ন তস্য প্রতিমা অস্তি - বেদ মন্ত্র নিয়ে আর্যমসমাজী ও যবনদের আক্ষেপ নিবারণ

 



 "ন তস্য প্রতিমা অস্তি" - এই মন্ত্র টি

 শুক্ল যজুর্বেদের ৩২ অধ্যায়ের ৩নং মন্ত্র , যা নিয়ে সনাতন বিরোধী তত্ত্ব প্রচার করে আর্যমসমাজী তথা অনান্য অসনাতনীরা সর্বদা মূর্তিপূজার নিন্দা করে। 

তাদের মত হল "ন তস্য প্রতিমা অস্তি" এর অর্থ - সেই পরমপিতা পরমাত্মার কোনো প্রতিমা নেই।


"প্রতিমা" শব্দের অর্থ বর্তমানে "প্রতিমা ই রেখে দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে এই ম্লেচ্ছ আর্যপ্রতিমাসমাজীরা, আর সেসবের সুযোগ নিচ্ছে যবনরাও ।

মজার বিষয় হল এই আর্যমসমাজীরা - বেদ শাস্ত্রের কোনো স্থানে "শিব" শব্দ দেখলেই সবক্ষেত্রেই তার অর্থ মঙ্গলময় বের করে, অর্থাৎ বিশেষ্য থেকে বিশেষণ বানিয়ে দেয়। কিন্তু নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য উক্ত বেদ মন্ত্রের "প্রতিমা" শব্দের অর্থ "প্রতিমা" ই রেখে দিয়ে তার অর্থ মূর্তিবিশেষ বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে এরা, এক্ষেত্রে প্রতিমা শব্দের অর্থ আর বিশেষণ হিসেবে তুলে ধরে না তারা, এটাকে একপ্রকার যা ইচ্ছা তাই মানবো , যা ইচ্ছা তাই করবো অর্থাৎ স্বেচ্ছাচারিতা বলে।

আজকে আমরা শৈব সনাতনীরা এই থিয়োসোফিক্যাল সোসাইটির খ্রিষ্টানদের দালাল ম্লেচ্ছ দয়ানন্দ সরস্বতী ও তার অনুসারী আর্যসমাজীদের সাথে সাথে যবনদের‌ও জবাব দেবো ।

চলুন এবার দেখা যাক, এই "প্রতিমা" শব্দের দ্বারা এক্ষেত্রে কি অর্থ বলা হয়েছে ?


💥 বিশ্লেষণ পর্ব :  "প্রতিমা" শব্দের অর্থ দুই ধরণের হয়। যথা -

(১) মূর্তি/ভাস্কর্য/বিগ্রহ, 

(২) তুলনা, পরিমাণ, সমান, সাদৃশ্য।

এবার পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যাক উপরোক্ত দুই রকমের অর্থের মধ্যে কোন অর্থটি উপরোক্ত বেদমন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

(১) 👉প্রতিমা শব্দের অর্থ যদি "মূর্তি" ধরা হয় তবে তার অর্থ এমন হবে - ‘তার মূর্তি নেই, যার নামে মহৎ যশ’

⚫ বিবেচনা করে দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, এই অর্থ উপরোক্ত মন্ত্রের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ ।

মূর্তি কল্পনা করাই যদি যশস্বী ব্যক্তির যশের ক্ষতি করতো তাহলে পুরাতন মহাত্মাগণ, রাজা, মহারাজা, পণ্ডিত ব্যক্তিদের মূর্তি তৈরি হত না। এমনি আর্যমসমাজীদের তথাকথিত মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর‌ও যে মূর্তি তৈরি হয়েছে সেটিও অপযশ বা দুষ্কৃতীর স্তম্ভ বলে স্বীকৃত হতো। 

সংসারে যারা যশস্বী ব্যক্তির‌ই মূর্তি তৈরী করে স্থাপিত হয়, কোনো হীন ব্যক্তির নয় ।

(২) 👉 প্রতিমা শব্দের অর্থ যদি "তুলনা বা উপমা" হয় তবে তার অর্থ এমন হবে - তার কোনো তুলনা বা উপমা নেই , যার নামে মহৎ যশ ।

⚫ পাঠক বৃন্দ আপনারাই বিবেচনা করে দেখুন, একজন যশস্বী ব্যক্তি কে এমনটাই বলা কি যুক্তিযুক্ত নয় ?

“আপনার তুল্য আর কেউ নেই” - এই কথাটি এই কথাটি একজন যশস্বী ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় ?

প্রতিমা শব্দের মধ্যে থাকা ‘মা’ ধাতুর প্রয়োগ মাপ করা অর্থেই প্রযোজ্য হয় সাধারণত।

🟪এখন উক্ত মন্ত্রের মহীধর ভাষ্য দেখা যাক 👇

ন তস্য প্রতিমা অস্তি যস্য নাম মহদযশঃ ৷

হিরণ্যগর্ভ ইত্যেষ মা মা হিংসীদিত্যেষ যস্মান্ন জাত ইত্যেষঃ ॥

(শুক্ল-যজুর্বেদ ৩২৷৩)


🛑 মহীধরভাষ্য : “তস্য” পুরুষস্য “প্রতিমা” প্রতিমানমুপমানং কি়ঞ্চিদ্বস্তু নাস্তি ... ৷

 অর্থাৎ মহীধর আচার্য এখানে বলছেন যে - সেই পুরুষের প্রতিমা বলতে - প্রতিমান উপমান হবে এমনটাই বুঝিয়েছেন, বিগ্রহ বা মূর্তি বোঝাননি ৷

(যদিও আর্যমসমাজীরা মহীধরকে গালিগালাজ করার পরেও তার ভাষ্য তুলে মিথ্যাচার করে বলতে চেয়ে যে ওখানে কি না মহিধর‌ও প্রতিমা শব্দের অর্থ মূর্তি ধরেছে, যদিও এমন কোনো কথা ওখানে নেই, তস্য পুরুষস্য প্রতিমা প্রতিমানমুপমানং - এর অর্থ এমন, সেই পুরুষের প্রতিমা অর্থাৎ প্রতিমান উপমান নেই।)

🟣 পণ্ডিত শ্রীজ্বালাপ্রসাদ মিশ্র ভাষ্য : (তস্য) সেই পুরুষের (প্রতিমা) প্রতিমান উপমান সদৃশ উপমা দেওয়ার যোগ্য কোনো বস্তু (ন, অস্তি) নাই ; (যস্য) যার (নাম) নাম প্রসিদ্ধ (মহৎ) বড় (যশঃ) যশ আছে অর্থাৎ সর্বাধিক তাঁর যশ ৷ এই বেদের “হিরণ্যগর্ভ ইত্যেষ” [২৫৷১০-১৩] “মা মা হিংসীদিত্যেষ” [১২৷১০২] এবং “যস্মান্ন জাত ইত্যেষা” [৮৷৩৬,৩৭] ইত্যাদি মন্ত্র দ্বারা তাঁকেই বর্ণনা করা হয়েছে ৷


পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ জী আরো বলেছেন —

“আধুনিক অল্পজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ এই মন্ত্রের মধ্যে থাকা প্রতিমা অর্থ কে মূর্তি ধরে নিয়ে বলে যে, ঈশ্বরের কোন মূর্তি নেই আর মূর্তিপূজা উচিত নয় ৷”

    


অত‌এব,

 এই যজুর্বেদীয় মন্ত্রের সঠিক অর্থ হল -

 সেই পরমাত্মার কোনো‌ প্রতিমান( তার সমান, তার তুলনায় ) আর কেউ নেই। তার সমান কেউ নেই, তিনি অদ্বিতীয় - ন তস্য প্রতিমা অস্তি।


 "প্রতিমা" শব্দের অর্থ বর্তমানে "মূর্তি" মনে করা হয় কিন্তু প্রাচীন কালে এর অর্থ ছিল "প্রতিমান"(বরাবর/সমান)। বেদের সঠিক অর্থ বিশ্লেষণের দাবী করা  কিছু ব্যক্তি, যারা মূর্তিপূজা বিরোধী, এই শব্দের(প্রতিমা) আধুনিক অর্থ দিয়ে বলা শুরু করেছে যে পরমাত্মার কোনো‌ মূর্তি নেই। অনেক আর্যসমাজী বিদ্বান এটাই দূ্ষ্প্রচার করে এসেছে। 

হিন্দিতে প্রশংসা করার জন্য একটি শব্দ আছে -"অপ্রতিম" তার অর্থ হল "অদ্বিতীয়" । 

বাক্যের সময় আমরা এভাবে ব্যবহার করি তেমন - অমুক ব্যক্তি " অপ্রতিম " সে " অপ্রতিম " গুণ ও কলাদ্বারা যুক্ত।

 এভাবে অপ্রতিম শব্দের বিপরীত "প্রতিম" হয় তার অর্থ সমান। এই অর্থেই "ন তস্য প্রতিমা অস্তি" তে "প্রতিমা" এর অর্থ বরাবর বা সমান-ই হয়।

এবার দেখুন.....

আর্যসমাজীরা বাল্মীকি রামায়ণ নিয়ে খুব আহ্লাদ দেখায়, যদিও তারা সেই রামায়ণের‌ও বহু অংশকে প্রক্ষিপ্ত বলে চালায়, যখন‌ই তাদের বুদ্ধি কাজ করে না বা তাদের মতের সাথে অমিল হয় তখন‌ই সেই অংশটিকে তারা প্রক্ষিপ্ত বলে পিঠ বাঁচায়।

সেই

বাল্মীকি রামায়নে -এও অপ্রতিমা শব্দের প্রতিমা- এর অর্থ সাদৃশ্য নিয়ে বলা হয়েছে -


"কীর্তিং চাঽপ্রতিমাং লোকে প্রাপস্যসে পুরূষষর্ভ "

( বা, কা, - ৩৮/৭)

সরলার্থ - তুমি এই লোকে অনুপম কীর্তি প্রাপ্ত করবে। (এখানে অপ্রতিম = অনুপম/অতুলনীয় অর্থে সুস্পষ্ট।) 

"রূপেণা প্রতিমাভুবি "

(বা,ক, - ৩২/১৪)

সরলার্থ - এই ভূ-তলে তার রূপ-সৌন্দর্যের কোনো তুলনা ছিল না। সাদৃশ্য অর্থে প্রতিমা শব্দ -

"সা সুশীলা বপুঃশ্লাধ্যা রূপেণাপ্রতিমাভুবি"।

(বাল্মীকি রামায়ন/অরণ্যকাণ্ড -৩৪/২০ )

সরলার্থ - তার রূপের তুলনা করার মতো দ্বিতীয় কোনো স্ত্রী ভূ-মণ্ডলে নেই।


সুতরাং, যদি "ন তস্য প্রতিমা অস্তি" এর ইতিবাচক বাক্য তৈরি করা হয় তাহলে হবে - 

" সঃ অপ্রতিম অস্তি " অর্থাৎ সেই পরমপিতা পরমাত্মা অপ্রতিম(অদ্বিতীয় অপ্রতিমান)


সুতরাং,  পরমেশ্বরের কোনো প্রতিমা বা মূর্তি নেই এই কথা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। 

বরং, এই বেদ মন্ত্রের ক্ষেত্রে পরমেশ্বরের সাথে অন্য কোনো কিছুর তুলনাই হয় না - এই অর্থ‌ই সর্বথা গ্রহণ যোগ্য ।


হে আর্যনামাজীগণ ! আপনাদের কথা অনুযায়ী যদি কিছুক্ষণের জন্য ধরেও নেয়া হয় যে, ঈশ্বরের কোনো প্রতিমা নেই, তাতেও এটা কোথাও সিদ্ধ হয় না যে, প্রতিমা পূজা নিষিদ্ধ। বরং ঈশ্বরের প্রতিমা রয়েছে তা স্বয়ং বেদ বলছে, দেখুন 👇


সহস্রস্য প্রতিমা অসি
[তথ্যসূত্র — যজুর্বেদ/অধ্যায় ১৫/মন্ত্র নং ৬৫]
অর্থ — হে পরমেশ্বর আপনার হাজার রকমের প্রতিমা রয়েছে ।


সম্বৎসরস্য প্রতিমাং যাং ত্বাং রাত্র্যুপাস্মহে । 

সা ন আয়ুষ্মতীং প্রজাং রায়স্পোষেণ সং সৃজ ॥ 

[তথ্যসূত্র : অথর্ব-বেদ/৩/১০/৩]

অর্থ — হে রাজ্যভিমানী দেব ঈশ্বর(রাত্রি) ! সম্বৎসর(সমগ্র বৎসর সর্বদা) যার প্রতিমা বিদ্যমান, সেই আপনাকে আমি উপাসনা করে থাকি, আপনি আমাদের সন্তানদের দীর্ঘজীবী করে তাদের গো তথা ধনসম্পন্ন করে তুলুন ।


স এক্ষত প্রজাপতি হমং বাঽআত্মনঃ প্রতিমামসৃক্ষিযৎসম্বৎসরমিতিতস্মাদাহুঃ প্রজাপতিঃসম্বৎসর ইত্যাৎমনোতংহ্যেতং প্রতিমামসৃজত যদেবচতুরক্ষরঃ সম্বৎসরশ্চতুরক্ষরঃ প্রজাপতি স্তোনো হৈবাস্যেষ প্রতিমা ।

[তথ্যসূত্র : শতপথ ব্রাহ্মণ/১১/১/৬/১৩]

অত‌এব, ঈশ্বর নিজের প্রতিমা সম্বৎসর নামকে উৎপন্ন করেছেন, এই কারণে বলা হয়েছে ঈশ্বর হলেন সম্বৎসর, দেখুন সম্বৎসর-এ চারটি অক্ষর আর প্রজাপতি-তেও চার অক্ষর রয়েছে, এই কারণে সম্বৎসর হল ঈশ্বরের প্রতিমা, এটিই শতপথ ব্রাহ্মণে উল্লেখ হয়েছে ।


আর্যসমাজীরা এটা দেখে প্রশ্ন করবে, 

প্রথম ক্ষেত্রে আপনি প্রতিমা শব্দের অর্থ করলেন তুলনা আবার দ্বিতীয় ধাপে ই আপনি প্রতিমা শব্দের অর্থ প্রতিমাই রাখলেন কেন? 


উত্তর — আমাদের সনাতনীদের অনুসারে বেদে স্থান কাল পাত্র ভেদে রুদ্র শব্দের অর্থ পরমেশ্বর রুদ্র হয় আবার রুদ্রগণও হয়। আবার আপনাদের থিয়োসোফিক্যাল সোসাইটি নামক ম্লেচ্ছ খ্রিষ্টানদের দালাল দয়ানন্দ সরস্বতীও ইন্দ্র বলতে কখনো নিরাকার ঈশ্বর বুঝিয়েছেন আবার কখনো জীবাত্মা। 

 দয়ানন্দ সরস্বতী ও তার চ্যালা আর্যসমাজী আপনারা প্রতিমা শব্দের অর্থ কোনোভাবেই "তুলনা/উপমা" বলে স্বীকার করতে নারাজ। অথচ দয়ানন্দ সরস্বতীই যজুর্বেদের অধ্যায় ১৫/মন্ত্র নং ৬৫ -এর ভাষ্যে প্রতিমা শব্দের অর্থ (তুল্য) তুলনা লিখেছেন👇


তাহলে আমাদের সনাতনীদের কাছে স্থান কাল ভেদে প্রতিমা শব্দের অর্থ তুলনা আবার প্রতিমা কেন হবে না ? আপনাদের তথাকথিত মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীও একই কাজ করেছিলেন, তিনিও এক এক স্থানে প্রতিমা শব্দের অর্থ কোথাও প্রতিমাই রেখেছেন অন্য স্থানে প্রতিমা শব্দের অর্থ তুলনা বলেছেন, তাহলে তার উপরেও প্রশ্ন তোলা উচিত । নচেৎ এটা তো আপনাদের ভণ্ডামি বলে প্রমাণিত ।


বেদ শাস্ত্রে ঈশ্বরের প্রতিমা নেই বলে দাবী করলে বেদের অন্য মন্ত্রের সাথে তার বিরোধ ঘটে। আমরা জানি যে, বেদ শাস্ত্রে কখনোই পরস্পর স্ববিরোধী মন্তব্য থাকতে পারেনা, তাই যেহেতু বেদে ঈশ্বরের প্রতিমার উল্লেখ রয়েছে, তাই যজুর্বেদে উক্ত ৩২ অধ্যায়ের ৩নং মন্ত্রের প্রতিমা শব্দটির অর্থ কখনোই প্রতিমা হিসেবেই গণ্য হবে না বরং উপমা অর্থ হিসেবে ই তা গণ্য হবে । ফলে বেদের মধ্যে স্ববিরোধী কথার‌ও কোনো আশঙ্কা থাকে না।


এবার আমরা তাদের বাকি জবাব গুলো দেবো, 

 

🚫আর্যসমাজী আক্ষেপ ১ :  যারা বলে পরমাত্মার উপমা নেই তারাই বরং ভুল বলে। কারণ পুরুষসূক্তসহ বেদের অসংখ্যস্থলে পরমাত্মার মহিমাকে বিভিন্ন উপমার সাহায্যে প্রকাশ করা হয়েছে৷

🔥 খণ্ডন : পরমাত্মার কোনো উপমা নেই বলার অর্থটাই আপনাদের মূঢ় মস্তিষ্কে ঢোকেনি, বেদে বিভিন্ন জায়গায় পরমেশ্বরের মহিমাকে উপমার সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে ঠিক‌ই কিন্তু পরমেশ্বরকে সেই উপমায় ব্যবহৃত কোনো বস্তুর সাথে সমান যশস্বী বলা হয়নি। বরং মহান উপমা বস্তুর দ্বারা সেই বস্তুর মাধ্যমে উদাহরণ হিসেবে পরমেশ্বরের মহানতার প্রকাশ করা হয়েছে মাত্র। 

যেমন - যদি বলা হয়, পরমেশ্বর হল সূর্যের আলোকের ন্যায় জ্ঞানস্বরূপ , অর্থাৎ এখানে সূর্যে আলো যেমন অন্ধকার বিদূরিত করে তেমনভাবেই পরমেশ্বর আমাদের জ্ঞান প্রদান করে আমাদের অবিদ্যা দূর করেন, এখানে কোথাও পরমেশ্বরের সমান সূর্য বলা হয়নি, বরং সূর্য যেমন প্রকাশ করছে আলো সেই পদ্ধতিকে রূপক অর্থে ব্যবহার করে পরমেশ্বরের জ্ঞান প্রকাশের কথা বলা হয়েছে।

যারা পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টান মতবাদী থিয়োসোফিক্যাল সোসাইটির দালাল দয়ানন্দ সরস্বতীর অন্ধভক্ত তারা তো মূঢ় মস্তিষ্কের হবেই। 

 

🚫 আর্যসমাজী আক্ষেপ ২ : যজুর্বেদ ৪০/৮ বলছে ঈশ্বর অকায়ম(সর্বপ্রকার শরীররহিত) - মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর ভাষ্যেও তিনি এটি বলেছেন

🔥 খণ্ডন : প্রথমত, দয়ানন্দ সরস্বতী তার ভাষ্যে কি বললো তা আমাদের মান্য নয়, কারণ তিনি নিজেই একজন মিথ্যাচারী বিভ্রান্তকারী ব্যক্তি, কেননা তিনি শিবমহাপুরাণের সমীক্ষার নামে ডাহা মিথ্যা কথা বলেছেন, প্রমাণ দেখুন 👇

দয়ানন্দ সরস্বতীর রচিত সত্যার্থপ্রকাশ পুস্তকে শিবপুরাণ সমীক্ষা নামক আপত্তির নিরসন



 

এবার বলি, সমগ্র সনাতনীদের কাছে পরমেশ্বর নিরাকার আর সাকার উভয়ভাবেই গণ্য হয়ে এসেছে চিরকাল। শাস্ত্রে পরমেশ্বরকে যেমন নিরাকার হিসেবে অকায়ম বলেছে ঠিক তেমনভাবে তাকে গিরিপর্বতবাসীও বলেছে, ধনুর্ধারী বলেছে, সহস্রশীর্ষ, সহস্র চরণ‌, বিশ্বরূপ, কপর্দী প্রভৃতি বলেছে । সুতরাং একটা বেদ মন্ত্র নিয়ে নিরাকার নিরাকার বলে চ্যাচামেচী করা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়।


🚫 আর্যসমাজী আক্ষেপ ৩ : আচার্য শঙ্করের ভাষ্য দেখুন, তিনিও বলছেন সেই আত্মা(পরমাত্মা) স্থুল, সূক্ষ্ম শরীর বিবর্জিত ।

🔥 খণ্ডন : আজকাল আচার্য শঙ্করকেও মান্য করা শুরু করলেন বুঝি ? 

তা আপনারা তো এটাও জানেন যে আদি শঙ্করাচার্য সাকার ও নিরাকার উভয় ই মান্য করতেন। 

তাহলে তার ভাষ্য থেকে শুধু নিরাকারবাদটা তুলে ধরলেন, সাকারবাদটা কোথায় গেল ? 

আমাদের শৈবদের কাছে পরমেশ্বর শিবের নিরাকার সত্ত্বাকে নির্দেশ করতে পরমশিব বলা হয়, সুতরাং আমরা নিরাকার অশরীরী পরমাত্মাকে অস্বীকার করিনা, কিন্তু তিনি যে দিব্যশরীর ধারণপূর্বক নিরাকার থেকে সাকাররূপে জটা ধারণ করেন, ধনুক ধারণ করেন, গিরিপর্বতে অবস্থান করেন - এটাও তো আমরা স্বীকার করি। 

আপনারা তো শ্রীমদ্ভগবদগীতা নিয়ে লাফালাফি করেন,

ভগবদ্গীতা তে বলছে 👇

 যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানম অধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥

পরিত্রাণায় হি সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥"
(ভগবদ্গীতা/৪/৭-৮)

অর্থ : হে ভারত (অর্জুন), যখনই ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, আমি(পরমাত্মা) সেই সময়ে দেহ ধারণপূর্বক অবতীর্ণ হই।


সুতরাং, এখানে পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে পরমাত্মা দেহ ধারণ করতেই পারেন, করেও থাকেন। এখন আর্যনামাজীরা প্যাচাল পাড়বে আর বলবে এখানে কৃষ্ণ আমি নিজেকে সৃজন করি বলতে জীবাত্মাকে বুঝিয়েছেন, অথচ, এই দয়ানন্দী ধূর্তরাই স্বীকার করেছে যে, ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ "আমি" বলতে পরমাত্মাকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু পরমাত্মা অবতীর্ণ হয়ে শরীর ধারণ করেন এই শ্লোকটাতে "আমি" শব্দের অর্থকে জীবাত্মা বলে চালিয়ে দিয়েছে আর্যসমাজীরা ।

পাঠকবৃন্দ! দেখুন আর্যমসমাজীদের গোঁজামিল আর ধূর্ততার দুঃসাহস....  যা ইচ্ছে তাই অর্থ বের করে এরা ।

কাল্পনিক ত্রৈতবাদ দিয়ে সমাজীরা এই শ্লোকের ব্যাখা করে যা অতিমাত্রায় হাস্যকর ও শিশুসুলভ দাবি। এই দর্শন অনায়াসে খণ্ডিত করা হয়েছে তাই এসব উটকো দর্শন দিয়ে কখনো শাস্ত্র বিচার হয় না।

পরমাত্মা শরীর ধারণ করেন সেটিই এখানে প্রমাণিত। হে নামাজীগণ.. আপনারা দয়ানন্দ সরস্বতীর মতোই একচোখা তাই আপনাদের বুদ্ধিও তার মতো ।


🚫 আর্যসমাজী আক্ষেপ ৪ : এবার তাহলে প্রশ্ন রইল, যার কোনো শরীরই নেই তাঁর মূর্তি বা প্রতিমা আপনারা কিভাবে তৈরি করবেন ? 

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদও বলছে, “তাঁর কোনও প্রতিরূপ বা প্রতিমা নেই”(৪/১৯) এবং “সনাতনের কোন রূপ নেই যা চক্ষুর গোচর হয়, দৃষ্টির দ্বারাও তাঁকে কেও দেখে না”(৪/২০)

ঈশ্বর সাকার রূপ ধারণ করলে তিনি আর সর্ব ব্যাপী থাকতে পারেন না তাই ঈশ্বর সাকার রূপ ধারণ করেন না, ঈশ্বর সাকার নন, এর কোনো প্রমাণ নেই। এমনকি 

শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৬/৯ বলছে সেই ঈশ্বরের কোনও লিঙ্গ অর্থাৎ চিহ্নবিশেষও নেই


🔥 খণ্ডন : যার কোনো শরীর নেই তার শরীর কে তৈরি করেছে ? 

আমরা তো পূজার জন্য প্রতিমা গড়ে পূজা করি মাত্র,  যার বিধান পুরাণ শাস্ত্রেই রয়েছে, মহাভারতেও অর্জুন পরমেশ্বর শিবের মাটির শিবলিঙ্গ গড়ে পূজা করেছিল। আপনারা এখন সেটাকে কিভাবে এড়িয়ে যাবেন ? প্রক্ষিপ্ত বলে ? ওটাই তো আপনাদের মুখস্ত বুলি....

তাছাড়া পরমেশ্বর দিব্যশরীর ধারণ করেন, সেই সাকার অবয়ব‌ই কল্পনা করে দেবপ্রতিমা গড়ে তার পূজা হয়। মাটি জল আকাশ বায়ু অগ্নি সবেতেই পরমেশ্বর অবস্থিত(শ্বে.উ/৪|২),  আরো দেখুন 👇

তদেবাগ্নিস্তদাদিত্যস্তদ্বায়ুস্তদু চন্দ্রমাঃ ।

তদেব শুক্রং তদ্ ব্রহ্ম তা আপঃ স প্রজাপতিঃ ॥ 

[তথ্যসূত্র : যজুর্বেদ/৩২/১]

অর্থ — সেই ঈশ্বর‌ই অগ্নি, তিনি আদিত্য রূপ, বায়ু, চন্দ্র সংসারের বীজ, প্রসিদ্ধ জল, প্রজাপতি আদিরূপ সেই ব্রহ্মের‌ই ।

 এগুলো তো আমরা তৈরি করিনি। এগুলো তো পরমেশ্বর সৃষ্ট, যদিও আপনারা আবার ত্রৈতবাদ নামক কাল্পনিক দর্শনে বিশ্বাসী। দেখে নিন সমগ্র বিশ্বের সৃষ্টি পরমেশ্বর থেকেই হয়েছে, প্রকৃতি অনাদি নয়। 

যতো জাতানি ভুবনানি বিশ্বা(শ্বে.উ/৪৪)

বিশ্বস্য স্রষ্টারমনেকরূপম(শ্বে.উ/৪|১৪)

রূপং রূপং প্রতিরূপো বভুব৷ অয়মত্মা ব্রহ্ম সর্ব্বানুভূঃ৷

অর্থাৎ তিনি প্রতি বস্তুর রূপ ধারণ করিয়াছেন ৷ এই আত্মাই ব্রহ্ম ৷ তিনি সর্ব্বগত ৷(বৃহদারণ্যক,উ ২|৫|১৯)


সুতরাং, কেন উপনিষদে বলা  ১/৬ নং শ্লোকের ভাবার্থ বৃহদারণ্যক উপনিষদ অনুসারে হল এই - স্বতন্ত্রভাবে জড়বস্তুই ঈশ্বর নয় বরং জড় বস্তুর রূপ ঈশ্বর ধারণ করেছেন তাই সেই জড়রূপ ধারণকারী জড়বস্তুর মধ্যে থাকা জড়বস্তুর কারণরূপ অদ্বিতীয় পরমেশ্বর কেই উপাসনা করা হয় । জড়বস্তুই স্বয়ং ব্রহ্ম একথা কোনো সনাতনীই বিশ্বাস করে না, তাই এই বোকা বোকা আরোপ করা বন্ধ করুন দয়ানন্দীগণ


 অজ্ঞ আর্যসমাজীরা দাবি করেছে যে, ঈশ্বর সাকার হলে নাকি তার সর্ব ব্যাপকত্ব খণ্ডন হয়ে যায়। আরে মূর্খ সমাজীরা একটু ভেবে দেখুন অগ্নি সর্বব্যাপী হয়েও এক‌ই সময়ে কোনো স্থানে দৃশ্যমান হয়ে জ্বলছে আবার কোনো স্থানে তা সুপ্ত অবস্থায় অদৃশ্য ভাবে নিহিত রয়েছে, তার মানে কি অগ্নি সর্বব্যাপী নয় ? 


 কাঠের মধ্যে অগ্নি অন্তর্নিহিত রয়েছে যতক্ষণ না তা আরেকটি কাঠের সাথে ঘর্ষণ করা না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত অগ্নি দৃশ্যমান হয় না, যখনই ঘর্ষণ করা হয় তখনই অগ্নি দৃশ্যমান হয়, কিন্তু যখন ঘর্ষণ করা হয়নি তখনও সেই কাঠের মধ্যে অগ্নি অন্তর্নিহিত ছিল, অর্থাৎ অগ্নি যদি কোনো স্থানে দৃশ্যমান হয়েও অন্য স্থানে অদৃশ্য হয়ে সর্বত্র বিরাজমান থাকতে পারে তবে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হয়ে সাকার কেন হতে পারবে না ? 

সর্বব্যাপী হয়েও পরমেশ্বর যক্ষরূপে দিব্য দেহ ধারণ করে সাকার হন , তা কেন উপনিষদেই শব্দপ্রমাণ সহ বলা হয়েছে , দেখুন 👇

তদ্বৈষাং বিজজ্ঞৌ তেভ্যো হ প্রাদুর্বভূব তন্ন ব্যজানত কিমিদং যক্ষমিতি ॥

(তথ্যসূত্র : কেন উপনিষদ/অধ্যায় ৩/২নং শ্লোক)

সরলার্থ: দেবতাদের মিথ্যা অভিমানের কথা জেনে তাঁদেরই কল্যাণার্থে তাঁদের সামনে স্বয়ং ব্রহ্ম আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই যক্ষরূপী দিব্যমূর্তি ব্রহ্মকে দেবতারা চিনতে পারলেন না। ।

এরপর ইন্দ্র যক্ষকে দেখে তার কাছে যেতেই পরমেশ্বর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তখন আকাশ মার্গ থেকে মাতা পার্বতী নেমে এলেন ।

আকাশ থেকে প্রকটিত হ‌ওয়া অলঙ্কারপরিহিত উমা অর্থাৎ পার্বতী মাতার কাছে যখন দেবতারা জানতে চাইলেন যে - কিমেতদ্ যক্ষমিতি (কেন উপনিষদ/৩|১১) অর্থাৎ ঐ যক্ষস্বরূপ ধারণকারী কে ?

তখন মাতা পার্বতী দেবী বললেন, 

সা ব্রহ্মেতি হোবাচ, ব্রহ্মণো বা এতদ্বিজয়ে মহীয়ধ্বমিতি ততো হৈব বিদাঞ্চকার ব্রহ্মেতি ৷৷ 

(কেন উপনিষদ/৪|১)

সরলার্থ: তিনি (উমা হৈমবতী) বললেন, 'উনি ব্রহ্ম। যে বিজয়ের জন্য তোমরা এত উল্লসিত হয়েছিলে, তা আসলে ব্রহ্মের জয়।' তখন ইন্দ্র জানতে পারলেন যে, ওই যক্ষমূর্তি আসলে ব্ৰহ্ম অর্থাৎ শিব ।


কি আর্যসমাজীগণ ! কি যবনেরা ! এবার বলুন, ব্রহ্ম যদি রূপ নাই ধারণ করতো তাহলে ইন্দ্র সেই ব্রহ্মকে কিভাবে দেখলো ?

(বিঃদ্রঃ— ব্রহ্মের প্রাদুর্ভাব হবার এই ঘটনাকে দয়ানন্দ মনগড়া যুক্তি দিয়ে এটিকে “আলঙ্কারিক যা যথার্থ নয়” বলে এড়িয়ে গেছেন মাত্র। তার কাছে আলঙ্কারিক বলে দাবি করবার কোনো শব্দ প্রমাণ তথা যুক্তি নেই। নামেই আলঙ্কারিক বলে এড়িয়ে গেছেন। আর অলংকার পরিহিতা স্ত্রীমূর্তি মাতা পার্বতীকে গুণবাচক ব্রহ্মবিদ্যা বলে সাকার স্ত্রী সত্ত্বার বিষয়টা ঘোরাতে না পেরে এড়িয়ে গেছেন মাত্র, দয়ানন্দ সরস্বতী আমাদের কি বোঝাবে ? আমরা ভালো করেই জানি যে মাতা পার্বতী পরমব্রহ্ম শিবের ব্রহ্মবিদ্যা, তাই দয়ানন্দের কথার অপেক্ষায় আমরা বসে নেই। শৈব অদ্বৈত দর্শন অনুসারে, শিবের অভিন্না বিমর্শ হল শক্তি, যা কাল্পনিক ত্রৈতবাদী দয়ানন্দ সরস্বতীর অনুসারীদের মাথায় ঢুকবে না।)

পরমব্রহ্ম নিজেই নিজের ইচ্ছায় রূপ ধারণ করেন আবার নিজের ইচ্ছায় পরমেশ্বর অদৃশ্য হন তা 'কেন উপনিষদ' পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে। 


প্রয়োজনে পরমব্রহ্ম নিজেই নিজের ইচ্ছায় রূপ ধারণ করে প্রাদুর্ভাব ঘটিয়ে সাকার হন । সেই পরমব্রহ্ম সম্পর্কে মা উমা অর্থাৎ পার্বতী দেবী ইন্দ্র তথা দেবতাদের বলেছেন যে ইনি অর্থাৎ শিব হল ব্রহ্ম ।


তৈত্তিরীয় আরণ্যকে পরমেশ্বর শিবের সাকার দিব্যদেহের বর্ণনা করে বলা হয়েছে 👇

নমো হিরণ্যবাহবে হিরণ্যবর্ণায় 

হিরণ্যরূপায় হিরণ্যপতয়ে অম্বিকাপতয় 

উমাপতয়ে পশুপতয়ে নমো নমঃ॥

( তৈত্তিরীয় আরণ্যক,১০ম প্রপাঠক, ২২ অনুবাক )

অর্থ — যার হিরণ্যবর্ণের অর্থাৎ সোনার মতো উজ্জ্বল বর্ণের আভাযুক্ত বাহু রয়েছে, যার দিব্যদেহের বর্ণ সোনার মতো উজ্জ্বল, যিনি সোনার মতো উজ্জ্বল রূপধারী, যিনি অম্বিকা অর্থাৎ শিবাদেবীর স্বামী, যিনি উমা অর্থাৎ পার্বতী দেবীর পতি সেই পশুপতি পরমেশ্বর শিবের প্রতি নমস্কার  । 

তাই আর্যসমাজীদের কট্টর নিরাকার বাদ এখানেও টিকলো না। তাই বেদে সাকার ব্রহ্মের প্রমাণ রয়েছে এটি নিঃসন্দেহে বোঝা যায়।


 আরো প্রমাণ লাগবে ? চলুন, আপনারা যেহেতু শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ টেনেছেন সেহেতু সেখান থেকে আপনাদের একটু সাকার ব্রহ্মের পরিচয় করাই।

আর্যনামাজীগণ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ৪নং অধ্যায়ের ১৯ আর ২০নং শ্লোক তুলে দিলেন কিন্তু তার অর্থ কি বোধগম্য করতে পেরেছেন আদৌও ?


১৯নং শ্লোকের ন তস্য প্রতিমা শব্দের বিশ্লেষণ উপরেই হয়ে গিয়েছে,তাই ২০নং শ্লোকের ব্যাখা জেনে নিন 👇

ন সংদৃশে তিষ্ঠতি রূপমস্য ন চক্ষুষা পশ্যতি কশ্চনৈনম্। হৃদা হৃদিস্থং মনসা য এনমেবং বিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি ॥২০

সরলার্থ : ইন্দ্রিয় দ্বারা সাধারণভাবে তার রূপ দেখা যায় না, সাধারণ চক্ষুর দ্বারা তিনি দৃষ্টিগোচর নন, তাকে যোগ দ্বারা হৃদয়ে হদয়স্থিত করলে সেই বিশুদ্ধ মনের দ্বারা তাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হন, এরফলে অমরত্ব লাভ হয় ।


দেখুন অবোধগণ, এখানে পরিষ্কারভাবেই বলা হয়েছে সাধারণ দৃষ্টিতে সেই পরমেশ্বরের ঐশ্বরীয় রূপ দেখা যায় না, শুদ্ধতা এলে তবেই তাকে দর্শন বা উপলব্ধি করা সম্ভব। 

শ্রীমদ্ভগবদগীতাতে ১১নং অধ্যায়ের ৮নং শ্লোকেই বলা হয়েছে অর্জুন সাধারণ দৃষ্টিতে পরমেশ্বরের রূপ দেখতে সমর্থ হননি, তিনি দিব্যচক্ষু লাভের পর‌ই সেই দিব্যরূপ দর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন

আর সেই দিব্যচক্ষু পাবার পরেই অর্জুন ব্রহ্মের প্রকাশিত সকল সাকার দেবতাদের দর্শন করেছিলেন, প্রমাণ দেখুন 👇

অর্জুন উবাচ

পশ্যামি দেবাংস্তব দেব দেহে

সর্বাংস্তথা ভূতবিশেষসঙ্ঘন।

ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনস্থ-

মূখীংশ্চ সর্বানুরগাংশ্চ দিব্যান্ ॥১৫

[তথ্যসূত্র : ভগবদ্গীতা/১১নং অধ্যায়]

অর্থ — অর্জুন বললেন, হে পরম দেব ! আপনার দেহে আমি সমস্ত দেবতা ও বহু ভূত সমগ্র, পদ্মাসনে অবস্থিত ব্রহ্মা ও ঈশান(রুদ্রদেব) সহ সমস্ত ঋষি এবং দিব্য সর্পদের দেখতে পাচ্ছি

আর্যসমাজীরা তো আজকাল ভগবদ্গীতা নিয়ে দিনরাত প্রচার করতে শুরু করেছে নিজেদের প্রচার প্রসারের জন্য, কিন্তু সেই ভগবদ্গীতার মধ্যেও পরিষ্কার করে উল্লেখ রয়েছে যে, ব্রহ্মা বা রুদ্র/ঈশান নিরাকার ঈশ্বরের গুণবাচক নাম নয় বরং তারা ব্রহ্মের সাকার ব্যক্তিবিশেষ হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে তাই শ্লোকের মধ্যে সেই ‘ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনস্থ’ অর্থাৎ ব্রহ্মা কমল আসনে বসে আছেন ও ভগবান ঈশানকেও বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে বলে ভগবদ্গীতার মধ্যেই স্বীকৃতি পেয়েছে, তাই অর্জুন সেটি ‘পশ্যামি’ অর্থাৎ দেখতেও পাচ্ছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

সুতরাং ভগবদ্গীতা ও উপনিষদের আগাগোড়া বিশ্লেষণের মাধ্যমে আপনাদের এই গুটি কয়েক উপনিষদের শ্লোক নিয়ে অর্ধসত্য প্রচার করাও ধরা পড়ে গেল।


শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের মধ্যেই ৪নং অধ্যায়ের ২১নং শ্লোকে পরমেশ্বর শিবের মুখের উল্লেখ পর্যন্ত রয়েছে - 

অজাত ইত্যেবং কশ্চিদ্ভীরুঃ প্রপদ্যতে।

রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্ ।।২১

🔥সরলার্থ: হে রুদ্র, তুমি জন্মরহিত। তাইতো মৃত্যুভয়ে ভীত মানুষ তোমার শরণ নেয়। তোমার দক্ষিণ(কল্যাণময়) মুখ আমার দিকে ফেরাও এবং সর্বদা আমাকে রক্ষা কর।

দেখুন, আর্যমসমাজী অগ্নিবিড়িখোরেরা - আপনারা যজুর্বেদের রুদ্রসূক্ততে থাকা পরমেশ্বর রুদ্রকে একজন পর্বতবাসী রাজা হিসেবে দেখানোর অপপ্রয়াস করেছিলেন, অথচ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেই সেই রুদ্রকে অজন্মা বলা হয়েছে, ব্রহ্ম ছাড়া আর কে অজন্মা ? 

কোন পর্বতবাসী রাজা অজন্মা ? একটু জানাবেন।

আর তার‌ই সাথে এখানে পরমেশ্বরের যে মুখ রয়েছে, তার যে দিব্য দেহ রয়েছে তা বারংবার প্রমাণিত হয়েছে।

সেই সাকার পরমেশ্বর সর্বব্যাপী হয়েও গিরি পর্বত কৈলাসে অবস্থান করেন, তার প্রমাণ স্বয়ং বেদ দিচ্ছে, দেখে নিন 👇


সেই পরমেশ্বর রুদ্র গিরিপর্বতে অবস্থান করেন (শ্বে.উ/৩|৫/৬) 

প্রযতঃ প্রণবো নিত্যং পরমং পুরুষোত্তমম্ ।

ওঙ্কারং পরমাত্মনং তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু ॥২০

যো বৈ বেদাদিষু গায়ত্রী সর্বব্যাপীমহেশ্বরাৎ

তদ্বিরুক্তং তথাদ্বৈশ্যং তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু ॥২১

কৈলাসশিখরে রম্যে শংকরস্য শুভে গৃহে ।

দেবতাস্তত্র মোদন্তি তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত ॥২৪

[তথ্যসূত্র - ঋগ্বেদ সংহিতা / খিলানি / ৪ নং অধ্যায় / ১১ নং খিলা এবং শিবসংকল্প উপনিষদ]


এখন বেদের মধ্যে সাকার পরমেশ্বর শিবের প্রমাণ দেখে বেদের খিলা সূক্তকে নিশ্চয়‌ই প্রক্ষিপ্ত বলে পিঠ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠবে আর্যসমাজী গণ 😆😂


শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ৬/৯ শ্লোকে লিঙ্গ বলতে স্থান কাল পাত্র ভেদে - পুরুষ ও নারীর কথা ইঙ্গিত করা হয়েছে, অর্থাৎ পরমেশ্বরের নিরাকার সত্ত্বা কোনো লিঙ্গসম্পর্কিত নন, অর্থাৎ তিনি পুংলিঙ্গ স্ত্রীলিঙ্গ ক্লীবলিঙ্গ নন। 

পরমেশ্বরের অবশ্যই প্রতিক চিহ্ন হয়, আর সেটির প্রমাণ হিসেবে,

  পরমেশ্বরের শিবলিঙ্গের উল্লেখ বেদের আরণ্যকভাগে রয়েছে। এমনকি সেখানে লিঙ্গ রূপী পরমেশ্বরের প্রতিমাকে স্থাপন করবার জন্য নির্দেশ দেয়া রয়েছে দেখে নিন 👇

শিবায় নমঃ | শিবলিঙ্গায় নমঃ | 

জ্বলায় নমঃ | জ্বললিঙ্গায় নমঃ | 

আত্মায় নমঃ |আত্মলিঙ্গায় নমঃ | 

পরমায় নমঃ | পরমলিঙ্গায় নমঃ | 

এতৎসোমস্য সূর্যস্য

সর্বলিঙ্গং স্থাপয়তি পাণিমন্ত্রং পবিত্রম্ | 


[তথ্যসূত্র — কৃষ্ণ যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক/

১০ম প্রপাঠক/১৬ নং অনুবাক/২নং সূক্ত]


আর্যসমাজের গুরু দয়ানন্দ সরস্বতী তার সত্যার্থ প্রকাশের প্রথম সমুল্লাসে সমস্ত দেবতার নামকে এক পরমেশ্বরের গুণবাচক নাম হিসেবে দেখাতে গিয়ে শৈবদের মান্য কৈবল্য উপনিষদের শ্লোক টেনে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন।

Satyartha Prakash Khandan
সত্যার্থ প্রকাশের ১ম সমুল্লাসে কৈবল্য উপনিষদকে প্রামাণ্য ধরেছেন দয়ানন্দ 

 

তাহলে দয়ানন্দ সরস্বতী নিশ্চয়‌ই ১০৮ উপনিষদের মধ্যে থাকা কৈবল্য উপনিষদকে মান্য ও প্রামাণিক শাস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাই না ?

 সেই কৈবল্য উপনিষদের ৭নং শ্লোক থেকে পরমব্রহ্মের সাকার হবার পরিষ্কার বর্ণনা দেখে নিন 👇

তমাদিমধ্যান্তবিহীনমেকং বিভুং চিদানন্দমরূপমদভুতম্।

তথাদিউমাসহাযং পরমেশ্বরং প্রভুং ত্রিলোচনং নীলকণ্ঠং প্রশান্তম্।

ধ্যাত্বা মুনির্গচ্ছতি ভূতযোনিং সমস্তসাক্ষিং তমসঃ পরস্তাৎ  ॥৭॥


অর্থ — এইভাবে যিনি অচিন্ত্য, অব্যক্ত তথা অনন্তরূপে যুক্ত, কল্যাণকারী, শান্ত-চিত্ত, অমৃত, যিনি নিখিল ব্রহ্মান্ডের মূল কারণ, যার আদি, মধ্য এবং অন্ত নেই, যিনি অনুপম, বিভু(বিরাট্) এবং চিদানন্দ স্বরূপ, অরূপ এবং অদ্ভুত, এভাবে সেই উমা সহিত পরমেশ্বরকে , সম্পূর্ণ চর-অচরের পালনকর্তাকে, শান্তস্বরূপ, ত্রিনেত্র স্বরূপ, নীলকণ্ঠকে যিনি সমস্ত ভূত সমূহ তথা প্রাণীদের মূল কারণ, সবকিছুর সাক্ষী এবং অবিদ্যা রহিত প্রকাশিত হচ্ছে, এভাবে সেই(প্রকাশপুঞ্জ পরমাত্মা) কে যোগীজন ধ্যানের মাধ্যমে গ্ৰহণ করেন ॥৭

 

 কৈবল্য উপনিষদের শ্লোক থেকে পরিষ্কার ভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে পরমেশ্বর শিবের সাথে উমা অর্থাৎ মাতা পার্বতী রয়েছেন, শিবের ত্রিনেত্র, কণ্ঠ নীল বর্ণের ।


এছাড়াও মহাভারত থেকে প্রমাণ দিলাম মাটি দিয়ে শিবপ্রতিমা বিগ্রহ তৈরি করে তাতে ফুলের মালা পরিয়ে পূজা করবার 👇

শরণ্যং শরণং গত্বা ভগবন্তং পিনাকিনম্ ।

মৃন্ময়ং স্থণ্ডিলং কৃত্বা মাল্যোনাপূজয়দ্ভবম্ ॥৬৫

[তথ্যসূত্র — মহাভারত/বনপর্ব/৩৫ অধ্যায়]

অর্থ —পিনাকধনুক ধারণকারী শরণাগতরক্ষক ভগবান  মহাদেবের শরণাপন্ন হয়ে, স্থণ্ডিলের উপরে শিবের মৃন্ময়(মাটির) প্রতিমা বানিয়ে মালা দ্বারা শিব প্রতিমার পূজা করলেন ‌।


কি হে... ! অসনাতনী ম্লেচ্ছ রা.... ! এবার বুঝলেন তো যে বেদ অনুযায়ী পরমেশ্বর সাকার হন কি না ? তার প্রতিমা আছে কি না ? 

সেই প্রতিমা স্থাপন করার মন্ত্র আছ কি না ? 


আশা করি, এখন আর্যসমাজীরা পাগল সারমেয় নন্দনের মতো চ্যাচানোর স্বভাব এবার বদলে ফেলবে। নচেৎ এরপর এর চেয়ে আরো দশগুণ কড়া ডোজ আসবে ।


পবিত্র বেদে পরমেশ্বরের প্রতিমার উল্লেখ রয়েছে, পরমেশ্বর সাকার ও নিরাকার উভয়‌ই । প্রতিমারূপী শিবলিঙ্গ স্থাপনার মন্ত্র বেদের আরণ্যক অংশে রয়েছে। 

তাই বেদে সাকার ব্রহ্মের প্রমাণ নেই বলাও ভুল, পরমেশ্বর সাকার হতে পারেন না এটাও ভুল কথা, বেদে প্রতিমা পূজার জন্য প্রতিমা স্থাপনের মন্ত্র নেই বলাও সম্পূর্ণ ভুল ও অজ্ঞতাপূর্ণ দাবি মাত্র আর্যসমাজীদের তথা যবনদের ।

যবনেরা আর্যসমাজীদের বোকা বোকা যুক্তি গুলো নিয়ে খুব লাফালাফি করে, তাদের যুক্তিও খণ্ডিত হয়ে গেল একত্রে । 


অসনাতনী তথা আর্যমসমাজী দমনে : শ্রীনন্দীনাথ শৈব জী 

বিশেষ ধন্যবাদ - শ্রীমতি রৌদ্রী নাথ শৈব

কপিরাইট ও প্রচারে - International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT


হর হর মহাদেব

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমবার ব্রত বিধি ও মাহাত্ম্য (শৈবপুরাণোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ১ (মূলপূজা)

বৃহৎ শিবার্চন বিধি পুস্তক (শৈব আগমোক্ত)

শিবরাত্রির ব্রত বিধি ২ (প্রহরপূজা)

ত্রিপু্রোৎসব দীপপ্রজ্জ্বলন রীতি – স্কন্দমহাপুরাণোক্ত