প্রদোষ ব্রতের মাহাত্ম্য ও ব্রতকথা (শৈবমহাপুরাণোক্ত)

 


♠♠ প্রদোষ ব্রতের মাহাত্ম্য ♠♠


ত্রয়োদশ্যাং তিথৌ সায়ং প্রদোষঃ পরিকীর্ত্তিতঃ ।

তত্র পূজ্যো মহাদেবো নান্যো দেবঃ ফলার্থিভিঃ ॥ ৫ ॥

প্রদোষপূজামাহাত্ম্যং কো নু বর্ণয়িতুং ক্ষমঃ ।

যত্র সর্ব্বেহপি বিবুধান্তিষ্ঠন্তি গিন্নিশান্তিকে॥ ৬ ॥ প্রদোষসময়ে দেবঃ কৈলাসে রজতালয়ে।

করোতি নৃত্যং বিবুধৈরভিষ্টুতগুণোদয়ঃ ॥ ৭ ॥ অতঃপূজা জপো হোমস্তৎকথাস্তদগুণস্তবঃ।

কৰ্ত্তব্যো নিয়তং মৰ্ত্ত্যৈশ্চতুর্বৰ্গফলার্থিভিঃ ॥ ৮ ॥ দারিদ্র্যতিমিরাদ্ধানাং মর্ত্যানাং ভবভীরুণাম্।

ভবসাগরমম্লানাং প্লবোঽয়ং পারদর্শনঃ ॥ ৯ ॥ দুঃখশোকভয়াৰ্ত্তানাং ক্লেশনিৰ্ব্বাণমিচ্ছতাম্ ।

প্রদোষে পার্ব্বতীশস্য পূজনং মঙ্গলায়নম্ ॥ ১০ ॥ দুর্বুদ্ধিরপি নীচোঽপি মন্দভাগ্যঃ শঠোঽপি বা । প্রদোষে পূজ্য দেবেশং বিপদ্ভ্যঃ স প্রমুচ্যতে ॥ ১১ ॥

শত্রুভির্হন্যমানোঽপি দশ্যমানোঽপি পন্নগৈঃ । শৈলৈরাক্রম্যমাণোঽপি পতিতোঽপি মহাম্বুধো ॥ ১২॥

আবিদ্ধকালদণ্ডোঽপি নানারোগহতোঽপি বা ।

ন বিনশ্যতি মর্ত্যোঽসৌ প্রদোষে গিরিশার্চ্চনাৎ ॥ ১৩ ॥

দারিদ্র্যং মরণং দুঃখমৃণ ভারং নগোপমম্।

সদ্যো বিধূয় সম্পদ্ভিঃ পূজ্যতে শিবপুজনাৎ ॥ ১৪ ॥

অনৰ্চ্চিতশিবা মর্ত্যাঃ প্রাপ্নুবন্তি দরিদ্রতাম্ ॥ ৭২

সত্যং ব্ৰবীমি পরলোকহিতং ব্রবীমি সারং ব্রবীম্যুপনিষদ্হৃদয়ং ব্রবীমি ।

সংসারমুল্বণমসারমবাপ্য জন্তো সারো যমীশ্বরপদাম্বুরুহস্য সেবা ॥ ৭৩

যে নার্চ্চয়ন্তি গিরিশং সময়ে প্রদোষে যে নাৰ্চ্চিতং শিবমপি প্রণমস্তি চান্যে ।

এতৎ কথাং ক্ষতিপুটৈর্ন পিবস্তি মুঢ়ান্তে জন্মজন্মসু ভবন্তি নরা দরিদ্রাঃ ॥ ৭৪ ॥

যে বৈ প্রদোষসময়ে পরমেশ্বরস্য কুর্ব্বন্ত্যনন্যমনসোঽঙ্ঘ্রি সরোজপূজাম্। 

নিত্যং প্রবৃদ্ধধনধান্য কলত্র পুত্রসৌভাগ্যসম্পদধিকাস্ত ইহৈব লোকে ॥ ৭৫ ॥ 

কৈলাসশৈলভবনে ত্রিজগজ্জনিত্রীং গৌরীং নিবেশ্য কনকাঞ্চিতরত্নপীঠে।

নৃত্যং বিধাতুমভিবাঞ্ছতি শূলপাণৌ দেবাঃ প্রদোসসময়েঽনুভজন্তি সৰ্ব্বে ॥ ৭৬ ॥

বাগ্দেবী ধৃতবল্লকী শতমথো বেণুং দধৎপদ্মজন্তালোন্নিদ্রকরো 

রমা ভগবতীগেয়প্ৰয়োগান্বিতা ।

বিষ্ণুঃ সান্দ্রমৃদঙ্গবাদনপটুৰ্দেবাঃ সমন্তাৎ স্থিতাঃ সেবন্তে তমনু প্রদোষসময়ে দেবং মৃড়ানীপতিম্ ॥৭৭

গন্ধর্বযক্ষপতগোরগসিদ্ধসাধ্য বিদ্যাধরামরবরাপ্সরাংগণাশ্চ ।

যেঽন্যে ত্রিলোকনিলয়াঃ সহ ভূতবর্গাঃ

প্রাপ্তে প্রদোষসময়ে হরপার্শ্বসংস্থাঃ ॥৭৮

অতঃ প্রদোষে শিব এক এব পূজ্যোঽথ নান্যে হরিপদ্মজাদ্যাঃ।

তস্মিন্ মহেশে বিধিনেজ্যমানে সর্ব্বে প্রসীদন্তি সুরাধিনাথাঃ ॥৭৯

[রেফারেন্স - স্কন্দমহাপুরাণ/ব্রহ্মখণ্ড/উত্তরখণ্ড/অধ্যায় ৬]

সরলার্থ - ত্রয়োদশী তিথির সায়ং প্রদোষ(সন্ধ্যা) সময়।

 ঐ সময়ে কামী ব্যক্তি(ইচ্ছপূরণ করার জন্য) পরমেশ্বর মহাদেবেরই পূজা করবেন ; অন্য দেবতার নয়। প্রদোষপূজার মাহাত্ম্য কে বর্ণনা করতে সক্ষম হয়?— যে প্রদোষ সময়ে নিখিল দেবতাই শিব-সন্নিধানে উপস্থিত থাকেন। 

প্রদোষ সময়ে দেবদেব কৈলাসভূধরের রজতগৃহে দেবগণ 'কর্তৃক পরিষ্টুত হয়ে নৃত্য করেন। অতএব চতুৰ্ব্বর্গফলার্থী মানবগণ ঐ সময়ে দেবদেবের জপ, হোম, পূজা, কথা, স্তবাদি সম্পন্ন করবেন। এই দেবদেব দারিদ্র্য-তিমিরান্ধ ভবভীরু ভবসাগরমগ্ন মর্ত্যবাসীদিগের পারপ্রদর্শনকারক প্লবস্বরূপ। দুঃখার্ত্ত, শোকার্ত্ত, ভয়ার্ত্ত এবং ক্লেশ দূর করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিগণের প্রদোষে পার্ব্বতীশ্বরের অর্থাৎ পরমেশ্বর শিবের পূজা অপার মঙ্গলদায়ক হয়। দুৰ্বুদ্ধিই হোক, নীচই হোক, মন্দভাগ্যই হোক, শঠই হোক, সকলেরই প্রদোষে মহেশের পূজা করিয়া বিপদ হইতে মুক্তিলাভ করা সম্ভব। মানব শত্রু দ্বারা হন্যে হলেও, সর্পকর্তৃক দৃশ্যমান হলেও, শৈলদ্বারা আক্রান্ত হলেও, মহাসাগরে পতিত হলেও, কালদণ্ডদ্বারা আবদ্ধ হলেও এবং নানা রোগ দ্বারা পীড়িত হলেও, যদি প্রদোষে শিবপূজা করে, তাহলে সে বিনাশপ্রাপ্ত হয় না । শিবপূজাকারী মানবগণের মরণযন্ত্রণাদায়ক দারিদ্র্য ও গিরিভারসদৃশ ঋণভার সদ্যসদ্যই অপনীত হয় ॥ ৫-১৪ ॥

যে সকল মর্ত্য বাসী শিবের অর্চ্চনা করে না, তিনি নিশ্চিতই দারিদ্র্য লাভ করে ॥৭২

অসার সংসারে জীবগণের ঈশ্বর-পদাম্বুজ-সেবাই একমাত্র সার; এই আমি সত্য, পরলোক-হিতকর, সার ও উপনিষদ্ হৃদয়স্বরূপ বাক্য বললাম ॥৭৩

যে ব্যক্তি প্রদোষকালে গিরিশের অর্চ্চনা বা প্রণাম করে না কিম্বা তাঁহার চরিত-কথা কানে শ্রবণ করে না, সেই মুঢ় ব্যক্তি জন্মে জন্মে দরিদ্র হয় ॥৭৪

যে নর(মানুষ) প্রদোষসময়ে অনন্যমনে পরমেশ্বরের পাদ পদ্ম পূজা করে, এই সংসারে তার নিত্য ধন, ধান্য, পুত্র, কলা, সৌভাগ্য ও অতুল সম্পদ লাভ হয় ॥৭৫

ভগবান্ শূলপাণি প্রদোষসময়ে তার কৈলাস-ভবনে কনকাঞ্চিত রত্নপীঠে জগজ্জননী পার্বতীকে উপবেশন করিয়ে স্বয়ং নিজে নৃত্য করিতে আরম্ভ করলে তখন দেবগণ সকলে ঐ স্থানে উপস্থিত হন। বাগ্দেবী বীণা- বাদন করেন, ইন্দ্র বংশীবাদন করেন, ব্রহ্মা তাল প্রদান করেন, রমা(লক্ষ্মী) ও ভগবতী(পার্বতী) গীত গায়ন করেন, বিষ্ণু মৃদঙ্গ বাদন করেন এবং অপরাপর যাবতীয় দেবতা মৃড়ানীপতির(পার্বতীপতি শিবের) সেবা করিয়া থাকেন। গন্ধর্ব, যক্ষ, পতগ, উরগ, সিদ্ধ, সাধ্য, বিদ্যাধর, বরাপ্সরোগণ ও অপরাপর ত্রিজগৎবাসী নিখিল ভূতপ্রেতগণ সকলেই প্রদোষকালে দেবদেবের নিকট উপস্থিত থাকেন। অতএব প্রদোষে একমাত্র দেবদেব মহাদেবই পূজনীয় ; ব্রহ্মাদি দেবগণ পূজ্য নন । বিধিপূর্ব্বক মহেশের পূজা করলে সর্ব দেবতাই প্রসন্ন হন ॥ ৭৩-৭৯॥


এবমন্যে সমারাধ্য প্রদোষে গিরিজাপতিম্। লভন্তেঽভীপ্সিতান্ কামান্ দেহান্তে তু পরাং গতিম্ ॥ ১৬০

সূত উবাচ। 

এতন্মহাব্রতং পুণ্যং প্রদোষে শঙ্করার্চ্চনম্ । ধর্ম্মার্থকামমোক্ষাণাং যদেতৎ সাধনং পরম্ ॥ ১৬১ ॥ য এতচ্ছৃণুয়াৎ পুণ্যং মাহাত্ম্যং পরমাদ্ভুতম্ ।

প্রদোষে শিবপূজান্তে কথয়েদ্বা সমাহিতঃ ৷৷ ১৬২ ৷৷ ভবেন্ন তস্য দারিদ্র্যং জন্মান্তরশতেষ্বপি । জ্ঞানৈশ্বৰ্য্যসমাযুক্তঃ সোহন্তে শিবপুরং ব্ৰজেৎ ॥ ১৬৩

 যে প্রাপ্য দুর্লভতরং মনুজাঃ শরীরং কুব্বন্তি হন্ত পরমেশ্বরপাদপূজাম্ ।

ধন্যাস্ত এব নিজপুণ্যজিতত্রিলোকাস্তেষাং পদাম্বুজরজো ভুবনং পুনাতি ॥ ১৬৪

[রেফারেন্স - স্কন্দমহাপুরাণ/ব্রহ্মখণ্ড/উত্তরখণ্ড/অধ্যায় ৭]

সরলার্থএইরূপ অপরাপর ব্যক্তিও প্রদোষে গিরিজাপতির আরাধনা করে ঈপ্সিত কাম(ইচ্ছা) ও দেহান্তে শ্রেষ্ঠগতি লাভ করে। 

সূত মুনি বললেন, — এই পুণ্য মহাব্রত শঙ্করার্চ্চন প্রদোষকালে অনুষ্ঠিত হলে ধর্ম্মার্থ কাম মোক্ষের সাধন হয়। এই পরম অদ্ভূত শিবমাহাত্ম্য যে ব্যক্তি শ্রবণ করে, এবং প্রদোষকালে শিব প্রান্তে সমাহিত হয়ে পাঠ করে শত জন্মেও তার দারিদ্র্য ঘটে না; অধিকন্তু সে জ্ঞানৈম্বৰ্য্য যুক্ত হয়ে অন্তিমকালে শিবপুরে গমন করে। মানব-জন্মে সেই ব্যক্তি নিজপুণ্যের বলে ত্রিলোক জয় করে এবং পদাম্বুজ রজো(পায়ের ধূলিকণা) দ্বারা ত্রিলোক পবিত্র করে থাকে ॥ ১৬১–১৬৪ ॥


সোমবারে বিশেষেণ প্রদোষাদিগুণান্বিতে ॥৮

কেবলেনাপি যে কুর্য্যুঃ সোমবারে শিবাৰ্চ্চনম্ ।

ন তেষাং বিদ্যতে কিঞ্চিদিহামূত্র চ দুর্লভম্ ॥৯

উপোষিতঃ শুচির্ভূত্বা সৌমবারে জিতেন্দ্রিয়ঃ । বৈদিকৈর্লৌকিকৈর্বাপি বিধিবৎ পূজয়েচ্ছিবম্ ॥ ১০  ব্রহ্মচারী গৃহস্থো বা কন্যা বাপি সভর্ত্তৃকা ।

বিভর্ত্তৃকা বা সম্পূজ্য লভতে বরমীপ্সিতম্ ॥ ১১ ॥

[রেফারেন্স -স্কন্দমহাপুরাণ/ব্রহ্মখণ্ড/উত্তরখণ্ড/অধ্যায় ৮]

সরলার্থ - প্রদোষাদি কালে অথবা কেবল সোমবারে যে ব্যক্তি শিবার্চ্চন করবে, তার ইহকাল বা  পরকালে কিছুই দুর্লভ থাকে না। জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি গৃহস্থ, সভর্ত্তৃকা কন্যা, বা বিভর্ত্তৃকা কন্যা যে কোন ব্যক্তি যদি সোমবারে উপবাসী থাকিয়া বৈদিক বা লৌকিক বিধানে বিধিবৎ শিবপূজা করে, তবে ঈপ্সীত বর লাভ করে থাকেন ॥ ৮ - ১১ ॥



♠♠ প্রদোষ ব্রতের ব্রতকথা ♠♠


শিবমহাপুরাণে উল্লেখিত প্রদোষ ব্রতের ব্রতকথা :


নন্দীশ্বর বললেন – 

বিদর্ভ দেশে সত্যরথ নামে একজন প্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন, যিনি ধর্মে তৎপর, সত্যশীল এবং বড় বড় শিবভক্তদের অনুগ্রাহী ছিলেন। ধর্মসহকারে পৃথিবী পালন করে তিনি বহুসময় সুখে অতিবাহিত করেছেন। তারপর কোনো এক সময় শাল্বদেশের রাজা সেই রাজার রাজধানী আক্রমণ করে, তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখেন। বলোন্মত্ত শাল্বদেশীয় ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে, যাঁদের বিশাল সৈন্যবাহিনী ছিল, রাজা সত্যরথের ভয়ংকর যুদ্ধ হল। শত্রুদের সঙ্গে সেই ভীষণ যুদ্ধে সত্যরথের বহু সৈন্য বিনাশ হল। তারপর দৈবযোগে রাজাও শাল্বের হাতে মৃত্যুবরণ করলেন। রাজার মৃত্যুতে অবশিষ্ট সৈনিকেরা মন্ত্রীগণসহ ভয়ে বিহ্বল হয়ে পলায়ন করল। মুনে ! সেই সময় বিদর্ভরাজ সত্যরথের মহারানী শত্রু পরিবেষ্টিত হলেও বহু চেষ্টায় রাতের অন্ধকারে নগর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তিনি গর্ভবতী ছিলেন; শোকসন্তপ্ত হয়ে ভগবান শংকরের চরণকমল স্মরণ করতে করতে তিনি ধীরে ধীরে পূর্বদিকে অনেক দূর চলে এলেন। প্রভাত হলে রানী ভগবান শংকরের কৃপায় এক নির্মল সরোবর দেখতে পেলেন। ইতিমধ্যে তিনি বহু পথ অতিক্রম করেছিলেন। সরোবরের তীরে এসে তিনি এক বৃক্ষের ছায়ায় বসলেন। সৌভাগ্যবশতঃ সেই নির্জন স্থানে, বৃক্ষের নীচে শুভ মুহূর্তে রানী উত্তম গুণসমন্বিত এক দিব্য বালককে জন্ম দিলেন। সেই বালক সকল শুভ লক্ষণযুক্ত ছিলেন। দৈববশতঃ বালকের জননী মহারানী অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত হন। জল পান করার জন্য রানী সেই সরোবরে নামেন। এরমধ্যে এক বিশাল কুমীর এসে রানীকে গ্রাস করে।

বালক জন্ম হতেই মাতৃ-পিতৃহীন হয়ে যায় এবং ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে সেই সরোবরের তীরে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। তখন তাঁর ওপর কৃপা করে ভগবান মহেশ্বর সেখানে এসে শিশুটিকে রক্ষা করতে থাকেন। তাঁর প্রেরণায় এক ব্রাহ্মণী অকস্মাৎ সেখানে আসেন, তিনি ছিলেন বিধবা এবং গৃহে গৃহে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। নিজের এক বছরের বালককে কোলে নিয়ে তিনি সেই সরোবরের তীরে পৌঁছে এক অনাথ শিশুকে সেখানে কাঁদতে দেখলেন। নির্জন বনে সেই বালককে দেখে ব্রাহ্মণী অত্যন্ত বিস্মিত হলেন এবং মনে মনে ভাবতে লাগলেন — ‘আরে ! এতো বড় আশ্চর্যের কথা, এই নবজাত শিশু, যার সূত্রনালীও এখনও কাটা হয়নি, মাটিতে পড়ে রয়েছে। এর মাও নেই, পিতা বা অন্য কাউকেও দেখা যাচ্ছে না। কী ব্যাপার ! কি জানি এ কার পুত্র ? এর সম্বন্ধে জানাবারও কেউ নেই, কাকে এর জন্মের কথা জিজ্ঞাসা করব ? একে দেখে আমার করুণা হচ্ছে। আমি একে আমার পুত্রের মতো পালনপোষণ করতে চাই। কিন্তু এর বংশ ও জন্ম ইত্যাদি না জানায় ছুঁতে সাহস হচ্ছে না।'

ব্রাহ্মণী যখন এইসব চিন্তা করছিলেন, তখন ভক্ত

বৎসল ভগবান শংকর অত্যন্ত কৃপা করেন। বড় বড় লীলাকারী মহেশ্বর এক সন্ন্যাসীর রূপ ধারণ করে সহসা সেখানে এলেন। এই ব্রাহ্মণী সন্ধিগ্ধ হয়ে প্রকৃত কথা জানতে ইচ্ছুক হয়েছিলেন। শ্রেষ্ঠ ভিক্ষুর রূপ ধরে আগত করুণানিধান শিব হেসে তাঁকে বললেন— 'ব্রাহ্মণী ! এই বালক পরমপবিত্র, তুমি একে নিজের পুত্র মনে করে প্রেমপূর্বক পালন করো। নিজ চিত্তে খেদ ও সন্দেহ রেখো না।'


ব্রাহ্মণী বললেন—প্রভো! আপনি আমার সৌভাগ্য বশতঃ এখানে এসেছেন। আপনার আদেশে আমি এই বালককে নিজের পুত্রের মতো পালন-পোষণ করব, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবুও আমি বিশেষভাবে জানতে চাই যে এই বালক বাস্তবিক কে, কার পুত্র এবং আপনি কে, যে এই সময় এখানে এসেছেন ? ভিক্ষুবর ! আমার বারবার মনে হচ্ছে যে আপনি করুণাসিন্ধু শিব এবং এই বালক পূর্বজন্মে আপনার ভক্ত ছিল। কোনো কর্মদোষে এই বালক এমন দুরবস্থা প্রাপ্ত হয়েছে। এই ভোগ শেষ করে সে পুনরায় আপনার কৃপায় পরম কল্যাণ লাভ করবে। আমিও আপনার মায়াতেই মোহিত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে এখানে এসে পড়েছি। আপনিই একে পালন করার জন্য আমাকে এইস্থানে পাঠিয়েছেন।


ভিক্ষুপ্রবররূপী শিব বললেন – ব্রাহ্মণী শোনো ! এই বালক শিবভক্ত বিদর্ভরাজ সত্যরথের পুত্র। শাল্বদেশীয় ক্ষত্রিয়েরা সত্যরথকে যুদ্ধে বধ করেছে। তাঁর পত্নী অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে রাতের অন্ধকারে তাড়াতাড়ি মহলের বাইরে পালিয়ে আসেন। তিনি এখানে এসে এই শিশুর জন্ম দেন। সকালবেলায় তৃষ্ণার্ত হয়ে তিনি সরোবরে নামেন এবং তখনই দৈববশতঃ এক কুমির এসে তাঁকে খেয়ে ফেলে । ব্রাহ্মণী জিজ্ঞাসা করলেন—ভিক্ষুদেব ! কি কারণে এর পিতা সত্যরথ শ্রেষ্ঠভোগ উপভোগ করার পূর্বেই শাল্বদেশীয় শত্রু দ্বারা নিহত হলেন ? কীজন্য এই শিশুর মাতাকে কুমির গ্রাস করল ? এই শিশু কী কারণে জন্ম থেকেই অনাথ ও বন্ধুহীন হল ? আমার নিজের পুত্রও দরিদ্র ও ভিক্ষুক কেন হল আর আমার এই দুই পুত্র ভবিষ্যতে কী করে সুখলাভ করবে ?


ভিক্ষুবর্য শিব বললেন – এই রাজকুমারের পিতা পূর্বজন্মে পাণ্ড্য দেশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন। তিনি সর্বধর্মের জ্ঞাতা ছিলেন এবং ধর্মপূর্বক সমগ্র পৃথিবী পালন করতেন। একদিন প্রদোষকালে রাজা ভগবান শংকরের পূজা করছিলেন এবং অত্যন্ত ভক্তিসহকারে ত্রিলোকীনাথ মহাদেবের আরাধনায় ব্যাপৃত ছিলেন। সেই সময়ে নগরের চারদিকে মহাকোলাহল শুরু হয়। 

সেই শব্দ শুনে রাজা মাঝপথেই ভগবান শংকরের পূজা ছেড়ে নগরে ক্ষোভ ছড়াবার আশঙ্কায় রাজভবন ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। এরমধ্যে রাজার মহাবলী মন্ত্রী শত্রুকে ধরে তাঁর কাছে নিয়ে আসেন। সেই শত্রু পাণ্ড্যরাজেরই সামন্ত ছিলেন। তাঁকে দেখে রাজা ক্রোধে তাঁর মস্তক কেটে ফেললেন। শিবপূজা ছেড়ে নিয়ম সমাপ্ত না করেই রাজা রাত্রে আহারও করেন। এইভাবে রাজকুমারও প্রদোষকালে শিবের পূজা না করে আহার করে শয়ন করেন। সেই রাজাই পরের জন্মে বিদর্ভরাজ হয়েছিলেন। শিবের পূজায় বিঘ্নের ফলে শত্রুরা তাঁর সুখ-ভোগের মধ্যেই তাঁকে বধ করে। পূর্বজন্মে তাঁর যে পুত্র ছিল, সে এই জন্মেও পুত্র হয়েছে। শিবের পূজা উল্লঙ্ঘন করায় সে দারিদ্র্য প্রাপ্ত হয়েছে। এর মাতা পূর্বজন্মে ছলনা দ্বারা নিজ সতীনকে হত্যা করেন। সেই মহাপাপের জন্যই সে এই জন্মে কুমির দ্বারা নিহত হয়। ব্রাহ্মণী ! তোমার এই পুত্র পূর্বজন্মে উত্তম ব্রাহ্মণ ছিল। সে সর্বসময় দানগ্রহণ করেই কাটিয়েছে, যজ্ঞাদি কোনো সৎকর্ম করেনি। তাই সে দারিদ্র্য প্রাপ্ত হয়েছে। সেই দোষ নিবারণের জন্য তুমি এবার ভগবান শংকরের শরণ গ্রহণ করো। এই দুই বালক যজ্ঞোপবীত-সংস্কারের পর যেন ভগবান শিবের আরাধনা করে। ভগবান শিব এদের কল্যাণ করবেন। ব্রাহ্মণী কে এইভাবে উপদেশ দিয়ে ভিক্ষুর(শ্রেষ্ঠ সন্ন্যাসীর) শরীর ধারণকারী ভক্তবৎসল পরমেশ্বর শিব তাঁকে নিজ উত্তম স্বরূপ দর্শন করালেন। তাঁকে সাক্ষাৎ শিব জেনে ব্রাহ্মণপত্নী তাঁকে প্রণাম করে প্রেমে গদগদবাক্যে তাঁর স্তুতি করলেন। তারপর ভগবান শিব সেখান থেকে অন্তর্ধান করলেন। তিনি চলে গেলে ব্রাহ্মণী নিজ পুত্রসহ সেই বালককে নিয়ে গৃহে ফিরে গেলেন। একচক্রা নামক সুন্দর গ্রামে তিনি গৃহ নির্মাণ করেছিলেন। অতঃপর উত্তম অন্নের দ্বারা নিজ পুত্র ও রাজকুমারকে পালন পোষণ করতে থাকেন। যথাসময়ে ব্রাহ্মণেরা ঐ দুজনের যজ্ঞ-উপবীত-সংস্কার করেন। তাঁরা দুজন শিবপূজায় তৎপর থেকে সেখানেই বড় হতে লাগলেন। শাণ্ডিল্য মুনির উপদেশে(প্রদোষব্রতের বিধি জেনে নিয়ে) এঁরা দুজন নিয়মপরায়ণ হয়ে শুভব্রত ধারণ করে প্রদোষকালে শংকরের(পার্বতী সহিত) পূজা করতেন। একদিন দ্বিজকুমার রাজকুমারকে সঙ্গে না নিয়ে নদীতে স্নান করতে যান। সেখানে তাঁর রত্নপূর্ণ এক সুন্দর কলশের প্রাপ্তি ঘটে। এইভাবে শংকরের পূজা করতে করতে ঐ দুই কুমারের এক বৎসর কেটে গেল। তারপর একদিন রাজকুমার ব্রাহ্মণকুমারের সঙ্গে বনে গেলেন। সেখানে অকস্মাৎ এক গন্ধর্বকন্যা এসে গেলেন। তাঁর পিতা ঐ কন্যাকে রাজকুমারকে সমর্পণ করেন। গন্ধর্ব | কন্যাকে বিবাহ করে রাজকুমার নিষ্কণ্টক রাজ্য ভোগ করতে লাগলেন। যে ব্রাহ্মণপত্নী প্রথমে তাঁকে নিজ পুত্রের ন্যায় পালন-পোষণ করেছেন, তিনি এখন রাজমাতা হলেন এবং সেই ব্রাহ্মণকুমার তাঁর ভাই হলেন। রাজার নাম ছিল ধর্মগুপ্ত। এইভাবে দেবেশ্বর শিবের আরাধনা করে রাজা ধর্মগুপ্ত তাঁর রানীর সঙ্গে বিদর্ভদেশে রাজোচিত সুখ উপভোগ করতে লাগলেন। আমি তোমার কাছে ভিক্ষুবর্য অবতারের বর্ণনা করলাম, যিনি রাজা ধর্মগুপ্তকে বাল্যকালে সুখপ্রদান করেছিলেন। এই পবিত্র কাহিনী পাপহারী, পরম পবিত্র, চার পুরুষার্থের সাধক ও সমস্ত অভীষ্ট প্রদানকারী। যিনি প্রতিদিন একাগ্রচিত্তে এটি শোনেন বা শোনান, তিনি ইহলোকে সমস্ত ভোগ উপভোগ করে অন্তকালে শিবধামে গমন করেন। 

(রেফারেন্স - শিবমহাপুরাণ/শতরুদ্রসংহিতা/অধ্যায় ৩১)

[বিঃদ্রঃ - উপরোক্ত এই এক‌ই কাহিনী স্কন্দমহাপুরাণের ব্রহ্মখণ্ডের উত্তর খণ্ডের অধ্যায় নং ৬ ও অধ্যায় নং ৭ -এ বর্ণিত হয়েছে। তবে সেখানে ভিক্ষুকরূপী পরমেশ্বর শিব রাজপুত্র বা রাজার সম্পর্কে কিছুই বলেননি ব্রাহ্মণী কে, এই বিষয়ে শাণ্ডিল্য মুনি অবগত করিয়েছিলেন ব্রাহ্মণী কে। 

কাহিনীর মূল বিষয় বস্তু এক‌ই, সামান্য তফাৎ হ‌ওয়ার কারণ হল এক‌ই ঘটনা প্রত্যেক কল্পে এক‌ইভাবে ঘটে কিন্তু সামান্য পার্থক্য থাকে, এই কারণে তফাৎ হয়ে থাকে কাহিনী গুলি, কিন্তু কাহিনীর মূল বিষয় বস্তু এক‌ই থাকে সর্বদা।]

🌿লেখনীতে - শ্রী কৌশিক রায় শৈবজী

কপিরাইট ও প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT


॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥


শিবনাম প্রচারের স্বার্থে এই পোষ্টের লিঙ্ক টি বেশি করে শেয়ার করুন বন্ধুদের, ফলো করুন, কমেন্ট করে নিজের মতামত জানান।  

 

👉ত্রয়োদশী প্রদোষ ব্রত পূজা বিধি - সংক্ষিপ্ত (শৈবপুরাণোক্ত)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত