো হিরণ্যমিব রোচতে।
শ্রেষ্ঠো দেবানাং বসুঃ ॥ ৫ 
[ঋগবেদ সংহিতা/১/৪৩/৫]

যিনি শুক্রের মতো উজ্জ্বল, সূর্যের মতো দীপ্তিমান, তিনি সকল দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তিনি বসু (শিব)।

ঈশান পদ 'শ্রেষ্ঠত্ব' ও 'ঐশ্বর্যের' সমার্থক। যেহেতু শিবই দেবতাদের শ্রেষ্ঠ, তাই এই পদ তাঁরই প্রাপ্য।


🔵তাই তো শ্রুতি বলছে—


অহর্ন্নিদং দয়সে বিশ্বমভুং ন বা ওজীয়ো রুদ্রত্বদস্তি। ১০॥

[ঋগবেদ সংহিতা/শাকল সংহিতা/২/৩৩/১০]

"হে রুদ্র! তুমি দিনরাত্রি এই সমগ্র জগতের অনুকম্পাকারী। তোমার চেয়ে অধিক শক্তিশালী এমন কেউই নেই।"


শিবরূপ রুদ্রই সমগ্র জগতের সর্বক্ষণ দয়ালু রক্ষক এবং তাঁর চেয়ে অধিক শক্তিশালী (ওজস্বী) আর কেউ নেই।


অর্থাৎ পরমেশ্বর শিবকে সর্বব্যাপিতা, জগৎরক্ষকত্ব এবং সর্বোচ্চ শক্তির অধিকার প্রমাণ করা হয়েছে।


ঈশান’ শব্দটি কেবল শিবের জন্যই প্রযোজ্য,

অন্য কোনো দেবতা যেমন বিষ্ণু, ব্রহ্মা ইত্যাদি অনান্য দেবদেবী এই মন্ত্রের নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু নন।


সুতরাং, এই মন্ত্র শিবকেই একমাত্র পরমেশ্বর ও ঈশান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।


🔵তাই তো শ্রুতি বলেছে —

 "ভগেশং" [শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৬ অধ্যায়/৬ নং মন্ত্র]

অর্থাৎ শিবই ঐশ্বর্য্যে সকলের শ্রেষ্ঠ, শিবই ঐশ্বর্য্যের অধিপতি।


বৈষ্ণবীয় শাস্ত্র বৃহন্নারদীয় উপপুরাণে ‘ঈশ’ শব্দে পরমেশ্বর শিবের নামকেই নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, শিবের এই ঈশ নামটি উচ্চারণ করলে কলিযুগে জীবের মুক্তির পথে কলি বাধা দেবে না, প্রমাণ দেখুন 👇 

শিব শঙ্কর রুদ্র ঈশ নীলকন্ঠ ত্রিলোচন 

ইতি জপন্তিয়ে ইয়াপি কলি স্তন্যাপিবাধতে ॥১০১

[বৃহন্নারদীয় উপপুরাণ/পূর্বভাগ/৪১ নং অধ্যায়]

অর্থ — শিব, শঙ্কর, রুদ্র, ঈশ(ঈশান/ঈশ্বর), নীলকন্ঠ, ত্রিলোচন এই পবিত্র নামসমূহ যারা জপ করেন কলিযুগ তাদেরকেও বাধা দিতে পারেন না তথা মুক্তি সম্ভব ॥১০১


🔵পরিশেষে এটাই বলবো—


ॐ ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাং ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ব্রহ্মাধিপতির্ব্রহ্মণোহধিপতির্ব্রহ্মা শিবো মে অস্তু সদাশিবোম্ ॥

[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরন্যক/১০ম প্রপাঠক/১৭ অনুবাক]

অর্থ - পরম ঈশ্বর হল- ঈশান-শিব সর্বশক্তিমান, সবকিছুর মধ্যেই তিনি(শিব) আছেন, ঈশানই সকল বিদ্যা (৬৪ কলা) ও ভূতের অধীশ্বর (স্থাবরজঙ্গম এর একমাত্র ঈশ্বর)। যিনি বেদের পালন কর্তা, যিনি ব্রহ্মাদিদেবতার (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্রাদি দেবতার) অধিপতি সেই পরমেশ্বর সদাশিব আমাদের সদা মঙ্গল বিধান করুক।।


🔵ঈশান” শব্দ একটি রূঢ় এবং তাত্ত্বিকভাবে নির্দিষ্ট বিশেষ্য পদ, যার একমাত্র প্রতিপাদ্য শিব। 

নিঘন্টু, অমরকোষ থেকে শুরু করে বেদ, উপনিষদ, মহাভারত, ভাগবত, সকল স্থানেই ঈশান শব্দ কেবলমাত্র শিবের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। ‘ঈশান’ শব্দের অর্থ ও প্রয়োগ যেখানে ঈশ্বরতত্ত্বের চূড়ান্ত রূপ বোঝানো হয়েছে, সেখানে কেবল শিবই তাত্ত্বিক ও প্রমাণভিত্তিকভাবে উপযুক্ত। বিষ্ণু বা অন্য কোনও দেবতা এই রূঢ় পদটির অধিকারী নন।

________________________________________________


🔴 বৈষ্ণব/শাক্ত/অনান্য দেবদেবীর উপাসক তথা পণ্ডিত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন —


"ঈশান" শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অনুযায়ী যিনি সকলের ঈশ্বরত্বে অধিকারী তিনি কি বহুজন হতে পারেন? যদি না পারেন, তাহলে একাধিক ব্যক্তিকে "ঈশান" বলা হলে পরব্রহ্মের একত্ব নষ্ট হয় না কি ?


স্তোত্র বা পুরাণের স্তববাক্যে ঈশান শব্দের ব্যবহার যদি কেবল ভক্তিপ্রসূত শ্রদ্ধাবাচক হয়, তবে তা কি তত্ত্ব নির্ধারক উপনিষদীয় প্রয়োগের সমতুল্য হতে পারে ?


উপনিষদে যিনি “ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাং” বলে চিহ্নিত, তাঁকে এক ও অদ্বিতীয় বলা হয়েছে তাহলে কেন পুরাণে একাধিক ব্যক্তিকে ঈশান বলা হচ্ছে ? এটি কি উপনিষদের শ্রুতিমন্ত্রের বিরুদ্ধাচারণ নয় ?


“আধারঃ সর্ববিদ্যানাং” ও “ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাং”— এই দুই বাক্যের মধ্যে ‘আধার’ ও ‘ঈশান’ শব্দের অর্থ কি সমান ? যদি না হয়, তবে এই দুটি বাক্যকে একে অপরের প্রতিস্থাপক হিসেবে ধরা কতটা যৌক্তিক ?


বৈদিক নিঘন্টু (৬/২০/১) ও অমরকোষে ‘ঈশান’ শব্দ শিবের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে বৈষ্ণব, শাক্ত, স্মার্ত রা কি এর কোনো বিপরীত নিঘন্টু বা ব্যাকরণ প্রমাণ দিতে পারেন যেখানে ঈশান শব্দ বিষ্ণু/শক্তি/অনান্য কোনো দেবদেবীর জন্য নির্দিষ্ট ?


যদি ঈশান শব্দ বিষ্ণু/শক্তি/অনান্য দেবদেবীর জন্য ইচ্ছামতো হয়ে থাকে, তাহলে উপনিষদে কেন বলা হয় “তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরং” ? “ঈশ্বরদেরও ঈশ্বর” মহেশ্বর কেন হলেন ? বিষ্ণু/শক্তি/অনান্য দেবদেবী নয় কেন ?


“একো রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য” এই রুদ্র যদি পরমেশ্বর ঈশান হন, তাহলে আবার অনিরুদ্ধ বা কেশবকে ঈশান বলা হলে কি “একত্ব” এবং “অদ্বিতীয়তা” নষ্ট হয়ে যায় না ?


ঈশান যখন সর্ববিদ্যার ঈশ্বর বলা হয়েছে (ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাং), তখন যদি অনিরুদ্ধ বা নারায়ণ এই ঈশান হন, তাহলে মহেশ্বরকে কেন সায়ণাচার্য দ্বারা তথা শাস্ত্রজুড়ে "বিদ্যাতীর্থ", "নিঃশ্বাসরূপ বেদপ্রদাতা" ইত্যাদি বলা হয়েছে ?


ঈশান যদি বিষ্ণু/শক্তি/অনান্য দেবদেবী হন, তাহলে মহাভারতে কেন বলা হয়েছে “ঈশান ঈশ্বরঃ কালঃ নিশাচারী পিনাকবান্” ? যেখানে ঈশান শিবেরই রূপধারক শব্দরূপে ব্যবহৃত ।


একাধিক পুরাণ ও উপনিষদ যদি ঈশান = শিব বলে থাকে, তাহলে একক কোনো স্তোত্রবাচ্য প্রমাণ দিয়ে ঈশান শব্দের অর্থ পাল্টে দেওয়াটা কতটা যুক্তিসংগত ?


না, কখনোই যুক্তিসঙ্গত নয়।

তাই ‘ঈশ্বর’ নামটি দ্বারা যে অদ্বিতীয় পরমসত্তাকে বোঝানো হয়, তিনি একমাত্র পরমেশ্বর শিবই, অন্য আর কেউ নয়। 

যেমন, নটরাজ, উমাপতি, মহাদেব নামসমূহ একান্তই পরমেশ্বর শিবের‌, অন্য কারো নয়, ঠিক তেমন ভাবে ‘ঈশ্বর’ নামটিও পরমেশ্বর শিবের‌ই। এমনকি সত্যযুগে প্রভু শিবের প্রদান করা প্রথম গীতার নাম হল - ঈশ্বরগীতা, যা কূর্মপুরাণের অন্তর্গত। 

আর যেহেতু ঈশ্বর শব্দটি সনাতন ধর্মের শাস্ত্রের মধ্যেই রয়েছে। বাইবেল, কোরআন বা অনান্য অসনাতনী মতবাদের গ্রন্থে অনুপস্থিত, তাই খ্রিস্টান, মুসলমানদের মান্য পরমসত্তাকে কখনোই ঈশ্বর শব্দে ভূষিত করা যায় না, কারণ এটি যুক্তিসঙ্গত নয়। 

________________________________________________

        🙏“সর্বে হ্যেষ রুদ্রস্তস্মৈ রুদ্রায় নমো অস্তু”🙏


নমঃ শিবায় 🙏
নমঃ শিবায়ৈ🙏
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে ✊🚩
হর হর মহাদেব 🚩 

✍️সত্য উন্মোচনে — শ্রী অন্তিক ভট্টাচার্য্য (শম্বরনাথ শৈব)

🌻বিশেষ কৃতজ্ঞতা— আমার গুরু শ্রী নন্দীনাথ শৈবাচার্য ও আমার আদর্শ শ্রী রোহিত কুমার চৌধুরী শৈবজী।

কপিরাইট ও প্রচারে— আন্তর্জাতিক শিবশক্তি জ্ঞান তীর্থ (International Shiva Shakti Gyan Tirtha)

বিঃ দ্রঃ — লেখাটি অনুকরণ করলে সম্পূর্ণ করবেন, কোনো রকম কাটছাট গ্রহণযোগ্য নয়।


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ