শ্রীকৃষ্ণ কেন পরস্ত্রী দের প্রতি কামার্ত হয়ে কামবাসনায় লিপ্ত হতেন ? — জানুন সেই কঠিন সত্য রহস্য




॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥

বর্তমানের এই কলিকালে শ্রীকৃষ্ণ কে সনাতন ধর্মের একমাত্র পরমেশ্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর হয়ে উঠেছে তথাকথিত বৈষ্ণবেরা । ছলে, বলে, কলে, কৌশলে যেনতেন প্রকারে শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর বানাতে উঠে পড়ে লেগেছে । কিন্তু যেখানে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই নিজেকে পরমেশ্বর ভেবে চরম বিপদে পড়েছিলেন, সেই নিজের করা ভুল সম্পর্কে জেনে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে পরমেশ্বর ভাবা ত্যাগ করেছিলেন, অথচ আজকালকার কলিযুগের কলির চরেরা নিজেদের মনমতো শ্রীকৃষ্ণ কে জোরপূর্বক সমাজের সামনে পরমেশ্বর বলে ঘোষণা করে চলেছে, বহু মানুষ এদের এই অপপ্রচারের ফাঁদে পড়ে শ্রীকৃষ্ণ কে পরমেশ্বর বলে মেনে নিতে শুরু করেছে। বর্তমানে ‘শ্রীকৃষ্ণ ই সনাতন ধর্মের একমাত্র পরমেশ্বর’ এমন গুজব সনাতনীদের অনেকেই মানতে শুরু করেছেন।

এর ফলে হয়েছে আরেক বিপদ। মুসলমানেরা, খ্রিষ্টানেরা, বৌদ্ধরা, নাস্তিকেরা, আর্যসমাজী নামক পাষণ্ডরা সনাতনী দের প্রশ্ন করবার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। এই সব সনাতনধর্ম বিরোধীদের প্রশ্ন হল — 

তোমাদের শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর হয়ে কেন রাধা থাকা সত্ত্বেও রাধার কাছ থেকে লুকিয়ে তিনি একের পর এক গোপী নারীদের সাথে সঙ্গম করতেন ? শ্রীকৃষ্ণ এত কামুক কেন ছিলেন ? তিনি যার তার সাথেই শারীরিক মিলনে লিপ্ত হয়ে যেতেন । এ কেমন পরমেশ্বর যিনি নিজেই কামনার বশীভূত । এসব আপনাদের ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে লেখা আছে, সুতরাং অস্বীকার করবার উপায় নেই আপনাদের।


এর উত্তরে, বৈষ্ণবেরা বলেন, শ্রীরাধার অংশ হলেন গোপী নারীগণ, রাধা পূর্ণ আর গোপীরা আর অংশমাত্র ।তাই শ্রীকৃষ্ণ তার স্ত্রী রাধার অংশ গোপীদের সহিত মিলিত হয়েছেন এতে কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয় । কারণ, সব‌ই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী, অন্য কেউ নয় । তাই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কলঙ্কহীন ।


বৈষ্ণবদের একথার উত্তরে অসনাতনীরা পুনরায় প্রশ্ন তুলে বলেন —

 শ্রীকৃষ্ণ যদি রাধার অংশদের সাথে সঙ্গম করতেন আর তা যদি অশ্লীলতা ও নোংরামি না হয়, তাহলে আপনাদের ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ কেন এটি বলছে যে, শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের সাথে শারীরিক মিলনে লিপ্ত হয়েছে শুনে শ্রীরাধা অত্যন্ত রেগে গিয়েছেন । যেখানে রাধা নিজেই শ্রীকৃষ্ণের এই কর্মকে মেনে নিতে পারেননি বরং তিনি শ্রীকৃষ্ণকে কামুক নারীলোলুপ লম্পট বলে গালমন্দ পর্যন্ত করেছেন, সেখানে আপনারা বৈষ্ণবেরা কোন যুক্তিতে গোপীদের রাধার অংশ বলে স্থির করে শ্রীকৃষ্ণের সাথে তাদের সঙ্গম করাকে সভ্য দৃষ্টিতে দেখাতে চাইছেন ?

শ্রীরাধার অংশ গোপীগণ - একথা তো রাধা জানতেন, তাহলে তিনি গোপীদের সাথে কৃষ্ণের সঙ্গম সম্পর্কে জানতে পেরে কেন রেগে গেলেন ? আর বৈষ্ণবদের দেওয়া যুক্তি অনুসারে, যদি শ্রীকৃষ্ণ রাধার অংশরূপী গোপীদের সাথে বারংবার শারীরিক মিলনকে তার স্ত্রী শ্রীরাধার সাথে সঙ্গম করা হয়েছে বলে চালিয়ে দিয়ে বৈধতা হিসেবে ধরা হয় তাহলে শ্রীরাধা নিজে কেন তা মেনে নিতে পারছিলেন না ?

তাছাড়া শ্রীকৃষ্ণ যখন পূর্ণ রাধাকেই স্ত্রী হিসেবে পেয়ে গিয়েছেন তাহলে অংশরূপী গোপীদের সহিত সঙ্গম করতে গেলেন কেন ?  পূর্ণ রাধা কি শ্রীকৃষ্ণের চাহিদা পূরণ করতে অক্ষম হয়েছেন ? নাকি অংশরূপী গোপীদের সহিত সঙ্গম করে শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণ রাধার সাথে করা সঙ্গমের চেয়েও বেশি পূর্ণাঙ্গ রমনের সুখ প্রাপ্ত করতেন ?

আপনাদের ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের মধ্যে তো পরিষ্কার করে বর্ণনা করা হয়েছে, শ্রীরাধা নিজে শ্রীকৃষ্ণের অন্য নারীর প্রতি কামুকতার বিভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে ধরে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাহলে বলুন রাধা কেন রেগে গেলেন ? আর শ্রীকৃষ্ণ তা শুনে ভয় আর লজ্জা পেয়ে গেলেন কেন ?

বলুন, আপনাদের পরমেশ্বর এত লম্পট, কামুক, ভীতু, লাজুক কেন ? 

 — উপরোক্ত অসনাতনীদের প্রশ্ন শুনে বৈষ্ণবদের আর উত্তর দেবার ক্ষমতা থাকে না, তখন তারা এই প্রসঙ্গে আর কোনো কথা না বলে পালিয়ে যায় ।

কারণ, বৈষ্ণবদের ক্ষমতা নেই প্রকৃত উত্তর দেবার। তারা সনাতন ধর্মের প্রকৃত সিদ্ধান্ত মানে না, নিজেদের মনগড়া কাল্পনিক ধারণা কে মেনে চলেন আর অন্যদেরও এটি মানাতে চায়। সব জায়গায় শ্রীকৃষ্ণ কে পরমেশ্বর বলে অপপ্রচার তো করে দেয়, কিন্তু যখন শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রের এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের কাহিনী গুলি সামনে তুলে ধরে কোনো মুসলিম বা অসনাতনী রা প্রশ্ন করে, তখন বৈষ্ণবদের সব জ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায়। কারণ, নকল জ্ঞান কখনোই সত্যের সন্ধান দিতে পারে না। তাই নকল জ্ঞানের পথে চলে কখনো টিকে থাকা যায় না। এই কারণেই, শ্রীকৃষ্ণ কে পরমেশ্বর বলে প্রচার করে বেড়ালেও, শ্রীকৃষ্ণ যে কেন রাধাকে ছেড়ে লুকিয়ে লুকিয়ে অন্য নারীদের সাথে সম্ভোগ করতেন, তার উত্তর বৈষ্ণবদের কাছে নেই।

কিন্তু আমরা আদি সনাতনী অর্থাৎ সনাতন ধর্মের এক ও অদ্বিতীয় ধারক ও বাহক - শৈব রা কখনোই অসনাতনী দের কাছে সনাতন ধর্মকে অবমাননা হতে দেবো না।

আমি শ্রী নন্দীনাথ শৈব — শাস্ত্র থেকে প্রমাণ তুলে ধরে সত্য প্রকাশের মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সম্মান ও সনাতন ধর্মের পরম মহিমান্বিত মর্যাদা রক্ষা করবো ।

________________________________________________

ISSGT সংগঠন শৈব মহাপাশুপত পরম্পরার ধারক ও বাহক, আমাদের শৈব সনাতন গুরুপরম্পরার পক্ষ থেকে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বর্ণিত ‘শ্রীকৃষ্ণের পরস্ত্রী গমন’-এর বিষয়ে শাস্ত্রে বর্ণিত তথ্য উপস্থাপন করে তা বিশ্লেষণ করে সনাতন ধর্মের পরমেশ্বর কে কলঙ্কহীন প্রমাণ করবো তথা শ্রীকৃষ্ণ কেন হঠাৎ ই শ্রীরাধিকাকে ছেড়ে অন্য নারীদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছেন সে বিষয়ে আলোকপাত করবো । 

ধৈর্য্য ধরে সম্পূর্ণ প্রবন্ধ টি ধীরে ধীরে শেষ পর্যন্ত পড়ুন ও নিরপেক্ষ ভাবে নিজের বিচার বিবেচনা কাজে লাগিয়ে ভাবুন, তবেই সত্য আপনি বুঝতে সক্ষম হবেন । যেটি সত্য সেটি গ্রহণ করুন ও মেনে চলুন। 


প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, 

ঘটনার সূত্রপাত —


শঙ্খচূড় অসুর আসলে কে ছিল, তার পরিচয় কি । এই বিষয়ে ভগবান ‘শ্রীনারায়ণ হরি’ গোলকে ঘটে যাওয়া পুরাতন কাহিনী সম্পর্কে প্রজাপতি ব্রহ্মা ও দেবতাদের অবগত করাচ্ছেন । ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের প্রকৃতিখণ্ডের ১৬ অধ্যায় -এর ১৮৫নং শ্লোক থেকে ১৯৫ নং শ্লোক পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে — 


[তথ্যসূত্র : ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ/প্রকৃতিখণ্ড/১৬ অধ্যায়]

ভগবান নারায়ণ বললেন, হে পদ্মজ! ব্রহ্মা ! শঙ্খচূড়ের বৃত্তান্ত আমি সমুদয় অবগত আছি; সে আমার পরম ভক্ত এবং পূর্বজন্মে সে মহাতেজস্বী গোপ ছিল। হে দেবগণ! তোমরা সকলে সেই পুরাতন গোলোকের ইতিহাস শ্রবণ করো, ইহা পাপনাশক ও পুণ্যপ্রদ। সেই শঙ্খচূড় পূর্বে আমার(কৃষ্ণ/বিষ্ণু/নারায়ণ) পার্ষদ-শ্রেষ্ঠ সুদামা নামে গোপ ছিল, রাধিকার দারুণ শাপে দানবী-যোনি প্রাপ্ত হয়েছে।

এক সময়ে আমি(কৃষ্ণ/বিষ্ণু/নারায়ণ) গোলোকধামে প্রাণাধিকা মানিনী রাধিকাকে পরিত্যাগ করে নিজ গৃহ হতে রাসমণ্ডলে গমন করেছিলাম। ১৮৪-১৮৮। অনন্তর রাধিকা, দাসীর মুখে আমাকে(কৃষ্ণকে) বিরজার সহিত ক্রীড়া(শারীরিক মিলন) করতে শুনে ক্রোধভরে সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে আমাকে দেখতে পেলেন, এবং তৎক্ষণাৎ বিরজাকে নদীরূপা এবং 'আমাকে তিরোহিত অর্থাৎ অন্তর্ধান হতে জেনে সক্রোধে সখীগণের সহিত পুনরায় গৃহে ফিরে এলেন। পরে দেবী রাধিকা, সেই স্থানে যৌনীভূত ও সুস্থির আমাকে সুদামার সহিত অবস্থিত দেখে, যথোচিত ভর্ৎসনা করেন। সুদামা, তাহা সহ্য করতে না পেরে রাধার প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করলে, রাধা ক্রুদ্ধা হয়ে আমার সামনেই সুদামাকে প্রচণ্ড তিরস্কার করলেন এবং সুদামাও রাধাকে প্রচণ্ড তিরস্কার  করলে রাধিকা তার উপর অতিশয় ক্রোধ করায়, তার চক্ষু দুটি তখন রক্ত পঙ্কজের ন্যায় শোভা ধারণ করেছিল। তিনি অতিশয় ব্যস্ত হয়ে আমার সভা হতে সুদামাকে বহিষ্কৃত করবার জন্য আজ্ঞা করলেন। আজ্ঞা করা মাত্র দুর্বার তেজস্বিনী লক্ষ সখী গাত্রোত্থানপূর্ব্বক বারংবার কটুভাষী সুদামাকে অতিশীঘ্র বহিষ্কৃত করে দিলেন। সেই সময়ে রাধিকা সুদামার কটূক্তিতে ক্রুদ্ধ হয়ে 'তুই দানবযোনি প্রাপ্ত হয়ে যাবি' বলে দারুণ অভিশাপ দিলেন ।


👁️ বিশেষ নজর : উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণ হল, শ্রী হরি নিজেই বলছেন যে পুরাতন এক সময়ে তিনি গোলোকে কৃষ্ণ হিসেবে থেকে রাধাকে ছেড়ে গোলোকের রাসমণ্ডলে গিয়ে বিরজা নামক এক গোপীর সাথে শারীরিক মিলনে লিপ্ত হয়ে যান। এই সব গোপনীয় বিষয় রাধার এক দাসী গিয়ে রাধাকে জানিয়ে দেন, তা শুনে রাধা ভীষনভাবে রেগে গিয়ে সেই স্থানে গিয়ে দেখেন যে শ্রীকৃষ্ণ ঐ সঙ্গমকার্যে রত রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ তা দেখে তখনই সেখান থেকে অন্তর্হিত হয়ে যান। 

কিন্তু এখানে প্রশ্ন হল, শ্রীকৃষ্ণ হঠাৎ ই রাধাকে পরিত্যাগ করে গোপীদের সাথে কেন মিলনে লিপ্ত হলেন ?

একথা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে ভগবান হরি বলেননি । শুধু মাত্র ‘তিনি রাধাকে ত্যাগ করে অন্য নারীর সহিত মিলিত হয়েছেন’ এতটুকুই উল্লেখ করে বলেছেন। কিন্তু কি কারণে এমনটা করেছেন তা শ্রী নারায়ণ উল্লেখ করেননি। তাই বৈষ্ণবদের কাছেও শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা  হওয়া এমন কার্যের কারণ অজানা। এর উত্তর আমরা প্রমাণ সহ দেবো পরবর্তীতে। তার আগে আরো দেখুন, শ্রীকৃষ্ণ গোলোকে থেকে রাধারানীর আড়ালে আরো কি কি করেছেন 👇


বৈষ্ণবদের প্রিয় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে, 

 তুলসী দেবী কি বলছেন , দেখুন —


[তথ্যসূত্র : ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ/প্রকৃতিখণ্ড/১৫ অধ্যায়]

আমি তুলসী, আমি পূর্বে গোলোকে গোপিকা ছিলাম; শ্রীকৃষ্ণের কিঙ্করী হয়ে, সর্বদা তার সেবা করতাম; আমি রাধার অংশসম্ভূতা এবং প্রিয়তমা সখী ছিলাম, এক সময়ে আমি রাসমণ্ডলে গোবিন্দ সহ ক্রীড়া কৌতুক ভোগ করত মূর্ছিত হয়ে পতিতা হয়েছিলাম; সেই সময়ে রাসেশ্বরী রাধিকা হঠাৎ সেই স্থানে আগমন করে, আমাকে সেই অবস্থায় দেখলেন। হে পিতামহ ! তখন তিনি অত্যন্ত ক্রোধে অন্ধা হয়ে, গোবিন্দকে বহু ভর্ৎসনা করলেন এবং আমাকে এই শাপ দিলেন, “পাপিষ্ঠে! তুই মনুষ্য-যোনিতে গমন কর।”


👁️ বিশেষ নজর : তুলসী দেবী নিজমুখে বলছেন যে, দেবী তুলসী  শ্রীরাধার সখী ছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ তাকে নিয়ে সঙ্গম করতে করতে মূর্ছিত করেন, তুলসী দেবী পড়ে যান। এ অবস্থায় শ্রীরাধা সেখানে উপস্থিত হয়ে এই ঘটনা নিজ চোখে দেখে ক্রোধে যেন অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন অর্থাৎ ক্রোধ চরম মাত্রায় পৌঁছেছিল তার। এর জন্য শ্রীকৃষ্ণকে চরম ভর্ৎসনা করেন শ্রীরাধা ও দেবী তুলসীকে অভিশাপ দেন।

কিন্তু এখানে আবার‌ও সেই এক‌ই প্রশ্ন হল, শ্রীকৃষ্ণ হঠাৎ ই শ্রীরাধাকে ছেড়ে তুলসীর সাথে কেন মিলনে লিপ্ত হলেন ?

এর কি কারণ তা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে দেবী তুলসী উল্লেখ করে বলেননি । শুধু মাত্র ‘এক সময়ে আমি রাসমণ্ডলে গোবিন্দ সহ ক্রীড়া কৌতুক ভোগ করত মূর্ছিত হয়ে পতিতা হয়েছিলাম’ এতটুকুই উল্লেখ করে বলেছেন। কিন্তু কি কারণে এমনটা করেছেন তা দেবী তুলসী উল্লেখ করেননি। তাই বৈষ্ণবদের কাছেও শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা হওয়া এমন কার্যের প্রকৃত কারণ কি তা অজানা রয়েছে । এর উত্তর আমরা প্রমাণ সহ দেবো পরবর্তীতে। তার আগে আরো দেখুন, রাধা স্বয়ং বলেছেন - শ্রীকৃষ্ণ গোলোকে থেকে রাধারানীর আড়ালে আরো কি কি করেছেন 👇


♦️ স্বয়ং শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণকে বলছেন —


[তথ্যসূত্র : ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ/প্রকৃতিখণ্ড/১১ অধ্যায়/৩১-৭৪শ্লোক]

তোমার মুখকমল বারংবার দেখতে দেখতে কামের বশবর্তী হয়ে আরক্তলোচনে তোমার পার্শ্বে অবস্থান করছে ঐ কল্যাণী নারী কে? তোমার রূপ দর্শন করে সে রোমাঞ্চিত দেহে মূর্ছিতপ্রায় হয়ে পড়ছে এবং বস্ত্রদ্বারা মুখ আচ্ছাদন করে তোমাকেই বারবার নিরীক্ষণ করছে। ৩১-৪১। তুমিও তাকে দর্শন করে সকাম ও সম্মিত হয়ে পড়েছো, কিন্তু আমি গোলোকে বিদ্যমান থাকা কালীন মুহূর্তেই তোমার দুর্বৃত্ততা হয়েছে, তুমি বার বার এইরূপ দুর্বৃত্ত্যাচরণ করেছো। কিন্তু আমি নারী হবার কারণে, আমার মন অতি সরল, অতএব তোমার প্রতি প্রেমের নিমিত্তেই তোমার সব অপরাধ ক্ষমা করে দিই। ওহে লম্পট! তুমি তোমার এই প্রিয় ভার্য্যা কে নিয়ে গোলোক হতে দূর হও। ব্রজেশ্বর! যদি তা না করো তবে আর কিছুতেই তোমার মঙ্গল হবে না ।

আমি দেখেছি, চন্দনকাননে তুমি বিরজার সহিত মিলিত হয়েছিলে, তা সত্ত্বেও সখীগণের বাক্যে ক্ষমা করেছি; তখন তুমি আমার আগমন-শব্দ শ্রবণ করামাত্র অন্তর্হিত হয়েছিলে এবং বিরজাও স্বদেহ পরিত্যাগ করত নদীরূপা হয়েছিল; সেই বিরজা কোটি যোজন বিস্তীর্ণা ও দৈর্ঘ্যে তাহার চতুর্গুণ; অদ্য পর্য্যন্তও তোমার সংকীর্ত্তিস্বরূপা হয়ে বিদ্যমান রয়েছে। বিরজা নদীরূপা হবার পর, আমি গৃহে গমন করলাম, তারপর তুমি তার কাছে গিয়ে 'বিরজা বিরজা' বলে উচ্চৈঃস্বরে রোদন করতে লাগলে; তখন সিদ্ধযোগিনী বিরজা অলঙ্কারমণ্ডিত মূর্তিধারণ করে জল হতে উঠে এসে তোমাকে দর্শন দিয়েছিল; তারপর তুমি তাকে আলিঙ্গন করে তার গর্ভে নিজের বীর্যপাত করে দিয়েছিলে। সেখান থেকেই সপ্ত সমুদ্রের উদ্ভব হয়। ৪২-৫০।

আমি এও দেখেছি যে, চম্পক কাননে তুমি শোভা নামের গোপিকার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলে, আমার আগমন-শব্দ শোনা মাত্রেই তৎক্ষণাৎ সে স্থান হতে অন্তর্হিত হলে, শোভাও দেহত্যাগ করত চন্দ্রমণ্ডলে গমন করল। তৎপরে তার শরীর স্নিগ্ধ তেজঃস্বরূপে পরিণত হল, তখন তুমি দগ্ধচিত্তে সেই তেজ বিভাগ করে কিঞ্চিৎ রত্বে, কিছু স্বর্ণে ও কিছু শ্রেষ্ঠ মণিতে প্রদান করলে এবং সেই তেজ কিছু স্ত্রীগণের মুখপদ্মে, কিছু উৎকৃষ্ট বস্ত্রে, কিছু রৌপ্যে, কিছু চন্দন-পন্ধে, কিছু জলসমূহে, কিছু পল্লবে, কিছু পুষ্পে, কিছু সুপক ফলে ও শক্ষ্যে এবং কিছু সংস্কৃত দেবগৃহে ও রাজপ্রাসাদে প্রদান করিয়াছ। 

 আমি দেখেছি বৃন্দাবনের বনের মধ্যে তুমি প্রভা নামের গোপিকার সহিত মিলিত হয়েছিলে, তুমি আমার আগমন শব্দ শোনা মাত্রেই অন্তর্হিত হলে, প্রভা দেহ ত্যাগ করত সূর্য্যমণ্ডলে গমন করল এবং তার শরীর তীক্ষ্ণ তেজরূপে পরিণত হইল, তখন তুমি সেই স্থানে গমন করে তার প্রেমে রোদন করতে করতে সেই তেজ স্ববক্ষে ধারণ করেছিলে। তৎপরে আমার লজ্জা ও ভয়ে  তুমি তা পরিত্যাগ করে বিভিন্ন- রূপে কিছু হুতাশনে, কিছু নৃপগণকে, কিছু পুরুষ- সমূহে, কিছু দেবতাদিগকে, কিছু দস্যুগণকে, কিছু নাগগণকে, কিছু ব্রাহ্মণদিগকে, কিছু মুনিগণকে, কিছু তপস্বীদিগকে, কিছু সৌভাগ্যশালিনা স্ত্রীদিগকে এবং কিছু যশস্বীগণকে প্রদান করেছো। এইরূপে তেজ বিভাগ করে প্রদান করে স্বয়ং রোদন করতে উদ্যত হয়েছিলে। ৫১-৬২।

 তুমি রাসমণ্ডলে শান্তি নামের গোপিকাসহ সুখমিলনে মিলিত হয়েছিলে; বসন্তকালে মনোহর মাল্যযুক্ত ও চন্দনচর্চ্চিত কলেবরে পুষ্পশয্যায় রত্নময়ভূষণে ভূষিত হয়ে, বিভিন্ন রত্নভূষণে বিভূষিতা সেই শান্তির সহিত রত্নপ্রদীপযুক্ত রত্নমন্দিরে বিহার করেছিলে। বিভো! সেই রমণীয়া শান্তি নামক গোপিকা তোমার প্রদত্ত তাম্বুল সাদরে ভক্ষণ করেছিল এবং তুমি তার দেওয়া তাম্বুল-বীটিকা সাদরে ভক্ষণ করেছিলে; তখন তুমি(কৃষ্ণ) আমার(রাধার) আগমনের শব্দ শ্রবণ করে তৎক্ষণাৎ অন্তর্হিত হলে, শান্তিও দেহত্যাগ করত তোমাতেই লীনা হল, তৎপরে তার শরীর শ্রেষ্ঠ-গুণরূপে পরিণত হল। তখন তুমি রোদন করতে করতে তার প্রেমে আবদ্ধ হয়ে সেই গুণরাশি বিভিন্নরূপে অনাসক্ত ব্যক্তিতে, সত্ত্বরূপ বিষ্ণুকে, শুদ্ধসত্বরূপিণী লক্ষ্মীকে, তোমার মন্ত্রোপাসক বৈষ্ণবদিগকে, তপস্বীদের, ধৰ্ম্মে ও ধর্ম্মিষ্ঠ ব্যক্তিদের কিছু কিছু করে প্রদান করেছো। 


আমি পূর্বে দেখেছি; তুমি সুবেশ করত মাল্য গন্ধ চন্দনাদি দ্বারা ভূষিত হয়ে চন্দনযুক্ত পুষ্পময় শয্যাতে গন্ধচন্দনচর্চ্চিতা এবং রত্নময় ভূষণে ভূষিতা ক্ষমা নামের গোপিকার সহিত মিলিত হয়ে সুখে মূর্ছিত হয়েছিলে এবং নূতন নূতন সঙ্গমের সুখে নিদ্রিতা সেই ক্ষমাও তোমাকে আলিঙ্গন করে নিদ্রায় মগ্ন হয়েছিল, তখন আমি তাকে এবং তোমাকে নিদ্রা হতে জাগরিত করিয়েছিলাম ।


👁️ বিশেষ নজর :

স্বয়ং রাধা প্রশ্ন তুলেছেন শ্রীকৃষ্ণের চরিত্র ও ব্যবহারের উপর, রেগে গিয়ে শ্রীরাধা নিজেই বলছেন যে, শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে ছেড়ে অন্য নারীকে দেখে ‘সকাম ও সম্মিত’ হয়ে পড়েন, এই চরিত্র কে শ্রী রাধা দুর্বৃত্ত আচরণ বলে আখ্যায়িত করেছেন, তিনি এটিকে অপরাধ বলেও চিহ্নিত করেছেন। এমনকি তিনি শ্রীকৃষ্ণকে ‘লম্পট’ বলেও মন্তব্য করে গোলোক থেকে বিতাড়িত করবার কথা বলেছেন ।

 বিরজা নামক নারীর সাথে শ্রীকৃষ্ণ মিলিত হয়েছিলেন রাধার আড়ালে, রাধার উপস্থিতিতে শ্রীকৃষ্ণ সাথে সাথে সেই স্থান ত্যাগ করেন আর রাধার ভয়ে বিরজা নদী হলে শ্রীকৃষ্ণ বিরজার প্রেমে বিরহে রোদন পর্যন্ত করেন, তখন নদী থেকে বিরজা উঠে এলে শ্রীকৃষ্ণ তার গর্ভে বীর্যপাত করেন। এই ঘটনাকে শ্রীরাধা নিজের অংশরূপী বিরজার সাথে ঘটেছে বলে বৈধতা প্রদান করেননি বরং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এরপর শ্রীরাধা বলেছেন, শোভা নামক গোপীর সাথেও এই এক‌ই ঘটনা ঘটিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ। তারপর প্রভা নামের গোপীর সাথেও এই ঘটনা ঘটিয়েছেন, রাধার উপস্থিতিতে শ্রীকৃষ্ণ তখন লজ্জায় পড়েন ও ভয় পান বলেও রাধা উল্লেখ করেছেন। শান্তি নামের আরেকজন গোপীর সাথে শ্রীকৃষ্ণ এই ঘটনা ঘটিয়েছেন, তার বিরহেও তিনি কেঁদেছেন বলে উল্লেখ করেছেন শ্রীকৃষ্ণ।

এরপরেও শ্রীকৃষ্ণ আবার ক্ষমা নামক আরেকজন গোপীর সাথে এই এক‌ই ভাবে সঙ্গম করেন, ক্ষমা নামক গোপী প্রথমবার শ্রীকৃষ্ণের সাথে সঙ্গমের কারণে জ্ঞান হারিয়ে মূর্ছিত হয়েছিলেন, তারপর তারা দুইজন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। শ্রী রাধা সেখানে এসে শ্রীকৃষ্ণ ও ক্ষমা কে সেই ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জাগ্রত করেন। এই উক্তি সমূহ স্বয়ং শ্রীরাধার নিজের। সুতরাং, এখানে কয়েকটি বিষয় একদম ই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে —

(১) শ্রীকৃষ্ণ রাধার অংশরূপী গোপীদের সহিত সঙ্গম করতেন রাধার আড়ালে ।

(২) শ্রীরাধা এই ধরণের চরিত্রের কারণে শ্রীকৃষ্ণকে প্রচণ্ড ভর্ৎসনা করতেন ।

(৩) শ্রীকৃষ্ণ রাধাতেই সন্তুষ্ট হননি, নচেৎ নিজের ইচ্ছেমতো তিনি এভাবে যে কোনো নারীর সহিত কামভোগে লিপ্ত কেন হতেন ।

(৪) তুলসী সহ ঐ সকল গোপীগণ নিজের অংশ থেকে উৎপন্ন হয়েছে বলে রাধা জানতেন, তবুও তিনি এই বিষয়টিকে সভ্যতার দৃষ্টিতে দেখননি, বরং তিনি প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে, সকলকে অভিশাপ দিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ কে লম্পট দুর্বৃত্ত বলে ভর্ৎসনা করেন শ্রীরাধা।

(৫) শ্রীকৃষ্ণ কামের বশবর্তী হয়ে কেন এই ধরণের পরস্ত্রীতে আসক্ত হয়ে যেতেন তার ‘কারণ’ কি ? এ বিষয়ে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে কোনো কিছু উল্লেখ নেই । 


________________________________________________


উপরোক্ত ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ থেকে প্রমাণ সহ জানা গেল যে,  মুসলিম/খ্রিষ্টান/নাস্তিক/বৌদ্ধ/আর্যসমাজী প্রভৃতি অসনাতনী রা যে দাবী করেন, তা অযৌক্তিক নয় । কারণ, শ্রীকৃষ্ণ যদি একমাত্র পরমেশ্বর হয়ে থাকেন, তাহলে তার মধ্যে এরকম লম্পটদের মতো প্রবৃত্তি কি করে থাকতে পারে ? 

পরমেশ্বর কি কখনো কামুক ব্যক্তিদের মতো নারী দর্শন করা মাত্রই তার সাথে শারীরিক মিলনে লিপ্ত হতে পারেন ? , পরমেশ্বর কি কখনো লজ্জা ও ভয় পেয়ে পালিয়ে যান ? নিশ্চয়ই শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে অপরাধ বোধ ছিল, তাই তিনি রাধার উপস্থিতিতে পালিয়ে যেতেন । 

তবুও তিনি বারংবার এই এক‌ই কাজ করেছেন, তাহলে যখন সনাতন ধর্মের পরমেশ্বর নিজেই এত কামুক, যে পরমেশ্বর নিজেই কামনা বাসনায় ডুবে আছেন , যে পরমেশ্বর পরস্ত্রীকে ভোগ করেন তিনি কি করে পরমেশ্বর হন ? 

                    — এই পর্যন্ত অসনাতনী রা দাবী করেছেন।

এবার শৈব সনাতনীদের পক্ষ থেকে উত্তর দেবার পালা ।

________________________________________________


🚫 (অসনাতনীদের প্রশ্ন) শ্রীকৃষ্ণ কেন রাধাকে ছেড়ে অন্য নারীদের সাথে সম্ভোগ করতে যেতেন ?


শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জীর উত্তর — 

শ্রীকৃষ্ণ কেন নিজের ইচ্ছেমতো এই ঘটনা ঘটাতেন তার উত্তর রয়েছে শিবমহাপুরাণে। দেখুন, শিবলোকে  পরমেশ্বর সদাশিব — ব্রহ্মা বিষ্ণু কে শঙ্খচূড়ের কাহিনী বলতে গিয়ে পরমসত্য তুলে ধরেছেন ।


[তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/যুদ্ধখণ্ড/৩১ অধ্যায়]

অর্থ —

পরমেশ্বর শিব বললেন, হে হরে ! হে বৎস ! হে ব্রহ্মা ! তোমরা দুইজন শঙ্খচূড়ের দ্বারা উৎপন্ন হওয়া ভয়কে পূর্ণরূপে ত্যাগ করো, তোমাদের নিঃসন্দেহে কল্যাণ হবে।

শঙ্খচূড়ের সমস্ত বৃত্তান্ত আমি জানি, তিনি পূর্বে শ্রীকৃষ্ণের পরমভক্ত সুদামা গোপ ছিল ॥ ২-৩

আমার আজ্ঞায় শ্রীবিষ্ণু শ্রীকৃষ্ণের রূপ ধারণ করে আমার দ্বারা অধিষ্ঠিত রম্য গোলোক নামক এই গোশালাতে নিবাস করেন ॥ ৪

নিজেকে ‘আমি তো স্বতন্ত্র’ — এমন ভেবে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ পূর্বে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন আর এই প্রকারে মায়ায় মোহিত হয়ে নিজের ইচ্ছামত যা ইচ্ছা তাই নানা প্রকারের কার্যকলাপ করতে লাগলেন ॥ ৫

তখন আমি শ্রীকৃষ্ণকে নিজের মায়া দ্বারা মোহিত করে দিয়েছিলাম, যার ফলে শ্রীকৃষ্ণের সদ্ বুদ্ধি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল আর তার সঙ্গদোষে পড়ে সুদামা অভিশাপগ্রস্ত হয়েছিলেন । এই প্রকারে আমি লীলা করে অবশেষে আমার মায়া সংবরণ করে নিলাম, সেই মায়া থেকে মুক্ত হয়ে যাবার পর শ্রীকৃষ্ণ আবার জ্ঞানযুক্ত তথা সদ্ বুদ্ধিযুক্ত হয়ে গেলেন॥ ৬-৭

তখন শ্রীকৃষ্ণ আমার কাছে এসে আর দীনভাবে আমাকে প্রণাম করে হাতজোড় করে বিনম্র ভাবে ভক্তিপূর্বক আমার স্তুতি করতে লাগলেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ সহিত উপস্থিত সকলে লজ্জিত মনে সমস্ত বৃত্তান্ত বললেন আর দীনভাবে ‘আমাদের রক্ষা করুন, আমাদের রক্ষা করুন’ - এভাবে তারা বলতে লাগলেন আমার সামনে ॥ ৮-৯ 

তখন তাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে আমি তাদের এই বচন বললাম, হে কৃষ্ণ ! তোমরা সবাই আমার আজ্ঞায় ভয়কে ত্যাগ করো । আমি তোমাদের সর্বদাই রক্ষক। আমি প্রসন্ন থাকলে তোমাদেরও কল্যাণ হবে। যা কিছু হয়েছে এই সমস্তই আমার ইচ্ছাতেই হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। হে কৃষ্ণ তুমি এই রাধা এবং পার্ষদদের সাথে নিয়ে নিজের স্থানে গমন করো, এই সুদামা ভারতবর্ষে দানবের রূপে জন্ম নেবে, এতে সন্দেহ নেই । উচিত সময় উপস্থিত হলে আমি তোমাদের দুজন শ্রীকৃষ্ণ ও সুধামাকে উদ্ধার করবো। তখন বুদ্ধিমান শ্রীকৃষ্ণ আমার বচন শ্রবণ করে তার শিরোধার্য করে রাধা কে সাথে নিয়ে অত্যন্ত প্রসন্নতার সহিত নিজের স্থানে চলে গেলেন আর তারা দুজন শিবের শাসনের প্রতি সভয়ে শিবের আরাধনা করতে থেকে নিবাস করতে থাকলেন ॥ ১০-১৪

সেই সময় কৃষ্ণের এই জ্ঞান হল যে, এই সমগ্র জগত আমার অর্থাৎ শিবের অধীন, আর আমি কৃষ্ণ সর্বদা পরাধীন (আমি শ্রীকৃষ্ণ স্বতন্ত্র ন‌ই, শিবের আদেশের অধীন) আর সেই সুদামা রাধার অভিশাপে শঙ্খচুর নামক দানব হিসেবে উৎপন্ন হয়েছিল, যিনি ধর্মতে নিপুন হয়েও দেবদ্রোহী ও সেই দূর্বুদ্ধি দানব নিজের বলের দ্বারা সমস্ত দেবগণকে সর্বদা পীড়া প্রদান করছে । আমার মায়ার দ্বারা মোহিত হবার কারণে সে দুষ্ট মন্ত্রীদের সহায়তাও প্রাপ্ত করছে । অত‌এব যেহেতু আমি শাসক রয়েছি সেহেতু তোমরা শীঘ্রই ওই দানবের ভয় ত্যাগ করে দাও ॥ ১৫-১৭

(এরপর সেখানে শ্রীকৃষ্ণ উপস্থিত হয়ে পরমেশ্বর সদাশিবের উদ্দেশ্যে স্বয়ং বললেন)

শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে দেবদেব ! হে মহাদেব ! হে পরব্রহ্ম! হে সৎ পুরুষদের গতি ! হে পরমেশ্বর! আমার অপরাধ ক্ষমা করুন আর আমার ওপর প্রসন্ন হোন। হে শর্ব ! সবকিছু আপনার থেকে উৎপন্ন হয় আর হে মহেশ্বর ! সব কিছু আপনাতেই স্থিত। হে সর্বাধীশ ! সবকিছু আপনিই, অত‌এব, হে পরমেশ্বর আপনি প্রসন্ন হোন ॥ ২২-২৩

আপনি সাক্ষাৎ পরম জ্যোতি, সর্বব্যাপী এবং সনাতন । হে গৌরীশ ! আপনি আমাদের সকলের আশ্রয়দাতা নাথ(স্বামী/প্রভু), তাই আমরা সনাথ (অর্থাৎ প্রভুর আশ্রয়ে আছি) ॥ ২৪

মোহে পড়ে থাকা আমি শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে সর্বোপরি পরমেশ্বর ভেবে নিজের ইচ্ছামতো বিহার করে চলেছিলাম, এর ফল আমি যেভাবে পেলাম তা হল এইরূপ, আমি শ্রীকৃষ্ণ অভিশপ্ত হলাম আর হে স্বামীন ! সুদামা নামের আমার যে শ্রেষ্ঠ পার্ষদ সে রাধার অভিশাপে দানবযোনি প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছে। হে দুর্গেশ ! হে পরমেশ্বর ! আপনি আমাদের উদ্ধার করুন আর প্রসন্ন হোন, শাপ থেকে উদ্ধার করুন আর  আপনার এই শরণাগত আমাদের রক্ষা করুন । এই প্রকার প্রার্থনা করে শ্রীকৃষ্ণ রাধার সহিত মৌন হলেন, তখন শরণাগত বৎসল সদাশিব তাদের উপর প্রসন্ন হলেন ॥ ২৫-২৮

শ্রীসদাশিব বললেন, হে কৃষ্ণ ! হে গোপিকানাথ ! তুমি তোমার ভয়কে পরিত্যাগ করো আর সুখী হয়ে যাও । হে তাত ! আমি অনুগ্রহ করে এই সমস্ত কিছু করেছি (যাতে মোহমুক্ত হয়ে সত্য অবগত হতে সক্ষম হ‌ও) ॥ ২৯

তোমার কল্যাণ হবে, এখন তুমি তোমার উত্তম স্থান গোলোকে প্রস্থান করো আর সাবধান পূর্বক নিজের অধিকার পালন করো। । আমাকে(শিবকে) পরাৎপর ব্রহ্ম বলে জেনো, আর এই কথা স্মরণে রেখে নিজের জন্য সমুচিত যেমনভাবে বিহার করা শ্রেয় বলে মনে হয় তেমন ভাবে বিহার করো আর নির্ভয় হয়ে রাধা তথা পার্ষদদের সাথে নিজের কার্য করো ॥ ৩০-৩১

উত্তম বারাহকল্প তে যুবতী রাধার সাথে শাপের ফল ভোগ করে পুনরায় সেই গোলোককে প্রাপ্ত করবে ॥ ৩২


🔥 বিশ্লেষণ — দেখুন ! অসনাতনী মহাশয়গণ ! শিবমহাপুরাণে প্রভু সদাশিব বলছেন - শিবলোকের  গোলোক নামক গোশালাতে শ্রীকৃষ্ণকে গোমাতাদের দেখাশোনা করবার আজ্ঞা দিয়েছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ সেই আজ্ঞা পালন করবার জন্য গোলোকে নিবাস করতেন ।

সেখানে থাকতে থাকতে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে অর্থাৎ স্থূল বিষ্ণুদেহকে স্বতন্ত্র ভাবতে শুরু করেছিলেন। যার অর্থ হল — শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে পরমেশ্বর ভাবতে শুরু করেছিলেন ।


আমাদের সনাতন ধর্মের সিদ্ধান্তশাস্ত্র মহাশ্রুতি শৈবাগম ও শ্রুতিশাস্ত্র বেদ অনুযায়ী, একমাত্র পরমেশ্বর হলেন - স্বতন্ত্র, অর্থাৎ পরমেশ্বর অন্য কারোর আদেশ পালন করেন না, পরমেশ্বরের আদেশ সকলে পালন করেন, পরমেশ্বর নিজের ইচ্ছা মতো যা ইচ্ছা তাই করেন। তাই , পরমেশ্বর কে স্বতন্ত্র বলেছে চিহ্নিত করেছে শাস্ত্র। 


পরমেশ্বর শিবের আদেশের অধীন সবকিছু, তিনি কারোর আদেশের অধীন নন । তাই শাস্ত্রে প্রভু শিবকে স্বতন্ত্র বলা হয়েছে । 

কিন্তু, শ্রীকৃষ্ণ গোলোকে থাকাকালীন সময়ে নিজেকে স্বতন্ত্র ভাবতে শুরু করেছিলেন অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে পরমেশ্বর শিবের আদেশের অধীন বলে মানেননি, বরং শ্রীকৃষ্ণ নিজেকেই স্বয়ং স্বতন্ত্র পরমেশ্বর ভাবতে শুরু করেছিলেন। পরমেশ্বর শিব এবিষয়ে সব জানতেন, তাই প্রভু শিব শ্রীকৃষ্ণকে তার ঐ মোহ থেকে উদ্ধার করবার জন্য লীলা করলেন। শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে পরমেশ্বর ভেবে নিয়ে মনে করলেন শ্রীকৃষ্ণ যেহেতু স্বতন্ত্র তাই শ্রীকৃষ্ণ যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন। এই মনোভাবের কারণে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধাকে ছেড়ে লুকিয়ে লুকিয়ে অন্য গোপীদের সাথে শারীরিক মিলনে লিপ্ত হয়ে কামনা পরিতৃপ্তি করতেন। 

কিন্তু শ্রীরাধিকা এসব সহ্য করতে না পেরে শ্রীকৃষ্ণকে ভর্ৎসনা করেছেন, আর তার সাথে সাথে বাকিদের‌ও অভিশাপ দিয়ে মর্তে পতিত করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকে মর্তে পতিত হয়ে যাবার অভিশাপ দিয়েছিলেন শ্রীরাধা, যা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের শ্রী কৃষ্ণজন্মখণ্ডের ৩য় অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে। আর শিবমহাপুরাণের উপরোক্ত ৩২নং শ্লোকেও পরমেশ্বর শিব বলেছেন, শ্রীকৃষ্ণ মর্তে গিয়ে অভিশাপ ভোগ করবার পর পুনরায় গোলোকেই ফিরে আসবেন । সুতরাং,  একটি ঘটনার কাহিনী কিছুটা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বর্ণিত হলেও, সেই কাহিনীর উৎস অন্য শাস্ত্র শিবমহাপুরাণে বিস্তারিত বলা আছে। শ্রীকৃষ্ণ নিজের অজান্তেই পরমেশ্বর শিবের মায়ায় পড়ে নিজেকে পরমেশ্বর ভেবে এসব কার্য করে শ্রীরাধার কাছে শাপ পেলেন।

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ যখন জানতে পারলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে স্বতন্ত্র পরমেশ্বর ভেবে এমন চরম দুর্গতিতে পড়েছেন । তখন তিনি শিবলোকের স্বামী পরমেশ্বর সদাশিবের কাছে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করেন । পরমেশ্বর শিব তখন বললেন যে, তিনি শিবলীলা করে এগুলি ঘটিয়েছেন, যাতে শ্রীকৃষ্ণ মোহ থেকে উদ্ধার হতে পারেন । 

পরমেশ্বর সদাশিব শ্রীকৃষ্ণ কে বললেন, তুমি আমাকে অর্থাৎ শিবকে ব্রহ্ম বলে জেনে তারপর সেই মতো চলো, এতেই শ্রীকৃষ্ণের মঙ্গল, এরপর শ্রীকৃষ্ণ নিজের গোলোকে উপস্থিত হয়ে শিব আরাধনা করলেন, তখন তার জ্ঞান উৎপন্ন হল, শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পারলেন যে শ্রীকৃষ্ণ কখনোই স্বতন্ত্র নন, শ্রীকৃষ্ণ শিবের অধীন। স্বতন্ত্র একমাত্র পরমেশ্বর শিব, পরমেশ্বর ছাড়া অন্য আর কেউ স্বতন্ত্র নয়, তাই শিব ছাড়া অন্য কেউ স্বতন্ত্র নন, শ্রীকৃষ্ণ যেহেতু পরমেশ্বর নন তাই তিনি পরমেশ্বর শিবের অধীন।

এবার বুঝতে পারলেন, অসনাতনী মহাশয়েরা !! শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে ছেড়ে অন্য নারীদের সাথে সঙ্গম কেন করেছিলেন। কারণ, শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে পরমেশ্বর ভেবে যা ইচ্ছে তাই করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু এটি তার ভ্রম ছিল। পরমেশ্বরের মায়ায় পড়ে তিনি এগুলি করতেন । তাই যেহেতু মায়ায় পড়ে শ্রীকৃষ্ণ এসব করতেন, সেটির দ্বারা সনাতন ধর্মের প্রকৃত পরমেশ্বর সদাশিবের চরিত্রে প্রশ্ন ওঠে না। কারণ, শ্রীকৃষ্ণ তো কোনোভাবেই পরমেশ্বর নন। পরমেশ্বর হলেন শিবলোকবাসী প্রভু সদাশিব ।

শ্রীকৃষ্ণ যদি পরমেশ্বর হতেন তাহলে তিনি শিবমায়ায় পড়তেন না, শ্রীকৃষ্ণ নিজেকেই একমাত্র পরমেশ্বর ভেবেই মায়াগ্রস্ত হয়েছেন। তাই শ্রীকৃষ্ণের এসব কার্যকলাপের দোষ সনাতন ধর্মের এক ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বর শিবের উপর কখনোই লাগে না । 

সার কথা হল,

(১) পরমেশ্বর একমাত্র সদাশিব, শ্রীকৃষ্ণ নন।

(২) এই ঘটনাটি গোলোকে ঘটেছিল, মর্তে নয়। তাই, শ্রীকৃষ্ণ কোনো গোপীর মনের ইচ্ছা পূরণ করবার জন্য এমন কাজ করেননি, বরং শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে স্বতন্ত্র পরমেশ্বর ভেবে নিয়ে শিবমায়ায় পড়ে নিজের খেয়াল খুশি মতো রাধাকে ত্যাগ করে তার অনান্য গোপীদের সাথে মিলনে লিপ্ত হন, এর দ্বারা শ্রীকৃষ্ণ ও সুদামা সহ গোপীগণ‌ও রাধার অভিশাপে মর্তে পতিত হয়ে যান ।

(৩) শ্রীকৃষ্ণ নিজের ভুল বুঝতে পেরে পরমেশ্বর শিবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, শেষে তিনি বুঝতে পারলেন শ্রীকৃষ্ণ শিবের অধীন, কারণ শিব হলেন পরমেশ্বর। শিব‌ই একমাত্র স্বতন্ত্র , তাই পূর্বকালে নিজেকে স্বতন্ত্র ভেবে বড় অপরাধ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ । 

(৪) যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর নন, তাই সনাতন ধর্মের পরমেশ্বরের চরিত্রের উপর কোনো দোষ‌ও লাগেনি । সেই পরমেশ্বর একমাত্র অম্বিকাপতি - শিব ।

(৫) শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর নন, তাই তিনি মায়ায় মোহিত হতেই পারেন, এতে অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু মায়ায় আবদ্ধ ব্যক্তির ভালোমন্দ বিচার করবার মত জ্ঞান ওই সময় থাকেনা, তাই মায়া মোহিত হওয়া শ্রীকৃষ্ণ কে দোষ দেওয়া যায় না। তিনিও সম্পূর্ণ নির্দোষ। 


এখানেই অসনাতনীদের আক্ষেপ শান্ত করে দেওয়া হল ।

______________________________________________


এবার, এসব শুনে বৈষ্ণবেরা প্রশ্ন করে বলবেন —

🚫 (বৈষ্ণবদের প্রশ্ন) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতার মধ্যে বলেছেন, “আমিই পরমেশ্বর আমি সব” । তাহলে সেটা কি মিথ্যা ?


✅ শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জীর উত্তর — 

শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় আমি বলতে কি বুঝিয়েছেন ? সর্বপ্রথম সেটি আপনাদের বুঝতে হবে।

‘আমি’ শব্দের প্রয়োগ কোন স্থানে কিভাবে হচ্ছে তা বুঝতে না পারলে এই বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়া স্বাভাবিক বিষয় ।

শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতাতে ‘আমি’ শব্দ দ্বারা আত্মাকে বুঝিয়েছেন, নিজের দেহকে নয়। দেহকে অনাত্মা বলে অর্থাৎ যা আত্মা নয় । কিন্তু অজ্ঞানী ব্যক্তিরা ‘দেহরূপী কৃষ্ণ’ কে ওই আমি শব্দের বাচ্যার্থ বলে ভাবেন । শ্রীকৃষ্ণ যোগের দ্বারা তার দেহের মধ্যে স্থিত থাকা ‘আত্মারূপী পরমাত্মা শিব’ কে পরমেশ্বর বলে ইঙ্গিত করেছেন।

পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডের ১৭৫ নং অধ্যায়ে শ্রীবিষ্ণুকে মাতা লক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করে বলেছিলেন, হে ভগবান শ্রীহরি আপনিই তো পরমাত্মা তাহলে আপনার যোগমগ্ন হবার কি প্রয়োজন পড়ছে? তখন ভগবান বিষ্ণু বললেন, হে দেবী তুমি আমার যে এই বিষ্ণুদেহ দেখতে পাচ্ছ এটি মায়াময়, এই বিষ্ণুদেহের মধ্যে যিনি আত্মা রূপে আছেন তিনিই সকল মায়ার ঊর্ধ্বে থাকা শিব, ‘আমি’ শব্দ দ্বারা সেই প্রকৃতপক্ষে সেই শিবকেই  বোঝানো হয়ে থাকে । ভগবদ্গীতার ১৮ টি অধ্যায় সদাশিবের‌ই ১৮ টি অঙ্গের প্রতীক । অর্থাৎ, এক্ষেত্রে শ্রীহরি নিজেই প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণরূপে তিনি অর্জুন কে ‘আমি পরমেশ্বর আমিই সব’ বলতে ‘আত্মা’ কে বুঝিয়েছেন ‘কৃষ্ণরূপ দেহ’ কে নয়। কৃষ্ণরূপ বা বিষ্ণুরূপ এই দেহ মায়া মাত্র, প্রকৃত ‘আমি’ শব্দে দেহের মধ্যে থাকা আত্মাকে বোঝায়, ঐ আত্মাই পরমেশ্বর শিব। তাই শাস্ত্রের বাক্য দিয়ে শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে প্রভু শিবকেই একমাত্র পরমব্রহ্ম বলে জানা যায় । 

👉 এ বিষয়ে বিস্তারিত জানে এখানে ক্লিক করুন 👇 

পদ্মপুরাণে ভগবদ্গীতা সাক্ষাৎ শিবস্বরূপ‌ ও সদাশিব‌ বিষ্ণুর চেয়ে পরম বলে শ্রীবিষ্ণুর স্বীকারোক্তি - (ভাবার্থ বিশ্লেষণ ও টীকা সহ) 

✳️ মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ১৩ অধ্যায়ে স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণ একথা স্বীকার করে বলেছেন যে, সকল জীবের অন্তরে থাকা জীবাত্মারূপী পরমেশ্বর শিব, সকল যোগী তথা প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের অন্তরে থাকা শিবকে জেনেই শান্তি লাভ করেন । দেখুন 👇 


হৃদযং সর্বভূতানাং ক্ষেত্রজ্ঞত্ত্বমূষিস্তুতঃ।

সর্বতঃ পাণিপাদস্তুং সর্ব্বতোহক্ষিশিরোমুখঃ ॥৪১৫৷

সর্বতঃ শ্রুতিমাল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠসি।

ফলং ত্বমসি তিগ্নাংশোনিমেষাদিষু কশ্মসু ॥৪১৬৷৷(যুগ্মকম্)

ত্বং বৈ প্রভাচ্চিঃ পুরুষঃ সর্বস্য হৃদিসংশ্রিতঃ।

অণিমা লঘিমা প্রাপ্তিরাশানো জ্যোতিরব্যয়ঃ ॥৪১৭॥

ত্বযি বৃদ্ধিৰ্ম্মতির্লোকাঃ প্রপন্নাঃ সংশ্রিতাশ্চ যে। 

ধ্যানিনো নিত্যযোগাশ্চ সত্যসত্ত্বাজিতেন্দ্রিযাঃ ৷৷৪১৮৷৷

যত্ত্বাং ধ্রুবং বেদয়তে গুহাশয়ং প্রভুং' পুরাণং পুরুষঞ্চ বিগ্রহম্।

হিরণ্ময়ং বুদ্ধিমতাং পরাং গতিং স বুদ্ধিমান্ বুদ্ধিমতীত্য তিষ্ঠতি ৷৷৪১৯৷৷ 

বিদিত্বা সপ্ত সূক্ষ্মাণি ষড়ঙ্গং ত্বাঞ্চ মূর্ত্তিতঃ। 

প্রধানবিধিযোগস্থত্ত্বামেব বিশতে বুধঃ ।।৪২০৷৷

[তথ্যসূত্র : মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১৩/৪১৫-৪২০ নং শ্লোক]

অর্থ — 

ঋষিস্তুত আপনি, সমস্ত প্রাণীর হৃদয়স্থিত জীবাত্মা। জগতে সকল দিকেই আপনার হস্ত ও পদ, সকল আপনাব বৰ্ম্ম রয়েছে ; আর বিশেষতঃ জীবাত্মার স্পন্দনাদি দিকেই চক্ষু, মস্তক ও মুখ এবং সকল দিকেই আপনি সমস্ত ব্যাপ করে অবস্থান করছেন। কার্য্যের ফল জীবনও আপনিই ॥৪১৫-৪১৬৷৷

মহাদেব! আপনি আলোক, শিখা, সাংখ্যপ্রসিদ্ধ পুরুষ, সমস্ত প্রাণীর হৃদয়স্থিত জীবাত্মা, অণিমা, লঘিমা ও প্রাপ্তিশালী জগতেব ঈশ্বর, পরমাত্মা ও অবিনশ্বর॥৪১৭৷৷

মহাদেব! যাদের বুদ্ধি ও মন আপনাতে থাকে এবং যে সকল লোক আপনার শরণাপন্ন ও আশ্রিত, আর ধ্যানী, যোগী, অধ্যবসায়ী ও জিতেন্দ্রিয় হয়, সেই ব্যক্তিগণই ধন্য ॥৪১৮৷৷

মহাদেব! যিনি আপনাকে(শিবকে) হৃদয়স্থিত, জীবাত্মা, প্রভু, পুরাণপুরুষ, মূর্তিমান্ পরব্রহ্ম ও জ্ঞানিগণের পরম গতি বলিয়া নিশ্চিতভাবে জানেন; সেই জ্ঞানীলোক লৌকিক বুদ্ধি অতিক্রম করে থাকেন ॥৪১৯৷৷

পণ্ডিত লোক মহৎ, অহঙ্কার ও পঞ্চতন্মাত্র এই সাতটা সূক্ষ্ম পদার্থ এবং মুত্তিমদবস্থায় আপনাকে শাং শীং শৃং শৈং শৌং শঃ এই বড়ঙ্গযুক্তভাবে জেনে প্রধানভাবে বিহিত যোগাবলম্বনে থাকেন, তিনি আপনাতেই(শিবেতেই) প্রবেশ করেন ॥৪২০॥


অর্থাৎ যোগের দ্বারা সকল জীব নিজের আত্মরূপ শিবকেই ‘আমি’ শব্দ দ্বারা বুঝিয়ে থাকেন ।

দেখুন, সাক্ষাৎ বেদ শাস্ত্রে সরাসরি এই কথা বলা হয়েছে, বেদের রুদ্রহৃদয় উপনিষদের ৩৬-৩৭নং মন্ত্রে বলা হয়েছে — প্রকৃত গুরু যেন তার শিষ্যকে তার আত্মা ও তার সাথে পরমাত্মার একত্বতার(অভিন্নতার) জ্ঞান দেন, আর এর দ্বারা সেই ব্যক্তি‌ও তার হৃদয়ে অন্তরে থাকা শিবকে জেনে অজ্ঞান থেকে মুক্ত হয়ে যান , দেখুন 👇


গুরুস্তস্মৈ পরাং বিদ্যাং দদ্যাদ্ ব্রহ্ম আত্মবোধিনীম্ ।

গুহায়াং নিহিতং সাক্ষাদক্ষরং বেদ চেন্নরঃ ॥ ৩৬ ॥

ছিত্ত্বাঽবিদ্যামহাগ্রন্থিং শিবং গচ্ছেৎ সনাতনম্ ।

তদেতদমৃতং সত্যং তদ্বোদ্ধব্যং মুমুক্ষুভিঃ ॥ ৩৭ ॥

[তথ্যসূত্র : কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/রুদ্রহৃদয় উপনিষদ/৩৬-৩৭ নং মন্ত্র]

অর্থ —  যিনি আত্মজ্ঞান লাভে ইচ্ছুক ব্যক্তি তেমন সাধক ব্যক্তিকে সেই গুরু ‘আত্মা আর ব্রহ্মের অভিন্নতা’ বোধ হয় যাতে সেই পরাবিদ্যা প্রদান করবে । এর দ্বারা সাধক ব্যক্তি যখন নিজের হৃদয় গুহার মধ্যে স্থিত সেই অক্ষর ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার করে নেন, তখন এমন ধরনের সাধক ব্যক্তি অজ্ঞান রূপে মহাগ্রন্থিকে ছিন্ন করে সনাতন শিবতত্ত্বকে প্রাপ্ত করে । যারা মোক্ষলাভ করতে ইচ্ছুক সেই সমস্ত মুমুক্ষ সাধকদের জন্য এই অমৃতস্বরূপ সত্য (শিবতত্ত্ব) জানা উচিত ॥ ৩৭


যখন শ্রীহরি নিজের আত্মাকে ‘আমি’ শব্দে পরমেশ্বর বলেছেন তখন তা ‘যোগ’ -এর বিষয় হ‌ওয়ায় তা শিবকেই নির্দেশ করবার কারণে এই ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের কোনো দোষ হয়না, তাই এর জন্য তাকে কোনো দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়নি । 

কিন্তু শ্রীহরি বা শ্রীকৃষ্ণ যখন‌ই নিজের স্থূলদেহকে নির্দেশ করে ‘আমি পরমেশ্বর, আমিই সব’ ভেবেছেন, ঠিক তখন‌ই হয় তিনি মোহগ্রস্ত হয়ে মায়ায় পড়েছেন , ঠিক তখন‌ই তার এই ভুলধারণা ভাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটি প্রমাণ দেখুন 👇 

স্কন্দ মহাপুরাণ/সূতসংহিতা/শিব মাহাত্ম্য খণ্ড/অধ্যায় ৩/৪-২০ নং শ্লোক - এ সূতমুনি ভগবান শ্রীহরি বিষ্ণুর মোহ বিষয়ক প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বললেন — 

পূর্বকালে সমস্ত পুরুষের মধ্যে উত্তম, জগৎ পালক, পুরাতন বিষ্ণু স্বয়ং শিবের মায়ায় মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন ॥ ৪

অহংকারের বশীভূত হয়ে শ্রীবিষ্ণু নিজের আত্মরূপ অম্বিকানাথ নিরতিশয় আনন্দ তথা জ্ঞানাত্মক মহেশ্বর কে অবগত না হয়েই শ্রী হরি বিষ্ণু ব্রহ্মাাদি সব দেবতাদের সামনে অত্যধিক ঔদ্ধত্যতার সহিত ঘোষণা করেছিলেন — ‘ আমি জগতের রচয়িতা, আমার মধ্যেই সংসার স্থিত। কোন দেশ বা কালে আমার তুল্য বা আমার থেকে শ্রেষ্ঠ কেউই নেই । এই সমস্ত জড়ো চেতন সংসার আমারই সামর্থ্যর বিস্তার লাভ করেছে। সমস্ত জন্তুদের দ্বারা সর্বদা আমারই আরাধনা করা উচিত।’ বিষ্ণুর এই কথা জ্ঞাত হয়ে সর্বস্ব রূপ, সর্বসাক্ষী, স্বয়ং প্রকাশ মহাদেব নিজের বিমর্শকালীন বিবেকশক্তিকেও হরণ করে শ্রীবিষ্ণু কে মোহগ্রস্ত করে দিলেন । এর ফলে বিষ্ণু ব্রহ্মা আদি সকল  পাশযুক্ত জীব হবার কারণে দেবতা হলেও তারা পশু বলেই গণ্য হন ॥ ৫-৯

মোহকে প্রাপ্ত হয়ে আর শম্ভুর মায়ায় সর্বথা বশবর্তী হয়ে তারা পূজারী বিষয়ক সঠিক নির্ণয় করতে অসমাপ্ত হয়ে গেলেন এই সময় শঙ্করের প্রিয়, যিনি সমস্ত বিদ্যারত্নের খনি, করুণানিধি শ্রীমান নন্দী সেখানে উপস্থিত হয়ে শ্রী হরি, ব্রহ্মা আদি দেবতাদের শিবের পরমার্থিক স্বরূপ অবগত করালেন । শ্রী নন্দীকেশ্বর বললেন — হে বিষ্ণু ! প্রভু শিব‌ই সমস্ত জগতের স্বামী, ভোগ ও মোক্ষ প্রদানকারী তথা সংসারের পরিচালক। সকলের সাক্ষী হবার কারণে তিনি সর্বজ্ঞ, সদা তৃপ্ত থাকেন এবং সবার অধিষ্ঠান স্বরূপ তিনিই বিদ্যমান। সমস্ত জীবেদের প্রজ্ঞাত্মা তিনিই। তিনি সকলকে প্রকাশিত করেন অর্থাৎ জ্ঞানের দ্বারা সংবদ্ধ করেন ॥১০-১৩

শিবের কৃপার কোনো ক্ষুদ্র অংশের প্রভাবে আপনি এই বিষ্ণুপদ লাভ করতে পেরেছেন, অন্য কোন কারণে নয় ॥ ১৪

অন্য সকল দেবতাও শিবের কৃপাতেই নিজের নিজের পদ লাভ করেছেন । শিবকে ছাড়া এই জগতের স্বয়ং নিজের কোনো নিজস্ব সত্তা নেই, সত্তার কারণেই এই জগত সত্তান্বিত আছে ॥ ১৫

শিব সর্বদা সমস্ত পদার্থের নির্মাতা এবং পোষক । যেমন অগ্নির দ্বারা লোহা জ্বালিয়ে চমকানো সম্ভব হয় (স্বয়ং লোহা নিজেকে চমকাতে পারেনা, অগ্নির দ্বারা চমকাতে পারে) । তেমনভাবেই শিবের কারণেই এই জগত বিদ্যমান আর প্রকাশিত হয় । অন্নপ্রাণীগণ এনারয় আনন্দের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র অংশ পেয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে যান । (নন্দী মহারাজের বলা একথা গুলিকে বলে বর্ণনা করতে করতে এবার সূতমুনি তার শ্রোতা অন্যান্য মুনিগণেদের উদ্দেশ্যে বললেন) হে ব্রহ্মা উপাসক মুনিগণ ! সেই মহাদেবের আদেশেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে এই জগত সর্বদা চলছে॥ ১৬ -১৮

 এই ‘শিবরূপ আত্মতত্ত্ব’কে অবগত না হয়ে হে বিষ্ণু আপনি অত্যন্ত মোহ তে পড়েছেন আর অহংকারের বশীভূত হয়ে আপনি অন্যান্য দেবতাদেরও বিবেক ভ্রষ্ট করে দিয়েছেন ॥ ১৯

অতএব আপনি ভ্রম এর পরিত্যাগ করে নিজের আত্মরূপ উমাপতি মহেশ্বর কে সমস্ত দেবতাদের সহিত আদরপূর্বক আরাধনা করুন ॥ ২০


সুতরাং, ‘আমি’ শব্দ দ্বারা আত্মাকে বোঝানো হলে তা পরমেশ্বর শিবের ইঙ্গিত করে, যা বৈধ । কিন্তু যদি ‘আমি’ শব্দ দ্বারা ‘পাঞ্চভৌতিক স্থূল শরীর’ কে পরমেশ্বর বলে ঘোষণা করা হয় তা হল ভ্রম তথা অবৈধ ভাবনা। 

শ্রীকৃষ্ণ যখন‌ই আমি বলতে নিজেকে অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণকেই পরমেশ্বর ভেবেছেন তখন‌ই মোহগ্রস্ত হয়ে পরস্ত্রী গমন করে অভিশপ্ত হয়ে জগতে পতিত হয়ে কলঙ্কের ভার নিজের কাঁধে বহন করেছেন, বা তার মোহকে শ্রী নন্দীমহারাজ ভঙ্গ করেছেন । 

নচেৎ, শ্রীকৃষ্ণ যদি পরমেশ্বর ই হতেন তবে তিনি কোনো কারণ ছাড়া এভাবে অন্যায় ভাবে কখনোই অন্য স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হতেন না । 

এই ধরণের বৈশিষ্ট্য শুধুমাত্র জীবের মধ্যে দেখা সম্ভব, পরমেশ্বরের উপর কোনো মায়া প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর নন তাই মায়াগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু প্রভু সদাশিব যেহেতু পরমেশ্বর তাই তিনি কখনোই মায়াগ্রস্ত হননি , কোনো শাস্ত্রে ত্রিদেবের উৎপত্তিকর্তা সদাশিব মায়াগ্রস্ত হয়েছেন বলে উল্লেখ নেই। 

পরমেশ্বর সদাশিবের অবতার ‘সংহারকর্তা গুণাত্মক লীলাধারী রুদ্রদেব’ কখনো কখনো লীলাবশত নিজের বরদানের কারণে লোকাচার(অভিনয়) বশত মায়াগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জগতকে দেখিয়েছেন। কিন্তু শিবলোকবাসী সদাশিব গুণাতীত মায়ার‌ও নিয়ন্ত্রক, পরমেশ্বর শিবের এই সদাশিবরূপ কখনোই কোনো মায়াতে আবদ্ধ নন, এমনকি কোনো লীলাবশত‌ও তিনি মায়ায় আবদ্ধ হবার অভিনয়েও অংশগ্রহণ করেননা। 

সাক্ষাৎ বেদ ও শিবমহাপুরাণ পরমেশ্বর শিবকে মায়া প্রভাব থেকে মুক্ত বলেছেন , এমনকি মায়ার নিয়ন্ত্রক বলেও ঘোষণা করেছেন 👇

মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং চ মহেশ্বরম্ ॥১০

[তথ্যসূত্র : শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/অধ্যায় ৪/১০ নং মন্ত্র]

অর্থ – প্রকৃতি হল মায়াশক্তি, সেই মায়া সহ সকল বিদ্যারূপ শক্তি মহেশ্বরের অধীন, তাই মহেশ্বর হলেন মায়ার নিয়ন্ত্রক মায়াধীশ ॥১০

এক‌ই কথা - শিবমহাপুরাণ বলছে 👇

মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং তু মহেশ্বরম্ ॥৩৩

[তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/বায়বীয়সংহিতা/পূর্বখণ্ড/অধ্যায় ৬/৩৩নং শ্লোক]

অর্থ – প্রকৃতি হল মায়াশক্তি, সেই মায়া সহ সকল বিদ্যারূপ শক্তি মহেশ্বরের অধীন, তাই মহেশ্বর কে মায়ার নিয়ন্ত্রক মায়াধীশ বলা হয় ॥৩৩

এই মায়ার অধীশ্বর পরমেশ্বর সদাশিব যে স্থানে থাকেন তা সমস্ত লোকের উপরে স্থিত। সেই পরমেশ্বর সদাশিব থেকেই সকলের উৎপত্তি, এমনকি ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-রুদ্র’ ত্রিদেব‌ও উৎপন্ন হয়েছেন সদাশিব থেকে। প্রমাণ দেখুন 👇 

সর্বোপরি চ যস্যাস্তি শিবলোকঃ পরাৎপরঃ ।

যত্র সংরাজতে শম্ভুঃ পরব্রহ্ম পরেশ্বরঃ ॥ ৪৭

প্রকৃতে পুরুষস্যাপি যোঽধিষ্ঠাতা ত্রিশক্তিধৃক্ ।

নির্গুণঃ সগুণঃ সোঽপি পরংজ্যোতিঃ স্বরূপবান্ ॥ ৪৮

যস্যাঙ্গজাস্তু বৈ ব্রহ্মস্ত্রয়ঃ সৃষ্ট্যাদিকারকাঃ ।

সত্ত্বাদিগুণসম্সন্না বিষ্ণুব্রহ্মহরাভিধাঃ ॥ ৪৯

স এব পরমাত্মা হি বিহরত্যুময়া সহ ।

যত্র মায়াবিনির্মুক্তো নিত্যানিত্যপ্রকল্পকঃ ॥ ৫০

তৎসমীপে চ গোলোকে গোশালা শঙ্করস্য বৈ ।

তস্যেচ্ছ্যা চ মদ্রূপঃ কৃষ্ণো বসতি তত্র হ ॥ ৫১

তদ্গবাং রক্ষণার্থায় তেনাজ্ঞপ্তঃ সদা সুখী ।

তৎসংপ্রাপ্তসুখঃ সোঽপি সংক্রীড়তি বিহারবিৎ ॥ ৫২

[তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/যুদ্ধখণ্ড/২৯ অধ্যায়/৪৭-৫২নং শ্লোক]

অর্থ — শ্রী বিষ্ণু বললেন, যার পরাৎপর শিবলোক সমস্ত লোকের উপরে স্থিত, যেখানে স্বয়ং পরমেশ্বর সদাশিব বিরাজিত, তিনশক্তি(পরা,পরা-অপরা,অপরা) ধারণকারী যিনি প্রকৃতি এবং পুরুষেরও অধিষ্ঠাতা, যিনি নির্গুণ, সগুণ তথা পরম জ্যোতি স্বরূপ । হে ব্রহ্মা ! সৃষ্টি আদি পরিচালনাকারী তথা সত্ত্ব আদি গুণের দ্বারা যুক্ত বিষ্ণু, ব্রহ্মা এবং মহেশ(সংহারকর্তা) নামক তিন দেবতা যার অঙ্গ থেকে উৎপন্ন হয়েছে, মায়ার থেকে সর্বদা যিনি মুক্ত এবং নিত্য অনিত্যের যিনি ব্যবস্থাপক সেই পরমাত্মা শিব উমা(পরা অম্বিকা)র সাথে যেখানে বিহার করেন, তারই সমীপে গোলোক অবস্থিত , যা পরমেশ্বর শিবের গোশালা (গোয়ালঘর) । সেই পরমেশ্বর শিবের ইচ্ছা অনুসারে সেই গোলোকে আমার(বিষ্ণুর) স্বরূপে স্থিত শ্রীকৃষ্ণ নিবাস করেন, পরমেশ্বর শিব নিজের গোগণের রক্ষার জন্য শ্রীকৃষ্ণকে সেখানে নিযুক্ত করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ‌ও গোগণের রক্ষা কার্যের দায়িত্ব পালন করতে থেকে সুখী হয়ে বিহার করতে থাকেন ॥ ৪৭-৫২

অর্থাৎ, পরমেশ্বর একজন‌ই তিনি হলেন - প্রভু শিব । তাই ভগবদ্গীতার জ্ঞান সত্য, কারণ তা পরমেশ্বর শিবের ব্যাখ্যা করে, অন্য কারোর নয়। শ্রীকৃষ্ণের বলা ভগবদ্গীতার জ্ঞান প্রকৃত অর্থে কোন ইঙ্গিত করেছে, তা আপনারা যদি অবগত না হন, এতে দায় ভগবদ্গীতা বা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নন, এর দায় আপনাদের বৈষ্ণবদের‌ই । আপনারা সনাতন ধর্মের আদি সিদ্ধান্ত না মেনে নিজেদের কাল্পনিক সিদ্ধান্ত বানিয়ে প্রচার করে সেটি মান্য করে চলেন, মানুষের বানানো সিদ্ধান্ত কখনোই সত্য হতে পারে না, তাই আপনাদের ওই কাল্পনিক মনুষ্য প্রসূত সিদ্ধান্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রের ও সনাতন ধর্মের পরমেশ্বরের নামে কলঙ্কের দাগ লাগানোর অপপ্রয়াসকে মোচন করতে সক্ষম হয়নি। একমাত্র আদি সনাতনী শৈব সিদ্ধান্ত দ্বারাই সনাতন ধর্মের শাস্ত্রের মাধ্যমেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রের পবিত্রতা ও সনাতন ধর্মের এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের  নিষ্কলঙ্কতা প্রমাণ করে দেওয়া হল । 

সুতরাং, যা সত্য তা গ্রহণ করুন । 

কারণ, 

শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🔥

হর হর মহাদেব 🚩 


শ্রীগুরবে নমঃ ॥

শ্রীবিষ্ণবে শৈবায় নমঃ ॥

ॐ নমঃ শিবায় ॥

🔥 সত্য উন্মোচন ও অপপ্রচার দমনে : শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী 

©️ কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ