ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন — “মহাদেব সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ তত্ত্ব জানতে সক্ষম নন” বলে নিজেরই পরমত্বকে খণ্ডন করেছেন
নমঃ শিবায়
বর্তমান সময়ে শিবভক্তদের উদারতার সুযোগ নিয়ে বৈষ্ণবেরা কৃষ্ণ পরমত্বকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য যেন সকল রকম অপপ্রয়াস করছে, অপপ্রচারে কোনো কমতি রাখে না বৈষ্ণবেরা ।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ হল বৈষ্ণবদের প্রাণপ্রিয় পুরাণ, যেখানে শ্রীকৃষ্ণকেই পরমেশ্বর বলে স্বীকার করা হয়েছে। এই পুরাণের দোহাই দিয়ে নিজেদের আরাধ্যকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করতে থাকে। আর বলতে থাকে যে কৃষ্ণ থেকে শিব উৎপন্ন হয়েছে।
হ্যাঁ এটা ঠিক যে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ কে পরম তত্ত্বের পরাকাষ্ঠা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সত্য কখনোই চাপা থাকে না, তাই সেই পুরাণের মধ্যেও শ্রীকৃষ্ণ পরম ব্রহ্ম হিসেবে বাচিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে সর্বজ্ঞ নন, অর্থাৎ তিনি সমস্ত কিছুর জ্ঞাতা নন, এটি তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন।
দেখুন 👇
শ্ৰীকৃষ্ণ উবাচ -
ব্রহ্মনঃ পতনে নাপি শূলপানেঃ ক্ষয়ো ভবেৎ ।
তস্মাদ্ আয়ুষঃ প্রমাণশ্চ ন অহং জানামি কা শ্ৰুতিঃ ॥১০৬
(তথ্যসূত্র — ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ/শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড/৩৬ অধ্যায়)
✅ অর্থ — শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধাকে বললেন,,
ব্রহ্মার পতন (নাশ) হলেও, কদাপি শূলপাণি ভগবান শঙ্কর (রুদ্র স্বরূপ) নাশপ্রাপ্ত (ক্ষয়) হন না ।
তার আয়ুর ধারণা স্বয়ং আমারই অজ্ঞাত, আমি নিজেই জানি না তার আদি সম্পর্কে তাহলে শ্রুতিশাস্ত্র বেদ কিভাবে সেই অবিনশ্বর ভগবান শঙ্করের সম্বন্ধে জানবে আর কিভাবেই বা তার সম্পূর্ন তত্ত্ব সম্পর্কে বলাবার প্রমাণ হতে পারে?
কি হে কলির বৈষ্ণবেরা !
আপনাদের মস্তিষ্কে যদি বুদ্ধি থাকে তাহলে বলুন, শ্রীকৃষ্ণ যদি পরমেশ্বর হয়ে থাকেন, শ্রী কৃষ্ণ যদি সত্যিই প্রভু শিবকে উৎপন্ন করে থাকেন তাহলে শ্রীকৃষ্ণ প্রভু মহাদেবের আয়ুর প্রমাণ সম্পর্কে অজ্ঞ কেন ?
পরমেশ্বরের কি কোনো কোনো কিছু অজানা থাকে ?
পরমেশ্বর কি নিজের উৎপন্ন করা জিনিসের সম্পর্কে অনভিজ্ঞ থাকেন ?
🔶 একইভাবে বৈষ্ণবদের প্রাণপ্রিয় তথাকথিত সাত্ত্বিক বৈষ্ণবপুরাণ পদ্মপুরাণে শ্রীবিষ্ণু বলছেন,
হরিরুবাচ —
ন শক্তিং ভস্মনো জানে প্রভাবং তে কুতো বিভো।
নমস্তেহস্তু নমস্তেহস্তু ত্বামেব শরণং গতঃ ॥ ২৩৮
[তথ্যসূত্র — পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/অধ্যায়-৬৪]
✅ অর্থ — হরি বলিলেন, হে প্রভো ! আমি বিষ্ণু আপনার ভস্মেরই মহিমা জানি না, আপনার(শিবের) মহিমা কিরূপে জানবো ? (আপনাকে আর অধিক কি বলিব) আপনারই শরণাপন্ন হইলাম ॥ ২৩৮
👉তাহলে এখানে বিষ্ণু নিজ মুখেই স্বীকার করে নিয়ে বলছেন যে, বিষ্ণু ভস্মের মহিমা জানেন না, শিবের মহিমা জানা তো দূরের কথা।
সুতরাং শ্রীবিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণ কেহই সকল কিছু জানতে সক্ষম নন। আর এটি বৈষ্ণবদের ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও প্রাণপ্রিয় সাত্ত্বিক পদ্মপুরাণ বলছে। তারা যে সর্বজ্ঞ নন, বরং অসর্বজ্ঞ , তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট ।
🔷 চলুন, এবার দেখে নিই...যিনি প্রকৃত পক্ষে ঈশ্বর, সেই ঈশ্বরের লক্ষণ কেমন হবে তা দেখে নেওয়া যাক।
পাতঞ্জল যোগ দর্শনে — ঈশ্বরের লক্ষণ কেমন তা সম্পর্কে বলা হয়েছে —
“ক্লেশকৰ্ম্মবিপাকাশয়ৈর পরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ”
[তথ্যসূত্র — পাতঞ্জলদর্শন যোগসূত্র/১/২৪]
✅ অর্থ — ক্লেশ, কৰ্ম্ম, বিপাক তাকে স্পর্শ করতে পারে না। যাবস্ত সংসারী আত্মা ও যাবস্ত মুক্তাত্মা হতে যিনি পৃথক বা স্বতন্ত্র, তিনি ঈশ্বর।
"তত্র নিরতিশয়ং সর্ব্বজ্ঞত্ববীজম্ ॥"
[তথ্যসূত্র — পাতঞ্জলদর্শন যোগসূত্র/১/২৫]
✅ অর্থ — ঈশ্বরের নিরতিশয় জ্ঞান থাকায় তিনি সর্ব্বজ্ঞ, অর্থাৎ তাঁহাতে সর্ব্বজ্ঞতার অনুমাপক পরিপূর্ণ জ্ঞানশক্তি বিদ্যমান আছে। অন্য আত্মায়(জীবাত্মায়) তাহা নাই।
তাহলে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, যিনি প্রকৃত ঈশ্বর হবেন তিনি সবকিছুই জ্ঞাত থাকেন, তার কাছে কোনো কিছুই অজানা নয়। তার কাছ থেকে কোন কিছু লুকানো সম্ভব নয়।
অথচ শ্রীকৃষ্ণ নিজে মুখে শ্রী রাধার কাছে স্বীকার করেছেন যে, শ্রীকৃষ্ণ মহেশ্বর এর আয়ু সম্পর্কে অবগত নন।
সুতরাং, বৈষ্ণবদের প্রাণপ্রিয় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারেই প্রমাণিত হলো যে শ্রীকৃষ্ণ কোনভাবেই পরমেশ্বর নন। কারণ, ঈশ্বরের যে সর্বজ্ঞতার লক্ষণ তার মধ্যে থাকার কথা তা শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে নেই।
সুতরাং শ্রীকৃষ্ণ যে পরমেশ্বর নন তা প্রমাণিত।
চলুন এবার দেখা যাক, সর্বজ্ঞ ঈশ্বর কে ❓
ঈশ্বরের লক্ষণ হিসেবে বলা উক্ত লক্ষণগুলি যার মধ্যে আমরা দেখতে পাবো, তিনিই হলেন সনাতন ধর্মের একমাত্র পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর।
শিব মহাপুরাণের বিদ্যেশ্বর সংহিতার ১৮ তম অধ্যায়ের ১১নং শ্লোকে বলা হয়েছে 👇
শিব এব হি সর্বজ্ঞঃ পরিপূর্ণশ্চ নিঃস্পৃহ ॥১১
সর্বজ্ঞতা তৃপ্তিরনাদিবোধঃ স্বতন্ত্রতা নিত্যমলুপ্তশক্তিঃ ।
অনন্তশক্তিশ্চ মহেশ্বরস্য যন্মানসৈশ্চর্যমবৈতি বেদঃ ॥১২
(শিব মহাপুরাণ/বিদ্যেশ্বর সংহিতা/১৮ অধ্যায়)
অর্থ — শিব ই সর্বজ্ঞ, পরিপূর্ণ তথা নিঃস্পৃহ ॥১১
সর্বজ্ঞতা, তৃপ্তি, অনাদিবোধ, স্বতন্ত্রতা, নিত্য অনুপ্ত শক্তি দ্বারা সংযুক্ত হওয়া এবং নিজের মধ্যে অনন্ত শক্তি ধারণ করা- মহেশ্বরের এই ছয় প্রকার মানসিক ঐশ্বর্য কেবল বেদ ই জানে ॥১২
তাহলে প্রমাণিত হয়ে গেল যে, পরমেশ্বর শিবই একমাত্র সর্বজ্ঞ, পরিপূর্ণ, নিঃস্পৃহ অর্থাৎ ক্লেশ, কৰ্ম্ম, বিপাক তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
আবার দেখুন, পরমেশ্বর শিব নিজেই ব্রহ্মাকে বলছেন যে, প্রভু শিবের কাছে কোনো কিছুই অজানা থাকে না ।
প্রমাণ 👇
ত্বং বেৎসি শংকরেণৈতৎকর্ম জ্ঞাতং ন কিঞ্চন ।
ত্রৈলোক্যেঽপি ন মে অজ্ঞাতং গূঢ়ং তস্মাৎ কথং বিধে ॥ ৩২
[তথ্যসূত্র — শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সতীখণ্ড/অধ্যায় ১৯/শ্লোক ৩২]
✅ অর্থ — হে বিধে-ব্রহ্মা ! তুমি কি ভেবেছো আমি(শিব) কিছু জ্ঞাত নই ? ত্রিলোকের কোথাও কোনোকিছুই আমার(অর্থাৎ শিবের) অজ্ঞাত নয়। আমি(শিব) সকল কিছুই জ্ঞাত ॥ ৩২
— ওহে কলির শিবনিন্দুক বৈষ্ণবেরা দেখুন, প্রভু শিব বলছেন যে, তিনি সকল কিছুই জানেন, তার কাছে কোনো কিছুই অজানা নয়। শিব সর্বজ্ঞ তা পরমেশ্বর শিব নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন।
এবার অন্তিম প্রমাণ মহাভারত থেকে দেখাচ্ছি 👇
স বৈ রুদ্রঃ স চ শিবঃ সোঽগ্নিঃ সৰ্ব্বঃ স সবজিৎ
স চৈবেন্দ্রশ্চ বায়ুশ্চ সোঽশ্বিনৌ স চ বিদ্যুতঃ ॥ ৩৮
স চন্দ্রমাঃ স চ ঈশানঃ স সূর্য্যো বরুণশ্চ সঃ।
স কালঃ সোঽন্তকো মৃত্যুঃ স যমো রাত্র্যহানি চ ॥ ৩৯
মাসার্দ্ধমাসা ঋতবঃ সন্ধ্যে সংবৎসরশ্চ সঃ ।
স ধাতা স বিধাতা চ বিশ্বকৰ্ম্মা স সর্ববিৎ ॥ ৪০
নক্ষত্রাণি গ্রহাশ্চৈব দিশোহথ প্রদিশস্তথা ।
বিশ্বমূর্তিরমেয়াত্মা ভগবান্ পরমদ্যুতিঃ ॥ ৪১
[তথ্যসূত্র - মহাভারত/অনুশাসন পর্ব/অধ্যায় ১৩৮]
✅ অর্থ — তিনি রুদ্র, তিনি শিব, তিনি অগ্নি, তিনি সর্ব্ববিজয়ী সর্ব, তিনি ইস্ত্র, তিনি বায়ু, তিনি অশ্বিনীকুমারদ্বয় এবং তিনি বিদ্যুৎ ॥ ৩৮
তিনি চন্দ্র, তিনি ঈশান, তিনি সূর্য, তিনি বরুণ, তিনি কাল, তিনি অন্তক, মৃত্যু ও যম এবং তিনি দিন ও রাত্রি ॥ ৩৯
তিনি মাস, পক্ষ, ঋতু, সন্ধ্যা ও সংবৎসর, তিনি ধাতা, তিনি বিধাতা, তিনি বিশ্বকৰ্ম্মা, তিনি সৰ্বজ্ঞ ॥ ৪০
অজ্ঞেয়স্বরূপ ও মহাতেজা ভগবান্ মহাদেব নক্ষত্র, গ্রহ, দিক্, বিদিক্ ও বিশ্বরূপ ॥৪১
সুতরাং, একমাত্র প্রভু শিবের সাথেই ঈশ্বরের লক্ষণ মিলে গিয়েছে। এরফলে আমরা জানতে পারলাম যে,
পরমেশ্বর শিব হলেন একমাত্র সর্বজ্ঞ, অর্থাৎ তিনি সবকিছুই জানেন, তার কাছ থেকে কোনো কিছু গুপ্ত রাখা যায় না, তার কোনো কিছুই অজানা নয়। কারণ তিনিই একমাত্র পরমেশ্বর। শ্রীকৃষ্ণ সর্বজ্ঞ নন, তাই তার সাথে ঈশ্বরের লক্ষণ মেলেনি। শ্রীকৃষ্ণ যে সবকিছুর জ্ঞাতা নন একথা তিনি নিজের মুখে স্বীকার করেছেন। তাই তিনি পরমেশ্বর নন।
এবার বুঝলেন তো শ্রীকৃষ্ণ কেন পরমেশ্বর শিবের আয়ুর পরিমাণ সম্পর্কে জানতে সক্ষম নন ?
বা শ্রীবিষ্ণু কেন পরমেশ্বর শিবের সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে জানতে অক্ষম ?
কারণ, পরমেশ্বর শিব মন ও বাক্যের অতীত, ভাবনারও অতীত তিনি। তার না আছে জন্ম আর না আছে মৃত্যু, তিনি স্বয়ং মৃত্যুঞ্জয় ত্রয়ম্বক ।
🔸 বিস্তারিত এখানে দেখুন 👇 প্রভু শিবের জন্মমৃত্যু নেই, বিষ্ণু সহ অন্যান্য দেবতারা জন্মমৃত্যুর অধীন
প্রভু শিবের আয়ু গণনা করবার ক্ষমতা কারোরই নেই। কারণ প্রভু শিবের না আছে আদি আর না অন্ত । তিনি আদি-অন্তরহিত। আর এই লক্ষণ একমাত্র পরমেশ্বর যিনি হন, তারই থাকে। যিনি পরমেশ্বর নন, শুধু পরমেশ্বরের কৃপায় মাত্র পরমেশ্বর উপাধিতে সম্মানিত হন কল্পান্তরে , তারা সকলেই পাশবদ্ধ জীবমাত্র। সেই পাশবদ্ধ জীবেদের পতি হলেন একমাত্র পশুপতি শিব ।
আগেও বারংবার বিভিন্ন নিবন্ধ লেখবার সময় বলেছিলাম যে, সব পুরাণই প্রভু শিবেরই পরমত্বকে ইঙ্গিত করে, শৈবপুরাণগুলি সরাসরি প্রত্যক্ষভাবে প্রভু শিবেরই পরমত্ব স্বীকার করে, আর বৈষ্ণব পুরাণ গুলি তথা অন্যান্য পুরাণ গুলি পরোক্ষভাবে গুপ্তভাবে আকার ইঙ্গিতের মাধ্যমে প্রভু শিবেরই পরমত্বকে স্বীকার করেন।
যাদের শাস্ত্র জ্ঞান নেই, যারা মীমাংসা করতে অপারগ, যাদের বিচার বুদ্ধিতে পরমেশ্বর কৃপার শক্তি বর্ষিত হয়নি সেইসব আকাট-মূর্খরাই পুরাণ শাস্ত্রের অন্তর্নিহিত অর্থ ও ইঙ্গিত কে বুঝতে পারে না।
কোনো বৈষ্ণবের যদি পাণ্ডিত্যে এতটুকু জোর থাকে তবে এই কঠিন সত্য কে খণ্ডন করে দেখাক।
বৈষ্ণবদের বৈষ্ণবীয় শাস্ত্র ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ থেকেই শ্রীকৃষ্ণের পরমত্ব খণ্ডনপর্ব সম্পূর্ণ হল ।
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
✍️ সত্য উন্মোচনে — শ্রী নন্দীনাথ শৈবাচার্য
©️ কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন