শতরুদ্রিয় সূক্ত নিয়ে আর্য সমাজীদের করা অপব্যাখ্যার খণ্ডন (শৈব পরম্পরা দ্বারা)
🔶শুক্ল-যজুর্বেদ শতরুদ্রীয় অধ্যায়ে রুদ্রের শতরূপ এবং শতরুদ্রিয় হোমের সঙ্গতিপূর্ণ ব্যাখ্যা ও আর্য সমাজী নামক অনার্যদের অপপ্রচারের খণ্ডন ও অপব্যাখ্যা নিরসন🔶
🔘বৈদিক সাহিত্য মানবসভ্যতার অন্যতম প্রাচীনতম জ্ঞানভাণ্ডার। এর প্রতিটি মন্ত্র, স্তোত্র ও অধ্যায় গভীর দার্শনিক তাৎপর্য বহন করে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, যুগে যুগে কিছু অনার্য ব্যাখ্যাকার বেদের প্রকৃত তাৎপর্য বিকৃত করার চেষ্টা করেছে। এই ‘অনার্য’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে দয়ানন্দ সরস্বতী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘আর্য সমাজ’ -এর অনুসারী আর্যসমাজীদের। কারণ, এরা নিজেদের আর্য বলে দাবী করলেও এদের কোনো লক্ষণ প্রকৃত আর্যের মতো নয়, বরং আর্যের বিপরীত অনার্যের মতো। তাই এখানে আর্যসমাজীদের অনার্য আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি,
বিশেষত, শুক্ল-যজুর্বেদের ১৬ অধ্যায় কে রুদ্র অধ্যায় বলে, যুগ যুগ ধরে এই অধ্যায়কে শতরুদ্রিয় বলে সম্বোধন করেছে বিভিন্ন শাস্ত্রে। কারণ এইখানে পরমেশ্বর মহারুদ্র শিবের শত নাম উল্লেখিত হয়েছে।
এই শতরুদ্রিয় অধ্যায়কে ঘিরে এই আর্যসমাজীদের একটি মূর্খতাপূর্ণ দাবী হলো, এখানে যে ‘রুদ্র’কে বারবার বন্দনা করা হয়েছে, তিনি কোনো চিরন্তন ঈশ্বর নন, বরং একজন সাধারণ ক্ষত্রিয় রাজা বা সেনাপতি। তাদের মতে, এই অধ্যায়ের মূল আলোচ্য বিষয় - ক্ষাত্রধর্ম, ঈশ্বরতত্ত্ব নয়।
এই দাবির মাধ্যমে আসলে তারা বৈদিক ঐতিহ্যের কেন্দ্রীয় ধারণা এক সর্বব্যাপী, সর্বরূপ, সাকার, সর্বজনীন চৈতন্যসত্তার পূজাকে খর্ব করতে চেয়েছে। কেননা, যদি রুদ্র কেবল একজন মানবশাসক হন, তবে শতরুদ্রিয় হয়ে দাঁড়ায় কেবল রাজনৈতিক বা সামরিক প্রশস্তি, এর আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য হারিয়ে যায়।
কিন্তু, গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, অনার্যদের এই ব্যাখ্যা পরস্পরবিরোধী, অসম্পূর্ণ এবং যুক্তিহীন। শতরুদ্রীয় কেবল যুদ্ধনীতি বা রাজধর্মের উপদেশ নয়, বরং সমগ্র জগতকে পরিব্যাপ্ত করা সর্বোচ্চ সত্তার বন্দনা। এখানে রুদ্রকে কখনো শস্ত্রধারী, কখনো পশুপালক, কখনো ব্যাধ বা চোররূপে চিত্রিত করা হলেও এর দ্বারা কোনো ব্যক্তি বিশেষকে চোর বা ব্যাধ বলা হয়নি। বরং এটি রুদ্রের সর্বরূপ ধারণ, জগতের ক্ষুদ্রতম ও সাধারণতম রূপ থেকে মহত্তম ও পরম রূপ পর্যন্ত সবই রুদ্রস্বরূপ।
অতএব, শতরুদ্রীয়ের প্রকৃত তাৎপর্য বোঝার জন্য একপাক্ষিক ব্যাখ্যা নয়, সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই গ্রহণযোগ্য। যেখানে অনার্যরা এটিকে মানবশাসক বা ক্ষাত্রধর্মের সঙ্গে সীমাবদ্ধ করতে চায়, সেখানে বাস্তবে এটি এক পরম আধ্যাত্মিক দার্শনিক স্তোত্র, যা রুদ্রকে সর্বব্যাপী, সর্বরূপ, চিরন্তন পরমসত্তা রূপেই প্রকাশ করে।
এবার একে একে অনার্যদের অবান্তর দাবীগুলো খণ্ডন করা যাক।
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী —
যজুর্বেদ ১৬/৫৯ "যে ভূতানামধিপতয়" মন্ত্রে উব্বট মহিধর রুদ্রশব্দ কে ঈশ্বর পক্ষে লাগান নি বরং ভূতের রক্ষক পক্ষে লাগিয়েছেন যাহাতে ক্ষত্রিয় রাজার আশয় সিদ্ধ হয়।
শুধু এই নয় দেখুন
"যেতীর্থানি প্রচরন্তিম্কাহস্তানিষঙ্গিণঃ "যজু ১৬। ৬১
এই মন্ত্রের ভাষ্য মহিধর লিখেছেন -
"যে রুদ্রা তীর্থানি প্রয়াগকাশ্যাদীনি প্রচরন্তি গচ্ছতি। কীদৃশাঃ। সৃকাহস্তা সৃকা ইত্যায়ুধনাম স্কা আয়ুধানি হস্তে যেসাং তে"
অর্থঃ
যে রুদ্র প্রয়াগাদি তীর্থে শস্ত্র হাতে নিয়ে বিচরন করেন (নিষঙ্গিণঃ) খড়গ ধারণ করে।
এই বিষয়ে উব্বটও একই অর্থ করেছেন। এই অর্থ দ্বারা সিদ্ধ হয় হয় যে, আপনারও ভাষ্যকার রুদ্র শব্দের অর্থ সব জায়গায় ঈশ্বর মানেন নি।
এই ভাষ্যকারদের মতে রুদ্র শব্দ ক্ষত্রিয় বিশেষ বা দেব বিশেষের বাচকই নয় বরং কোথাও কোথাও চোর ডাকুর বাচক হিসেবে রুদ্র শব্দ ব্যবহার করেছেন। এই অধ্যায়ের ৬০ নং মন্ত্রে উব্বট লিখেছেন " চোরাদয়ো বা রুদ্রা "অর্থ- রুদ্র শব্দের অর্থ চোর আদি।
এরূপে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী উক্ত অধ্যায় রাজপক্ষে ব্যাখ্যা করেছেন। অধ্যায়ের প্রারম্ভে তিনি বলেছেন "অথ রাজধর্ম উপদিশ্যতে" অর্থাৎ ষোড়শ অধ্যায় আরম্ভ হলো। এই অধ্যায়ের প্রথম মন্ত্রে রাজধর্মের উপদেশ করা হয়েছে
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন —
শতরুদ্রীয়তে রুদ্রকে শতরূপে স্তুতি করা হয়েছে। রুদ্রের যেমন- শান্ত, সৌম্য, মঙ্গলময় স্বরূপ রয়েছে তেমনি- ভয়ানক, বিকৃত, অদ্ভুত স্বরূপেও স্তুতি করা হয়েছে। তাই, অনার্যরা কেবল ১/২ টি মন্ত্রের খণ্ডিত ভাষ্য দ্বারা এটা প্রমাণ করতে চেয়েছে যে, রুদ্র একজন সাধারণ রাজা/সেনাপতি, তবে আমি তাদের বলতে চাই, এটা অনার্যদের বৃথা চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
🔘শতরুদ্রীয় নিয়ে উবট-মহীধর দুই ভাষ্যকার প্রারম্ভে বলেছেন—
🔘উবট ভাষ্য— শতরুদ্রীয়হোমঃ। অথাতো যঃ শতরুদ্রীয়ং জুহোতি ইত্যুপক্রম্য স এষোঽন্নাগ্নিশ্চিতো বুভুক্ষমাণো রুদ্ররূপেণাবতিষ্টতে। তস্য তর্পণং দেবৈঃ কৃতম্। দ্বিতীয়ং দর্শনম্। যদ্বৈ শতরুদ্রীয়ং জুহোতীত্যুপক্রম্য প্রজাপতের্বিস্রস্তাদিত্যভিধায় মন্ত্রার্যানুগুপ্যেন শ্রুতির্ভবতি। স এব শতশীর্ষো রুদ্রঃ সমভবদিতি। নমস্তে রুদ্রমন্যবে রৌদ্রোঽধ্যায়ঃ পরমেষ্টিন আপে দেবানাং বা প্রজাপতের্বা আগ্রোঽনুবাকঃ ষোড়শভিঋগ্ভিঃ। তত্র একো রুদ্রো দেবতা একা গায়ত্রী তিস্রোঽনুষ্টুভস্তিস্রঃ পঙ্ক্তয়ঃ সপ্তানুষ্টুভৌ দ্বে জগত্যৌ। নমোঽস্তু তে।।১।।
ভাষ্যনুবাদ— "শতরুদ্রীয় হোম"— অর্থাৎ, এখন যিনি শতরুদ্রীয় মন্ত্র দ্বারা আহুতি দেন, সেই ব্যক্তি অন্ন ও অগ্নিসহ পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে রুদ্ররূপে অবতীর্ণ হন। দেবতারা তাঁর পূজা (তর্পণ) করেন।
দ্বিতীয় স্থানে দেখা যায়, যখন কেউ শতরুদ্রীয় জপ করেন, তখন তা প্রজাপতির কাছ থেকে উদ্ভূত বলেই শ্রুতি বলে থাকে। তখন সেই রুদ্র শতশীর্ষ রূপে প্রকাশিত হন। "নমস্তে রুদ্র মন্যবে" দিয়ে শুরু হওয়া এই অধ্যায়ে পরমেষ্টি দেবতা কিংবা প্রজাপতি ঋষি, ষোড়শ ঋক সমন্বিত। তাতে এক রুদ্র দেবতা, এক গায়ত্রী, তিন অনুষ্টুপ্, তিন পঙ্ক্তি, সাত অনুষ্টুপ্, এবং দুই জগতি ছন্দ আছে।
🔘মহীধর ভাষ্য— পঞ্চদশে অধ্যায়ে চয়নমন্ত্রান্ সমাপ্য ষোড়শে শতরুদ্রীয়াখ্যহোমমন্ত্রা উচ্যন্তে। শতরুদ্রীয়হোম উত্তরপক্ষস্যাপরস্যাভ্যং স্রক্তয়াং পরিশ্রিৎস্বকেপর্ণেনাকেকাষ্টেন শাতয়ন্সংততং জর্তিলমিশ্রান্ গবেধুকাসক্তুনজাক্ষীরমেকে তিষ্টত্রুদঙনামস্য ইত্যধ্যায়েন ত্র্যনুবাকান্তে স্বাহাকারো জানুমাত্রে পশ্চান্তে চ নাভি মাত্রে প্রাক্ চ প্রত্যবরোহেভ্যো মুস্রমাত্রে প্রতিলোমং প্রত্যবরোহান্ জুহোতি প্রমাণেষু নমোঽস্তিয়ি প্রতিমন্ত্রম্ (কা ১৮/১/১-৫)। হিরণ্যশকলৈরগ্নিপ্রোক্ষনান্তরং শতরুদ্রীয়সংজ্ঞো হোমঃ তস্যা হবনীয়ে প্রাপ্তাবপবাদমাহ। উত্তরপক্ষপশ্চিমকোণে যাঃ পরিশ্রিতো জঙ্গামাত্রাদয়ঃ পূর্ব নিখাতাস্তাসু হোমঃ। তত্র বিধিঃ। জর্তিলৈরারণ্যতিলৈর্ভিশ্রান্ গবেধুকাসক্তুনক্রেপত্রেণ জুহোতি । কি কুর্বন্ । অর্ককাষ্ঠেন সন্ততং ক্ষারযন্ পরিশ্রিত্সু পাতযন্ অর্কপত্রং দক্ষকরেণাদায়ার্ককাষ্ঠং বামেনাদায় তেন পাতনীযম্। সক্তুস্থানে অজাদুগ্ধমিতি কেচিত্ । উদঙ্মুখো নমস্ত ইত্যধ্যায়েন । তত্রানুবাকত্রযান্তে “অর্ভকেভ্যশ্চ বো নমঃ? ( ক০ ২৬ ) ইত্যত্র জানুমাত্রে পরিশ্রিতি স্বাহাকারো বিধেয়ঃ । পশ্চানুবাকান্তে সুধন্বনে চ? ( ক০ ৩৬ ) ইত্যত্র নাভিমাত্রে পরিশ্রিতি স্বাহাকারঃ । “নমোঽস্তু রুদ্রেভ্যঃ ( ক০ ৬৩ ) ইতি প্রযবরোহমন্ত্রাঃ তেভ্যঃ প্রাক্ মুখমাত্রপরিশ্রিতি স্বাহাকারঃ । নমোঽস্ত্বিতি কণ্ডিকাত্রয়েণ প্রতিলোমং হোমঃ । যে দিবি? ( ক০ ৬৪ ) ইতি মুখমাত্রে । 'যেঽন্তরিক্ষে ( ক০ ৬৫ ) ইতি নাভিমাত্রে । যে পৃথিব্যাম্' ( ক০ ৬৬ ) ইতি জানুমাত্রে । ইতি সূত্রার্থঃ । নমস্তে । ষোড়শর্চোঽনুবাকঃ একরুদ্রদৈবত্যঃ আদ্যা গায়ত্রী তিস্রোঽনুষ্টুভঃ তিস্রঃ পঙ্ক্তয়ঃ সপ্তানুষ্টুভঃ দ্বে জগত্যো । অধ্যাযস্য পরমেষ্ঠিদেবপ্রজাপতয ঋষযঃ । মা নঃ . ( ক০ ১৫-১৬ ) ইতি দ্বয়োঃ কুৎসোঽপি ঋষিঃ । হে রুদ্র, রুত্ দুঃখং দ্রাবযতি রুদ্রঃ । যদ্বা “রু গতৌ? যে গত্যর্থাস্তে জ্ঞানার্থাঃ। রবণং রুত্ জ্ঞানং রাতি দদাতি রুদ্রঃ জ্ঞানম্ ভাবে ক্বিপ্ তুগাগমঃ । রুত্ জ্ঞানপ্রদ্ঃ । যদ্বা পাপিনো নরান্ দুঃখভোগেন রোদযতি রুদ্রঃ । হে রুদ্র, তে তব মন্যবে ক্রোধায় নমঃ নমস্কারোঽস্তু । উতো অপিচ তে তবেষবে বাণায় নমঃ । উতাপিং চ তে তব বাহুভ্যাং নমঃ । তব ক্রোধবাণহস্তা অস্মদ্রিষ্বেব প্রসরন্তু নাস্মাখিযত্যর্থঃ ॥ ১ ॥
ভাষ্যানুবাদ— পূর্বের (১৫তম) অধ্যায়ে চয়নমন্ত্র শেষ হওয়ার পর ষোড়শ অধ্যায়ে শতরুদ্রীয় নামে হোম মন্ত্রগুলি এসেছে। এই হোম, যজ্ঞের উত্তর অংশে, নির্দিষ্ট পাত্রে ও শালপাতায়, জটিল বীজ মিশ্রিত শস্য, অজাদুগ্ধ বা সক্তু (শুকনা খাদ্য) দিয়ে করা হয়।
আহুতি দেবার সময় আর্কগাছের কাঠ দিয়ে শিখা রক্ষা করে, শালপাতায় সেই শস্য রেখে দক্ষহস্তে অর্ঘ্য তুলে দেন। প্রতিটি মন্ত্রে স্বাহা উচ্চারণসহ দিকনির্দেশ অনুযায়ী আহুতি দেওয়ার নিয়ম রয়েছে যেমন, "অর্ভকেব্যশ্চ বো নমঃ" মন্ত্রে হাঁটু সমান উচ্চতায়, "সুধন্বনে চ" মন্ত্রে নাভি সমান উচ্চতায়, "যে দিবি" মন্ত্রে মুখ সমান উচ্চতায়, ইত্যাদি। এই অধ্যায়ের দেবতা এক রুদ্র, প্রথম মন্ত্র গায়ত্রী, পরে বিভিন্ন ছন্দে বাকিগুলো। ঋষি পরমেষ্টি দেবতা ও প্রজাপতি। "রুদ্র" শব্দের অর্থ, যিনি দুঃখ নাশ করেন। অথবা "রু" (গতি) থেকে যিনি জ্ঞান প্রদান করেন। অথবা পাপীদের দুঃখভোগের দ্বারা কাঁদান।
"হে রুদ্র, তোমার ক্রোধের জন্য নমস্কার, তোমার তীক্ষ্ণ বাণের জন্য নমস্কার, তোমার বাহুর জন্য নমস্কার। তোমার ক্রোধবাণ যেন আমাদের দিকে না আসে, বরং শত্রুর দিকে যায়।"
🔘ব্যাখ্যা— এই অংশে মূলত শতরুদ্রীয় হোমের নিয়ম, উদ্দেশ্য, এবং রুদ্রের প্রার্থনা বর্ণিত হয়েছে।
উদ্দেশ্য:— যজ্ঞকারী নিজেকে রুদ্ররূপে প্রতিষ্ঠা করে দেবতার সন্তুষ্টি ও আশীর্বাদ লাভ করা।
কর্মপদ্ধতি:— নির্দিষ্ট উপাদান (শস্য, দুধ, কাঠ), নির্দিষ্ট ভঙ্গি ও উচ্চতায় আহুতি, এবং দিকনির্দেশ অনুযায়ী ক্রম।
রুদ্রতত্ত্ব:— রুদ্র সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, তিনি জ্ঞানদাতা, দুঃখনাশক এবং শত্রুনাশক শক্তির প্রতীক।
প্রার্থনা:— রুদ্রের ক্রোধ যেন যজ্ঞকারী বা তাঁর জনগণের দিকে না আসে, বরং শত্রুর দিকে গিয়ে তাদের বিনাশ করুক।
অর্থাৎ, এখান থেকে বিষয়টা পরিস্কার যে, শতরুদ্রীয়তে রুদ্রকে শতরূপে স্তব করা হয়েছে। এবং এই শতরুদ্রীয় ভাষ্য অনুযায়ী রুদ্রের উদ্দেশ্যে করা হোমের মন্ত্র, যেখানে রুদ্রের করুণা যাচনা ও রুদ্রের ক্রোধ নিবারণ করার প্রার্থনা জানানো হয়েছে। যেখানে রুদ্রকে শতরূপে আহুতি দেওয়া হয়েছে। তাই এখানে বিষয়টি দিনের আলোর ন্যায় পরিস্কার যে, এখানে রুদ্রকে ঈশ্বর রূপেই স্তব করা হয়েছে, কোনো সাধারণ রাজা বা সেনাপতি রূপে নয়। কেননা, কোনো রাজা বা সেনাপতির উদ্দেশ্যে হোম করা হয় না। হোম একমাত্র ঈশ্বরের করুণাময় অনুগ্রহ লাভের উদ্দেশ্যে করা হয়।
উবট এবং মহীধর উভয় রুদ্রকে শতরূপে স্তব করেছেন। রুদ্রকে সৃষ্টি, স্থিতি, লয়ের কর্তা, সকল জীবের হৃদয়ে আত্মারূপে অবস্থানকারী, ষড়ৈশ্বর্যযুক্ত ঈশ্বরও বলেছেন এবং মহাহত্যাকারী (প্রলয়ে যিনি সমস্ত জগত ধ্বংস করেন), বিকৃত রূপধারীও বলেছেন। আবার বিশ্বের সকল রূপ রুদ্রের এমনও বলেছেন। এবং এই রুদ্রের করুণা লাভের আশায় হোমে আহুতি প্রদানও করা হচ্ছে। তাই এখানেই অনার্যদের দাবী খণ্ডিত হয়ে যায় যে, শতরুদ্র প্রকরণে ক্ষাত্রধর্ম সম্পর্কে বলা হচ্ছে।
🔘এবার আসা যাক ৫৯ ও ৬১ নং মন্ত্রের ভাষ্যে—
আমি ব্যাখ্যা করেছি যে, এখানে রুদ্রকে শতরূপে হোমে আহুতি দেওয়া হচ্ছে। তার মধ্যে রুদ্রের শান্ত করুণাময় স্বরূপের উদ্দেশ্যেও দেওয়া হচ্ছে এবং ভয়ঙ্কর, বিকৃত, নিকৃষ্ঠ রূপের উদ্দেশ্যেও দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এর থেকে বোঝা যায় যে, রুদ্রই সর্বব্যাপী সত্ত্বা যিনি জগতের সকল রূপের ধারক৷ তাই রুদ্র যদি খড়গ ধারী হন তাতে তো রুদ্রের পরমত্বে কোনো প্রভাব পড়েনা। এবং রূদ্রকে কেন “চোর আদি” বলা হয়েছে তার মীমাংসা এই লেখার শেষে দেওয়া হবে।
উবট ও মহীধর শতরুদ্রীয়ের ২৯ নং মন্ত্রের ভাষ্যে বলেছেন—
শিপিবিষ্ট = বিষ্ণুরূপ ‘বিষ্ণুঃ শিপিবিষ্টঃ’ শ্রুতি আছে ।
অথবা, শিপি (পশু) তে প্রবিষ্ট ‘পশবঃ শিপিঃ’ সমস্ত প্রাণীতে অন্তর্যামী রূপে অবস্থিত তাই শিপিবিষ্ট।
অথবা, ‘যজ্ঞঃ শিপিঃ’ যজ্ঞে অধিদেবতা রূপে প্রবিষ্ট বা শিপিরূপ সূর্যের মধ্যে অধিষ্ঠাতা। অথবা, রশ্মিরূপ শিপিতে অভিষ্ট ।
অর্থাৎ এক রুদ্রই যিনি গিরিতে (কৈলাসে) থাকেন, সেই রদ্রই সকল প্রাণীর মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন, তাই রুদ্রই হলো বিষ্ণু অর্থাৎ সর্বব্যাপী ঈশ্বর৷ আবার রুদ্রকে আদিত্য রূপেও বলেছেন ভাষ্যকাররা। সূর্য সমস্ত জগৎকে নিজের কিরণ দ্বারা ব্যাপ্ত করেন তাই সূর্যও সর্বব্যাপী। এখানেও রুদ্রকে সর্বব্যাপী ঈশ্বর হিসেবেই মেনেছেন ভাষ্যকাররা৷ রুদ্রই বিষ্ণু ও সূর্য রূপে প্রতিভাসিত হন।
সুতরাং, এখানে বিষয়টি পরিস্কার যে, রুদ্রই সর্বব্যাপী ঈশ্বর। জগতের সকল রূপেই রুদ্র প্রবিষ্ট। মায়ায় আবদ্ধ জীবেদের পশুপাশ থেকে মুক্ত করেন বলে রুদ্র পশুপতি। তাই, এখানে রুদ্র কোনো সাধারণ রাজা/সেনাপতি নন। রুদ্র এখানে সর্বব্যাপী ঈশ্বর। তাই মঙ্গলময় ও বিকৃত যেকোনো স্বরপেই রুদ্র ব্যাপ্ত হয়ে আছেন।
👉সাধারণ একটা উদাহরণ দ্বারা বোঝায়—
যেমন- জল জীবের তৃষ্ণা নিবারণ করে। আবার জল থেকেই, বরফ হচ্ছে, সফট্ ড্রিংকস্ হল, তরল জাতীয় বিভিন্ন উপাদান হয়েছে, নদী হয়েছে, বাষ্প হয়েছে। অর্থাৎ ব্যবহারিক পর্যায়ে জলের ভালো-মন্দ উভয় স্বরূপই রয়েছে কিন্তু, তত্ত্বগত ভাবে এক বিশুদ্ধ জল তত্ত্বই বিদ্যমান৷
তদ্রুপ রুদ্রেরও ব্যবহারিক পর্যায়ে রুদ্রের বিভিন্ন স্বরূপ থাকলেও, পারমার্থিক পর্যায়ে এক নিষ্কলঙ্ক অনন্ত সর্বব্যাপী সত্ত্বা রুদ্রই বিরাজমান আছেন। ভয়ঙ্কর/সৌম্য/অস্ত্রধারী/চোরসদৃশ/সূর্য/বিষ্ণু সব রূপই রুদ্রতত্ত্বের বহুমুখী প্রকাশ। তাই রুদ্রের অসংখ্য স্বরূপের মধ্যে মঙ্গলময়-বিকৃত উভয় স্বরূপই বিদ্যমান। তাই কেবল ব্যবহারিক রূপ দ্বারা রুদ্রকে কদাপি মানুষের কাতারে বিচার করাটা মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
ঋগ্বেদ (১/১৬৪/৪৬) অনুযায়ী "একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি"— সত্য এক, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞরা তাকে নানাভাবে বলেন।
উব্বট ও মহীধর উভয়েই বলেছেন—
“একো রুদ্রো দেবতা একা গায়ত্রী…”
অর্থাৎ, শতরুদ্রীয়ের সমস্ত মন্ত্রের একমাত্র দেবতা হলেন রুদ্র।
তাই শতরুদ্রিয়তে রুদ্রকে কৃষক, রাজা, সৈনিক, শিকারী, এমনকি “অস্ত্রধারী” বা “ভূতপতি” রূপে বন্দনা করা তাঁর সর্বত্র বিদ্যমানতাকেই প্রতিপাদিত করে।
প্রেক্ষাপট না বুঝে “অস্ত্রধারী” অর্থকে চোর/ডাকাত হিসেবে ধরে নেওয়া আসল অর্থ বিকৃতি।
🔘 শতরুদ্রিয় মন্ত্রাবলির উদ্দেশ্য হচ্ছে এক রুদ্রকেই শতরূপে বন্দনা করা। তাই কোথাও রুদ্রকে শান্ত, করুণাময়, মুক্তিদাতা বলা হয়েছে, আবার কোথাও ভয়ঙ্কর, অস্ত্রধারী, ভূতপতি বলা হয়েছে। এর কারণ, রুদ্রই সর্বব্যাপী ঈশ্বর, সকল রূপের মধ্যে তিনি প্রবিষ্ট।
অতএব, কোনো এক-দুইটি মন্ত্রকে খণ্ডিতভাবে টেনে এনে রুদ্রকে কেবল রাজা, সেনাপতি বা চোর ডাকাতের সমার্থক বলা যুক্তিহীন। কারণ—
হোম, যজ্ঞ, আহুতি এসব কখনোই কোনো মানুষ বা রাজাকে উদ্দেশ্য করে হয় না, কেবল ঈশ্বরকেই উদ্দেশ্য করে হয়।
উবট ও মহীধর উভয় ভাষ্যকারই রুদ্রকে সৃষ্টি, স্থিতি, লয়ের কর্তা এবং সর্বব্যাপী ঈশ্বররূপে বর্ণনা করেছেন।
শাস্ত্রীয় নীতি অনুযায়ী, আংশিক ভাষ্য দিয়ে পূর্ণার্থ বিকৃত করা অবৈধ, প্রেক্ষাপট ধরেই অর্থ নির্ণয় করতে হয়।
👉 তাই যুক্তির নিরিখে পরিস্কার যে, শতরুদ্রিয়তে রুদ্রকে কখনোই সাধারণ মানুষ (রাজা, ডাকাত বা সৈনিক) হিসেবে কল্পনা করা হয়নি। বরং রুদ্রই সর্বব্যাপী ঈশ্বর, যিনি জগতের সকল রূপে বিরাজমান।
🔴 অনার্য দের মূর্খতাপূর্ণ দাবীর উপর কিছু প্রশ্ন—
১. যদি রুদ্র কেবল একজন রাজা/সেনাপতি হন, তবে
কেন তাঁর উদ্দেশ্যে শতরুদ্রিয় হোমের বিধান থাকবে, যা একান্তই দেবতাদের উদ্দেশ্যে করা হয় ?
২. কোনো রাজা বা সেনাপতির উদ্দেশ্যে কি কখনো "নমঃ" (পূর্ণ ভক্তিভরে প্রণাম) সহ মন্ত্রোচ্চারণ করা হয় ?
যদি হয়, তবে কোন বৈদিক প্রমাণ আছে ?
৩. যদি রুদ্র কেবল ভয়ঙ্কর চরিত্র হতেন, তবে কেন শতরুদ্রিয়তে তাঁকে আবার “দুঃখনাশক, জ্ঞানদাতা, সর্বব্যাপী” বলা হয়েছে ?
এক সাধারণ মানুষ কিভাবে একই সাথে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও দুঃখনাশক হতে পারে ?
৪. শতরুদ্রিয়তে রুদ্রকে “শিপিবিষ্ট” বলে বিষ্ণুরূপে, সূর্যরূপে, প্রাণীতে প্রবিষ্ট রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
এক রাজা কি কখনো সূর্য বা সর্বব্যাপী বিষ্ণু হতে পারেন ?
৫. বৈদিক যজ্ঞে প্রতিটি দেবতার মন্ত্র নির্দিষ্ট, যদি রুদ্র কোনো রাজা হতেন, তবে তাঁর মন্ত্র কোথায় বাকি রাজাদের জন্যও আছে? কেন শুধুই রুদ্রের জন্য শত শত মন্ত্র সংকলিত হলো ?
৬. “ভূতানামধিপতয়ঃ” বলে রুদ্রকে সকল জীবের অধিপতি বলা হয়েছে।
এক রাজা কি কখনো সকল জীবের (পশু, পাখি, মানুষ, দেবতা) অধিপতি হতে পারেন ?
৭. যদি রুদ্রকে চোর-ডাকাতের দেবতা বলা হয়, তবে কেন শতরুদ্রীয়তেই তাঁকে করুণাময়, পাপিনীকেও রক্ষা করতে সক্ষম বলা হয়েছে ?
চোর ডাকাতের দেবতা কি করুণা ও মুক্তির প্রতীক হতে পারে ?
——————————————————————————————————————————————
❌ অনার্য আর্যসমাজীদের ব্যাখ্যা —
নমস্তে রুদ্র মন্যব উতো ত ইষুবে নমঃ বাহুভ্যাভূত তে নমঃ৷৷১৷৷
ভাষার্থঃ
হে (রুদ্র) দুষ্ট শত্রু কে রোদনকারী রাজন! তোমার (মন্যবে) ক্রোধযুক্ত বীর পুরুষের জন্য (নমঃ) বজ্র প্রাপ্ত হোক (উতো) এবং (ইষবে) শত্রুকে নাশকারী (তে) তোমার জন্য (নমঃ) অন্ন প্রাপ্ত হোক (উত) এবং (তে) তোমার (বাহুভ্যাম) ভুজা দ্বারা (নমঃ) বজ্র শত্রুকে প্রাপ্ত হোক৷৷ ১৷৷
নোটঃ মন্ত্রে দয়ানন্দ জী রুদ্র শব্দের অর্থ রাজন করেছেন। রুদ্র কে জীব পক্ষে করার পক্ষে তিনি শতপথ এবং উণাদি কোষ থেকে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। যথাঃ "কতমে রুদ্র ইতি দশমে পুরুষ প্রাণা একদশ আত্মা। একাদশ রুদ্রাঃ কস্মাদেতে রুদ্রা যদসম্মান্ মর্তাচ্ছরীরদুৎক্রামন্ত্যথ রোদয়ন্তি যত্তদ্রোদয়ন্তি তস্মাদ্ রুদ্রা। ইতি শতপথ ব্রাহ্মণে [বৃহঃ উপঃ ৩।৯। 8]
রোদের্ণিলুক্ চ [উণা০ ২.২৪] অনেনেণাদিগণসুত্রেণ
রোদিধাতো রক্ প্রত্যয়ো ণিলুক্ চ।"
অর্থাৎ রুদ্র কয়টি? অর্থাৎ পঞ্চ প্রাণ এবং পঞ্চ উপপ্রাণ এই দশ প্রাণ এবং জীবাত্মা মিলে একাদশ রুদ্র। এই এগারো দেহান্তকালে রোদন করায় বলিয়া রুদ্র বলা হয়।
❌অনার্যদের দাবি— “রুদ্র” = রাজা বা বীর ব্যক্তি, ঈশ্বর নন। “মন্যু” মানে ক্রোধ, “ইষু” মানে অস্ত্র। মন্ত্রে মানুষের প্রতি প্রার্থনা।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— অনার্যদের দাবী অনুযায়ী শতরুদ্রিয়তে যে রুদ্রের উল্লেখ আছে তিনি একজন বীর রাজা, কোনো ঈশ্বর নন। এবং এই দাবীকে স্থাপিত করার জন্য শাস্ত্রের বেশ ভালোই রকমেই অনর্থ করেছে এই তথাকথিত বেদবাদী আর্যসমাজীরা। রুদ্র অর্থে যদি কেবল মানুষ বা বীর ক্ষত্রিয় রাজাই বোঝায় তবে সমস্ত শতরুদ্রীয় জুড়ে- শিব, শর্ব, ভব, উগ্র, ভীম, রুদ্র, সোম, শিপিবিষ্ট, পশুপতি, গিরিশ, কপর্দ্দী, নীললোহিত, নীলগ্রীব, কৃত্তিবাসা, ধনুকধারী, সহস্রাক্ষ, হিরণ্যবাহু ইত্যাদি শব্দ দ্বারা কোন রাজাকে বোঝানো হয়েছে তা একমাত্র দয়াভণ্ডের শিষ্য অনার্যরাই জানে। অথবা, কোন রাজা বা মানুষের বৈশিষ্ট্য এমন - তা এই অনার্যরা ছাড়া আর কেউই জানে না। কেননা, অমরকোষ অনুযায়ী—
শম্ভুরীশঃ পশুপতিঃ শিবঃ শূলী মহেশ্বরঃ। ঈশ্বর সর্ব্ব ঈশানঃ শঙ্করশ্চন্দ্রশেখরঃ। ভূতেশঃ খণ্ডপরশুর্গিরীশো গিরিশোম্বড়ঃ। মৃত্যুঞ্জয়ঃ কৃত্তিবাসাঃ পিনাকী প্রমথাধিপঃ। উগ্রঃ কপদ্দী শ্রীকণ্ঠঃ শিতিকণ্ঠঃ কপালতৃৎ। বামদেবো মহাদেবো বিরূপাক্ষস্ত্রিলোচনঃ। কুশানুরেতাঃ সর্ব্বজ্ঞো ধূর্জটিনীললোহিতঃ। হরঃ স্মরহরো ভর্গ-ত্র্যাম্বকন্ত্রিপুরান্তকঃ। গঙ্গাধরোহন্তুকরিপুঃ ত্রুতুধ্বংসী বৃষভধ্বজঃ। ব্যোমকেশো ভবো ভীমঃ স্থাণুরুদ্র উমাপতিঃ। ২১।।
[অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/২১]
অর্থাৎ শম্ভু থেকে শুরু করে উমাপতি পর্যন্ত এই ৪৮ টা নাম দ্বারা শিবকেই বোঝানো হয়। আর এখানে অমরসিংহ শিবের নিরাকার সাকার দুই স্বরূপেরই উল্লেখ করে গেছেন। এবং এসব শব্দ দ্বারা প্রতিপাদ্য বস্তু একমাত্র শিবই কোনো মানুষ বা রাজা নন। কেননা, কোনো মানুষ বা রাজার, তিন চোখ থাকেনা। বাঘের চর্মপরিহিত, পিনাকধারী, জটাজুটধারী, জটাতে গঙ্গাকে ধারণ করা কোনো সাধারণ মানুষ বা রাজার পক্ষের সম্ভব নয়। এবং কোন মানুষ বা রাজা কৈলাসে বাস করেন সেটাও এখানে ব্যাখ্যা করা হয়নি। তাছাড়াও কোন মানুষ বা রাজা উমাপতি (পার্বতী স্বামী) সেটাও এই অনার্যরা ব্যাখ্যা করেনি। কেবল শাস্ত্রের অনর্থ দ্বারা প্রমাণ করতে চেয়েছে এখানে কৈলাস নিবাসী নীলকণ্ঠ ত্রিনেত্রধারী রুদ্রকে বোঝানো হয়নি। কিন্তু, এই দাবীটা সম্পূর্ণ ভুল ও অশাস্ত্রীয়। কেননা, এসব শব্দ দ্বারা কেবল একচেটিয়া ভাবে শিবকেই বোঝায়, কোনো সাধারণ মানুষ বা রাজাকে নয়। তাই শতরুদ্রীয়তে যে রুদ্রের উল্লেখ রয়েছে তিনিই কৈলাসনিবাসী ত্রিনেত্রধারী নীলকন্ঠ শিবই।
🔘তাছাড়াও শুক্লযজুর্বেদের ১৬তম শতরুদ্রিয় অধ্যায়ে পরমেশ্বর শিবেরই মাহাত্ম্য প্রকাশ করা হয়েছে, তার প্রমাণ আমরা মহাভারতেও সুষ্পষ্ট পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে ব্যাসদেব বলেন—
বেদে চাস্য বিদুর্বিপ্রাঃ শতরুদ্রীয়মুত্তমম্।
ব্যাসেনোক্তঞ্চ যচ্চাপি উপস্থানং মহাত্মনঃ।।
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩৯/২২]
অনুবাদ— বেদেও মহাদেবের মাহাত্ম্য প্রকাশক উত্তম শতরুদ্রীয় অধ্যায় আছে, ইহা ব্রাহ্মণেরা জানেন এবং বেদব্যাস সেই মাহাত্ম্য উপাসনার উপযোগী যাহা বলিয়াছেন, তাহাও ব্রাহ্মণেরা অবগত আছেন।
বেদে চাস্য সমান্নাতং শতরুদ্রিয়মুত্তমম্।
[মহাভারত/দ্রোণপর্ব/ অধ্যায়১৭০/৯৯)
অনুবাদ— যজুর্বেদে মহাদেবের উত্তম শতরুদ্রিয় প্রকরণ বলা হইয়াছে।
অতএত, এখানে বিষয়টি স্পষ্ট যে শতরুদ্রিয় কেবল পরমেশ্বর শিবের প্রতিই সমর্পিত, এবং এখানে প্রতিপাদ্য শিবতত্ত্ব নিরাকার হয়েও সাকার স্বরূপে বিদ্যমান। তাই এখানে কোনো মানুষ বা ক্ষত্রিয় রাজা সম্পর্কে নয় বরং পরমেশ্বর শিব সম্পর্কেই নির্দেশ দিয়েছে।
🔘বিস্তারিত ভাবে যদি বলতে হয় তাহলে এখানে পূর্বমীমাংসার “ছাগপশুন্যায়” উদ্ধৃত দেওয়া হচ্ছে— “অগ্নিষোমীয়ং পশুমালভেত” [তৈত্তিরীয় সংহিতা/৬/১/১/৬] “পশুচোদনায়াম্ অনিয়মঃ অবিশেষাৎ” [মীমাংসা ৬/৮/৩০]— অগ্নিষোমীয় যজ্ঞে পশুবলি দেওয়া উচিত, এই নির্দেশক (বিধি) বাক্যে ‘'পশু’ এমন একটি সাধারণ পদ হওয়ায়, তা চার পায়ে চলা কোনো পশু বলি দেওয়ার কথা বলে, কোনো নির্দিষ্ট পশুর কথা বলে না।
এই কারণে, সেই অগ্নিষোমীয় যজ্ঞে বলি দেওয়ার জন্য ঠিক কি পশু, সে বিষয়ে সন্দেহ হয়। কিন্তু, “ছাগস্য হবিশো বপায়া মেদসঃ” [তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩/৬/৮/১]— অর্থাৎ ছাগলের চর্বি দিয়ে হোম করতে হবে, এই অর্থবোধক বিনিয়োগ মন্ত্র থেকে এবং এই মন্ত্রে ‘ছাগ’ নামক বিশেষ পদ থাকার কারণে, সাধারণ ‘পশু’ শব্দের অর্থ ‘ছাগ’ নির্ধারিত হয়। এইভাবে, সাধারণ 'পশু’ শব্দের ‘ছাগ’ অর্থ না করলে, ‘'অগ্নিষোমীয়’’ এই বিধিবাক্য ও ‘ছাগস্য হবিশঃ’ এই বিনিয়োগ বাক্যের মধ্যে একতা থাকবে না। তাই সাধারণ ‘পশু’ শব্দের ‘ছাগ’ এই বিশেষ অর্থ গ্রহণ করা উচিত। এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য পূর্বমীমাংসার “ছাগো বা মন্ত্র বর্ণাত্” [মীমাংসা ৬/৮/৩১]— এই সূত্র প্রবৃত্ত হয়। একেই ছাগপশুন্যায় বলা হয়।
তাই এই ন্যায় দ্বারা সিদ্ধ হয়, ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রে যেসব বিশেষ পদ এসেছে, সেগুলির উপর ভাবনা করে, সাধারণ পদগুলোর অর্থ নির্ধারণ করা উচিত। তাই শতরুদ্রীয় শ্রুতিতে— “রুদ্র” দ্বারা যদি শিবকে মানা না হয় তবে, শ্বেতাশ্বতর, কৈবল্য, অথর্বশির, কঠবল্লী ইত্যাদি অনেক উপনিষদে যেসব বিশেষ শব্দ এসেছে যেমন— শিব, অমৃত, উমাসহায়, উমার্দ্ধদেহং’ পরমেশ্বর, নীলকণ্ঠ, ত্রিলোচন, জাতবেদ, ঈশান ইত্যাদি, সেগুলো শিবেই প্রতিষ্ঠিত বিশেষ শব্দ, তারাও বৃথা হয়ে যাবে। অর্থাৎ শতরুদ্রীয় শ্রুতিতে উল্লেখিত “রুদ্র, শিব, শংকর, উগ্র, ভব, শর্ব, ভীম, পশুপতি, কৃত্তিবাসা, নীললোহিত, সোম, গিরিশ, কপর্দ্দী, ধনুধারী ” বিশেষ অর্থ অন্যান্য শ্রুতি বর্ণিত “শিব, রুদ্র, মহেশ্বর, ত্রিলোচন, বিরূপাক্ষ, কৃষ্ণপিঙ্গল, উমাসহায়ং” বিশেষ অর্থের একাত্মতা থাকবে না। তাই ন্যায় অনুযায়ী “রুদ্র” বিশেষ অর্থ অন্যান্য শ্রুতিতে যে “শিব, ঈশান, রুদ্র, মহেশ্বর আদি যে বিশেষ অর্থ আছে, তাতে শিবই সিদ্ধ হয় অন্য কোনো দেবতা /মানুষ /রাজা নয়। এটাই মেনে নেওয়া ন্যায় সঙ্গত।
👉বিঃ দ্রঃ — এখানে আবার এটা দাবী যেনো না করেন আপনারা অমরকোষ মানেন না। কারণ আপনারা নিজেরাই এখানে অমরকোষ ব্যবহার করেছেন। তাছাড়াও আপনারা অনার্যরা কি মানেন না মানেন তাতে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমরা নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য গিরগিটি ন্যায় রঙ পরিবর্তন করি না।
🔘এই প্রসঙ্গে শুক্ল-যজুর্বেদ ৩.৬১-এর ওপর উব্বট ও মহীধর ভাষ্য থেকে উদ্ধৃতিসহ যুক্তি দিয়ে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করবো যে—
এই মন্ত্রে ‘রুদ্র’ মানে শিব তিনি কেবল নিরাকার ঈশ্বর বা জড় প্রাণ নন, বরং সাকার, অস্ত্রধারী, বসবাসকারী, পূজ্য, শান্ত রূপে পরমেশ্বর শিব।
🔘“সূজবানাম্ অপর্বতঃ ভগবতো রুদ্রস্য বসতিঃ তাম্ অতীহি গচ্ছ।”
(উব্বট ভাষ্য, ৩/৬১ মন্ত্রে)
বিশ্লেষণ—
“ভগবতঃ” = সর্বগুণসম্পন্ন, ঈশ্বরীয় মহিমাসম্পন্ন সজ্ঞানে ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি।
“রুদ্রের বসতিস্থান” = অবস্থান করার অর্থ দেহযুক্ত, সাকার সত্তা।
👉রুদ্র এখানে উপাস্য শিবই, যিনি এখানে কেবল নিরাকার তত্ত্ব নন বরং ভগবানরূপে শিব, যাঁর পর্বতে অবস্থান আছে (যেমন কৈলাস)। এখানে বলে রাখা ভালো শিব যেহেতু পরমব্রহ্ম তাই শিব সাকার নিরাকার দুই অবস্থাতেই বিদ্যমান আছেন। নিরুক্তে বলা আছে—
"অপি বোভয়বিধাঃ স্যুঃ"
[যাস্ক নিরুক্ত/৭/২/৩/৭]
দেবতারা মনুষ্যকার এবং মনুষ্যাকার নয় দুই হতে পারে।
👉ব্রহ্মের অবস্থা সম্পর্কে শ্রুতিতে বলা হয়েছে—
“দ্বে বাব ব্রহ্মণো রূপে মূর্ত্তঞ্চৈবামূর্ত্তঞ্চ”
[বৃহদারণ্যক উপনিষদ/২/৩/১]।
ব্রহ্মের দুটি রূপ একটি নিরাকার অপরটি সাকার।।
👉এবং শ্রুতিতে আরও বলা হয়েছে যে—
“তদনুপ্রবিশ্য সচ্চ ত্যচ্চাভবৎ”
[তৈত্তিরীয় উপনিষদ/২/৬]
অর্থাৎ— ব্রহ্ম সংসারে অনুপ্রবেশ করিয়া সৎ অর্থাৎ মূর্ত এবং ত্যৎ অর্থাৎ অমূর্ত উভয়ই হলেন।
অর্থাৎ এর থেকে জানা যাচ্ছে ব্রহ্ম সাকার ও নিরাকার দুই অবস্থাতেই বিদ্যমান আছেন।
👉এই প্রসঙ্গে ঋগবেদ বলছে—
“অকাযো নির্গুণোহধ্যাত্মা তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত ||”
[ঋগবেদ/আশ্বলায়ন শাখা/১০/১৭১]
অর্থাৎ শিবই অকায়ো ব্রহ্ম যিনি সকল গুণের ঊর্ধ্বে। অকায়ো অর্থাৎ যার কোনো কায়া নেই মানে নিরাকার প্রত্যাগাত্মা। এবং আবার শিবই যে সাকার তার প্রমাণও ঋগবেদ নিজেই দেই—
কৈলাসশিখরাভাসা হিমবদিগরিসংস্থিতা |
নীলকণ্ঠং ত্রিনেত্রং চ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত ||
[ঋগবেদ/আশ্বলায়ন শাখা/১০/১৭১]
যিনি হিমগিরি কৈলাস শিখরে বাস করেন, যিনি (সাকারে) নীলকন্ঠ, যিনি ত্রিনেত্র সেই শিবের প্রতি মন সঙ্কল্পিত হউক।
এর উপর আচার্য সায়ণের ভাষ্যও পাওয়া যায় যেখানে তিনি শিবকে কৈলাস নিবাসী নীলকণ্ঠ ত্রিনেত্রধারী রুদ্র বলেই স্বীকার করে গেছেন। অর্থাৎ শিব নিরাকার হলেও তিনি সাকার স্বরূপেও বিদ্যমান। তাই কেবল একচেটিয়া ভাবে নিরাকার সত্ত্বাকে মেনে সাকার সত্ত্বাকে অবমাননা করা নিতান্তই মূর্খামি ও অশাস্ত্রীয়।
এছাড়াও যজুর্বেদ এর মহীধর-উবট ভাষ্য থেকেও দেখিয়েছিয়ে যে এখানে যে রুদ্রের উল্লেখ রয়েছে তিনি কৈলাস নিবাসী, ত্রিনেত্রধারী, নীলকণ্ঠ স্বরূপ। তাই এখানে আর কোনো রকম অশাস্ত্রী অপব্যাখ্যা খাটবে না। যাইহোক, পূণরায় প্রসঙ্গে আসা যাক।
🔘উবট যজুর্বেদ এর ৩/৬১ নং মন্ত্রের ভাষ্যে বলছেন—
“অহিংসনঃ, অবিনাশয়ঃ চ, অস্মান্ শিবঃ, শান্তঃ ভূত্বা, অতীহি, পূজিতং গচ্ছ।”
(উব্বট ভাষ্য, ৩/৬১ মন্ত্রে)
বিশ্লেষণ—
“শিবঃ” = কল্যাণময় ঈশ্বর, শাস্ত্রীয়ভাবে এটি শিবের পারিভাষিক নাম।
“পূজিতং গচ্ছ” = পূজা লাভ করে চলে যাও → পূজার যোগ্য ব্যক্তি হতে হয়, জড় বা নিরাকার নয়।
“শান্ত হও, অহিংস হও” এগুলো নৈতিক গুণযুক্ত সত্তাকে সম্বোধন করে, জড় পদার্থ নয়।
রুদ্র এখানে স্পষ্টভাবে পূজ্য, নৈতিক, কল্যাণময় শিবরূপে উপস্থাপিত। এটি কোনো নিস্প্রাণ, নিরাকার তত্ত্ব নয়।
🔘“পিনাকাবসঃ”, “কৃত্তিবাসঃ”—
“পিনাকাবসঃ” পিনাক রূপ ধনু যার বস্ত্র বা বাহন।
“কৃত্তিবাসঃ” চর্মবসনধারী (পশুচর্ম পরিহিত)।
(মহীধর ভাষ্য, ৩/৬১)
🔘নিরুক্ত সূত্র সংযোগ—
"রস্তঃ পিণাকমিতি দণ্ডস্য”(নিঘন্টু ৩.২০.২২)
পিনাক = দণ্ড/ধনু
"পিণাকং প্রতিপিনষ্ট্যনেন” (নিঘন্টু ৩.২০.২৬)
পিনাক = সংহারকারী অস্ত্র
ব্যুৎপত্তি— √পিষ্ (পিষ্ = পিষে ফেলা, হত্যা) + আর্ক = পিনাক → ধ্বংসকারী ধনু
“পিনাকধারী”, “চর্মবসনধারী” এই গুণাবলি শুধু শিবেরই পরিচিত রূপচিহ্ন। নিরুক্তেও এই শব্দগুলোর ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে অস্ত্রধারী শিবের জন্য সংরক্ষিত।
🔘“অবততধন্বা” ধনু নামানো শিব—
“অবততধন্বা- অবরোচিত ধনু”
(মহীধর ভাষ্য, ৩/৬১)
🔘ব্যুৎপত্তি—
অব- + তত (√তন্ ধাতু — বিস্তার করা → অস্ত্র ধরা বা ধরা থেকে নামানো)
অর্থ— জ্যামুক্ত ধনুধারী অর্থাৎ যিনি যুদ্ধ শেষে অস্ত্র রাখছেন।
এটি যুদ্ধ-সম্পন্ন সাকার অস্ত্রধারী দেবতা বোঝায়, যাঁকে বলা হচ্ছে “ধনু নামাও, শান্ত হও”। এই গুণ কেবল শিবরূপ রুদ্রের।
✅সিদ্ধান্ত—
শুক্ল-যজুর্বেদ ৩.৬১-এর ভাষ্য অনুসারে এবং যাস্কীয় নিরুক্ত-সমর্থনে নিশ্চিতভাবে বলা যায়—
এখানে ‘রুদ্র’ শব্দ জীব বা নিরাকার তত্ত্ব নয়, বরং সাকার, অস্ত্রধারী, শান্ত রূপ, পূজ্য, বসবাসকারী পরমেশ্বর শিব-কেই নির্দেশ করে।
এই মন্ত্রে রুদ্র ≠ প্রাণ / নিরাকার ঈশ্বর
এই মন্ত্রে রুদ্র = অস্ত্রধারী সাকার শিব, পিনাকী, কৃত্তিবাস, ভগবান।
🔘শতরুদ্রীয়তে রুদ্র শব্দের অর্থ।
মহীধর বলেন —
“হে রুদ্র, রুত্ দুঃখং দ্রাভয়তি রুদ্রঃ। যদ্বা পাপিনো নরান্ দুঃখভোগেন রোদয়তি রুদ্রঃ”
অর্থাৎ, রুদ্র = যিনি পাপীদের দুঃখভোগ করান, দুঃখ দূর করেন = সংহারক ঈশ্বর।
উব্বটও বলেন — “রুদ্ররূপেণাবতিষ্ঠতে” অর্থাৎ ব্রাহ্মণ রুদ্ররূপে অবতীর্ণ হন।
অতএব, রুদ্র = রাজা বা মানুষ নয়, বরং ঈশ্বরতুল্য সংহারশক্তির অধিকারী দেবতা।
🔘মন্ত্র ঈশ্বরকে উদ্দেশ করে মানুষ বা রাজাকে নয়, মন্ত্রে বলা হয়েছে—
“নমস্তে রুদ্র” “তে ইষবে নমঃ” “তে বাহুভ্যাম্ নমঃ”
প্রত্যেক ক্ষেত্রেই “তব” (তোমার) ব্যক্তিগত সর্বনাম, ঈশ্বরকে উদ্দেশ করে।
মানুষকে বা রাজাকে নমস্কার করা এখানে যুক্তিহীন।
✅ অতএব, প্রার্থনা ঈশ্বররূপ রুদ্রের প্রতি, কোনো রাজপুরুষের প্রতি নয়।
🔘“মন্যু” ও “ইষু”।
মহীধরের মতে—
“মন্যু = ক্রোধ”, “ইষু = বাণ (ধনু)” এবং এই ক্রোধ ও অস্ত্র ঈশ্বররূপ রুদ্রের।
❌দয়ানন্দ বলেন — মানুষের ক্রোধ বা অস্ত্র।
✅কিন্তু ভাষ্যে স্পষ্ট, এ সবই রুদ্রদেবের বৈশিষ্ট্য, মানুষের নয়।
🔘অধিকার ও হোমবিধি।
উব্বট বলেন—
এই শতরুদ্র অধ্যায় একটি বৈদিক হোমকর্মের বিধান, যেখানে রুদ্রদেবকে উদ্দেশ করে অন্বাচার্য্য মন্ত্রপাঠ হয়।
কাজেই এটি রাজধর্ম বা রাজাকে প্রশংসা করার মন্ত্র নয়।
🔘সুতরাং—
❌অনার্য দাবী— রুদ্র = রাজা।
✅মহীধর-উবট ভাষ্য— রুদ্র = দুঃখদাতা সংহারক ঈশ্বর।
❌অনার্য দাবী— প্রার্থনা রাজপুরুষের প্রতি।
✅মহীধর-উবট ভাষ্য— সব শব্দ ঈশ্বরকে (তব/তে) উদ্দেশ করে।
❌অনার্য দাবী— মন্ত্র মানবরূপে বীরের বর্ণনা।
✅মহীধর-উবট ভাষ্য— শাস্ত্রীয় হোমকর্মে ঈশ্বররূপ রুদ্রকে স্তব।
❌অনার্য দাবী— “মন্যু” = মানুষের রাগ।
✅মহীধর-উবট ভাষ্য— ভাষ্যে ঈশ্বরের ক্রোধশক্তি।
অতএব, আর্যদের ভাষ্য ও দাবি মহীধর-উব্বটের মূল ভাষ্যবিরুদ্ধ ও বিকৃতিপূর্ণ।
🔘“নমস্তে রুদ্র মন্যব…” মন্ত্রে 'রুদ্র' শব্দকে দয়ানন্দীয় মতে রাজা বা মানব বীর বলে মানা যুক্তিহীন, ভাষ্যবিরোধী ও শাস্ত্রবিরুদ্ধ। এই মন্ত্রে রুদ্র হলেন পরমেশ্বর শিব সাকার, অস্ত্রধারী, পূজ্য, নৈতিক গুণে ভরপুর এক সংহারকারী ঈশ্বর, যিনি “মন্যু” ও “ইষু” দ্বারা সজ্জিত। তাঁকে উদ্দেশ করে নমস্কার ও শান্তি প্রার্থনা করা হয়েছে। এটি কোনো মানব বা রাজাকে নয়, পরমাত্মা শিবকে লক্ষ্য করেই উচ্চারিত বৈদিক স্তোত্র।
শতরুদ্রীয় শ্রুতি ও তার ভাষ্য বিশ্লেষণে নিঃসংশয়ে প্রতিপন্ন হয় যে— এখানে বর্ণিত ‘রুদ্র’ কেবল কোনো প্রতীক, প্রাণ, শক্তি, রাজা বা সাধারণ বীর নন; তিনি শাস্ত্রসম্মত সাকার পরমেশ্বর শিবই। উব্বট ও মহীধরের ভাষ্যে "ভগবান", "শিব", "পূজ্য", "অস্ত্রধারী", "চর্মবসনধারী", "পিনাকী", "বসবাসকারী" এই সব বৈশিষ্ট্যে যাঁর পরিচয় পাওয়া যায়, তিনি নিরাকার নয় বরং দেহধারী ও গুণসম্পন্ন শিবরূপ ঈশ্বর। যাস্কীয় নিরুক্ত, অমরকোষ, উপনিষদ, মহাভারত ও মীমাংসার “ছাগপশুন্যায়” মিলিয়ে দেখালে আরও স্পষ্ট হয় যে, শতরুদ্রীয়তে যে ‘রুদ্র’ পূজিত হয়েছেন, তিনি পরমেশ্বর শিব ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারেন না। অতএব, অনার্যদের এই দাবি যে 'রুদ্র' কেবল কোনো রাজা বা মানবপ্রতীক তা একান্তই অশাস্ত্রীয় ও ভাষ্যবিরুদ্ধ বিকৃতি। শাস্ত্রবাক্যে, ভাষ্যকারের সাক্ষ্যে, এবং তর্কনির্ণয়ক ন্যায়ধর্মে, ‘রুদ্র’ মানেই এখানে শিব সেই সর্বগুণনিধি, সাকার, পূজ্য, শরণযোগ্য মহাদেব।
অতএব, “রুদ্র = রাজা” এই অনার্য ব্যাখ্যা সম্পূর্ণরূপে অশাস্ত্রীয়, অযৌক্তিক এবং বাতিলযোগ্য।
🔴অনার্যদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন —
যদি রুদ্র মানে রাজা হয়, তবে সেই রাজার তিনটি চোখ (ত্র্যম্বক) কীভাবে সম্ভব? “ত্র্যম্বকং যজামহে” [যজু ৩.৬০] ত্র্যম্বক = তিন-চক্ষুযুক্ত এটি কোনো মানব বা রাজার পক্ষে শারীরিকভাবে সম্ভব নয়। কোন রাজা বা বীর মানুষের তৃতীয় নেত্র আছে যা থেকে অগ্নি নির্গত হয়?
রুদ্র যদি রাজা হন, তবে তিনি “গিরিশঃ”, “কৈলাসবাসী”, “উমাপতি” ইত্যাদি উপাধির অধিকারী কীভাবে হলেন?
[শুক্ল-যজুর্বেদ /মহীধর-উবট ভাষ্য/ অধ্যায় ১৬/৩৯] মহীধর ভাষ্য— উময়া সহিতঃ সোমঃ তস্মৈ। উমাপতি = দেবী পার্বতীর স্বামী। মহীধর ভাষ্যেও বলা হয়েছে "সূজবানাম্ অপর্বতঃ ভগবতো রুদ্রস্য বসতিঃ" রুদ্রের পর্বতবাড়ি। গিরিশ = পর্বতের ঈশ্বর।
কোন রাজা পর্বতের অধিপতি? কে উমার স্বামী? কোন ইতিহাসে এমন রাজার অস্তিত্ব?
যদি রুদ্র একজন মানুষ বা রাজা হন, তবে কেন তাকে “পিনাকী” (ধনু ধারি), “কৃত্তিবাস” (চর্মবসনধারী), “ভগবান”, “ঈশান” বলে ডাকা হচ্ছে?
সব শব্দ শিববাচক পারিভাষিক রূপ অমরকোষ, নিরুক্ত, পুরাণ সর্বত্র প্রমাণিত।
মানুষের হাতে “পিনাক” নামক ধনু থাকে না, চর্ম বস্ত্রও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন পরিচ্ছদ নয়। এগুলো শিবের বৈশিষ্ট্য, রাজার নয়।
যদি রুদ্র একজন রাজা হন, তবে কেন শতরুদ্রীয় স্তোত্রে বারবার তাকে ‘নমঃ’, ‘তব’, ‘ভগবতঃ’, ‘পূজিতং গচ্ছ’ ইত্যাদি শব্দে পূজিত ও স্তব করা হচ্ছে?
মানুষ বা রাজাকে তো বৈদিক স্তোত্র ও হোমমন্ত্র দিয়ে পূজা করা হয় না।
“অস্মান্ শিবঃ, শান্তঃ ভূত্বা, অতীহি, পূজিতং গচ্ছ।” (উব্বট ভাষ্য ৩/৬১)
কোন রাজাকে এইভাবে পূজার আহ্বান জানানো হয়? রাজাকে হোমে আহ্বান করে শান্ত হও বলা কি যুক্তিযুক্ত?
যদি রুদ্র মানে প্রাণ বা জীবাত্মা হয় (যেমন শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে), তবে সেই জীবাত্মা কিভাবে অস্ত্রধারী ও সংহারকারী শিবের মতো রূপে চিত্রিত হলো?
শতরুদ্রীয়তে “অস্ত্রধারী রুদ্র”, “বাণনিপাতকারী রুদ্র”, “হিংসিত রুদ্র”, “ভীষণ রুদ্র”, “নীলগ্রীব রুদ্র” এসব রূপের বর্ণনা আছে। কোন প্রাণ বা জীবাত্মা এসব গুণের অধিকারী? এগুলো তো ব্রহ্মাণ্ডসংহারকারী, লোকত্রয়-আচরণকারী ঈশ্বরীয় গুণ প্রাণ বা আত্মার নয়।
যদি রুদ্র রাজা হন, তবে মহাভারতের অনুশাসনপর্ব কেন বলে “বেদে চাস্য বিদুর্বিপ্রাঃ শতরুদ্রীয়মুত্তমম্”
অর্থাৎ, ব্রাহ্মণরা জানেন শতরুদ্রীয় শিবের মাহাত্ম্যপ্রকাশক শ্রুতি। মহাভারতের মতো স্মৃতিশাস্ত্রে রুদ্র = পরমেশ্বর শিব বললে, অনার্যরা কীভাবে সেটিকে শুধুমাত্র একজন “রাজা” বানিয়ে ফেলেন?
কেন মহীধর ও উব্বট দুই প্রাচীন ভাষ্যকার একবারও “রুদ্র = রাজা” বলেননি, বরং সর্বত্র শিবকে বোঝাতে ব্যাখ্যা করেছেন?
উব্বট বলেন — “শিবঃ পূজিতং গচ্ছ”
মহীধর বলেন — “পিনাকাবসঃ”, “কৃত্তিবাসঃ”, “অবততধন্বা” এসব ব্যাখ্যা দেখাচ্ছে রুদ্র = অস্ত্রধারী সাকার দেবতা শিব, কোনো মানব বীর নয়।
যদি রুদ্র = রাজা হয়, তবে শতরুদ্রীয় হোমমন্ত্রে কেন বলা হয়েছে “তভ্যং হোমঃ”, “তব ইদং”, “নমঃ তে”
এভাবে কোনো রাজার উদ্দেশ্যে অগ্নিহোত্র হোম হয় না।
শুধুমাত্র দেবতার উদ্দেশে এভাবে হোম হয়।
🔴 অনার্যদের “রুদ্র = রাজা / বীর / মানব” এই দাবিটি যতই ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে উপস্থাপন করা হোক না কেন, তা—
1. ভাষ্যকার-প্রমাণবিরুদ্ধ।
2. শ্রুতি ও স্মৃতির পরিপন্থী।
3. ব্যাকরণ ও নিরুক্তবিরুদ্ধ।
4. যুক্তির ঘোর অমান্য।
5. বেদ ও হোমবিধির নীতিবিরোধী।
অতএব, এই দাবির ভিত্তিতেই শূন্য, প্রশ্নে প্রশ্নেই তার ভ্রান্তি স্পষ্ট।
অনার্যদের উচিত এ জাতীয় দাবির আগে ভাষ্য, নিরুক্ত, শাস্ত্র ও মীমাংসা অন্তত একবার খুলে দেখা। না হলে শুধু অপব্যাখ্যার গর্জন, সত্যের ঝর্ণাধারায় ধুয়ে যাবে।
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী —
এই প্রকার পরবর্তী মন্ত্রগুলো বিচার করলে অধ্যায় টির আশয় পরিষ্কার হয়ে যাবে -
যা তে রুদ্র শিবা তনুরঘোরাহপাপকাশিনী।
তয়া নস্তন্বা শান্তময়া গিরিসন্তাভি চাকশীহি৷৷২৷৷
ভাষার্থঃ
হে (গিরিশন্ত) মেঘ বা সত্য উপদেশ দ্বারা সুখ পৌছানো (রুদ্র) দুষ্ট কে ভয় এবং শ্রেষ্ঠ এর জন্য সুখকারী শিক্ষক বিদ্বান! (যা) যে (তে) আপনার (অঘোরা) ঘোর উপদ্রব রহিত (অপাপকাশিনী) সত্য ধর্মের প্রকাশিত কারক (শিবা) কল্যাণকারিণী (তনুঃ) দেহ বা বিস্তৃত উপদেশ রূপ নীতি (তয়া) সেই (শান্তময়া) অত্যন্ত সুখ প্রাপ্ত করানো (তন্বা) দেহ বা বিস্তৃত উপদেশ কে নীতি দ্বারা (নঃ) আমাদের কে আপনি (অভি চাকশীহি) সব প্রকারে শীঘ্র শিক্ষা করুন।
নোটঃ এই মন্ত্রে সাকারবাদীরা কৈলাসবাসী শিব অর্থে লাগানোর জন্য (গিরিশন্ত) এর অর্থ "গিরিকৈলাসে স্থিতঃ শং সুখং তনোনীতি গিরিশন্ত" গিরি কৈলাশে বসে সুখের বিস্তার করে তাকে "গিরিশন্ত" বলে এরূপ অর্থ করে। উব্বট আদি আচার্য্য গিরিশন্ত এর তিন প্রকার অর্থ করেছেন এক যিনি (গিরি) বাণী দ্বারা সুখের বিস্তার করে, দুই যিনি (গিরি) মেঘের বৃষ্টি দ্বারা সুখের বিস্তার করে, তিন যিনি (গিরি) কৈলাশে স্থিত হয়ে সুখের বিস্তার করে।
কিন্তু সাকার প্রেমী পৌরাণিকদের কৈলাশবাসী শিব অর্থে অধিক প্রেম। কারন এতে করে শিবের সাকারত্ব সিদ্ধ হবে।
কিন্তু উক্ত তিন অর্থ দ্বারা কৈলাশবাসী ঈশ্বর কদাপি সিদ্ধ হয় না। কারন গিরি শব্দের অর্থ পর্বতমাত্র। তাহাতে অবস্থান করে সুখের বিস্তার করার আশয় হচ্ছে - যে রাজ পুরুষ হিমালয়ের উচ্চ শিখরে থাকে তিনিই "গিরিশন্ত" শব্দের বাচ্য (গিরি)_শব্দের অর্থ কৈলাশ নেবার কোন প্রমাণ নেই। বাণী দ্বারা সুখের বিস্তার করে সত্যপদেশক এবং রাজ পুরুষই এখানে অভিপ্রেত। এবং মেঘ দ্বারা আশয় এই যে মেঘের বৃষ্টির সমান অনবরত সত্যোপদেশ করেন তাকে "গিরিশন্ত" বলে।
এই কথাগুলো স্পষ্ট করে দেয় যে এই অধ্যায়ে সাকার ঈশ্বরের বর্ণনা নয়, বরং শস্ত্রধারী ক্ষাত্র ধর্মের যোদ্ধার বর্ণনা। কৈলাসবাসী পৌরাণিক শিব এই অধ্যায়ের বিষয় নয়।
❌অনার্যদের দাবী – “তনুঃ” মানে শরীর নয়, ‘নীতিরূপ উপদেশ’ বা ‘সত্যোপদেশ’।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— উব্বট এবং মহীধর উভয় ভাষ্যই ‘তনুঃ’ শব্দকে শরীর (দেহ) বলেই ব্যাখ্যা করেছেন।
🔘উব্বট ভাষ্য (যজু/১৬/২)—
“শিবা শান্তা তনুঃ শরীরম্”
অর্থাৎ “শান্ত ও কল্যাণময় সেই তনু অর্থ শরীর।”
এখানে “তনু” শব্দের অস্পষ্ট বা গূঢ় অর্থ নয়, সরাসরি দেহ অর্থেই গ্রহণ করা হয়েছে।
🔘মহীধর ভাষ্য (যজু/১৬/২) —
“তনূঃ শরীরম্... কীদৃশী তনূঃ? শিবা = শান্তা, মঙ্গলরূপা।”
আবারো স্পষ্ট করে দিচ্ছেন “তনূঃ = শরীরম্”।
পাশাপাশি ভাষ্যকার ব্যাখ্যা করেছেন, এই শরীরটি শান্তময় এবং শুভফলদায়ী।
🔘যাস্ক নিরুক্তে তনূঃ অর্থে কি বলা হয়েছে তা দেখে নেওয়া যাক—
“তনূত্যজেব তস্করা বনগূ রশনাভির্দশভিরভ্যধীতাম্।।”
(নিরুক্ত ৩।১৪।১)
👉‘তনূ’ শব্দটি এখানে “শরীর” (দেহ) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় “তনূত্যজ” শব্দের ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ থেকে।
🔘ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ—
তনূ= শরীর, দেহ, কায়।
ত্যজ্ = ত্যাগ করা, পরিত্যাগ করা।
তনূত্যজ = “যে নিজের শরীর ত্যাগে প্রস্তুত”, অর্থাৎ মৃত্যুভয়হীন সাহসী ব্যক্তি।
👉এই শব্দটিকে যাস্ক তাঁর নিরুক্ত-এ ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে—
“তনূত্যক্তঃ তনূত্যজঃ” (নিরুক্ত/৩/১৪/২)
“তনূত্যজ” শব্দের অর্থ হলো শরীর ত্যাগকারী।
সুতরাং, এখানে “তনূ” অর্থ কী?
“তনূ” = শরীর এই অর্থই নিঃসন্দেহে প্রতিপাদিত হয়েছে।
👉এবং এটি যাস্কের নিজ ভাষ্য থেকেই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত—
“তনূত্যজ” মানে— যে দেহ ত্যাগ করে বা দেহত্যাগে প্রস্তুত।
“তনূত্যক্তা” মানে— যে দেহ ছেড়ে দিয়েছে।
👉“তনূ” মানে নীতি, উপদেশ বা সত্যোপদেশ এই ধরনের কোনো অর্থ নিরুক্তে একবারও দেওয়া হয়নি।
এটি অনার্য ব্যাখ্যাকারদের মনগড়া এবং ভাষ্যবিরুদ্ধ ব্যাখ্যা।
নিরুক্ত ৩।১৪।১-২ অনুযায়ী “তনূ” শব্দের অর্থ হলো “শরীর”।
আর “তনূত্যজ” মানে “যে দেহ ত্যাগে প্রস্তুত”, অর্থাৎ সাহসী ও মৃত্যুভয়হীন ব্যক্তি।
সুতরাং, যারা বলেন “তনূ” মানে নীতি বা সত্যোপদেশ,
তারা ব্যাকরণ, নিরুক্ত ও প্রাচীন ভাষ্যসমূহের সম্পূর্ণ পরিপন্থী ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, যা অযুক্তিক ও গ্রন্থবিরোধী।
🔘আরও দেখে নেওয়া যাক—
"স ন স্তিপা উত ভবা তনূপাঃ"
(ঋগ্বেদ ১০।৬৯।৪)
👉যাস্ক এই মন্ত্রকে ভাষ্য করে বলেন—
স্তিপা = কূপ, যেমন কূপ বা জলের আধার।
তনূপা = যে তনূ (শরীর) রক্ষা করে, শরীররক্ষাকারী।
অর্থাৎ, “যেমন কূপ জল দিয়ে প্রাণীদের রক্ষা করে, হে অগ্নি, তুমিও আমাদের তনূ, অর্থাৎ দেহ রক্ষা করো।”
🔘বিশ্লেষণ—
তনু-পা = "তনু" + "পা"।
তনু = দেহ, শরীর।
পা = রক্ষা করা (√পা ধাতু, পালন, রক্ষা)।
তনূপা = শরীর রক্ষা করো, দেহের রক্ষাকর্তা।
“তনূ” শব্দের অর্থ এখানে একদম স্পষ্টভাবে “শরীর”।
যেহেতু প্রার্থনা করা হয়েছে “তুমি আমাদের তনুপা হও” অর্থাৎ “তুমি আমাদের শরীর রক্ষা করো”, তাই “তনূ” মানে নীতি, উপদেশ, বা জ্ঞান নয়, বরং জড় শরীর বা কায়।
🔘তনূ প্রসঙ্গে যাস্ক নিরুক্তের আরও বলা আছে—
“তনূশুভ্রং” [ঋগবেদ/৫/৩৪/৩]
অর্থাৎ, শরীরশোভাকারী। [যাস্কনিরুক্ত/৬/১৯/১] অনুযায়ী, তনূঃ অর্থে শরীরই বলেছে।
“তনূশুভ্রং - তনূশোভয়িতারং” [যাস্কনিরুক্ত/৬/১৯/৬]
যার অর্থ হয়- শরীরের শোভা সম্পাদন করা ইত্যাদি। অর্থাৎ, এখানেও তনূঃ অর্থে শরীরই নির্দেশ করেছে।
তাই "তনুঃ = নীতি" বলা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও ভাষ্যবিরুদ্ধ।
🔘তনূ” শব্দের অর্থ শরীর উণাদিসূত্র অনুসারে—
উণাদিসূত্র (১।৮০)—
"কৃষিচমিতনিধনিসর্জিখর্জিভ্য ঊঃ স্ত্রিয়াম্"
এই সূত্র অনুযায়ী—
“তন্” (তনু ধাতু, অর্থাৎ বিস্তার করা) এই ধাতুর সঙ্গে
“ঊঃ” প্রত্যয় যোগে। স্ত্রীলিঙ্গ প্রাতিপদিক হয় তনূঃ।
👉স্বা০ দ০ বৃ০—
“তনোতি কার্যাণি যয়া [সা] তনূঃ”
(অর্থাৎ, যে দ্বারা কাজ সম্পাদিত হয় সে হলো ‘তনূ’, অর্থাৎ শরীর)
তন্ + ঊঃ— তনূ (স্ত্রীলিঙ্গ)
অর্থ— শরীর (যা দ্বারা কাজ হয়)
অতএব, “তনূ” মানে নীতি, সত্যোপদেশ, ইত্যাদি নয়, বরং উণাদিসূত্র অনুসারে নির্দিষ্টভাবে “শরীর” এটাই শুদ্ধ ব্যাকরণতত্ত্ব।
🔘উণাদিসূত্র আরও বলছে—
উণাদিসূত্র (১।৭)—
“ভৃমৃষীদ্ধৃচরিত্সরিত্নিধনিমিমস্জিভ্য ঊঃ”
(ভৃ, মৃ, শী, ধৃ, চর্, ত্সর্, তन्, ধন্, মি, মস্জ্ — এই ধাতুগুলির থেকে ‘উ’ প্রত্যয় হয়)
তনুঃ —
"তন্যন্তে কর্মাণ্যনেন ইতি তনুঃ"
(অর্থাৎ, যার দ্বারা কর্মসমূহ বিস্তৃত হয়, তাকে বলে ‘তনুঃ’)
অর্থ— শরীর (দেহ)।
বিকল্প অর্থ— স্বল্প, কোমল, ত্বক (কিন্তু মূল অর্থ শরীর)।
🔘ধাতু + প্রত্যয় রূপ—
ধাতু— তন্ (বিস্তার করা)।
প্রত্যয়— উঃ।
গঠন— তন্ + উঃ = তনুঃ।
স্ত্রীলিঙ্গ, প্রাতিপদিক।
অর্থ— যা দ্বারা কার্য (কাজ) সম্পন্ন হয় = শরীর।
“তনুঃ” শব্দটি উণাদিসূত্র ১।৭ অনুসারে তন্ ধাতু থেকে উঃ প্রত্যয়ে গঠিত এবং এর অর্থ শরীর, বা কর্মবাহক দেহ।
অতএব, ‘তনূ’ মানে নীতি বা উপদেশ ইত্যাদি বলাটা উণাদিসূত্র ও ভাষ্যবিরোধী যথার্থ ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী এটি শরীর অর্থেই প্রমাণিত।
❌অনার্যদের দাবি – ‘গিরিশন্ত’ মানে পাহাড়ে অবস্থানকারী শিক্ষক/বীর রাজা/সত্যবক্তা ঈশ্বর নয়। গিরি অর্থে যে কৈলাস হবে এমন কোনো কথা নেই।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— দুই ভাষ্যই ‘গিরিশন্ত’ শব্দকে কৈলাসে অবস্থানকারী পরমেশ্বর শিব রূপে নির্দিষ্ট করেছেন।
🔘উব্বট ভাষ্য (যজু/১৬/২) —
“গিরৌ পর্বতে কৈলাসাখ্যে অবস্থিতঃ শং (সুখ) তনোতি = ইতি গিরিশন্তঃ”
কৈলাস পর্বতে যিনি অবস্থান করেন এবং সুখ বিস্তার করেন, তিনি গিরিশন্ত।
🔘মহীধর ভাষ্য (যজু/১৬/২) —
“গিরৌ = কৈলাসে স্থিতঃ... শং তনোতি ইতি গিরিশন্তঃ”
এটি কোনো সাধারণ পর্বত নয়, কৈলাস পর্বতের কথা, এবং পরমেশ্বরকেই বোঝানো হয়েছে।
এছাড়া উভয় ভাষ্যেই ‘গিরিশন্ত’ এর বিকল্প ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে (যেমন মেঘ, বৃষ্টি ইত্যাদি), কিন্তু কোথাও “রাজা” বা “শিক্ষক” অর্থ একবারও বলা হয়নি।
🔘এই প্রসঙ্গে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে—
যা তে রুদ্র শিবা তনুরঘোরাহপাপকাশিনী।
তয়া নস্তন্বা শান্তময়া গিরিসন্তাভি চাকশীহি৷।৫।।
[শ্বেতাশ্বতর /৩/৫]
অর্থ— হে রুদ্র, হে গিরিশন্ত, তুমি গিরিতে (কৈলাসে) থেকে সুখ বিস্তার করো, তোমার যে মঙ্গলরূপ, অভয়া, পূণ্যপ্রকাশিনি শরীর, সেই সুখতমা শরীর দ্বারা আমাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করো।।
অর্থাৎ, রুদ্র সাকারে যে কৈলাস নিবাসী তাই এই শ্রুতি প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ হয়ে যায়। এখানেও স্পষ্ট বলাই আছে গিরি বলতে পর্বত বোঝায় আর পর্বতে অবস্থান কারী রুদ্র কোনো সাধারণ মানুষ বা রাজা কদাপি নন। কেননা, কোনো মানুষ বা রাজার মঙ্গলরূপ, অভয়া, পূণ্যপ্রকাশিনি শরীর হয় না। এখানে যে শরীরের উল্লেখ রয়েছে তা দিব্য। কিন্তু, মানুষ বা রাজার শরীর দিব্য নয়। তাই এখানে গিরিতে অর্থাৎ কৈলাসে থেকেই রুদ্রের সুখ বিস্তারের কথাই স্পষ্ট ভাবে বোঝানো হলো। আবার এই রুদ্রই যে পরমেশ্বর তা শ্বেতাশ্বতর এর এই প্রমাণ দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায়—
এক হি রুদ্রঃ ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য ইমাঁল্লোকানীশত ঈশানীভিঃ।
প্রত্যঙ্ জনাংস্তিষ্ঠতে সঞ্চুকোপান্তকালে সংসৃজ্য বিশ্বা ভূবনানি গোপাঃ।।
[শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৩/২]
অর্থ— রুদ্রই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর দ্বিতীয় কেউই নেই। তিনিই সমস্ত জগতকে ঈশান রূপে শাসন করেন।
তিনিই প্রত্যেক জীবের অন্তরে বিরাজ করেন।
প্রলয়ের কালে তিনি ক্রুদ্ধ হন (অর্থাৎ ধ্বংস করেন)। তিনি সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করে আবার তার পালন করেন।
🔘"এক হি রুদ্রঃ" রুদ্রই একমাত্র পরমেশ্বর। এবং এই সমর্থনে শ্রুতি বলে —
“একমেবাদ্বিতীয়ম” ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় [ছান্দোগ্য উপনিষদ/৬/২/১]।
একজন সাধারণ মানুষ বা রাজা তো অদ্বিতীয় হতে পারে না। কোনো মানুষ বা রাজা ‘দ্বিতীয়বিহীন সর্বেশ্বর’ হয় না। তাই, এটি মানুষ নয়, পরমেশ্বরের পরিচয়।
🔘"ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য" তাঁর কোনো দ্বিতীয় দাঁড়াতে পারে না। তাই শ্রুতি বলছে—
“দ্বিতীয়াদ্বৈ ভয়ং ভবতি” তিনি অদ্বিতীয়, তার প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বিতীয় কেউ-ই নাই [বৃহদারণ্যক উপনিষদ/১/৪]৷
কিন্তু, মানুষের হাজারো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে। রাজারও শত্রু, প্রতিদ্বন্দ্বী, সেনা, উপদেষ্টা অনেক কিছু থাকে। অথচ, রুদ্র এখানে সর্বজ্যেষ্ঠ, তুলনাহীন, অদ্বিতীয়।
🔘"প্রত্যঙ্ জনাংস্তিষ্ঠতে" সমস্ত জীবের অন্তরে অবস্থান করেন। শতরুদ্রীয়তে এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—
“নমো হৃদয়্যায় চ” [শুক্ল-যজুর্বেদ/১৬/৪৪]
এর ব্যাখ্যায় উবট বলেন—
“হৃদয়ে ভবঃ হৃদয্যঃ"
যে হৃদয়ে অবস্থান করেন। তিনি হৃদয়্য।
অর্থাৎ, হৃদয়ে অবস্থানকারী ঈশ্বর।
মহীধর বলেন—
“হৃদয়ে ভবঃ হৃদয়্যঃ জীবস্তস্মৈ"
জীবের হৃদয়ে যিনি অবস্থান করেন তিনিই হৃদয়্য। এখানে জীব শব্দটিও উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ সেই ঈশ্বর যিনি আত্মাস্বরূপে জীবের হৃদয়ে বিরাজ করেন। এটি অন্তর্যামী ঈশ্বরকেই নির্দেশ করে।
কোনো মানুষ, রাজা বা গুরু সব জীবের হৃদয়ে অবস্থান করতে পারেন না। এই অধিকার কেবল ঈশ্বরের, যিনি অন্তর্যামী।
🔘"সঞ্চুকোপান্তকালে" তিনি ক্রুদ্ধ হন প্রলয়ের কালে।
শতরুদ্রীয়ের ৪০ নং মন্ত্রের ভাষ্যে মহীধর বলেছেন—
“অনে পুরো বর্তমানো হন্তীলমেবচঃ তস্যৈ।
দূরে বর্তমানো হন্তীতি দূরেবধঃ তস্মৈ।
হন্তীতি হন্তা তস্মৈ।
লোকে ইয়ো হন্তি তদ্রূপেণ রুত্র এভ হন্তীত্যর্থঃ।
অতিশয়ে হন্তা হনীয়ান তস্মৈ।
‘তুরিষ্ঠেমেয়ঃছু’ (পা০ ৬।৫।১৫৪) ইতি তৃচো লোপঃ।
প্রলয়ে সর্বহন্তেত্যর্থঃ।”
অর্থ— তিনি (রুদ্র) কখনো সামনে থেকে শত্রুদের সংহার করেন, আবার কখনো দূর থেকে হত্যা করেন তাই তিনি ‘ইনি’ ও ‘দূরেবধ’।
‘হন্তা’ অর্থে যিনি হত্যা করেন, তিনিই এখানে উদ্দেশ্য।
এই জগতে যে সংহার ঘটে, তা আসলে রুদ্রের রূপেই সংঘটিত হয় এইটাই অর্থ।
আর যখন তিনি অতিশয়ভাবে সংহার করেন, তখন তিনি হন ‘হনীয়স্’।
পাণিনির "তুরিষ্ঠেমেয়ঃছু" সূত্র অনুযায়ী ‘তৃচ্’ প্রত্যয়ের লোপ হয়েছে।
এইভাবে বোঝানো হয়েছে, প্রলয়ের সময় তিনিই সর্বসংহারকারী।
রুদ্র/শিব শুধু একটি ভয়ের প্রতীক নন, বরং সৃষ্টির অন্তে সমস্ত জগতকে ধ্বংস করে দেন তিনি সর্বহন্তা, মহাপ্রলয়ের কর্তা। এবং এটি ভাষ্যকার মহীধরের স্পষ্ট বক্তব্য অর্থাৎ শতরুদ্রীয় অধ্যায়ে শিবকে সৃজন-সংহার-নিয়ন্তা পরমেশ্বর হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
প্রলয় তো জগতের মহাসংহার! কোনো মানুষ বা রাজা এই ক্ষমতা রাখে না। প্রলয় করা বা সমস্ত সৃষ্টি সংহার কেবল পরমেশ্বর-এরই কার্য।
🔘"সংসৃজ্য বিশ্বা ভূবনানি গোপাঃ" তিনিই সৃষ্টি ও পালন করেন। এই প্রসঙ্গে শতরুদ্রীয়তে বলা আছে —
“জগতাম্ পতয়ে নমো” [যজু ১৬/১৮]
ভাষ্যকার মহীধর বলেছেন—
অন্নানাং পালকায় নমঃ। ভবস্য সংসারস্য হেল্যৈ আয়ুধায় সংসারনিবর্ত্তকায় রুদ্রায় নমঃ। জগতাং পালকায় রুদ্রায় নমঃ ।
অর্থ— যিনি গৃহহীন বা নিরাশ্রয় জীবদের রক্ষা করেন,
যিনি সংসাররূপ দুঃখকে বিনাশ করতে অস্ত্র ধারণ করেন এবং মোক্ষের পথ প্রদর্শন করেন, যিনি সমস্ত জগৎ ও জীবের পালনকর্তা, সেই সর্বশক্তিমান রুদ্রকে আমি প্রণাম জানাই।
মানুষ বা রাজা তো জগৎ সৃষ্টি করে না। মানুষ স্রষ্টা নয়, নিজেই সৃষ্টি। সৃষ্টি, সংহার ও পালন এই তিন কাজ পরমেশ্বরেরই লক্ষণ, ন্যায় প্রস্থান উত্তরমীমাংসা মতে "জন্মাদ্যস্য যতঃ" [ব্রহ্মসূত্র/১/১/২], “আত্মকৃতেঃ” [ব্রহ্মসূত্র/১/৪/২৬] এরই সমর্থন করে। এটি ঈশ্বরত্বের স্বরূপলক্ষণ (জগত-কারণত্ব)।
অতএব, এই মন্ত্রে ‘রুদ্র’ শব্দে ‘পরমেশ্বর’ই বোঝানো হয়েছে, না যে সাধারণ রাজা, না কোনো গুরু, না মানববিদ্বান।
অনার্যদের দাবি যে "রুদ্র = রাজা / মানুষ / শিক্ষক", তা এই মন্ত্র দ্বারা পুরোপুরি খণ্ডিত হয়। কারণ,রুদ্র এখানে অন্তর্যামী, অদ্বিতীয়, বিশ্বেশ্বর, সৃষ্টিকর্তা, সংহারক, এবং রক্ষক এই সব গুণ মানুষের মধ্যে কল্পনাও করা যায় না। তাই কেবল মন্ত্র ও ভাষ্যের খণ্ডিতাংশ দ্বারা পরমেশ্বর রুদ্রকে রাজা, মানুষ, বিদ্বান এসব প্রমাণ করা বৃথা। এবং পরমেশ্বর রুদ্রই কৈলাসে অবস্থান করেন। এখানে যজু ১৬/২ নং মন্ত্রের উল্লেখিত রুদ্র সাক্ষাৎ পরমেশ্বর যিনি সাকার স্বরূপে কৈলাসে অবস্থান করেন। যার শ্বেতাশ্বতরের বক্তব্য, ভাষ্যকারের মতানুযায়ী প্রমাণিত।
🔘গিরি অর্থে কৈলাসই বোঝায় ঋগবেদেও একই কথা বলা হয়েছে—
কৈলাসশিখরে রম্যে শংকরস্য শুভে গৃহে |
দেবতাস্তত্র মোদন্তি তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত || ২৪ ||
কৈলাসশিখরাভাসা হিমবদিগরিসংস্থিতা |
নীলকণ্ঠং ত্রিনেত্রং চ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত ||২৫ |
[ঋগবেদ/খিলভাগ/৪/১১] [ঋগবেদ/আশ্বলায়ন শাখা/১০/১৭১]
কৈলাস পর্বত শিখরে শিব শংকরের ভবনে সমস্ত দেবতাগণ (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, ইন্দ্রাদি) বিচরণ করছেন। সেই (সর্বদেবাত্মক কৈলাসবাসী) শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হউক। যিনি হিমগিরি কৈলাস শিখরে বাস করেন, যিনি (সাকারে) নীলকন্ঠ, যিনি ত্রিনেত্র সেই শিবের প্রতি মন সঙ্কল্পিত হউক।
সিদ্ধান্ত - এক শিবই ত্রিদেবরূপে প্রকট হয়েছেন। মূল সত্ত্বা সেই শিবই, যার প্রত্যক্ষ সাকার রূপ হল- ত্রিনেত্রধারী ও নীলকন্ঠ (সদাশিব)।
👉আচার্য সায়ণ তৈত্তিরীয় সংহিতার ৪/৫ (শ্রীরুদ্রম্) এর ভাষ্যে বলেছেন—
"গিরৌ কৈলাসে স্থিত্বা নিত্যং প্রাণিভ্যো যঃ শং তনোতি স সম্ভোধনং হে গিরিশন্ত। তথাবিধ হে রুদ্র শং তমযাতিশযেন সুখং তনুভাঽভিচাকশীহি মামনিলক্ষ্য প্রকাশং কুরু। গিরৌ কৈলাসে রোবে তিষ্ঠতীতি গিরিশঃ স্বামচ্ছ প্রাপ্তুং শিবেন মঙ্গলঞ্চেন স্তুতিরূপেণ বচসা বদামসি বয়ং।"
অর্থ— যিনি কৈলাস পর্বতে সর্বদা অবস্থান করেন এবং সমস্ত প্রাণীর প্রতি শান্তি ও মঙ্গল বিস্তার করেন, তাঁকে আমরা 'গিরিশ' নামে সম্বোধন করি। হে রুদ্র! আপনি সেই কল্যাণময় রূপে, অতিশয় শান্তিদায়ক তনু দ্বারা, আমাকে দর্শন দিন, আমার অন্তরে জ্যোতি প্রকাশ করুন। আপনি যেহেতু গিরিতে, অর্থাৎ কৈলাস পর্বতে অধিষ্ঠান করেন, তাই আপনাকে 'গিরিশ' বলা হয়। আমরা আপনাকে 'শিব' নামে যার অর্থ মঙ্গলময় স্তব বা প্রশংসা করি, যাতে আমরা আমাদের অভীষ্ট, পরম কল্যাণ, আপনার প্রসাদে লাভ করতে পারি।"
অর্থাৎ সায়ণাচার্য নিজেই বলছেন শিবই সকলের মঙ্গলকারী পরমেশ্বর যিনি গিরিতে থাকেন। এখানে গিরি বলতে কৈলাসকেই বুঝিয়েছে।
অর্থাৎ ব্রহ্ম সাকার নিরাকার দু ভাবেই আছেন।
শুক্ল-যজুর্বেদ এর ১৬নং অধ্যায়ে পরমেশ্বর শিবের সাকারত্ত্বের বহু প্রমাণ পাওয়া যায়, যেখানে শিবকে, ত্রিলোচন, নীলকণ্ঠ, কপর্দ্দী, ধূর্জটি, কৃত্তিবাসা, পিনাকধৃত, নীললোহিত ইত্যাদি বলা হয়েছে যা শিবের সাকারত্ত্বকে প্রতিপাদিত করে। তাহলে এখানে অনার্যরা যে দাবী করেছিলো যে, গিরি অর্থে কৈলাস নয় তা শ্রুতি ও আচার্য ভাষ্য অনুযায়ী খণ্ডিত হলো।
🔘শাস্ত্রীয় ব্যাকরণ থেকেও এটি স্পষ্ট —
“শকন্ধ্যাদিলাত্ পররূপম্ (পাণিনি ৬.১.৯৪)” সূত্রানুসারে, ‘গিরিশন্ত’ শব্দটি একটি সম্বোধনবাচক বহুব্রীহি সমাস যা বিশেষ কোনো ঈশ্বরতুল্য রূপেই বোঝানো হয়।
সুতরাং, গিরিশন্ত মানে “ঈশ্বর শিব” ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করা ভাষ্য ও ব্যাকরণ উভয়ের বিরোধিতা।
❌অনার্যদের দাবি – “পূর্ববর্তী মন্ত্রসমূহে যেহেতু বীর/রাজা/অস্ত্রধারীর প্রতি প্রার্থনা, তাই এখানেও তাই।”
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন—
এটি একটি সিদ্ধান্ত-পূর্বক প্রক্ষেপণ (presumptive projection) যা শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে অবৈধ।
প্রত্যেক মন্ত্রের নিজস্ব উদ্দেশ্য, দেবতা ও প্রসঙ্গ থাকে, যেটা মন্ত্রে ব্যবহৃত শব্দ, পাদবিন্যাস, এবং ভাষ্য দ্বারা নির্ধারিত হয় পূর্বমন্ত্র থেকে অনুমান করে নির্ধারিত নয়।
উদাহরণস্বরূপ, ১৬.১-এ ‘মন্যু’, ‘ইষু’ প্রভৃতি অস্ত্রসজ্জিত শক্তির উল্লেখ থাকলেও, ১৬.২-এ "শিবা তনুঃ", "অপাপকাশিনী", "শান্তময়া" প্রভৃতি শব্দগুলো সম্পূর্ণ সৌম্য ও কল্যাণময় ঈশ্বররূপ প্রকাশ করে।
🔘মহীধর-উবট ভাষ্য অনুযায়ী (যজু১৬/২)—
“অঘোরা অবিষমা”— রুদ্রের ঘোরতা নেই।
“অপাপকাশিনী”— যিনি কেবল পুণ্যফল দেন, পাপফল দেন না।
“শান্তময়া তন্বা”— সুখতম, শান্তরূপ দেহ।
এগুলোর মাধ্যমে বীরপুরুষ/রাজা নয়, একমাত্র শিবতত্ত্বময় ঈশ্বররূপ ব্যক্ত হয়।
অনার্য দাবী "তনুঃ" মানে নীতি বা উপদেশ। কিন্তু, ভাষ্য অনুযায়ী “তনূঃ শরীরম্” (উব্বট, মহীধর)। সুতরাং অনার্যদের দাবী ভাষ্যবিরোধী।
অনার্যদের দাবী “গিরিশন্ত” মানে রাজা/শিক্ষক। কিন্তু, ভাষ্য অনুযায়ী “গিরৌ কৈলাসে অবস্থিতঃ শং তনোতি”। সুতরাং অনার্যদের দাবী ভাষ্যবিরোধী।
অনার্যদের দাবী প্রসঙ্গ রাজপুরুষ। কিন্তু, ভাষ্য অনুযায়ী “শিবা”, “অঘোরা”, “অপাপকাশিনী” ঈশ্বরতত্ত্বমন্ত্র। সুতরাং অনার্যদের দাবী ভাষ্যবিরোধী।
🔘এই মন্ত্রটি যে ঈশ্বররূপ শিবের শান্ত ও অপাপকারী রূপের প্রতি প্রার্থনা তা উব্বট, মহীধর ভাষ্য ও ব্যাকরণ উভয় দ্বারা সুপ্রমাণ। অনার্যদের দাবি সম্পূর্ণরূপে ভাষ্যবিরুদ্ধ, ব্যাকরণবিরুদ্ধ এবং প্রসঙ্গবিচ্যুত।
🔴দয়াভণ্ডের চ্যালাচামুণ্ডাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন—
আপনারা যাঁরা বলেন "তনুঃ মানে নীতি বা উপদেশ", তাঁরা কি যাস্কের নিরুক্ত ৩.১৪.২-এ "তনূত্যজ = দেহত্যাগকারী" এবং "তনূত্যক্তঃ" শব্দের বিশ্লেষণ অস্বীকার করেন? যদি না করেন, তবে "তনূ" শব্দের অর্থ "শরীর" নয়, এমন দাবি কেন করছেন? (যাস্ক নিজেই বলেছেন তনূ = শরীর)
উব্বট ও মহীধর উভয় ভাষ্যকার যদি স্পষ্টভাবে বলেন “তনূঃ = শরীরম্”, তাহলে তাদের ভাষ্য অগ্রাহ্য করে কীভাবে "নীতিরূপ উপদেশ" অর্থে তনু গ্রহণ করা যায়?
আপনাদের এই ব্যাখ্যার কোন বৈদিক ভাষ্যকার সমর্থক?
যদি "গিরিশন্ত" মানে “শিক্ষক” বা “রাজা” হন, তাহলে কেন উব্বট এবং মহীধর উভয়েই লিখেছেন—
“গিরৌ কৈলাসে অবস্থিতঃ শং তনোতি = গিরিশন্তঃ”?
এই ব্যাখ্যাকে কী আপনারা অগ্রাহ্য করেন? কেন?
যদি রুদ্র কোনো সাধারণ রাজা বা অস্ত্রধারী ব্যক্তি হন, তাহলে কেন শতরুদ্রীয়তে তাকে বলা হয়েছে—
"হৃদয়্য" (হৃদয়ে অবস্থানকারী)
"সংসারনিবর্ত্তক" (মোক্ষদাতা)
"প্রলয়ে সর্বহন্তা" (সমগ্র জগতের সংহারকারী)
এই গুণাবলী কি কোনো রাজা বা মানুষে সম্ভব?
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে যখন বলা হচ্ছে— "এক হি রুদ্রঃ ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য ইমাঁল্লোকানীশত ঈশানীভিঃ..."
এবং বলা হচ্ছে— "সঞ্চুকোপান্তকালে সংসৃজ্য বিশ্বা ভূবনানি গোপাঃ" তখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে রুদ্রই সর্বজগৎস্রষ্টা, সংহারক ও পালনকর্তা। আপনারা কীভাবে রুদ্রকে তখন একজন রাজপুরুষ হিসাবে মেনে নেন?
ঋগ্বেদের আশ্বলায়ণ শাখার শ্লোকে যখন বলা হয়— “কৈলাসশিখরে রম্যে শংকরস্য শুভে গৃহে দেবতাস্তত্র মোদন্তি” এবং “নীলকণ্ঠং ত্রিনেত্রং চ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু” এইসব ঈশ্বরীয় গুণ ও শিবের অবস্থান যদি কৈলাসেই হয়, তাহলে কীভাবে "গিরি ≠ কৈলাস" বলা চলে?
যদি এই অধ্যায় শুধুই রাজপুরুষ/শিক্ষকের বর্ণনা হয়, তাহলে কেন উব্বট, মহীধর, যাস্ক, এবং সায়ণ সব ভাষ্যকাররাই একবাক্যে এই রুদ্রকে ঈশ্বর, মোক্ষদাতা ও বিশ্বপালক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন?
👉বি: দ্র: — এখন অনার্যরা শিবের ঐশ্বরিক রূপকে মেনে না নিয়ে কীভাবে শ্রুতি, ভাষ্যকারদের ভাষ্য, নিরুক্ত, উণাদিসূত্র, ন্যায়কে অগ্রাহ্য করবে সেটা অনার্যরাই জানে। তবে একটা উপায় আছে, অনার্যরা পূর্বের ন্যায় নিজেদের মনগড়া অর্থ প্রচার করতেই পারবে। কারণ এটা তাদের গুরু দয়াভণ্ডের শিক্ষা যে শাস্ত্রের অনর্থ করা।
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী —
যামিষু গিরিশন্ত হস্তে বিভ্যস্তবে।
শিবাং গিরিত্র তাং কুরু হিংসীঃ পুরুষ জগৎ৷৷ ৩ ৷৷
ভাষার্থঃ
হে (গিরিশন্ত) মেঘের দ্বারা সুখ পৌছানোকারী সেনাপতি! যেই কারণে তুমি (অস্তবে) নিক্ষেপের জন্য (যাম্) যেই (ইমুম্) বাণ কে (হস্তে) হাতে (বিভর্ষি) ধারন করেছো, এই জন্য (তাম্) তাকে (শিবাম্) মঙ্গলকারী (কুরু) করো। হে (গিরিত্র) বিদ্যার উপদেশক বা মেঘের রক্ষাকারী রাজপুরুষ! তুমি (পুরুষ) পুরুষার্থযুক্ত মনুষ্যাদি (জগৎ) সংসার কে (মা) না (হিংসী) মার।।
নোটঃ এখানে বৈদিক ধর্মের মর্যাদায় স্থিত ক্ষত্রিয় কে পাওয়া গেলো। তাহার নিকট প্রার্থনা করা হয়েছে যে, "গিরিত্র" সেই বাণ কে আপনি মঙ্গল ময়করুণ যাতে এই বাণ ধর্মার্থ কাম মোক্ষ এই ফল চতুষ্টয়সম্পন্ন জগৎ কে হিংসা না করে। অর্থাৎ রাজপুরুষের উচিৎ যে যুদ্ধবিদ্যাকে জেনে এবং অস্ত্র শস্ত্রের ধারণ করে মনুষ্যাদি শ্রেষ্ঠ প্রাণী কে কষ্ট দেবে না কিংবা মারবে না, বরং মঙ্গলময় আচরন দ্বারা সবার রক্ষা করবে।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— পূর্বে ২ নং মন্ত্রের বিশ্লেষণ ও অনার্যদের খণ্ডনে গিরিশন্ত, গিরিত্র, গিরি ইত্যাদি শব্দে যে কৈলাস/ কৈলাসে অবস্থানকারী পরমেশ্বর শিবকে বোঝানো হয়েছে তাই, শ্রুতি, পাণিনি, আচার্যদের ভাষ্য ইত্যাদি থেকে প্রমাণ করেছি। এবং এটাও প্রমাণ করা হয়েছে ওখানে উল্লেখিত রুদ্র স্বয়ং পরমেশ্বর কোনো রাজা, মানুষ ইত্যাদি নয়। তাই এখানে এসবের পূণরায় প্রমাণ করার প্রয়োজনীয়তা নেই। এখানে আমরা কেবল আচার্যের ভাষ্যের সাথে তুলনা করবো অনার্যদের দাবী কতটা যৌক্তিক। চলুন তবে দেখে নেওয়া যাক শতরুদ্রীয় এর ৩ নং মন্ত্রের ভাষ্যে মহীধর-উবট কি বলেছেন—
🔘উব্বট ভাষ্য—
"যামিষুম্। যাম্ ইষুং কান্ডং। হে গিরিশন্ত! গিরৌ পর্বতে অবস্থিতঃ কৈলাসাখ্যে সুখং তনোতীতি গিরিশন্তঃ, তস্য সম্ভোধনং ‘হে গিরিশন্ত’।
হস্তে বিবর্ষি ধারয়সি। অস্তবে অসিতুং, ক্ষেতুমিত্যর্থঃ।
শিবাং গিরিত্র গিরৌ কৈলাসে অবস্থিতঃ, ত্রায়তে ভক্তানীতি গিরিত্রঃ, তস্য সম্ভোধনং ‘হে গিরিত্র’।
তাং কুরু। কিঞ্চ। মা হিংসীঃ, মা অবধীঃ পুরুষঃ জগৎ জঙ্গমং চ গবাদি॥ ৩॥
🔘মহীধর ভাষ্য—
"হে গিরিশন্ত! স্বং যাং ইষু বাণং হস্তে বিবর্ষি ধারয়সি।
কিং কর্তুম্? অস্তবে ‘অসু ক্ষেপণে’ তুমর্থে তব্যপ্রত্যয়ঃ।
অসিতুং শত্রূন্ ক্ষেপ্তুমিত্যর্থঃ।
গিরিত্র গিরৌ কৈলাসে স্থিতো ভুতানি ত্রায়তে ইতি গিরিত্রঃ।
তামিষু শিবাং কল্যাণকারিণীং কুরু।
কিঞ্চ পুরুষং, পুত্রপৌত্রাদিকং, জগৎ জঙ্গমম্, অন্যদপি, গবা-অশ্বাদিকং, মা হিংসীঃ, মা বধীঃ॥ ৩ ॥
অর্থ— হে গিরিশন্ত! আপনি কৈলাস পর্বতে অবস্থান করেন এবং মঙ্গল বা সুখ বিস্তার করেন, এজন্য আপনাকে গিরিশন্ত বলা হয়। আপনি যেই তীক্ষ্ণ বাণ ধারণ করেন, তা শত্রুদের বিনাশের জন্যই।
হে গিরিত্র! আপনি কৈলাস পর্বতে অবস্থান করে সমস্ত প্রাণীদের রক্ষা করেন, এজন্য আপনাকে গিরিত্র বলা হয়। সেই বাণকে আপনি শান্ত, শুভফলদায়ক করুন। আর, আপনি যেন কোনো মানুষ, কিংবা জগতে চলমান প্রাণী, কিংবা গরু-ঘোড়া প্রভৃতি পশুকে আহত বা হত্যা না করেন।
🔘আবার একই মন্ত্রে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও রয়েছে—
যামিষু গিরিশন্ত হস্তে বিভ্যস্তবে।
শিবাং গিরিত্র তাং কুরু হিংসীঃ পুরুষ জগৎ ৷৷ ৬ ।।
[শ্বেতাশ্বতর /৩/৬]
অর্থ— হে কৈলাসবাসী মঙ্গলবিস্তারকারী শিব!
তুমি যে বাণ হাতে ধারণ করেছো নিক্ষেপের জন্য,
হে কৈলাসে অধিষ্ঠানকারী জীবরক্ষক শিব!
সেই বাণকে তুমি শান্তময়, পাপরহিত, কল্যাণদায়ী করে তোলো। এই সকল জীব সমূহ দ্বারা পূর্ণ জগতের প্রতি যেন তুমি হিংসা না করো।
"গিরিশন্ত" ও "গিরিত্র" কোনো রাজপুরুষ বা মানবীয় অস্ত্রধারী ব্যক্তি নন, বরং পরমেশ্বর শিব-এর নাম,
যিনি কৈলাসে অধিষ্ঠান করেন, যিনি শান্তময় তনু ধারণ করেন এবং যিনি সকল জীবের কল্যাণ ও রক্ষাকর্তা।
👉আবার এখানে রুদ্রই যে সাক্ষাৎ পরমেশ্বর তা এই প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ হয়ে যায়—
“এক হি রুদ্র ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য”
[শ্বেতাশ্বতর /৩/২]
সুতরাং এখানে রুদ্র অর্থে কোনো মানুষ, রাজা, সেনাপতি ইত্যাদি নয় তা শ্রুতি থেকেই প্রমাণিত।
❌অনার্যদের দাবী— গিরিশন্ত’ ও ‘গিরিত্র’ = শিব নন, বরং কোনো মানবীয় রাজপুরুষ/শিক্ষক/সামরিক সেনাপতি।
✅শৈবপক্ষের খণ্ডন— উবট- মহীধর ভাষ্য অনুযায়ী বিশ্লেষণ—
🔘মহীধর ভাষ্য— মহীধর ২ নং মন্ত্রে গিরিশন্ত মানে কৈলাসে শিব অবস্থান করে সুখ প্রদান করেন অর্থ করেছেন। এবং ৩ নং মন্ত্রের ভাষ্যেও একই অর্থ গ্রহণ করেছেন।
গিরিশন্ত—
“কৈলাসে স্থিতঃ... শং তনোতি ইতি গিরিশন্তঃ” (২নং মন্ত্রের ভাষ্য)
গিরি = কৈলাস পর্বত; শং = মঙ্গল; তনোতি = বিস্তার করেন। যিনি কৈলাসে অবস্থান করে মঙ্গল বিস্তার করেন তিনিই গিরিশন্ত।
অতএব, মহীধরের মতে ‘গিরিশন্ত’ মানে শিব, যিনি কৈলাসে অবস্থানকারী ও শান্তি বিস্তারকারী।
এটি কোনো রাজপুরুষ নয় কারণ কোনো মানব রাজা ‘কৈলাসে অবস্থানকারী’ নয়, এবং শ্রুতির প্রসঙ্গেও তাঁর অস্তিত্ব নেই।
গিরিত্র—
“গিরিত্র গিরৌ কৈলাসে স্থিতো ভুতানি ত্রায়তে ইতি গিরিত্রঃ।।”(৩নং মন্ত্রের ভাষ্য)
গিরি = কৈলাস পর্বত; ত্রে = রক্ষা করা; যিনি কৈলাসে থেকে ভক্ত বা জীবের রক্ষা করেন তিনিই গিরিত্র।
এই ভাষ্যও পরিষ্কার করে দেয় যে, ‘গিরিত্র’ মানে শিব, যিনি কৈলাসে অবস্থান করে সকল জীবকে রক্ষা করেন।
কোনো মানব সেনাপতি বা রাজপুরুষ ভক্ত বা জগতের সমস্ত জীবকে রক্ষা করেন না, বরং ঈশ্বর শিবের ক্ষেত্রেই এই গুণ খাটে।
🔘উবট অনুযায়ী বিশ্লেষণ—
গিরিশন্ত—
“গিরৌ পর্বতে অবস্থিতঃ কৈলাসাখ্যে সুখং তনোতীতি গিরিশন্তঃ, তস্য সম্ভোধনং ‘হে গিরিশন্ত।।”
গিরিত্র—
“শিবাং গিরিত্র গিরৌ কৈলাসে অবস্থিতঃ, ত্রায়তে ভক্তানীতি গিরিত্রঃ, তস্য সম্ভোধনং ‘হে গিরিত্র।।’”
উব্বটও একইভাবে “গিরিশন্ত” ও “গিরিত্র” শব্দকে কৈলাসবাসী পরমেশ্বর শিব হিসেবেই ব্যাখ্যা করেছেন, কোনো “রাজপুরুষ” হিসেবে নয়।
সুতরাং, “গিরিশন্ত” ও “গিরিত্র” = রাজপুরুষ/শিক্ষক/সামরিক নেতা। এই দাবী ভাষ্যবিরোধী ও মনগড়া।
🔘মহীধর ও উব্বট ব্যাখ্যা—
“গিরিশন্ত” = শিব, কৈলাসে থেকে মঙ্গল বিস্তার করেন।
“গিরিত্র” = শিব, কৈলাসে থেকে ভক্ত ও জীবের রক্ষা করেন। এই শব্দদ্বয় শিববাচক, ঈশ্বরবাচক Proper Noun।
অতএব, যজুর্বেদ ১৬.৩ মন্ত্রে গিরিশন্ত ও গিরিত্র কোনোরূপ মানবীয় রাজা বা সেনাপতি নয়, বরং কৈলাসনিবাসী পরমেশ্বর শিব একথা মহীধর ও উব্বট ভাষ্য দ্বারা নিশ্চিতরূপে প্রতিপন্ন। অনার্যদের দাবি ব্যাকরণ, ভাষ্য ও শাস্ত্রসম্মত নয়।
❌অনার্যদের দাবী— ইষু’ (বাণ) = যুদ্ধজ্ঞান বা নীতি/শিক্ষা।
✅শৈবপক্ষের খণ্ডন— প্রথমে দেখে নেবো ইষু শব্দের অর্থ কি হয়। মহর্ষি যাস্ক এই প্রসঙ্গে বলেছেন—
🔘নিরুক্তের প্রথম উদ্ধৃতি—
ধনুর্ধন্বতের্গতিকর্ম্মণঃ, বধকর্ম্মণো বা, ধন্বন্ত্যস্মাদিষবঃ।।
(নিরুক্ত ৯।১৬।৬)
👉ব্যাখ্যা—
নিরুক্তকার যাস্ক এই শ্লোকে "ধনুস্" বা "ধনু" শব্দের অর্থ ও উৎস ব্যাখ্যা করছেন দুটি ভিন্ন দিক থেকে।
১. প্রথমত, “ধনুঃ ধন্বতেঃ গতিকৰ্ম্মণঃ” ধনু মানে গতি ঘটায় এমন বস্তু।
"ধনু" শব্দটি এসেছে "ধন্ব" ধাতু থেকে, যার একটি অর্থ হলো চলা বা গমন করা। এই দিক দিয়ে, ধনু এমন বস্তু যা থেকে বাণ ছোঁড়া হয়। বাণ ধনু থেকে গমন করে, তাই ধনু হলো গতি ঘটানোর উপকরণ।। (উণাদি ২৭৪ দ্রষ্টব্য)।।
২. দ্বিতীয়ত “বধকৰ্ম্মণো বা” ধনু মানে বধ করে এমন অস্ত্র।
আবার, "ধন্ব" ধাতুর আরেকটি অর্থ হলো হত্যা বা সংহার করা। সেই দিক দিয়ে, ধনু এমন বস্তু যা শত্রু নিধন বা সংহার সাধন করে। ধনু অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হয় বাণ চালানোর জন্য।
🔘ধনু শব্দের মূলে আছে দুইটি সম্ভাবনা।
(১) বাণকে চালনা করার জন্য গতি প্রদান করে।
(২) সেই বাণের মাধ্যমে বধ সাধন করে।
অর্থাৎ, ধনু কোনো জ্ঞানের প্রতীক নয়, এটি একটি বাস্তব অস্ত্র বাণ চালনার যন্ত্র।
অর্থাৎ এখানে স্পষ্ট হয়ে গেলো যে ইষু অর্থ বাণ। কারণ ধনুকের সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকার কারণে এবং যা দ্বারা বধ করা হয় এমন অর্থ বোঝানোর জনক্স ইষু অর্থ বাণ এই অর্থ সরাসরি স্পষ্ট হয়ে যায়।
🔘নিরুক্তের দ্বিতীয় উদ্ধৃতি—
ইষুরীষতের্গতিকর্ম্মণো বধকর্ম্মণো বা।
(নিরুক্ত ৯।১৮।৬)
👉ব্যাখ্যা—
এই শ্লোকে যাস্কাচার্য "ইষু" শব্দের উৎস ব্যাখ্যা করছেন, যেটি মূলত "বাণ" বা "অস্ত্র" বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
১. প্রথমত, “ইয়ুঃ ঈষতেঃ গতিকৰ্ম্মণঃ” ইষু অর্থ গতি সম্পন্ন বস্তু।
ইষু শব্দ এসেছে "ঈষ্" ধাতু থেকে, যার অর্থ ছোড়া বা চালনা করা। এই দিক দিয়ে, ইষু সেই বস্তু যা গতি লাভ করে বা চালিত হয় (যেমন: ধনু থেকে ছোঁড়া বাণ)।
২. দ্বিতীয়ত, “বধকৰ্ম্মণঃ বা” ইষু অর্থ প্রাণ সংহার করে এমন অস্ত্র।
"ঈষ্" ধাতুর আরেকটি অর্থ হত্যা বা প্রহার করা। এই দিক দিয়ে, ইষু এমন বস্তু যা প্রাণ হরণ করে, অর্থাৎ প্রাণনাশক অস্ত্র।। (উণাদি ১৩ সূত্র দ্রষ্টব্য)।।
🔘ইষু একটি অস্ত্র, যা ধনু থেকে ছোঁড়া হয় এবং বধ করে। আর ধনু নিশ্চিত ভাবেই বাণই ছোঁড়া হয়। একে কোনো জ্ঞান বা নীতিবচনের প্রতীক হিসাবে দেখানো ভিত্তিহীন।
🔘নিরুক্তের তৃতীয় উদ্ধৃতি—
বুন্দ ইষুর্ভবতি ।
(নিরুক্ত ৬।৩২।১৩)
👉ব্যাখ্যা—
এখানে যাস্কাচার্য বলেন, “বুন্দ” শব্দের অর্থ হলো- ইষু, অর্থাৎ বাণ বা তীর।
“বুন্দ” শব্দটি এই শ্লোকের মাধ্যমে “ইষু” বা অস্ত্রের প্রতিশব্দ হিসাবে প্রতিপন্ন। এটি বোঝায় যে “ইষু” শব্দ কেবল গতি বা আঘাতকারী অস্ত্রকেই বোঝায় অন্য কিছু নয়।
“ধনু” ও “ইষু” উভয় শব্দই অস্ত্রবাচক।
তাদের মূল ধাতুগত অর্থ গতি ও সংহার।
নিরুক্তে কোথাও “ইষু” বা “ধনু” শব্দকে জ্ঞান, নীতি, শিক্ষা বা উপদেশের প্রতীক বলা হয়নি।
অতএব, “ইষু = শিক্ষা বা নীতিবোধ” এই দাবি নিরুক্তের প্রমাণে সম্পূর্ণ অসঙ্গত ও ভিত্তিহীন।
🔘এবার আসা যাক উবট-মহীধর ৩ নং মন্ত্রের ভাষ্যে “ইষু” অর্থে কি বলেছে—
উবট— হস্তে বিবর্ষি ধারয়সি। অস্তবে অসিতুং, ক্ষেপ্তুমিত্যর্থঃ।
মহীধর— হে গিরিশন্ত! স্বং যাং ইষু বাণং হস্তে বিবর্ষি ধারয়সি। কিং কর্তুম্? অস্তবে ‘অসু ক্ষেপণে’ তুমর্থে তব্যপ্রত্যয়ঃ। অসিতুং শত্রূন্ ক্ষেপ্তুমিত্যর্থঃ।
অর্থ— হে গিরিশন্ত! তুমি হাতে যে বাণটি (ইষু) ধারন করেছো, সেটি কি করার জন্য? ‘অস্তবে’ শব্দের অর্থ হলো ‘অসু ক্ষেপণ’ অর্থাৎ শত্রুদের প্রতি বাণ নিক্ষেপ করা। অর্থাৎ, তোমার হাতে ধরা বাণটি শত্রুদের বিনাশ করার উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করো।
তাহলে ইষু অর্থ কি তার জন্য আলা ব্যাখ্যা করতে হচ্ছেনা। কারণ ভাষ্যকারও ইষু অর্থে বাণই স্বীকার করেছেন। তাই ভাষ্যকারের অর্থকে স্বীকার না করা মানে ভাষ্যকার ও নিরুক্তের অবমাননা করার। তাই, ভাষ্য মতেও এটা প্রমাণিত হয় ইষু অর্থ বাণই।
🔘মন্ত্রে বলা হচ্ছে—
“যা ইষুম্ হস্তে বিভর্ষি, তাম্ শিবাম্ কুরু, মা হিংসীঃ”
তুমি যেই বাণ হাতে ধরে আছো, সেটা মঙ্গলময় করো এবং কাউকে হিংসা কোরো না।
যদি “ইষু = শিক্ষা / নীতি” হয়, তাহলে ‘তাম্ কুরু শিবাম্’ বা ‘তাম্ মা হিংসীঃ’ এসবের কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকে না।
কেননা, শিক্ষাকে হিংসা করা, বা নীতি-বাণকে শান্ত করা এইসব কথা অর্থহীন। কিন্তু, বাণ বা অস্ত্রকে ‘শিব’ করো = শান্ত করো, এবং ‘জগতকে হিংসা কোরো না’ এই প্রার্থনা যথার্থ এবং ব্যাখ্যাসমর্থ।
“ইষু” শব্দের অর্থ একমাত্র বাণ / অস্ত্র / শর। এটি উব্বট, মহীধর, যাস্ক, উণাদিকোষ, ব্যাকরণ ও ভাস্যসমূহে সর্বত্র একইভাবে প্রতিপাদিত। “ইষু = নীতি / শিক্ষা / জ্ঞানবাণ”। অনার্যদের এই দাবি—
❌ ভাষ্যবিরোধী,
❌ নিরুক্তবিরোধী,
❌ ব্যাকরণবিরোধী,
❌ পদার্থবিরুদ্ধ এবং অনর্থক,
❌ মন্ত্রপ্রসঙ্গের পরিপন্থী।
অতএব, “ইষু” মানে নীতি/শিক্ষা, এই অনার্য ব্যাখ্যা শাস্ত্রসম্মত নয়, এটি সম্পূর্ণ মনগড়া, ভাষ্যবিরোধী, ব্যাকরণবিরুদ্ধ এবং শৈবতত্ত্ব পরিপন্থী। শাস্ত্রসম্মত অর্থে “ইষু” মানেই শিবের নিক্ষেপযোগ্য বাণ(পাপনাশক অস্ত্র)।
❌অনার্যদের দাবী— ‘শিবা’ = শুভ/নীতি/সৎচরিত্রে পরিণত অস্ত্র (শিক্ষা)।
✅শৈবপক্ষের খণ্ডন— (উব্বট ও মহীধর ভাষ্য-সমর্থিত যুক্তিতে)
🔘“শিবা” এখানে শক্তিসম্পন্ন দেবতাত্মক অবয়ব অস্ত্র নয়, শিক্ষা তো নয়ই।
উব্বট বলেন—
“শিবাং গিরিত্র... তাং কুরু।”
“শিবাং” শব্দটি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন “গিরিত্র” মানে শিব, যিনি কৈলাসে অবস্থান করেন এবং ভক্তদের রক্ষা করেন (ত্রায়তে)।
সেই গিরিত্র (শিব)-এর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা হচ্ছে যে, “তাং শিবাং কুরু” অর্থাৎ, তুমি যেই বাণ (ইষু) ধারণ করছো, তাকে “শিবা” (কল্যাণকারিণী) করো।
যদি “শিবা” = শিক্ষা হত, তাহলে উব্বট নিশ্চয়ই বলতেন “বাণ = শিক্ষা” এবং “শিবাং” মানে ‘নীতিমূলক/উপকারী শিক্ষা করো’। কিন্তু তিনি তা বলেননি। বরং তিনি পর্বতে অবস্থিত শিব-কে উদ্দেশ করে বাণটিকে মঙ্গলকারিণী করতে বলছেন।
🔘মহীধর ভাষ্য— শিবা মানে কল্যাণকারিণী, শিক্ষা বা নীতি নয়।
“তামিষু শিবাং কল্যাণকারিণীং কুরু।”
মহীধর ভাষ্য স্পষ্ট করে “শিবা” শব্দের অর্থ দিয়েছেন “কল্যাণকারিণী”। এটি কোনো “নীতিমূলক অস্ত্র” নয়, বরং ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন ও পরিণামদায়ী এক ঐশ্বরিক শক্তি, যা নাশও করতে পারে, কল্যাণও করতে পারে।
প্রার্থনাটি হচ্ছে “তুমি যেন সেই ইষু (বাণ)-কে শিবা, অর্থাৎ কল্যাণদাত্রী রূপে পরিণত করো।”
এই বাক্যে “কুরু” ধাতুর প্রার্থনা-বাচক ব্যবহার আছে, তাই এই অনুরোধও ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে, কোনো অস্ত্রকে বা নীতিকে নয়।
🔘“শিবা” অস্ত্র নয়, অস্ত্রের গুণপ্রদানকারী পরমশক্তি।
“ইষু” বা বাণ (ধারণযোগ্য বস্তু) কে মঙ্গলময় করতে বলা হচ্ছে, তার চরিত্র পাল্টাতে নয়।
“নীতি/শিক্ষা/সৎচরিত্র” যদি এই “শিবা” শব্দের অর্থ হতো, তাহলে—
একে “কুরু” বলার দরকার হত না, কারণ নীতির জন্য অস্ত্র ধারন করতে হয় না।
“অসিতুং শত্রূন্” (শত্রু বধ করার জন্য) বলার কোনো মানে থাকতো না। শিক্ষায় তো বধ হয় না।
🔘“শিবা” শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ ব্যাকরণগতভাবেও অস্ত্র নয়।
“ইষু” শব্দটি পুংলিঙ্গ (ধনু, বাণ), কিন্তু “শিবা” হচ্ছে স্ত্রীলিঙ্গ যার মানে মঙ্গলকারিণী শক্তি, দেবীস্বরূপ।
অস্ত্র বা শিক্ষা কখনোই স্ত্রীলিঙ্গ “শিবা” হয়ে না।
আর যদি এই “শিবা” শব্দ “শিক্ষা” বা “নীতি” হত, তবে তা হতে পারতো “শিক্ষা”, “নীতি”, “উপদেশ” কিন্তু, “ইষু” শব্দটির সাথে একবাক্যে “শিবা কুরু” এটা ভাষার দিক দিয়েও অসংগত।
❌অনার্য দাবী— ‘শিবা’ = নীতিমূলক অস্ত্র/শিক্ষা।
✅উব্বট-মহীধর ব্যাখ্যায় খণ্ডন— “শিবা” মানে ‘কল্যাণকারিণী শক্তি’ যা দেবতা রূপে বর্ণিত।
❌অনার্য দাবী— বাণ = শিক্ষা, ‘শিবা’ = নীতি।
✅উব্বট-মহীধর ব্যাখ্যায় খণ্ডন— উভয় ভাষ্যই বলছে, বাণ ধারণ করা হয়েছে শত্রুবধের জন্য সুতরাং অস্ত্র নয়, শিক্ষা তো নয়ই।
❌অনার্য দাবী— দেবতা নেই, শুধু উপদেশ।
✅উব্বট-মহীধর ব্যাখ্যায় খণ্ডন— ভাষ্যকাররা সরাসরি শিবদেবকে “গিরিশন্ত”, “গিরিত্র” বলছেন; “শিবা” তাঁরই শক্তির প্রকাশ।
এই মন্ত্রে “শিবা” মানে কোনো নীতিকথা বা অস্ত্র নয় এটি শিবের এক মঙ্গলকারিণী শক্তি, বা দেবীস্বরূপ, “শিবত্ব” যিনি বাণের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেন। “শিক্ষা” বলে চালিয়ে দেওয়া অনার্য ব্যাখ্যা ভাষ্যসমর্থিত নয়।
🔘উপরোক্ত বিশ্লেষণে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, যজুর্বেদের শতরুদ্রীয় মন্ত্র ১৬.৩ (তথা শ্বেতাশ্বতর ৩.৬) এ বর্ণিত ‘গিরিশন্ত’, ‘গিরিত্র’ ও ‘শিবা’ শব্দসমূহ কোনো মানবীয় ক্ষত্রিয়, রাজপুরুষ, বা নীতিবাচক শিক্ষার রূপক নয়, বরং তারা প্রত্যক্ষভাবে কৈলাসস্থ পরমেশ্বর শিব, তাঁর অস্ত্র ও কল্যাণময় শক্তিকে নির্দেশ করে। উব্বট ও মহীধর প্রভৃতি প্রাচীন ভাষ্যকারগণ স্বয়ং ‘গিরিশন্ত’ ও ‘গিরিত্র’ শব্দের অর্থ কৈলাসে অধিষ্ঠানকারী পরমেশ্বর ও জগতের রক্ষাকর্তা শিবরূপেই ব্যাখ্যা করেছেন। ‘ইষু’ শব্দের ধাতু-নিরুক্তমুলক অর্থ “বাণ/অস্ত্র” এবং ‘শিবা’ শব্দের মানে “কল্যাণকারিণী শক্তি” এই দুইটি অর্থও ভাষ্য, ধাতু ও প্রয়োগদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও সুস্পষ্ট।
অতএব, অনার্য ব্যাখ্যাগুলি ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ভাষ্য ও প্রাসঙ্গিক প্রয়োগ সমস্ত দিক থেকেই ভিত্তিহীন, মনগড়া এবং মন্ত্রতাত্ত্বিক প্রসঙ্গের পরিপন্থী। এই মন্ত্র শিবের অস্ত্র ও মঙ্গলশক্তিকে উদ্দেশ্য করে করা প্রার্থনা, যা শিবের পাপনাশক অথচ কল্যাণময় রূপের প্রতিফলন। সুতরাং, এ শ্লোককে শৈবতত্ত্ব ও শিবভক্তির এক মহান বৈদিক স্বীকৃতি বলেই গৃহীত হওয়া উচিত।
🔴 দয়াভণ্ডের চ্যালাচামুণ্ডাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন—
যদি ‘গিরিশন্ত’ ও ‘গিরিত্র’ মানবীয় রাজা/সেনাপতি হয়, তাহলে মহীধর ও উব্বট উভয়ে কেন স্পষ্ট বলেছেন —
“গিরৌ কৈলাসে অবস্থিতঃ” (উভয় ভাষ্যে)।
কে সেই মানব রাজা যিনি কৈলাসে বসবাস করেন? তিনি কোন্ পুরাণ বা ইতিহাসে আছেন?
“গিরিশন্ত” মানে যিনি "পর্বতে থেকে সুখ বিস্তার করেন" এবং “গিরিত্র” মানে "যিনি কৈলাসে থেকে ভক্ত রক্ষা করেন” এই ব্যাখ্যা তো কেবল পরমেশ্বর শিবের পক্ষেই মানানসই। তাহলে কেন একজন ক্ষত্রিয় বা রাজপুরুষ হঠাৎ কৈলাসে গিয়ে বসবাস করবেন এবং ভক্ত রক্ষা করবেন ?
নিরুক্ত, উব্বট ও মহীধর একবাক্যে “ইষু” মানে “বাণ” বলছেন এবং বলেন “অসিতুং শত্রুন্”।
যদি ইষু = শিক্ষা/নীতি হয়, তবে “শত্রুদের প্রতি নিক্ষেপ করো” এই বাক্য নীতি বা শিক্ষার উপর আক্রমণের অনুরোধ হয় কেন? এটা তো মন্ত্রের অভিপ্রায়বিরুদ্ধ হয়ে যায়।
“শিবা” শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ, এবং ভাষ্যে বলা হয়েছে “কল্যাণকারিণীং কুরু”।
যদি “শিবা” মানে শিক্ষা/নীতি হয়, তাহলে এই স্ত্রীলিঙ্গ শব্দকে “ইষু” (পুংলিঙ্গ) বস্তুর গুণ হিসাবে ব্যবহার করা কি ব্যাকরণগতভাবে বৈধ ?
শিক্ষাকে কি কখনো “তাম্ কুরু শিবাম্” (তাকে কল্যাণকারিণী করো) বলা যায় ?
“একোহি রুদ্রঃ ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর” [শ্বেতাশ্বতর/৩/২]
সেখানে যেখানে বলা হচ্ছে বিশ্বে একমাত্র রুদ্রই সর্বোচ্চ, তার পাশে কোনো দ্বিতীয় নেই। সে জায়গায় “গিরিশন্ত”, “গিরিত্র”, “শিবা”এই সব শব্দের অর্থ কিভাবে “সামান্য মানবীয় ক্ষত্রিয়/শিক্ষক/রাজপুরুষ” হতে পারে ?
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী —
শিবেন বচসাত্বা গিরি শাচ্ছাবদামসি।
যথা নঃ সর্ব মিজ্জগদ যক্ষ্মং সুমনা অসৎ ৷৷ ৪ ৷৷
ভাষ্যার্থঃ হে (গিরিশ) পর্বত বা মেঘে রমণ কারী রোগনাশক বৈদ্যরাজ ! তুমি (সুমনাঃ) প্রসন্নচিত্র হয়ে আপনি (যথা) যেমন (নঃ) আমাদের (সর্বম্) সমস্ত মনুষ্যাদি জঙ্গম এবং স্থাবর রাজ্য (অযক্ষ্মম) ক্ষয় আদি রাজরোগ থেকে রহিত (অসত্) হয় ওইরূপ (ই) ই (শিবেন) কল্যাণকারী (বচসা) বচন দ্বারা (ত্বা) তোমাকে আমরা (অচ্ছ বদামসি) উত্তম বলি।
নোটঃ এই মন্ত্রে কেবল এক গিরিষ শব্দ এসেছে যার অর্থ পৌরাণিকরা কৈলাশবাসী শিব করে। বাস্তবে অর্থ এই যে গিরৌপর্বতে ঔষধার্থ শেতে রমতে, ইতি গিরিশ।
অর্থাৎ যে পর্বতে ঔষুধ খোজার জন্য শেতে অর্থাৎ অত্যন্ত দক্ষচিত্ত হয়ে রমন করেন। আর এক পদ ধ্যান দেবার যোগ্য যে মন্ত্রে শিব মঙ্গল বাচক শব্দ। যেমন বলা হয় শিবং ভবতু অর্থাৎ তোমার কল্যাণ হোক। এই প্রকার কেবল শিব শব্দ আসাতে ঈশ্বর গ্রহন হয় না।
সামনের মন্ত্রে ভিষক শব্দ স্পষ্ট ভাবে পাঠ রয়েছে যাহাতে মন্ত্র বৈদ্যের অভিপ্রায় সিদ্ধ হয়।
❌অনার্যদের দাবী— “গিরিশ” শব্দটি কোনও বৈদিক ঈশ্বর বা শিবদেবতার নাম নয়। এটি কেবল সেই ব্যক্তিকে বোঝায়, যিনি পাহাড় বা গিরিতে ঔষধ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিচরণ করেন।
অতএব, “গিরিশ” শব্দ মানে পাহাড়ে বসবাসকারী কোনও ঔষধ-বিশারদ বা সাধু ব্যক্তি মাত্র।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— এই দাবিটি শব্দার্থ ও প্রাসঙ্গিকতা উভয় দিক থেকেই অসংগত। মন্ত্রে "গিরিশ" শব্দটি যেভাবে ব্যবহার হয়েছে, তা কেবল সাধারণ গিরিভ্রমণকারী নয়, বরং একটি বিশেষ ও সম্বোধনযোগ্য দেবতা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। ভাষ্যকার উব্বট ও মহীধর স্পষ্ট করেছেন যে "গিরিশ" বলতে কৈলাসে অধিষ্ঠিত পরমেশ্বর শিব বোঝানো হয়েছে, যা সাধারণ ঔষধ-বিশারদ ব্যক্তি নয়। সম্পূর্ণ শতরুদ্রীয় জুড়ে- পিণাকধৃত, নীলকণ্ঠ, কৃত্তিবাসা, সোম(উমা সহিত শিব), জটাজুটধারী, নীললোহিত, রুদ্র, শিব, ভব, উগ্র, মৃড, শর্ব, পশুপতি, শংকর, শম্ভু, গিরিশ (কৈলাসনিবাসী), বিরূপ, বিশ্বরূপী, শিপিবিষ্ট ইত্যাদি পদবী দ্বারা প্রতিপাদিত তত্ত্ব পরমেশ্বর শিবই যিনি সাকারে ত্রিনেত্রধারী নীলকন্ঠ কৈলাস নিবাসী সদাশিব। এসব পদবী দ্বারা কোনো সাধু/বৈদ্যকে বোঝাবে না। কারণ এখানে রুদ্র সাক্ষাৎ ব্রহ্ম যিনি সাকার স্বরূপে কৈলাসে নিবাস করেন বলে তাকে গিরিশ নামে সংজ্ঞায়িত করা হয়। যা পূর্বের লেখাতে আমি শ্রুতি, আচার্যের ভাষ্য, ব্যাকরণ আদি শাস্ত্র দ্বারা প্রমাণ করেছি।
🔘উব্বট ও মহীধর উভয়েই পরিষ্কার ভাষ্যে বলেছেন—
“গিরিশ গিরৌ পর্বতে কৈলাসাখ্যে শেতে ইতি গিরিঃ তস্য সম্বোধনম্ হে গিরিশ”
গিরি মানে শুধু কোনও পাহাড় নয়, বরং কৈলাস পর্বতকে বোঝানো হয়েছে, যেখানে দেবতা শিব বসবাস করেন। অর্থাৎ, "গিরিশ" মানে কৈলাসে অধিষ্ঠানকারী পরমেশ্বর শিব,সাধারণ ঔষধ সংগ্রাহক বা হিমালয়চারী ব্যক্তি নন।
এই রকম ভাষ্য দ্বারা "গিরিশ" শব্দকে শিবের উপাধি হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে, এবং ঈশ্বরত্ব প্রমাণিত হয়েছে।
যদি “গিরিশ” শব্দের অর্থ হয় শুধুমাত্র “গিরিতে ঔষধ খোঁজার জন্য ঘুরে বেড়ানো ব্যক্তি”, তবে শ্রুতি ভাষ্যকার উব্বট এবং মহীধর কেন এটিকে "কৈলাসে অধিষ্ঠানকারী দেবতা শিব" বলে ব্যাখ্যা করলেন? তারা তো প্রকরণ-বিরুদ্ধ ব্যাখ্যা দিতেন না।
“গিরিশ” শব্দ যে দেবতাবাচক তা তো ভক্তিপূর্বক সম্বোধনের মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে (“হে গিরিশ”)। কোনো ঔষধ সংগ্রাহককে কি এইভাবে মন্ত্রপূর্বক আহ্বান করা হয়, যেখানে জগৎ রোগমুক্তির প্রার্থনা করা হয়?
❌অনার্যদের দাবী— “শিব” শব্দটি এখানে কোনও দেবতাকে বোঝায় না। এটি কেবল "কল্যাণ", "মঙ্গল", বা "শুভ" অর্থে ব্যবহৃত একটি সাধারণ শব্দ, যেমন “শিবং ভবতু” (তোমার কল্যাণ হোক) এই অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— “শিব” শব্দটি নিঃসন্দেহে ‘মঙ্গল’ অর্থে প্রয়োগযোগ্য হলেও, পাণিনীয় সংজ্ঞাবলে যখন গুণবাচক শব্দ নির্দিষ্ট ব্যাক্তিতে রূঢ় হয়ে যায়, তখন তা নাম (সংজ্ঞা) হয়ে দাঁড়ায়। এই মন্ত্রে “শিব” শব্দটি "গিরিশ" নামক নির্দিষ্ট সত্তার গুণস্বরূপে এসেছে। তাই একে কেবল গুণার্থক সাধারণ শব্দ বলা ব্যাকরণ ও ভাষ্য উভয়ের পরিপন্থী। এছাড়াও, সম্পূর্ণ শতরুদ্রীয়তে শিবের বিশেষণ হিসেবে- কৃত্তিবাসা, পিনাকী, উমার পতি, জটাজুটধারী, নীলকণ্ঠ, হিরণ্যবাহু ইত্যাদি পদ প্রযোজ্য যা শিবের সাকার সত্ত্বাকেই নির্দেশ করে। তাই কেবল, শিব অর্থ মঙ্গল, কল্যাণ অর্থে ব্যবহার করা অযৌক্তিক।
🔘উব্বট বলেছেন —
“শিবেন বচসা” অর্থাৎ শিবেন = মঙ্গলেন, কিন্তু এখানে তা একটি নির্দিষ্ট ব্যাক্তি “গিরিশ”-এর সম্বন্ধে ব্যবহার করা হয়েছে।
অর্থাৎ "শিব" এখানে শুধু একটি গুণ নয়, একটি গুণবাচক নামে পরিণত সত্তা, যিনি গিরিশ, ভিষক্, সুমনাঃ ইত্যাদি নামে পরিচিত। এছাড়াও ‘সুমনা অসৎ’ এখানে শিব ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থনা করা হচ্ছে, যেন তিনি আমাদের সব জগৎকে রোগমুক্ত করেন। সাধারণ কোন মঙ্গলকামী মানুষের প্রতি এরূপ স্তোত্র বা প্রার্থনা অর্থহীন।
সুতরাং “শিব” এখানে নিছক ‘কল্যাণ’ নয়, বরং কল্যাণকারী দেবতার নামরূপে ব্যবহার হয়েছে, যথা শিব।
যদি “শিব” কেবল কল্যাণ বোঝায়, তাহলে “শিবেন বচসা” এই বাক্যে একজন নির্দিষ্ট সত্তাকে মঙ্গলবচন সহকারে আহ্বান করার অর্থ কী? সাধারণ গুণ তো ব্যক্তির সঙ্গে সম্বোধনে এভাবে ব্যবহৃত হয় না।
❌অনার্যদের দাবী— এই মন্ত্রে রুদ্র বা শিবকে আহ্বান করা হয়নি। “ভিষক্” (চিকিৎসক) শব্দটি পরবর্তী মন্ত্রে উপস্থিত থাকায়, এটি প্রমাণ করে যে মন্ত্রে উদ্দেশ্য একজন মানব চিকিৎসক, না যে কোনও ঈশ্বরসত্ত্বা।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— "ভিষক্" শব্দটি ব্যুৎপত্তিগতভাবে চিকিৎসক বোঝালেও, যেহেতু মন্ত্রে সর্বজগতের রোগ থেকে মুক্তি প্রার্থনা করা হয়েছে ("নঃ সর্বমিজ্জগত্ অযক্ষ্মমসৎ"), তাই স্পষ্ট বোঝা যায় এটি কোনো সীমিত মানবচিকিৎসককে নয়, বরং সার্বভৌম, সর্বব্যাপী ঈশ্বরস্বরূপ চিকিৎসককে বোঝায়। উব্বট ও মহীধর ভাষ্যেও "সুমনাঃ", "গিরিশ", "শিবেন বচসা" ইত্যাদি দ্বারা তা পরিষ্কার হয়। অতএব "ভিষক্" শব্দের সীমিত মানব অর্থ এখানে গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়াও, এখানে যার প্রতি প্রার্থনা বোঝানো হয়েছে, তাকে শতরুদ্রীয়তে- জগতের স্রষ্টা, পালক, সংহারক বলা হয়েছে। “জগতাম পতয়ে নমো” মন্ত্রের ভাষ্যে উবট-মহীধর উভয়ই এই অর্থকেই স্বীকার করেছেন। তাই যিনি অনন্ত জগতের স্রষ্টা, পালক ও সংহারক তিনি কোনো সাধারণ মানব হতেই পারেনা, এটা অনার্যদের পক্ষপাতদুষ্ট আক্ষেপ মাত্র।
🔘 ‘ভিষক্’ শব্দটি পরবর্তী মন্ত্রে এলেও এই মন্ত্রেই বলা হয়েছে —
“অযক্ষ্মং অসৎ ভবতি” যেন সমগ্র জগৎ রোগহীন (অযক্ষ্ম) হয় এবং কল্যাণময় হয়।
একজন মানব চিকিৎসক কখনোই "সমগ্র জগৎ" এর (নর, পশু, স্থাবর, জঙ্গম) রোগ নিরাময় করতে পারেন না। এটি একমাত্র সেই ঈশ্বর-এর পক্ষে সম্ভব, যিনি সর্বব্যাপী এবং সার্বভৌম শক্তিসম্পন্ন।
তাই "ভিষক্" যদি পরবর্তী মন্ত্রে আসে, তবু এই মন্ত্রে “গিরিশ”, “শিব”, “সুমনাঃ” প্রভৃতি পদের সঙ্গে যুক্তভাবে তা ঈশ্বরার্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলে স্বীকৃত।
যদি এই মন্ত্রে মানব চিকিৎসক উদ্দেশ্য হয়, তবে কেন এখানে বলা হয়েছে- “নঃ সর্বমিজ্জগৎ অযক্ষ্মমসৎ” অর্থাৎ যেন সমগ্র জগৎ রোগহীন হয়? কোন মানব চিকিৎসকের পক্ষে “সমগ্র জগৎ” এর রোগ মুক্ত করা সম্ভব?
পরবর্তী মন্ত্রে যিনি “ভিষক্” নামে পরিচিত, তিনিই তো “জগতাম্ পতয়ঃ” জগতের প্রভু হিসেবে স্তুত হচ্ছেন। তখন কীভাবে তিনি একমাত্র একজন মানব চিকিৎসক বলে গণ্য করা যায়?
❌অনার্যদের দাবী— “সুমনা” মানে এখানে সদয়/ভদ্র/সজ্জন ব্যক্তি, যিনি মানুষের উপকার চান বা সুপরামর্শ দেন এতে কোনও ঈশ্বর বা আধ্যাত্মিক তাৎপর্য নেই।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— যেহেতু “সুমনা” শব্দটি মন্ত্রে “অসৎ ভবতি” জগৎকে রোগরহিত এবং কল্যাণময় করবার ক্ষমতাসম্পন্ন কারো উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে, তাই এটি নিছক সদয় ব্যক্তিকে নির্দেশ করে এই ধারণা অনুপযুক্ত। একজন সাধারণ সদয় ব্যক্তি কখনোই "সর্বমিজ্জগত্" সমস্ত জগতকে রোগমুক্ত করার অধিকার রাখেন না। সুতরাং "সুমনা" এখানে ঈশ্বরীয় গুণে গুণান্বিত পরম সত্তা শিবের একটি বিশেষণ মাত্র।
🔘উব্বট ও মহীধর উভয়েই "সুমনা" শব্দের অর্থ করেছেন—
"শোভাবনমনস্কং চ" অর্থাৎ, "দিব্য রূপ ও সদ্ভাবযুক্ত ঈশ্বরস্বরূপ সত্তা"।
এছাড়া “সর্বমিজ্জগত্” অর্থাৎ “সমগ্র জগৎ” (নর, পশু, স্থাবর) কে রোগমুক্ত করে যিনি সুমনা সত্তা হন, তাঁকে আহ্বান করা হয়েছে। এতবড় দায়িত্ব বা ক্ষমতা শুধু সদয় মানব চিকিৎসকের নয়, বরং ঈশ্বরস্বরূপ দেবতারই হতে পারে।
“সুমনা” যদি কেবল একজন সদয় মানুষের গুণবাচক বিশেষণ হয়, তাহলে “অসৎ ভবতি” অর্থাৎ জগতকে রোগমুক্ত ও কল্যাণময় করবার ক্ষমতা তার কিভাবে থাকতে পারে?
এই তো স্পষ্ট ঈশ্বরার্থক ক্ষমতা, যা কোনো সাধারণ মানুষ ধারণ করতে পারে না।
ভাষ্যকারেরা কেন "সুমনা" শব্দকে “শোভাবনমনস্কং চ” দিব্য ও সদ্ভাবযুক্ত সত্তা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যদি এটি কেবল সাধারণ মনুষ্যের বাচক হত?
❌অনার্যদের দাবী— “গিরিশ”, “শিব” ইত্যাদি শব্দের উপস্থিতি দেখে একে শিবদেবতার মন্ত্র বলা শুধু পৌরাণিক কল্পনার চাপিয়ে দেওয়া ফল। আসলে বেদে কোনও শিব-দেবতার স্পষ্ট পরিচয় নেই, এইসব শব্দ কেবল গুণবাচক/সাধারণ শব্দ মাত্র।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— যদিও এই শব্দগুলো ব্যুৎপত্তিগতভাবে গুণার্থে ব্যবহারযোগ্য, তবে ব্যাকরণ, প্রসঙ্গ এবং ভাষ্য অনুসারে এগুলো এখানে রূঢ় নামরূপে ব্যবহৃত হয়েছে, অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট দেবতাকে নির্দেশ করে। যেমন “গিরিশ” শব্দটি শুধুমাত্র ‘গিরিতে ঘুরে বেড়ানো ব্যক্তি’ বোঝায় না, বরং কৈলাসবাসী শিবের নামরূপে এসেছে যা ভাষ্যকার স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এছাড়াও, পরমেশ্বর অকল্পনীয়, অচিন্তনীয়, ভাবনারহিত সেই নির্গুণ পরমেশ্বরের গুণাবাচক নাম কীভাবে হতে পারে? গুণ ধারণ করা মানেই সাকার হওয়া। যিনি সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আকার দিয়েছে তিনি কেবল নিরাকার কীভাবে হতে পারে? যদি কেবল নিরাকার হয় তবে নিরুক্ত ও শ্রুতি দুইয়ের বিরোধ হবে। কেননা শ্রুতি ও নিরুক্ত বলছে—
“দ্বে বাব ব্রহ্মণো রূপে মূর্ত্তঞ্চৈবামূর্ত্তঞ্চ”
[বৃহদারণ্যক উপনিষদ/২/৩/১]
ব্রহ্মের দুইটি স্বরূপ নিরাকার ও সাকার।
"অপি বোভয়বিধাঃ স্যুঃ"
[যাস্ক নিরুক্ত/৭/২/৩/৭]
দেবতারা মনুষ্যকার এবং মনুষ্যাকার নয় দুই হতে পারে।
অর্থাৎ ব্রহ্মের সাকার ও নিরাকার দুই স্বরূপই বিদ্যমান। তাই কেবল একচেটিয়া ভাবে ব্রহ্মের সাকার স্বরূপকে অবজ্ঞা করে নিরাকার স্বরূপকেই মান্যতা দেওয়া শাস্ত্র বিরুদ্ধ আচরণ। তাই শ্রুতিতে শিব কেবল কল্যাণময় নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্ম বলাটা অযৌক্তিক।
অতএব, এই শব্দগুলিকে নিছক সাধারণ শব্দ ধরে নেওয়া ব্যাকরণ এবং শাস্ত্রবিরুদ্ধ।
🔘ভাষ্য অনুসারে —
“গিরিশ = কৈলাসে শয়মান পরমেশ্বর”
“শিব = মঙ্গলকারী ঈশ্বর”
“সুমনাঃ = সদ্ভাব ও দিব্য সত্তা”
“অসৎ ভবতি = জগৎ রোগমুক্ত করে”
এছাড়া “অচ্ছাবদামসি” মানে ‘আমরা প্রার্থনা করি’ এই প্রার্থনা ব্যক্তিগত ব্যক্তির প্রতি নয়, বরং দিব্য ও সর্বশক্তিমান সত্তার প্রতি।
তাই একে শুধুমাত্র সাধারণ শব্দ-ব্যবহার বললে, ভাষ্যকারদের অভিপ্রায়, এবং মন্ত্রপ্রয়োগ, উভয়ই অবজ্ঞা করা হয়। এটি সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক ও অবৈদিক ব্যাখ্যা।
🔘 এই মন্ত্রে শিব শব্দ গুণবাচক হলেও তা ঈশ্বরনামেরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। “গিরিশ”, “সুমনা”, “ভিষক্” সব শব্দই সেই শিবরূপ ঈশ্বরের গুণ বা কর্মসূচক নাম। উব্বট ও মহীধর ভাষ্য অনুসারে, শিবই এই মন্ত্রের উদ্দেশ্যভুক্ত ঈশ্বর।
অতএব, অনার্যদের উপরের সব দাবীই ভাষ্য ও যুক্তির দ্বারা ভ্রান্ত ও খণ্ডনযোগ্য।
যদি “গিরিশ”, “শিব”, “ভিষক্”, “সুমনা” এগুলো কেবল গুণবাচক শব্দ হয়, তবে উব্বট ও মহীধর ভাষ্যকাররা কেন এগুলোর প্রত্যেকটির ব্যাখ্যায় একে কৈলাসনিবাসী, মঙ্গলকারী, দিব্যসত্তা, জগতপতি বলে নির্দিষ্ট ঈশ্বরের লক্ষণে ব্যাখ্যা করেছেন?
যদি বেদে শিবদেবতার কোনও স্পষ্ট পরিচয় না থাকে, তাহলে শতরুদ্রীয় মন্ত্রে কেন একে একে “গিরিশ”, “শিব”, “পিনাকী”, “নীলকণ্ঠ”, “উমাপতি”, “বিশ্বরূপ”, “মৃড”, “শম্ভু”, “জটাজুটধারী” প্রভৃতি উপাধি সহকারে আখ্যায়িত করা হয়েছে যা কেবল পরমেশ্বর শিবকেই বোঝায়?
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী —
অধ্যবোচদধিবক্তা প্রথমো দৈব্যো ভিষক্।
অহিংশ্চ সর্বাঞ্জম্ভয়ত্সর্ব্বাশ্চ যাতুধান্যোহধরাচীঃ
পরা সুব৷৷৫৷৷
ভাষার্থঃ হে রোগনাশক বৈদ্য! যে (প্রথমঃ) মুখ্য (দৈব্যঃ) বিদ্বানদের মধ্যে প্রসিদ্ধ (অধিবক্তা) সব থেকে উত্তম কক্ষের বৈদ্যকশাস্ত্র কে পাঠ করানো তথা (ভিষক্) নিদান আদি কে জানা রোগ কে নিবৃত্ত করানোকারী আপনি (সর্বান্) সমস্ত (অহীন) সর্পের তুল্য প্রাণান্ত করানোকারী রোগ কে (চ) নিশ্চয় রূপে (জম্ভয়ন) ঔষধি দ্বারা দূর করে (অধ্যবোচৎ) অধিক উপদেশ করেন, তো আপনি (সর্বাঃ) সমস্ত (অধরাচীঃ) নিচ গতি কে পৌছানোকারী (যাতুধান্যঃ) রোগকারিণী ঔষধি বা ব্যভিচারিণী স্ত্রী, তাহাকে (পরা) দূর (সুব) করুন।
নোটঃ উব্বট এবং মহিধর এই মন্ত্রের অর্থে বিশেষ ভেদ নেই, নিজ মনোর্থে রুদ্র কে বৈদ্য মেনে মন্ত্রার্থ করেছেন। মন্ত্রের বিষয়ে যে বৈদ্যের উপদেশ রয়েছে তাহা তারাও ছাড়তে পারে নি। একটু ভেদ রয়েছেন তা হলো (যাতুধান্যঃ) এর অর্থ রাক্ষসী করেছেন। অমরকোষের রীতি অনুসারে যাতুধান নাম রাক্ষসের এই কারণে বেদার্থে ভূত প্রেতাদির সন্দেহ প্রদর্শন করেছেন। বাস্তবে "যাতুনি দুখানি প্রাণিষু ধারয়ন্তীতি যাতুধান্যঃ" যে প্রাণীদের দুঃখ উৎপন্ন করে তাকে যাতুধান্য বলে।
❌অনার্যদের দাবী — এই মন্ত্রে ‘রুদ্র’ দেবতার কোনও উল্লেখ নেই, বরং এটি একজন রোগনাশক মানব চিকিৎসকের (ভিষক্) উদ্দেশ্যে রচিত। যিনি নিদান (রোগ-পরিচিতি) ও ঔষধশাস্ত্রে পারদর্শী এবং জড় ঔষধি ব্যবহার করে রোগ দূর করেন।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— এই দাবী মূলত শতরুদ্রীয় অংশের সামগ্রিক ঐতিহ্য, মন্ত্রপ্রবাহ, ভাষ্যকারের দৃষ্টিকোণ, এবং ব্যাকরণবদ্ধ শব্দার্থের সরলতা উপেক্ষা করে তোলা হয়েছে। একটি প্রশ্ন জাগে— যদি এটি কেবল মানব চিকিৎসক হন, তবে কেন মন্ত্রে তাঁর বিষস্রাবী সর্প, যাতুধান্য, অধরাচী রাক্ষসদের নিধনের ক্ষমতা বর্ণনা করা হচ্ছে? কেন তাঁকে “প্রথমঃ দৈব্যঃ ভিষক্” এবং “অধিভক্তা” বলা হচ্ছে? এধরনের মহাশক্তিধর গুণ কোনো সাধারণ চিকিৎসকের পক্ষে অসম্ভব, যা শুধু ঈশ্বরস্বরূপ রুদ্রের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সুতরাং এই মন্ত্র ঈশ্বররূপ রুদ্রকেই উদ্দেশ করে, চিকিৎসক রূপে নয় বরং সর্বজ্ঞান ঈশ্বর রূপে।
🔘উবট ভাষ্য—
উবটের ভাষ্য অনুসারে, মন্ত্রে ‘রুদ্র’ একজন ‘দৈব্য ভিষক্’, অর্থাৎ ঈশ্বরীয় চিকিৎসক এবং ‘ভগবান্ রুদ্রঃ’ নামে পূজিত। উবট বলেন—
“প্রথমো দৈব্যো ভিষক্ মুখ্যো দেবসম্পন্ধী ভিষক্ বৈধ্যঃ”
রুদ্র কে শুধু মানব চিকিৎসক হিসেবে নয়, বরং প্রথম ও প্রধান ঈশ্বরীয় চিকিৎসক বলা হয়েছে।
“অহীঁশ্চ সর্বান্ জম্ভয়ান্”
সকল বিষধর সর্প, ঝাঁক, ও অন্যান্য ক্ষতিকারক প্রাণীকে বিনাশের ক্ষমতা তিনি রাখেন, যা সাধারণ চিকিৎসকের সাধ্যের বাইরে।
“পরাসুভ পরাক্ষিপ”
অশুভ শক্তিকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা দেবতুল্য।
উবটের ভাষ্য স্পষ্ট যে ‘রুদ্র’ কেবল একজন বৈদ্য নয়, বরং ঈশ্বরীয় ক্ষমতাসম্পন্ন রোগনাশক। যাতুধান্যদের রূপক অর্থে ব্যবহার হয়েছে যা অশুভ শক্তির নির্দেশ। তাই ‘রুদ্রকে মানব চিকিৎসক’ দাবি অগ্রহণযোগ্য।
🔘মহীধর ভাষ্য—
“মামধ্যবোচত্ অধিভক্তু মাম্ সর্বাধিকং বাদতু” রুদ্র নিজের বক্তব্য করেন ও সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করেন, মানব চিকিৎসক সাধারণত এমন ব্যক্তিত্ব নয়।
“প্রথমঃ সর্বেষাং মুখ্যঃ পূজ্যত্বাৎ দৈব্যঃ”
প্রথম ও মুখ্য, দৈব অর্থে ঈশ্বরীয়।
“ভিষক্ রোগনাশক”
রোগনাশক, তবে স্মরণমাত্রেই রোগ দূর করার ক্ষমতা রাখা ঈশ্বরীয়।
“সর্বা যাতুধান্যঃ… দূরিকুরু”
সমস্ত অশুভ শক্তি (যাতুধান্য, রাক্ষসী) দূরে সরানোর ক্ষমতা, যা চিকিৎসকের পারদর্শিতার বাইরে।
“সর্পব্যাঘ্রাদীন্ জম্ভয়ান্ বিনাশয়ান্”
বিষধর প্রাণী ও ক্ষতিকারক শক্তি বিনাশ।
মহীধরও ‘রুদ্র’কে কেবল একজন চিকিৎসক নয়, বরং দেবত্বসম্পন্ন রোগনাশক রূপে দেখেছেন।
🔘উবট ও মহীধর উভয়ই ‘রুদ্র’কে মানব চিকিৎসকের চেয়ে অনেক উচ্চতর ও ঈশ্বরীয় রূপে বর্ণনা করেছেন। ‘রুদ্র’ শব্দের সাথে যুক্ত ‘ভগবান্’, ‘দৈব্য’, ‘পরাসুভ পরাক্ষিপ’, ‘অহীন জম্ভয়ান’ ইত্যাদি পদাবলী ঈশ্বরত্বের নির্দেশক।
অনার্যদের দাবীর যে ‘রুদ্র’ মানব চিকিৎসক তা ঈশ্বরীয় শক্তি ও ক্ষমতার বর্ণনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
‘যাতুধান্য’ প্রভৃতি শব্দের অর্থ কেবল ব্যভিচারিণী বা রোগকারিণী নারী নয়, বরং রাক্ষসী বা অশুভ শক্তির প্রতীক।
অতএব, শতরুদ্রীয় মন্ত্রের মূল অর্থেই ‘রুদ্র’ একটি ঈশ্বর, যিনি সর্বদাই রোগ ও অশুভ শক্তির বিনাশ করেন।
‘রুদ্র’ যদি শুধু একজন মানব চিকিৎসক হন, তবে কেন তাঁকে ‘ভগবান্’ ও ‘দৈব্য ভিষক্’ হিসেবে পূজিত করা হয়?
রোগনাশক এবং অশুভ শক্তি বিনাশক ক্ষমতা একটি মানব চিকিৎসকের সাধ্যের বাইরে তাহলে অনার্যদের কিভাবে এই অমিল যুক্তি ব্যাখ্যা করবেন?
❌অনার্যদের দাবী— ‘প্রথম দৈব্য অধিবক্তা’ অর্থেও কোনও ঈশ্বরীয় বা দিব্য বৈশিষ্ট্য নেই, এটি কেবল একজন পাণ্ডিত্যান্বিত চিকিৎসক, যিনি দেব-ঔষধ শাস্ত্রে প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— এই দাবীর মূল সমস্যা হলো— ‘দৈব্য’ শব্দের ব্যুৎপত্তি এবং ‘অধিভক্তা’ শব্দের প্রকৃত অর্থকে অগ্রাহ্য করা। শাস্ত্র ও ভাষ্য অনুযায়ী ‘দৈব্য’ মানে কেবল ‘দেব-ঔষধে শিক্ষিত’ নয়, বরং ‘দেবতাসম্পর্কিত’, এমনকি ‘দেবতা সদৃশ’ও বোঝায়। আবার ‘অধিভক্তা’ মানে ঊর্ধ্বতন জ্ঞানসম্পন্ন বক্তা, এই গুণ মানব চিকিৎসকের নয়, বরং সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের। ভাষ্যকার উব্বটও একে “ঈশ্বরো বক্তা” বলে ব্যাখ্যা করেছেন। অতএব, মন্ত্রের এই পদাবলী কোন সাধারণ পণ্ডিত চিকিৎসক নয়, সর্বজ্ঞ রুদ্র ঈশ্বরকে নির্দেশ করে।
🔘উবট ভাষ্য—
“প্রথমো দৈব্যো ভিষক্ মুখ্যো দেবসম্পন্ধী ভিষক্ বৈধ্যঃ”
‘প্রথমঃ’— অর্থে সর্বপ্রথম ও প্রধান।
‘দৈব্যঃ’— দেবসম্পর্কিত বা দেবতুল্য।
‘ভিষক্’— রোগনাশক ঈশ্বরীয় চিকিৎসক।
“অধিভক্তা” অর্থে অধি বক্তা, অর্থাৎ ঈশ্বরো বক্তা।
🔘“দৈব্যঃ” শব্দটি দেব-ঔষধে শিক্ষিত ব্যক্তি নয়, দেবসম্বন্ধযুক্ত, অর্থাৎ, ঈশ্বরীয়, অলৌকিক।
‘দৈব্য’ শব্দটি সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দিব্য + য = দৈব্য = দেবতাসুলভ বা দিব্য গুণসম্পন্ন।
উবট নিজেই স্পষ্ট বলেন, “ভগবান্ রুদ্রঃ”, অর্থাৎ মানব নয়, ভগবৎস্বরূপ।
🔘অধিভক্তা = অধি + বক্তা—
“অধি” মানে উপরে/অধিষ্ঠিত।
“বক্তা” বক্তা বা জাননে ইচ্ছুক।
“অধিভক্তা” বোঝায়, যিনি ঈশ্বরীয় শক্তির দ্বারা ঊর্ধ্বস্থ বক্তা বা জ্ঞানদাতা।
🔘উবটের ভাষ্যে ‘রুদ্র’ মন্ত্র-উচ্চারণকারী এবং ঔষধ-ব্যবহারকারী চিকিৎসক নয় বরং রাক্ষসী, অহী, যাতুধান্য বিনাশক ঈশ্বর।
🔘“প্রথমঃ দৈব্যঃ অধিভক্তা” শুধুমাত্র কোনও পাণ্ডিত চিকিৎসকের বর্ণনা নয়, বরং দেবত্বধারী, সর্বপ্রথম, জ্ঞাতব্য ঈশ্বররূপ রুদ্রের বর্ণনা।
🔘মহীধর ভাষ্য—
“প্রথমঃ সর্বেষাং মুখ্যঃ পূজ্যত্বাৎ”
সর্বশ্রেষ্ঠ, পূজ্যযোগ্য।
“দৈব্যঃ…দেভেব্যঃ হিতঃ”
দেবতুল্য অথবা দেব-সম্পর্কিত, ঈশ্বরীয়।
“অধিভক্তা অধিকবাদনশীলঃ”
যিনি সর্বাধিক জানেন ও প্রভাব বিস্তার করেন।
মহীধর 'দৈব্য' শব্দের ব্যাখ্যায় বলেন, এটি "দেভেব্যঃ হিতঃ" অর্থাৎ দেবতার দ্বারা হিতসাধনকারী অথবা দেবতাত্মক। কেবল 'দেব-ঔষধে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক' নয়, দেবোৎসারিত ক্ষমতাসম্পন্ন।
“অধিভক্তা অধিকবাদনশীলঃ” এখানে বক্তার শ্রেষ্ঠত্ব শিক্ষায় নয়, ঈশ্বরত্বে নিহিত। একজন মানব চিকিৎসক কখনোই “অধি-বাদতু” (অধিষ্ঠিত হয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ বলনকারী) হতে পারেন না।
মহীধরের দৃষ্টিতে রুদ্র একজন রাক্ষসী/অহী বিনাশকারী, স্মরণেই রোগনাশক, যা অলৌকিক ক্ষমতার নির্দেশ দেয়।
🔘‘প্রথমঃ দৈব্যঃ অধিভক্তা’ কে কেবলমাত্র দেব-ঔষধজ্ঞানবিশিষ্ট মানব চিকিৎসক বলা মহীধরের ভাষ্যবিরুদ্ধ। তিনি এই মন্ত্রে রুদ্রকে পূজ্য, অলৌকিক ও সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
🔘“প্রথমঃ দৈব্যঃ অধিভক্তা” বাক্যাংশে কোনও সাধারণ, মানবিক চিকিৎসকের বর্ণনা নেই।
উবট ও মহীধর উভয়ের ভাষ্যই ‘দৈব্য’ ও ‘অধিভক্তা’ শব্দে ঈশ্বরীয় গুণ তুলে ধরেছেন, যা অনার্যদের দাবীকে খণ্ডন করে।
মন্ত্রের প্রেক্ষিতে রুদ্র কেবল একজন জড়ঔষধ-ব্যবহারকারী চিকিৎসক নন, বরং সর্বপ্রধান, অলৌকিক রোগনাশক, ও অশুভ বিনাশকারী দেবতা।
যদি “দৈব্য” শব্দটি কেবল “দেব-ঔষধে শিক্ষিত” বোঝাত, তাহলে উবট ও মহীধর কেন তাকে ভগবান, পূজ্য, রোগনাশক ঈশ্বর বলেছেন?
একজন মানব চিকিৎসক কিভাবে “অহীঁশ্চ সর্বান্ জম্ভয়ান্” সমস্ত বিষধর সর্প বিনাশকারী এবং “যাতুধান্যঃ পরাসুভ ক্ষিপ” রাক্ষসী বিনাশের অধিকারী হন?
❌অনার্যদের দাবী— ভিষক্ শব্দটি মানেই “ঐশ্বরিক চিকিৎসক” নয় বরং সাধারণভাবে যেকোনো চিকিৎসক বা ওঝা/বৈদ্য বোঝায়, সুতরাং রুদ্র বা শিবকে এখানে ডাকছেন বলা পৌরাণিক প্রক্ষিপ্ততা বা ব্যাকরণবিরুদ্ধ চাপানো অর্থ।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— ভিষক্’ শব্দটি সাধারণ অর্থে চিকিৎসক বোঝাতে ব্যবহৃত হলেও, শাস্ত্র ও ভাষ্যকারেরা যখন ঈশ্বর রূপে রুদ্রকে “ভিষক্” বলেন, তখন তা রূপক নয়, বরং নিখাদ ঐশ্বরিক। কেননা মন্ত্রে বলা হয় “স্মরণমাত্রে রোগনাশক”, “অহীন্ জম্ভয়ান্”, “রাক্ষসী দূরীকরণকারী” এই গুণপনা একমাত্র ঈশ্বরসত্তার সাথেই মানানসই। ঋগ্বেদের “ভিষক্তমং ভিষজাং” মন্ত্রেও এই রুদ্রকেই বলা হয়েছে সমস্ত ভিষজদের শ্রেষ্ঠ। সুতরাং ‘ভিষক্’ শব্দ এখানে একমাত্র ঐশ্বরিক রুদ্র/শিবকে বোঝায়।
🔘উবট আচার্য এই মন্ত্রের ভাষ্যে ‘প্রথমো দৈব্যো ভিষক্’ শব্দবন্ধের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পরিষ্কার বলেন—
“প্রথমো দৈব্যো ভিষক্”
মুখ্যো দেবসম্পন্ধী ভিষক্ বৈধ্যঃ।
অর্থাৎ, এখানে "ভিষক্" কেবল সাধারণ ডাক্তার নয়; তিনি দেবসম্পর্কিত, সর্বোচ্চ ঈশ্বরস্বরূপ রোগনাশক।
আরও বলেন—
“অধি-বাদতু ব্রবীতু কঞ্চিত্ স্বকীয়ং পুরুষং ভগবান্ রুদ্রঃ।”
“ঈশ্বর রুদ্র যিনি অধিভক্তা, অর্থাৎ যিনি ঐশ্বর্য ও জ্ঞান দ্বারা সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে রোগনাশ বিষয়ে বচন করেন।”
অর্থাৎ, এই ভিষক্ হলেন ঈশ্বররূপ রুদ্র, যিনি ঐশ্বরিক বাচ্যতা দ্বারা “উপরি উপদেশকারী” (অধিভক্তা)।
🔘মহীধরভাষ্যও ঈশ্বররূপ রুদ্রকে বোঝান।
মহীধর বলেন—
“রুদ্রঃ মামধ্যবোচত্”
অধিভক্তু মাম্ সর্বাধিকং বাদতু।
অর্থাৎ ঈশ্বররূপ রুদ্র আমাকে ঔষধবিষয়ে সর্বোচ্চভাবে বচন করুন।
এবং তিনি স্পষ্ট করে বলেন—
“প্রথমঃ সর্বেষাং মুখ্যঃ পূজ্যত্বাৎ। দৈব্যঃ দেবেব্যঃ হিতঃ।”
এখানে রুদ্রকে “সর্বেশ্বর, পূজ্য, দেবসম্পর্কিত” বলা হচ্ছে।
ভিষক্ শব্দে তিনি ঔষধধারী স্মরণমাত্ত্রে রোগনাশক ঈশ্বরকে বোঝান—
“ভিষক্ রোগনাশকঃ স্মরণেনৈব রোগনাশাদ্ ভিষকম্।”
কেবল স্মরণেই রোগ বিনাশ করতে পারেন, এমন ব্যক্তি সাধারণ ওঝা/বৈদ্য নন, বরং ঈশ্বর। আর এই ঈশ্বরই শাস্ত্রমতে শিব।
🔘এই প্রসঙ্গে ঋগবেদে বলা আছে—
উন্নো বীরাঁ অর্পয় ভেষজেবি র্ভিষক্তমং ত্বা ভিষজাং শৃণোমি।”
(ঋগ্বেদ ২/৩৩/৪)
অর্থ— হে রুদ্র! আপনি আমাদের সন্তানদের ভেষজবলে সুস্থ করে তুলুন। আমি আপনাকে সকল চিকিৎসকের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম চিকিৎসক (ভিষক্তমং ভিষজাং) বলে শুনেছি।
এই ঋগ্বৈদিক প্রমাণে রুদ্রকে কেবল ভিষক্ নয়, বরং “ভিষজদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠতম ভিষক্” বলা হয়েছে-
যা ঔষধধারী ঈশ্বররূপ রুদ্র/শিব, এই অর্থই সমর্থন করে।
সুতরাং, ভিষক্ শব্দে ঈশ্বররূপ রুদ্রকেই বোঝানো হচ্ছে, যিনি সাধারণ চিকিৎসক নন।
🔘“ঔষধধারী রুদ্র” ভৌতিক নয়, ঈশ্বরীয়।
এই বিষয়টি স্পষ্ট হয় ঋগ্বেদ ১.১১৪.৫ মন্ত্রেও—
“ হস্তে বিভ্রদ্ ভেষজা বার্যাণি”
যিনি হাতে সমস্ত রকম ঔষধ ধারণ করেন।
উক্ত মন্ত্রে এই রুদ্রকেই বলা হচ্ছে—
“নমসা নি হ্বয়ামহে”
আমরা তাঁকে নমস্কার করে আহ্বান করি।
এই মন্ত্রে ঔষধধারিতা = ঈশ্বররূপ সত্তার গুণ। তাই যিনি ভিষক্, তিনি ঔষধির আধারস্বরূপ ঈশ্বর।
🔘এই প্রসঙ্গে আরও একটি ঋগ্বৈদিক সমর্থন—
“তমু স্তুহি যঃ স্বিষুঃ সুধন্বা যঃ বিশ্বস্য ক্ষয়তি ভেষজস্য।
যক্ষ্বা মহে সৌমনসায় রুদ্রং নমোভির্ দেবম্ অসুরং দুরস্য॥”
(ঋগ্বেদ সংহিতা ৫.৪২.১১)
অর্থ— রুদ্রকে স্তব করো, যিনি দক্ষ ধনুর্বান, যিনি সমগ্র ভেষজশক্তির ধারক। রুদ্রের উদ্দেশ্যে পূজা করো কল্যাণ ও শান্তির জন্য, এবং প্রাণশক্তিসম্পন্ন সেই দেবতারূপ অসুর (ঈশ্বর) কে নমস্কার করো।
এই মন্ত্রে রুদ্রকে “বিশ্বস্য ভেষজস্য ক্ষয়তি” অর্থাৎ ভেষজের আধার, ধারক, নিয়ন্তা ও প্রয়োগকারী ঈশ্বর বলা হয়েছে। তিনি কেবল রোগনাশক নন, বরং ঔষধ শক্তির আধারস্বরূপ।
এটি প্রমাণ করে যে রুদ্র/শিব ঈশ্বরীয় ভিষক্, সাধারণ ভেষজজ্ঞ ব্যক্তি নন। এটি অনার্যদের "রুদ্র মানে ওঝা বা মানুষ মাত্র" এই দাবিকে সম্পূর্ণ খণ্ডন করে।
🔘‘ভিষক্’ ব্যুৎপত্তি অনুসারে ঈশ্বরেও প্রযোজ্য।
উণাদিসূত্র (১.৩৮) অনুসারে ‘ভি/ভী’ (ভয় বা রোগপ্রদায়ক অবস্থা বোঝানো ধাতু) থেকে ষুক্ আগম ও হ্রস্বাদেশ দ্বারা “ভিষক্” শব্দ তৈরি হয়।
এর অর্থ— যিনি ভয় বা রোগ দূর করেন। এই গুণ কেবল সাধারণ চিকিৎসকের নয়, ঈশ্বররূপ রুদ্র যিনি রোগের মূল উৎপাটনকারী, তিনিও এই অর্থে ভিষক্।
🔘নিরুক্ত দ্বারা ব্যুৎপত্তিগত সমর্থন—
“ততো ভিষক্, তত্ ইতি সন্তাননাম, পিতুর্বা পুত্রস্য বা।”
(নিরুক্ত/৬/৬/৩)
অর্থ— ঋষি যাস্ক বলেন, “ততঃ ভিষক্”, অর্থাৎ ভিষক্ বা রোগনাশক যিনি, তাঁর নাম "তত্"।
“তত্” শব্দের অর্থ- সন্তান, পুত্র বা পিতা, যে সৃষ্টির বিস্তার করে বা যার দ্বারা বিস্তার ঘটে।
এই “তত্” শব্দ ঈশ্বরবাচক, যিনি সৃষ্টি করেন, পোষণ করেন, এবং রক্ষা করেন।
এটি রুদ্রের “ভিষক্” স্বরূপকে শুধু রোগ-নাশক অর্থে সীমাবদ্ধ না রেখে, সৃষ্টির উৎস, বিস্তার ও কার্যকারিতা বিশিষ্ট ঈশ্বররূপ হিসেবে প্রতিপাদিত করে।
সুতরাং, “ভিষক্” শব্দটি কেবল কোনো ওঝা নয়, বরং ঈশ্বররূপ স্রষ্টা ও রক্ষক রুদ্রের জন্যই প্রযোজ্য।
🔘সাধারণ ভিষক্ নয়, সর্বজ্ঞানবিশিষ্ট “অধিভক্তা”।
উবট ও মহীধর দুজনেই “অধ্যবোচৎ” ধাতুর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন—
“অধিভক্তা অধি-বাদতু ঈশ্বরো বক্তা”
যিনি ঊর্ধ্বতন জ্ঞাতব্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান দিয়ে থাকেন, তিনিই অধিভক্তা = ঈশ্বররূপ বক্তা।
অতএব, সাধারণ ভিষক্ নয়, এখানে বলা হয়েছে,
ঈশ্বররূপ, সর্বজ্ঞ, ঔষধধারী, রোগনাশক রুদ্র/শিব যিনি এই মন্ত্রে আহ্বানযোগ্য ভিষক্।
ঋগ্বেদে রুদ্রকে “ভিষক্তমং ভিষজাং” বলা হয়েছে। যদি ‘ভিষক্’ মানেই কেবল মানব চিকিৎসক হতো, তবে এই সর্বশ্রেষ্ঠতা কিসের ভিত্তিতে?
যদি ভিষক্ শব্দে ঈশ্বর বোঝানো না হয়, তাহলে কেন মহীধর বলেন “স্মরণমাত্রে রোগ হরণকারী”? একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া এই ক্ষমতা কার?
❌অনার্যদের দাবী— ‘যাতুধান্যঃ’ শব্দটির মানে পৌরাণিক “রাক্ষসী” নয়, এটি কেবল কোনো রোগদায়িনী স্ত্রীলোক বা দুঃখদায়িনী ঔষধিবিশেষকে বোঝায়, অমরকোষেও একই মান্যতা। অতএব, এতে অশরীরী ভৌতিক শক্তির কোনও উল্লেখ নেই।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— এই ব্যাখ্যা নিরুক্ত, ঋগ্বেদ, ভাষ্য, এবং অভিধানসমূহকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে বলা হয়েছে। যাস্ক স্পষ্ট বলেছেন “যাতুধান” শব্দের অর্থ রাক্ষস। অমরকোষও এই অর্থেই রীতিবদ্ধ করেছে, “যে যাতু (অপদেবতা) পালন করে” সে ‘যাতুধান’। ভাষ্যকার উব্বট ও মহীধরও এটিকে ‘রাক্ষসী’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। ‘যাতুধান্যঃ’ মানেই হল ভয়ংকর অশুভ শক্তির রূপ, যাকে ঈশ্বর রুদ্রই বিনাশ করেন। অতএব, এটিকে শুধুমাত্র রোগদায়িনী নারী বা ঔষধি বলে সীমিত করা বিভ্রান্তিকর।
🔘 “যাতুধান” শব্দে মহর্ষি যাস্ক কি বলে তা দেখে নেবো—
অদ্যা মুরীয় যদি যাতুধানো অস্মি" (ঋগ্বেদ/৭/১০৪/১৫)
[নিরুক্ত/৭/৩/৮]
অদ্যা মুরীয় (আমি যেন আজ মরিয়া যাই) যদি যাতুধানঃ অস্থি (যদি আমি রাক্ষস হইয়া থাকি)।
এখানে “রাক্ষস” বোঝাতে “যাতুধান” শব্দ ব্যবহার হয়েছে। অর্থাৎ, নিরুক্ত মতে যাতুধান অর্থ রাক্ষস।
🔘 “যাতুধান” অর্থে শব্দকোষ অভভিধান বলছে—
"যাতুধানঃ"
[অমরকোষ/স্বর্গ-বর্গ/৫৮]
যাতুধান-পুং {যাতু-ধা+যু, কর্তৃ} যাতু (রাক্ষস) পোষণ করে যে [জাতুধান]।
“যে যাতু (অপদেবতা) পোষণ করে, তাকে যাতুধান বলে।” অর্থাৎ, অপদেবতাকে লালন-পালনকারী শক্তি = যাতুধান।
সুতরাং "যাতুধান্যঃ" শব্দের অর্থ কোনও ভেষজ বা নারীসেবিকা নয়, বরং রাক্ষস, রাক্ষসী, অপদেবতা, যাদের ঈশ্বর ধ্বংস করেন।
🔘উবট ভাষ্য—
উবট ‘যাতুধান্যঃ’ শব্দের ব্যুৎপত্তি দেন—
“যাতনাঃ দুঃখং কষ্টং তত্ প্রাণিষু ধারয়ন্তি ইতি যাতুধান্যঃ”
“যারা প্রাণীদের দুঃখ ও কষ্ট বহন করায়” তারা যাতুধান্য।
এখানে যাতনাদান, মানসিক/শারীরিক কষ্টের জন্ম দেওয়া যারা, তারা হচ্ছে অশুভ শক্তি, রাক্ষসী প্রকৃতির সত্তা।
উবট এরপর বলেন—
“রাক্ষসীঃ জম্ভয়ান্”
রুদ্র যিনি সেই রাক্ষসীদের বিনাশ করেন।
উবট একে কেবল ‘রোগদায়িনী নারী’ হিসেবে দেখেননি। ‘রাক্ষসী’ হিসেবে যাতুধান্যর সত্তা দেবশত্রু শক্তির প্রতিরূপ। তিনি ঔষধি বা স্ত্রীলোক বোঝাতে যাতুধান্য শব্দ ব্যবহার করেননি।
🔘মহীধরভাষ্য—
“সর্বা যাতুধান্যঃ… পরাসুভ ক্ষিপ”
হে রুদ্র, তুমি যেন সমস্ত যাতুধান্য রাক্ষসীকে দূর করে দাও।
“অধরাচীঃ” অর্থে— ‘অধরঞ্চনাঃ’
অর্থাৎ নিচগামী, অধঃপতিত আচরণবিশিষ্টা”।
এই সকল রাক্ষসী প্রকৃতির শক্তিকে তিনি অধোগতিগামী, নিচ প্রকৃতির শক্তি বলে চিহ্নিত করেন।
মহীধর ‘যাতুধান্য’কে স্পষ্টভাবে অধোগতিগামী রাক্ষসী হিসেবে চিহ্নিত করেন।
এখানে ঔষধি বা নারী নয়, বরং অশুভ অস্তিত্বকে বোঝানো হয়েছে যারা “অস্মভ্যঃ দূরিকুরু” আমাদের থেকে দূর করো।
অনার্যদের যে দাবি “এটা কেবল চিকিৎসার পরামর্শমাত্র” তা মিথ্যা, কারণ—
এখানে কোন ভেষজ বা চিকিৎসা পদ্ধতির আলোচনা নেই। বলা হয়েছে— “সমস্ত জগৎকে রোগমুক্ত করো”, “রাক্ষস ধ্বংস করো”, “বিষধর সাপকে দূর করো”এসব কার্যে ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কেউ সক্ষম নয়।
ভাষ্যকাররাও এই রুদ্রকে সাধারণ মানুষ নয়, বরং সর্বোচ্চ ঈশ্বর বলেছেন।
অতএব, এই মন্ত্রে বর্ণিত রুদ্র ঈশ্বরস্বরূপ সর্বজ্ঞ ভিষক্, যিনি রোগমুক্তি ও অপদেবতা বিনাশের দেবতা, তিনিই শিব।
যদি ‘যাতুধান্যঃ’ শব্দটি কেবল কোনও রোগদায়িনী নারী বোঝাত, তাহলে যাস্কাচার্য ও অমরকোষ কেন এর ব্যুৎপত্তি রাক্ষস বা অপদেবতার সঙ্গে যুক্ত করেছেন?
ভাষ্যকার উবট ও মহীধর উভয়ে যাকে ‘রাক্ষসী’, ‘অধরাচী’, ‘অধঃপতিত শক্তি’ বলছেন, তা কি কেবল ভেষজ বা স্ত্রীলোক বোঝাতে ব্যবহার করা যেতে পারে?
❌অনার্যদের দাবী— উব্বট ও মহীধর এই মন্ত্রে রুদ্রকে বৈদ্যরূপে দেখিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা চাপানো আসলে মন্ত্রটি শারীরিক চিকিৎসা ও রোগনাশক পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক পরামর্শমাত্র।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— ভাষ্যকারদের কাজই হল মন্ত্রের প্রকৃত ব্যুৎপত্তি, প্রসঙ্গ, এবং শব্দার্থ বিশ্লেষণ করে শাস্ত্রসঙ্গত ব্যাখ্যা দেওয়া। তাঁরা যদি রুদ্রকে ‘ঈশ্বর’, ‘ভগবান্’, ‘ঐশ্বর্যেন বক্তা’, ‘রাক্ষসী বিনাশক’ রূপে ব্যাখ্যা করেন, তবে তা “চাপানো” নয়, বরং মন্ত্রের প্রকৃত ঐতিহ্য এবং অর্থানুগত অভিপ্রায়। শতরুদ্রীয় অংশ নিজেই রুদ্রকে শতরূপে পূজ্য ঈশ্বর রূপে বর্ণনা করে। একে নিছক বৈজ্ঞানিক পরামর্শ বলা নিছক বিভ্রান্তিকর ও ভাষ্যকারদের প্রতি অপমানস্বরূপ।
🔘ভাষ্যকারের বক্তব্য সরাসরি ঈশ্বররূপ রুদ্র বোঝায়, রূপক নয়—
উব্বট বলেন—
“অধি-বাদতু ব্রবীতু কঞ্চিত্ স্বকীয়ং পুরুষং ভগবান্ রুদ্রঃ । অধি বক্তা ঐশ্বর্যেণৈব…”
এই কথায় স্পষ্ট বলা হয়েছে “ভগবান্ রুদ্রঃ”, অর্থাৎ "রুদ্রই ভগবান", তিনি “ঐশ্বর্যেণ অধি বক্তা”, মানে তিনি ঈশ্বরত্ব দিয়ে আদেশদাতা। এই বক্তব্য কোনও রূপক বা প্রতীক নয়, সরাসরি ঈশ্বরসত্ত্বা স্বরূপ রুদ্রকেই বোঝায়।
🔘‘ভিষক্’ শব্দটি সাধারণ মানব চিকিৎসক নয়, ঈশ্বর-রূপ মহাভিষক্—
মহীধর বলেন—
“ভিষক্ রোগনাশকঃ স্মরণেনৈব রোগনাশাদ্…”
অর্থাৎ, “ভিষক্” মানে এমন রোগনাশক যিনি মাত্র স্মরণমাত্রে রোগ হরণ করেন।
এই ধরনের ক্ষমতা কোনও মানব চিকিৎসকের নয়, শুধুমাত্র ঈশ্বরসত্ত্বা শিবের।
সাধারণ বৈদ্য ওষুধ দিয়ে ধীরে রোগ দূর করেন।
কিন্তু, মন্ত্রে বলা হয়েছে স্মরণ করলেই রোগ দূর হয়।
অতএব, এটা আধ্যাত্মিক ঈশ্বররূপ ভিষক্, শারীরিক চিকিৎসক নয়।
🔘যে রুদ্র 'অধিবক্তা', তিনি 'ঈশ্বর' উব্বটের ভাষ্যে স্পষ্ট—
উব্বট স্পষ্ট লেখেন—
“অধি-বাদতু ঈশ্বরো বক্তা”
এখানে “অধি-বাদতু” মানে ঈশ্বররূপ বক্তা, যিনি অন্যদের উপর কর্তৃত্ব করে বলেন, সেই ব্যক্তি একমাত্র ঈশ্বর হতে পারেন।
❌অনার্যদের ভুল— তাঁরা ধরে নিয়েছেন “অধি বক্তা” শব্দ মানে একজন জ্ঞানী চিকিৎসক।
✅কিন্তু, ভাষ্যকার বলছেন, অধিবক্তা অর্থাৎ “ঈশ্বরো বক্তা”।
অতএব, মন্ত্রের অভিপ্রায় শারীরিক চিকিৎসক নয়, বরং ঐশ্বরিক চিকিৎসক, যিনি অধিষ্ঠাতা রূপে আদেশ দেন।
🔘‘অহীন্’, ‘যাতুধান্যঃ’, ‘অধরাচীঃ’ সব রাক্ষস-ভূত ইত্যাদি নির্দেশ করে—
মন্ত্রে রয়েছে—
“অহিংশ্চ সর্বাঞ্ জম্ভয়ৎ, সর্বাশ্চ যাতুধান্যোঃ অধরাচীঃ পরাসুভ।”
এই সব পদ “অহী”, “যাতুধান্য”, “অধরাচী” রাক্ষস, দানব, নিচচর অপদেবতা নির্দেশ করে।
উব্বট ও মহীধর দুজনেই একে রাক্ষসী, সর্প, রোগকারক শক্তি, অপদেবতা অর্থে নিয়েছেন।
প্রশ্ন হল— এক মানব চিকিৎসক কি রাক্ষসী, দানব, অপদেবতা, ভূত ইত্যাদি নাশ করতে পারে?
উত্তর— না। একমাত্র ঈশ্বরের পক্ষেই সম্ভব “জম্ভয়ান্” (ধ্বংস করা) এই অপশক্তিকে।
অতএব, মন্ত্র কেবল শারীরিক চিকিৎসা নয়, বরং আধ্যাত্মিক রোগ ও অপশক্তি বিনাশকারী ঈশ্বর শিবকে উদ্দেশ করে।
🔘ভাষ্যকারদের ব্যাখ্যা "চাপানো" নয়, বরং পঠন ও প্রসঙ্গ অনুসারে সঙ্গত—
অনার্যরা বলেন, ভাষ্যকাররা নিজে থেকে ঈশ্বরত্ব “চাপিয়ে” দিয়েছেন। কিন্তু এটি একটি বিভ্রান্তি।
কারণ—
ভাষ্যকারদের কাজই হল মন্ত্রের অভিপ্রায়, ধাতু, উপপদ, এবং প্রসঙ্গ অনুসারে নির্ভুল ব্যাখ্যা প্রদান।
উব্বট ও মহীধর বৈদিক মন্ত্রের ব্যাকরণ ও প্রসঙ্গ মেনেই বলেন রুদ্র = ভগবান ঈশ্বর, ভিষক্ = রোগনাশক শিব।
তার উপরে এই শ্লোকটি "শতরুদ্রীয়" অংশের অন্তর্গত, যেখানে রুদ্রকে শতাধিক রূপে (গিরিশ, ভিষক্, পশুপতি, শঙ্কর, শিব ইত্যাদি) উল্লেখ করা হয়েছে যা ঈশ্বররূপে পরিপূর্ণ বর্ণনা।
🛑 এই প্রেক্ষিতে রুদ্রকে কেবল এক "ওষুধ-বিশারদ চিকিৎসক" বলা ভাষ্য, প্রসঙ্গ ও বাকি মন্ত্রসমূহ সমগ্রভাবে অবজ্ঞা করা। এবং তা ভাষ্যকারদের ন্যায্য ব্যাখ্যাকে “চাপানো” বলে ভ্রান্ত অপবাদ দেওয়া।
🔘অতএব, “অধ্যবোচৎ”, “ভিষক্”, “জম্ভয়ত্”, “অধরাচীঃ”, “অহীন্”, “যাতুধান্যঃ” প্রভৃতি পদ দ্বারা রূপক নয়, বরং সরাসরি ঈশ্বর শিবকেই বোঝানো হয়েছে।
“ভগবান রুদ্র”, “ঐশ্বর্যেণ বক্তা”, “স্মরণমাত্রে রোগনাশক”, “রাক্ষসী বিনাশকারী” এই সব গুণ মানব চিকিৎসকের নয়, একমাত্র ঈশ্বররূপ ভিষকের।
উব্বট-মহীধরের ব্যাখ্যা “চাপানো” নয়, বরং ভাষ্য, প্রসঙ্গ, ব্যাকরণ, এবং পদ্ধতিগত ধর্মপাঠ অনুযায়ী সম্পূর্ণ যুক্তিপূর্ণ ও শাস্ত্রসম্মত।
অনার্যদের দাবীই ভ্রান্ত, অপভাষ্য, এবং শৈবমন্ত্রের প্রকৃত গাম্ভীর্য ও ঈশ্বরত্বকে অবজ্ঞা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
যদি উবট ও মহীধরের ব্যাখ্যা “ব্যক্তিগত চাপানো অর্থ” হয়, তাহলে তাঁরা কেন ব্যাকরণ, নিরুক্ত ও ঋগ্বৈদিক প্রসঙ্গ ধরে শাব্দিক বিশ্লেষণে ঈশ্বররূপ রুদ্রের উপস্থাপন করেন?
শতরুদ্রীয় অংশে যেখানে রুদ্রের শতাধিক ঈশ্বরীয় রূপ বর্ণিত, সেখানে ভিষক্ রূপে রুদ্রকে কেবল একজন মানব চিকিৎসক বলা কি পুরো অংশটির সার্বিক ঈশ্বরত্বের প্রতি অবজ্ঞা নয়?
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী —
অসৌ যস্তাস্রোহঅরুণহউত বদ্রুঃ সুমঙ্গলঃ।
যে চৈনং রুদ্রাহভিতো দিক্ষু শ্রিতাঃ সহস্রশোহবৈষাং হেডহইমহে৷৷৬৷৷
ভাষ্যার্থঃ হে প্রজাস্থ মনুষ্যো! (যঃ) যে (অসৌ) তিনি (তাপ্রঃ) তাম্রবৎ দৃঢ়াঙ্গ যুক্ত (হেডঃ) শত্রুর অনাদর কারী (অরুণঃ) সুন্দর গৌরাঙ্গ (বভূঃ) কিঞ্চিত হলুদ বা ধূমেলা বর্ণযুক্ত (উত) এবং (সুমঙ্গলঃ) সুন্দর কল্যাণকারী রাজা হও (চ) এবং (যে) যে (সহস্রশঃ) হাজার (রুদ্রাঃ) দুষ্ট কর্ম কারী কে রোদনকারী (অভিতঃ) চোর এবং (দিক্ষু) পূর্বাদি দিশাতে (এনম্) এই রাজার (শ্রিতাঃ) আশ্রয়ে অবস্থান করো (এষাম) এই বীরের আশ্রয় নিয়ে আমরা (অবেমহে) বিরুদ্ধাচরণের ইচ্ছা করি না।
নোটঃ উব্বট মহিধর মন্ত্র কে সূর্যপক্ষে লাগিয়েছেন এবং অর্থ করেছেন "আদিত্যরূপেন রুদ্রঃ স্তুয়তে.... কিরণরূপেন সহস্রসংখ্যাঃ এষাং হেডঃ ক্রোধমস্পদপরাধজং বয়মের ঈমহে নিবারয়ামঃ ভক্ত্যা নিরাকুৰ্ম্মঃ।" অর্থাৎ রুদ্ররূপ সূর্য্য কে স্তুতি করি। সহস্রসংখ্যক যে কীরণ রয়েছে তাহাকে স্তুতি করি এবং তাহার ক্রোধ আমরা ভক্তি দিয়ে করি। এখানে মহিধর জড় সূর্যাদির উপাসনার তথা ভক্তির ঈঙ্গিত করেছেন নিজ কল্পনা বশতঃ।
❌অনার্যদের দাবী— এই মন্ত্রে “রুদ্র” বলতে কোনো নির্দিষ্ট দেবতা বোঝানো হয়নি; বরং সমাজের কোনো সাধারণ রাজা বা প্রশাসক ব্যক্তি বোঝানো হয়েছে যিনি শত্রুদের দমন করেন।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— প্রথমত, শতরুদ্রীয় সম্পূর্ণ অধ্যায়টি পরমেশ্বর শিবের প্রতিইই সমর্পিত যা শুরুতেই কারণ সহ ব্যাখ্যা করে বলেছি। তাই বারংবার, পরমেশ্বর শিবকে সাধারণ রাজা বানানো মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই নয়। কেবল খণ্ডিতাংশ কিছু শ্লোকের ভুল ব্যাখ্যা করে সম্পূর্ণ অধ্যায়ের মূল অর্থকে পরিবর্তন করা যাবে না। কেননা, যিনি জগতের পতি, স্রষ্টা, পালক, লয়কর্তা তিনি সাধারণ কোনো রাজা হতেই পারেন না। কিসের সাথে কার তুলনা দেয় সেটাও এই মূর্খ অনার্যরা জানেনা। শ্রুতি তে আছে
-
"ন তস্য প্রতিমা অস্তি যস্য নাম মহদযশঃ | " (শুক্ল-যজুর্বেদ/ বাজসনেয়ী সংঃ/৩২/৩)
মহীধর- উবট ভাষ্য - “ তস্য পুরুষস্য “প্রতিমা প্রতিমানমুপমানং কি়ঞ্চিদ্বস্তু নাস্তি ... ।"
ব্রহ্মের সাথে কারো তুলনা বা উপমান সম্ভব নয়।
যেখানে রুদ্রকে বিশেষ দৈবগুণে বিশেষায়িত করেছে, যে রুদ্রের দর্শনে জীব মুক্তি লাভ করে, যিনি অখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নায়ক, যিনি সকল দেবতা ও জীবের হৃদয়ে আত্মরূপে অবস্থান করেন, যিনি সকল কিছুর স্বরূপে অবস্থান করেন ব্রহ্মাদি দেবতা থেকে কীট পর্যন্ত, যিনি ত্রিনয়নধারী, কৈলাসনিবাসী, নীলকণ্ঠ, জটাজুটধারী, চর্মপরিহিত, উমাসহিত, পিনাকী, পরম বৈদ্য সেই পরমেশ্বর রুদ্রের তুলনা করছে একজন সাধারণ রাজার সাথে! এটা কি হাস্যকর নয়? একজন রাজা কীভাবে সমগ্র জগতের পালক হবে? একজন রাজা কীভাবে, জীবের হৃদয়ে আত্মরূপে অবস্থান করবে? এসব কি সাধারণ রাজার পক্ষে সম্ভব? তাই এখানে যজুর্বেদের ১৬ অধ্যায় (শতরুদ্রিয়) সম্পূর্ণ মন্থন করে যে রুদ্রের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তিনি পরমেশ্বর যিনি সাকারে উমার পতি, ত্রিনেত্রধারী, নীলকন্ঠ, জটাজুটধারী, পিণাকী, কৃত্তিবাসা, কৈলাসনিবাসী সদাশিবই। তাই অনার্যদের ব্যাখ্যা শ্রুতির বিপরীতে যাওয়া জন্য তা অমান্য ঘোষণা করে হলো। যেহেতু ব্রহ্মের সাথে কারো তুলনা সম্ভব নয় তাই, কোনো রাজার তুলনাও পরমেশ্বর রুদ্রের সাথে হতেই পারেনা। তাই শ্রুতি ও আচার্য ভাষ্য অনুযায়ী অনার্যদের দাবী এখানেই খণ্ডিত হয়। এবার দেখবো উক্ত শ্লোকের ভাষ্যে ভাষ্যকাররা কি বলে।
🔘উবট ভাষ্য—
“অসৌ যঃ… আদিত্যরূপেণাত্র রুদ্রঃ স্তূয়তে।”
অর্থাৎ, এই মন্ত্রে ‘অসৌ’ যিনি সূর্যরূপে দৃশ্যমান, তিনিই রুদ্র দেবতা। তাঁকে সূর্যদেবের মতো উজ্জ্বল, সর্বত্র বিরাজমান, দেবরূপেই স্তব করা হচ্ছে, কোনো মানবীয় শাসক নয়।
🔘মহীধর ভাষ্য—
“রুদ্ৰো রবিরূপঃ” অর্থাৎ রুদ্র সূর্যের রূপে প্রকাশিত, কিন্তু তিনি দ্যুতি-সম্পন্ন ঈশ্বর, “সর্বমঙ্গলপ্রবর্তক”।
এছাড়াও, রুদ্রের হাজার রশ্মিরূপ বিস্তার, সৌর আভা ও ক্রোধ প্রশমনের জন্য ভক্তি সহকারে স্তব করা, এসব কিছুই প্রমাণ করে, এটি কোনো পার্থিব রাজা নয়, বরং সর্বময় ঈশ্বররূপ দেবতা।
যদি এখানে একজন সাধারণ শাসক বোঝানো হতো, তবে কেন তাঁকে সূর্যরূপে, হাজার রশ্মির অধিকারী বলা হতো?
আর সেই শাসকের ‘ক্রোধ প্রশমনে’ কেন ভক্তি সহকারে প্রার্থনা করতে হবে?
❌অনার্যদের দাবী— “সহস্রশঃ রুদ্রাঃ” শব্দগুচ্ছ দ্বারা কোনো অলৌকিক বা দেবতাত্মা বোঝানো হয়নি, এটি কেবল বহুসংখ্যক সেনাপতি বা সৈনিক নির্দেশ করে যারা এই রাজাকে চারদিকে রক্ষা করে।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— ‘সহস্র’ শব্দটি বেদে বহুবার ‘অনন্ত’, ‘সংখ্যাতীত’ অর্থে এসেছে, সংখ্যার পরিমাণ নয়, বরং সর্বব্যাপ্তির ইঙ্গিতে। আবার ‘রুদ্র’ যদি সৈনিক হয়, তাহলে তাদের কেন ‘রশ্মিরূপ’ বলা হলো? সেনাপতিরা কি রশ্মিরূপে দশদিকে বিস্তৃত হতে পারে? ভাষ্যকার উবট-মহীধর এমনকি "রশ্ময়ঃ" ও "সহস্রশঃ" দ্বারা সূর্যতেজ-নির্গত দেবত্ব-সম্পন্ন রূপ বুঝিয়েছেন। এতে এক অলৌকিকত্ব ও ঐশ্বরিক ব্যাপ্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে যা পার্থিব সৈনিক বা মানুষের সঙ্গে খাটে না।
🔘উবট বলেন —
“য়ে চ এনং ভগবন্তম্ আদিত্যং রুদ্রাঃ রশ্ময়ঃ।”
অর্থাৎ এই ‘রুদ্র’-এর রশ্মিরূপেই রুদ্রগণ সর্বদিকে বিস্তৃত। “সহস্রশঃ” শব্দটি এখানে দ্যুতির রূপে অসংখ্য রশ্মি বোঝাতে ব্যবহৃত, যা শুধুই ঈশ্বরের বেলাতেই খাটে।
🔘মহীধর বলেন —
“সহস্রশোঽসংখ্য্যাঃ”
সংখ্যাতীত রশ্মিরূপ রুদ্রগণ চারদিকের দিক্দিগন্তে বিস্তৃত।
সুতরাং, এখানে “সহস্র রুদ্র” মানে বহু সৈনিক নয়, বরং এক রুদ্রের সহস্র প্রভাময় রূপ।
এটি আধ্যাত্মিক বহুরূপতা, মানবিক বহুসংখ্যা নয়।
যদি এগুলো সৈনিক হতো, তবে তাদের “রশ্ময়ঃ” বা আলোরূপ বলার অর্থ কী?
কেন তাদের “সুমঙ্গলঃ” বলা হচ্ছে, যা বরাবরই ঈশ্বরের জন্য ব্যবহৃত?
❌অনার্যদের দাবী— ভাষ্যকারগণ (উব্বট, মহীধর) এই মন্ত্রকে “সূর্যরূপ রুদ্র” বা “আদিত্যরূপ রুদ্র” ব্যাখ্যা করে আসলে জড়-তত্ত্ব বা দৃশ্য সূর্যের উপাসনার ভেতর দেবত্ব আরোপ করেছেন, যা আসলে বেদের আসল উদ্দেশ্য নয় বরং পরবর্তী কল্পনা।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— বেদের দৃষ্টিতে সূর্য কেবল একটি জড় বস্তু নয়, এটি ব্রহ্মতত্ত্বের এক দ্যুতিমান প্রকাশরূপ। “আদিত্যরূপে রুদ্র” বলা মানে সূর্যের রূপে প্রকাশিত এক সত্তা যিনি দিব্যচেতন, যাঁর দ্বারা আলো, তেজ, জীবন, মঙ্গল প্রকাশ পায়। বেদে সূর্য কখনোই একান্তভাবে জড় বস্তু হিসেবে বিবেচিত হয়নি। যাঁকে “ভগবন্তম্” বলা হয় এবং যাঁর রশ্মিরূপে সহস্রগুণ প্রকাশ ঘটে, তিনি কেবল ভক্তিভাজ্য দেবতাই হতে পারেন, জড় নয়।
🔘উবট বলেন —
“রুদ্রঃ … রশ্মিরূপে সহস্রশঃ … হেড ঈমহে”
রুদ্র সূর্য হলেও তা কেবল বাহ্য সূর্য নয়, সেইরূপে তিনি ঈশ্বরস্বরূপ ও ক্রোধশমক দেবতা।
🔘মহীধর বলেন —
“রুদ্রঃ রবি রূপে সর্বমঙ্গলপ্রবর্তক”
সূর্যরূপ রুদ্র দৃষ্ট সূর্য নয়, বরং ঐশ্বরিক শক্তির বাহক।
এছাড়া, “ভক্ত্যা নিরাকুর্মঃ”এই ভক্তির ভাব জড় সূর্যের উদ্দেশ্যে হয় না। এটি একমাত্র ঈশ্বরের প্রতি সম্ভাব।
যদি এটি কেবল সূর্যপূজা হতো, তবে ভাষ্যকাররা “রুদ্রঃ”, “ভগবন্তম্”, “ভক্ত্যা” ইত্যাদি ঈশ্বরবাচক শব্দ ব্যবহার করতেন কেন?
সহস্রশঃ রশ্মির “ক্রোধ” কে প্রশমনের প্রার্থনা এটা জড় বস্তুর ক্ষেত্রে কিভাবে খাটে?
❌অনার্যদের দাবী— মন্ত্রে “হেডঃ”ও “সুমঙ্গলঃ” ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে রাজনৈতিক বা সামাজিক চরিত্রের (যেমন- শাসক, রাজা, সেনাপতি) গুণগান করা হয়েছে, এটি কোনো ঈশ্বরের স্তোত্র নয়।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— ‘সুমঙ্গল’ শব্দটি ঐতিহাসিক ও শ্রুতিসম্মতভাবে সর্বদা ঈশ্বরের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, যিনি সমস্ত মঙ্গলের আধার। রাজা বা সাধারণ শাসক নিজেই তো মঙ্গলের জন্য প্রার্থনার পাত্র, তিনি কখনো ‘সর্বমঙ্গলপ্রবর্তক’ নন। তেমনি ‘হেডঃ’ শব্দটি যদি রাজার রাগ বোঝাত, তাহলে ভক্তিভাবে তা প্রশমনের আকুতি কেন থাকবে? ভক্তি-সহিত ক্রোধ প্রশমন একমাত্র ঈশ্বরের ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য। সুতরাং এই শব্দগুলো ঈশ্বরীয় গুণ ও অবস্থার ইঙ্গিতবাহী, মানবীয় নয়।
🔘উবট বলেন —
“সুমঙ্গলঃ- শোভনানি মঙ্গলান্যস্য ইতি।”
অর্থাৎ যাঁর দ্বারা সমস্ত মঙ্গল বা কল্যাণ হয়, তিনি সুমঙ্গল রুদ্র, এটি রাজার গুণ নয়, সর্বময় স্রষ্টার গুণ।
🔘মহীধর বলেন —
“সুমঙ্গলঃ- রব্যুদয়ে সর্বমঙ্গলপ্রবর্তনাত্”
তিনি যেহেতু সূর্যরূপে প্রভা দান করেন, তাই বিশ্বমঙ্গল ঘটান। শাসক তো নিজেই মঙ্গলের জন্য প্রার্থনার মুখাপেক্ষী!
রাজার জন্য “সর্বমঙ্গলপ্রবর্তক” উপাধি কি বাস্তবে যুক্তিযুক্ত?
আর "হেড" বা ক্রোধ যদি মানবীয় হতো, তাহলে ভক্তি দিয়ে তার প্রশমন করার প্রার্থনা করা হতো কেন?
❌অনার্যদের দাবী— “অসৌ”, “রুদ্র”, “অভিতঃ দিক্ষু শ্রিতাঃ” ইত্যাদি শব্দাবলীকে দেবভাব দিয়ে দেখার কোনো কারণ নেই, কারণ তা বহুবচন ও মানবীয় পরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অতএব, একে শিব বা সর্বেশ্বর রুদ্র বলার সুযোগ নেই।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— “অসৌ” শব্দটি নির্দেশবাচক বিশেষ্য, অর্থাৎ ঐ নির্দিষ্ট, দৃশ্যমান কিন্তু অলৌকিকভাবে গুণান্বিত এক সত্তা। “অভিতঃ দিক্ষু শ্রিতাঃ” অর্থাৎ চতুর্দিকে ব্যাপ্ত, যা ঈশ্বরের এক স্বীকৃত বৈশিষ্ট্য। যদি তিনি চতুর্দিকে সহস্ররূপে অবস্থান করেন, তবে তিনি সাধারণ মানুষ নন, বরং সর্বব্যাপী দেবসত্তা। ভাষ্যকারগণ এমনকি রুদ্রের বহু রূপ, বহু রশ্মি, বহু গুণ, সর্বমঙ্গলরূপ ইত্যাদি গুণাবলির মাধ্যমে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, এই রুদ্র কোনো মানবরাজা নন, তিনি শাশ্বত সর্বেশ্বর।
🔘উবট ভাষ্যে রুদ্রকে রশ্মিরূপ সূর্য হিসেবে বলেন এবং ব্যাখ্যা করেন—
“অভিতঃ দিক্ষু শ্রিতাঃ - সর্বদিকে সহস্র রশ্মি।”
এটি মানবসামর্থ্য নয়, এটি ঈশ্বরীয় সর্বব্যাপিতা।
🔘মহীধর বলেন —
“সর্বদিক্ প্রাচ্য থেকে পশ্চিম সর্বত্র রুদ্রগণের উপস্থিতি” এটা স্বাভাবিক মানুষ বা রাজা হতে পারে না।
আর "অসৌ" (উল্লেখযোগ্য সেইজন) এবং “সুমঙ্গলঃ” সর্বত্র বিরাজমান সেই রুদ্রকেই বোঝায় যাঁর বহু রূপ আছে—
“অনেকানি হি রূপাণি রুদ্রঃ করোতি কার্যবশাত্” (উবট)
কোনো মানব বা রাজা কি নিজেকে হাজার রশ্মি বা বহু রূপে রূপান্তর করতে পারে?
“অসৌ” শব্দ দ্বারা বারবার একই রুদ্রের গুণগান করা হলে, তাকে কেন দেবতা ভাবা হবে না?
🔘যজুর্বেদের শতরুদ্রীয় অধ্যায়ের ষোড়শ অধ্যায়ের ষষ্ঠ মন্ত্র (১৬.৬) নিয়ে অনার্যপক্ষের দাবি ছিল যে— “এটি কোনো ঈশ্বরের স্তোত্র নয় বরং কোনো মানব রাজা ও তার সেনাবাহিনীর প্রশংসা।” কিন্তু মন্ত্রের ভাষ্য, শব্দার্থ, ব্যাকরণ, প্রেক্ষিত ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এ দাবি সম্পূর্ণ অসার, শাস্ত্রবিরোধী এবং প্রমাণহীন কল্পনার ফল।
মন্ত্রে যাঁর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তিনি একজন “অসৌ রুদ্রঃ” অর্থাৎ রুদ্র নামক এক নির্দিষ্ট পরমেশ্বর, যিনি সূর্যরূপে প্রকাশিত, যাঁর সহস্র রশ্মিরূপ বিস্তার রয়েছে, যাঁকে “সুমঙ্গলঃ” বলা হয়েছে, যাঁর ক্রোধ প্রশমন করতে ভক্তি সহকারে প্রার্থনা করতে হয়।
উবট ও মহীধরের ভাষ্য উভয়ই এককথায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এই রুদ্র কোনো মানব রাজা নয়, বরং সূর্যরূপে প্রকাশিত দেবতা, যিনি সর্বত্র বিরাজমান এবং সর্বমঙ্গলপ্রবর্তক। “সহস্রশঃ রশ্ময়ঃ”, “ভগবন্তম্”, “ভক্ত্যা ঈমহে” এই সব শব্দ ও বচন কেবল ঈশ্বরের ক্ষেত্রেই খাটে, সাধারণ রাজার ক্ষেত্রে নয়।
অনার্যদের যে সকল যুক্তি ছিল যেমন —
"সহস্র রুদ্র" মানে সৈন্য, রুদ্র মানে রাজা, সূর্যরূপ মানে দৃশ্যমান জড় বস্তু, এসবই শাস্ত্র, ভাষ্য এবং ঈশ্বরতত্ত্বের পরিপন্থী।
একজন সাধারণ রাজার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়—
সহস্র রশ্মিরূপে দ্যুতি ছড়ানো, সর্বদিক ব্যপী হওয়া, ভক্তির মাধ্যমে ক্রোধ প্রশমন, সর্বমঙ্গল প্রবর্তন করা, বহু রূপ ধারণ করা, সূর্যরূপে প্রকাশ পাওয়া।
এইসব বৈশিষ্ট্য কেবল একজন সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরেরই হতে পারে, যিনি রুদ্র, শিব।
🔘সুতরাং, বলা যায়— যজুর্বেদ ১৬.৬ মন্ত্রে বর্ণিত রুদ্র কোনো পার্থিব রাজা, সেনানায়ক বা সামাজিক ব্যক্তিত্ব নন, তিনি পরমেশ্বর শিব, যিনি সূর্যরূপে প্রকাশিত, সহস্র রশ্মিরূপে বিরাজমান, ভক্তির দ্বারা যাঁর ক্রোধ প্রশমিত হয়, যিনি সর্বমঙ্গল দানকারী এবং শ্রুতির ভাষায় “ভগবন্তম্ রুদ্রম্”।
অনার্যদের প্রতিটি ব্যাখ্যা এখানে শাস্ত্র, ভাষ্য ও যুক্তি দ্বারা পরিপূর্ণরূপে খণ্ডিত।
অতএব, শৈব ঐতিহ্য ও বৈদিক শ্রুতি অনুযায়ী, এই মন্ত্র শিবের স্তোত্র, এবং একে সাধারণ রাজা বা জড় সূর্য হিসাবে মানা শাস্ত্রবিরোধী, যুক্তিহীন এবং প্রত্যাখ্যাত।
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী—
অসৌ যোেহবসর্পতি নীলগ্রীব বিলোহিত।
উতৈনং গোপাহঅদশ্রন্নুদাহ্যঃ স দৃষ্ট মূডয়াতি নঃ।।৭।।
পদার্থঃ (যঃ) যে (অসৌ) তিনি (নীলগ্রীবঃ) নীলমণির মালা পরিহিতা (বিলোহিতঃ) বিবিধ প্রকারের শুভ, গুণ, কর্ম এবং স্বভাব দ্বারা যুক্ত (রুদ্রঃ) শত্রুর হিংসক সেনাপতি (অবসর্পতি) দুষ্ট থেকে বিরুদ্ধ চলেন। যেই (এনম্) ইহাকে (গোপাঃ) রক্ষক ভৃত্য (অদৃশ্রন) দেখে (উত) এবং (উদহার্য্যঃ) জল আনয়নকারী স্ত্রী (অদৃশ্রন) দেখে (সঃ) সেই সেনাপতি (দৃষ্টঃ) দৃষ্টি দিয়ে (নঃ) আমাদের সব ধার্মিক কে (মৃডয়াতি) সুখি করেন।
নোটঃ পৌরাণিকরা এই মন্ত্রে নীল কন্ঠের সহায়তা নিয়ে সমুদ্র মন্থন এবং শিবের বিষভক্ষনের কাহিনীর বেদে দেখানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এর খন্ডন করে উব্বটাচার্য্য লিখেছেন "নীলগ্রীব ইবাস্তং গচ্ছন্ লক্ষতে" অর্থাৎ সূর্য অস্ত হওয়ার সময় নীল কন্ঠের সমান প্রতীত হয়। সমুদ্র মন্থনের কারণে উত্থিত বিষ পানে যদি শিবের কন্ঠ নীল হয়েছে এরূপ তত্ত্ব হতো তাহলে উব্বট কেন সূর্যের নীল গ্রীব বললেন? পৌরাণিকদের একটা চিরন্তর অভ্যাস এই যে বেদে যদি তারা পুরাণের একটুও ইঙ্গিত পান সেটাকে একদম পৌরাণিক কাহিনী বানিয়ে ছাড়বে।
❌অনার্যদের দাবী— “নীলগ্রীব” মানে নীলমণির মালা পরিহিত ব্যক্তি।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— শব্দতত্ত্ব এবং বেদ-ভাষার ধ্বনিগত ও শাস্ত্রসম্মত ব্যাখ্যা অনুযায়ী, “নীলগ্রীব” শব্দটি কেবল অলংকার বা নীলমণির মালা বোঝায় এমন ভাবনা একেবারেই পাণ্ডিত্যহীন ও অপার্থক্যমূলক। নীল = কৃষ্ণ/শ্যামবর্ণ, আর গ্রীব = গলা বা কণ্ঠ এই অর্থ ভেদ করে “মণিমালা” অর্থ চাপানো যায় না, বিশেষত যেখানে বেদ ও ভাষ্যকার উভয়েই কণ্ঠবর্ণের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। একে অলঙ্কারবাচক করে তুললে মূল মন্ত্রের প্রতীকি শক্তিই ভেঙে পড়ে। মূল অর্থ বাদ দিয়ে অন্য অর্থ মেনে নেওয়া যায় না। বেদের যদি কেবল নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মেরই উল্লেখ হলো তবে এসব শ্রুতি প্রমাণ মিথ্যা হয়ে যাবে-
“কৈলাসশিখরাভাসা হিমবদিগরিসংস্থিতা |
নীলকণ্ঠং ত্রিনেত্রং চ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত ||২৫ |”
[ঋগবেদ/আশ্বলায়ন শাখা/১০/১৭১]
এখানে যে তত্ত্বের প্রতি মন সমর্পিত হতে বলেছে- তার স্বরূপ- তিনি হিমগিরি কৈলাস নিবাসী, নীলকণ্ঠ, তিনচোখ বিশিষ্ট যায়া সরাসরি শিবের বৈশিষ্ট্যকে প্রতিপাদিত করে। এবং আচার্যদেরও মান্যতা তাই। তাই সরাসরি মন্ত্রের অর্থকে পালটানো যায় না। আচার্যরা/ভাষ্যকাররা কেউই এমনে এমনে বেদের ভাষ্যকার হয়নি। তারা সকল শাস্ত্রকে মন্থন করে, গুরুকুলের শিক্ষা সম্পন্ন করে, গুরুর নির্দেশেই বেদ আদি শাস্ত্রের ভাষ্য করেছেন। যা, ১০০/১৫০ বছর আগে আসা স্বঘোষিত তথাকথিত মহর্ষির ভাষ্য দ্বারা খণ্ডানো যাবে না। প্রত্যেকটা পুরাণ, মহাভারত, রামায়ণ, শ্রুতি, তন্ত্র, আচার্যের ভাষ্য, শব্দকোষ অভিধান আপনারা নিজের স্বার্থের জন্য কতটা শাস্ত্রকে প্রক্ষিপ্ত বলবেন? মানে আমাদের আগের আচার্যরা সবাই ভুল পথে ছিলো তাই তো? তারা সবাই মূর্খ ছিলো তাই তো? আপনারা শ্রুতি একভাগ মানবেন অন্যভাগ মানবেন না, রামায়ণ/মহাভারতের কিছু অংশ মানবেন আবার কিছু মানবেন না, নিজেদের প্রয়োজনে পুরাণ ব্যবহার করবেন আবার ঐ পুরাণই মানবেন না, মানে আপনারা করতে চানটা কি? গিরগিটির মতো এতো রঙ বদলানো স্বভাব কেন আর্যসমাজীদের? আচ্ছা যাইহোক, প্রসঙ্গে আসা যাক।
🔘উব্বট (শ্লোক ৭)—
“নীলগ্রীবঃ নীলগ্রীব ইবাস্তং গচ্ছন্ লক্ষ্যতে।”
সূর্যের অস্তময় অবস্থাকে রূপকভাবে নীলকণ্ঠ রূপে বর্ণনা করেছেন। ‘গ্রীবা’ মানে গলা/কণ্ঠ; গহনা বা অলংকার নয়।
অর্থাৎ, সূর্য অস্ত যাচ্ছেন এমনভাবে যেন নীলগ্রীব রুদ্র গমন করছেন। এটি একটা উপমা মাত্র। অনার্যদের উপমা আর আক্ষরিক অর্থের পার্থক্য বোঝায় দরকার।
🔘মহীধর (শ্লোক ২৮)—
“বিষভক্ষণেন নীলা গ্রীবা কণ্ঠৈকদেশো ইয়স্য স নীলগ্রীবঃ।”
বিষপানে রুদ্রের কণ্ঠে যে নীলতা এসেছে, সেই কারণেই তাঁর উপাধি "নীলগ্রীব"।
“নীলগ্রীব” শব্দটি সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসারে নীল + গ্রীব (কণ্ঠ) গলা বা কণ্ঠের রং। এটি কখনোই অলংকার বা গহনার অর্থ বহন করে না। উপরন্তু, ভাষ্যকারদ্বয় (উব্বট-মহীধর) ব্যাখ্যা করেছেন যে, বিষপান বা সূর্যের অস্তকালীন বর্ণনাতেই নীলগ্রীবতার উপমা। ফলে অনার্যদের অলঙ্কারমূলক ব্যাখ্যা কেবল অনুমাননির্ভর ও ব্যাকরণবিরোধী।
অতএব, এটি রুদ্র/শিবের বৈশিষ্ট্যসূচক বিশেষণ, যা বেদেই রয়েছে। "নীলমণি" বা “মালা” এসব মনগড়া শব্দ ভাষ্যে নেই।
যদি “নীলগ্রীব” শব্দে “নীলমণির মালা” বোঝানো হতো, তবে “গ্রীব” শব্দের প্রচলিত অর্থ ‘গলা/কণ্ঠ’ (যা একাধিক শাস্ত্র ও আচার্য ভাষ্য দ্বারা সমর্থিত) পরিত্যাগ করে অলংকারকেই প্রধান ধরা কতটা যুক্তিসম্মত?
যখন ভাষ্যকার উব্বট ও মহীধর দু’জনেই কণ্ঠবর্ণ এবং বিষপানের ঐতিহাসিকতা তুলে ধরেছেন, তখন সেই ঐতিহ্যবাহী ব্যাখ্যা এড়িয়ে কল্পিত “মণিমালা” ব্যাখ্যার গ্রহণযোগ্যতা কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব?
❌অনার্যদের দাবী— “রুদ্র” মানে হিংস্র সেনাপতি বা সাধারণ যোদ্ধা, কোনো দেবতা নয়।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— “রুদ্র” শব্দটি বেদে ব্রহ্ম/দেবতা হিসেবে শত শত বার ব্যবহৃত হয়েছে, এবং তার স্বরূপ নির্ণয়ে বেদবেত্তারা বিস্তর আলোচনাও করেছেন, যা পূর্বের প্রমাণিত করা হয়েছে। একে কেবল “হিংস্র” বা “সেনাপতি”রূপে তুলে ধরলে তা শাস্ত্র ও শব্দার্থ উভয়েরই অপমান। বিশেষত যেখানে রুদ্র নিজেই “মৃডয়াতি নঃ” শান্তিদাতা রূপে চাহিত, সেখানে তাঁকে কেবল আঘাতকারী সেনানায়ক হিসেবে মানা নিছক পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব।
🔘উব্বট (শ্লোক ৮)—
“অথো অপিচ যে আস্য সত্বানঃ সত্বভূতা রুদ্রাঃ, অহং তেব্যঃ নমস্কারম্ করোমি।”
রুদ্রের ভৃত্যরাও বন্দনার যোগ্য, অর্থাৎ তিনি ঈশ্বররূপ দেবতা।
🔘মহীধর (শ্লোক ৭)—
“স রুদ্রঃ দৃষ্টঃ... অস্মান্ মৃডয়াতি সুখযতু।”
শুধু দর্শনেই সুখদান, যা কেবল দেবতাকেই মানায়, সাধারণ যোদ্ধাকে নয়।
‘রুদ্র’ শব্দটি একাধারে ক্রোধদর্শী, তপস্বী, এবং শাস্তিদাতা এক ব্রহ্মতত্ত্বকে বোঝায় যেমন বৈদিক সহস্রনাম বা ‘নমক’ সূত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি যিনি বিধ্বংস করেন অসুরকে, দয়া করেন ভক্তকে, তিনিই রুদ্র। উব্বট-মহীধরের ভাষ্যে রুদ্রকে সেনাপতি বলা তো দূরের কথা, বরং তাঁকে সর্বজীবের ঈশ্বররূপ, প্রার্থনার যোগ্য ও সর্বত্রব্যাপ্ত চৈতন্যসত্তা হিসেবে দেখানো হয়েছে।
“রুদ্রঃ মৃডয়াতি নঃ” এই বাক্যে যখন সরাসরি বলা হচ্ছে তিনি আমাদের সুখ দিন, তখন তিনি কেবল হিংস্র কি করে হতে পারেন? হিংস্র সেনাপতি কি কখনও দর্শনমাত্রে শান্তি ও সুখ দিতে পারে?
যখন “রুদ্র” শব্দটি শতাধিক স্থানে বেদে এবং শঙ্খ, আশ্বলায়ণ, যাস্ক প্রমুখ ঋষিদের দ্বারা দৈবতত্ত্ব বর্ণিত, তখন সেটিকে সেনানায়ক বলার জন্য কী শাস্ত্রসম্মত সংজ্ঞা বা প্রমাণ তারা দিতে পারেন?
❌অনার্যদের দাবী— “উতৈনং গোপা... অদৃশ্রন্” মানে সাধারণ রাখাল বা গোপীরা এই সেনাপতিকে দেখে।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— এই মন্ত্রাংশের শাব্দিক গঠন যতটা সরল, তার প্রতীকি গভীরতা ততটাই ব্যপক। “গোপা” ও “উদহার্য্য” এখানে কেবল সাধারণ মানুষ না, বরং প্রতীক, যারা প্রাত্যহিক জীবনে দেহের মধ্যস্থ সূক্ষ্মতত্ত্বকে উপলব্ধি করে না। এদের দ্বারা সূর্য/রুদ্রদর্শনের প্রতীক বলা হয়েছে। অথচ অনার্য ব্যাখ্যায় এদের শুধু রাখাল ও জলবাহক নারী হিসেবে দেখানো হচ্ছে, যা মন্ত্রের গূঢ়ার্থকে ভেঙে কেবল বাহ্যদৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ রাখছে।
🔘উব্বট (শ্লোক ৭)—
“গোপালাঃ অভিপশ্যন্তি গবাং প্রবেশনকালং মন্যমানাঃ।”
অস্তরাগ সূর্যকে রুদ্ররূপে দেখা হচ্ছে, রাখালের চোখে নয়, এটি লোকাচারভিত্তিক দেবদর্শন।
🔘মহীধর (শ্লোক ৭)—
“জলহারিণ্যো যোষিতো’প্যেনমদৃশ্রন্।”
ঘরে ফেরা সময়ে রুদ্ররূপ সূর্য দর্শিত হন, গোপ/গোপালাঃ মানে নির্দিষ্ট দেবদর্শনের উপলক্ষ্য।
এখানে 'গোপা' মানে কেবল রাখাল নয়; তা ব্যুৎপত্তি অনুসারে রক্ষক। তদ্ব্যতীত, সূর্য অস্ত কালে গোরা রাখালের চোখে যেমন পড়ে, তেমনি সাধারণ গৃহিণীরও তা দৃষ্টগোচর হয় একে উপমারূপে বলা হয়েছে, এটি দর্শনযোগ্যতা ও সর্বজনদর্শন বোঝায়, এবং ভাষ্যকারগণ তা স্পষ্ট করেছেন। কোনো সেনাপতির দেখায় আধ্যাত্মিক সুখ (মৃডয়াতি) হয় না।
গোপা” যদি কেবল রাখাল হয়, তবে ভাষ্যকার কেন বলছেন “গবাং প্রবেশনকালং মন্যমানাঃ” সূর্যাস্তের মুহূর্তে রুদ্রদর্শনের রূপক প্রতীক হিসাবে?
“গোপা” শব্দটির মূল ধাতু √গুপ্ (রক্ষা করা) এর সঙ্গে “রক্ষক”-এর মতো সূক্ষ্ম অর্থ থাকা সত্ত্বেও কেবল বাহ্যিক পল্লী রাখালের অর্থে সীমাবদ্ধ করাটাই কি যথার্থ?
❌অনার্যদের দাবী— “মৃডয়াতি” এখানে কোনো অলৌকিক আশীর্বাদ বা শান্তিদান বোঝায় না, বরং সাধারণ সেনাপতির দয়া বোঝায়।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— বেদে “মৃড” ধাতুর অর্থ ‘সুখ দান’, ‘অনুগ্রহ করা’, ‘রক্ষা করা’ এইসব গুণ। রুদ্রের প্রতি এই আবেদন তিনি যেন মৃডয়াতি নঃ আমাদের শান্তি দেন। এটি বৈদিক ভাষ্যকারগণও ঐরূপই ব্যাখ্যা করেছেন। একে সাধারণ সেনাপতির সাময়িক দয়া বলে ধরলে বেদীয় দেবতাত্মক অনুভব ও চেতনার অবমাননা ঘটে। এখানে ঈশ্বরীয় করুণার আকুতি রয়েছে, রণনায়কের তোষ নয়।
🔘উব্বট (শ্লোক ৭)—
“মৃড্ সুখতে’ সুখয়তি।”
রুদ্র দর্শনে আধ্যাত্মিক শান্তি বা সুখ লাভ হয়।
🔘মহীধর (শ্লোক ৭)—
“সুখং করোতি ইত্যর্থঃ।”
‘মৃড’ ধাতু থেকে এসেছে 'মৃডয়াতি', যার অর্থ সুখ প্রদান করা, যা দেবতাকেই মানায়।
‘মৃড’ ধাতু মানেই ‘সুখ দান’। এই রকম আশীর্বাদ বা কৃপা সেনাপতি বা হিংস্র ব্যক্তি দিতে পারেন না।
রুদ্র দর্শনে কেবল ভক্তিই নয়, দর্শনমাত্রে মোক্ষসদৃশ শান্তি ও কৃপা লাভ হয়, এটি নৈর্ব্যক্তিক শাস্ত্রীয় ফল, এবং ভাষ্যকারেরা তা স্পষ্ট করেছেন। অনার্য ব্যাখ্যায় মৃডয়াতি-র ঈশ্বরীয় শক্তিকে পাশ কাটিয়ে সাধারণ মানবীয় স্তরে নামিয়ে আনা হয়েছে, যা বেদ ও ভাষ্য দুটিকেই লঙ্ঘন করে।
“মৃডয়াতি” ধাতু যদি “সুখদাতা” অর্থে হয়, এবং ভাষ্যকাররা একে “সুখং করোতি” বলেন, তাহলে এটিকে সেনানায়কের অস্থায়ী দয়ায় নামিয়ে আনার পেছনে কি যুক্তি আছে?
বেদে শত শত স্থানে “রুদ্র মৃডয়াতি”, “মৃডান্নঃ শম্ভো” বলা হয়েছে, এসব কি কেবল সাধারণ মানুষের প্রতি কারও সাময়িক সহানুভূতির ভাষ্য?
❌অনার্যদের দাবী— “নীলগ্রীব” শব্দে বা “রুদ্র” শব্দে শিব বা বিষপান বা সমুদ্র মন্থনের কাহিনী জোর করে পুরাণ থেকে ঢোকানো হয়েছে।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— বেদের “নীলগ্রীব”, “শিতিকণ্ঠ”, “বিলোহিত” এসব শব্দ পরবর্তী পুরাণের অনুপ্রেরণা হয়েছে, উল্টো নয়। ভাষ্যকারগণ বেদে যা ব্যাখ্যা করেছেন, তা পরবর্তীকালে পুরাণসমূহে বিস্তৃত রূপ পেয়েছে, এটা ইতিহাসসম্মত ও শাস্ত্রসংগত পন্থা। কাজেই বলা যে এগুলো “পুরাণ থেকে জোর করে বেদে ঢোকানো হয়েছে” এটা নিতান্তই অজ্ঞতাপ্রসূত ও গ্রন্থস্রোতের বিপরীত ভাবনা।
🔘মহীধর (শ্লোক ২৮)—
“বিষভক্ষণেন নীলা গ্রীবা ... স নীলগ্রীবঃ।”
বিষপান থেকে রুদ্রের কণ্ঠ নীল এটি ভাষ্যকারের সরাসরি মন্তব্য, এই ব্যাখ্যা সমুদ্র মন্থনের পৌরাণিক বিষপানের সার্থক প্রতিফলন।
🔘উব্বট (শ্লোক ৭)—
“নীলগ্রীবঃ ইবাস্তং গচ্ছন্ লক্ষ্যতে।”
সূর্যাস্তে রুদ্ররূপতাই প্রতীত হয় শিবতত্ত্বের ঋষিসিদ্ধ ধারণা।
বিষপান ও নীলকণ্ঠতা পুরাণে বিস্তারিত, কিন্তু তার উৎস বেদেই, যেহেতু ভাষ্যকাররাও রুদ্রের বিষপান ও নীলতা উল্লেখ করেছেন। অতএব, এটি বেদপ্রমাণিত পুরাতত্ত্ব, পরবর্তীকালের কল্পনা নয়।
উব্বট ও মহীধর যদি স্পষ্ট করে বিষপানের ফলে রুদ্রের কণ্ঠ নীল বলেছেন, তাহলে এ ব্যাখ্যাকে ‘পুরাণ থেকে জোর করে ঢোকানো’ বলা কি ভাষ্যকারদের অজ্ঞ বলে অপমান করার নাম নয়?
পুরাণ যদি বেদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে, তখন উল্টোভাবে পুরাণকেই উৎস ধরে বেদকে পরবর্তী বলে ঘোষণার ভিত্তি কী?
❌অনার্যদের দাবী— ভাষ্যকার উব্বট নিজেই বলেন সূর্য রুদ্ররূপে অস্ত যায় এর মানে শিবের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— উব্বট ও মহীধর উভয়ের ভাষ্যে সূর্যকে “রুদ্ররূপ” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু একে যদি বলা হয়, এতে শিবের কোনো ভূমিকা নেই, তা হলে ভাষ্যকারদের মূল বক্তব্য অগ্রাহ্য করা হয়। “রুদ্র” এখানে আত্মার প্রতীক, সূর্য তাঁর প্রকাশ। অতএব, “সূর্য = রুদ্র ≠ শিব” এই সমীকরণ বানানো মনগড়া ও একপাক্ষিক, যা ভাষ্যকারদের মতকে ঘোর অপব্যাখ্যা।
🔘উব্বট (শ্লোক ৭)—
“যদ্বা রুদ্র এবোচ্যতে। ঋষিরাহ।”
এখানে রুদ্র সূর্যতুল্য, তবে সূর্য ≠ রুদ্র নয়, বরং রুদ্র সূর্যরূপে প্রতিফলিত হন।
🔘মহীধর (শ্লোক ৭)—
“অসৌ মণ্ডলবর্ত্তী রুদ্র এব তপতীতি জ্ঞাতঃ।”
সূর্যদেবতায়ই রুদ্র তপতী, এটি বেদীয় আরাধনার রূপক।
সূর্য ও রুদ্র এখানে অভিন্ন, যেহেতু এক ঈশ্বরই রূপভেদে বিচরন করেন। এটি উপাসনার এক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব ‘অদ্বৈত দর্শন’। সূর্যকে রুদ্র রূপে উপাসনা করা হয় বলে রুদ্র ‘সূর্য’ হয়েছেন না বরং সূর্যে যে রুদ্রতত্ত্ব বিরাজমান, তা ঋষির প্রাত্যহিক অনুভব। ভাষ্যকারেরা এই দৃষ্টিকোণেই বলেন সূর্যাস্তে রুদ্র দর্শন হয়।
যদি ভাষ্যকাররা বলেন “অসৌ রুদ্রঃ মণ্ডলবর্ত্তী” সূর্য মণ্ডলে রুদ্র বিরাজমান, তাহলে কেবল সূর্যই রুদ্র এবং শিব নয়, এই সীমিত দৃষ্টিভঙ্গির উৎস কী?
শাস্ত্রে বলেছে— “একং সদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি” (ঋগবেদ/১/১৬৪/৪৬) আবার এই “একমেবাদ্বিতীয়ম” ব্রহ্মটাই যে রুদ্র তা- “এক হি রুদ্র ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য” (শ্বেতাশ্বতর/৩/২),(তৈত্তিরীয় সংহিতা/১/৮/৬) দ্বারা৷ প্রমাণিত। অর্থাৎ এক পরব্রহ্ম শিব বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত সূর্য, অগ্নি, রুদ্র সবই তাঁর প্রকাশ, তাহলে রুদ্রের সূর্যরূপে প্রকাশকে স্বতন্ত্র ও শিব-বিরোধী রূপে দাঁড় করানোর উদ্দেশ্যটাই বা কী?
🔘অনার্যদের প্রতিটি দাবি ভাষ্যকারদের ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে, ব্যাকরণবিরোধী, শাস্ত্রবিরোধী ও যুক্তিবিচ্যুত।
উব্বট ও মহীধর রুদ্রকে শিবস্বরূপ, বিষপায়ী, সর্বত্রব্যাপ্ত ঈশ্বর ও সদাশিব রূপেই প্রতিষ্ঠা করেছেন, এবং তাদের ভাষ্য শাস্ত্রতত্ত্ব ও মীমাংসা অনুযায়ী শুদ্ধ।
✅ ভাষ্যকারদের মতে— এই মন্ত্রে রুদ্রই সূর্যরূপে, অস্তমিত রক্তিমরাগে, নীলকণ্ঠে (বিষপানকারী শিবের প্রতীক), সকল সাধারণ মানুষ (গোপাল, নারী) দ্বারা প্রত্যক্ষ হন, এবং দৃষ্ট হয়েই তিনি “মৃডয়াতি” কল্যাণ করেন।
❌ অনার্য ব্যাখ্যা— ব্যাকরণ, শব্দার্থ, শাস্ত্রীয় অনুশীলন এবং ভাষ্যকারদের ঐতিহ্য সবকিছুকে উপেক্ষা করে একটি ভিন্ন চরিত্র দাঁড় করায়, যা বেদের অর্থকে বিকৃত করে।
অতএব, অনার্যদের উপস্থাপন “নীলগ্রীব মানে নীলমণির মালা পরিহিতা সেনাপতি” ইত্যাদি ভাষ্যকারদের মতে নিতান্তই অযৌক্তিক, বিকৃত এবং বেদের শাব্দিক ও ভাষ্যগত ঐতিহ্যের পরিপন্থী।
যখন উব্বট ও মহীধর, উভয়েই বহু স্থানে রুদ্রকে বিষপায়ী, নীলকণ্ঠ, দয়াময়, সর্বজ্ঞ দেবতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তখন তাঁদের ভাষ্যের পুরো কাঠামো উপেক্ষা করে কি করে অনার্যরা নিজেদের মত চাপিয়ে দিতে পারে?
“ব্যাকরণ”, “ধাতু”, “অমরকোষ”, “নিরুক্ত”, “ঋষি-ভাষ্য”, “শ্রুতি-স্মৃতি” সবকিছুকে অস্বীকার করে বেদের উপর আধুনিক মনোবিশ্লেষণ চাপানোই যদি হয় উদ্দেশ্য, তাহলে তা আর “ব্যাখ্যা” নয় তা হয় “বিকৃতি”। এই বিকৃতিকে কি কেউ শাস্ত্রতুল্য বিবেচনা করতে পারে?
——————————————————————————————————————————————
❌ অনার্যদের দাবী —
নমস্তে নীলগ্রীবায় সহস্রাক্ষায় মীচুষে।
অথৌ যেহঅস্য সত্বানোহহং তেভ্যহকরং নমঃ ৷৷ ৮ ৷৷
ভাষ্যার্থঃ (নীলগ্রীবায়) যাহার কন্ঠ এবং স্বর শুদ্ধ সেই (সহস্রাক্ষায়) হাজার ভৃত্যের কার্য দর্শনশীল (মীচুষে) পরাক্রমযুক্ত সেনাপতির জন্য আমার দানকৃত (নমঃ) অন্ন (অস্ত্র) প্রাপ্ত হোক (অথো) ইহার অনন্তর (যে) যে (অস্য) এই সেনাপতির অধিকারে (সত্বানঃ) সত্ব গুণ তথা বলা দ্বারা যুক্ত পুরুষ (তেভ্যঃ) তাহাদের জন্যও (অহম) আমি (নমঃ) অন্নাদি পদার্থ কে (অক্ররম্) সিদ্ধ করবো।
নোটঃ মহীধর এই মন্ত্রের অর্থ করেছেন যে, সেই রুদ্রের ভৃত্য কে নমস্কার করি। ইহাতে স্পষ্ট সিদ্ধ হয় যে, ইহা রাজধর্মের প্রকরণ মন্ত্র। অন্যথা ভৃত্যকে নমস্কার করার কি তাৎপর্য্য, আমাদের পক্ষে তো ইহা কোন দোষ নয়, কারণ সেনাপতির ভৃত্যও অন্ন দান আদির যোগ্য।
“নমঃ-অন্নাদি পদার্থ নিঘন্টু ২.৭।।”
❌অনার্যদের দাবী— “নীলগ্রীব” ও “সহস্রাক্ষ” শব্দদ্বয় কোনো ঈশ্বর বা রুদ্র/শিব বোঝায় না, বরং একজন শক্তিশালী মানব সেনাপতি এবং তার হাজার ভৃত্য বা সহচরদের নির্দেশ করে।
অর্থাৎ, এটি শিবতত্ত্বের স্তোত্র নয়।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— নীলগ্রীব” উভয় ভাষ্যকারই স্পষ্ট করেছেন এটি রুদ্র/শিবের বর্ণনা। রামায়ণ, মহাভারতেও যিনি নীলকণ্ঠ শব্দে সংজ্ঞায়িত হয়েছেন তিনিই পরমেশ্বর শিব। আর শুরু থেকেই নীলকণ্ঠ দ্বারা কাকে বোঝায় তা বিস্তারিত ভাবে ভাষ্য ও শ্রুতি প্রমাণ সহ ব্যাখ্যা করেই বলেছি। এবং ওখানেই প্রমাণিত হয়ে যায় নীলগ্রীব/নীলকণ্ঠ দ্বারা যে শিবই প্রতিপাদিত তত্ত্ব।
🔘উব্বট বলেন—
“নীলগ্রীবায় নীলকণ্ঠায়”
যার গ্রীবা বা কণ্ঠ নীল, তিনি রুদ্র।
🔘মহীধর বলেন—
“নীলগ্রীবায় রুদ্রায়” অর্থাৎ এটি সরাসরি রুদ্রকে বোঝায়।
অতএব, এটি কোনো মানব বা রাজপুরুষ নয়, এটি ঐশ্বরিক রূপ নির্দেশ করে।
“সহস্রাক্ষ” অর্থে মহীধর বলেন- “সহস্রমক্ষীণি যস্য, ইন্দ্রস্বরূপিণে” যার হাজার চক্ষু, তিনি ইন্দ্রস্বরূপ রুদ্র।
বহু চোখ (সহস্রাক্ষ) মানে সর্বদর্শী ঈশ্বর, মানবসীমার অতীত, সর্বজ্ঞানরূপ স্বরূপ।
কাজেই এই শব্দগুলি ঈশ্বরতত্ত্বে প্রযোজ্য, সেনাপতি বা রাজপুরুষ নয়।
যদি “নীলগ্রীব” বা “সহস্রাক্ষ” শুধুমাত্র মানব সেনাপতি বা রাজা হত, তাহলে কীভাবে “হাজার চোখ” বা “নীলকণ্ঠ” এর মত অতিপ্রাকৃত বৈশিষ্ট্য ও দেবত্বপূর্ণ বিশেষণ অর্থবহ হয়?
মানব সেনাপতির কণ্ঠ কখনো “নীল” বা “সহস্রাক্ষ” (সহস্র চক্ষু) হতে পারে?
মহাকাব্য ও পুরাণগুলো কেন রুদ্রকে “নীলকণ্ঠ” বলেছে, যা ঐশ্বরিক গুণের চিহ্ন?
❌অনার্যদের দাবী— “নমঃ অক্ররম্” (আমি অন্ন/দান করব) এই বাক্যে বোঝায় সেনানায়ক ও তার সহচরদের প্রতি শ্রদ্ধা ও দানের প্রতিশ্রুতি, যা স্পষ্টত দেবতা নয় বরং রাজারাজড়ার ধর্মীয় অনুষঙ্গ।
এর ফলে মন্ত্রটি দেবভাবনাযুক্ত নয়, বরং রাজনীতিক প্রেক্ষাপটে গঠিত।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— “অক্ররম্” উব্বট ও মহীধর উভয়েই এটিকে “নমস্কারম্” অর্থে নিয়েছেন। আবার এখানে অনার্যদের দাবীর উপর প্রশ্ন উঠে যায় তবে সমস্ত শতরুদ্রীয়তে, জগতের পালক, জীবের পালক, অন্নের পালক, বনের পালক, বৃক্ষের পালক, পশুদের পালক সেই রুদ্রের উদ্দেশ্যে নমস্কার জানাই এমন অর্থ আছে। কিন্তু, ৮ নং শ্লোকে এসে “নমঃ” পদের অর্থ অন্নাদি দান কীভাবে হবে? শতরুদ্রীয় শুরুর ১ম শ্লোকেও বলা আছে- “নমস্তে রুদ্র মন্যব উতো ত ইষবে নমঃ” অর্থাৎ রুদ্রের ক্রোধ, বাণ, বাহুযুগলের প্রতি নমস্কার। এবং উবট-মহীধরও একই অর্থ স্বীকার করে গেছেন। তো যেখানে রুদ্রকে নমস্কারের মাধ্যমে শতরুদ্রীয় প্রারম্ভ হয় এবং সমস্ত শতরুদ্রীয় জুড়ে কেবল রুদ্রকেই নমস্কার করা হয়েছে সেখানে, এই একটি শ্লোকে “নমঃ” এর অর্থ হয়ে গেলো অন্নাদি দান? এটা কোন ধরনের যৌক্তিকতা? অনার্যরা কীভাবে ভাষ্যকারের ভাষ্য, শব্দের অর্থ, শ্রুতির বচন এসবের বিরোধীতা করে নিজের মনগড়া মত স্থাপন করবেন? এই কি তবে আপনাদের বেদ প্রচার? শাস্ত্রের অনর্থ করায় কি তবে আপনাদের মূল লক্ষ্য?
🔘মহীধর বলেন—
“মীঢুষে…. সেচক্রে, বৃষ্টিকর্ত্ত্রে পর্জন্যরূপায়”
অর্থাৎ, রুদ্র বৃষ্টিদাতা, পৃথিবীর পালনকর্তা তাঁর প্রতি ভক্তিভরে দান (অন্ন, হোম দ্রব্য) করা হয়।
“অক্রম্” অর্থে 'নমস্কারম্' কেবল খাদ্যদানের প্রতিশ্রুতি নয়, ভক্তিসহ বিনয়পূর্বক উপাসনা।
“অহং নমঃ নমস্কারম্ অকরম্ করোমি।
‘কৃঞ্ কৃতৌ’ শপ্ লঙি উত্তম-একবচনম্”
অর্থাৎ, আমি নমস্কার করি এখানে কোনো বস্তু বা ভোজ্য দানের প্রসঙ্গই নেই।
“অক্ররম্” শব্দটি “কৃ” ধাতু + শপ্ প্রত্যয় + লঙ্ লকার দ্বারা গঠিত ক্রিয়াপদ, যার অর্থ “আমি করেছিলাম/করছি (নমস্কার)”।
এখানে "অক্ররম্" ক্রিয়াপদরূপে "নমস্কার করা" বোঝায়, কোনো বস্তু বা দান নয়। এটি দানার্থে নয়, ক্রিয়ার্থে। ফলে, “অন্ন দান” বোঝানো একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক ও ভাষাবিরুদ্ধ।
“নমঃ” শব্দ সর্বত্র ঈশ্বরতত্ত্বে প্রযোজ্য, এটি বেদজ ও নিঘন্টুক অর্থে, ভক্তিরূপে নমন বোঝায়। নিঘন্টু ২.৭-এ "নমঃ" এর প্রসঙ্গ নানা ক্ষেত্রে থাকলেও, এখানে ভাষ্য ও প্রসঙ্গ অনুযায়ী এটি দেবনমস্কার অর্থেই প্রযোজ্য।
🔘মহর্ষি যাস্ক নমঃ অর্থে বলছেন—
“নমো মহদ্ভ্যো নমো অর্ভকেভ্যঃ” (ঋগ্বেদ ১/২৭/১৩)
নিরুক্ত ৩/২০/৪ ভাষ্য
“মহদ্ভ্যঃ নমঃ” = বৃদ্ধ দেবগণকে নমস্কার,
“অর্ভকেভ্যঃ নমঃ” = অল্পবয়স্ক দেবগণকে নমস্কার।
এই ঋগ্বৈদিক দৃষ্টান্তে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, নমঃ শব্দ ও তার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিগণ যদি দেবতা হন, তবে তাদের ভিন্ন বয়স বা অবস্থার সত্ত্বেও নমস্কার করা হয়, এবং তাদের “অল্প” বা “ভৃত্য” হওয়া তাদের দেবত্ব অস্বীকার করে না।
অতএব, “রুদ্রের ভৃত্যদের” উদ্দেশ্যে নমস্কার করাও শিব/রুদ্রতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত।
“ভৃত্য”কে উদ্দেশ্য করে “নমঃ” বললে সেটি দেবভাবের পরিব্যাপ্তি, যেমন ঋগ্বেদের এই মন্ত্রেও দেখা যায়।
কেন মন্ত্রের শুরুতে এবং অন্যান্য স্থানে “নমঃ” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যদি তা কেবল দানের অর্থ বহন করতো?
শাস্ত্র ও ভাষ্যের কি নির্দেশ নেই যে ‘নমঃ’ শব্দ দিয়ে শ্রদ্ধা বা নমস্কার প্রকাশ হয়?
‘অক্ররম্’ শব্দের ব্যাকরণগত বিশ্লেষণ কি দানের কোনো বাচক অর্থকে সমর্থন করে?
যদি এটি কেবল সামাজিক বা রাজনীতিক দানের মন্ত্র হয়, তাহলে কেন এর মধ্যে ঈশ্বরতাত্ত্বিক গুণাবলী এবং দেবতার আভাস এত পরিষ্কার?
❌অনার্যদের দাবী— মহীধরের ভাষ্যেও যেহেতু ভৃত্যদের উদ্দেশ্যে নমস্কার উল্লেখ আছে, তাই এই মন্ত্রটি রুদ্র বা শিবকে কেন্দ্র করে নয়, বরং এটি সামাজিক বা প্রশাসনিক স্তরের মানব সম্পর্ককে কেন্দ্র করে গঠিত।
অতএব, এখানে শিবতত্ত্ব আরোপ অযৌক্তিক ও পরবর্তীকালের পৌরাণিক কল্পনা।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— অনার্যদের দাবি যে, মহীধরের ভাষ্যে “ভৃত্যদের উদ্দেশ্যে নমস্কার” থাকার কারণে এই মন্ত্রটি শিব বা রুদ্রকে কেন্দ্র করে নয়, বরং সামাজিক বা প্রশাসনিক স্তরের মানব সম্পর্ককে কেন্দ্র করে গঠিত, এটি ভিত্তিহীন ও অসঙ্গত। কারণ, বেদ ও ভাষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে “ভৃত্য” শব্দের অর্থ কেবল সাধারণ মানব নয়, বরং ঈশ্বরের ঐশ্বরিক শক্তির বহুবিধ রূপ এবং তার কার্যক্ষম দিকগুলোকে নির্দেশ করে। মহীধরের ভাষ্য স্পষ্টভাবে রুদ্রের ভৃত্যদের প্রতি শ্রদ্ধা ও নমস্কারকেই নির্দেশ করলেও, এই ভৃত্যরা সাধারণ সৈনিক বা প্রজা নয়, বরং পরমেশ্বর রুদ্রের শক্তির বহুবিধ আভাস ও প্রকট রূপ। তাই, “ভৃত্য” শব্দের ব্যবহারে কোনোভাবেই মন্ত্রের ঈশ্বরতাত্ত্বিক তাৎপর্য ক্ষুণ্ন হয় না; বরং এটি রুদ্রের সার্বজনীন ও বহুমুখী ঐশ্বরিক উপস্থিতির প্রমাণ। অতএব, এই দাবীটি পূর্ণতই যুক্তিহীন এবং পরবর্তী সামাজিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে প্ররোচিত, যা শ্রুতির মূলভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
🔘মহীধর বলেন—
“অথো... আস্য রুদ্রস্য সত্বানঃ ভৃত্যাঃ তেব্যঃ... নমস্কারম্”
অর্থাৎ, প্রথমত রুদ্রকে নমস্কার, তারপর তাঁর ভৃত্যদেরও নমস্কার।
এটি দেবতাকে কেন্দ্রে রেখে তাঁর সেবকদের সম্ভাষণ যেমন ভক্তিভাবে "ভগবানের দাসদের সম্মান" করা হয়। এটি কখনই তাদের দেবতাস্বরূপ দেখানো নয়।
এই "সত্বানঃ" বা ভৃত্যরা “প্রাণিস্বরূপ” হলেও, তারা মূল দেবতার অংশ বা বাহক।
🔘শিব তত্ত্ব নিয়ে উবট এই মন্ত্রের ব্যাখ্যায় বলেছেন—
“অবিপরিণামীতি স্তূয়তে।”
অর্থাৎ, যিনি পরিবর্তনশীল নন, সেই রুদ্রকে স্তব করা হচ্ছে।
এভাবে “অবিপরিণামী” শব্দ দ্বারা ঈশ্বররূপে অচ্যুত, পরিবর্তনহীন রুদ্রই বোঝানো হয়েছে, যা স্পষ্টত মানব প্রশাসনের কোনো স্তর নয়।
মহীধর এই মন্ত্রে রুদ্রকে “পর্জন্যরূপায়”, “ইন্দ্রস্বরূপিণে” রূপে অভিহিত করেছেন। এই বহুরূপ ঈশ্বরই বেদের প্রধান তত্ত্ব, যিনি বৃষ্টি দেন, বিশ্বে বিচরণ করেন, সর্বত্র বিরাজমান।
“ভৃত্য” শব্দ কি শ্রুতিতে কখনো সাধারণ সৈনিক বা মানব-সমাজের সদস্য হিসেবে সীমাবদ্ধ?
কেন শ্রুতির ভাষ্যে “ভৃত্য” শব্দটি রুদ্রের শক্তি ও দাসত্বের বহুমাত্রিক রূপে ব্যবহৃত হয়েছে?
যদি এটি মানব প্রশাসনিক স্তরের মন্ত্র হয়, তাহলে “অবিপরিণামী”, “নীলগ্রীব”, “সহস্রাক্ষ” ইত্যাদি অলৌকিক বিশেষণের অর্থ কী হবে?
কেন মহীধরের মত প্রামাণিক ভাষ্যকার এই মন্ত্রকে রুদ্রের ভক্তিমূলক স্তোত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন?
🔘এই মন্ত্রের “নীলগ্রীব” ও “সহস্রাক্ষ” শব্দগুলো মানব সেনাপতি বা সাধারণ ব্যক্তিকে বোঝায় না, বরং এগুলো পরম রুদ্র শিবের ঐশ্বরিক ও অতিপ্রাকৃত গুণাবলীর প্রকাশ। “অক্ররম্” শব্দও ‘দান’ অর্থে নয়, শ্রদ্ধা ও নমস্কারের ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যা মন্ত্রটিকে ভক্তিমূলক ও ঈশ্বরকেন্দ্রিক করে তোলে। মন্ত্রে যেসব “ভৃত্য” বা সহচরদের উল্লেখ আছে, তারা সাধারণ মানব নয়, রুদ্রের ঐশ্বরিক শক্তির বহুমাত্রিক রূপ এবং তাঁর সার্বজনীন উপস্থিতির দিক নির্দেশ করে। অতএব, এই মন্ত্রটি সামাজিক বা প্রশাসনিক কোনো মানবিক প্রেক্ষাপটে গঠিত নয়, বরং এটি পরম রুদ্র বা শিবের প্রতি গভীর ভক্তি ও শ্রদ্ধার এক অনন্য স্তোত্র। তাই অনার্যদের দাবি যে এটি কেবল রাজনীতিক বা সামাজিক মন্ত্র তা যুক্তিহীন ও অপ্রমাণিত।
মোটকথা, মন্ত্রের ভাষ্য, ব্যাকরণ ও শ্রুতি সমর্থিত প্রমাণ সব মিলিয়ে এটি নিঃসন্দেহে পরম রুদ্রের ঐশ্বরিক গুণগান এবং শৈব তত্ত্বের অন্তর্গত একটি পবিত্র স্তোত্র।
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী —
প্রমুঞ্চ ধন্বনস্তুমুভয়োরাত্র্যোক্র্যাম্ যাশ্চ তে হস্ত ইষবঃ পরা তো ভগব বপ৷৷৯৷৷
ভাষ্যার্থঃ হে (ভগবঃ) ঐশ্বর্য্যযুক্ত সেনাপতি! (তে) তোমার (হস্তে) হাতে (যাঃ) যে (ইষবঃ) বাণ (তাঃ) তাহা (ধন্বনঃ) ধনুকের (উভয়োঃ) উভয় (আােঃ) পূর্ব পর কিনারায় (জ্যাম) প্রযত্নে যুক্ত করে শত্রুর উপর (ত্বম) তুমি (প্র, মুচ্চ) বলের সাথে ছেড়ে দাও (চ) এবং যে তোমার উপর শত্রু বাণ ছুড়েছে তাকে (পরা, বপ) দূর করো।
নোটঃ এই মন্ত্রে উব্বট মহিধর পৌরাণিক মতানুযায়ী এই ভাষ্য করেছে যে, "হে ভগবান তোমার ধনুকের উভয় দিকের জ্যা খুলে ফেলো এবং তোমার হাতের বাণ ফেলে দাও এখানে এই অর্থ পরিষ্কার না যে এই বাণ ফেলে দেওয়া রুদ্র কে? পৌরাণিক রুদ্রের না কোন অন্য ভগবানের? এখানে তো মিতভাষীর মতো অর্থ করা হয়েছে।
এখানে কি বাণ কে হাত থেকে ফেলে দেবার অর্থ রুদ্র কাউকে না মারে? অথবা কোন শত্রুর উপর নিক্ষেপ করে? যদি প্রথম অর্থ মানা যায় যে রুদ্র নিজ হাত থেকে বাণ ফেলে দিয়ে শান্তরূপ হবে, তো আপনার রুদ্রের রুদ্রত্ব কি থাকলো তবে? আর যদি শত্রুর উপর নিক্ষেপ করার উপদেশ করা হয় তো রুদ্রের প্রবল শত্রু কে? এভাবে রুদ্র পরমাত্মা পক্ষে এই অর্থ করা উচিৎ নয় কারণ পরমাত্মার কোন শত্রু নেই এই জন্য এই প্রকরণ রাজধর্মের।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— শতরুদ্রীয়তে রুদ্রটা কে তা ইতি মধ্যেই অনেকবার প্রমাণিত হয়ে গেছে। তাই নতুন করে এখানে রুদ্র কে, তা আর প্রমাণ করার প্রয়োজনীয়তা নেই। প্রথম কথা হলো, এখানে বাণ ধারণকারী ও বাণত্যাগকারী দুই-ই হলো এক রুদ্রই। বাণ ফেলে দেওয়ার মানে এই নয় যে, রুদ্রের রুদ্রত্ব থাকবে না। আর শ্রুতিতে প্রার্থনাটা কি উদ্দেশ্যে করা হয়েছে সেটাও দেখার বিষয়। এখানে বাণ ফেলে দাও তার মানে এই নয় যে, এখানে পরমেশ্বর রুদ্রের কথা বলা হচ্ছে না। শ্রুতিতে স্থান, কাল, পাত্র ভেদে একই শব্দ বিভিন্ন অর্থে প্রয়োগ হয়। মন্ত্রে “বাণ ফেলে দাও” বলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা ‘তোমার হাতে থাকা বাণ শত্রুর দিকে নিক্ষেপ করো’ এই অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে, এটি উবট-মহীধর উভয়ের ভাষ্যে পরিষ্কার। “বাণ ফেলা” মানে কোনোভাবেই নিরস্ত্র হওয়া নয়, বরং ধ্বংসের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ। মন্ত্রে ব্যবহৃত “পরা বপ”, “পরাবপ”, “পরাক্ষিপ” এই সব ক্রিয়াপদও নির্দেশ করে যুদ্ধের প্রক্রিয়া। শান্তির অনুরোধ এখানে থাকলে এই সব শব্দ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেত। তাই অর্থ না বুঝেই শব্দের অনর্থ করলে এমনই মনে হবে যে, এখানে রুদ্রটা সাধারণ রাজা মাত্র।
আর যদি আসি রুদ্রের রুদ্রত্বের তবে বলা বাহুল্য যে, মহীধর এই শ্লোকের ভাষ্যে সেই রূদ্রকে ষড়-ঐশ্বর্য্য সম্পন্ন বলেছে যা ভগবানের গুণ বা লক্ষণ। তাহলে প্রশ্ন থাকে কোন রাজা ষড়ৈশ্বর্য যুক্ত? তবে কি রাজা ভগবান হয়ে গেলো? রুদ্র যদি ভগবান না হয় তবে কেন ষড়-ঐশ্বর্য্যযুক্ত বলা হলো? এখানেই তো প্রমাণ হয় রুদ্র পরমেশ্বর, কোনো সাধারণ রাজা নয়।
এবার যদি রুদ্রের প্রবল শত্রু নিয়ে তবে আর্যদের শাস্ত্রের অনর্থ করার পর্দা এখানেই ফাঁস হয়ে যায়। কেননা, এখানের রুদ্রের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে বলা হয়েছে— "হে ভগবান! ধনুকের উভয় প্রান্তে স্থাপিত জ্যা (মৌর্বী লতা) তুমি খুলে ফেলো, আর তোমার হাতে থাকা বাণগুলি শত্রুদের দিকে নিক্ষেপ করো।" এখানে এটা বলা হয়নি যে, বাণগুলি রুদ্রের শত্রুর দিকে নিক্ষপ করো। এখানে অনার্যরা ভুল ও অযৌক্তিক অর্থকে উপস্থাপন করলো মাত্র। এখানে যজমানের পক্ষ থেকে ইষ্টদেব রুদ্রকে আহ্বান জানানো হচ্ছে যেন তিনি আঘাতকারী, প্রতিকূল শক্তির বিনাশ করেন।
এইভাবে, রুদ্রের শত্রু বলতে বোঝানো হচ্ছে দেববিরোধী শক্তি বা দুষ্ট অনার্য বাহিনী যারা ধর্ম কার্যে বাধা সৃষ্টি করে। এবার দেখে নেবো উবট ও মহীধর নিজেদের ভাষ্যে কি বলেছেন।
🔘(যজু/উবট-মহীধর ভাষ্য/অধ্যায় ১৬/৯)—
উবট ভাষ্য-
প্রমুঞ্চ ধন্বনঃ ধনুষঃ ত্বসুবযোঃ আল্পোর্দহনুরন্তযোঃ জ্যাং গুণম্ ।
যাশ্চ তে তব হস্তে ইপবঃ । পরা তা ভগবো বপ পরাবপ পরাক্ষিপ তা হে ভগবন মহদৈশ্বর্যযুক্ত ॥ ৯ ॥
মহীধর ভাষ্য—
হে ভগবঃ ভগং ষড্বিধমৈশ্বর্যমস্যাস্তীতি ভগবান ।
'মতুভসো রুঃ সংবুদ্ধৌ ছন্দসিঃ' (পা০৮।৩।১) ইতি রুত্বম্ ।
'ঐশ্বর্যস্য সমগ্রস্য ধর্মস্য যশসঃ শ্রিয়ঃ । জ্ঞানবৈরাগ্যযোশ্চৈব ষণ্ণাঁ ভগ ইতিরণা' ইত্যুক্তেঃ ।
হে ভগবন ধন্বনঃ ধনুষ উভয়োরার্ত্ন্যো দ্বযোঃ কোঠ্যোঃ স্থিতাঁ জ্যাঁ মৌর্বী লং প্রমুঞ্চ দূরীকুরু ।
যাশ্চ তে তব হস্তে ইষবঃ বাণাঃ তা ইধুঃ পরাবপ পরাক্ষিপ ॥ ৯ ॥
(উবট ও মহীধর ভাষ্য অনুসারে)— হে ভগবান, যিনি ষড়ঐশ্বর্য-সম্পন্ন (সমগ্র ঐশ্বর্য, ধর্ম, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্যে পরিপূর্ণ), তুমি তোমার ধনুকের উভয় প্রান্তে (অর্থাৎ সামনের ও পেছনের দুই কোণে) যে শক্তভাবে বাঁধা মৌর্বী জ্যা (ধনুকের টানার সুতার মতো অংশ), তাকে খুলে দাও বা শিথিল করো। আর তোমার হাতে যে সমস্ত ইষবঃ অর্থাৎ বাণ বা তীরসমূহ রয়েছে, তাদেরও দূরে সরিয়ে দাও বা পরিত্যাগ করো, অথবা শত্রুদের দিকে নিক্ষেপ করো।
তাহলে এখানে দেখা যাচ্ছে ভাষ্যকারের ভাষ্য ও অনার্যদের করা দাবী ভাষ্যকারের বিরুদ্ধ। কারণে এখানে সেই রদ্রকে ধনুকের জ্যা শিথিল করার প্রার্থনা করছে যিনি ভগবান পদবাচ্য। কিন্তু, অনার্যরা বললো এটা একজন রাজা বা সেনাপতির উদ্দেশ্যেই বলা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ ভাষ্য বিরোধী। তাছাড়াও শতরুদ্রীয় এর ১ নং মন্ত্র থেকে শুরু করে এই ৯ নং মন্ত্র পর্যন্ত ভাষ্যকারর গণ রুদ্রকে একজন ঈশ্বর হিসেবেই উল্লেখ করে এসেছেন। যিনি বিভিন্ন অলৌকিক গুণে গুণান্বিত। তাই এখানেও যে রুদ্রের উল্লেখ রয়েছে তিনি কোনো সাধারণ রাজা বা সেনাপতি নন বরং পরমেশ্বর রুদ্রই।
❌অনার্যদের দাবী— এই মন্ত্রে ‘ভগবত্’, ‘ইষু’, ‘ধন্বনঃ’ ইত্যাদি শব্দ থাকা সত্ত্বেও, রুদ্র বা শিবের উল্লেখ কোথাও নেই, সুতরাং এটি কোনো নির্দিষ্ট দেবতা বা পৌরাণিক রুদ্রকে নির্দেশ করে না। এটি কেবল একটি সাধারণ অস্ত্রধারী সেনাপতির প্রতি সম্বোধন।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— প্রথমত কোনো সাধারণ রাজা বা সেনাপতিকে ভগবান বলা যায় না। কেননা এখানে যে রুদ্রের উল্লেখ রয়েছে তিনি সাক্ষাৎ পরমেশ্বর। যা ১ নং মন্ত্র থেকেই প্রমাণ করেছি। তাই এখানে পরমেশ্বর এর তুলনা সাধারণ রাজা বা সেনাপতির সাথে করা সম্পূর্ণভাবে শ্রুতি বিরুদ্ধ। এই দাবিটি প্রাথমিকভাবে ভাষ্যকারদের (উবট ও মহীধর) স্পষ্ট বক্তব্য ও ঋগ্বেদীয় প্রেক্ষাপট অস্বীকার করে। শতরুদ্রীয়ের শুরু থেকে রুদ্রকে পরমেশ্বর রূপেই দেখানো হয়েছে, যিনি ষড়ঐশ্বর্য-সম্পন্ন, ভগবত্ত্বের অধিকারী। তাই এই প্রার্থনা কোনো সাধারণ রাজার প্রতি নয়, বরং সেই মহাদেবের প্রতি, যিনি শত্রুদের বিনাশকারী ও কল্যাণমূর্তিও বটে। আমরা দেখবো কিভাবে ভাষ্যকাররা রুদ্রকে শুধু সেনাপতি নয়, বরং সর্ব্বভৌম ঈশ্বর রূপেই দেখিয়েছেন।
🔘উবট ভাষ্যে স্পষ্ট বলা হয়েছে —
“প্রমুঞ্চ ধন্বনঃ ধনুষঃ ত্বসুবযোঃ আল্পোর্দহনুরন্তযোঃ জ্যাং গুণম্।”
অর্থাৎ, হে ভগবান, তোমার ধনুকের উভয় প্রান্তের দৈর্ঘ্য মুক্ত কর। এখানে ‘ভগবঃ’ শব্দটি ঈশ্বর বা সর্বশক্তিমানকে নির্দেশ করে, কেবল সাধারণ মানব সেনাপতি নয়।
🔘মহীধর ভাষ্য আরো স্পষ্ট করে—
“হে ভাগবঃ, ভাগং ষড্বিধমৈশ্বর্যমস্যাস্তীতি ভাগবন।”
অর্থাৎ, যিনি ষড্বিধ অর্থাৎ ছয় প্রকার ঐশ্বর্যের অধিকারী, তিনি হে ভগবান।
অতএব, ‘ভাগবঃ’ শব্দ দ্বারা প্রকাশিত ব্যক্তি মানব সেনাপতি নয়, বরং পরমেশ্বর রুদ্র বা শিব, যিনি সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞানী। তাই মন্ত্রে রুদ্র/শিবের উল্লেখ না থাকার দাবি ভিত্তিহীন।
🔘উবট ও মহীধর ভাষ্য স্পষ্টতই বলেছে— ‘ধন্বনঃ’ অর্থ ‘ধনুক’, ‘উভয়োঃ’ অর্থ ‘উভয় প্রান্ত’ বা ‘দুই পাশে’, এবং ‘হস্তে ইষবঃ’ অর্থ ‘তোমার হাতে থাকা বাণ’। অর্থাৎ, রুদ্রের হাতে থাকা বাণ তার শত্রুর দিকে নিক্ষেপ করার কথা বলা হচ্ছে।
‘বাণ ফেলা’ মানে রুদ্র নিজে নিজেকে শান্ত করা নয়, বরং তার শত্রুকে নির্মূল করার নির্দেশ।
পরমাত্মার রূপে রুদ্রের ‘শত্রু’ শব্দটি অর্থাত্মক, শত্রু বলতে দুষ্কৃতি, অবজ্ঞা, অহংকার, মায়া, অজ্ঞতা, মোহ, ইন্দ্রিয়বৃত্তি ইত্যাদি। অর্থাৎ, পরমাত্মার মুক্তির পথে বাধাস্বরূপ মনস্তাত্ত্বিক ও আদ্যত্ববৈরী শক্তি। তাই ‘শত্রু’ না থাকলেও অর্থবহ শত্রুর অবতারণা আছে।
অতএব, ‘বাণ ফেলা’ শব্দটি পরমাত্মার ঐশ্বর্য ও রুদ্রত্বের সাথে একেবারে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং শান্তি বা নিষ্ক্রিয়তার নয়।
যদি এটি শুধু মাত্র একজন "সাধারণ সেনাপতির" প্রতি আহ্বান হয়, তবে কেন তাকে "ভগবঃ" (ষড়ঐশ্বর্যযুক্ত ভগবান) সম্বোধন করা হলো, যা একান্তই ঈশ্বরসংজ্ঞক শব্দ?
কেন মহীধর ভাষ্যে বলা হলো—
“ভগং ষড্বিধমৈশ্বর্যমস্যাস্তীতি ভগবান”?
একমাত্র ঈশ্বরকেই তো ষড়ঐশ্বর্যের অধিকারী বলা হয় (ধর্ম, ঐশ্বর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য)।
সেনাপতি যদি শত্রুদের উপর বাণ নিক্ষেপের প্রতীক হয়, তাহলে সেই প্রতীককে পূজার্ঘ্য দেবতা হিসেবে অভিহিত করে যজ্ঞে আহ্বান করার যৌক্তিকতা কী?
❌অনার্যদের দাবী— ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ধনুকের উভয় দিকের জ্যা খুলে ফেলার কথা বলা হয়েছে, যা সাধারণ সেনাপতি বা যোদ্ধার অস্ত্রচালনা নির্দেশ করছে, কিন্তু রুদ্র বা শিবের বিষয় এখানে নেই।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— শ্রুতি সর্বদা নাম নয়, গুণ ও লক্ষণ দ্বারা দেবতাকে চিহ্নিত করে। শতরুদ্রীয়তে মন্ত্রে রুদ্রকে কোথাও “রুদ্র” বলে সম্বোধন না করলেও, তার গুণাবলী যথা— ধনুক-ধারী, ভগবৎ-ঐশ্বর্যযুক্ত, শত্রুনাশী, এই সবই রুদ্রের বিশেষত্ব বহন করে। তার ওপর ভাষ্যকারগণ একাধিকবার এই মন্ত্রসমূহে “ভগবান রুদ্র” বলেই উল্লেখ করেছেন। তাই নাম না থাকলেও লক্ষণ দ্বারা নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় এটি সেই রুদ্র পরমেশ্বর শিব।
এখানে রুদ্র বা শিবের বিষয় যদি না থাকতো তবে, ভাষ্যকার রুদ্রকে ষড়ৈশ্বর্যযুক্ত বলতো না। সম্পূর্ণ শতরুদ্রীয় জুড়ে রুদ্রই যে শিব তা আলাদা করে বলা লাগে না। যাদের ন্যূনতম শাস্ত্রজ্ঞান নেই তারাই কেবল একটি মন্ত্রের ভুল অর্থ করে পরমেশ্বরকে সাধারণ রাজা বানিয়ে দিতে পারে। মস্তিকে এতটুকু পরিমাণ বুদ্ধি থাকলে এটা বুঝতো যে কোনো রাজা অনন্ত জগতের পালক হতে পারে না। রাজা নিজের রাজ্য সামলাতে হিমসিম খায়, সেখানে সম্পূর্ণ জগতের পালন করা তো বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর মতো অবস্থা।
আর এখানে “জ্যা খোলা” মানে কোনোভাবেই যুদ্ধ পরিহার নয়, বরং ধনুর্বিদ্যায় এই কাজ ‘প্রস্তুতির অংশ’ অস্ত্র সাজানো, বা জ্যা ঢিলা করে পুনরায় প্রস্তুত হওয়া বোঝায়। শত্রুনাশের প্রেক্ষিতে এটি স্পষ্টতই রুদ্রকে আহ্বান করা, যেন তিনি অস্ত্র ধারণ করেন ও প্রয়োগ করেন। শান্ত হবার প্রার্থনা এখানে সম্পূর্ণভাবে অনুচিত, কারণ একই মন্ত্রে ‘ইষবঃ পরা বপ’ বলা হয়েছে, যার অর্থ শত্রুদের দিকে বাণ নিক্ষেপ। ভাষ্যকারগণও তাই বলেছেন।
🔘মন্ত্রের এই অংশ—
“প্রমুঞ্চ ধন্বনঃ ধনুষঃ উভয়োরাজ্যের জ্যা”
এখানে ‘ধনুষঃ’ বা ধনুক অর্থাৎ অস্ত্র নয়, বরং ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতীক।
🔘মহীধর ভাষ্যে বলা হয়েছে—
“ভাগং ষড্বিধমৈশ্বর্যমস্যাস্তীতি ভগবান।”
অর্থাৎ, ষড্বিধ ঐশ্বর্যের অধিকারী ভগবান। এটি সাধারণ অস্ত্রচালনার নির্দেশ না দিয়ে ঈশ্বরের অলৌকিক ক্ষমতার ব্যাখ্যা।
অতএব, ‘ধনুকের জ্যা খোলা’ কেবল অস্ত্র চালনার নির্দেশ নয়, বরং ঈশ্বরের ক্ষমতা বিস্তারের প্রতীক।
‘ভগবঃ’ শব্দের অর্থ ‘ঈশ্বর্যপূর্ণ’ বা ‘ঈশ্বর’।
‘ইষবঃ’ শব্দ অর্থ ‘বাণ’ যা রুদ্রের প্রচলিত অস্ত্র।
‘ধন্বনঃ’ শব্দ অর্থ ‘ধনুকধারী’, যা রুদ্রের প্রধান অস্ত্র।
এছাড়াও, বাণ ও ধনুকসহ এই সমগ্র মন্ত্রের প্রেক্ষাপটে ‘শত্রু ধ্বংসকারী’ রূপকথন এবং ঐশ্বর্যের বহুবিধ প্রকাশ (মহীধর ভাষ্যে ষড্বিধ ভগবত্বের উল্লেখ) স্পষ্ট করে দেয় যে এটি শুধুমাত্র একটি সাধারণ সেনাপতির সম্বোধন নয়, বরং মহাদেব রূপে রুদ্রের নির্দেশনা।
অতএব, এখানে শিব বা রুদ্রের সরাসরি নাম না থাকলেও, বাক্য ও অস্ত্র-চিহ্ন (ধনুক-বাণ) স্পষ্টভাবেই তাকে নির্দেশ করে।
যদি “বাণ ফেলা” মানে রুদ্রের “শান্ত হওয়া” বা “অস্ত্র ত্যাগ” বোঝানো হয়, তবে কেন একই মন্ত্রে বলা হচ্ছে—
“পরা তা ভগব বপ” অর্থাৎ বাণগুলো নিক্ষেপ করো বা দূর করো?
দুটি বিপরীত অভিপ্রায় অস্ত্র পরিত্যাগ ও শত্রুনাশ একই মন্ত্রে কেন থাকবে?
উবট ও মহীধরের ব্যাখ্যায় বারবার “পরাবপ” (নিক্ষেপ করো) বলা হয়েছে, সেটিকে “নিরস্ত হওয়া” বলার ব্যাকরণিক ভিত্তি কী?
❌অনার্যদের দাবী— এখানে “বাণ ফেলে দেওয়ার” নির্দেশ মিতভাষী অর্থে দেওয়া হয়েছে, যা পৌরাণিক রুদ্র বা শিবের বৈশিষ্ট্য থেকে সরে গিয়ে সাধারণ একটি যোদ্ধা বা সেনাপতির অস্ত্রের প্রতি নির্দেশ করে।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— মিতভাষী” শব্দটি এই মন্ত্রে ব্যবহৃতই হয়নি, বরং এই মন্ত্রে ভাষা সরাসরি, ঋজু ও অনুরোধমূলকভাবে রুদ্রকে অস্ত্র ব্যবহারের জন্য আহ্বান জানায়। এটি কোনো রূপক নয়, শত্রুদের উদ্দেশ্যে বাণ নিক্ষেপের স্পষ্ট নির্দেশ। ভাষ্যকাররাও কোনো জায়গায় এই মন্ত্রকে “শান্তির প্রার্থনা” বলেননি বরং “শত্রুনাশ” ও “ঐশ্বর্যসম্পন্ন ভগবান রুদ্রের” প্রতি আহ্বান বলেই ব্যাখ্যা করেছেন। অতএব, এই দাবিও অসার।
‘ভগবঃ’ শব্দটি মন্ত্রে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং তার অর্থ মহীধর নিজে দিয়েছেন, “ষড়ঐশ্বর্যযুক্ত ইতি ভগবান।” আর সেই ছয়টি ঐশ্বর্য (সম্পূর্ণ ঐশ্বর্য, ধর্ম, যশ, শ্রী, জ্ঞান, বৈরাগ্য) সাধারণ কোনো মানব সেনাপতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই দাবিটি শুধুমাত্র শব্দের মৌলিক অর্থ অস্বীকার করে পৌরাণিক রুদ্রকে লঘু করার একটি চেষ্টামাত্র। ভাষ্যকারদের ভাষ্যই এই দাবিকে বাতিল করে দেয়।
🔘মন্ত্রের অংশ—
“যাশ্চ তে তব হস্তে ইষবঃ বাণাঃ তা ইধুঃ পরাবপ পরাক্ষিপ।”
অর্থাৎ, তোমার হাতে থাকা বাণগুলি শত্রুর উপরে নিক্ষেপ করো।
উবট-মহীধর ভাষ্য অনুযায়ী, এই বাণ শুধুমাত্র অস্ত্র নয়, বরং ঐশ্বরিক শক্তির প্রতীক।
🔘মহীধর ভাষ্য—
“মহদৈশ্বর্য-যুক্ত হে ভগবঃ”
তোমার এই শক্তিশালী বাণগুলো শত্রুর দিকে নিক্ষেপ কর।
রুদ্র বা শিবের বাণ নিক্ষেপ মানে ঐশ্বরিক শক্তি প্রয়োগ ও শত্রুর ধ্বংস, যা মানব অস্ত্রের তুলনায় অনেক উচ্চ।
এখানে ‘বাণ ফেলা’ অর্থে মানব অস্ত্র নিক্ষেপ নয়, শিবের ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রক্ষেপণ।
তাই এটি সাধারণ যোদ্ধার অস্ত্রচালনার নির্দেশ নয়।
‘উভয়োঃ’ অর্থ ‘উভয় প্রান্ত’। ধনুকের দুই প্রান্তের উদাহরণ সাধারণ অস্ত্র নয়, বরং এটি একটি প্রতীকি ভাষা।
রুদ্রের বাণ ধনুকের মতোই শক্তিশালী, দুই প্রান্ত মুক্ত করা অর্থ ‘তৈরি হওয়া’ বা ‘পূর্ণ ঐশ্বর্য’ সঞ্চালনের প্রতীক।
শাস্ত্রীয়ভাবে, ‘ধনুকের প্রান্ত মুক্ত করা’ অর্থ ঐশ্বর্য প্রদর্শনের জন্য শক্তি মুক্ত করা বা অস্ত্র প্রস্তুত রাখা।
তাই এটি সামান্য অস্ত্র চালনার বর্ণনা নয়, বরং ঐশ্বরিক শক্তি প্রয়োগের চিহ্ন।
উবট-মহীধর ভাষ্যে ‘বাণ ফেলা’ স্পষ্টতই ঐশ্বর্যের ছয়টি ভাগ ধারণ করে, যা সাধারণ যোদ্ধার বিষয় নয়।
‘মিতভাষী অর্থ’ অর্থাৎ ‘সুক্ষ্মতর অর্থ’ বলা হলেও এখানে তা রুদ্রের ঐশ্বরিক ঐশ্বর্যের নির্দেশ।
মহীধর ভাষ্যে ‘শত্রু ধ্বংসকারী ঐশ্বর্য’ ও ‘বিধি মোক্ষকারী শত্রু’ ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানো হয়েছে, যে এখানে অস্ত্রচালনার পেছনে পরমাত্মার কার্যক্রম ও অনন্ত শক্তির প্রতীক রয়েছে।
🔘মিতভাষী নিয়ে আরও স্পষ্ট ভাবে বলতে গেলে—
প্রশ্ন— এই মন্ত্রে “মিতভাষী” অর্থ কি করা হয়েছে?
উত্তর— না, করা হয়নি।
এই মন্ত্রে বাণ, ধনুক, জ্যা ইত্যাদি শব্দ ও ক্রিয়াগুলো প্রত্যক্ষ যুদ্ধ ও শত্রুনাশ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।
যেমন—
“প্রমুঞ্চ ধন্বনঃ” = ধনুকের জ্যা খুলো বা অস্ত্র প্রস্তুত করো।
“ইষবঃ” = হাতের বাণ।
“পরা তা বপ, পরাবপ, পরাক্ষিপ” = শত্রুদের দিকে ছুঁড়ো, নিক্ষেপ করো, দূর করো।
এগুলো রূপক বা আভাস নয়, বরং সরাসরি, ঋজু ও স্পষ্ট অনুরোধ যা যুদ্ধপ্রসঙ্গেই মানানসই।
🔘উবট ও মহীধরের ভাষ্যে কী বলা হয়েছে দেখা যাক—
উভয় ভাষ্যকারই রুদ্রকে "ভগবন", অর্থাৎ ষড়্বিধ ঐশ্বর্যসম্পন্ন দেবতা রূপে চিহ্নিত করে বলেছেন। তিনি যেন ধনুকের জ্যা প্রস্তুত করেন (অস্ত্র ধারণ করেন), এবং শত্রুদের প্রতি বাণ নিক্ষেপ করেন।
অর্থাৎ রুদ্রকে এখানে শান্ত হওয়ার অনুরোধ নয়, বরং শত্রুনাশের জন্য সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এই মন্ত্রে "মিতভাষী" অর্থ নয়, বরং সরাসরি যুদ্ধ আহ্বান করা হয়েছে। ভাষ্যকারদের বিশ্লেষণ ও শব্দার্থ অনুযায়ী এটি পরমেশ্বর রুদ্রকে শত্রু নিধনের আহ্বান।
সুতরাং, "রুদ্রকে শান্ত হতে বলেছে", বা "মিতভাষায় বলা হয়েছে" এই দাবি অনার্যদের পক্ষ থেকে করা হলেও তা ভ্রান্ত, ভাষ্য ও প্রকৃত পাঠের পরিপন্থী।
অতএব, এটি পৌরাণিক রুদ্রের প্রকৃত রুদ্রত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
যদি এটি “মিতভাষী অর্থে” হয়, তবে কেন ভাষ্যকার সরাসরি যুদ্ধপ্রসঙ্গ ও শত্রুনাশের উল্লেখ করেছেন? কেন তিনি কোনো শান্তির উপদেশ বা পরিমিত বচন সম্পর্কিত কিছু বলেননি?
যদি ধনুকের জ্যা খোলা মানে অস্ত্র নিষ্ক্রিয় করা বোঝায়, তবে “ইষবঃ” (বাণ) কেন শত্রুদের প্রতি ছোঁড়ার কথা বলা হচ্ছে?
নিষ্ক্রিয় করার সাথে অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ কি সাংঘর্ষিক নয়?
শাস্ত্রীয়ভাবে, ‘জ্যা খোলা’ মানে কি সত্যিই অস্ত্রচালনার পরিহার?
নাকি এটি ধনুক প্রস্তুত বা ধনুৎচ্যু বাণ সঞ্চালনার প্রাক-পর্যায়ের একটি অংশ?
মহীধর যিনি ব্যাখ্যা করেছেন—
“ভগবঃ” = ষড়ঐশ্বর্যযুক্ত ঈশ্বর
তার মতে ধনুক ও বাণও অলৌকিক অস্ত্র। তাহলে কি এদের প্রতীকী অর্থ “ঐশ্বরিক শক্তি প্রয়োগ” নয়?
🔘এই মন্ত্রটি (যজুর্বেদ ১৬.৯) আসলে এক গভীর ও গুরুগম্ভীর প্রার্থনা, যেখানে "রুদ্র" "ভগবান" পরমেশ্বরকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে—
তিনি যেন তাঁর হাতে থাকা বাণ (তীর) ও ধনুকের জ্যা খুলে শত্রুদের উপর নিক্ষেপ করেন বা ধ্বংস করেন।
মূল বিষয়গুলো হল—
ভগবান শব্দটি ব্যবহার করে মন্ত্রে যে রুদ্রের কথা বলা হয়েছে, তিনি কোনো সাধারণ রাজা বা সেনাপতি নন, তিনি ষড়ঐশ্বর্যযুক্ত, অর্থাৎ জ্ঞান, বৈরাগ্য, ঐশ্বর্য, ধর্ম, যশ, শ্রী, এই ছয় গুণে বিভূষিত একমাত্র পরমেশ্বর।
"বাণ ফেলে দাও" এ কথার অর্থ কখনোই ‘শান্ত হয়ে যাও’ নয়, বরং ভাষ্যকারদের মতে এর মানে হলো:
“শত্রুদের উপর ঐশ্বরিক শক্তির প্রয়োগ করো”।
এখানে শত্রু বলতে সাধারণ কোনো মানুষের শত্রু নয়, বরং তারা হলো ধর্মের বিরোধিতা করা শক্তি, অজ্ঞতা, অহংকার, কাম, মোহ ইত্যাদি, যেগুলো পরমাত্মা-সাধনার পথে বাধা দেয়।
যেহেতু উবট ও মহীধর, দুই ভাষ্যকারই রুদ্রকে "ভগবান" বলেছেন এবং মন্ত্রের প্রতিটি পদে ঐশ্বর্য, শক্তি ও নিয়ন্ত্রণ প্রকাশ পেয়েছে, তাই এই মন্ত্রকে কেবল একটি সাধারণ যোদ্ধার সম্বোধন বলে দেখা ভুল।
অনার্যদের মতানুযায়ী এখানে যদি "মিতভাষায়" বা "আভাসে" কিছু বোঝানো হতো, তবে ভাষ্যকাররা সেটা প্রকাশ করতেন। বাস্তবে তারা সরাসরি বলেছেন- "ধনুকের জ্যা খোলো", "বাণ ছুড়ো", "শত্রু দূর করো" যা একটি সক্রিয়, প্রতিরক্ষামূলক ঈশ্বরীয় আহ্বান।
🔘এই মন্ত্র রুদ্রকে শান্ত না হয়ে বরং শত্রু দমনকারী পরমেশ্বর রূপে আহ্বান করেছে। তিনি কেবল রুদ্র নন, তিনি ভগবান রুদ্র, যিনি ঐশ্বর্যের অধিকারী এবং দুষ্ট শক্তির বিনাশকারী। এভাবেই এই মন্ত্রের প্রকৃত অর্থ রক্ষা করে এবং রুদ্রের পরমাত্মা-স্বরূপ প্রতিষ্ঠা করে।
তাই ‘রুদ্রকে শান্ত হতে বলা হয়েছে’, বা ‘এটি কোনো রাজাকে উদ্দেশ করে’ এমন অনার্য দাবি ভাষ্যকারদের ব্যাখ্যা ও শ্রুতির প্রকৃত রচনার পরিপন্থী ও ভ্রান্ত।
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী —
বিজং ধনুকপির্দিনো বিশাল্ল্যো বাণবাংউত।
অনে শন্নস্য যাহইষব আভূরস্য নিষঙ্গধি৷৷১০৷৷
ভাষ্যার্থঃ হে ধনুর্বেদ জ্ঞাত পুরুষ! (অস্য) এই (কপর্দ্দিনঃ) প্রসংশিত জটাজুট ধারণকারী সেনাপতির (ধনুঃ) ধনুক (বিজ্যম) প্রত্যঞ্চা রহিত না হোক তথা এই (বিশল্যঃ) বাণের অগ্রভাগ থেকে রহিত এবং (আভূঃ) আয়ুধ থেকে খালী না হোক (উত) এবং (অস্য) এই অস্ত্র শস্ত্রের ধারণ কারী সেনাপতি কে (নিষঙ্গধিঃ) বাণাদি শস্ত্রাস্ত্র কোষ খালি না হোক তথা (বাণবান) বহু বাণ দ্বারা যুক্ত হোক (যাঃ) যে (অস্য) এই সেনাপতির (ইষবঃ) বাণ (অনেশন) নষ্ট হয়ে যাবে, তখন তাহাকে তোমরা নতুন দাও।
নোটঃ এই মন্ত্রে মহিধর এবং উব্বট অর্থ করেছে যে, জটাজুটধারীর রুদ্রের ধনুর জ্যা রহিত হোক, তাহার বাণের অগ্রভাগ রহিত হোক, বাণগুলো নষ্ট হোক ও তুণীর শূণ্য হোক"। এবং শেষে বলেছেন - "রুদ্র অস্মান্ প্রনিন্যস্তসর্ব শস্ত্ররিত্বত্যর্থঃ" অর্থাৎ রুদ্র আমাদের জন্য সমস্ত শস্ত্র রহিত হোক।
❌অনার্যদের দাবী— এই মন্ত্রে ‘কপর্দিনঃ’ অর্থাৎ জটাধারী বলে উল্লেখ থাকলেও, সেটি শিব বা কোনো দেবতা নয়, বরং জটাধারী কোনো সাধারণ যোদ্ধা বা সেনাপতি। অতএব, এটি শিবের নির্দেশ নয় বরং একজন অস্ত্রধারীর প্রতি নির্দেশ।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— জটাধারী বলতে যদি শিব না হয় তবে, সম্পূর্ণ শতরুদ্রীয়তে রুদ্রটা কে? যিনি, জটাধারী, পরমেশ্বর পদবাচ্য জগতের অধীশ্বর? সম্পূর্ণ অধ্যায়টিতে যে সত্য উল্লেখ রয়েছে তা এড়িয়ে গিয়ে আড়াল করে কেবল একটি মন্ত্রের অর্থ বিকৃত করলে কি সম্পূর্ণ অধ্যায়ের অর্থ বদলে যাবে ?
আবার এই জটাজুটধারী নিয়ে ঋগ্বেদ বলছে—
ইমা রুদ্রায় তবসে কপর্দিনে ক্ষয়দ্বীরায় প্র ভরামহে মতীঃ ।
যথা শমসদ দ্বিপদে চতুষ্পদে বিশ্বং পুষ্টং গ্রামে অস্মিন্ননাতুরম্ ॥
[ঋগবেদ/১/১১৪/১]
আমরা এই প্রার্থনাগুলি নিবেদন করি বলশালী, জটাজুটধারী রুদ্রের প্রতি, যিনি শত্রু নিধনকারী বীরদের অধিপতি। যেন এই সমাজে সমস্ত মানুষ ও পশু শান্তিতে, সুস্থভাবে ও কষ্টহীনভাবে বাস করতে পারে।
🔘এই মন্ত্রের ভাষ্যে আচার্য সায়ণ বলছেন—
রুদ্রায় । রোদয়তি সর্বমন্তকালে ইতি রুদ্রঃ।"
যার প্রলয়ের সময় সমস্ত সৃষ্টি নষ্ট ও বিলীন করে দেয়, তাকে রুদ্র বলা হয়। রুদ্র সর্বশক্তিমান, যিনি সৃষ্টির আরম্ভ ও সমাপ্তি, অতএব ঈশ্বর।
"যদ্বা । রুত্- সংসারখ্য দুঃখ। তৎ দ্রাবয়তি, অপগময়তি, বিনাশয়তি ইতি রুদ্রঃ।"
‘রুত্’ মানে- সংসারজনিত দুঃখ। তিনি এই দুঃখগুলো দূর করেন, হ্রাস করেন, সম্পূর্ণ বিনাশ করেন।
দুঃখনাশক রুদ্র, সৃষ্টির দায়মুক্ত ঈশ্বর।
"যদ্বা । রুতঃ = শব্দরূপাঃ উপনিষদঃ… তামুপাসকেভ্যঃ রাত্রি দদাতি ইতি রুদ্রঃ।"
‘রুত্’ বলতে বোঝানো হচ্ছে, বেদের ‘শব্দ’ বা উপনিষদের জ্ঞান। রুদ্র সেই জ্ঞান ভক্তদের দেন। তিনি আত্মবিদ্যার দাতা ঈশ্বর, নিরুপম এক জীবনীশক্তি।
“তবসে প্রবৃদ্ধায় কপর্দিনে জটিলায়…"
এখানে ‘কপর্দি’ অর্থাৎ জটাযুক্ত, ‘জটিল’ বারী-জটাযুক্ত। রুদ্র সেই জটাধারী তপস্বী, যিনি শিবরূপে কঠিন সাধনায় আবদ্ধ।
ঈশ্বররূপে রুদ্র, কারণ তিনি সৃষ্টির প্রলয়কারী, দুঃখনাশক, আত্মবিদ্যার দাতা উচ্চতম শক্তি।
জটাধারী রূপে রুদ্র, কারণ তিনি তপস্যাশীল, ‘জটা ও কপর্দি’ যুগল রূপে সেই শিব।
👉আরও বলা আছে—
দিভো বরাহম্ অরুষং কপর্দিনং ত্বেষং রূপং নমসা নি হ্বয়ামহে ।
হস্তে বিভ্রদ্ ভেষজা বার্ষাণি শর্ম বর্ম ছর্দিরস্মভ্যং যৎসৎ ॥
[ঋগবেদ/১/১১৪/৫]
আমরা নমস্কারপূর্বক আহ্বান করি সেই রক্তবর্ণ, উজ্জ্বল, জটাধারী ও প্রভূত তেজময় রূপধারী রুদ্রকে, যিনি স্বর্গ থেকে প্রকাশিত হন। যাঁর হাতে রোগনাশক ওষধি আছে, তিনি আমাদের শান্তি, রক্ষা এবং আশ্রয় প্রদান করুন, যা কল্যাণকর ও শুভ।
🔘এই মন্ত্রের ভাষ্যে আচার্য সায়ণ বলছেন—
অরুষম্ আরোচমানং কপর্দিনং জটাভির্যুক্তং স্বেষং তেজসা দীপ্যমানং রূপং নিরূপণীয়ং বেদান্তৈরধিগম্যম্ এবংভূতং রুদ্রং নমসা হবির্লক্ষণেনঅন্নেন নমস্কারেণ বা দিবঃ দ্যুলোকে-সকাশাৎ নিঃস্বয়ামহে নিতরামাহৃযামঃ।
আমরা সেই রুদ্রকে গভীর শ্রদ্ধা ও অন্নদ্বারা (হবিরূপে) অথবা নমস্কার দ্বারা আহ্বান করি, যিনি অরুণবর্ণের, দীপ্তিমান, কপর্দি অর্থাৎ জটাজুটধারী, জটায় যুক্ত,
নিজস্ব তেজে দীপ্তিময়, যাঁর রূপ বৈদান্তিক জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধ ও নিরূপণযোগ্য, এবং যিনি ঐশ্বর্যপূর্ণ রূপে প্রকাশিত হয়েছেন। তাঁকে আমরা দ্যুলোক থেকে (স্বর্গ থেকে) সর্বশক্তি দিয়ে আহ্বান করি, যেন তিনি আমাদের কাছে আসেন।
“কপর্দিনং জটাভির্যুক্তং”
এখানেই সরাসরি বলা হয়েছে রুদ্র জটাজুটযুক্ত, যা তাকে শিব রূপেই চিহ্নিত করে।
“বেদান্তৈঃ অধিগম্যম্”
বোঝানো হয়েছে, রুদ্র কেবল বাহ্যদৃষ্টি নয়, বরং বেদান্ত দ্বারা অনুধাবনযোগ্য, অর্থাৎ তিনি পরম ব্রহ্ম বা ঈশ্বর।
এখানে রুদ্রকে শিব ও ঈশ্বরস্বরূপ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যিনি তেজোময়, জটাজুটধারী এবং জ্ঞেয়।
তাহলে এখানে যে রুদ্রের কথা বলা হচ্ছে তিনি কি ভিন্ন কেউ? এখানেও স্পষ্ট ভাষায় বলা হচ্ছে জটাজুটধারী রুদ্র, যার আছে প্রার্থনা করা হচ্ছে যাতে দ্বিপদ ও চতুষ্পদী সকল জীব সুস্থভাবে থাকে। শ্রুতিতে এমন কোন রাজা/সেনাপতি আছে, যিনি দ্বিপদ ও চতুষ্পদ জীবের কল্যাণ কর্তা? এখানেও কপর্দী শব্দ আছে এবং যে রুদ্রের নিকট প্রার্থনা করা হচ্ছে, হব্য প্রদান করা হচ্ছে তিনি পরমেশ্বরই। তাহলে কি এখানেও অর্থের অনর্থ করে জটাজুটধারী রুদ্রকে সাধারণ রাজা/সেনাপতি বানিয়ে দেবেন? নাকি বলবেন যজুর্বেদের রুদ্র ও ঋগবেদের রুদ্রের মধ্যে পার্থক্য আছে? এবার যজুর্বেদ এর উক্ত মন্ত্রের উবট-মহীধর ভাষ্য দেখে নেওয়া যাক।
🔘উবট ভাষ্য—
“কপর্দোঽস্য জটাবন্ধঃ”
অর্থাৎ যার জটা বা জটাবন্ধ রয়েছে, তিনি কপর্দী।
এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, "কপর্দী" মানেই এমন ব্যক্তি যিনি জটা বা জটাজুট ধারণ করেন। ঋগ্বেদ থেকে শুরু করে সমস্ত বৈদিক সাহিত্যে "কপর্দী" শব্দটি রুদ্র-শিবের নামরূপেই প্রতিষ্ঠিত। এই নাম কোনো সাধারণ সেনাপতির ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়নি।
🔘মহীধর স্পষ্ট বলেছেন—
"কপর্দঃ জটাজুটঃ অস্য আস্তীতি কপর্দী রুদ্রঃ"
অর্থাৎ, যার জটাজুট আছে তিনিই কপর্দী, আর এই কপর্দী হলেন রুদ্র। ভাষ্যকার এখানে কেবল একটি বাহ্যিক লক্ষণ (জটা) দিয়ে নয়, বরং ‘কপর্দী’ শব্দের অর্থ ও বৈদিক প্রেক্ষাপটের আলোকে পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন যে, এটি কোনো সাধারণ সেনাপতি নয়, বরং রুদ্র দেবতা স্বয়ং।
অতএব, মন্ত্রে উল্লেখিত কপর্দী মানেই শিব বা রুদ্র। কেবল ‘জটা’ থাকলেই সাধারণ পুরুষ ধরে নেওয়া অজ্ঞতার পরিচয়। কেবলমাত্র "জটা" বা বাহ্যিক চিহ্ন দিয়ে কাউকে বিচার করা যায় না, তা বৈদিক প্রেক্ষাপটে আরও অনর্থ করে দেয়। "কপর্দী" রুদ্র কোন ব্যক্তি নন, তিনি ঈশ্বরস্বরূপ, যিনি দুঃখনাশক, জ্ঞানদাতা, এবং তেজোময় রূপে স্বর্গ থেকে আহ্বানযোগ্য।
যদি কপর্দী কেবলমাত্র জটাধারী একজন সাধারণ যোদ্ধা বা সেনাপতি হন, তাহলে কেন ঋগ্বেদ (১.১১৪.১ ও ১.১১৪.৫)-এ তাঁকে "শত্রু নিধনকারী", "তেজোময়", "রোগনাশক", "দ্যুলোক থেকে আহ্বানযোগ্য", "দ্বিপদ ও চতুষ্পদ জীবের রক্ষক", এবং “বেদান্ত দ্বারা অনুধাবনযোগ্য পরম সত্তা” বলা হয়েছে? সাধারণ মানুষ কি বেদান্ত দ্বারা উপলব্ধ হয়?
রুদ্রকে যদি সেনাপতি হিসেবে ভাবা হয়, তাহলে কেন তিনি হাতে "ভেষজ" বা রোগনাশক ওষুধ ধারণ করছেন (ঋগ্বেদ ১.১১৪.৫)? কেন তাঁকে প্রার্থনা করা হচ্ছে যেন তিনি রক্ষা করেন, আশ্রয় দেন, শান্তি দেন?
কোন রাজা বা সেনাপতি রোগনাশক ভেষজ ধারণ করেন এবং ঈশ্বরের মতো কল্যাণ কামনা লাভ করেন?
কপর্দী শব্দটি যদি সাধারণের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য হয়, তাহলে কেন এই নামটি শুধুমাত্র রুদ্রের ক্ষেত্রেই বৈদিক সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে? অন্য কোনো যোদ্ধা, রাজা বা সাধারণ ব্যক্তি কি কখনো "কপর্দী" নামে সম্বোধিত হয়েছেন বৈদিক মন্ত্রে? ‘কপর্দী’ নামটির একচেটিয়া ব্যবহার রুদ্রের ক্ষেত্রে কেন?
যদি ঋগ্বেদ ও যজুর্বেদের রুদ্র পৃথক ব্যক্তি হন বলে তারা দাবি করেন, তাহলে কি তারা শাস্ত্রের ঐক্যতান স্বীকার করেন না? এই ‘শ্রুতি-সংঘাত’ এর দায় তারা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
একাধিক বেদে একরূপ রুদ্র, একই গুণবিশিষ্ট এবং একই নামবিশিষ্ট একে কি কেবল কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে?
❌অনার্যদের দাবী— এই মন্ত্রে রুদ্রের ধনুকের জ্যা, বাণ ও তূণীর নিঃশেষ হওয়ার প্রার্থনা করা হয়েছে। কাজেই রুদ্র এখানে বন্দনীয় দেবতা নন, বরং তাঁর হাত থেকে অস্ত্র হরণযোগ্য বা অস্ত্রচ্যুত একজন ভয়ংকর অস্ত্রধারী রূপে চিত্রিত।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— এই মন্ত্রটি সোজাসুজি রুদ্রকে বন্দনা করে তাঁর ক্রোধ প্রশমনের প্রার্থনা, যাতে তিনি শান্ত হয়ে যান ও জীবগণ রক্ষা পায়। এটি আত্মরক্ষামূলক উপাসনা, রুদ্রের পরম শক্তি স্বীকৃতির প্রকাশ। তাই বলা হয়েছে—
🔘উবট ভাষ্য—
“রুদ্র অস্মান্ প্রতি ন্যস্তসর্বশস্ত্রঃ”
অর্থাৎ, রুদ্র যেন আমাদের প্রতি তাঁর সমস্ত অস্ত্র পরিত্যাগ করেন।
এখানে "ধনুকের জ্যা মুক্ত হওয়া", "বাণ নিঃশেষ হওয়া", "তূণী খালি হওয়া" ইত্যাদি কোনো অপমান নয়, বরং রুদ্রের ভয়ংকর রূপ শান্ত করার জন্য প্রার্থনা। এটি শান্তির জন্য পূজার অংশ।
🔘মহীধর ভাষ্য—
“রুদ্রঃ অস্মান্ প্রতি ন্যস্তসর্বশস্ত্রঃ অস্তু ইত্যর্থঃ"
রুদ্র যেন আমাদের প্রতি সমস্ত অস্ত্র ত্যাগ করেন।
এটি কোনো অবমাননামূলক বাক্য নয়, বরং শান্তিমন্ত্র, যেমন, যখন কোনো রাজাকে শান্ত করবার জন্য প্রজারা তাকে নমস্কার জানায় ও “আপনার কোপ প্রশমিত হোক” বলে।
অতএব, এই মন্ত্রে রুদ্রকে অপমান করা হয়নি, বরং তাঁকে অতিমাত্রায় শক্তিমান, অস্ত্রে সজ্জিত দেবতা হিসেবেই মান্য করা হয়েছে, যার দয়ার আশায় প্রার্থনা করা হচ্ছে।
এই মন্ত্রে রুদ্রকে অসম্মান নয়, বরং তাঁর অপরিসীম শক্তি ও প্রতাপে শান্তির প্রার্থনা করা হয়েছে। তিনি যেহেতু শাস্তিকর্তা, বিধ্বংসী এবং অস্ত্রে সজ্জিত, তাই তাঁর করুণা ও শান্ত স্বরূপ কামনা করাই যথার্থ ভক্তির প্রকাশ। অন্যথায়, একটি মন্ত্রে অস্ত্রধারী রুদ্রের করুণা প্রার্থনা ও শতরুদ্রীয় জুড়ে রুদ্রের বন্দনার মধ্যে সাংঘর্ষিকতা তৈরি হতো, যা শ্রুতির ঐক্য নষ্ট করত।
যদি কোনো ব্যক্তি 'অস্ত্রচ্যুত হবার যোগ্য' মাত্র একজন ভয়ংকর অস্ত্রধারী হন, তাহলে কেন তাঁর প্রতিই শান্তির জন্য প্রার্থনা করা হবে? অর্থাৎ, কেন বলা হচ্ছে—
"রুদ্র, আপনার ধনুকের জ্যা খুলে দিন, আপনার বাণ নিঃশেষ হোক, তূণী শূন্য হোক, আমাদের প্রতি অস্ত্র প্রয়োগ করবেন না"? এই প্রার্থনা তো তখনই সম্ভব, যখন রুদ্র অতুল প্রতাপশালী, ভয়ংকর এবং ক্ষমতাশালী, এবং সেইজন্য তাঁর করুণা প্রার্থনীয়। কেউ কি কখনও দুর্বল বা অবমাননীয় কারও কাছে শান্তির আশায় প্রার্থনা করে?
যদি রুদ্র এখানে ‘অবমাননীয়’ বা 'অস্ত্রচ্যুতির উপযুক্ত' ব্যক্তি হন, তাহলে কেন উবট ও মহীধর ভাষ্যকার একে ‘বিনয়ের প্রার্থনা’ এবং ‘রাজধর্মীয় শান্তি প্রার্থনার মতো’ উপাসনা বলে ব্যাখ্যা করেছেন? অর্থাৎ তারা স্পষ্টভাবে বলেছেন, এটি কোনো হীন বক্তব্য নয় বরং আত্মসমর্পণের এক প্রার্থনামূলক আবেদন, যেখানে রুদ্র ঈশ্বরতুল্যভাবে সমীহযোগ্য।
সাধারণ কারও প্রতি কি এমন ভাষ্য রচিত হয় বৈদিক শাস্ত্রে?
❌অনার্যদের দাবী— মহীধর-উব্বট ভাষ্যকারও স্বীকার করেছেন যে, এই মন্ত্রে রুদ্রের সব অস্ত্র যেন হরণ করা হয়। এটি ঈশ্বরোপাসনার প্রার্থনা নয়, বরং ভয় দূরীকরণের জন্য এক প্রতিরক্ষামূলক কৌশল। সুতরাং, এই রুদ্র পূজ্য দেবতা নয়।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— উভয় ভাষ্যেই বলা হয়েছে, রুদ্রকে শান্তরূপে চাওয়া হচ্ছে। এখানে রুদ্রের অস্ত্রনাশ নয়, তাঁর করুণা ও শান্তি কামনা করা হচ্ছে। রুদ্র যখন ক্রোধে অগ্নিশর্মা, তখন তাঁর অস্ত্র ভয়ংকর। তাই ভক্ত সেই অস্ত্র নিষ্ক্রিয় করে তাঁর আশ্রয় চান। অনার্যদের এইটুকুও জ্ঞান নেই যে, ত্যাগ করা আর হরণ করার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। যজমান রুদ্রের নিকট প্রার্থনা করে বলছে অস্ত্র ত্যাগ করতে, যাতে সেই ভয়ানক অস্ত্র দ্বারা তাদের কোনো ক্ষতি না হয়। এই শতরুদ্রীয় অধ্যায়ে যেমন রুদ্রকে মঙ্গলময় স্বরূপে স্তুতি করা হয়েছে, তেমনি, উগ্র, ভীম, সংহারকারী স্বরূপেও স্তুতি করা হয়েছে। ভয় দেখানো নয়, বরং রুদ্রের এসব গুণই স্তুত হয়েছে। তাই প্রেক্ষাপট না বুঝে যা তা অর্থ করলে তা কদাপি মান্যতা পাবে না।
🔘শতরুদ্রীয় এর ৪০ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে—
“নমঃ উগ্রায় চ ভীমায় চ। নমঃ অগ্রে বধায় চ দূরে বধায় চ নমো হন্ত্রে চ হনীয়সে চ”।।
👉উবট ভাষ্য—
নম উগ্রায় চ ভীমায় চ । উগ্র উদূর্ণঃ । ভীমো ভীষণঃ ।
নমোঽগ্রেবধায় চ দূরেবধায় চ । অমেস্থিতো হন্তি অগ্রেবধঃ । দূরস্থিতো হন্তি দূরেবধঃ ।
নমো হন্ত্রে চ হনীয়সে চ । হন্তীতি হন্তা হনীয়ান্ হন্তৃতমঃ ।
অর্থ— আমি প্রণাম করি সেই উগ্র রুদ্রকে, যিনি প্রচণ্ড শক্তিসম্পন্ন, আমি প্রণাম করি সেই ভীম রূপে রুদ্রকে, যিনি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। আমি প্রণাম করি অগ্রেবধ রূপে রুদ্রকে, যিনি সামনে থেকে শত্রু নিধন করেন, এবং দূরেবধ রূপে রুদ্রকে, যিনি দূর থেকে শত্রু ধ্বংসে সক্ষম। আমি প্রণাম করি হন্তা রূপে রুদ্রকে, যিনি হত্যা করেন, আরও প্রণাম করি হনীয়স রূপে, যিনি সবার মধ্যে শ্রেষ্ঠ, সর্বোৎকৃষ্ট হত্যাকারী রূপে প্রতিষ্ঠিত, যিনি ধ্বংসের পরাকাষ্ঠা।
👉মহীধর ভাষ্য—
উগ্র উদূর্ণায়ুধঃ শত্রূন্ হন্তুং তস্মৈ। ভীমঃ শত্রুভয়োৎপাদকঃ। অগ্রে পুরো বর্তমানো হন্তীত্যগ্রেবধঃ তস্মৈ। দূরে বর্তমানো হন্তীতি দূরেবধঃ তস্মৈ । হন্তীতি হন্তা তস্মৈ। লোকে যো হন্তি তদ্রূপেণ রুদ্র এব হন্তীত্যর্থঃ। অতিশয়েন হন্তা হনীয়ান্ তস্মৈ ।
“তুরিষ্ঠেমেয়ঃসু” (পা. ৬।৫।১৫৪) ইতি তৃচো লোপঃ ।
প্রলয়ে সর্বহন্তেত্যর্থঃ ।
অর্থ— রুদ্র সেই উগ্র, যাঁর হাতে ভয়ংকর অস্ত্র, যিনি শত্রুদের বিনাশ করেন। তিনি সেই ভীম, যিনি শত্রুদের অন্তরে তীব্র ভয় জাগান। তিনি অগ্রেবধ, যিনি সম্মুখ থেকে শত্রু নিধন করেন, আর দূরেবধ, যিনি বহু দূরে থেকেও নিখুঁত ধ্বংস করতে পারেন। তিনি হন্তা, কারণ তিনিই প্রকৃত হত্যাকারী। তিনি হনীয়স, কারণ তিনি সর্বোৎকৃষ্ট, অতিশয় ধ্বংসকারী, আর প্রলয়ের সময় তিনিই সর্ববিধ সৃষ্টিকে ধ্বংস করেন (“তুরিষ্ঠেমেয়ঃসু” এই পাণিনি সূত্র অনুযায়ী তৃচ্ প্রত্যয়ের লোপে 'হনীয়স' শব্দ গঠিত হয়েছে। অর্থাৎ “সবচেয়ে বেশি যিনি হন্তা” এই অর্থ প্রকাশ পায়), এইরূপ রুদ্রকে প্রণাম।
উবট— রুদ্রকে উগ্র, ভীম, অগ্রেবধ, দূরেবধ, হন্তা, হনীয়স রূপে বর্ণনা করে প্রণাম করেছেন।
মহীধর— রুদ্রকে শত্রুবিনাশকারী, বিশ্বহন্তা, প্রলয়ের সর্বহন্তা বলে পূজিত করেছেন।
এই মন্ত্রে রুদ্রের ভয়ংকর ও শান্ত উভয় রূপেই তাঁকে মঙ্গলকামী শক্তি হিসেবে বন্দনা করা হয়েছে। রুদ্র ভক্তের পক্ষে ভয়ংকর নন, বরং তাঁর শত্রুদের জন্যই ভয়ংকর।
যে মন্ত্রে বারবার "নমঃ" শব্দের মাধ্যমে রুদ্রকে প্রণতি জানানো হয়েছে, সেখানে তাঁকে অবৈধ বা অপূজ্য বলা একেবারেই যুক্তিহীন। রুদ্র পূজ্য, কারণ তিনি সৃষ্টির রক্ষাকর্তা, শত্রুর সংহারক ও প্রলয়ের দেবতা, ভয়ংকর হলেও করুণাময়। এটি ঈশ্বরোপাসনারই এক গভীর রূপ, যেখানে তাঁর রুদ্রত্ব (সংহারশক্তি) কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকৃত ও বন্দিত।
🔘আবার শতরুদ্রীয় এর ৪১ নং মন্ত্রে পরমেশ্বর রুদ্রকে শান্ত মঙ্গলময় স্বরূপেও স্তুতি করা হয়েছে—
“নমঃ শম্ভবায় চ ময়োভবায় চ। নমঃ শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ। নমঃ শিবায় চ শিবতয়ার চ।।”
👉উবট ভাষ্য—
নমঃ শং ভবায় চ ময়ো ভবায় চ। ‘শম উপশমে’। আস্য। শং সুখনাম। শম্ভাবয়তীতি শম্ভবঃ। যদ্বা। শমা সুখেন বা ভাবয়তীতি শম্ভবঃ। শং চ আনন্দরূপশ্চ। কালদেশানবচ্ছিন্নং ভবনং তচ্ছক্তিশ্চ। আনন্দবিজ্ঞান ইত্যর্থঃ। ইয়মেব ব্যাখ্যা ময়োভুবশব্দস্য। নমঃ শংকরায় চ ময়স্করায় চ। শং করোতীতি শংকরঃ। ময়ঃ করোতীতি ময়স্করঃ। নমঃ শিবায় চ শিবতারায় চ। শিবঃ শান্তো নির্বিকারঃ। শিবতারস্ততোঽপ্যধিকো নিরতিশয়সর্বজ্ঞবীজঃ ॥ ৪১ ॥
👉মহীধর ভাষ্য—
শং সুখং ভবত্যস্মাদিতি শম্ভবঃ। যদ্বা শং সুখরূপশ্চাসৌ ভবঃ সংসাররূপশ্চ মুক্তিরূপো ভবরূপশ্চ তস্মৈ। ময়ঃ সুখং ভবত্যস্মান্ময়ো ভবঃ সংসারসুখপ্রদঃ তস্মৈ। শং লৌকিকসুখং করোতি শংকরঃ তস্মৈ। ময়ো মোক্ষসুখং করোতি ময়স্করঃ তস্মৈ। স্রকচন্দনাদিরূপেণ লৌকিকসুখকারিত্বং শাস্ত্রাদিরূপেণ জ্ঞানপ্রদত্বান্মোক্ষসুখকারিত্বমিত্যর্থঃ। এতাভ্যাং পদাভ্যাং সাক্ষাৎসুখকারিত্বং পূর্বপদাভ্যাং তদ্দ্বারা কারয়িতৃত্বমিতি বিবেকঃ। শিবঃ কল্যাণরূপো নিষ্পাপঃ তস্মৈ ।
শিবতারোঽত্যন্তং শিবো ভক্তানপি নিষ্পাপান্করোতি তস্মৈ। অস্যাং কণ্ডিকায়াং ষড়্ যজুঁষি পূর্বস্যাং দশোক্তেঃ ॥ ৪১ ॥
ভাষ্যনুযায়ী এই মন্ত্রে রুদ্রকে তাঁর সৌম্য, শান্ত, জ্ঞানময় ও কল্যাণময় রূপে প্রণাম জানানো হয়েছে। তিনি শুধুই ভয়ঙ্কর নয়, বরং এমন এক শান্তিপ্রদ, মোক্ষদাতা, ভক্তহিতৈষী দেবতা, যিনি ভক্তের দেহ-মন-আত্মা সব কিছুকে প্রশান্ত করেন, সংসারেও সুখ দেন, আবার মুক্তির পথেও পৌঁছে দেন।
রুদ্র এখানে "ভয়" নন, বরং "ভরসা"। তিনি শত্রুহন্তা নন শুধু , তিনি শরণাগতরক্ষক, মুক্তিদাতা, কল্যাণময় ঈশ্বর।
🔘১০ নং মন্ত্রেও মহীধর বলেন—
“রুদ্রঃ... খঙ্গরহিতঃ অস্তু... আস্মান্ প্রতি ন্যস্তসর্বশস্ত্রঃ অস্তু।”
পূজার এই কৌশল শত্রু নিধন নয়, শান্তি ও কল্যাণের জন্য দেবতাকে শান্তরূপে কল্পনা করা। এমনকি পৌরাণিক যুগে শিবকে ‘পিনাকপাণি’ রূপে বন্দনা করা হলেও ‘শান্তম্ শিবম্ সুন্দরম্’ বলে তাঁর কল্যাণভাবনাও কাম্য।
🔘যেখানে রুদ্র, একাধারে ভয়ংকর সংহারক, আবার স্নেহময় শান্তদাতা। অনার্যদের যাঁরা এই স্তবকে রুদ্রের অস্ত্রনাশের কৌশল বলে অপপ্রচার করেন, তাঁদের বক্তব্য শুধুমাত্র অবিচার নয়, বরং অজ্ঞতারই পরিচায়ক।
তাঁদের আপাত যুক্তির জবাব উবট ও মহীধরের সংস্কৃত ভাষ্যেই সুস্পষ্টভাবে আছে। ৪০ নং মন্ত্রে, যেখানে রুদ্রের উগ্রতা, ভীমতা ও বিশ্বসংহারক রূপের প্রশস্তি হয়েছে, সেখানে 'নমঃ' শব্দের পুনঃপুন ব্যবহার প্রমাণ করে, এটি পরাভব নয়, প্রকৃষ্ট পূজা।
৪১ নং মন্ত্রে রুদ্রের শান্ত, আনন্দদায়ক, মুক্তিদাতা রূপে তাঁকে ‘শম্ভব’, ‘ময়োভব’, ‘শঙ্কর’, ‘ময়স্কর’, ‘শিব’, ‘শিবতার’ এইসব নাম ধরে আত্মার পরম আশ্রয় বলে বন্দনা করা হয়েছে। এখানে রুদ্র পূজ্য, কারণ তিনি—
ভক্তের সুখের উৎস (শম্ভব)।
সংসারসুখের দাতা (ময়োভব)।
জাগতিক কল্যাণের জনক (শঙ্কর)।
মোক্ষের পথপ্রদর্শক (ময়স্কর)।
নিষ্পাপ, নির্বিকার ঈশ্বর (শিব)।
ভক্তকে পরিশুদ্ধকারী (শিবতার)।
এই রুদ্রই যুদ্ধক্ষেত্রে ভীম, প্রলয়ের সময় হনীয়স, আবার ভক্তের চেতনায় শান্তম্ শিবম্ সুন্দরম্।
রুদ্রের অস্ত্র ত্যাগে তাঁর শক্তি কমে না, বরং তাঁর করুণা উজ্জ্বল হয়। ভক্ত সেই রুদ্রকেই আহ্বান করেন, হে দেব, হিংসা নয়, হিত করো, ভয় নয়, ভরসা দাও।
সুতরাং, অনার্য পক্ষের বিভ্রান্তি দূর করে একথা স্পষ্টভাবে বলা যায়, রুদ্র কখনো অপূজ্য নন।
তিনি পূজ্য, কারণ তিনি বিধাতা, সংহারক ও করুণাময় ত্রাতা। তিনি ভয়ংকর, কিন্তু ভক্তের পক্ষে, ভয়ের নয়, নির্ভরতার নাম।
যে মন্ত্রে রুদ্রকে ‘উগ্র’, ‘ভীম’, ‘হন্তা’, ‘হনীয়স’ ইত্যাদি ভয়ংকর রূপে বর্ণনা করেও বারবার ‘নমঃ’ শব্দ দ্বারা বন্দনা করা হয়েছে, তাঁকে কি ‘অপূজ্য’ বলা কোনোভাবেই বৈদিক প্রেক্ষিতে গ্রহণযোগ্য?
“নমঃ” মানেই প্রণাম, উপাসনা ও শ্রদ্ধা।
তাহলে কেন উপাসক রুদ্রকে ভয় না পেয়ে তাঁরই শরণাপন্ন হচ্ছেন?
যদি তিনি শুধুই ‘ভয়’ হতেন, তবে ভক্ত ‘ভরসা’ কোথা থেকে পেতেন?
যদি রুদ্রকে অস্ত্রহীন করার অর্থ হয় তাঁর শক্তি হরণ, তবে শতরুদ্রীয়ের পরে কেন ৪১ নং মন্ত্রে তাঁকেই ‘শম্ভব’, ‘শঙ্কর’, ‘শিব’, ‘ময়স্কর’, ‘শিবতার’ এইসব শান্ত ও কল্যাণময় রূপে পূজা করা হচ্ছে? এটা কি প্রমাণ করে না, অস্ত্রত্যাগ মানেই শান্তির আহ্বান, শক্তিহীনতা নয়? বরং এতে বোঝা যায়, ভক্ত নিজেই রুদ্রকে শান্তভাবে ডাকছেন, যেন তাঁর প্রলয়কারী রূপ রক্ষা ও আশীর্বাদময় রূপে পরিণত হয়।
উবট ও মহীধর ভাষ্যকার যাঁরা শাস্ত্রজ্ঞ, তাঁরা যদি স্পষ্টভাবে বলে থাকেন যে, এই প্রার্থনা রুদ্রের প্রতি বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ, তখন কী ভিত্তিতে অনার্যপন্থীরা এই ভাষ্য অস্বীকার করে “অস্ত্রহরণ মানে অপমান” দাবি করেন?
এরা কি শাস্ত্র ভাষ্যকারদের চেয়েও বড় ব্যাখ্যাকারক হয়ে গেল?
ভাষ্যের বিরুদ্ধে ব্যাখ্যা = শাস্ত্রবিরোধী কল্পনা।
যদি রুদ্র পূজ্য না হন, তাহলে কেন ঐ একই শতরুদ্রীয়তে রুদ্রকে, 'শত্রু বিনাশকারী', 'সংসারসুখের দাতা', 'মোক্ষের দাতা', 'প্রলয়ের দেবতা', ‘কল্যাণময়’ এই সব রূপে বিশদভাবে স্তুতি করা হয়েছে? একজন "অপূজ্য" শক্তির এত বৈচিত্র্যময় গুণাবলীর পূজা কেন?
এটি কি রুদ্রের পূজ্যতা ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরত্বের স্পষ্ট স্বীকৃতি নয়?
একই মন্ত্রে যেখানে বলা হয়েছে, “রুদ্রঃ... খঙ্গরহিতঃ অস্তু... ন্যস্তসর্বশস্ত্রঃ”, আরেক জায়গায় বলা হচ্ছে— “নমঃ অগ্রেবধায় চ দূরেবধায় চ” (অর্থাৎ, তুমি সম্মুখ ও দূর থেকে বধ করতে সক্ষম) তাহলে কি এতে কোনো সাংঘর্ষিকতা আছে?
না কি এর অর্থ হলো, রুদ্র চাইলে মারতে পারেন, চাইলে অস্ত্র পরিত্যাগ করে শান্তও থাকতে পারেন, এই দ্বৈততা তাঁর মহত্বেরই প্রকাশ?
এই তো ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য, অপরিসীম শক্তি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারা।
“আপনারা কীভাবে এমন একজন সর্বশক্তিমান, শাস্ত্রসম্মত, বহুবার বন্দিত দেবতাকে 'অপূজ্য' বলতে পারেন, যাঁর প্রতিটি রূপেই মঙ্গল নিহিত?”
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী —
কিন্তু সামনের ১১ নং মন্ত্রেই শস্ত্রধারী রুদ্রের কাছে পালনের প্রার্থনা করা হয়েছে। তাই এই মন্ত্রে শস্ত্র নাশের প্রার্থনা অসঙ্গত। ১১ নং মন্ত্রার্থ দেখুন -
যা তে হেডিমিচুষ্টম হস্তে বভূব তে ধনুঃ।
তয়াস্মান্ বিশ্বতত্ত্বময়ায়া পরি ভুজ ৷৷১১৷৷
ভাষ্যার্থঃ হে (মীচুষ্টম) অত্যন্ত বীর্যের সেচক সেনাপতি! (যা) যে (তে) তোমার সেনা এবং যে (তে) তোমার (হস্তে) হস্তে (ধনুঃ) ধনুক তথা (হেতিঃ) বজ্র (বভূব) হয় (তয়া) সেই (অয়ায়া) পরাজয় আদির পীড়া নিবৃত্ত কারী সেনা দ্বারা এবং সেই ধনুক আদি দ্বারা (অস্মান) আমাদের প্রজা এবং সেনা পুরুষ কে (ত্বম) তুমি (বিশ্বতঃ) সব প্রকারে (ভুজ) পালন করো।।
নোটঃ এই মন্ত্রের অর্থে মহিধর বলেছেন "হে কামবর্ষী তোমার হাতে যে ধনুকরূপ আয়ুধ আছে তা দ্বারা আমাদের সকল দিক হতে রক্ষা করো।" কিন্তু পূর্বের মন্ত্রেই রুদ্র কে শস্ত্রনাশের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। রুদ্র কে শস্ত্রহীন প্রার্থনা করে আবার শস্ত্রধারী রুদ্রের নিকট পালন প্রার্থনা প্রকরণ বিরুদ্ধ তথা অসঙ্গত।
❌অনার্যদের দাবী— মন্ত্র ১০-এ রুদ্রের অস্ত্র ও বাণ নষ্ট হওয়ার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে, যেখানে মন্ত্র ১১-এ অস্ত্রসহ রুদ্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— ১০নং মন্ত্রে ও ভাষ্যে কোথাও বলা হয়নি রুদ্রের অস্ত্র নষ্ট হোক। বরং উগ্র স্বরূপ রুদ্রকে প্রার্থনা করে বলা হয়েছে যাতে রুদ্র নিজের উপাসকদের উপর থেকে ভয়ঙ্কর অস্ত্রের দিক পরিবর্তন করে সরিয়ে নেয় এবং যাতে রুদ্রের কৃপা বর্ষিত হয়। রুদ্র অপরাজেয় তাকে কেউই জয় করতে পারে না। তেমনি রুদ্রের অস্ত্রও অপরাজেয় রুদ্রের অস্ত্র নষ্ট হবেনা কখনো। এবার ভাষ্য থেকে দেখে নেওয়া যাক—
🔘মন্ত্র ১০—
“শম্ না ধন্বা”
ধনুক যেন আমাদের শান্ত করে।
🔘উবট ভাষ্য—
“রুদ্র অস্মান্ প্রতি ন্যস্তসর্বশস্ত্রঃ”
অর্থাৎ, রুদ্র যেন আমাদের প্রতি তাঁর সমস্ত অস্ত্র ত্যাগ করেন।
🔘মহীধর ভাষ্য—
“অস্মান্ প্রতি ন্যস্তসর্বশস্ত্রঃ অস্তু ইত্যর্থঃ”
অর্থাৎ, আমাদের প্রতি যেন তিনি সমস্ত অস্ত্র না প্রয়োগ করেন।
“অস্ত্রনাশ” এখানে প্রার্থিত নয়, বরং ভক্তদের উপর রুদ্র যেন অস্ত্র প্রয়োগ না করেন, এই আত্মরক্ষামূলক শান্তিকামনা করা হয়েছে। এটি মন্ত্রোপাসনার স্বাভাবিক অংশ।
🔘মন্ত্র ১১ ভাষ্য—
“তা বা হেতিরায়ুধম্ হস্তে বভূব”
হে রুদ্র, তোমার হাতে যে ধনুকরূপ অস্ত্র আছে…
🔘মহীধর ভাষ্য—
“তয়া ধনুরূপয়া হেত্যা বিশ্বতঃ সর্বতোঽস্মান্ পরিভুজ”
সেই ধনুকরূপ অস্ত্র দ্বারা তুমি আমাদের সর্বদিক থেকে রক্ষা করো।
রুদ্রের অস্ত্রের অস্তিত্ব ও কার্যকারিতা স্পষ্টভাবে স্বীকার করে, রক্ষা প্রার্থনা করা হয়েছে। এটি “অস্ত্রচ্যুতি”র বিপরীত নয়, বরং একই উদ্দেশ্যে রুদ্র যেন ভক্তদের অনিষ্ট না করেন, বরং রক্ষা করেন।
🔘অনার্যদের দাবি— যে মন্ত্র ১০-এ রুদ্রের অস্ত্র ধ্বংসের প্রার্থনা করা হয়েছে এবং মন্ত্র ১১-এ আবার সেই অস্ত্র দিয়েই রক্ষা কামনা করা হয়েছে, মূলে ভ্রান্ত ও ভাষ্যবিরোধী। কারণ, উবট ও মহীধরের মতো প্রামাণ্য ভাষ্যকারদের ব্যাখ্যায় স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, “অস্ত্রনাশ” নয়, বরং “রুদ্র যেন তাঁর ভক্তদের উপর অস্ত্র প্রয়োগ না করেন” এই শান্তিকামনাই মূল বিষয়।
রুদ্রের অস্ত্র কখনোই দুর্বল বা বিনষ্টযোগ্য নয়। রুদ্র তাঁর অস্ত্রসহেই সর্বত্র বিরাজমান, আর সেই অস্ত্র দ্বারা তিনি দণ্ড দেন আবার আশ্রিতকে রক্ষা করেন। তাই মন্ত্র ১০-এ অস্ত্র ত্যাগের আহ্বান হল ভক্তদের উপর থেকে, এবং মন্ত্র ১১-তে সেই অস্ত্রেই রক্ষা চাওয়া হল ভক্তদের জন্যে।
১০ নম্বর মন্ত্রে— রুদ্র যেন অস্ত্র প্রয়োগ না করেন, প্রশমনের প্রার্থনা।
১১ নম্বর মন্ত্রে— রুদ্র যেন অস্ত্র দ্বারা রক্ষা করেন, আশ্রয়ের প্রার্থনা।
এ দুটি আবেদনের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য এক রুদ্রের করুণা লাভ ও সুরক্ষা। রুদ্রের অস্ত্রের প্রতি এই দ্বৈত আচরণ কোনো পরস্পরবিরোধিতা নয়, বরং এক আদর্শ ভক্তির প্রকাশ, যেখানে একই শক্তিকে ভয় করেও তার আশ্রয় চাওয়া হয়।
অনার্যদের দাবি অনুযায়ী যদি এই দুটি মন্ত্র পরস্পরবিরোধী হয়, তবে ভাষ্যকারেরা কেন এই দুই মন্ত্রকে একই ধারায়, শান্তি ও রক্ষা রূপে গ্রহণ করেছেন?
যদি সত্যিই “অস্ত্রনাশ” প্রার্থনা হত, তবে কেন মহীধর ও উবট বারবার “পরিভুজ” (রক্ষা করো) এবং “ন্যস্তসর্বশস্ত্রঃ” (অস্ত্র প্রয়োগ না করো) এই দয়ার স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন?
অস্ত্রধারীকে ভক্তের শত্রু না হয়ে রক্ষাকর্তা হিসেবে ডাকায় কি সত্যিই কোনো বৈপরীত্য আছে? না কি এ-ই আসল উপাসনার হৃদয়?
❌অনার্যদের দাবী— মন্ত্র ১০ ও ১১-এর এই পরস্পরবিরোধী আবেদন মন্ত্রের অর্থে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এবং অসঙ্গত।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— অর্থের অনর্থ করলে এমনই মনে হবে। ১০নং মন্ত্রে বলা হয়েছে- উপাসকদের প্রতি অস্ত্র নিরারণ করতে ত্যাগ করতে, যাতে উপাসকের রুদ্রের ভয়ঙ্কর অস্ত্র দ্বারা কোনো ক্ষতি না হয়। এবং ১১ নং মন্ত্রে রুদ্রকে প্রার্থনা করেই বলা হয়েছে– হে রুদ্র রক্ষাকারী অস্ত্র দ্বারা আমাদের অর্থাৎ উপাসকদের রক্ষা করো। এবং রুদ্রই যে শাস্তি দেন, শত্রুদের সংহার করেন, জগৎকে প্রলয়ে সংহার করেন তা রুদ্রের উগ্র ও ভয়ংকর স্বরূপকেই দর্শায়। অর্থাৎ এই উগ্র স্বরূপে রুদ্র
হলো ভয়ঙ্কর শাস্তি বিধাতা। আবার রুদ্রই হলো কল্যাণকারী ঈশ্বর, মুক্তিপ্রদানা, শান্তিপ্রদাতা। অর্থাৎ উগ্রতা ও কল্যাণকারী স্বরূপ রুদ্রেরই বিশেষ গুণ। তাই এখানে রুদ্রকে নিজের ভয়ংকর স্বরূপকে শান্ত করার প্রার্থনা ও রক্ষা করার প্রার্থনা করা হয়েছে। তাই এখানে বিরোধ কোথায় হচ্ছে সেটা তো অনার্যরাই ভালো জানে৷ কারণ শাস্ত্রের অনর্থকারী তো অনার্যরা। এবার ভাষ্য থেকেও দেখে নেবো কি বলা আছে—
🔘উবট ভাষ্য (মন্ত্র ১০)—
“পরিনামনিষেধদ্বারেণ স্তুতিঃ”
অর্থাৎ, অস্ত্রচ্যুতির প্রার্থনার মাধ্যমে রুদ্রকে প্রশান্ত করার স্তব।
🔘মহীধর ভাষ্য (মন্ত্র ১১)—
“অয়ক্ষ্ময়া নাস্তি যক্ষ্মা রোগঃ যস্যা:… দৃঢ়য়া অনুপদ্রবকারিণ্যা ধনুরূপা হেত্যা… পরিভুজ”
সেই নিরুপদ্রব, দৃঢ়, রক্ষাকারী অস্ত্র দ্বারা আমাদের রক্ষা করো।
একদিকে রুদ্র যেন তাঁর ক্রোধ ও বিঘ্নকারী রূপ সংহত করেন, অন্যদিকে সেই অস্ত্রই যেন নির্বিঘ্ন, দৃঢ় ও শান্তরূপে রক্ষাকর্মে ব্যবহৃত হয়।
এই দুইটি বক্তব্যে প্রকরণগত কোনও বিরোধ নেই। বরং, এটি রুদ্রের ভয়ংকর এবং শান্ত, সংহারক ও রক্ষক, উভয় রূপের একত্র সম্মান।
🔘রুদ্রের দুইটি স্বরূপ একটি ভয়ংকর, একটি করুণাময়। এই দুই রূপই বৈদিক সাহিত্যে ও শৈব দর্শনে অটলভাবে প্রতিষ্ঠিত।
যে ভক্ত তাঁর অস্ত্রের ভয়ে ভীত, সেই ভক্তই তাঁর অস্ত্রেই আশ্রয় চায়- এতে বিরোধ নয়, ভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রকাশ পায়।
১০ ও ১১ নম্বর মন্ত্র সেই চিরন্তন সত্যকেই ধরেছে, রুদ্রের উগ্রতা যেন প্রশমিত হয়, আর সেই রুদ্রই হোন আমাদের আশ্রয়, আমাদের রক্ষক।
যদি এটি দ্বন্দ্ব হতো, তাহলে উবট ও মহীধর ভাষ্যকারেরা কি এত স্পষ্টভাবে একদিকে “স্তুতি” আর অপরদিকে “রক্ষা” বলে ব্যাখ্যা করতেন?
এক ঈশ্বর, যিনি দণ্ড দেন ও রক্ষা করেন, এ দ্বৈত রূপ তো সকল বৈষ্ণব, শাক্ত, গাণপত্য, সৌর ইত্যাদি মতে বিদ্যমান, তাহলে একমাত্র রুদ্রের ক্ষেত্রেই কেন তা “অসঙ্গত” হবে?
অনার্যদের প্রকৃত আপত্তি কি মন্ত্রের মধ্যে?
না কি তারা রুদ্রের সর্বব্যাপী শক্তিকেই মানতে নারাজ?
❌অনার্যদের দাবী— এই অসঙ্গতি রুদ্রকে সর্বশক্তিমান দেবতা হিসেবে পূজার দৃষ্টিতে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— এখানে আসলে কোনো "অসঙ্গতি" নেই। রুদ্র নিজেই দ্বৈততাকে ধারণকারী সর্বময় সত্তা, একদিকে তিনি ভয়ঙ্কর, সংহারক, দণ্ডদাতা। অপরদিকে তিনি শান্ত, কল্যাণময়, রক্ষাকর্তা। এই দ্বৈততা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং এটি পরিপূর্ণতা ও সর্বশক্তির প্রতীক। শতরুদ্রীয় জুড়েই এই দুই রূপের সমন্বয় পাওয়া যায়।
একদিকে রুদ্র "ভয়ঙ্কর"—
"উগ্র, ভীম, হনীয়স" ইত্যাদি নামে তিনি পরিচিত, যিনি পাপিষ্ঠকে দণ্ড দেন, বিশ্বসংহার করেন।
অপরদিকে রুদ্র "শান্ত ও কল্যাণময়"—
তিনি "শিব, শঙ্কর, শম্ভব, পশুপতি" রূপে পরিচিত, যিনি জীবকে রক্ষা করেন, মুক্তির পথ দেখান।
আবার শতরুদ্রীয়তেই বলা হয়েছে—
“জগতাম্ পতয়ে নমো” [যজু ১৬/১৮]
🔘ভাষ্যকার মহীধর বলেছেন—
অন্নানাং পালকায় নমঃ। ভবস্য সংসারস্য হেল্যৈ আয়ুধায় সংসারনিবর্ত্তকায় রুদ্রায় নমঃ। জগতাং পালকায় রুদ্রায় নমঃ ।
অর্থ— যিনি গৃহহীন বা নিরাশ্রয় জীবদের রক্ষা করেন,
যিনি সংসাররূপ দুঃখকে বিনাশ করতে অস্ত্র ধারণ করেন এবং মোক্ষের পথ প্রদর্শন করেন, যিনি সমস্ত জগৎ ও জীবের পালনকর্তা, সেই সর্বশক্তিমান রুদ্রকে আমি প্রণাম জানাই।
তাহলে ১১ নং মন্ত্রের রুদ্র ও ১৮ নং মন্ত্রের রুদ্র কি আলাদা কেউ? যদি আলাদা কেউ না হয় তাহলে রুদ্র সর্বশক্তিমান হবে না কেন?
এখানেই তো প্রমাণ হয়ে যায় রুদ্রই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর।
🔘মহীধর ভাষ্য (মন্ত্র ১১)—
“অয়ক্ষ্ময়া ধনুরূপা হেত্যা… দৃঢ়া… পরিভুজ”
রুদ্রের হাতে যে ধনুকরূপ অস্ত্র, তা দৃঢ়, রোগহীন, নিরুপদ্রব, এবং সেই অস্ত্রই রক্ষা করে।
🔘উবট ভাষ্য (মন্ত্র ১০)—
“রুদ্র অস্মান্ প্রতি ন্যস্তসর্বশস্ত্রঃ”
রুদ্রের সমস্ত অস্ত্র যেন আমাদের প্রতি প্রয়োগ না হয় এই কামনা, কারণ রুদ্র অতিশক্তিমান।
রুদ্র এতই শক্তিমান যে, তাঁর অস্ত্র প্রয়োগ না করাই অনুগ্রহ। আর তিনি সেই অস্ত্র দিয়েই রক্ষা করতেও সক্ষম। এই দ্বৈতসত্তা, সংহার ও রক্ষা, সর্বশক্তিমত্তারই প্রতীক, নয় কোনো অসঙ্গতি।
🔘রুদ্রের “সংহার ও রক্ষা” এই দুই রূপ একে অপরকে বাতিল করে না, বরং একে অপরকে পরিপূরক করে। এই দ্বৈততা রুদ্রের অখণ্ড শক্তিরই প্রকাশ। যিনি ধ্বংস করতে পারেন, তিনিই সর্বোচ্চভাবে রক্ষা করতে পারেন, এই দ্বৈত রূপেই তাঁর সর্বশক্তিমানত্ব প্রকাশ পায়।
এটি কোনো “অসঙ্গতি” নয়, বরং এটি সেই মহান সত্য, এক ঈশ্বর, দুই রূপ। রুদ্র শাস্ত্রের দণ্ডদাতা যেমন, তেমনি ভক্তের ত্রাণকর্তাও। তিনিই জগতের উৎপত্তি, সংহার ও স্থিতির কেন্দ্র।
কেনই বা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর শুধু রক্ষা করবেন, শাস্তি দেবেন না?
সংহার ছাড়া কল্যাণ কীভাবে হবে?
একই ঈশ্বর যদি ভয় ও ভক্তি, দুই অনুভূতির জন্ম না দেন, তবে তাঁর সর্বময়তা কিসে?
এমন সমন্বয় কোথায় পাওয়া যাবে, যদি না হয় শিবতত্ত্বেই?
অতএব, মন্ত্র ১০ ও ১১ এর ব্যাখ্যা ও ভাষ্যই প্রমাণ করে, রুদ্রই পরমেশ্বর, সর্বশক্তিমান, সর্বরূপময়।
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী —
এর পর ১৫ এবং ১৬ নং মন্ত্রে একজন সেনাপতির যুদ্ধের বিধি নিষেধের বর্ণনা করা হচ্ছে-
মা নো মহান্তমুত মা নোহঅর্ভকং মা নোহউক্ষন্তমুত মা নোহউক্ষিতম্।
মা নো বধীঃ পিতরং মাতে মাতরং মা নঃ প্রিয়াস্তম্বো রুদ্র রীরিষ ৷৷ ১৫ ৷৷
পদার্থঃ হে (রুদ্র) যুদ্ধের সেনার অধিকারী বিদ্বান পুরুষ! আপনি (নঃ) আমাদের (উত্তম গুন দ্বারা যুক্ত পূজ্য কে (মা) না (উত) এবং (অর্ভকম্) ছোট ক্ষুদ্র পুরুষ কে (মা) না (নঃ) আমাদের (উক্ষন্তম) গর্ভাধান কারী কে (মা) না (উত) এবং (নঃ) আমাদের (উক্ষিতম) গর্ভকে (মা) না (নঃ) আমাদের (পিতরম্) পালন কারী পিতা কে (মা) না (উত) এবং (নঃ) আমাদের (মাতরম) মান্য কারক মাতা কেও (মা) না (বধীঃ) মারো এবং (নঃ) আমাদের (প্রিয়া) স্ত্রী আদির প্রিয় (তন্বঃ) শরীর কে (মা) না (রীরিষঃ) মারো।
ভাবার্থঃ যোদ্ধা লোকের উচিৎ যে যুদ্ধের সময় বৃদ্ধ, বালক, যুদ্ধ থেকে নিরস্ত হওয়া, গর্ভ, যোদ্ধার মাতা পিতা সমস্ত স্ত্রী, যুদ্ধ দেখা বা প্রবৎ কারী এবং দুত কে মারবে নন, কিন্তু শত্রুর সম্বন্ধী মনুষ্য কে সদা বশে রাখবে।
মা নস্তোকে তনয়ে মা নহআয়ুষি মা নো গোষু মা নোহঅশ্বেষু রীরিষ।
মা নো বীরান্ রুদ্র ভামিনো বধীর্হবিষ্মন্তঃ সদমিত ত্ববা হবামহে ৷৷১৬৷৷
ভাষ্যার্থঃ হে (রুদ্র) সেনাপতি! তুমি (নঃ) আমাদের (তোকে) তৎকাল উৎপন্ন সন্তান কে (মা) না (নঃ) আমাদের (তনয়ে) পাঁচ বর্ষের উপর অবস্থার বালক কে (মা) না (নঃ) আমাদের (আয়ুধি) অবস্থা কে (মা) না (নঃ) আমাদের (গোষু) গাভী, ভেড়া ছাগল আদি কে (মা) না (নঃ) আমাদের এবং (অশ্বেষু) ঘোড়া, হাতি এবং উট আদি কে (মা) না (রীরিষঃ) মারো এবং (নঃ) আমাদের (ভামিনঃ) ক্রোধ কে প্রাপ্ত (বীরান) শূরবীর কে (মা) না (বধীঃ) মার। ইহা দ্বারা (হবিষ্মন্তঃ) অনেক দেওয়া নেওয়ার যোগ্য বস্তু দ্বারা যুক্ত আমরা (সদস্) ন্যায়ে স্থির (ত্বা) তোমাকে (ইত্) ই (হবামহে) স্বীকার করি।।
ভাবার্থঃ রাজপুরুষের উচিৎ যে আপন প্রজার বালক, কুমার এবং গাভী, ঘোড়া আদি, বীর, উপকারী জীব কে কখনো হত্যা করবে না এবং বাল্যাবস্থায় বিবাহ করে ব্যভিচার দ্বারা অবস্থার হানি করবে না। গাভী আদি পশু দুধ আদি পদার্থ কে দান দ্বারা সবার উপকার করে, তাহাকে সদৈব বৃদ্ধি করবে।
উপরোক্ত মন্ত্র দুটিতে ক্ষাত্রধর্মের জন্য হননের নিয়ম বেধে দেওয়া হয়েছে যে, কোন কোন মানুষদের হনন করা উচিৎ নয়। এরূপ উত্তম শিক্ষা ইহাই সিদ্ধ করে যে এটা ক্ষাত্রধর্ম শিক্ষার প্রকরণ। কারন এখানে নানা প্রকার শস্ত্রের বর্ণন এবং সেনা সেনাপতির বর্ণন পাওয়া যায়। কিন্তু পৌরাণিক রুদ্রের সেনা শস্ত্রাদির কি আবশ্যকতা? যখন তিনি নিজেই ঈশ্বর সেনা আর শস্ত্রের কি প্রয়োজন?
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— প্রথমে দেখে নেবো- ১৫ ও ১৬ নং মন্ত্রের ভাষ্যে আচার্য উবট-মহীধর কি বলছেন—
🔘১৫ নং মন্ত্রের উবট-মহীধর ভাষ্য —
👉উবট ভাষ্য—
"মা নঃ মাবধীঃ নঃ অস্মাকং মহান্তং বৃদ্ধং বয়ঃপ্রভৃতিভিঃ"
আমাদের মহৎ, গুরুজন, বৃদ্ধ ব্যক্তিদের তুমি যেন হত্যা না করো।
"উত মা নঃ অর্ভকম্ অল্পবয়স্ক বালকং মাবধীঃ" আমাদের ছোট, শিশু সন্তানদেরও তুমি যেন হত্যা না করো।
"মা ন উক্ষন্তম্ তরুণম্ বীজপ্রয়োগকারীং মাবধীঃ" আমাদের তরুণ, কর্মক্ষম যুবকদেরও তুমি যেন হত্যা না করো।
"উত মা ন উক্ষিতম্ গর্ভস্থিতম্ মাবধীঃ"
আমাদের গর্ভস্থ সন্তানকেও তুমি যেন হত্যা না করো।
"মা নঃ বধীঃ পিতরম্"
আমাদের পিতাকেও তুমি যেন হত্যা না করো।
"মোত মাতরম্ মাবধীঃ"
আমাদের মাতাকেও তুমি যেন হত্যা না করো।
"মা রীরিষঃ মা হিংসীঃ নঃ প্রিয়ান্ তন্বঃ"
আমাদের প্রিয় শরীর, সন্তানাদি, পরিবারবর্গকে তুমি যেন হিংসা না করো।
👉মহীধর ভাষ্য—
"হে রুদ্র, নোঽস্মাকং মহান্তং বৃদ্ধং গুরু-পিতৃব্য-আদিকং মা বধীঃ"
হে রুদ্র, আমাদের গুরুজন, পিতৃব্য প্রমুখ বৃদ্ধদের হত্যা কোরো না।
"উত অপি নোঽস্মাকং অর্ভকং বালকং মা বধীঃ" এমনকি শিশুদেরও হত্যা কোরো না।
"উত অপি নো উক্ষন্তং গর্ভাধানকারিণং তরুণং মা বধীঃ"
তরুণ কর্মক্ষম ব্যক্তিকেও হত্যা কোরো না।
"উত অপি নো উক্ষিতং গর্ভস্থিতম্ মা বধীঃ"
গর্ভস্থ শিশুকেও হত্যা কোরো না।
"নঃ পিতারং মাতরং প্রিয়ান্ তন্বঃ মা রীরিষঃ"
পিতা, মাতা ও প্রিয় সন্তানদিগকে তুমি যেন হিংসা না করো।
👉ভাষ্যের সংক্ষিপ্ত অর্থ— হে রুদ্র! আমাদের পরিবার-সমাজের কারোর প্রতি তুমি হিংসার ভাব রেখো না। না বৃদ্ধ, না শিশু, না গর্ভস্থ, না পিতা-মাতা, না আমাদের প্রিয় সন্তানসদৃশ শরীরগুলির ওপর।
🔘১৬নং মন্ত্রের উবট-মহীধর ভাষ্য —
"মা হিংসীঃ নঃ অস্মাকং তোকে পুত্র বিষয়ে। মা হিংসীঃ তনয়ে পৌত্র বিষয়ে। মা হিংসীঃ নঃ অস্মাকং আয়ুষি"
আমাদের পুত্র, পৌত্র, আয়ু বা জীবনকে তুমি হিংসা কোরো না।
"মা নো গোষু মা হিংসীঃ নঃ অস্মাকং গোপু বিষয়ভুতাসু"
গাভী প্রভৃতি পালনীয় পশুর প্রতিও হিংসা কোরো না।
"মা নো অশ্বেষু মা হিংসীঃ নঃ অস্মাকম্ অশ্বেষু"
আমাদের অশ্ব বা কর্মক্ষম পশুর প্রতিও হিংসা কোরো না।
"মা নো বীরান্ রুদ্র ভামিনো বধীঃ"
আমাদের বীর, যুদ্ধপ্রস্তুত লোকদেরও তুমি হত্যা কোরো না।
👉মহীধর ভাষ্য—
"নোঽস্মাকং তোকে পুত্রে তনয়ে পৌত্রে মা রীরিষঃ মা হিংসীঃ"
আমাদের সন্তান, পৌত্রদের তুমি হিংসা কোরো না।
"নো গোষু ধেনুষু মা রীরিষঃ... নোঽশ্বেষু তুরগেষু"
গরু ও ঘোড়ার প্রতিও হিংসা কোরো না।
"ভামিনঃ ক্রোধযুতান্ অপি নোঽস্মাকং বীরান্... মা বধীঃ"
এমনকি ক্রোধযুক্ত বীরদেরও তুমি হত্যা কোরো না।
"সদৈব ত্বং বয়ং হবামহে... ত্বদেকশরণা বয়ম্"
আমরা সদা তোমার উপাসক, একমাত্র তোমারই আশ্রয়ে আছি।
👉ভাষ্যের সংক্ষিপ্ত অর্থ— হে রুদ্র! আমাদের প্রজন্ম, প্রাণ, গরু, ঘোড়া ও বীরদের প্রতি তুমি হিংসা বা মারণ ইচ্ছা পোষণ কোরো না। আমরা সদা হবিষ্যুক্ত, তোমার উপাসক, তোমাকেই ডাকি, আমাদের প্রতি সদয় হও।
🔘এমন কোন রাজপুরুষ আছে যাকে যজ্ঞে হব্য আহুতি দ্বারা আহবান করা হয়? যদি কোনো রাজা বা সেনাপতিকে যজ্ঞে আহুতি ও আহবানের দ্বারা পূজা করা হয় তাহলে তিনি তো সাক্ষাৎ ভগবান হয়ে যাবে! কিন্তু, এমন কোন রাজা বা সেনাপতি আছে, যাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞে আহুতি দেওয়া হয়?
🔘ঋগবেদ এই প্রসঙ্গে বলছে—
মা নঃ মহান্তমুত্ মা নঃ অর্ভকং মা ন উক্ষন্তম্ উত্ মান্ উক্ষিতম্ ।
মা নঃ বধীঃ পিতরং মোত মাতরং মা নঃ প্রিয়াস্তন্বো রুদ্র রীরিষঃ ॥
মা নস্তোকে তনয়ে মা ন আয়ৌ মা নো গোষু মা নো অশ্বেষু রীরিষঃ ।
বীরান্ মা নো রুদ্র ভামিতো বধীর্ হবিষ্মন্তঃ সদমিত্ ত্বা হবামহে ॥
[ঋগবেদ/১/১১৪/৭-৮]
হে রুদ্র! তুমি যেন আমাদের মধ্যে কোনও বড়ো, শিশু, গর্ভবতী, সদ্যোজাত, পিতা-মাতা কিংবা প্রিয় কারোরই অনিষ্ট না করো।
হে রুদ্র! তুমি যেন আমাদের সন্তান, আয়ু, গাভী, অশ্ব, বীর সন্তানদের কোনও অনিষ্ট না করো। আমরা সদা হব্য প্রদানকারী হয়ে তোমাকে আহ্বান করি।
🔘ঋগবেদের ১ম মণ্ডল ১১৪ নং সুক্তে পরমেশ্বর শিবেরই উল্লেখ রয়েছে, যিনি জটাজুটধারী যা আমি উপরেই উল্লেখ করেছিলাম সায়ণ ভাষ্য সমেত। তাই এখানে যে রূদ্রের কথা বলা হয়েছে তিনি কোনো সেনাপতি/রাজা ইত্যাদি কেউ-ই নয়। এবং ৭-৮ নং মন্ত্রেও পরমেশ্বর রুদ্রেরই উল্লেখ করা হয়েছে। আবার এখানে অনার্যরা এটা না বলে বসে যে- ঋগবেদের রুদ্র ও যজুর্বেদের রুদ্র আলাদা কেউ। এমন কিছু উদ্ভট আচরণ করে নিজেদের মূর্খামির প্রমাণ দেবেন না।
👉আচার্য সায়ণ এই মন্ত্রের ভাষ্য করতে গিয়ে বলেছেন—
“বয়ং চ হবিষ্মন্তঃ হবিভির্যুক্তাঃ সন্তঃ সদমিত্ সর্বদৈব স্বাং হবামহে আহ্বয়ামহে।।”
অর্থ— "হে রুদ্র! আমরা হবিষ্মন্ত (অর্থাৎ যজ্ঞকারী), আমরা হব্য সামগ্রী (ঘৃত, অন্ন, বটিকা ইত্যাদি) সহ তোমাকে ও অন্যান্য দেবতাদের সদা আহ্বান করে থাকি। তুমি যেন আমাদের কারো প্রতি রুষ্ট না হও।"
🔘মন্ত্রে বলা হয়েছে —
"হবিষ্মন্তঃ সদমিত্ ত্বা হবামহে"
অর্থাৎ, "আমরা হবিষ্যুক্ত হয়ে, সর্বদা তোমাকেই আহ্বান করি।"
প্রশ্ন উঠবে—
একজন সাধারণ সেনাপতিকে কি যজ্ঞের মাধ্যমে আহ্বান করা হয়?
নিশ্চয়ই নয়।
যজ্ঞে আহ্বানযোগ্য একমাত্র সত্তা হলেন ঈশ্বর।
বেদে দেবতা আহ্বান মানেই যজ্ঞে কর্তৃত্বপ্রাপ্ত, জ্ঞানগম্য, সর্বব্যাপক, হোমগ্রাহী পরমেশ্বর।
তাই, যাঁকে যজ্ঞে আহ্বান করা হচ্ছে, তিনি নিশ্চয়ই কোন রাজপুরুষ নন, বরং পরমেশ্বর রুদ্র।
🔘তৈত্তিরীয় আরণ্যকে একই মন্ত্রের ভাষ্যে সায়ণাচার্য বলেছেন—
“তত্বদর্থং হবিষ্মন্তো যথাবিধিনাষ্পাদিতহবির্যুক্তজুহুহস্তা বয়ং নমসা প্রণামেন তে তবেজ্যাং বিধেম কুর্যাম”..।।
[তৈত্তিরীয় আরণ্যক/ সায়ণভাষ্য /১০/৫৩]
অনুবাদ— “আমরা সেই পরম তত্ত্বরূপ প্রভুর (রুদ্রের) উদ্দেশ্যে যথাবিধি প্রস্তুতকৃত হব্যসহ যজ্ঞদ্রব্য ধারণ করে, আহুতি প্রদানের উপযুক্ত হাতে, নমস্কার ও প্রণামের মাধ্যমে তোমার সেই পূজ্য ঈশ্বরের উপাসনা সম্পাদন করি।”
🔘এই প্রসঙ্গে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ বলছে—
মা নস্তোকে তনয়ে মা ন আয়ুষি মা নো গোষু মা নো অশ্বেষু রীরিষঃ ।
বীরান্ মা নো রুদ্র ভামিতো বধীর্ হবিষ্মন্তঃ সদমিত্ ত্বা হবামহে ॥
[শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৪/২২]
হে রুদ্র! তুমি আমাদের পুত্র ও নাতির প্রতি হিংসা কোরো না, আমাদের আয়ুক্ষয়ে বা জীবনে কষ্ট দিও না,
আমাদের গরু ও ঘোড়াদেরও তুমি হিংসা কোরো না।
হে রুদ্র! আমাদের সাহসী বীরদের প্রতিও রাগান্বিত হয়ে তুমি হত্যা কোরো না। আমরা তোমাকে সদা যজ্ঞের মাধ্যমে হব্য দান করে পূজা করি ও আহ্বান জানাই।
এখানে একেবারে যজুর্বেদ, ঋগ্বেদ ও তৈত্তিরীয় আরণ্যক এর মন্ত্র অনুলিপি করা হয়েছে। উপনিষদে ‘রুদ্র’ কে সর্বজ্ঞ, সর্বত্র, সর্বানন্ত ঈশ্বর হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে।
যেমন, রুদ্রকে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে “একহি রুদ্র ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য” (শ্বেতা/৩/২) ইত্যাদি শ্রুতি বাক্য দ্বারা শিবই যে একমাত্র পরমেশ্বর তা স্থাপিত করা হয়েছে। ইনিই হলো গিরি নিবাসী পরমেশ্বর রুদ্র। আবার শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেই বলা হয়েছে- “শিব এব কেবলঃ” (শ্বেতা/৪/১৮) অর্থাৎ যখন কিছুই ছিলোনা, তখন একমাত্র পরমেশ্বর শিব ছিলো। “বিশ্বাধিপো রুদ্র মহর্ষিঃ” (শ্বেতা/৪/১২) অর্থাৎ পরমেশ্বর সর্বজ্ঞ রুদ্র। এবং আরও বলেছে- “ত্মীশ্বরানাং পরমং মহেশ্বরং” (শ্বেতা/৬/৭) অর্থাৎ শিবই ঈশ্বরের মধ্যে পরম মহেশ্বর, দেবতাদের পরম দেবতা।
তাই এখানে স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে যে- “মা ন মহান্তমুত” “মা নস্তোকে তনয়ে” মন্ত্রের প্রতিপাদ্য বস্তু পরমেশ্বর শিবই, কোনো সাধারণ রাজা বা সেনাপতি কদাপি নন।
অতএব, যাঁকে উপনিষদ "একো ঈশ্বর" বলছে, তিনি সেনাপতি হতে পারেন না।
🔘এবার আসা যাক মজার বিষয়ে। অনার্যদের তথাকথিত স্বঘোষিত মহর্ষি দয়ানন্দ সত্যার্থ প্রকাশের ৭ম সমুল্লাস পৃষ্ঠা নং ১৩৭ “ঈশ্বর বেদ বিষয় ব্যাখ্যা” তে বলেছে—
মা নো মহান্তমুত মা নোऽঅর্ভকং মন উক্ষন্তমুত মা নঽ উক্ষিতম্।
মা নো বধীঃ পিতরং মোত মাতরং নঃ প্রিয়াস্তন্বো রুদ্র রীরিষঃ ॥ ১০॥
(যজু০ অ০ ১৬।১৫৷)
হে 'রুদ্র'! দুষ্টদিগকে পাপের দুঃখরূপ ফল প্রদান করিয়া আপনি রোদন করান। আমাদের জেষ্ঠ-কনিষ্ঠ, গর্ভ, মাতাপিতা, প্রিয়জন, বন্ধুবর্গ তথা (তাহাদের) শরীর হনন করিবার জন্য কাহাকেও প্রেরণা দিবেন না। আমাদের সকলকে এরূপ পথে পরিচালিত করুন, আমরা যেন আপনার দ্বারা দণ্ডনীয় না হই ৷ ১০৷৷
👉দয়ানন্দ ঈশ্বর স্তুতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই মন্ত্র উদ্ধৃত করেছে। কিন্তু, অবাক করা বিষয় হলো এইটা শতরুদ্রীয় মন্ত্র, যেই শতরুদ্রীয়কে দয়ানন্দ নাকি নিজের ভাষ্যে রাজধর্ম/ক্ষাত্রধর্ম প্রকরণ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আবার এই দয়ানন্দই একই মন্ত্রকে ঈশ্বরের স্তুতি বলে নিজের সত্যার্থ প্রকাশে উল্লেখ করে গেছেন। তাহলে এখন অনার্য এবং তাদের ভণ্ড গুরু দয়ানন্দকে কি বলা যায়? গিরগিটি নাকি দুমুখো সাপ?
যখন শতরুদ্রীয় দ্বারা অনার্যদের মত খণ্ডন হয়ে যাবে এমন অবস্থা, তখন অনার্যরা শতরুদ্রীয়কে ব্যাখ্যা করলো রাজধর্ম প্রকরণ বলে।
আবার তাদের গুরু দয়ানন্দ ঈশ্বরের স্তুতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একই মন্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন- সগুণ-নির্গুণ ভেদে নিরাকার ঈশ্বরের স্তুতি করা উচিত।
তাহলে এখানে দেখা যাচ্ছে দয়ানন্দ নিজেই নিজের খণ্ডন করে রেখেছে সত্যার্থ প্রকাশে। হয়তো এবার অনার্যরা সত্যার্থ প্রকাশকেই প্রক্ষিপ্ত বলে দেবে। কারণ এ ছাড়া এদের আর যৌক্তিক কোনো মীমাংসা নেই।
তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়- একই মন্ত্র দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? তাও বিপরীতমুখী ব্যাখ্যা? একস্থানে বলছে রাজধর্ম প্রকরণের মন্ত্র, আবার একই মন্ত্র অন্যস্থানে বলছে এটা নিরাকার ঈশ্বরের স্তুতি। মানে অনার্যরা আসলে কি চাই তারা নিজেরাও জানে না।
যেখানে দয়ানন্দ নিজেই মন্ত্রটাকে ঈশ্বরের স্তুতি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে, সেখানে শতরুদ্রীয়তে একই মন্ত্র দ্বারা রাজপুরুষ/সেনাপতিকে কীভাবে বোঝাবে?
সুতরাং ন্যায় মতে এটা ‘স্বপ্রতিপক্ষ’ দোষ যা গ্রহণীয় নয়। অনার্যদের এই ব্যাখ্যা এখানেই খণ্ডিত হয়।
❌অনার্যদের দাবী— মন্ত্রগুলোতে যুদ্ধের বিধি-নিষেধ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে বৃদ্ধ, গর্ভবতী নারী, শিশু, পিতা-মাতা, স্ত্রী ও পশুপালন সংরক্ষণের নির্দেশ রয়েছে।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— যদি এটি নিছক মানব সেনাপতির ভাষণ হতো, তবে "মা ন উক্ষিতম্" (অর্থাৎ গর্ভস্থ শিশু) বা "নঃ প্রিয়াস্তন্বঃ" (পুত্র-পৌত্র শরীরের প্রতিও হিংসা না করার আকুতি) এরূপ গভীর ও সর্বজীবপ্রীতি সমন্বিত আবেদন থাকত না।
ভাষ্যে বারবার উল্লেখ আছে "ত্বদেকশরণা বয়ম্", "হবিষ্মন্তঃ ত্বা হবামহে" যা পরিষ্কার করে যে এই আহ্বান কোনো মানব সেনাপতির প্রতি নয়, ঈশ্বর রুদ্রের প্রতি। তিনি যজ্ঞের দেবতা, যিনি দয়াময় ও ন্যায়বিচারক।
🔘উবট ভাষ্যেই আছে—
"প্রিয়াণি শরীরাণি পুত্র পৌত্র লক্ষণানি।"
অর্থাৎ প্রিয় শরীর বলতে সন্তান, পৌত্র প্রভৃতি লক্ষণ বোঝানো হয়েছে, এটা সাধারণ সেনাপতির ভাষা নয়, এটি সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের প্রতি আহ্বান।
মন্ত্রে যুদ্ধের বিধি-নিষেধ নেই, বরং রুদ্রকে প্রার্থনা করা হয়েছে যেন তিনি তাঁর প্রলয়রূপ শক্তি থেকে আমাদের রক্ষা করেন।
উবট ও মহীধরের ভাষ্য একবাক্যে একে "রুদ্রের নাশকতা বা হিংসা থেকে পরিত্রাণ প্রার্থনা" বলে নির্ধারণ করেন।
ভাষ্যে "মা বধীঃ" এবং "মা রীরিষঃ" এর মানে করা হয়েছে "মা হিংসীঃ", অর্থাৎ “হে রুদ্র, আমাদের ক্ষতি কোরো না।”
রুদ্র এখানে বিধিনিষেধ পালনের দাবিদার নয়, বরং অপ্রতিরোধ্য, ভয়ঙ্কর দেবতা যাঁর করুণার জন্য প্রার্থনা করা হচ্ছে।
এই মন্ত্রে যুদ্ধনীতি নয়, রুদ্রের প্রলয়রূপ ভয়ের প্রেক্ষিতে সর্বস্তরের জীবের রক্ষার প্রার্থনা করা হচ্ছে। এটি একেবারেই দেবতা-নির্ভরতা, সেনানায়ক কেন্দ্রিক নয়।
যে ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে যজ্ঞে “হবিষ্মন্তঃ সদমিত্ ত্বা হবামহে” বলা হচ্ছে, তিনি কি সাধারণ কোনো মানব সেনাপতি হতে পারেন?
যজ্ঞে কি কোনো সাধারণ রাজা বা সেনাপতিকে আহ্বান জানানো হয়?
“হবিষ্যুক্ত” বলে কার উদ্দেশে আহুতি দেওয়া হয় সেনানায়ক, না দেবতা?
যদি যজ্ঞ শুধুমাত্র দেবতার জন্য হয়, তবে এই রুদ্র কি মানবসত্তা হতে পারেন?
❌অনার্যদের দাবী— এই বিধিগুলি ক্ষাত্রধর্ম তথা যোদ্ধাদের আচরণের নিয়মাবলী, যা প্রমাণ করে এখানে মানুষের সামরিক আচরণের নীতিমালা বর্ণিত।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— "ক্ষাত্রধর্ম" বা যুদ্ধনীতি হলে এখানে কোনো নৈতিক নির্দেশ বা আদেশ থাকত, যেমন- “বৃদ্ধকে হত্যা করো না”, “গর্ভবতী নারীকে আঘাত কোরো না” ইত্যাদি। কিন্তু আসল মন্ত্রে সবকিছু রুদ্রকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে।
"মা নঃ প্রিয়াস্তন্বো রীরিষঃ"
হে রুদ্র, আমাদের প্রিয় দেহগুলোকে হিংসা কোরো না।
"মা নো বীরান্…..বধীঃ"
হে রুদ্র, আমাদের বীরদের হত্যা কোরো না।
এগুলো যুদ্ধনীতি নয়, রুদ্রের প্রতি ভক্তিপূর্ণ প্রার্থনা।
রুদ্র এখানে যোদ্ধাদের মধ্যে একজন নন, বরং শাস্ত্রধারী দেবতা, যাঁর হাতে জীবনের সংহার-রক্ষা নির্ভর করে।
এখানে মানুষকে উপদেশ নয়, রুদ্রকে প্রার্থনা। তাই ‘ক্ষাত্রধর্ম’ নয় বরং ‘দৈবভয়নিবারণ’।
ঈশ্বর যেমন সর্বশক্তিমান, তেমনি তিনি ন্যায়রক্ষক ও করুণামূর্তি। এই মন্ত্রে রুদ্রের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে যেন তিনি অন্যায়ভাবে হিংসা না করেন, যাতে নিরপরাধ, নিরস্ত্র, শিশু-বৃদ্ধ-গর্ভস্থ প্রভৃতি রক্ষা পান।
🔘মহীধর বলেন—
"ত্বদেকশরণা বয়ম্"
আমরা একমাত্র তোমারই আশ্রয়ে আছি।
এটি ঈশ্বরকে ডাকা, তাঁর কাছে করুণা চাওয়া। এই প্রার্থনা কেবল ঐশ্বরিক সত্তাকেই উদ্দেশ করে করা হয়, কোনো সামরিক মানব সেনাপতিকে নয়।
এখানে কোনো আদেশমূলক বাক্য নেই, নেই “ত্বং করোতি” জাতীয় নির্দেশ, বরং আছে “মা রীরিষঃ” দয়া করো, হিংসা কোরো না।
কোনো সেনানায়ককে কি গর্ভস্থ শিশু বা গাভীর প্রাণ সংহারের ক্ষমতা থাকে?
“ত্বদেকশরণা বয়ম্” আমরা কেবল তোমারই আশ্রিত এমন বাক্য কি মানব সেনাপতির উদ্দেশে চলে?
যদি নির্দেশ সেনানায়ককে দেওয়া হয়, তবে নির্দেশকার কে? সেই পরমেশ্বর কে?
❌অনার্যদের দাবী— পৌরাণিক রুদ্র যদি চূড়ান্ত ঈশ্বর বা সরাসরি অপার সামরিক শক্তি হতেন, তবে এই ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক বিধি তার প্রাসঙ্গিকতা থাকত না। কারণ ঈশ্বরের পক্ষ থেকে এমন সেনা বা শস্ত্রের প্রয়োজন বা বিধিবিধান বিবেচ্য নয়।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— এই যুক্তিও ভুল, কারণ প্রার্থনায় বলা হচ্ছে—
"হবিষ্মন্তঃ সদমিত ত্ববা হবামহে"
আমরা সদা তোমাকে আহ্বান করি, যজ্ঞদ্রব্যসহ তোমার পূজা করি।
এটি একমাত্র যজ্ঞে পূজ্য ঈশ্বর রুদ্র, যিনি বিধাতা ও সংহারক, তাঁর প্রতিই নিবেদিত।
অনার্যদের এই আপত্তি দেবতা ধারণা বুঝতে ব্যর্থ।
রুদ্র দ্বৈত চরিত্রের দেবতা—
একদিকে ভয়ঙ্কর, প্রলয়কারী, সংহারক।
অপরদিকে করুণাময়, চিকিৎসক, রক্ষক।
এই মন্ত্রে তাঁর ভয়ঙ্কর রূপকে প্রশমিত করতে বলা হচ্ছে।
🔘উবট স্পষ্ট বলছেন—
“রিষতি হিংসাকর্মা” রুদ্র হিংসাকর্মা (সংহারকারী)।
“মা রীরিষঃ মা হিংসীঃ” আমাদের হিংসা কোরো না।
এটি ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভয় এবং করুণা লাভের প্রার্থনা। ঈশ্বর যদি অলম শক্তিশালী হন, তবে তাঁর ভয়ঙ্কর দিক থেকে রক্ষার জন্য এইরূপ প্রার্থনা অত্যন্ত যথার্থ।
ঈশ্বর রুদ্রকে ভয় করেই নয়, করুণা লাভের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে, এটি উপাসকের স্বাভাবিক আচরণ।
যদি যুদ্ধনীতি হতো, তাহলে “রীরিষঃ”, “বধীঃ” এসব ঈশ্বরবাচক শব্দের মাধ্যমে সেনানায়কের প্রতি কাতর প্রার্থনার রূপ নিত না।
যুদ্ধনীতি কি ঈশ্বরকে লক্ষ্য করে প্রার্থনার রূপে প্রকাশ পায়?
“তুমি আমাদের বীরদের হত্যা কোরো না” এ ভাষা কি যুদ্ধশিক্ষার ভাষা? না ঈশ্বরপ্রার্থনার?
❌অনার্যদের দাবী— তাই মন্ত্রদ্বয়ে বর্ণিত রুদ্রের রূপ ও কার্যক্রম সম্ভবত মানবসমাজের সামরিক কাঠামোর প্রতীক বা রূপক, বাস্তব সেনাপতি বা যোদ্ধার রূপক, না যে পরমশক্তিমান ঈশ্বরের সরাসরি পরিচয়।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— রুদ্র শুধু ধ্বংসকারী নন, তিনি শান্তিকারী, রক্ষাকারী, দয়ালু তা ভাষ্য থেকেই পরিষ্কার। ভাষ্য অনুসারে রুদ্র হলেন পূজ্য, যজ্ঞীয় দেবতা। "সদা ইতি ত্বা হবামহে" আমরা তাঁকে হোমে আহ্বান করি। যাঁকে যজ্ঞে আহ্বান করা হয়, তিনি কেবল রূপক নন, দেবতা ও ঈশ্বর।
🔘উবট ভাষ্যেই আছে—
"নঃ অস্মাকং প্রিয়াস্তন্বঃ... মা রীরিষঃ মা হিংসীঃ"
প্রিয় শরীর/সন্তানদের যেন হিংসা না করেন, এমন হৃদয়গ্রাহী করুণা ও সার্বজনীনতা ঈশ্বর ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
🔘মহীধর সরাসরি বলেন—
"নঃ প্রিয়াস্ততন্বো... মা হিংসীঃ" রুদ্র আমাদের প্রিয় দেহ বা পরিবার (পুত্র-পৌত্র) যেন হিংসা না করেন।
এটি এমন দেবতা যাঁর হাতে জীবন-মৃত্যু নির্ভর, এবং যিনি গর্ভস্থ ভ্রূণ, শিশু, পশু, পিতা-মাতা, ঘোড়া-গরু পর্যন্ত ক্ষতি করতে পারেন।
কোনো মানব সেনাপতির পক্ষে তো গর্ভস্থ ভ্রূণ বা গাভীর আয়ু সংহারে ক্ষমতা নেই। এগুলি ঈশ্বরীয় শক্তিরই ইঙ্গিত।
মন্ত্রে রুদ্রের যে শক্তি ও নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে, তা মানুষের নয়, পরমেশ্বরের বৈশিষ্ট্য।
যাঁর ক্ষমতা গর্ভস্থ ভ্রূণ পর্যন্ত পৌঁছায়, যাঁকে সন্তুষ্ট করতে যজ্ঞ হয়, তিনি কি সেনানায়কের প্রতীক হতে পারেন?
প্রতীকী ব্যাখ্যার কোনো শাস্ত্রীয় ভিত্তি কোথায়?
ঋগ্বেদে সরাসরি বলা “তোমাকে সদা হব্য সহ আহ্বান করি” কোন প্রতীককে হব্য সহ আহ্বান করা হয়?
উপনিষদ যদি “শিব একমাত্র ঈশ্বর” বলে, তবে আপনি কীভাবে তাঁকে প্রতীক মাত্র বলছেন?
❌অনার্যদের দাবী— অতএব, এই মন্ত্রসমূহে রুদ্রের যে ভূমিকা প্রকাশ পেয়েছে, তা পৌরাণিক রুদ্র বা পরমেশ্বর রূপে ব্যাখ্যা করা যথার্থ নয়, বরং তা মানবিক এবং সামরিক সামাজিক নিয়মাবলীর প্রতিফলন।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— এই মন্ত্রে রুদ্রকে যেভাবে সর্বজীবের ওপর হিংসা বা করুণা প্রদানের অধিকারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, তা তাঁর সার্বভৌমত্ব ও সর্বশক্তিমানত্বেরই প্রমাণ।
🔘মহীধর বলেন—
“তোকং তনয়ঃ আয়ুঃ.....মা হিংসীঃ” সন্তান, পৌত্র, গাভী, ঘোড়া এদের প্রাণহানি রুদ্র করতে পারেন, তাই তাঁকে করুণা প্রার্থনা করা হচ্ছে।
মানব নির্মিত ক্ষত্রীয় নীতির সঙ্গে এগুলোর তুলনা ভিত্তিহীন। বরং এগুলো ঈশ্বরের "ত্রিকালজ্ঞ, সর্বব্যাপী, করুণাময় ও হিংসাশক্তিধারী" রূপের পরিচায়ক।
ভাষ্যকাররা রুদ্রকে “হিংসাকারী” ও “সংহারশক্তিধারী” হিসেবে বর্ণনা করে বারবার বলছেন “মা হিংসীঃ”, “মা বধীঃ”।
যদি রুদ্র সেনানায়ক হন, তাহলে তাঁর হাতে গাভীর প্রাণ থাকা কেমন করে সম্ভব?
রুদ্র যদি মানব হন, তাহলে তাঁর প্রলয়রূপ শক্তি থেকে মানুষ বাঁচার প্রার্থনা করার অর্থ কী?
ঈশ্বরের হিংসাশক্তি নিয়ন্ত্রণের প্রার্থনাকে কি আপনি মানবনীতি বলবেন?
🔘সুতরাং—
যদি রুদ্র কোনো রাজপুরুষ হন, তাহলে যজ্ঞ, হব্য, আহুতি, উপনিষদ, মন্ত্র সব কিছুকেই মানবস্তরেই নামিয়ে আনা হয়। এতে বেদ-উপনিষদের ঈশ্বরতত্ত্বের মৌলিকতাই ধ্বংস হয়ে যাবে।
যাঁকে যজ্ঞে আহ্বান করা হয়, যাঁর কাছে সন্তান, প্রাণ, পশু-পাখি রক্ষা করার জন্য প্রার্থনা করা হয়, যিনি হিংসা করতে ও জীবনহরণ করতে সক্ষম, যাঁকে উপনিষদ পরমেশ্বর হিসেবে বর্ণনা করে, যাঁকে ঋগ্বেদ “তব্যসে” (শক্তিশালী), “ভামিতঃ” (ক্রুদ্ধ) বলেন, যাঁকে “তাঁর ক্রোধ” থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভয় ও ভক্তি নিয়ে ডাকা হয়, তিনি কোনও মানব সেনাপতি নন। তিনি একমাত্র পরমেশ্বর রুদ্র।
"মা নঃ তোকে তনয়ে মা ন আয়ুষি…"এই প্রার্থনাগুলো কোনও নীতিশিক্ষা নয়, বরং এক চিরন্তন ঈশ্বরের কাছে মানবজাতির প্রার্থনা, যাতে তিনি রুষ্ট না হন, হিংসা না করেন।
এভাবেই ঋগ্বেদ, উপনিষদ, ভাষ্যকার, এবং আধুনিক যুক্তি, সব মিলিয়ে 'রুদ্র' সেনাপতি নয়, পরমেশ্বর একথা নিশ্চিতরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।
🟢এখানে অনার্যদের দাবীর উপর কিছু প্রশ্ন উঠে আসে—
রুদ্র ভীষণ ও প্রলয়কারী, তাই তাঁর জন্য ভীতি ও প্রার্থনা, এবং একেই সামঞ্জস্য রেখে বলা হয়েছে “মা রীরিষঃ”।
গরু, ঘোড়া, গর্ভস্থ ভ্রূণ, পিতা-মাতা, প্রিয় শরীর এইসবের সংহার কি সাধারণ রাজপুরুষের দ্বারা সম্ভব?
এমন কেউ কি আছেন যাঁর কাছে সন্তান, পশু, জীবন প্রার্থনা করে রক্ষা চাওয়া হয়?
ঈশ্বরের দিকটি এখানে দ্বৈতঃ তিনি সংহারকারী এবং রক্ষাকারী, তাই তো তাঁকে হিংসা না করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
ঈশ্বর যদি সংহার করতে না পারেন, তবে প্রলয়ের কর্তা কে?
রুদ্র যদি হিংসাশক্তিহীন ঈশ্বর হতেন, তবে “মা বধীঃ” এই প্রার্থনা কেন?
ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, উপনিষদ সব জায়গায় রুদ্রই সর্বজ্ঞান, সর্বত্র, যজ্ঞীয়, প্রলয়কারী, দয়ালু ঈশ্বর।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে যেই রুদ্র “একো রুদ্রঃ”, “শিবঃ কেবলঃ” সেই রুদ্র কি পৃথক?
একই মন্ত্র যদি ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, উপনিষদে পাওয়া যায়, তবে কিভাবে “বেদের রুদ্র পৃথক” বলতে পারেন?
যিনি “ত্মীশ্বরানাং পরমং মহেশ্বরং”, যিনি গাভী থেকে সন্তান সবকিছুর জীবনের উপর কর্তৃত্বশালী, তিনি সেনাপতি?
উপনিষদে যাঁকে সর্বেশ্বর, সর্বজ্ঞ, সর্বভূতাধিপতি বলা হচ্ছে, তাঁকে আপনি সেনাপতি বলছেন কোন প্রমাণে?
যদি সেনাপতি হয়েই থাকেন, তবে সেই সেনানায়ক কোথায় আছে যাঁকে ঘৃতসহ আহুতি দেওয়া হয়?
ঈশ্বরকে উদ্দেশ করে “মা রীরিষঃ”, “মা বধীঃ” বলে কাতর আহ্বান করা হচ্ছে, আপনি সেটিকে মানব সেনানীতির নির্দেশ বলবেন কি করে?
শাস্ত্রকারেরা যদি এই রুদ্রকে “পরমেশ্বর” বলে থাকেন, তাহলে আপনাদের পক্ষ থেকে তাঁকে “সামরিক প্রতীক” বলার অধিকার কোথা থেকে আসে?
রুদ্র যদি সেনানায়ক হন, তবে ঈশ্বর কে?
রুদ্র যদি প্রতীক হন, তবে যজ্ঞে তাঁকে আহ্বান করার মাধ্যমে কি প্রতীক পূজা হচ্ছে?
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী —
যদি বলা হয় যে, সাকারবাদীর মতে ঈশ্বরের শস্ত্রধারী হওয়াতে কোন দোষ নেই, যেমন রামচন্দ্রাদি ধনুক ধারী ছিলেন। এর উত্তর এই যে, রামচন্দ্রাদির সমান সাকার রুদ্র যদি মানা হয় তবে পুরাণ মতে রুদ্রের উৎপত্তি ব্রহ্মার থেকে। কূর্মপুরাণের ১০ম অধ্যায়ে রুদ্রের উৎপত্তির বর্ণনা এভাবে রয়েছে -
"ব্রহ্মা প্রজা সৃষ্টির জন্য অনেক তপ করলেন, এবং কোন কিছু উৎপন্ন না হলে তখন ব্রহ্মার চোখ থেকে অশ্রু ঝড়ে পড়লো। এবং সেই অশ্রু বিন্দু থেকে ভূত প্রেত উৎপন্ন হলো। তারপর ক্রোধে ব্রহ্মা দেহত্যাগ করলেন। সেই সময় ব্রহ্মার মুখ থেকে সূর্যের মতো অগ্নির তূল্য রুদ্র প্রাদুর্ভূত হলেন। তা দেখে মহাদেব ক্রন্দন করতে লাগলেন। তাই দেখে ব্রহ্মা বললেন, কেঁদো না। তিনি আরো বললেন তুমি রোদন করছো বলে জগতে তোমার নাম হবে রুদ্র।" [সংক্ষেপিত]
পুরাণের এই উদ্ধৃতি অনুসারে রুদ্রের উৎপত্তি ব্রহ্মার থেকে বলা হয়েছে। আর পৌরাণিক মতানুসারে ব্রহ্মাই সর্বপ্রথম বেদ জ্ঞান লাভ করেন। তাহলে যে রুদ্রের উৎপত্তি ব্রহ্মার থেকে এবং যে রুদ্র নাম ব্রহ্মাই দিলেন তাহলে সে রুদ্রের বর্ণনা বেদে থাকা কিভাবে সম্ভব? এ থেকে স্পষ্ট যে বেদে কোন পৌরানিক রুদ্রের বর্ণনা নেই। আমরা উব্বট, মহিধর আদি আচার্যের ভাষ্য অনুসারে দেখিয়েছি যে, এ অধ্যায়ে রুদ্র সর্বত্র ঈশ্বর পক্ষে তাহারাও ঘটান নি। বরং এখানে সাকার রূপ যে রুদ্রের বর্ননা পাওয়া যায় তাতে ক্ষাত্র ধর্মের যোদ্ধার বর্ননাই সিদ্ধ হয় যা মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
কিন্তু সেসব পৌরাণিকগণ "যাতে রুদ্র শিবা তনুঃ" এই মন্ত্র দ্বারা রুদ্রের শরীর সিদ্ধ করতে মন্ত্রটিকে ঈশ্বর পক্ষে লাগিয়ে যারা ঈশ্বরের সাকারত্বের পক্ষে ওকালতি করে তারা উক্ত অধ্যায়ের নিম্নোক্ত মন্ত্রগুলোতে রুদ্রের অর্থ কি করবে?
❌অনার্যদের দাবী— কূর্মপুরাণ ও অন্যান্য পুরাণ মতে রুদ্রের উৎপত্তি ব্রহ্মার অশ্রু থেকে। তাই রুদ্রকে প্রাকবৈদিক বা বৈদিক ঈশ্বরস্বরূপ বলার সুযোগ নেই। কারণ ব্রহ্মাই যদি রুদ্রকে সৃষ্টি করেন, তবে রুদ্র কিভাবে পূর্বতন বেদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন? রুদ্র নাম ব্রহ্মা দিয়েছেন রুদ্রের "রোদন" কর্ম দেখে। এর দ্বারা বোঝা যায়, ‘রুদ্র’ নাম কোন চিরন্তন ঈশ্বরতুল্য স্বনাম নয়, বরং কর্মানুগ (রোদন-সম্পর্কিত) একটি নাম যা সৃষ্টি পরবর্তী, বৈদিক প্রাক নয়।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— অনার্যরা কূর্ম্মপুরাণের ১০ অধ্যায়ের খণ্ডিত অংশকে দেখিয়ে এটাই প্রমাণ করতে চাইছে এখানে রুদ্র ব্রহ্মার থেকে উৎপত্তি হচ্ছে তাই যার উৎপত্তি হচ্ছে সে বেদে কীভাবে থাকবে! কিন্তু, অনার্যদের এই দাবী সম্পূর্ণ ভুল ও অযৌক্তিক। কেননা, পুরাণ হোক বা বেদ, ঘটনার বিচার করতে হয় প্রসঙ্গ ও প্রেক্ষাপট যাচাই করে। এবার দেখে নেবো কূর্ম্মপুরাণের পূর্বভাগের ১০ম অধ্যায়ে কি বলা হয়েছে—
বিষ্ণুরুবাচ—
কচ্চিন্নু বিস্মৃতো দেবঃ শূলপাণিঃ সনাতনঃ।
যদুক্তো বৈ পুরা শম্ভুঃ পুত্রত্বে ভব শঙ্কর।।১৭।।
“বিষ্ণু মোহনাশের নিমিত্ত স্বীয় পুত্র ব্রহ্মাকে বলিলেন,-তুমি কি সনাতন শূলপাণি মহাদেবকে বিস্মৃত হইয়াছো? পূর্ব্বে তুমি যে মহাদেবকে বলিয়াছিলে "হে শঙ্কর! তুমি আমার পুত্র হও।”
"ব্রহ্মার অশ্রু থেকে রুদ্র উৎপন্ন", এটি কোনো মৌলিক সৃষ্টি নয়, বরং লীলাময় প্রকাশ। অর্থাৎ, রুদ্র তখন সৃষ্ট বিশ্বে প্রকাশ পেলেন, কিন্তু তাঁর অস্তিত্ব অনাদিকাল থেকে বিরাজমান।
কূর্মপুরাণেই বলা হয়েছে "সনাতনঃ শূলপাণিঃ" রুদ্র সনাতন, অনাদি, চিরন্তন।
তাহলে যদি তিনি সনাতন হন, তবে তিনি ব্রহ্মা-সৃষ্ট হতেই পারেন না। এই 'অশ্রুজাত' কাহিনী কেবল জগতের দৃষ্টিতে তাঁর অবতার বা প্রকাশ ব্যাখ্যা করে।
তবে প্রশ্ন থাকতে পারে যে, তবে ব্রহ্মার থেকে রুদ্রের উৎপত্তির ঘটনা কি মিথ্যা? আসলে তা নয়। লিঙ্গোদ্ভব প্রেক্ষাপটের সময়েই পরমেশ্বর শিব যখন ব্রহ্মার মোহ নাশ করেন তখন ব্রহ্মা শিবকে পরমেশ্বর জানতে পেরে, পরমেশ্বর শিবের কাছ থেকেই এই বরদান চেয়ে নেন যাতে শিবই ব্রহ্মার পুত্ররূপে আবির্ভূত হন। এই প্রসঙ্গে কূর্ম্মমহাপুরাণনের পূর্বভাগের ৯ নং অধ্যায়ে বলা আছে—
ভগবন্ ভূতভব্যেশ মহাদেবাম্বিকাপতে।
ত্বামেব পুত্রমিচ্ছামি ত্বয়া বা সদৃশং সুতম্ ॥৭১
[কূর্ম্মমহাপুরাণ/পূর্বভাগ/অধ্যায় ৯/৭১]
"হে ভগবান্! হে অতীত-ভবিষ্যতের অধীশ্বর! হে মহাদেব! হে অম্বিকার স্বামী! আমি কেবল আপনাকেই পুত্ররূপে চাই, অথবা আপনার মতো সদৃশ একজন পুত্রকে চাই।"
অর্থাৎ, পূর্বে পরমেশ্বর শিব ব্রহ্মাকে বরদান দিয়েছিলেন, তিনি ব্রহ্মার পুত্র হবেন। তাই পরমেশ্বর শিব নিজের বাক্য ও বরদানকে ফলিত করার জন্য ব্রহ্মার ক্রোধ থেকে নিজেই প্রকাশিত হন। এটা পরমেশ্বর শিবেরই লীলা মাত্র। পুরাণে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে- এক পরমেশ্বর শিবই নিজেকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র স্বরূপে প্রকাশ করেন সৃষ্টির নিমিত্তে। আবার সেই পরমেশ্বর শিবকেই শ্রুতিতে, “একহি রুদ্র ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য” বলা হয়। তাই তত্ত্বগত ভাবে বিচার না করে যদি মূর্খামি করে বিচার করে, তবে এমনই মনে হবে যে- রুদ্রের জন্ম হয়, তাই বেদের রুদ্র বলতে পৌরাণিক রুদ্রকে বোঝায় না।
👉পরবর্তী শ্লোক গুলো দেখা যাক—
অবাপ্য সংজ্ঞাং গোবিন্দাৎ পরযোনিঃপিতা
প্রজাঃ অষ্টুমনান্তেপে তপঃ পরমদুশ্চরম্।।১৮।।
তস্যৈবং তপ্যমানস্য ন কিঞ্চিৎ সমবর্তত।
ততো দীর্ঘেণ কালেন দুঃখাৎক্রোধোহত্যক্ষার।।১৯।।
ক্রোধাবিষ্টস্য নেত্রাভ্যাং প্রাপতন্নশ্রুবিন্দরঃ।
ততন্তেভ্যোঽশ্রুবিন্দুভ্যো ভূতাঃ প্রেতান্তদাভবন্ ॥
সর্ব্বাংস্তানগ্রতো দৃষ্টা ব্রহ্মাত্মানমবিন্দত।
জহৌ প্রাণাংশ্চ ভগবান্ ক্রোধাবিষ্টঃপ্রজাপতি
তদা প্রাণময়ো রুদ্রঃ প্রান্থরাসীৎ প্রভোর্মুখাৎ সহস্রাদিত্যসঙ্কাশো যুগান্তদহনোপমঃ। ২২।।
রুরোদ সুস্বরং ঘোরং দেবদেবঃ স্বয়ং শিবঃ।
রোদমানং ততো ব্রহ্মা মা রোদীরিভ্যভাবত।
রোদনারুদ্র ইত্যেবং লোকে খ্যাতিং গমিষ্যসি।
অন্যানি সপ্ত নামানি পত্নীঃ পুত্রাংশ্চ শাশ্বতান্।।
স্থানানি তেষামষ্টানাং দদৌ লোকপিতামহঃ। তেষামষ্টানাং দদৌ লোকপিতামহঃ।
ভবঃ সর্ব্বন্তথেশানঃ পশূনাং পতিরেব চ।
ভীমশ্চোগ্রো মহাদেবস্তানি নামানি সপ্ত বৈ।
সূর্য্যো জলং মহী বহ্নির্বাযুরাকাশমেব চ।
দীক্ষিতো ব্রাহ্মণশ্চন্দ্র ইত্যেতা অষ্টমূর্ত্তয়ঃ।।২৬।।
স্থানেন্বেতেষু যে রুদ্রান্ ধ্যায়ন্তি প্রণমস্তি চ।''
তেষামষ্টতনুদেবো দদাতি পরমং পদম্ ॥২৭।।
[কূর্ম্মমহাপুরাণ / পূর্বভাগ / অধ্যায় ১০/ শ্লোক নং ১৮-২৭]
👉(শ্লোক ১৭)
“বিষ্ণু বলেন— হে ব্রহ্মা, তুমি কি সনাতন শূলপাণি মহাদেবকে বিস্মৃত হয়েছো?”
এই শ্লোকেই প্রথমে রুদ্রের প্রকৃত সত্তা বোঝা যায়, তাঁকে বলা হয়েছে "সনাতনঃ শূলপাণিঃ"।
“সনাতন” মানেই চিরন্তন, অনাদি, অজন্মা। অর্থাৎ তিনি ব্রহ্মার সৃষ্টি নন, বরং স্বয়ং সৃষ্টির কারণরূপ পরমেশ্বর। এই পরিচয় ব্রহ্মার পূর্বজ্ঞান ছিল, তবে তিনি তা সময়বিশেষে বিস্মৃত হয়েছিলেন, তাই বিষ্ণু স্মরণ করাচ্ছেন।
👉(শ্লোক ১৮–১৯)—
ব্রহ্মা গোবিন্দ থেকে আদেশ ও সংজ্ঞা পেয়ে দুঃসাধ্য তপস্যা শুরু করেন। কিন্তু ফল না পাওয়ায় তাঁর অন্তরে দুঃখ ও ক্রোধ উদয় হয়, যার ফলে তাঁর নেত্র থেকে অশ্রুপাত ঘটে।
এই “অশ্রুপাত” ও “ক্রোধ” কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতার চিত্র নয়, বরং জগতের বিভিন্ন তমোগুণপ্রধান সত্তার (ভূত, প্রেত প্রভৃতি) প্রাদুর্ভাবের উপযোগী পরিবেশ তৈরির রূপক, যার মাধ্যমে বোঝানো হয় যে বিশ্বে স্থুলতর শক্তির উদ্ভবও সত্তার লীলার অংশ।
👉(শ্লোক ২১–২২)—
ব্রহ্মা তখন নিজেকে তিরস্কার করে প্রাণত্যাগ করেন। এই “প্রাণত্যাগ” বোঝায় ব্রহ্মার অন্তর থেকে সবাত্মকভাবে শুদ্ধ ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ, এর ফলেই রুদ্রের আত্মপ্রকাশ।
এখানেই বলা হয়—
“তদা প্রাণময়ো রুদ্রঃ প্রান্তরাসীত প্রভোর্মুখাৎ সহস্রাদিত্যসঙ্কাশঃ”
অর্থাৎ, সহস্রসূর্য্যসম তেজস্বী রুদ্র ব্রহ্মার মুখ থেকে আত্মপ্রকাশ করলেন। একই প্রমাণ মহাভারতেও বিদ্যমান—
অহ্নঃ ক্ষয়ে ললাটাচ্চ সুতো দেবস্য বৈ তথা।
ক্রোধাবিষ্টস্য সংযজ্ঞে রুদ্রঃ সংহারকারকঃ ॥১৭॥
[মহাভারত/শান্তিপর্ব/অধ্যায় ৩২৭/শ্লোক ১৭–১৮]
যজ্ঞকালে, দিনের শেষে, যখন দেবতা (অর্থাৎ ব্রহ্মা) ক্রোধে অভিষ্ট হন, তখন তাঁর ললাট থেকে একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করেন, তিনি হলেন রুদ্র, যিনি সংহারকার্য করেন।
শ্রুতিতেও এমন সমর্থন পাওয়া যায়—
“তত উদতিষ্টৎ সহস্রাক্ষঃ সহস্ত্রপাৎ”
[ঋগবেদ/কৌষীতকি ব্রাহ্মণ/৬/১/১৩]
সহস্র চক্ষু আর সহস্র চরণ বিশিষ্ট (রুদ্র) উৎপন্ন হয়েছে।।
এই উৎপত্তি প্রকৃত অর্থে শারীরিক নয়, বরং জগতব্যাপী তেজের অবতারণা, যা শুধুমাত্র রূপান্তরের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা প্রকাশ।
অনার্যদের দাবী অনুযায়ী— রুদ্রের জন্ম ব্রহ্মা থেকে তাই এটা সৃষ্টির পরবর্তী ঘটনা হওয়ার জন্য, রুদ্র বৈদিক নয়। কারণ বেদ সৃষ্টির আগে থেকেই বিদ্যমান ছিলো। এখন যদি অনার্যদের এই যুক্তি মেনে নিই তবে অনার্যরা এর কি উত্তর দেবে?
ব্রীহয়শ্চ মে যবাশ্চ মে মাষাশ্চ মে তিলাশ্চ মে মুদ্গাশ্চ মে খল্বাশ্চ মে প্রিয়ঙ্গবশ্চ মেঽণবশ্চ মে শ্যামাকাশ্চ মে নীবারাশ্চ মে গোধূমাশ্চ মে মসূরাশ্চ মে যজ্ঞেন কল্পন্তাম্॥ [যজুর্বেদ ১৮/১২]
দয়ানন্দভাষ্য– (ব্রীহয়ঃ) তণ্ডুলাঃ (চ) ষষ্টিকাঃ (মে) (যবাঃ) (চ) আঢক্যঃ (মে) (মাষাঃ) (চ) কলায়াঃ (মে) (তিলাঃ) (চ) নারিকেলাঃ (মে) (মুদ্গাঃ) (চ) তত্সংস্কারাঃ (মে) (খল্বাঃ) চণকাঃ (চ) তত্সাধনম্ (মে) (প্রিয়ঙ্গবঃ) ধান্যবিশেষাঃ (চ) অন্যানি ক্ষুদ্রান্নানি (মে) (অণবঃ) সূক্ষ্মতণ্ডুলাঃ (চ) তৎপাকঃ (মে) (শ্যামাকাঃ) (চ) (মে) (নীবারাঃ) বিনা বপনেনোৎপন্নাঃ (চ) এতৎসংস্করণম্ (মে) (গোধূমাঃ) (চ) এতৎসংস্করণম্ (মে) (মসূরাঃ) (চ) এতৎসম্বন্ধি (মে) (যজ্ঞেন) সর্বান্নপ্রদেন পরমাত্মনা (কল্পন্তাম্)॥১২॥
অর্থ– চাল, যব, কলায়, তিল, নারিকেল, মুগ, ছোলা, প্রিয়ঙ্গু সহ অন্যান্য ক্ষুদ্র বীজ, শ্যামাক, নীবার, গম প্রভৃতি সংগ্রহ করে অগ্নিতে হবন করবে এবং অন্যদের খাওয়াবে।
অশ্মা চ মে মৃত্তিকা চ মে গিরয়শ্চ মে পর্বতাশ্চ মে সিকতাশ্চ মে বনস্পতয়শ্চ মে হিরণ্যঞ্চ মে যশ্চ মে শ্যামঞ্চ মে লোহঞ্চ মে সীসঞ্চ মে ত্রপু চ মে যজ্ঞেন কল্পন্তাম্॥ [যজুর্বেদ ১৮/১৩]
দয়ানন্দভাষ্য– (অশ্মা) পাষাণঃ (চ) হীরকাদীনি রত্নানি (মে) (মৃত্তিকা) প্রশংসিতা মৃৎ (চ) সাধারণা মৃৎ (মে) (গিরয়ঃ) মেঘাঃ (চ) অন্নাদি (মে) (পর্বতাঃ) হ্রস্বা মহান্তঃ শৈলাঃ (চ) সর্বধনম্ (মে) (সিকতাঃ) (চ) তত্রস্থাঃ পদার্থাঃ সূক্ষ্মা বালুকাঃ (মে) (বনস্পতয়ঃ) বটাদয়ঃ (চ) আম্রাদয়ো বৃক্ষাঃ (মে) (হিরণ্যম্) (চ) রজতাদি (মে) (অয়ঃ) (চ) শস্ত্রাণি (মে) (শ্যামম্) শ্যামমণিঃ (চ) শুক্ত্যাদি (মে) (লোহম্) সুবর্ণম্। লোহমিতি সুবর্ণনামসু পঠিতম্॥ (নিঘং॰১.২) (চ) কান্তিসারাদিঃ (মে) (সীসম্) (চ) জতু (মে) (ত্রপু) (চ) রঙ্গম্ (মে) (যজ্ঞেন) সঙ্গতিকরণযোগ্যেন (কল্পন্তাম্)॥১৩॥
অর্থ– পাষাণ, হীরে প্রভৃতি রত্ন, প্রশস্য মৃত্তিকা, সাধারণ মৃত্তিকা, মেঘ, অন্নাদি, ছোট ও বড় পাহাড়, সূক্ষ্ম বালি, বট আম প্রভৃতি বৃক্ষ, রূপা প্রভৃতি, শস্ত্র, শ্যামমণি, ঝিনুক আদি, সোনা, কান্তিসার, সীসা, লাক্ষা, রাঙ প্রভৃতি সম্পাদন করে উপযোগ করবে।
এই দুটি মন্ত্র ও স্বঘোষিত মহর্ষি দয়ানন্দের ভাষ্য যাচাই করার পর কিছু শংকা এর উদয় হয়। যেমন- বেদ যদি অনাদিকাল থেকেই বিদ্যমান ছিলো তবে, বেদের মধ্যে সৃষ্টির পরবর্তীর উপাদান কীভাবে উল্লেখিত থাকবে? চাল, ডাল, তিল, নারিকেল ইত্যাদি শস্যের উল্লেখ নিত্য শ্রুতিতে কীভাবে থাকবে? কারণ সৃষ্টিই যদি না থাকে এসবের উৎপাদন হবে কীভাবে? প্রথমে সৃষ্টির বিকাশ হবে তারপরই তো এসবের উৎপাদন সম্ভব হবে নাকি? একই ভাবে হীরা আদি রত্ন, সোনা আদি ধাতুও তো সৃষ্টির বিকাশ হওয়ার পরেই প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদন হয়। এছাড়াও সীসা, রাঙ আদি সঙ্কর ধাতু তো মানুষ কতৃক নির্মিত হয়, প্রাকৃতিক ভাবে হয় না। একটির সাথে অন্য একটি ধাতু মিশিয়ে নির্মাণ করা হয়। এসব তো প্রাক্বৈদিক নয়, তবে এসবের উল্লেখ বেদে কীভাবে আসলো? এবং দয়ানন্দও বা কেন সৃষ্টির পরের বিষয় নিয়ে ভাষ্য করলো? তাহলে রুদ্র অবৈদিক হলে কি বেদের এই উক্তি গুলোও অপ্রামাণিক ও প্রক্ষিপ্ত?
অনার্যরা বলে— রুদ্র ব্রহ্মার সৃষ্টি, তাই তিনি সৃষ্টির পরে, আর বেদ তো অনাদি, ফলে রুদ্র অবৈদিক।
এই যুক্তি দ্বিগুণভাবে ভ্রান্ত।
প্রথমত, তারা যে রুদ্রকে সৃষ্টি-পরবর্তী বলে, তিনি হলেন পুরাণকথিত ত্রিদেবের অন্তর্গত রুদ্র, যিনি প্রকৃত পরমেশ্বর শিব নন।
দ্বিতীয়ত, তারা এই ত্রিদেবীয় রুদ্রকেই বেদের একমাত্র "রুদ্র" বলে ধরে নিচ্ছে, যা অজ্ঞতাপ্রসূত রূপান্তর ও অর্থহীন ভেদাভেদহীনতা।
হ্যাঁ তবে এটা ঠিক যে, রুদ্রই শিবের গুণসত্ত্বা। যার দ্বারা পরমেশ্বর শিব জগতর সমস্ত কার্য সম্পাদন করেন। তাই তত্ত্বগত ভাবে রুদ্র ও শিব এক হলেও ব্যবহারিক দিক থেকে আলাদা। তাই বেদের প্রসঙ্গে বুঝতে হবে, কোন স্থানে পরমেশ্বর শিবের উল্লেখ করেছে আর কোন স্থানে ত্রিদেবের অন্তর্গত রুদ্রের উল্লেখ করেছে।
পূর্বমীমাংসা ১.১.৫ অনুসারে—
“ঔৎপত্তিকস্তু শব্দস্যার্থেন সম্বন্ধস্তস্য জ্ঞানম্ উপদেশোঽব্যতিরেকশ্চার্থেঽনুলব্ধে তৎ প্রমাণং বাদরায়ণস্যানপেক্ষত্বাৎ”
বেদের শব্দ ও অর্থের সম্পর্ক জন্মগত, এবং বেদই এমন বিষয় জানায় যা অন্যভাবে জানা যায় না; বেদ নিজেই প্রমাণ, ইতিহাস বা ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করে না।
যজুর্বেদের বহু মন্ত্রে রুদ্র শব্দ দ্বারা যিনি বোঝানো হচ্ছেন, তিনি ভয়ংকর, সর্বনাশক, সর্বজ্ঞ, অগ্নিস্বরূপ, সর্বব্যাপী ও প্রার্থিত পুরুষ যা কেবল পরমেশ্বর শিবেরই লক্ষণ।
আর যদি বলা হয় "সৃষ্টির পরে উৎপন্ন কিছু বেদে থাকতে পারে না", তাহলে চাল, তিল, নারিকেল, রাঙ, সোনা, সীসা এসব সৃষ্টির পরের উপাদান বেদে কীভাবে এল?
তাহলে কি বেদের বহু অংশই অবৈধ?
সৃষ্টির পরে উৎপন্ন বস্তু বেদে থাকতে পারে না, এই যুক্তি যদি ধরা হয়, তবে বেদই অপ্রামাণিক হয়ে পড়ে।
পূর্বমীমাংসা সূত্র বলে, বেদ নিজেই প্রমাণ। বেদে যিনি 'রুদ্র' বলে চিহ্নিত, তিনিই বৈদিক পরমেশ্বর শিব, তাঁর পরমত্ব ইতিহাস বা পুরাণ দিয়ে খণ্ডন করা চলে না।
ন্যায়সূত্রের পরিপ্রেক্ষিত—
“প্রতিজ্ঞা-হেতু-দাহরণ-উপনয়ন-নিগমনানি অবয়বাঃ।”
[ন্যায়/১/১/৩২]
“প্রতিজ্ঞা (দাবি), হেতু (কারণ), উদাহরণ, উপনয় (প্রয়োগ), নিগমন (উপসংহার) এই পাঁচটি যুক্তির অঙ্গ।”
এই পাঁচটি অঙ্গ উপস্থিত না থাকলে সেই যুক্তি ত্রুটিযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। যেখানে প্রতিজ্ঞা (দাবি) থাকলেও হেতু বা উদাহরণ না থাকে, সেখানে সেই যুক্তিকে বলা হয় “অননুগ্রাহ্য প্রতিজ্ঞা” (unsupported assertion)।
অনার্যদের যুক্তি বিশ্লেষণ (ত্রুটিযুক্ত যুক্তি প্রমাণ)—
(১) প্রতিজ্ঞা (প্রধান দাবি)—
“রুদ্র বেদীয় নন।”
এই দাবিটি তারা বারবার তোলে, তাই এটি প্রতিজ্ঞা।
(২) হেতু (কারণ)—
“কারণ, রুদ্র ব্রহ্মা থেকে উৎপন্ন, আর বেদ অনাদি। তাই যিনি পরে সৃষ্টি, তিনি বেদে থাকতে পারেন না।”
তারা এটিকে কারণ হিসাবে দেয়। কিন্তু’ এটা একপাক্ষিক এবং অপ্রমাণিত।
(৩) দৃষ্টান্ত (উদাহরণ)—
অনুপস্থিত।
তারা এমন কোনও দৃষ্টান্ত দেয় না, যেখানে বেদে এমন কিছুর উল্লেখ নেই যা পরে উৎপন্ন হয়েছে, বা অন্য কোনও সৃষ্টিপরবর্তী উপাদান বেদে অনুপস্থিত থাকার দৃষ্টান্ত দেয় না। “হেতুর সমর্থনে প্রাসঙ্গিক দৃষ্টান্ত নেই”, এটি যুক্তির গুরুতর ত্রুটি। এটি দৃষ্টান্তভাব দোষ।
কারণ, যদি রুদ্র বেদীয় হতে না পারেন শুধুমাত্র এই কারণে যে তিনি ব্রহ্মা-সৃষ্ট, এবং তাই পরে উৎপন্ন, তবে চাল, ডাল, নারিকেল, সোনা, সীসা, রাঙ এই সকল বস্তু সৃষ্টির পর উৎপন্ন। অথচ তারা বেদে স্পষ্টভাবে উপস্থিত। তাহলে ওই যুক্তিতে এই পদগুলোও অবৈদিক হয়ে পড়বে। ফলতঃ, বেদ প্রমাণই নষ্ট হয়ে যাবে। এটি “স্বপ্রতিপক্ষদোষ” নিজের যুক্তির বিপরীত উদাহরণই বেদে আছে।
(৪) উপনয় (কার্যস্থলে হেতুর প্রয়োগ)—
তাদের অব্যবস্থাপূর্ণ ভাবে ধারণা-
“রুদ্র যেহেতু ব্রহ্মা থেকে সৃষ্টি, তাই তিনি পরে উৎপন্ন। আর পরে উৎপন্ন বস্তু বেদে থাকতে পারে না।”
কিন্তু, এখানে উপনয়ের একটি বৃহৎ সমস্যা রয়েছে—
তারা হেতুটিকে যেভাবে রুদ্রের উপর প্রয়োগ করছে, সেই রুদ্র কে তা তারা নির্ধারণই করেনি। তিনি কি পরমশিব? সদাশিব? নাকি ত্রিদেবের মধ্যেকার একটি?
এমনকি পুরাণ অনুসারে যে রুদ্র ব্রহ্মার দ্বারা উৎপন্ন, তিনিও তো বহু প্রকারে বর্ণিত।
অতএব, উপনয়েও ব্যর্থতা রয়েছে।
(৫) নিগমন (উপসংহার)—
“তাই রুদ্র বেদীয় নন।”
কিন্তু উপরের অস্পষ্ট হেতু, উদাহরণহীনতা এবং ভ্রান্ত উপনয়ের ফলে এই উপসংহার অবৈধ।
অতএব, এই যুক্তির রূপ দাঁড়ায়—
প্রতিজ্ঞা— “রুদ্র বেদীয় নন” দাবিটি সুস্পষ্টভাবে উপস্থিত।
হেতু— “সৃষ্টিপরবর্তী বেদে থাকতে পারে না” এটি নিজেই বিতর্কিত এবং স্ববিরোধী।
দৃষ্টান্ত— সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, কেবল দাবি করা হয়েছে, প্রমাণ নয়।
উপনয়— অস্পষ্ট এবং ভ্রান্ত প্রয়োগ ‘রুদ্র’ কে বোঝানো হয়েছে তা নির্দিষ্ট নয়।
নিগমন— উপরের দুর্বলতাগুলির ফলে এই উপসংহারও অগ্রহণযোগ্য।
“অননুগ্রাহ্য প্রতিজ্ঞা” প্রমাণ—
ন্যায়সূত্র অনুযায়ী, যে যুক্তিতে দৃষ্টান্ত ও উপনয়ন অনুপস্থিত, এবং হেতু-প্রয়োগ সন্দেহজনক বা স্ববিরোধী, সেই যুক্তি "অননুগ্রাহ্য প্রতিজ্ঞা" বলে গণ্য হয়।
অতএব অনার্যদের “রুদ্র বেদীয় নন” দাবিটি—
যুক্তিসিদ্ধ নয়।
দৃষ্টান্তহীন।
উপনয়হীন।
সত্যপ্রতিপক্ষযুক্ত (কারণ বেদে পরবর্তী সৃষ্টির বহু পদ উপস্থিত)।
অতএব, এটি “অননুগ্রাহ্য প্রতিজ্ঞা” Unsupported Assertion।
👉(শ্লোক ২৩–২৪)—
রুদ্র তখন গম্ভীর ও তীব্র স্বরে রোদন করতে থাকেন। এই ‘রোদন’ তাঁর অন্তরস্থ তপস্যার প্রকাশ। তখন ব্রহ্মা তাঁকে “রোদন করিও না” বললে তিনি ‘রুদ্র’ নামে অভিহিত হন।
পুরাণ মতে, রুদ্র যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তিনি প্রবলভাবে রোদন শুরু করেন। সেই রোদন দেখে ব্রহ্মা বলেন— "রোদনা রুদ্র ইত্যেবং লোকে খ্যাতিং গমিষ্যসি" অর্থাৎ, “তুমি রোদন করছো, তাই তুমি রুদ্র নামে খ্যাত হবে।” এখান থেকেই অনার্যপক্ষ যুক্তি দাঁড় করায় যে, ‘রুদ্র’ নাম একটি কর্মনির্ভর (রোদনসংক্রান্ত) নাম, এবং তা সৃষ্টি পরবর্তী। অর্থাৎ, রুদ্রের কোনও পূর্বঅস্তিত্ব নেই, তাঁর নাম ও সত্তা উভয়ই সৃষ্টি পরবর্তী।
কিন্তু আদতে, ‘রুদ্র’ নামটি পূর্ব থেকেই তাঁকে গৃহীত, এই রোদনের ঘটনা কেবল সেই নামের একটি অর্থতাত্ত্বিক সম্ভাবনা মাত্র, তার নামকরণের মূল কারণ নয়। কেননা শাস্ত্রে বলছে—
"সর্বাণি হ বা অস্য নামধেয়ানি"
[আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র/৪/৯/২৭]
সব নামই রুদ্রেরই।।
অর্থাৎ—পরমতত্ত্ব পরশিবের সব নামই এক চেতনার বিভিন্ন রূপ, যার কেন্দ্রে রয়েছেন রুদ্র। কেননা, জগতের যত নাম ও রূপ তা বস্তুত রুদ্রেরই, কারণ রুদ্র'ই সর্বব্যাপী “সর্বে বৈ রুদ্রঃ” [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/২৪] এই শ্রুতি বাক্য ইহারই সমর্থন করে। তাই কোনো একটি ঘটনাবিশেষ থেকে একটি নামের উৎপত্তি কল্পনা করলেও, তা তাঁর চিরন্তন স্বরূপকে সীমাবদ্ধ করতে পারে না। এ কারণেই, এই নামকরণ ঘটনার পেছনে থাকা আখ্যানটি একপ্রকার লীলাময় রূপক, যার উদ্দেশ্য জগতকে এক তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে রুদ্রতত্ত্ব বোঝানো, কোনো দেহগত সৃষ্টির কালানুক্রমিক প্রমাণ নয়।
👉(শ্লোক ২৫–২৬)—
ব্রহ্মা তখন রুদ্রকে সাতটি অন্যান্য নাম দেন।
ভব, সর্ব, ঈশান, পশুপতি, ভীম, উগ্র, মহাদেব।
এবং রুদ্রের অষ্টমূর্তি (সূর্য, জল, ভূমি, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, ব্রাহ্মণ, চন্দ্র) নির্দিষ্ট করেন।
অর্থাৎ শিবের অষ্টমূর্তিরই উল্লেখ, যার মধ্যে একজন হলো রুদ্র যিনি ব্রহ্মার ক্রোধ থেকেই প্রকাশিত হন। এই অষ্টমূর্তির উল্লেখ অধিকাংশ পুরাণেই পাওয়া যায়। তার সাথে শতপথ ব্রাহ্মণেও একই কথায় বলা আছে ব্রহ্মার থেকে রুদ্র প্রকাশিত হন, এবং রুদ্রের রোদনের জন্য ব্রহ্মা তাকে রুদ্র নাম দেন সাথে আরও সাতটি নাম দেন। “শতপথ ব্রাহ্মণ- ৬/১/৩/ ১০-১৯” এখানে শিবের অষ্টমূর্তির উল্লেখ স্পষ্টই আছে। আবার আশ্বলায়ণ গৃহ্যসূত্রেও শিবের অষ্টমূর্তির উল্লেখ পাওয়া যায়—
হরায় মৃডায় শর্বায় শিবায় ভবায় মহাদেবোগ্রায় ভীমায় পশুপতয়ে রুদ্রায় শঙ্করায়েশানায় স্বাহেতি ।।১৭।।
[আশ্বলায়ণ গৃহ্যসূত্র /৪/৯/১৭]
একই সমর্থন পারস্কর গৃহ্যসূত্রেও—
রূদ্রায় স্বাহা, শর্বায় স্বাহা, পশুপতয়ে স্বাহা, উগ্রায় স্বাহা, ঈশানায় স্বাহা, ভবায় স্বাহা, মহাদেবায় স্বাহা, ঈশানায় স্বাহা।।
[পারস্কর গৃহ্যসূত্র /৩/৮/৬]
এইসব নাম ও মূর্তি দ্বারা বোঝানো হচ্ছে, রুদ্র সমগ্র সৃষ্টির অন্তর্যামী, তিনি সব উপাদানের মধ্যে বুদ্ধিসঙ্গতভাবে ছড়িয়ে আছেন, এবং যিনি এই রূপে ধ্যানযোগ্য, তিনিই পরমপদ দান করেন।
👉(শ্লোক ২৭)—
যে ব্যক্তি এই রুদ্রের অষ্টমূর্তি-রূপে ধ্যান করে, রুদ্র তাকে ‘পরমং পদম্’, অর্থাৎ চূড়ান্ত মোক্ষ প্রদান করেন।
এই শ্লোকে পরিষ্কার বলা হয়েছে। রুদ্রই পরমপদ দাতা ঈশ্বর, অর্থাৎ তিনি কারো দ্বারা সৃষ্ট কেউ নন, তিনি নিজেই চূড়ান্ত তত্ত্ব।
অনার্যদের মতে কূর্ম্মপুরাণ অনুসারে যে রুদ্রের উল্লেখ রয়েছে, তিনি বৈদিক রুদ্র নন৷ তবে কূর্ম্মপুরাণের উক্ত ভাগে ব্রহ্মা এই কথা কেন বললো যে- রুদ্রই ত্রিদেব স্বরূপ ও বেদের কর্তা বেদের সার? উক্ত প্রমাণ দেখে নেওয়া যাক—
নমস্ত্রিমূর্ত্তয়ে তূভ্যং ব্রহ্মণে জনকায় তে।
ব্রহ্মবিদ্যাধিপয়ে ব্রহ্মবিদ্যাপ্রদায়িনে।।৪৬।।
নমো বেদরহস্যায় কালকালায় তে নমঃ।
বেদান্তসারসারায় নমো বেদাত্মমূর্ত্তয়ে ॥৪৭।।
[কূর্ম্মমহাপুরাণ/পূর্বভাগ/ অধ্যায় ১০/ শ্লোক নং ৪৬/৪৭]
ত্রিমূর্তি রূপে পরিগণিত তোমাকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র রূপান্তরকারী রূপে প্রণাম। হে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মণ! তোমাকেই প্রণাম, যিনি ব্রহ্মবিদ্যার অধিপতি এবং ব্রহ্মবিদ্যা দানকারী।
হে বেদের গূঢ়তম রহস্য! তোমাকে প্রণাম। হে কালকেও যিনি গ্রাস করেন সেই কালকাল! তোমাকে প্রণাম। হে বেদান্তের সারতত্ত্ব এবং বেদের আত্মরূপমূর্তি! তোমাকে প্রণাম।
🔘এই রুদ্র যদি কেবল ব্রহ্মার সৃষ্ট অশ্রুজাত এক দেবতা হতেন, তবে তাঁকে কখনোই—
ত্রিমূর্তিস্বরূপ, ব্রহ্মবিদ্যাপ্রদাতা, কালকাল, বেদের গূঢ় রহস্য, বেদান্তসার, বেদাত্মমূর্তি এসব বলা যেত না।
এই শ্লোকদ্বয়ে যে রুদ্রের বর্ণনা, তিনি কেবল একজন দেবতা নন। তিনি ব্রহ্ম, পরমাত্মা, সময়ের অতীত, এবং মুক্তির একমাত্র লক্ষ। এটি পুরাণ ও বেদ উভয়ের সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি। এখানে ব্রহ্মা স্বয়ং যাঁকে “ত্রিমূর্তি, ব্রহ্মবিদ্যাপ্রদাতা, বেদের রহস্য, বেদান্তসার, বেদাত্মমূর্তি” বলে প্রণতি জানাচ্ছেন, সেই রুদ্র নির্বিশেষে বেদীয়, অনাদি, এবং সর্বোচ্চ ব্রহ্ম।
অতএব অনার্যদের এই দাবি যে, “কূর্ম্মপুরাণের রুদ্র বৈদিক রুদ্র নন” এটি সম্পূর্ণভাবে শাস্ত্রবিরুদ্ধ ও অনৈতিহাসিক। কারণ এই বর্ণিত রুদ্রই প্রকৃত বৈদিক রুদ্র, যাঁকে বেদেও বলা হয়—
"এক হি রুদ্রঃ ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য…"
মূল ব্যাপারটা হলো— শিবই অনাদি অনন্ত, শিবের না জন্ম আছে না মৃত্যু। পূর্বেও শিব ছিলো পরেও একমাত্র শিবই বিদ্যমান থাকবে এটাই শ্রুতির মত। অনার্যদের ভুল এখানেই হচ্ছে যে, তারা শিব, সদাশিব, ত্রিদেব সম্পর্কে কিছুই জানে না। যদি জানতো তবে এমন হাস্যকর দাবী কখনো করতো না। আসুন বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলি সহজে—
🔘গ্রাফের মাধ্যমে বুঝি—
⬇️
“শিব”
পরমব্রহ্ম, যাকে ভাবনা, কল্পনা, চিন্তা কিছুই করা যায় না। শিবতত্ত্ব, যিনি সর্বোচ্চ পরমসত্ত্বা যার ঊর্ধ্বে কেউই নেই। তাই শ্রুতিতে শিবকে— “ঊর্ধায় নমঃ” পরমায় নমঃ” [তৈত্তিরীয় আরণ্যক /১০/১৬], “একহি রুদ্র ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য” [শ্বেতা: ৩/২], “শিব এব কেবল” [শ্বেতা: ৪/১৮], “শান্তং শিবম্ অদ্বৈতম্ চতুর্থম্ মন্বন্তে স আত্মা স বিজ্ঞেয়” [মাণ্ডুক্য: ৭]। এই শিবই হলো পরমানন্দস্বরূপ অবস্থা।
⬇️
“সদাশিব”
পরমেশ্বর শিব অনন্ত অসীম অবস্থা থেকে যখন একটা স্বরূপে আবির্ভূত হন সেটাই সদাশিব। ইনি সাক্ষী ব্রহ্ম, শব্দ ব্রহ্ম, অক্ষর ব্রহ্ম, প্রণব স্বরূপ, ওঁকার স্বরূপ, যিনি সাকার ও নিরাকারের মধ্যবর্তী অবস্থা। সদাশিব মায়াতীত, কালাতীত, গুণাতীত ব্রহ্ম। সদাশিব কখনো সরাসরি জগতে প্রবেশ করেননা। তিনি নিজেরই অংশভূত স্বরূপ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্রকে দিয়েই জগতের সকল কার্য পরিচালনা করান৷ অর্থাৎ সদাশিব নিজেকে তিনটা ভাগে বিভক্ত করে, তিনটা স্বরূপে প্রকাশিত করেন বলে উক্ত কূর্ম্মপুরাণে ব্রহ্মা পরমেশ্বর শিবকে স্তুতি করে বলছেন—
“নমস্ত্রিমূর্ত্তয়ে তূভ্যং ব্রহ্মণে জনকায় তে”।।
[কূর্ম্মমহাপুরাণ / অধ্যায় ১০/ শ্লোক নং ৪৬/৪৭]
অন্বয়— নমঃ — প্রণাম / নমস্কার। ত্রিমূর্ত্তয়ে — তিন মূর্তির অধিষ্ঠাতা যিনি, অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র এই ত্রয়ীর মধ্যকার একত্বের রূপ। তুভ্যং — তোমাকে। ব্রহ্মণে — সেই ব্রহ্মকে। জনকায় — সৃষ্টিকর্তাকে / সকল জীব ও জগতের জনককে। তে — তোমার।
"হে ত্রিমূর্তির স্বরূপ, হে ব্রহ্ম, হে জগতের সৃষ্টিকর্তা তোমাকে প্রণাম জানাই।"
শ্রুতিতে সদাশিবের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—
ॐ ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাং ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ব্রহ্মাধিপতির্ব্রহ্মণোহধিপতির্ব্রহ্মা শিবো মে অস্তু সদাশিবোম্।।
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/৪৭]
সায়ণ ভাষ্য— যোঽযমূর্ধ্ববক্ত্রো দেবঃ সোঽয়ং সর্ববিদ্যানাং বেদশাস্ত্রাদিনাং চতুঃষষ্টিকলাবিদ্যানাং ঈশানঃ নিয়ামকঃ। তথা সর্বভূতানামখিলপ্রাণিনামীশ্বরো নিয়ামকঃ। ব্রহ্মাধিপতির্বেদাস্যধিকত্বেন পালকঃ। তথা ব্রহ্মণো হিরণ্যগর্ভাস্যাধিপতিঃ তাদৃশো যো ব্রহ্মা অস্তি প্রবৃদ্ধঃ পরমাত্মা সোঽয়ং মে মমানুগ্রহায় শিবঃ শান্তোঽস্তু। সদাশিবোম্, স এব সদাশিব ওমহং ভবামি।।
ভাষ্যানুবাদ— এই ঊর্ধ্বমুখ দেবতাই হলেন সমস্ত বিদ্যা বেদ, শাস্ত্র ও চৌষট্টি কলার ঈশান ও নিয়ন্তা। তিনিই সমস্ত জীবের ঈশ্বর ও নিয়ামক। তিনি বেদের অধিকারী রূপে রক্ষক এবং ব্রহ্মারও অধিপতি। তিনি হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মারও পরম শাসক। যিনি এইরূপে ব্রহ্মারূপে প্রবৃদ্ধ পরমাত্মা, সেই শিব যেন আমার প্রতি অনুগ্রহশীল হন তিনি শান্ত, সদাশিব। তিনিই চিরন্তন সদাশিব। আমিও যেন সেই সদাশিবই হয়ে উঠি।
👉সদাশিব সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে—
“হিরণ্যবাহবে হিরণ্যরূপায় হিরণ্যপতয়ে অম্বিকাপতয়ে উমাপতয়ে পশুপতয়ে নমঃ নমঃ”
[তৈত্তিরীয় আরণ্যক /১০/১৮]
সায়ণ ভাষ্য— বাহুশব্দস্য সর্ববায়বয়োপলক্ষণত্বাৎ হিরণ্যবাহবে- ভক্তানুগ্রহায় সুবর্ণময়কৃৎস্নশরীরযুক্তায়, হিরণ্যপতয়ে- অস্মদীয়হিরণ্যপালকায়। অম্বিকা- জগন্মাতা পার্বতী, তস্যাঃ ‘পতয়ে’ ভর্চে। তস্যা এব অম্বিকায়াঃ ব্রহ্মবিদ্যাত্মকো দেহ উমাশব্দেনোচ্যতে। তাদৃশ্যাঃ ‘উমায়াঃ’ ‘'পতয়ে’ স্বামিনে রুদ্রায়, পুনঃ পুনঃ নমস্কারো অস্তু। অনেনানুবাকত্রয়েণোক্তানাং মন্ত্রাণাং ত্বরিতরুদ্রাখ্যা মন্ত্রকপ্লেষু প্রসিদ্ধা। তদিনিয়োগস্তু রুদ্রাধ্যায়জপশেষত্বেন কল্পেষু দ্রষ্টব্যঃ।।
ভাষ্যানুবাদ— এখানে রুদ্র সদাশিবকে বহুমাত্রিক দেবতা হিসেবে অভিষিক্ত করছেন। তিনি শুধুমাত্র এক বায়ুরূপ বা একটি দিকের অধিপতি নন, বরং সমগ্র বায়ুতত্ত্বের নিয়ন্ত্রক ও প্রেরক। তিনি হিরণ্যবাহব, অর্থাৎ সোনার মতো দীপ্তিময় দেহধারী, যে ভক্তদের প্রতি সদা অনুকম্পাশীল। তিনি হিরণ্যপতি, এই জগতে যা কিছু মূল্যবান, তা রক্ষার ও নিয়ন্ত্রণের অধিকারী।
তাঁর পাশে অম্বিকা, জগৎজননী পার্বতী। তিনি শক্তিস্বরূপা। তাঁর পতিই রুদ্র। পার্বতীরই জ্ঞানরূপ দেহ ‘উমা’ নামে চিহ্নিত, এবং সেই ‘উমা’রও যিনি স্বামী, তিনিও রুদ্র। এইভাবে রুদ্রকে অম্বিকার পতিরূপে ও জ্ঞানদায়িনী উমার স্বামিরূপে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ রুদ্র শুধু শক্তির অধিপতি নন, জ্ঞান ও করুণারও উৎস।
শেষে বলা হয়েছে, এই তিনটি মন্ত্র (যেখানে রুদ্রের বিভিন্ন রূপে প্রণতি জানানো হয়েছে) “ত্বরিতরুদ্র” নামে প্রসিদ্ধ। এগুলি শুধু স্তব নয়, বরং ধ্যান, সাধনা ও যজ্ঞের একটি বিশেষ অনুষঙ্গ। কল্পসূত্র মতে, এগুলি রুদ্রাধ্যায়ের শেষপর্বে জপ্য মন্ত্র হিসেবে নির্ধারিত, অর্থাৎ এই মন্ত্রগুলি দিয়ে রুদ্রপূজা সম্পূর্ণতা পায়।
এই অংশে রুদ্রকে তেজ, জ্ঞান, করুণা ও শক্তির অধিষ্ঠাতা রূপে পূজিত করা হয়েছে, যিনি দেবী অম্বিকার সহধর্মচারী, সর্বজীবের নিয়ন্তা ও সকল বিদ্যার উৎস।
এই সদাশিব একাধারে নির্গুণের দ্বার এবং সগুণের উৎস। তিনি নিজে জগতে সরাসরি অবতরণ করেন না, বরং তাঁরই ত্রিরূপ প্রকাশ (ত্রিদেব) জগত পরিচালনা করে।
⬇️
“ত্রিদেব”
ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র জগতের পরিচালনা যারা করেন। এই ত্রয়ীই শিবের ত্রিমূর্ত্তি রূপ। তাই ত্রিদেব ভিন্ন নয় শিব থেকে, বরং শিবের সগুণ বিভূতিরূপে। ইতিহাস শাস্ত্র মহাভারতে বলেছে—
যোহসৃজদ্দক্ষিণাদঙ্গাদ ব্রাহ্মণং লোকসম্ভবম্। বামপার্শ্বাত্তথা বিষ্ণুং লোকরক্ষার্থমীশ্বরঃ ॥৩৪৫৷৷
যুগান্তে চৈব সম্প্রাপ্তে রুদ্রমীশোহসৃজৎ প্রভুঃ।
স রুদ্রঃ সংহরন্ কৃৎস্নং জগৎ স্থাবরজঙ্গমম্।।৩৪৬।।
[মহাভারত//অনুশাসনপর্ব্ব/অধ্যায় ১৩]
যে ঈশ্বর (মহাদেব) দক্ষিণপার্শ্ব হতে জগতের সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেছেন এবং লোকরক্ষার জন্য বামপার্শ্ব হতে বিষ্ণুকে উৎপাদন করেছেন ॥৩৪৫৷৷
জগতের প্রলয়ের জন্য পরমেশ্বর শিব রুদ্রকে উৎপন্ন করেন। সেই রূদ্র কাল হয়ে প্রলয়কারক মহাতেজা অগ্নির ন্যায় স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমগ্র জগৎ সংহারবশত সমস্ত ভূতকে গ্রাস করে অবস্থান করেন।।৩৪৬।।
👉আরও বলা আছে যে, ত্রিদেবরূপ সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিব ধারণ করেন—
নমস্ত্রিরূপধরায় সর্ব্বরূপধরায় চ ॥৩১১।।
[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব্ব/অধ্যায় ১৩/৩১১]
আপনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্রের রূপ ধারণ করেন এবং সকলের রূপই ধারণ করিয়া থাকেন আপনাকে নমস্কার ॥৩১১৷।
অনার্য বা আধুনিক অজ্ঞ সমালোচকদের প্রধান বিভ্রান্তি হচ্ছে- তারা শিবকে শুধুমাত্র মৃত্যুর দেবতা বা রাগী সন্ন্যাসী হিসেবে চেনে। তারা তত্ত্বগতভাবে শিব, সদাশিব, রুদ্র, মহেশ্বর, ঈশান, ঈশ্বর এসব নামের পার্থক্য বোঝে না। পুরাণে রুদ্রের উদ্ভবের উপাখ্যান দেখে ধরে নেয় রুদ্র শিবের জন্ম হয়েছে, অথচ বোঝে না উক্ত রুদ্র সদাশিবের এক বিশেষ কালিক প্রকাশমাত্র। অথচ শাস্ত্রজ্ঞান থাকলে বুঝত, রুদ্রের এসব অবতার পরমেশ্বর সদাশিবের কালিক/কার্যগত বিকাশমাত্র।
যেমন— জল এক, কখনও বাষ্প, কখনও বরফ তাই বলে একটির সৃষ্টি অন্যটি থেকে নয়। তেমনই, এক সদাশিবই নিজেকে তিন ভাগে বিভক্ত করে নেয়। তাই প্রসঙ্গ দেখে বুঝতে হবে কোথায় ত্রিদেব এর অন্তর্গত রুদ্রকে বোঝাচ্ছে আর কোথায় পরমেশ্বর সদাশিবকে বোঝাচ্ছে।
🔘রুদ্র কেবল পুরাণের ‘সৃষ্ট’ দেবতা নন, তিনি স্বয়ং বেদের পরমার্থস্বরূপ। এই বক্তব্য কূর্ম্মপুরাণ, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, তৈত্তিরীয় আরণ্যক, মহাভারত ইত্যাদি বহু গ্রন্থ দ্বারা সমর্থিত। কূর্ম্মপুরাণে রুদ্রকে বলা হয়েছে— "ত্রিমূর্ত্যধিপতি, ব্রহ্মবিদ্যা প্রদানকারী, বেদের গূঢ় রহস্য, বেদান্তসার, বেদাত্মমূর্তি", যা প্রমাণ করে তিনি কেবল সৃষ্ট একজন দেবতা নন, বরং তিনিই আদ্যতন বেদজ্ঞ ও পরম ব্রহ্ম। "সদাশিব" ও "ত্রিদেব" এই দুটি অবস্থার তাত্ত্বিক পার্থক্য না বোঝার ফলে অনেক আধুনিক গবেষক বিভ্রান্ত হন। শাস্ত্র অনুযায়ী, সদাশিব নিজেই ত্রিদেবরূপ ধারণ করেন জগতকার্য পরিচালনার জন্য। বেদের রুদ্রের সঙ্গে পুরাণের রুদ্র যদি পৃথকও হয়, তবুও পরমার্থরূপে শিব বা সদাশিবই উভয়ের মূল, এটাই উপনিষদ ও পুরাণের একান্ত সম্মত ভাব।
অতএব, অনার্য বা আধুনিক মতবাদ যে ‘পুরাণের রুদ্র বৈদিক রুদ্র নন’ বলে বিভাজন সৃষ্টি করে, তা শাস্ত্রসম্মত নয়। কারণ শাস্ত্র নিজেই রুদ্রকে "একঃ শিবঃ", "শান্তং শিবমদ্বৈতং", "ব্রহ্মা শিবো মে অস্তু সদাশিবোম্" বলেছে, যা তাঁকে দ্বৈতধর্মী দেবতা নয়, বরং অদ্বৈত পরমসত্ত্বা হিসেবে চিহ্নিত করে।
🔘অনার্যপক্ষের দাবি ছিল, “রুদ্র ব্রহ্মার অশ্রু থেকে জন্ম নেওয়ায়, তিনি প্রাকবৈদিক বা বৈদিক ঈশ্বর হতে পারেন না।” এই যুক্তির বিপরীতে আমরা কূর্ম্মপুরাণ, মহাভারত, শতপথ ব্রাহ্মণ, আশ্বলায়ণ গৃহ্যসূত্র, তৈত্তিরীয় আরণ্যকসহ বহু শ্রুতি-স্মৃতির মাধ্যমে প্রমাণ করলাম যে—
✅ রুদ্র অনাদি ও সনাতন পরমেশ্বর। কূর্মপুরাণেই বলা হয়েছে “সনাতনঃ শূলপাণিঃ”, অর্থাৎ তিনি চিরন্তন ও শূলধারী।
✅ ব্রহ্মা কর্তৃক 'রুদ্র' নামকরণ একটি রূপকীয় ঘটনা। এই নাম কোন "নতুন" নাম নয়, বরং তাঁর বহুমুখী পরিচয়ের একটি দিকমাত্র। তিনি স্বয়ং একাত্ম, বর্ণনার অতীত সর্বব্যাপী চৈতন্য।
✅ ‘অশ্রুজাত’ বা ‘রোদন’ কাহিনী একপ্রকার লীলাময় প্রকাশমাত্র। এটি তাঁর চিরন্তন অস্তিত্বের কোনো সৃজন সূচনা নয়। এটি ঐতিহাসিক কালানুক্রমিক সৃষ্টি নয়, বরং আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ব্যাখ্যার উপায়।
✅ শ্রুতি সমর্থনে রুদ্রই সর্বস্বরূপ পরমেশ্বর। বেদের “একহি রুদ্রঃ ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য” ও “সর্বে বৈ রুদ্রঃ” ইত্যাদি শ্রুতি বাক্য স্পষ্ট করে দেয়, রুদ্রই বেদের একমাত্র সর্বোচ্চ তত্ত্ব।
✅ অষ্টমূর্তি শিব, সূর্য, বায়ু, অগ্নি, জল, আকাশ, ভূমি, চন্দ্র ও ব্রাহ্মণরূপে তিনি সর্বত্রই বিরাজমান, সর্বজ্ঞ, সর্বেশ্বর এবং সর্বজীবে অধিষ্ঠিত।
অতএব, রুদ্রের নামকরণ বা পুরাণীয় ঘটনাবলিকে যেকোনো কালিক মানদণ্ডে বিচার করে “তাঁর প্রাক-বৈদিকতা” অস্বীকার একান্তই অজ্ঞতা ও তত্ত্বজ্ঞানহীনতা। বৈদিক রুদ্র ও পুরাণীয় শিব একই তত্ত্বের দুই প্রকাশ, এক জ্ঞান, এক চৈতন্য, এক রূপ।
যদি রুদ্র সত্যিই কেবল ব্রহ্মার অশ্রুজাত হতেন, তবে কূর্মপুরাণেই তাঁকে কেন "সনাতনঃ" বলা হবে?
অনাদি ও অনন্ত কেউ কখনো "সৃষ্টি" হতে পারেন না।
যদি রুদ্র সৃষ্টিজনিত সত্তা হতেন, তবে শ্রুতিতে কেন বলা হবে—
“একহি রুদ্রঃ ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য” (একই রুদ্র, তাঁর দ্বিতীয় কেউ নেই)?
যদি ‘রোদন’ থেকেই নাম হয় ‘রুদ্র’, তবে আশ্বলায়ণ গৃহ্যসূত্র বা শতপথ ব্রাহ্মণে রুদ্রের অসংখ্য নাম কেন আগে থেকেই উল্লেখিত?
যদি রুদ্র বৈদিক না হন, তবে কিভাবে তিনি বৈদিক অগ্নিহোত্রে, যজ্ঞে, অষ্টমূর্তি রূপে পূজিত?
যদি শিব, রুদ্র, মহাদেব প্রভৃতি পৃথক ব্যক্তিত্ব হতেন, তবে সব পুরাণ ও গৃহ্যসূত্রে কেন একই দেবতাকে এইসব নামে অভিহিত করা হয়?
যদি কূর্ম্মপুরাণের রুদ্র সত্যিই কেবল একটি ‘দেবতা’ হতেন, তবে কেন ব্রহ্মা তাঁকে বেদের কর্তা, বেদের আত্মা, বেদান্তসাররূপ বলে স্তব করবেন?
সৃষ্টির পরে উৎপন্ন বস্তু কি বেদে থাকতে পারে না, এই নীতির প্রমাণ কোথায়? তাহলে তো যজুর্বেদ ১৮/১২–১৩-এ যেসব বস্তু (চাল, ডাল, রাঙ, সোনা, সীসা, লোহা, নারিকেল) আছে, সেগুলো কি সবই অবৈধ?
আপনাদের মতে রুদ্র সৃষ্ট, কিন্তু বেদে বলা হয় তিনি সর্বব্যাপী, সর্বনাশক, সর্বজ্ঞ এ গুণাবলি কি সাধারণ সৃষ্টির? যদি না হয়, তাহলে তাঁর বেদীয় অবস্থান কে খণ্ডন করবে?
যেহেতু বেদকে অনাদি মানেন, তাহলে বেদে বর্ণিত বস্তুসমূহ কি সকলই অনাদি? যদি না হয়, তাহলে কি মানছেন, সৃষ্টির পরে উৎপন্ন জিনিসও বেদে থাকতে পারে?
আপনার প্রতিজ্ঞা (রুদ্র অবৈদিক) ন্যায়শাস্ত্রের পাঁচ অবয়বযুক্ত যুক্তিতে প্রমাণ করতে পারবেন?
আপনি কি বলতে পারেন আপনার যুক্তিতে,
প্রতিজ্ঞা-হেতু-দৃষ্টান্ত-উপনয়-নিগমন সবই রয়েছে?
🔘রুদ্র কোনো সৃষ্ট জীব নয়, তিনি সৃষ্টিরও আগে, সৃষ্টিরও পরে, চিরন্তন আত্মতত্ত্ব যিনি বেদে, উপনিষদে, পুরাণে সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত, এবং পরম ব্রহ্মরূপে ধ্যানযোগ্য।
❌অনার্যদের দাবী— যজুর্বেদের এই অধ্যায়ের রুদ্রকে উব্বট ও মহিধর-আচার্যরাও সর্বত্র পরমেশ্বর অর্থে নেননি, বরং তাঁরা বিভিন্ন স্থানে সেনাপতি, শস্ত্রধারী পুরুষ, ক্ষাত্রধর্মজ্ঞানী রূপেই ব্যাখ্যা করেছেন। সুতরাং এই অধ্যায়ের রুদ্র মানেই ঈশ্বর, এই দাবী প্রমাণিত নয়। আবার, অনেকে "যাতে রুদ্র শিবা তনুঃ" ইত্যাদি মন্ত্র ধরে রুদ্রকে ঈশ্বররূপ সাকার রূপে স্থাপন করতে চান। ঈশ্বর যদি পরম নির্বিকার হোন তবে এই কার্যকলাপ তাঁর পক্ষে অকর্তব্য।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— শতরুদ্রীয়তে উবট-মহীধর রুদ্রকে ঈশ্বর হিসেবে মেনেছেন কি মানেননি তা এতক্ষণ ধরে প্রমাণ করেই আসলাম। যিনি, জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় কার্য সম্পাদন করেন তিনিই পরমেশ্বর, “জন্মাদ্যস্য যতঃ” [ব্রহ্মসূত্র/১/১/২] আর সেই পরমেশ্বর যে, রুদ্র তা উবট-মহীধর নিজেদের ভাষ্যে প্রমাণিত করেছেন। যা নতুন করে প্রমাণ করার দরকার নেই।
🔘শতরূদ্রীয়ের ২৬নং মন্ত্রে রুদ্রকে সেনা ও সেনাপতিরূপ বলা হয়েছে ঠিক। কিন্তু, তাই বলে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না যে, এটা কেবল একজন সাধারণ রাজা বা সেনাপতিকে নির্দেশ করছে। মন্ত্রের অর্থ নির্ধারণ করতে হয় প্রসঙ্গ বিচার করে। সেজন্যই মহর্ষি জৈমিনি পূর্বমীমাংসাতে বলেছে—
“অভিজ্ঞেয়াৎ” [পূর্বমীমাংসা /১/২/৩৮]
“যে শব্দ বা বাক্য প্রত্যক্ষভাবে অর্থ দেয় না, বা যার অর্থ অনির্ধারিত থাকে, তা সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গ ও লক্ষণ বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করতে হবে।”
অর্থাৎ এখানে রুদ্রকেই সেনা, সেনাপতি হিসেবে উল্লেখ করেছে ঠিক কিন্তু, তা কোনো সাধারণ রাজা বা সেনাপতি বোঝাতে নয়। কেননা, সম্পূর্ণ শতরুদ্রীয় অধ্যয়ন করলে ও ভাষ্যকারের ভাষ্য থেকে জানা যায়, এখানে রুদ্র সাধারণ মানব নয়। এখানে রুদ্র হলো পরমেশ্বর পদবাচ্য। অন্যান্য মন্ত্রে থাকা—
“সদমিৎ ত্বা হবামহে” “অন্নানাং পতয়ে নমো” “জগতাম্ পতয়ে নমঃ” “হৃদয়ায় নমঃ” “বিশ্বরূপেভ্যশ্চ বো নমঃ” “পশুপতয়ে চ” “শিপিবিষ্টায় চ” “প্রথমায় চ” “পূর্বজায় চ” “নমঃ সোমায় চ” “উগ্রায় চ” “ভীমায় চ” “হন্ত্রে চ হনীয়সে চ” “নমঃ শম্ভবায় চ ময়োভবায় চ। নমঃ শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ। নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ।।”
এসব পদ দ্বারা রুদ্রকেই স্তুতি করা হয়েছে। আর এসব পদের অধিকারী কদাপি কোনো সাধারণ রাজা বা সেনাপতি নন৷ তাই এখানে সেনানী বা সেনাপতি হিসেবে রুদ্র কেবল একটি রাজ্য বা কোনো সীমিত শক্তির অধিকারী নন, তিনি সর্বজগতের সর্ববিধ শক্তির একচ্ছত্র অধীশ্বর।
মন্ত্রের সঠিক অর্থ নির্ধারণের জন্য মহর্ষি জৈমিনি আরও বলেছেন—
"তদর্থশাস্ত্রাৎ" [পূর্বমীমাংসা /১/২/৩১]
যদি কোনো শব্দ বা বাক্য মন্ত্রে অস্পষ্ট হয়, তবে তার অর্থ নির্ধারিত হয় অন্য কোন শাস্ত্র বা প্রসঙ্গের সাহায্যে।
এই প্রসঙ্গে কল্পসূত্রতে বলা হয়েছে—
সর্বাঃ সেনাঃ ।। ২৮।।
সর্বাণ্যুচ্ছ্রয়ণানি ।। ২৯।।
[আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র/৪/৯/২৮-২৯]
জগতের সকল সেনা (রুদ্রেরই সৈন্য)।।
জগতের সকল উৎকৃষ্ট বস্তুসমূহ (রুদ্রেরই অধীনে)।।
জগতে যত সেনাবাহিনী আছে, সবই রুদ্রের সেনা, এবং জগতের যত শ্রেষ্ঠ-উৎকৃষ্ট সম্পদ বা শক্তি, সবই রুদ্রের অধীন। এটা কোনো সাধারণ রাজা/সেনাপতির জন্য নয়। কেননা কোনো ক্ষত্রিয় রাজা কদাপি জগতের সকল সেনার অধিপতি হতেই পারে না। এবং জগতের সকল উৎকৃষ্ট বস্তুরও অধিপতি হতে পারেনা। তাই এখানে সেনাপতি বলতে কোনো সাধারণ সেনাপতি নয় বরং জগতের অধীশ্বর শিবই বটে।
🔘২৬ নং মন্ত্রের ভাষ্যে উবট-মহীধর বলেছেন—
উবট ভাষ্য— নমঃ সেনাভ্যঃ। সেনা চমুঃ। সেনা নিভ্যশ্চ বো নমঃ। সেনাং নয়তীতি সেনানীঃ।
এখানে "সেনা" অর্থে চমু বা বিশাল সজ্জিত বাহিনী বোঝানো হয়েছে। রুদ্রই সেই সব বাহিনী পরিচালনাকারী, তাই তিনি “সেনানী”।
মহীধর ভাষ্য— সেনারূপেভ্যো নমঃ। সেনাং নয়ন্তি তে সেনান্যঃ সেনাপতয়স্তদ্রুপেভ্যো বো নমঃ।
যাঁরা বাহিনী পরিচালনা করেন, তাঁরাই সেনানী। সেই সব রূপে যিনি বিরাজমান, তিনিই প্রকৃত সেনানায়ক, এবং তা রুদ্র ছাড়া আর কেউ নন।
এইসব শাস্ত্রবাক্য ও ভাষ্য থেকে স্পষ্ট হয়, রুদ্রই প্রকৃত সেনানী, জগতের সমস্ত শক্তি, বাহিনী, দেবতা এবং জড় চেতন কার্যব্যবস্থার মূল চালক। শতরুদ্রীয় মন্ত্রে যাঁকে সেনা ও সেনানী বলা হয়েছে, তিনি কোনো সাধারণ মানুষ নন, তিনি পরমেশ্বর শিব।
“সেনা’ ও ‘সেনানী’ শব্দের দ্বারা কোনো পার্থিব রাজা নয়, বরং সেই সর্বশক্তিমান রুদ্রই বোঝানো হয়েছে, যিনি সমগ্র জগতের সব বাহিনী ও শ্রেষ্ঠ শক্তির অধিপতি। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ও প্রাচীন ভাষ্যকারগণও সেই পরম তত্ত্বরূপ শিবকেই এখানে নির্দেশ করেছেন।”
তবুও কিছু অনার্যপন্থী আধুনিক মতবাদী ব্যাখ্যাকারগণ এই রুদ্রের ‘সেনানী’ রূপকে সাধারণ রাজা বা পার্থিব নেতা বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন, যা সরাসরি শ্রুতি, স্মৃতি, ভাষ্য এবং মীমাংসা সকলকেই লঙ্ঘন করে। এবং ঠিক এই কারণেই অনার্যদের শাস্ত্রের অনর্থকারী বলি। শাস্ত্রের সঠিক মীমাংসা দিতে না পারলে দোষ কি শাস্ত্রের নাকি অনার্যদের মূর্খতা ও অজ্ঞতার? এই প্রসঙ্গে মহর্ষি জৈমিনি পূর্বমীমাংসার মন্ত্রাধিকরণ ন্যায়ে বলেছেন—
“সংপ্রেষকর্মণো গর্হানুপলম্ভঃ সংস্কারত্বাৎ”
[পূর্বমীমাংসা /১/২/৫৫]
অর্থ— মন্ত্র সংস্কারস্বরূপ ব্যবহার হয়, অর্থ বোঝাতে নয়। তাই না বোঝা দোষ নয়।
যেমন— কোন বৃক্ষের দোষ নয় যে একজন অন্ধ তাকে দেখতে পাচ্ছে না।
তেমনি— একজন মূর্খ যদি মন্ত্রের গভীর অর্থ উপলব্ধি না করে, তাতে দোষ মন্ত্রের নয়, দোষ ঐ অনার্য, অপটু, মিথ্যাবাদী ব্যাখ্যাকারীর।
“অনার্যদের অজ্ঞতা ও অযোগ্যতা শাস্ত্রের সত্য অন্বেষণ ব্যর্থ করেছে কিন্তু, শাস্ত্র কখনোই অনর্থক নয়। শাস্ত্র বুঝতে হলে শাস্ত্রজ্ঞ হতে হয়।”
এই যুক্তি ও শাস্ত্রসমর্থিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে একথা স্পষ্ট হয় যে— শতরুদ্রীয়ের “সেনানী” রূপ কোনো পার্থিব, সামরিক বা ঐতিহাসিক ব্যক্তি নন। বরং যিনি সমস্ত শক্তির মূল, সকল সেনার চালক, এবং সকল উৎকৃষ্ট বস্তু ও শক্তির অধীশ্বর, তিনিই এখানে “সেনানী” রূপে রুদ্ররূপে প্রতিষ্ঠিত। এবং যারা এ সত্য উপলব্ধি করতে অক্ষম, তারা শাস্ত্রব্যাখ্যার অধিকারী নয়।
🔴অনার্যদের আরেকটা অপদাবী হলো “যা তে রুদ্র শিবা তনূরঘোরাহপাপকাশিনী” মন্ত্র দ্বারা রুদ্রের অহেতুক সাকারত্ব প্রমাণ করছি। যেখানে ঈশ্বর হলো নির্বিকার তাই রুদ্রের সাকারত্ব অযৌক্তিক।
✅অপদাবী নিরসন— এখানে অনার্যদের অপযুক্তির চাল আর খাটছে না। যদিও বহু ভাবনা চিন্তা করেই বললো ঈশ্বর নির্বিকার। অর্থাৎ যিনি বিকার রহিত, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ্, মাৎসর্য ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হন না। তাই যদি রুদ্রেরও শরীর হয় তবে তিনিও এসব বিকার দ্বারা প্রভাবিত হবেন যা ঈশ্বরের নির্বিকার লক্ষণের বিরোধ করে। তাই রুদ্রের শরীর হতেই পারে না। কিন্তু, এই অনার্যরা জানে না যে, জীবের দেহ ও ঈশ্বরের দেহ দুইয়ের মধ্যে আকাশ ও পাতালের পার্থক্য আছে।
শরীর ধারণ করলে সুখ-দুঃখ ইত্যাদি ভোগের অভিজ্ঞতা হওয়া অনিবার্য। তবে এই সুখ-দুঃখের ভোগের অভিজ্ঞতা জীবাত্মার শরীরেরই হয়, অন্য কারো শরীরের নয়।
পরমশিব ব্রহ্মের যে শরীর এবং জীবের শরীর, যার দ্বারা সে সুখ-দুঃখ ভোগ করে, এই দুইয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।
পরমশিবের শরীরে যেমন— শতরুদ্রীয়তে পরমেশ্বর শিবের সাকারত্বের বহু শব্দ প্রমাণ পাওয়া যায় জটাজুটধারী, নীলকণ্ঠ, পিণাকধারী, চর্মাম্বর পরিহিত, হিরণ্যবাহু, গিরি নিবাসী, সোম, নীললোহিত ইত্যাদি আরও অনেক। এছাড়াও “পূর্বমীমাংসা ১/২/৩১” অনুযায়ী যদি কোনো শব্দ বা বাক্য মন্ত্রে অস্পষ্ট হয়, তবে তার অর্থ নির্ধারিত হয় অন্য কোন শাস্ত্র বা প্রসঙ্গের সাহায্যে। এক্ষেত্রে “কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/ তৈত্তিরীয় আরণ্যক/ ১০/ ১২” বলছে—
“ঋতং সত্যং পরমব্রহ্ম পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলম্।
ঊর্ধ্বরেতং বিরূপাক্ষং বিশ্বরূপায় বৈ নমো নমঃ।।”
এখানে, ত্রিনয়নত্ব (তিনটি চোখ), কৃষ্ণপিঙ্গল (অর্ধনারীশ্বর) রূপ, ঊর্ধ্বরেতা (উচ্চশক্তি) ইত্যাদি গুণ, এসবই তাঁর নিজের ইচ্ছা থেকে উদ্ভূত।
অন্যদিকে, জীবের শরীর হলো তার পূর্বকৃত পুণ্য-পাপরূপ কর্ম থেকে উদ্ভূত। নিম্নে শাস্ত্রের উদ্ধৃত দ্বারা বুঝি।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ৮.৬—
যং যং বাপি স্মরণ্ভাবং ত্যজত্যন্তে কলেবরম্।
তং তম্ এবৈতি কৌন্তেয় সদা তদ্ভাবভাবিতঃ॥
হে কৌন্তেয়! জীব যখন যেই ভাব স্মরণ করে শরীর ত্যাগ করে, সেই ভাবেই সে পরবর্তীতে জন্মগ্রহণ করে, কারণ সে সদা সেই ভাবেই অভ্যাসে অভ্যস্ত ছিল।
এই শ্লোক ইঙ্গিত করছে যে, জীবের ভবিষ্যৎ জন্ম বা শরীর তার চিত্তবৃত্তি ও পূর্ববর্তীভাবনা/সংস্কার/কর্মের ওপর নির্ভরশীল।
গীতা ১৩.২১—
পুরুষঃ প্রকৃতিস্থো হি ভুঞ্জতে প্রকৃতিজান্ গুণান্।
কারণং গুণসঙ্গোস্য সদসদ্যোনিজন্মসু॥
এই পুরুষ (জীবাত্মা) যখন প্রাকৃতিক গুণের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তখন সে প্রাকৃতিক গুণের ফল ভোগ করে। গুণের সঙ্গে এই সংযোগই জীবের সদ্ ও অসদ্ (উচ্চ বা নিম্ন) জন্মের কারণ।
এখানে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, জীব গুণসংগত কর্মভোগের কারণে বিভিন্ন যোনিতে (শরীরে) জন্মগ্রহণ করে।
গীতা ১৫.৮–৯—
শরীরং যদবাপ্নোতি যচ্ছাপ্যুত্ক্রামতীশ্বরঃ।
গৃহীত্বৈতানি সংযুক্তৈঃ শ্বরহ্ ক্রামীতি বার্তরঃ॥
শ্রোত্রং চক্ষুঃ স্পর্শনং চ রসনং ঘ্রাণমেব চ।
অধিষ্ঠায় মনশ্চৈয়ং বিষয়ানুপসেবতে॥
এই ঈশ্বরস্বরূপ জীব (জীবাত্মা) যখন শরীর গ্রহণ করে কিংবা ত্যাগ করে, তখন সে ইন্দ্রিয়সমূহ ও মনকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যায়, যেমন বাতাস সুগন্ধ ধারণ করে চলে যায়। এইভাবে সে নানা ইন্দ্রিয় ও মন সহকারে বিষয়ের ভোগ করে।
এই শ্লোকেও বলা হচ্ছে, জীব পুরাতন কর্মফল অনুসারে নতুন শরীর গ্রহণ করে, এবং ইন্দ্রিয়সমূহের সাহায্যে তা ভোগ করে।
গীতার মতে, জীবের শরীর, যোনি (জন্ম), ও অভিজ্ঞতা সবই পূর্বকৃত পুণ্য-পাপরূপ কর্ম এবং গুণসংগত সংস্কার দ্বারা নির্ধারিত। গীতা ১৩.২১বিশেষভাবে বলছে— "কারণং গুণসঙ্গোস্য সদসদ্যোনিজন্মসু" অর্থাৎ "সৎ বা অসৎ যোনিতে জন্ম নেওয়ার কারণ গুণের সংযোগ"।
আবার এই প্রসঙ্গে শ্রুক্রনীতিতে বলা হয়েছে—
স্বামিত্বঞ্চৈব দাদৃত্বং ধনিকত্বং তপঃ ফলম্।
এনসঃ ফলমর্থিত্বং দাস্যত্বঞ্চ দরিদ্রতা।।
[শুক্রনীতি /১/১২২]
পূর্বজন্মের সু-তপস্যার দ্বারা আধিপত্য, দান ও ধনবান হয়। পূর্বজন্মের কু-তপাস্যার দ্বারা যাঞ্চনা, দাসবৃতি ও দরিদ্রতার ফল ভুগতে হয়।।১২২।।।
আরও বলা হয়েছে—
“প্রাক্কর্ম্মবশতো নিত্যং সধনো নির্দ্ধনো ভবেৎ”।।
[শুক্রনীতি /৩/৬৬]
মনুষ্যগণ পূর্বজন্মের কর্মের দ্বারা ধনবান এবং নির্ধনী হয়ে সুখ-দুঃখ ভোগ করে। তাই জীবাত্মা বিকার দ্বারা প্রভাবিত হয়, পরমাত্মা নয়।
পরমশিব, যদিও ত্রিনয়ন প্রভৃতি শরীরের অধিকারী,
তবু ছান্দোগ্য উপনিষদ অনুসারে তিনি পাপহীন, বার্ধক্যরহিত, এবং মৃত্যু, শোক, ক্ষুধা, তৃষ্ণা প্রভৃতি দুঃখতত্ত্ব তাঁর মধ্যে নেই।
তিনি হলেন—
সত্যকাম (সত্য ইচ্ছার অধিকারী),
সত্যসংকল্প (যা সংকল্প করেন, তাই সত্যে পরিণত হয়)।
অপরদিকে, জীবাত্মা পাপ-পুণ্যরূপ কর্মের দ্বারা প্রাপ্ত শরীরের অধিকারী হয় এবং সেই কর্ম অনুযায়ী সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা লাভ করে।
পরমশিব কখনোই সেই নিকৃষ্ট, দোষযুক্ত জীবশরীর ধারণ করেন না, বরং তিনি নিজ ইচ্ছায় অপ্রাকৃত, দিব্য, মাঙ্গলিক লীলাময় শরীর ধারণ করেন। এই কারণেই, জীবশরীরে যে সমস্ত দোষ দেখা যায়,
সেই দোষসমূহ পরমশিবকে স্পর্শও করতে পারে না।
ঋগ্বেদ এর এই ঋচাও সেই অর্থই প্রচার করে—
“স্থিরেভিরঙ্গৈঃ পুরুরূপ উগ্রঃ”
[ঋগবেদ/২/৩৩/৯]
"বহু রূপ ধারণকারী উগ্র পরমেশ্বর, কিন্তু তবু স্থির, বিকারহীন।।”
যদি শুধুমাত্র “সাকার হওয়া মানেই বিকারযুক্ত হওয়া” ধরা হয়, তবে মন্ত্র, আরাধনা, উপাসনা, লীলা, দৃষ্টি, সব অর্থহীন হয়ে পড়ে।
পূর্বে মন্ত্রাধিকরণ ন্যায় পূর্বমীমাংসা ১/২/৫৫ অনুযায়ী বলেছিলাম—
“অন্ধ যদি বৃক্ষকে না দেখে, তা বৃক্ষের দোষ নয়।”
একই ন্যায় অনুযায়ী, যিনি রুদ্রের সাকারত্বকে বিকার বলে তিরস্কার করেন, তিনি আসলে নিজের অন্ধতাকেই শাস্ত্রজ্ঞান বলে ভেবে বসেছেন। রুদ্রকে সাকার জ্ঞান করে যাঁরা বিকারযুক্ত ভাবেন, তাঁদের জ্ঞানের অভাব, শাস্ত্রের নয়।
এইভাবে প্রমাণিত হয়, রুদ্রের সাকারত্ব শাস্ত্রসম্মত, বিকারহীন, এবং ব্রহ্মত্বের বিরোধী নয়। বরং অনার্যদের অশাস্ত্রীয় অপযুক্তিই এখানে খণ্ডিত।
রুদ্রের “শরীর” থাকা মানেই তিনি জীবের মতো শরীরধারী নন।
জীবের শরীর = পাপ-পুণ্যের ফল + গুণসঙ্গ।
রুদ্রের শরীর = লীলাময়, অপ্রাকৃত, ইচ্ছাময়, জ্ঞানময়।
রুদ্র সাকার হলেও বিকারগ্রস্ত নন।
🔴এখানে কিছু প্রশ্ন অনার্যদের অপদাবীর বিরুধে—
যদি শতরুদ্রীয়ের রুদ্র কেবল এক পার্থিব সেনাপতি হন, তাহলে কেন তাঁকে “পশুপতি”, “জগত্পতি”, “বিশ্বরূপ”, “শিব”, “ময়োভব”, “শম্ভু”, “উগ্র”, “ভীম”, “সদমিত্”, “অন্নপতি”, “হৃদয়”, “প্রথম”, “পূর্বজ”, “সোম”, “হন্ত্রী” প্রভৃতি সর্বজনীন ও পরমেশ্বরীয় গুণে ভূষিত বলা হচ্ছে? পার্থিব কোনো সেনাপতি কি “বিশ্বরূপ” বা “জগৎপতি” হতে পারে?
যদি সেনানী মানেই রাজা বা পার্থিব নেতা বোঝায়, তবে কেন আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র বলছে—
“সর্বাঃ সেনাঃ ।। সর্বাণ্যুচ্ছ্রয়ণানি ।।” অর্থাৎ সমগ্র জগতের সেনাবাহিনী ও শ্রেষ্ঠ সম্পদ রুদ্রের অধীন।
এটা কি কোনো সীমিত পার্থিব ক্ষমতাসম্পন্ন নেতার জন্য বলার মতো কথা?
জগতে তো শতসহস্র রাজা,সেনানায়ক এসেছে চলে গেছে, তাদের কাউকেই এমন সর্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলা হয়নি। তাহলে এখানে রুদ্র ব্যতিক্রমী কেন?
যদি রুদ্রের “শরীর” থাকাটা তাঁকে বিকারযুক্ত করে তোলে, তবে শাস্ত্রসম্মত যে সকল মন্ত্রে তাঁর শরীরগত রূপ যেমন, “নীলকণ্ঠ”, “জটাজুট”, “পিণাকধারী”, “তিননয়ন”, “বিশ্বরূপ”, “ঋতং সত্যং পরমব্রহ্ম” ইত্যাদি বলা হয়েছে, সেগুলো কি মিথ্যা?
ঈশ্বরের শরীর যদি লীলাময়, ইচ্ছাময় হয় তবে তা কি বিকারসৃষ্ট দেহের মতো হতে পারে?
জীবের শরীর পাপ-পুণ্যের ফল, কিন্তু রুদ্রের শরীর স্বইচ্ছায় ধারণ করা। সেই পার্থক্য স্বীকার না করলে কি শাস্ত্রের শিক্ষাকেই অস্বীকার করা হয় না?
যদি ঈশ্বর নিরাকারই হন সর্বদা, তবে কেন ঋগ্বেদ ২/৩৩/৯ বলছে—
“স্থিরৈঃ বিরূপৈঃ পুরুরূপ উগ্রঃ।”
অর্থাৎ, “উগ্র পরমেশ্বর বহু রূপ ধারণ করেন কিন্তু তবু স্থির, বিকারহীন।” এখানে ‘পুরুরূপ’ ও ‘স্থির’ একত্রে বলার অর্থ কী? এটা কি রূপধারণ করেও বিকারহীনতা বোঝায় না?
যদি রুদ্র ঈশ্বর না হন, বরং একজন ক্ষত্রিয়/সাধারণ নেতা হন, তবে শতরুদ্রীয়ের বহু মন্ত্রে কেন “নমঃ” পদ দ্বারা তাঁর প্রতি স্তব ও উপাসনা করা হচ্ছে?
কেনই বা বলা হচ্ছে “শিবায় চ শিবতরায় চ”, “ময়োভবায় চ”, “শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ”?
এ ধরনের গুণবাচক ও উপাস্যপদ কি শুধুমাত্র একজন সেনানায়কের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে?
যদি উবট-মহীধর ব্যাখ্যায় কোথাও কোথাও পার্থিব রূপ দেখানো হয়, তাহলে কেন তাঁদেরই ভাষ্যে রুদ্রকে জগতের সকল শক্তির চালক, সেনাপতি, সকল রূপের ধারক, ও শাস্ত্রীয় ‘ঈশ্বর’ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়? একই ভাষ্যকার যখন অসংখ্য স্থানে পরমার্থিক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, তখন একটি-দুটি স্থান ধরে পরমেশ্বরত্ব অস্বীকার কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়?
যদি মন্ত্রের প্রতিটি শব্দই নিরাকার বা পার্থিবভাবে নিতে হয়, তবে কেন পূর্বমীমাংসা বলছে—
“অভিজ্ঞেয়াৎ” অর্থ অনির্দিষ্ট হলে প্রসঙ্গ দ্বারা বিচার করতে হবে। এই বিধান অনুযায়ী পুরো শতরুদ্রীয় পাঠ করলে কি রুদ্রকে কেবল সেনানায়ক বা পার্থিব পুরুষ বলা চলে?
অনার্য ব্যাখ্যাকারীদের যদি মন্ত্রের অর্থ বোঝার যোগ্যতা না থাকে, তবে পূর্বমীমাংসার “সংপ্রেষকর্মণো গর্হানুপলম্ভঃ সংস্কারত্বাৎ” এর মানে কী?
যেমন, অন্ধ ব্যক্তি বৃক্ষ না দেখলে দোষ বৃক্ষের নয়, তেমনি মূর্খেরা শাস্ত্র না বুঝলে দোষ কি শাস্ত্রের?
রুদ্রের পরমেশ্বরত্বের শাস্ত্রসমর্থন, ভাষ্যকার স্বীকৃতি, মন্ত্রপ্রমাণ, এবং মীমাংসানুসারিত প্রসঙ্গভিত্তিক ব্যাখ্যা থাকা সত্ত্বেও, কেবল আধুনিক যুক্তি ও মনগড়া ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তাঁর ঈশ্বরত্ব অস্বীকার কি জ্ঞানের চর্চা না, বরং শাস্ত্রবিদ্বেষ নয় কি?
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী —
যজুর্বেদে ১৬/২১ - বঞ্চনাকারী প্রতারক রুপী রুদ্রকে
নমস্কার, চোরদের পালক রুদ্রকে নমস্কার.... ক্ষেত্রাদিতে ধান্য অপহরনকারীর পালক রুদ্রকে নমস্কার, রাতে অসিহস্তে বিচরণশীল রুদ্র কে নমস্কার, লোকদের মেরে চুরি করে যারা, তাদের পালক রুদ্রকে নমস্কার।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— ভাষ্য স্পষ্ট করে বলে-
‘চোর’ বা ‘বঞ্চক’ শব্দ দিয়ে এখানে কোনো পাপী লোক বোঝানো হয়নি, বরং গোপনে বা অন্ধকারে চলমান জীব বা শক্তির ইঙ্গিত রয়েছে, যা ঈশ্বরের বহুমাত্রিক রূপ।
🔘উবট ভাষ্যে যেমন বলা হয়েছে—
"বঞ্চত্তির্ গত্যর্থঃ গমনে পরিবঞ্চতে…"
অর্থাৎ বঞ্চনা, গোপনচরিতার অর্থ এখানে এমন কোনো ব্যক্তি নয় যিনি সমাজে অন্যায় করেন, বরং সেই রহস্যময়, অদৃশ্য শক্তিকে বোঝানো।
🔘মহীধর ভাষ্যের ব্যাখ্যা অনুযায়ী—
“বশ্বতি প্রতারয়ীতীতি বশ্চন্। পরি সর্বতো বশ্চতি পরিবঞ্চন্ তস্মৈ নমঃ।” “গুপ্তচোরা দ্বিবিধাঃ। রাত্রৌ গৃহে খাদাদিনা দ্রব্যহর্তারঃ স্বীয়া এব আহর্নিশম্ অজ্ঞাতা হর্তারশ্চ।” “অসয়ঃ খঙ্গাঃ সন্তি যেষাং তে অসিমন্তঃ নক্তং রাত্রৌ চরন্তি তে নক্তংচরন্তঃ খঙ্গং ধৃত্বা রাত্রৌ, বীথিনির্গতপ্রাণীঘাতকাস্তেভ্যো রুদ্রেভ্য নমঃ।”
রুদ্র এমন শক্তি যিনি বশে আনেন বিভিন্ন ধরণের জীব ও শক্তিকে, যেমন গোপনভাবে ধান্য বা সম্পদ অপহরণকারী প্রকারের জীব, যাদের নিয়ন্ত্রণ রুদ্রেরই অঙ্গ। অর্থাৎ, ‘চোর’ শব্দটি এখানে প্রকৃত অপরাধী বা অসাধু লোক নয়, বরং জীবজগতের গুপ্ত গতিশীল শক্তি বা চেতনা।
এখানে ঈশ্বরের অবমাননার তো প্রশ্নই নেই। যদি এখানে ঈশ্বরের অপমান থাকত, তাহলে আর কোন প্রার্থনা বা নমস্কার থাকত না। মন্ত্রে স্পষ্ট ‘নমঃ’ করা হচ্ছে, অর্থাৎ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হচ্ছে। আর পরমেশ্বর শিব সকল মান অপমান রহিত, তিনি সকল কিছুরই ঊর্ধ্বে তাই শ্রুতি শিবকে “ঊর্ধ্বায় নমঃ” [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/১৬] বলে স্তুতি করেছেন।
মন্ত্র রুদ্রের নানা রূপ ও মহিমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে, তাঁর নিয়ন্ত্রণ ও শাসন ক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।
যে রুদ্রই হোক, পবিত্র শক্তি হিসেবে তাঁকে নমস্কার করা হচ্ছে, তাঁর সমস্ত গোপন ও প্রকাশিত রূপের জন্য।
👉তত্ত্বগত ব্যাখ্যা—
এখানে ‘বঞ্চনাকারী রুদ্র’ বলতে বোঝানো হচ্ছে জীবের ‘মায়াজাল’ বা ‘অজ্ঞাত ইন্দ্রিয়গত বঞ্চনা’, যা ঈশ্বরের আচরণ নয়, বরং জীবের অস্পষ্ট ও বিচ্ছিন্ন স্বরূপ।
ঈশ্বরের যে রূপ অস্পষ্ট, গূঢ়, ও বিভিন্ন অবস্থায় থাকে, সেটাকেই ‘বঞ্চনাকারী রুদ্র’ রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
অর্থাৎ, রুদ্রের বিকৃত রূপে জীবের দুর্বলতা, অনর্থক প্রবৃত্তি, পাপ ও অসঙ্গতি নির্দেশ করা হয়েছে।
ঈশ্বর এসব দোষ ধারন করেন না, তবে সেই অসঙ্গত রূপেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব বহিঃপ্রকাশ পায়।
সুতরাং, অনার্যদের ভুল ব্যাখ্যা যে ‘রুদ্র’ নামে কোনো দুরাচারী বা চোরকে বলা হয়েছে এবং ঈশ্বরকে অপমান করা হয়েছে, তা ২১ নং মন্ত্রের ভাষ্য ও অর্থের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ ভুল ও ভিত্তিহীন।
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী —
যজুর্বেদ ১৬/২২
উষ্ণীষ দিয়ে মুখে ডেকে ডেকে গ্রামের পথে যারা বস্ত্রাদি চুরি করে ও পর্বতাদি বিষম স্থানে যারা বিচরন করে এ উভয়রূপ রুদ্রকে নমস্কার।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— যজুর্বেদের রুদ্রমন্ত্রসমূহে রুদ্রের বহুমাত্রিক ও বৈচিত্র্যময় রূপাবলীর বর্ণনা পাওয়া যায়। রুদ্রকে শুধুমাত্র সৌন্দর্য, করুণা বা সুরক্ষা দেবতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি; বরং তাঁর রূপে রয়েছে কঠোরতা, শাস্তি, ধ্বংস এবং অশুভ শক্তির প্রকাশও। এই রূপগুলো কখনো কখনো মানুষের চোখে অপ্রিয়, ভয়ংকর বা অপ্রীতিকর মনে হতে পারে।
কিন্তু শাস্ত্রীয় ভাষ্যে স্পষ্ট যে, রুদ্রের এই ‘অশুভ’ রূপও তাঁর ঐশ্বরিক বৈশিষ্ট্যের অংশ, যা জীবজগতের বিভিন্ন দিক ও প্রাকৃতিক কার্যক্রমের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই এই রূপের প্রতি অবজ্ঞা বা অপমান শাস্ত্রসম্মত নয়।
অতিরিক্তভাবে, অনার্যরা রুদ্রের এই কঠোর ও ভয়ঙ্কর রূপগুলোকে ঈশ্বরের নিন্দা বা অপমান হিসেবে তুলে ধরেছে এবং দাবি করেছে যে এইসব রূপ প্রকৃত রুদ্র নয়, বরং তারা কোনো অসৎ ব্যক্তি বা অশুভ শক্তির প্রতীক। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল এবং শাস্ত্রীয় ভাষ্যের সঙ্গে অসঙ্গত।
নীচে ২২ নম্বর মন্ত্রের উবট ও মহীধর ভাষ্য থেকে সরাসরি উদ্ধৃতির মাধ্যমে এই ভুল ধারণার যৌক্তিক ও শাস্ত্রীয় ভিত্তিতে সমাধান হবে।
🔘উবট ভাষ্য—
“নমঃ উষ্ণীষিণে। উষ্ণীষঽস্যাস্তীতিউষ্ণীষী। উপনীষঃ শিরোবেষ্টনম্। গিরিচরায় গিরৌ পর্বতে চরতি ইতি গিরিচরঃ। কুলুঞ্চানাং পতয়ে নমঃ। কুত্সিতং লুঞ্চতি, কুলানি বা লুঞ্চতি ইতি কুলুঞ্চঃ। নম ইষুমদ্যঃ ধন্বায়িভ্যশ্চ ভো নমঃ।”
অর্থাৎ, রুদ্রের এমন রূপের প্রতি নমস্কার যারা মাথায় উষ্ণীষ (মুকুট বা বস্ত্র) ধারণ করে, পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়, যারা পরিবার বা গোষ্ঠীকে কলুষিত করে বা লাঞ্ছিত করে।
“ইষুমদ্যঃ ধন্বায়িভ্যশ্চ ভো নমঃ”
যারা ধনুষ ও তীর নিয়ে শত্রুদের বিনাশ করে, তাদেরও নমস্কার।
এখানে স্পষ্ট যে, ‘উষ্ণীষিণে’ বা ‘কুলুঞ্চানাং’ রূপের অর্থ ‘অশুভ’ বা ‘নিন্দিত’ কিছু নয়, বরং রুদ্রের বহুমাত্রিক রূপ ও কার্যকলাপের প্রকাশ। এগুলোকে ঈশ্বরের ‘অশুভ’ রূপ বলে অপমান করা ভুল।
🔘মহীধর ভাষ্য—
“উষ্ণীষং শিরোবেষ্টনমস্যাস্তীত্যুষ্ণীষী উষ্ণীষেণ শিরঃপ্রাবৃত্য গ্রামঽপহর্তু প্রবৃত্তঃ গিরো চরতি গিরিচরঃ অধ্বন্যানাং বস্রাদ্যপহর্তু পর্বতাদিবিষমস্থানচারী তদুভয়েরূপায় রুদ্রায় নমঃ ।”
অর্থাৎ, রুদ্রের এমন রূপ আছে যারা মাথায় উষ্ণীষ (মুকুট বা বস্ত্র) পরে, গোপনে বস্ত্র চুরি করে, পর্বতের অশান্ত স্থানে বিচরণ করে।
এইসব রূপ রুদ্রেরই অংশ এবং তাদের প্রতি নমস্কার।
“কু ভূমি ক্ষেত্রগৃদাদিরূপাং লুঞ্চন্তি হরন্তি কুলুশ্চাঃ কুত্সিতং লুশ্চন্তি বা তেষাং পালকায় নমঃ ।”
যারা খারাপ জমি বা ক্ষেত্র লুণ্ঠন করে, পরিবারগুলোকে লাঞ্ছিত করে, তাদেরও রুদ্রের রূপ বলেই শ্রদ্ধা জানানো হয়।
“ইষবো বিদ্যন্তে যেষাং তে ইষুমন্তঃ জনান্মিষয়িতুং বাণধারিণস্তেভ্যো নমঃ ।”
যাদের মধ্যে শত্রুতা ও দোষী প্রবণতা থাকে, যাঁরা বাণশস্ত্র বহন করেন, তাদেরও রুদ্রেরূপে নমস্কার।
অর্থাৎ, রুদ্রের এই ‘অশুভ’ রূপগুলো ঈশ্বরেরই অংশ, যা জীবজগতের বিভিন্ন দিক ও শক্তির প্রকাশ।
এগুলো শুধুমাত্র মানুষের চোখে অপ্রীতিকর, কিন্তু শাস্ত্রসম্মত ভাবনায় এসব রূপও রুদ্রেরই অভিন্ন অংশ।
ঈশ্বরের রূপকে কেবল সুন্দর বা সুখকর দিয়ে সীমাবদ্ধ করা মিথ্যা ও অসম্পূর্ণ ধারণা।
এই রূপগুলোকে অবজ্ঞা করে ঈশ্বরকে নিন্দা করা শাস্ত্রবিরোধী এবং অজ্ঞতার পরিচয়।
তাই এই মন্ত্রের ভাষ্য স্পষ্টতই বলছে, রুদ্রের সমস্ত রূপের প্রতি শ্রদ্ধা ও নমস্কার আবশ্যক।
সুতরাং, অনার্যদের যে দাবি ‘অশুভ রূপ’ বলে ঈশ্বরকে অবজ্ঞা করার, তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। ২২ নং মন্ত্রের ভাষ্য সে দাবি নিষ্পত্তি করে, রুদ্রের সকল রূপই ঈশ্বরেরই অংশ, এবং তাদের প্রতি নমস্কার জরুরি।
👉তত্ত্বগত ব্যাখ্যা—
‘উষ্ণীষ’ অর্থ শিরস্ত্রাণ বা মাথার মুকুট, শৈব মূর্তির একটি বিশেষ চিহ্ন।
‘বস্ত্র চুরি’ কথাটি আক্ষরিক না, বরং জীবের অস্পষ্টতা, দুঃখ বা অবরুদ্ধতা বুঝায়।
‘পর্বতাদি বিষম স্থান’ বলতে বোঝানো হয় যে ঈশ্বর কখনো শান্ত, সরল নয়, বরং কঠিন, অসুবিধাজনক এবং কঠোর আকারে ও অবয়বে বিরাজ করেন, যেমন পর্বত শৃঙ্গ।
অর্থাৎ ঈশ্বরের দিক থেকে তাদের যে রূপ মানুষের পক্ষে অচেনা, কঠিন ও বিচ্ছিন্ন, সেই রূপক।
এই রূপগুলোকে সম্মান জানানো মানে ঈশ্বরের সর্বত্র উপস্থিতি ও বহুমুখিতা স্বীকার করা।
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী —
যজুর্বেদ ১৬/২৭
শিল্পী ও সূত্রধর রূপী রুদ্রদের নমস্কার, কুম্ভকার ও কর্মকাররূপী রুদ্রদের নমস্কার, বনেচর মাংসাশী ভিল ও পুরুষ রূপী রুদ্রদের নমস্কার, কুকুরের গলার রজ্জুধারক ও ব্যাধরূপী রুদ্রদের নমস্কার।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— যজুর্বেদের রুদ্র মন্ত্রগুলোতে রুদ্রকে নানা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। কখনো তিনি শিল্পী, কখনো রথকার, কখনো বনচর, কখনো মাংসাশী, কখনো শিকারি, আবার কখনো কুকুরের গলার দড়িধারী রূপে প্রকাশিত। এই বহুমাত্রিক রূপাবলীর মাধ্যমে রুদ্রের মহত্ত্ব ও জীবজগতের বিভিন্ন দিকের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব ফুটে ওঠে।
কিন্তু অনার্যরা এই বৈচিত্র্যময় রূপগুলোকে ঈশ্বরের অবজ্ঞা এবং অপমান হিসাবে গ্রহণ করে, বলছে— ‘মাংসাশী’, ‘কুকুরের গলার দড়িধারী’, ‘শিকারি’ এইসব নামকরণ ঈশ্বরকে নীচ ও অপ্রীতিকর রূপে দেখানো হয়েছে। এ কারণেই তারা এই মন্ত্রগুলোকে ঈশ্বরের অবমাননা হিসেবে প্রচার করে।
🔘উবট ভাষ্য— নমঃ তক্ষভ্যঃ রথকারেভ্যশ্চ বো নমঃ । রথকারো রথং করোতীতি তক্ষ্ণো বিশেষএব । নমঃ কুলালেভ্যঃ কর্মারেভ্যশ্চ বো নমঃ। কুলালাঃ কুম্ভকারাঃ । কর্মারা লোহকারাঃ । নমো নিষাদেভ্যঃ পুঞ্জিষ্টেভ্যশ্চ বো নমঃ । নিপাদা মাত্সিকাঃ । পুঞ্জিষ্ঠা জাত্যন্তরসংবদ্ধাঃ পুল্কসাদয়ঃ । নমঃ শ্বনিভ্যঃ । শুনো নযন্তীতি শ্বন্যঃ তেভ্যঃ শ্বনিভ্যঃ । নযতের্হস্বত্বং ছন্দসস্ । শ্বগণিকা উচ্যন্তে । মৃগযুভ্যশ্চ বো নমঃ । 'ইদংযুরিদংকামযমানঃ’ ইতি যাস্কঃ । মৃগান্ কামযন্তীতি মৃগযবঃ পাপর্দ্ধিকাঃ তেভ্যো মৃগযুভ্যঃ ॥ ২৭ ॥
অর্থাৎ, রুদ্রের নামকরণ হয়েছে যেসব রূপে —
শিল্পী, রথকার (সূত্রধার), কুম্ভকার (মৃৎশিল্পী), লোহকার (লোহার কারিগর), নিষাদ (বনবাসী বা মাংসাশী), পক্ষিপুঞ্জঘাতক (পক্ষী শিকারি), শ্বগণিকা (কুকুরের গলার দড়িধারী), মৃগযুব (শিকারি) ইত্যাদি।
এগুলো রুদ্রের বহুমাত্রিক রূপ এবং এগুলোকে নমস্কার করা হয়েছে।
🔘মহীধর ভাষ্য — “তক্ষাণঃ শিল্পজাতযস্তেভ্যো নমঃ । রথং কুর্বন্তীতি রথকারাঃ সূত্রধারবিশেষাস্তেভ্যো বো নমঃ । কুলালাঃ কুম্ভকারাস্তেভ্যো নমঃ । কর্মারা লোহকারাস্তেভ্যো বো নমোঽস্তু । নিষাদা গিরিচর মাংসাশিনো ভিল্লাস্তেভ্যো নমঃ । পুঞ্জিষ্ঠাঃ পক্ষিপুঞ্চঘাতকাঃ পুল্কসাদযস্তেভ্যো বো নমঃ । শুনো নযন্তি তে শ্বন্যঃ শ্বকণ্ঠবদ্ধরজ্জুধারকাঃ শ্বগণিনঃ । নযতের্হ্নস্ব আর্ষঃ তেভ্যো নমঃ । মৃগান্ কাময়ন্তে তে মৃগযবঃ” ॥ ২৭ ॥
অর্থাৎ, রুদ্রের এইসব রূপে, শিল্পী, রথকার, কুম্ভকার, লোহকার, বনচর, মাংসাশী, পক্ষি শিকারি, কুকুরের গলার দড়িধারী ও শিকারি সকলকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।
👉রুদ্রের এই বহুমাত্রিক রূপগুলো ঈশ্বরেরই ভিন্ন ভিন্ন আভাস। “মাংসাশী” বা “কুকুরের গলার দড়িধারী” বলা মানে ঈশ্বরকে অপমান করা নয়, বরং জীবজগতের বিভিন্ন দিক ও শক্তিকে প্রতিফলিত করা। ঈশ্বরের সমস্ত রূপকে সম্মান জানানো শাস্ত্রীয় পরম কর্তব্য।
অনার্যদের দাবি হল স্বঘোষিত ‘অশ্রদ্ধা’, কারণ তারা রুদ্রের ভিন্ন ভিন্ন আকার ও কার্যকলাপ বুঝতে অক্ষম।
রুদ্রের এই রূপাবলীর মাধ্যমে জীবন ও প্রকৃতির সব দিক পরিচালিত হয়, তাই এদের অবজ্ঞা ঈশ্বরের অবজ্ঞা নয়, বরং অনভিজ্ঞতার প্রকাশ।
👉ব্যাপারটাকে আক্ষরিক অর্থে না দেখে তত্ত্বগত ভাবে বিচার করা যাক—
এখানে ‘শিল্পী’, ‘কুম্ভকার’ অর্থ শৈব লীলার বহুমাত্রিক রূপ, ঈশ্বরকে নানা কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে।
‘বনেচর’, ‘মাংসাশী’ ইত্যাদি রূপ ঈশ্বরের সেই রূপ যা ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ প্রাণীতে বিরাজমান।
‘কুকুরের গলার রজ্জুধারী’ কুকুরের গলার দড়ি যারা ধারণ করে, অর্থাৎ যাঁরা সমস্ত অসৎ শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেন, শাস্তি দেন, সেগুলোর অধিপতি রুদ্রকে সম্মান।
‘ব্যাধরূপী রুদ্র’ মানে রোগ ও অসুখের অধিপতি রুদ্র, তিনি দণ্ড ও শাস্তি দেন।
অর্থাৎ, ঈশ্বর জীবনের সমস্ত দিক, নৈতিকতার উর্ধ্বে থাকা বা অশুভ মনে করা রূপেও বিরাজমান, যা মানুষের দৃষ্টিতে হিংস্র বা কঠিন হলেও তাকে সম্মান জানানো হয়।
——————————————————————————————————————————————
❌অনার্যদের দাবী —
এভাবে যেসব পৌরাণিক গণ অধ্যায় টি ঈশ্বর পক্ষে করতে চান তারা কি তাদের রুদ্র কে চোর, অপহরনকারী, মাংসভক্ষী, কুকুরের গলার দড়ি ধারী এবং ব্যাধ বলে মেনে নেবেন? তারা যদি অধ্যায় টিকে ঈশ্বর পক্ষে করতে চায় তো পুরো অধ্যায় টি কে ঈশ্বর পক্ষে করুক। এক মন্ত্র ঈশ্বর পক্ষে আবার অন্য মন্ত্র আরেক পক্ষে অর্থ করা তো ভন্ডামী।
✅শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডন— এটা বোঝানোর জন্য ন্যায়ের উদ্ধৃত দিলাম —
👉“স্থালীপুলক ন্যায় অনুযায়ী”—
“যেমন ভাত রান্না হলে হাঁড়ির উপরের কয়েকটি দানা চামচে তুলে টিপে দেখা হয়। যদি এগুলি সেদ্ধ হয়, ধরে নেওয়া হয়, পুরো হাঁড়ির ভাত সেদ্ধ হয়েছে”।
তেমনি, শতরদ্রীয় অধ্যায়ে এমন কিছু মন্ত্র আছে যেখানে সরাসরি শিবকে পরমব্রহ্ম বলা হয়, তাই সমগ্র অধ্যায়ে সেই অর্থ বিরাজমান আছে সেটাই ধরে নেওয়া উচিত।
কেননা, সম্পূর্ণ শতরুদ্রীয় অধ্যায়টি শিবের প্রতি সমর্পিত। তাই ওখানে যা কিছুই বলা আছে তা শিবকেই উদ্দেশ্য করে বলা আছে।
আবার একই প্রশ্ন আমাদেরও কেবল কয়েকটি মন্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা দ্বারা আপনারা পরমেশ্বর শিবের পরমত্ব কীভাবে কলঙ্কিত করতে পারেন? যেখানে শিবের পরমত্ব রয়েছে সেই মন্ত্র গুলোকে একদম এড়িয়ে গেলেন ব্যাপার কি?
যেমন— "নমঃ শম্ভবায় চ ময়োভবায় চ। নমঃ শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ। নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ।।”
ইত্যাদি মন্ত্রগুলোতে শিবকে আনন্দস্বরূপ ও কল্যাণমূর্তি বলা হয়েছে সেগুলো কেন উপেক্ষিত? আর যেখানে অপদাবী কিছুটা খাটাতে পেরেছেন সেই মন্ত্রগুলোকে বিকৃত করে পরমেশ্বর শিবকে সাধারণ রাজা/সেনাপতি বানিয়ে দিলেন এটা কেমন যৌক্তিকতা?
এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বর শিবই নিরাকার, নির্বিকার, অচিন্তনীয়, অকল্পনীয়, ভাবনারহিত, অনন্ত সত্ত্বা, পরমব্রহ্ম। সেই পরমব্রহ্মই, জগৎ হচ্ছে, জীব হচ্ছে। স্থাবর-জঙ্গমাত্মক যা কিছু দেখা যায় সব এক পরশিবই বটে। “সর্ব্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”, “ সর্বে বৈ রুদ্রঃ” এমন শ্রুতিবাক্য এরই প্রতিপাদন করে।
তাহলে সেই অনন্ত সত্ত্বা রুদ্র যদি, চোর, অপরহরণকারী, মাংসভক্ষী, কুকুরের গলার দড়ি ধারী, ব্যাধ হন তাতে তো শিবের পরমত্ব কলঙ্কিত হয় না। কেননা, “চোর”, “ব্যাধ” ইত্যাদি পরিচয় কোনো একক সত্ত্বার জন্য প্রযোজ্য নয় বরং জগতে যত জীব আছে, তাদের মধ্যেই কোনো না কোনো রূপে এই গুণ বা দোষ পাওয়া যায়। যেহেতু সকল জীবের হৃদয়ে আত্মরূপে যিনি আছেন তিনিই শিব, তাই শ্রুতি তাঁকেই সর্বরূপে বন্দনা করে। শতরুদ্রীয়তে তাই “হৃদয়্যায় চ” বলে সেই জীবের হৃদয়ে আত্মরূপে অবস্থান করা শিবকে স্তুতি করেছেন৷ প্রাণ-নিষ্প্রাণ, চর-অচর সবই এক শিব স্বরূপই বটে। সেই এক রুদ্রই সর্বব্যাপী, তাঁর বাইরে কিছু নেই। “এক হি রুদ্র ন দ্বিতীয়ায় তস্থুর্য” [শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ /৩/২] এই শ্রুতি বাক্য এরই সমর্থন করে৷
যেহেতু, শিবেরই হৃদয় দর্পনে জগৎ টা ভাসিত হতে থাকে তাই জগতে কোনো ঘটনায় শিবকে কলঙ্কিত করতে পারেনা৷ কেননা, “দর্পণে দাগ লাগলেও দর্পণে প্রতিবিম্বিত হওয়া ব্যক্তির সেই দাগ লাগে না”। একই যুক্তিতে, শিবের বিমর্শ হৃদয়ে ভাসিত জগতের এসব ব্যাপারে শিবের উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। শিব নিষ্কলঙ্কই থাকে সবসময়।
👉এবার দেখে নেবো পরমেশ্বর শিবকে চোর, অপহরণকারী, কুকুরের গলার দড়িধারী, ব্যাধ এসব বলা মূল কারণ কি। এই প্রসঙ্গে যজুর্বেদ বলছে—
“নমো বিরূপেভ্যো বিশ্বরূপেভ্যশ্চ বো নমঃ”।।
[শুক্ল-যজুর্বেদ /শতরুদ্রীয়/ অধ্যায় ১৬/২৫]
উবট ভাষ্য— নমো বিরূপেব্যঃ নিকৃষ্টরূপেব্যঃ নানারূপেব্যো বা । বিশ্বরূপেভ্যশ্চ বো নমঃ। বিশ্বরূপাঃ সর্বরূপাঃ ॥ ২৫ ॥
হে রুদ্র! যাঁর রূপ কখনও বিকৃত, কখনও নীচে বা সাধারণে অবস্থিত, যাঁর রূপ নানা প্রকারের, তাঁকে আমি প্রণাম জানাই। যাঁর রূপ বিশ্বজগতে সর্বত্র বিরাজমান এবং যিনি সকল রূপের মধ্যে বিরাজ করেন, সেই বিশ্বরূপ, সর্বরূপ রুদ্রকে আমি প্রণাম জানাই।
এখানে ‘বিরূপ’ মানে কেবল বিকৃত নয়, বরং ‘সাধারণ বা অপ্রসিদ্ধ’ রূপও বোঝায়। শাস্ত্রীয় দৃষ্টিতে, সর্বব্যাপী সত্তা যদি সর্বত্র থাকেন, তবে তিনি উচ্চ-নীচ সকল রূপেই বিদ্যমান হবেন, এই ধারণাই এখানে মূল।
মহীধর ভাষ্য— বিকৃতং রূপং যেষাং তে বিরূপা নগ্নমুণ্ডজটিলাদয়স্তেভ্যো বো নমঃ। বিশ্বং সর্বং নানাবিধং রূপং যেষাং তে বিশ্বরূপাস্তুরঙ্গবদন হযগ্রীবাদয়স্তেভ্যো বো নমঃ॥ ২৫ ॥
যাঁদের রূপ বিকৃত যেমন নগ্ন, মুণ্ডিতমস্তক, জটাধারী প্রভৃতি, সেই বিরূপ রূপধারী রুদ্রকে প্রণাম। যাঁদের রূপ বিশ্বব্যাপী ও সর্ববিধ, যেমন ঘোড়ামুখ, হযগ্রীব প্রভৃতি নানা রূপধারী, সেই বিশ্বরূপ রুদ্রকে প্রণাম।
এইভাবে শতরুদ্রীয় স্পষ্ট বলছে— রুদ্র এক রূপে সীমাবদ্ধ নন, তিনি সর্বরূপ ধারণ করেন, সুন্দর, অসুন্দর, বিরল, সাধারণ, দেবীয়, মানবীয় সবই তাঁরই অভিব্যক্তি।
🔘এই প্রসঙ্গে শ্রুতি বলছে —
“ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উভ বা কুমারী।
ত্বং জীর্ণো দণ্ডেন বঞ্চয়সি ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ।।
নীলঃ পতঙ্গো হরিতো লোহিতাক্ষস্তড়িদ্গর্ভ ঋতবঃ সমুদ্রাঃ।
অনাদিমৎ ত্বং বিভুত্বেন বর্ত্তসে যতো জাতানি ভুবনানি বিশ্বাঃ।।”
[শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৪/৩-৪]
তুমি নারী, তুমি পুরুষ, তুমি কিশোর, আবার তুমি কুমারীও। তুমি বৃদ্ধ, হাতে দণ্ড (লাঠি) নিয়ে চলছো, আবার তুমি সদ্যোজাত, এবং তুমি সর্বত্র মুখবিশিষ্ট বিশ্বরূপ।
তুমি নীলবর্ণ, তুমি উড়ন্ত (আকাশচারী), তুমি সবুজ, তুমি লালচোখবিশিষ্ট। তুমি বজ্রগর্ভ, তুমি ঋতুসমূহ, তুমি সমুদ্র। তুমি অনাদিমূলক, সর্বব্যাপী শক্তিতে বিরাজমান, যেখান থেকে সমগ্র জগৎ ও সকল পৃথিবী জন্ম নিয়েছে।
👉ব্যাখ্যা — পরমাত্মা শিব কোনও নির্দিষ্ট লিঙ্গ বা বয়সে সীমাবদ্ধ নয়। জন্ম থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত, নারী থেকে পুরুষ পর্যন্ত, সব রূপের মধ্যেই তিনি প্রকাশিত।
সেই এক সত্ত্বার রূপ বৈচিত্র্য বর্ণিত রং, গুণ, প্রকৃতি, সময়, প্রাকৃতিক শক্তি, জল, আকাশ, সব কিছুর মধ্যেই শিবই আছেন। তিনি অনাদি, সর্বব্যাপী, এবং সৃষ্টির মূল। পরমাত্মা শিব কোনও এক রূপে সীমাবদ্ধ নন। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, রঙ, প্রকৃতি, ঋতু, শক্তি, জল, আকাশ, সব রূপেই তিনি আছেন। সৃষ্টির সমস্ত বৈচিত্র্যই তাঁর বহুরূপ প্রকাশ, এবং সেই অনাদি সত্ত্বাই সমগ্র জগতের উৎস।”
“সর্বে বৈ রুদ্রঃ”।।
“সর্বে হ্যেষ রুদ্রস্তস্মৈ রুদ্রায় নমো অস্তু”।।
[তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/২৪]
এখানে বেদ সরাসরি বলছে “যা কিছু আছে, সবই রুদ্র” অর্থাৎ কোনো এক ব্যক্তি বা চরিত্র নয়, বরং জগতের প্রতিটি সত্তাই রুদ্রস্বরূপ। তাই চোর, ব্যাধ, অপহরণকারী এরা যখন জগতে বিদ্যমান, তখন তাদের অন্তঃস্থ চেতনা বা আত্মাও রুদ্রই, কিন্তু তাঁর পরমসত্ত্বা অপরিবর্তিত ও নিষ্কলঙ্ক।
🔘শতরুদ্রীয়তে পরমেশ্বর শিবকে শতরূপে পূজিত করা হয়েছে। তার মধ্যে শিবের সোম্যরূপ আছে, উগ্ররূপ আছে, বিকৃতরূপ ও আছে। তাই কেবল একটা নির্দিষ্ট স্বরূপে আবদ্ধ করে এটি বলা মূর্খামি যে, রুদ্র একজন সাধারণ রাজা বা সেনাপতি।
“সূর্যের আলো সমস্ত জগৎকে প্রকাশিত করার জন্য মলিন স্থান ও স্বচ্ছ স্থানে সমান ভাবে আলো প্রদান করে, কিন্তু, তাতে সূর্যের পবিত্রতা নষ্ট হয় না”।
তেমনি এক পরশিব সকল জীবের মধ্যেই আছেন, তাতে পরশিবের পবিত্রতা নষ্ট হয় না এবং নিষ্কলঙ্কও থাকেন।
🔘ন্যায়শাস্ত্রীয় অবয়বে—
◾প্রতিজ্ঞা:— রুদ্র ঈশ্বর, এবং শতরুদ্রীয়তে সব রূপের রুদ্রকে প্রণাম করা হয়েছে, তাই চোর বা শিকারীর রূপও বিশ্বরূপ রুদ্রের অন্তর্ভুক্ত।
◾হেতু:— বেদে “রুদ্র” মানে কেবল একটি ব্যক্তি নয়, বরং পরমেশ্বর ও তাঁর নানা প্রকাশ, ঈশ্বর সর্বব্যাপী, তাই সৎ-অসৎ সব রূপেই বিরাজ করেন।
◾দৃষ্টান্ত:— যেমন সূর্যের আলো কুয়ো, মলিন স্থানে বা স্বচ্ছ জলে সমানভাবে পড়ে, তাতে সূর্যের পবিত্রতা নষ্ট হয় না। তেমনি ঈশ্বর সব জীবের মধ্যেই আছেন, তাতে তাঁর পবিত্রতা নষ্ট হয় না।
◾উপনয়:— শতরুদ্রীয়তে চোর, ব্যাধ, কুকুরপালক ইত্যাদির মধ্যে রুদ্রকে প্রণাম অর্থে ঈশ্বরের সর্বব্যাপকতা বোঝানো হয়েছে। এর অর্থ কখনোই ‘ঈশ্বর নিজে চোর বা চোরের অধিপতি’ -এমনটা নয়।
◾নিগমন:— সুতরাং অনার্যদের দাবি “রুদ্র অবৈদিক” যুক্তিহীন ও অননুগ্রাহ্য প্রতিজ্ঞা।
🔴অনার্যদের মূর্খতাপূর্ণ দাবীর উপর কিছু প্রশ্ন —
যদি রুদ্রকে চোর বা ব্যাধ বলার কারণে তিনি ঈশ্বর হতে না পারেন, তবে বেদের “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” বা “সর্বে বৈ রুদ্রাঃ” বাক্যগুলোর অর্থ কী হবে ?
সৃষ্টির মধ্যে যা কিছু আছে, তার মধ্যেই যদি ব্রহ্ম বা রুদ্র থাকেন, তবে চোর-ব্যাধের অন্তরেও সেই আত্মস্বরূপ শিব আছেন, এটা কি অস্বীকার করবেন ?
২. যদি ঈশ্বর কেবল শুভ রূপেই থাকেন বলে দাবি করেন, তবে অসৎ, কুৎসিত বা বিকৃত রূপগুলো কোথা থেকে এলো ?
যদি এসব রূপ ঈশ্বর থেকে না আসে, তবে ঈশ্বরের বাইরে আরেক শক্তি আছে কি? তবে কি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান নন ?
৩. যদি রুদ্র কেবল চোর-ব্যাধ ইত্যাদি মানেই অপমান হয়, তবে কেন একই শতরুদ্রীয়তে রুদ্রকে “শিব”, “শম্ভু”, “কল্যাণমূর্তি” বলা হয়েছে?
কেবল কিছু বিরল মন্ত্র ধরে চোর-ব্যাধরূপ প্রমাণ করবেন, আর ঈশ্বরত্বের মন্ত্রগুলো উপেক্ষা করবেন, এটা কি সৎ গবেষণা, না পক্ষপাতিত্ব ?
৪. যদি রুদ্রকে সাধারণ রাজা বা সেনাপতি মানেন, তবে কেন তাঁর উদ্দেশ্যে শত শত মন্ত্র, যজ্ঞ, হোম ও প্রণামবাক্য আছে, যা কেবল দেবতার জন্যই প্রযোজ্য ?
অন্য কোনো রাজা বা সেনাপতির জন্য কোথায় এমন বেদবাক্য পাওয়া যায় ?
৫. যদি ঈশ্বর সর্বব্যাপী হন, তবে চোর-ব্যাধ, কুকুরপালক এদের অন্তরে কে আছেন ?
তাঁদের অন্তর আত্মাকে অস্বীকার করলে, তবে কি আপনারা ঈশ্বরের সর্বব্যাপিতা অস্বীকার করছেন ?
৬. যদি ‘বিরূপ’ মানেই অপমান হয়, তবে শাস্ত্র যখন বলে “ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উভবা কুমারী” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪/৩), তখন ঈশ্বরকে বৃদ্ধ, শিশু, নারী-পুরুষ রূপে বলা হলো কেন?
এগুলোকেও কি আপনারা ঈশ্বরের অপমান বলবেন? নাকি এটা প্রমাণ করে যে ঈশ্বর সব রূপেই প্রকাশিত ?
👉 অনার্যদের নিকট এখন মাত্র ২টি রাস্তায় আছে—
১. অনার্যরা যদি ঈশ্বরকে কেবল সুন্দর, কল্যাণমূর্তিতে সীমাবদ্ধ করতে চায়, তবে ঈশ্বরের সর্বব্যাপকতা অস্বীকার করতে হবে।
২. আর যদি ঈশ্বরের সর্বব্যাপকতা স্বীকার করে থাকেন, তবে “চোর ব্যাধরূপে” শিবের অন্তর্যামী সত্ত্বা অস্বীকার করার জায়গা নেই।
——————————————————————————————————————————————
🔘অনার্যদের দীর্ঘদিনের একটি অপপ্রচার হলো শতরুদ্রীয় অংশে ‘রুদ্র’ বলতে ঈশ্বরকে নয়, বরং কোনো সাধারণ রাজা বা সেনাপতিকে বোঝানো হয়েছে। তারা মনে করে, এই অধ্যায় ক্ষাত্রধর্ম বিষয়ক, তাই রুদ্র মানে কেবল যুদ্ধনেতা বা মানুষের পরিচায়ক।
কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই দাবি যুক্তিহীন ও ভিত্তিহীন।
প্রথমত, শতরুদ্রীয়ের প্রতিটি মন্ত্রে রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বারবার প্রণাম নিবেদন করা হয়েছে। সাধারণ কোনো মানুষকে, রাজা বা সেনাপতিকে শত শতবার বন্দনা করার বিষয়টি অবাস্তব ও অসংগত। কেবল সেই শক্তিকেই সর্বত্র প্রণাম করা সম্ভব, যিনি সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান।
দ্বিতীয়ত, রুদ্রকে নানা রূপে স্থল, জল, দিক, প্রাণী, মানুষ, সর্বত্র বিরাজমান বলে স্বীকার করা হয়েছে। যদি রুদ্র কেবল মানুষ হতেন, তবে তাঁকে পশু, দিক বা বিশ্বরূপে কল্পনা করার কোনো প্রয়োজন থাকত না। এখানেই প্রমাণ হয়, রুদ্র মানে সাধারণ রাজা নন, বরং এক সর্বজনীন অনন্ত সত্তা।
তৃতীয়ত, শতরুদ্রীয়তে যে বিষয়গুলো এসেছে, তা কেবল ক্ষাত্রধর্ম নয়। সেখানে জীবন, সমাজ, প্রকৃতি, শক্তি, সবকিছুর মধ্যে রুদ্রের উপস্থিতি স্বীকার করা হয়েছে। অর্থাৎ এখানে একটি সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে, যা কোনো ব্যক্তিগত মানুষের বর্ণনা হতে পারে না।
সবশেষে বলা যায়, অনার্যদের প্রচার কেবল বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। বাস্তবে শতরুদ্রীয় হলো সর্বশক্তিমান রুদ্রের, অর্থাৎ সর্বত্র বিরাজমান পরম সত্তার বন্দনা। সেখানে রুদ্রকে সাধারণ মানুষ বা কেবল সেনাপতি ভাবা যুক্তি ও সত্যের পরিপন্থী।
অতএব, দয়ানন্দ সরস্বতীর তথাকথিত বেদভাষ্য সহ তার আর্য সমাজ নামক অনার্যদের অপপ্রচার যথাযথভাবে শৈবপক্ষ দ্বারা খণ্ডিত হলো।
🙏“সর্বে হ্যেষ রুদ্রস্তস্মৈ রুদ্রায় নমো অস্তু”🙏
নমঃ শিবায় 🙏
নমঃ শিবায়ৈ🙏
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে ✊🚩
হর হর মহাদেব 🚩
✍️অপপ্রচার দমনে— অন্তিক ভট্টাচার্য্য (শম্বরনাথ শৈব)
🌻বিশেষ কৃতজ্ঞতা— আমার গুরু শ্রী নন্দীনাথ শৈবাচার্য ও আমার আদর্শ শ্রী রোহিত কুমার চৌধুরী শৈবজী।
কপিরাইট ও প্রচারে— আন্তর্জাতিক শিবশক্তি জ্ঞান তীর্থ (International Shiva Shakti Gyan Tirtha)
বিঃ দ্রঃ — লেখাটি অনুকরণ করলে সম্পূর্ণ করবেন, কোনো রকম কাটছাট গ্রহণযোগ্য নয়।
শিব ওঁ........🙏


মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন