ফাল্গুনী বসন্তোৎসব (পাঙ্গুনি উথীরাম)



বর্তমানে সনাতন শৈবধর্মের বহু সংস্কৃতি আজ‌ও সনাতনীরা নিজেরাই বিস্মৃত হয়ে গেছেন। যার মধ্যে অন্যতম হল এই ফাল্গুনী বসন্তোৎসব। দক্ষিণ ভারতে তামিল ভাষায় এটি পাঙ্গুনি উথীরাম নামে সুবিখ্যাত। এই পাঙ্গুনি শব্দের অর্থ ফাল্গুন মাস কে বোঝায় এবং উথীরাম শব্দ একটি বিশেষ নক্ষত্র কে নির্দেশ করে, তার নাম - উত্তরা নক্ষত্র । 

এই অনুষ্ঠানের সম্পর্কে বাংলায় কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এই সর্বপ্রথম ISSGT(International Shiva Shakti Gyan Tirtha) এর পক্ষ থেকে শৈবসংস্কৃতির মধ্যে প্রাচীন তম একটি অনুষ্ঠান যার নাম ফাল্গুনী বসন্তোৎসব, সেটি লেখার মাধ্যমে  শ্রীকৌশিক রায় শৈবজী প্রকাশ করেছেন, তথ্য দ্বারা বিশেষ সহায়তা করেছেন - শ্রী রোহিত কুমার শৈবজী । এছাড়া ঈশান বর্মন সাহায্য করেছেন। 


♥️ উৎসবের উৎস : সেক্কিজার‌‌ পিল্লাই নায়নার‌ (তাঁরই‌ লেখা পেরিয়াপুরাণ- শেষতম তিরুমুরাই)। এই পেরিয়া পুরাণ তিরুমুরাই তে সেক্কিজার‌‌ লিখেছেন যে - 

নমিনন্দী আদিগাল নয়নার এবং আপ্পার নয়নার (তিরুনাভুক্কারাসার) প্রাচীন কালে এই অনুষ্ঠান পালন করেছিলেন।

পেরিয়া পুরাণ ও দক্ষিণভারতের মান্যতা অনুসারে এই দিনের মূল অনুষ্ঠান হল - কল্যান ব্রত

এই ব্রত পালন করার উদ্দেশ্য হল শিবপার্বতীর বৈবাহিক মধুর সম্পর্ক কে শ্রদ্ধা নিবেদন করে সেই মহাপবিত্র দিনের উদযাপন করা । যার ফলে জীবন ও সমগ্র জগৎসংসার রঙ্গীন স্বপ্নের ন্যায় অতি সুন্দর ও মঙ্গলকারী হয়ে ওঠে। সেই আনন্দে সামিল হন প্রত্যেক ভক্ত তথা যোগী মুনি দেবতা মানব তথা সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। বিশেষত এই উৎসব টি ফাল্গুন মাসে সূর্য উত্তরা নক্ষত্রে গমন কালে পূর্ণিমাতে ঘটে থাকে। সনাতনীদের কাছে এই দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। তার কিছু কারণ নিচে উল্লেখ করা হল -


 প্রধান কারণ : এইদিন প্রভু পরমেশ্বর শিবের ধ্যানভঙ্গ করবার জন্য জাগতিক প্রেমের দেবতা কামদেব তার কামবান পরমেশ্বর শিবের বক্ষে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু পরমেশ্বর শিব তার তৃতীয় নয়ন খুলে কামবান সহ কামদেব কে ভস্ম করে দেন। পরমেশ্বর শিব কামদেবকে ভস্মীভূত করেছিলেন তাঁর কামদহন বা কামারিমূর্তি রূপে। এই কামদেবকে ভস্মীভূত করার পর সেই ভস্ম তিনি নিজ দেহে লেপন করেছিলেন। কামদেবের এই ভস্ম ছিল রঙ্গীন মায়া মোহময় জগতের প্রতীক। প্রভু শিব মদনদেব কে ভস্ম করার মধ্য দিয়ে এটিই সূচিত করেছেন যে, শিব হল কামনা বাসনার ঊর্ধ্বে, তাকে ছল কপট বা চতুরতা দিয়ে পাওয়া সম্ভব নয়, তাকে পেতে গেলে বিশুদ্ধ হৃদয় প্রয়োজন। এছাড়া আরো একটি কথা হল, প্রভু শিব কামকে ভস্ম করে নিজের অঙ্গে যা লেপন করে এটিই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, কাম হোক অথবা অন্য যাই হোক সব কিছুই অন্তিমে শিবেই বিলিন হয়ে যাবে, শিব ই চরম সত্য, ভস্ম ই চরম সত্য । তাই সেই দিনকে স্মরণীয় করার উদ্দ্যেশ্যে মর্ত্যলোকে ভস্ম তথা রঙ্গীন হোলি ক্রীড়ার সূচনা হয়। 

পরবর্তীতে আদ্যাশক্তি পার্বতী মাতার অতি ভয়ঙ্কর সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে পরমেশ্বর শিব তাকে বিবাহ করেন অগ্রহায়ণ মাসের রোহিণী নক্ষত্রে যোগে।


এরপর কোনো একসময়ে মর্ত্যে দেবী পার্বতী মীনাক্ষী রূপে লোকলীলা প্রদর্শনের নিমিত্ত জন্মগ্রহণ করলেন, তখন পরমেশ্বর শিব দোলপূর্ণিমা তিথিতে সুন্দরেশ্বর রূপ ধারণ করে মীনাক্ষী দেবীকে বিবাহ করেন। বিবাহের  সময় প্রভু শিব যে পরমরূপ ধারণ করেছিলেন সেই রূপের নাম হল - কল্যাণসুন্দর রূপ।  মাতা পার্বতীর মীনাক্ষী রূপের সহিত প্রভু সুন্দরেশ্বর কল্যাণসুন্দর  শিবের এই দাম্পত্য জীবনের পবিত্র দৃষ্টান্ত সমগ্র জগতের চোখে সর্বোৎকৃষ্ট দাম্পত্য বৈবাহিক সম্পর্কের নিদর্শন হিসেবে অমর হয়ে গিয়েছে। 

ফলত, এই সর্বোৎকৃষ্ট দম্পতি কে আরাধনা করে সকলেই নিজেদের কল্যাণ করতে ইচ্ছুক হন। শিব পার্বতীর বিবাহের ফলে যেন সমগ্র জগতে মহা আনন্দের লহর বয়ে যেতে থাকে। সমগ্র জগতের সমস্ত মুনি ঋষি যোগী ভুত-প্রেত দেবতা কিন্নর যক্ষ গন্ধর্ব মানব পশুপাখি কীটপতঙ্গ সকলেই আনন্দে মেতে ওঠে। জগত অতি সুন্দর ও শোভাবর্ধনকারী হয়ে ওঠে, তাই সকলে রঙিন আবির এবং ভস্ম চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জগতকে রাঙ্গিয়ে তোলেন। যা আজ‌ও আমরা আবির অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করছি।


পরবর্তীতে দধীচি ঋষির প্রার্থনায় তার আশ্রমে সদ্য বিবাহিত হ‌ওয়া দম্পতি পরমেশ্বর শিব ও পরমেশ্বরী পার্বতী দেবী আবির্ভূত হলে সেখানে উমা মহেশ্বর কে দোলনায় বসিয়ে তাদের আরাধনা করা হয় বৈদিক মন্ত্র পাঠ করে ও তাদের কে শুভ রঙিন আবির প্রদান করে মহা আনন্দোল্লাস করা হয় বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্র বাজিয়ে কন্ঠসঙ্গীতের সাথে নৃত্য করে, দধীচি ঋষির আশ্রমের এই মহাঅনুষ্ঠান দোলপূর্ণিমাতে হয়েছিল। এটিই কল্যান ব্রতের শুভারম্ভ।

এছাড়া অনান্য রূপে পরমেশ্বর শিব একাম্বরেশ্বর রূপে বর্তমানের কাঞ্চী মন্দিরে দেবী পার্বতী কে বিবাহ করেন । তাই এই মহান উৎসবটি ধুমধামের সহিত সেই যুগ থেকেই পালিত হয়ে আসছে।


অপ্রধান কারণ : এই দিনেই পরবর্তীতে এই দিন‌ই শ্রীকার্তিকের বিবাহ হয় , এই ব্রতের ফলেই ইন্দ্র ইন্দ্রানী কে বিবাহ করেন, এই ব্রত করে এই দিন‌ই চন্দ্রের বিবাহ সম্পন্ন হয়, এই ব্রত করে এই দিন‌ই শ্রীরামচন্দ্রের বিবাহ সম্পন্ন হয় দেবী সীতার সহিত, এই ব্রত পালন করে এই দিন‌ই শ্রীকৃষ্ণের বিবাহ সম্পন্ন হয় জাম্ববতীর সহিত ।



🚩 উৎসব পালনের বিধি :   এই উৎসবের আয়োজন করতে হলে -

১) একটি পবিত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন স্থানে কলাগাছ দিয়ে মণ্ডপ তৈরি করবেন, আমপাতা সূতো দ্বারা সেটি মণ্ডপের কলাগাছের সাথে লাগিয়ে চারিদিকে গোল করে টানিয়ে দিতে হবে , যদি কলাগাছের অভাব হয় তবে অনান্য সামগ্রী অথবা ফুলের মালা দিয়েও বিভিন্ন ভাবে সাজাতে পারবেন,

২) মণ্ডপের ভেতর আলপনা দিয়ে সাজাতে পারেন , 

৩) একটি দোলনা বানাবেন ফুল দিয়ে সাজিয়ে ,

৪) দোলনার মধ্যে শিব পার্বতীর ছবি অথবা প্রতিমা বসাবেন(সাবধানে বসাবেন যাতে ছবি বা প্রতিমা নিচে পড়ে না যায়)

৫) বাড়ির সকলে মিলে অথবা বিভিন্ন ভক্তশৈব সনাতনীদের সাথে একত্রিত হয়ে এই উৎসব পালন করতে হয়।

৬) ব্রত পালনের দিন একবার মাত্র আহার করা যাবে, উপবাস থাকলে আরো ভালো। 



🍁 কল্যান ব্রত পালন :

১) উক্ত দিনের সকালে সকলেই স্নান করবেন, কপালে ত্রিপুণ্ড্র আঁকবেন ও গলায় রুদ্রাক্ষ মালা ধারণ করবেন।


২) তারপর সকলেই শুচি মন্ত্র পাঠ করবেন।

শুচি মন্ত্র - 

ॐ অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্বাবস্থাং গতোঽপি বা ।

যঃ স্মরেৎ বৈ বিরূপাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ ‌‌॥


৩) তারপর আচমন করবেন । 

এখানে ক্লিক করে দেখুন 👉 শৈব আচমন পদ্ধতি


৪) এরপর ধূপ ও দীপ জ্বেলে প্রভু শিব ও মাতা পার্বতীকে নিত্য দিনের ন্যায় পূজা করুন, পায়েস, মিষ্টি, ফল নৈবেদ্য প্রদান করুন , সামর্থ অনুযায়ী উপাচার(পূজার বিভিন্ন দ্রব্য) দিয়ে পূজা করুন ।

পূজার সময়ে প্রভু শিবকে ভস্ম প্রদান করুন -

🔘 ভস্ম নিবেদনের মন্ত্র - অনাদি শাশ্বতং শান্তং চৈতন্যং চিৎস্বরূপকম্ । চিদঙ্গং বৃষভাকারং চিদ্ভস্মলিঙ্গধারণম্ । শ্রীসাম্বসদাশিবায় নমঃ বিভূতিং সমৰ্পয়ামি ।


 ৫)এবার আবির নিবেদন করুন প্রভু শিব ও মাতা পার্বতীকে - ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌

আবির প্রদানের মন্ত্র - ॐ নমঃ শিবায় ॐ নমঃ শিবায়ৈ ॐ নমঃ ভগবতে শ্রীসাম্বসদাশিবায় নমঃ, নানাপরিমলদ্রব্যাণি সমর্পয়ামি।


৬) এবার শিবপার্বতীকে প্রনাম করে সকলে শিবপার্বতীকে সমর্পিত আবির নিজেদের কপালে তথা মুখে লাগিয়ে নিন, শিবের কৃপায় রাঙ্গিয়ে দিন দেহ মন । 


৭) পরমেশ্বর শিব ও মাতা পার্বতীর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সৌজন্যমূলক আনন্দ সঙ্গীত গেয়ে নৃত্য করে মহা আনন্দে মেতে উঠুন। এভাবেই শিবময় ফাল্গুনী বসন্তোৎসব পালন করুন । সব শেষে ধ্বনী দেবেন ।


নন্দীনাথশৈবকৃত শিবধ্বনী :


এক অদ্বিতীয় সগুণ নির্গুণ পরমেশ্বর 

হর শঙ্কর কি........ জয়......

ব্রহ্মাবিষ্ণুসেবিত শক্তিপতি মহেশ্বর

প্রভু সদাশিব কি...... জয়......

বেদ বেদান্ত বেদাঙ্গ ইতিহাস পুরাণ 

আগম ধর্মশাস্ত্রবর্ণিত মহাদেব কি...... জয়.....

সন্তানপ্রতিপালনকারী সনাতন ধর্ম

প্রকাশকারী রুদ্রদেব কি...... জয়.......

ভক্তবৎসল আশ্রয়দাতা পরমপিতা

আশুতোষ ত্রিপুরারী কি....... জয়....... 

জগতমাতা জগদম্বা ত্রিলোকপূজিতা 

শ্রীপার্বতী পরমেশ্বরী কি....... জয়.......


শৈব হো মন.. শৈব হো তন.. শৈব হো জীবন..

শৈব হে ধর্ম.. শৈব হে কর্ম.. শৈব হে বর্ম...

শিব শিব শিব হর হর শঙ্কর হর নীলকন্ঠ মহাদেব  


ॐ শান্তি শান্তি শান্তি

ॐ নমঃ পার্বতীপতয়ে হর হর মহাদেব ॥

হর হর মহাদেব ॥

হর হর মহাদেব ॥ 

ॐ নমঃ শিবায় 🙏


৯) সন্ধ্যাবেলায় সন্ধ্যা আরতি করবেন । শেষে উপরোক্ত ধ্বনী দেবেন।

সমাপ্ত

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত