অদ্বৈত শৈব পরম্পরা ও আদি শঙ্করাচার্যের নব্য ব্রহ্মবাদী স্মার্ত পরম্পরার মধ্যে কার প্রাচীনত্ব অধিক ও কার সিদ্ধান্ত শ্রেষ্ঠ ?
॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥
ভূমিকা —
বর্তমান সময়ে সনাতন ধর্মে কে হবে প্রধান পরিচালক, কে সবচেয়ে উচ্চ শিখরে আরোহণ করে মূল সিংহাসনে বসে সমগ্র সনাতন ধর্মের মাথা হয়ে সমাজে সকল সনাতনীদের নিয়ন্ত্রণ করবে , এই নিয়ে চলছে বৃহৎ অন্তর্দ্বন্দ্ব।
সাধারণ সনাতনীরা সনাতন ধর্মের খুঁটিনাটি সম্পর্কে অবগত নয়, তারা সাধুবেশ ধারী কোনো ব্যক্তিদের দেখে তাদের বলে দেওয়া কোনো কথা শুনেই তা বিশ্বাস করে নেয়, ফলে সনাতন শৈবধর্ম বিরোধী এমন বহু স্মার্ত আদিশঙ্করাচার্য পন্থী দের বহুল প্রচারিত কল্পকাহিনীর মাধ্যমে সমাজে আদি শঙ্করাচার্যের পন্থীদের মত পথ ই একমাত্র সনাতন ধর্মের সবচেয়ে পুরাতন ও একমাত্র নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদী পরম্পরা বলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আর এই স্মার্ত-আদিশঙ্করপন্থীরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করবার পাশাপাশি এটাও প্রচার করে বেড়ায় যে, শৈবপরম্পরা নাকি সাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়, যা সনাতন ধর্মের একটি শাখা মাত্র ।
এভাবেই শৈবধর্মকে তার মূল স্থান থেকে সরিয়ে আদিশঙ্করাচার্য সনাতন ধর্মের একটি শাখা বলে চিহ্নিত করে শৈবধর্মের মহানতাকে শৈব ‘সম্প্রদায়/Catagory মাত্র’ বানিয়ে তার মাহাত্ম্য কে নিকৃষ্ট ও সীমাবদ্ধ হিসেবে সমাজের কাছে উপস্থাপন করেছেন। যার ফলে বর্তমানে এই আদিশঙ্করাচার্যের অনুসারীরা সমাজের কাছে বড়ই অহংকারের সহিত নিজেদের সবচেয়ে পুরাতন ও সর্বশ্রেষ্ঠ অদ্বৈতবাদী পরম্পরা বলে দাবী করেন ।
আজ পরমেশ্বর শিবের ও শ্রীগুরুদেবের কৃপায় শৈবধর্মের নামে প্রচারিত হও সকল অপপ্রচারের উত্তর দেবো ।
শৈব সনাতন ধর্মের জয় 🔥
শিবধর্মের জয় 🔥
বৃষভ নন্দী মহারাজের জয় 🔥
________________________________________________
________________________________________________
অদ্বৈত শৈব পরম্পরা ও আদি শঙ্করাচার্যের নব্য ব্রহ্মবাদী স্মার্ত পরম্পরার মধ্যে কার প্রাচীনত্ব অধিক ও কার সিদ্ধান্ত শ্রেষ্ঠ ?
নিম্নলিখিত আলোচনায় আদি শঙ্করাচার্যপন্থীদের দাবীর উপস্থাপন এবং শৈবদের পক্ষ থেকে সেই আদিশঙ্করপন্থীদের দাবীর খণ্ডন হিসেবে সমগ্র প্রবন্ধ টি উপস্থাপন করা হয়েছে, ধৈর্য্য সহকারে শুরু থেকে সমাপ্ত পর্ব পর্যন্ত পড়বেন ও নিজের নিরপেক্ষ বিচার বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করে আপনার যে পক্ষকে অনুসরণ করা উচিত বলে মনে হবে, আপনি তাকে অনুসরণ করুন।
🚫 আদিশঙ্করাচার্য্য পন্থী স্মার্তবাদীদের দাবী — (১)
আদিগুরু শঙ্করাচার্য্য ভগবৎপাদ জী একমাত্র অদ্বৈত ব্রহ্মবাদ দর্শনকে সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার আগে অদ্বৈত দর্শনের অস্তিত্ব ছিল না, শৈবদের অদ্বৈতবাদ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না । কারণ, শৈব রা শুধুমাত্রই দ্বৈতবাদী, শৈবরা জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে এক বলে মান্য করে না ।
🔥 অদ্বৈত শৈব মহাপাশুপত শৈবপক্ষ থেকে খণ্ডন —
(১) আদিশঙ্করাচার্য জীর জন্মের পূর্বকাল থেকেই শৈব অদ্বৈত দর্শনের অস্তিত্ব ছিল এই জগতে, তা প্রমাণ অবশ্যই করবো। কিন্তু আদিশঙ্করাচার্যের তথাকথিত নব্য ব্রহ্মবাদের তুলনায় একমাত্র প্রাচীনতম অদ্বৈতবাদ যে শৈব অদ্বৈতবাদ, তা প্রথমে প্রমাণিত করবো শাস্ত্র থেকে, যা হল প্রকৃত ব্রহ্মবাদ, কারণ ‘ব্রহ্ম’ শব্দ দ্বারা শুধুমাত্র ও একমাত্রই পঞ্চমুখধারী পরমশিব কেই সম্বোধন করা হয়েছে শাস্ত্রে, অন্য কোনো দেবতাকে ‘ব্রহ্ম’ শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়নি, ব্রহ্ম নামটি শুধুমাত্র পরমেশ্বর শিবের,
প্রমাণ দেখুন —
অতো মুনে তমুদ্দিশ্য মুনয়ঃ ক্ষীণকল্মষাঃ ।
শিবে মনঃ সমাধায় প্রাপ্তাঃ শিবমনাময়ম্ ॥ ৩৪
সর্বাত্মত্বং তয়োরেবং ব্রহ্মেত্যুপনিষৎসু চ ।
গীয়তে ব্রহ্মশব্দেন বৃহিধাত্বর্থগোচরম্ ॥ ৩৫
বৃংহণত্বং বৃহত্বং চ সদা শম্ভাখ্যবিগ্রহে ।
পঞ্চব্রহ্মময়ে বিশ্বপ্রতীতির্ব্রহ্মশব্দিতা ॥ ৩৬
[শিবমহাপুরাণ/কৈলাসসংহিতা/১৬ অধ্যায়/৩৪-৩৬নং শ্লোক]
অর্থ — অতঃ হে মুনে ! নিষ্পাপ মুনিগণ সেই শিবকেই উদ্দেশ্যে করে শিবে মন একত্রিত করে অনাময় শিবকে প্রাপ্ত করেছেন । সেই শক্তিসম্পন্ন প্রভু শিবকেই উপনিষদে সর্বাত্মা তথা ব্রহ্ম বলা হয়েছে । ব্রহ্ম শব্দের দ্বারা বৃংহি ধাত্বর্থরূপ(ধাতব অর্থ) ব্যাপকতা তথা সর্বাত্মকতার প্রতিপাদন হয় ॥ ৩৪-৩৫
শম্ভু নামক বিগ্রহ তে বৃংহণত্ব তথা বৃহৎত্ত্ব (ব্যাপকতা এবং বিশালতা) সদা বিদ্যমান । তাই সদ্যোজাত আদি পঞ্চব্রহ্মরূপধারী শিববিগ্রহতেই বিদ্যমান বিশ্বপ্রতীতি ‘ব্রহ্ম’ শব্দ দ্বারা ব্যবহৃত হয় ॥ ৩৬
[ক্ষেত্রবিশেষে, বিষ্ণু আদি অনান্য দেবদেবীকে ব্রহ্ম বলা হয় একমাত্র তাদের অন্তরে থাকা শিবতত্ত্ব বিদ্যমান, এমন দৃষ্টিকোণের বিচারে, ঔপাধিক দৃষ্টিতে ব্রহ্ম বলা হয়না]
(২) শৈব অদ্বৈতবাদে শিব ও জগৎ-জীব সকল কিছুই অভিন্ন,
প্রমাণ শিব মহাপুরাণে দেখুন —
অয়মেব হি সংসারী মায়য়া মোহিতঃ পশুঃ ।
শিবজ্ঞানবিহীনো হি নানাকর্মবিমূঢ়ধীঃ ॥ ৭৫
শিবাদভিন্নং ন জগদাত্মানং ভিন্নমিত্যপি ।
জানতোঽস্য পশোরেব মোহো ভবতি ন প্রভো ॥ ৭৬
যথৈন্দ্রজালিকস্যাপি যোগিনো ন ভবেদ্ ভ্রমঃ ।
গুরুণা জ্ঞাপিতৈশ্চর্যঃ শিবো ভবতি চিদ্ঘনঃ ॥ ৭৭
[শিবমহাপুরাণ/কৈলাসসংহিতা/১৬ অধ্যায়/৭৫-৭৭নং শ্লোক]
অর্থ — সেই জীবাত্মা পুরুষ মায়ার দ্বারা মোহিত হয়ে সংসারী (সংসারের মায়াপাশ দ্বারা বন্ধনগ্রস্ত) পশু বলে সম্বোধিত হন। শিব তত্ত্বের জ্ঞান সম্পর্কে না অবগত হবার কারণে তার বুদ্ধি নানা প্রকার মায়াময় কর্মতে আসক্ত হয়ে মূঢ়তা প্রাপ্ত হয় । সেইজিৎ জগতকে শিবের সাথে অভিন্ন বলে জানতে পারেনা তথা নিজেকে শিবের থেকে ভিন্ন ভাবতে থাকে । হে প্রভো ! যদি পরমব্রহ্ম শিবের সাথে নিজের (দেহের মধ্যে থাকা) আত্মাকে তথা জগতকে অভিন্নতার সাথে বোধ হয়ে যায় তবে এই পশু (মায়ার পাশরূপী দড়ির বন্ধন)-র পশুত্ব (জীবত্ব) থেকে মুক্ত হয়ে তবে আর কখনো এই পশুত্বে মায়াজালে বন্ধনগ্রস্ত হতে হয় না । যেমনভাবে, ইন্দ্রজাল বিদ্যার জ্ঞাতা ব্যক্তি — নিজের বানানো অদ্ভূত ইন্দ্রজালে(মায়াজালে) ভ্রমিত হন না । তেমনভাবেই, (পশুত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়া) শিবজ্ঞানসম্পন্ন যোগী ব্যক্তিও কখনো মায়ায় মোহিত হন না । গুরুদেবের উপদেশ দ্বারা নিজের ঐশ্বর্যের বোধ প্রাপ্ত হয়ে যাবার পর সেই ব্যক্তি চিদানন্দ ঘন শিবরূপই হয়ে যান ॥ ৭৫-৭৭
(৩) এবার দেখুন, আদিশঙ্করাচার্য জীর জন্মের পূর্বকাল থেকেই শৈব অদ্বৈত দর্শনের অস্তিত্ব ছিল এই জগতে। পরমপবিত্র শিবমহাপুরাণের কৈলাসসংহিতার ১৭ অধ্যায়ের ৩নং শ্লোকে “শৈব অদ্বৈত দর্শন” উল্লেখ রয়েছে, যা আদিশঙ্করাচার্য্যের জন্মের বহু পূর্বের। শৈব অদ্বৈতবাদ বিষয়ে পরমেশ্বর শিবের পুত্র ভগবান কার্তিকেয় জী স্বয়ং পবিত্র বচন প্রকাশ করেছেন। বিস্তারিত দেখুন, এখানে প্রমাণ —
অদ্বৈতশৈববাদোঽয়ং দ্বৈতং ন সহতে ক্বচিৎ ।
দ্বৈতং চ নশ্বরং ব্রহ্মাদ্বৈতং পরমনশ্বরম্ ॥ ৩
সর্বজ্ঞঃ সর্বকর্তা চ শিবঃ সর্বেশ্বরোঽগুণঃ ।
ত্রিদেবজনকো ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ ॥ ৪
স এব শঙ্করো দেবঃ স্বেচ্ছয়া চ স্বমায়য়া ।
সঙ্কুচদ্রূপ ইব সন্পুরুষঃ সংবভূব হ ॥ ৫
[শিবমহাপুরাণ/কৈলাসসংহিতা/১৭ অধ্যায়/৩-৫নং শ্লোক]
অর্থ — এটিকে ‘অদ্বৈত শৈববাদ’ বলে , যে স্থানে (শিবস্তরে শিব ভিন্ন অন্য) দ্বৈত ভাবের কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণ, দ্বৈত নশ্বর আর অদ্বৈত হল অবিনাশী ব্রহ্ম । প্রভু শিব হলেন স্বয়ং সর্বজ্ঞ, সর্বকর্তা, সর্বেশ্বর, নির্গুণ হয়েও ত্রিদেব(ব্রহ্মা-হরি-সংহারক রুদ্র)-র জনক(পিতারূপী স্রষ্ঠা) ব্রহ্ম, সচ্চিদানন্দ বিগ্রহস্বরূপ ধারী, সেই একমাত্র পরমদেবতা শঙ্কর নিজের ইচ্ছেমতো নিজের মায়ার দ্বারা নিজেকে সঙ্কুচিত করে পুরুষরূপে নিজেকে প্রকট করেন ॥ ৩-৫
(৪) ঐ ব্রহ্ম-শিবের আরাধনাকারী শৈব ব্যক্তিগণই একমাত্র বেদের পথ অনুসরণকারী, নব্য আদিশঙ্করপন্থী অশৈবাচারীগণ নয়। প্রমাণ দেখুন —
স্ত্রীপুংরূপমিদং বিশ্বং শিবশক্ত্যাত্মকং বুধৈঃ ।
ভবাদৃশৈরূপাস্যং স্যাৎ শিবজ্ঞানবিশারদৈঃ ॥ ৩৩
সর্বং ব্রহ্মেত্যুপাসীত সর্বং বৈ রুদ্র ইত্যপি ।
শ্রুতিরাহ মুনে তস্মাৎপ্রপঞ্চাত্মা সদাশিবঃ ॥ ৩৪
[শিবমহাপুরাণ/কৈলাসসংহিতা/১৭ অধ্যায়/৩৩-৩৪নং শ্লোক]
অর্থ — (ভগবান কার্তিকেয় জী বললেন) শিবজ্ঞানবিশারদ ব্যক্তিদের এই শিবেরই উপাসনা করা উচিত। কারণ এই সমগ্র বিশ্ব শিবশক্ত্যাত্মক অর্থাৎ শিবের শক্তি দ্বারাই ব্যাপ্ত।
হে মুনে ! ‘এইসব ব্রহ্ম’ ‘এইসব রুদ্র’ — এমনটা মান্য করে শিবেরই উপাসনা করা উচিত, কারণ এটিই শ্রুতি(বেদ) বলে। এই কারণেই সদাশিব এই প্রপঞ্চের আত্মা বলে অভিহিত হন ।
• সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ/৩/১৪/১)
• সর্বো বৈ রুদ্র (কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/ তৈত্তিরীয় আরণ্যক/ ১০ ম প্রপাঠক- পরিশিষ্ট /২৪ নং অনুবাক)
(৫) আদিশঙ্করাচার্যের মতবাদ অনুসারে, যে কোনো দেবদেবীকেই ব্রহ্ম বলে মেনে নেওয়ার পন্থা ব্রহ্মবাদ নয় বরং তা মায়াবাদ । কারণ, সঠিক গুরু একমাত্র তিনিই, যিনি আত্মাকে ব্রহ্ম বলতে পরমেশ্বর শিবকেই মানেন, অন্য কোনো অনিত্য দেবদেবীকে নয়। আর ভগবান কার্তিকেয় জী বলেছেন, অদ্বৈত শৈব দর্শন ও শৈব অদ্বয়বাদীদের বিষয়ে তার বলা বচনকে যে ব্যক্তি মিথ্যা ভাববেন তাকে স্কন্দ জী শাস্তি প্রদান করবেন।
প্রমাণ দেখুন —
সদাশিবোঽমেবেতি ভাবিতাত্মা গুরুঃ শিবঃ ॥ ৩৫
এবংবিচারী সচ্ছিষ্যো গুরুঃ স্যাৎস শিবঃ স্বয়ম্ ।
প্রপঞ্চদেবতাযন্ত্রমন্ত্রাত্মা ন হি সংশয়ঃ ॥ ৩৬
আচার্যকৃপয়া বিপ্র সংছিন্নাখিলবন্ধনঃ ।
শিষ্যঃ শিবপদাসক্তো গুর্বাত্মা ভবতি ধ্রুবম্ ॥ ৩৭
রাগাদিদোষরহিত বেদসারং শিবোদিতম্ ।
তুভ্যং মে কথিতং প্রীত্যাদ্বৈতজ্ঞানং শিবপ্রিয়ম্ ॥ ৩৯
যো হ্যন্যথৈতন্মনুতে মদ্বচো মদগর্বিতঃ ।
দেবো বা দানবঃ সিদ্ধো গন্ধর্বো মনুজোঽপি বা ॥ ৪০
দুরাত্মনস্তস্য শিরঃ ছিন্দ্যসমনয়া ধ্রুবম্ ।
সচ্ছক্ত্যা রিপুকালাগ্নিকল্পয়া ন হি সংশয়ঃ ॥ ৪১
ভবানেব মুনে সাক্ষাৎ শিবাদ্বৈতবিদাং বরঃ ।
শিবজ্ঞানোপদেশে হি শিবাচারপ্রদর্শকঃ ॥ ৪২
[শিবমহাপুরাণ/কৈলাসসংহিতা/১৭ অধ্যায়/৩৬-৩৭নং শ্লোক]
অর্থ — ‘আমি ও সদাশিব অভিন্ন’ - এমন অদ্বৈত ভাবনা যে গুরুর রয়েছে, তিনি সাক্ষাৎ শিবস্বরূপ স্বয়ং তথা সেই শিবস্বরূপ গুরুই প্রপঞ্চ, দেবতা, যন্ত্র তথা মন্ত্রস্বরূপও তিনিই, এতে কোনো সংশয় নেই। এই ভাবে বিচারকারী যিনি সেই গুরুর শিষ্য , তিনিও শিবস্বরূপ হয়ে যান ।
শৈব আচার্যের কৃপায় সমস্ত রকমের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে শিবচরণের প্রতি আসক্ত শিষ্য নিশ্চিতভাবে মহান আত্মজ্ঞানী হয়ে যান ॥ ৩৫-৩৭
রাগাদি দোষহীন, বেদের সারস্বরূপ, শিবপ্রিয় তথা পরমেশ্বর শিবের দ্বারা কথিত এই পরমপবিত্র অদ্বৈত শৈব জ্ঞান অত্যন্ত প্রীতিপূর্ণ ভাবে বললাম ॥ ৩৯
যে ব্যক্তি অহংকারের বশবর্তী হয়ে আমার(কার্তিকেয়র) এই কথাকে মিথ্যা বলে ভেবে প্রচার করবে, তিনি দেবতা দানব সেদ্ধ গন্ধর্ব অথবা মনুষ্য যে কেউ হোন , আমি অবশ্যই সেই দুরাতার মস্তক ‘শত্রুদের জন্য কালাগ্নির সমান নিজের মহান শক্তি(ভেল) অস্ত্র’ দ্বারা ছিন্ন করে দেবো, এতে কোন সন্দেহ নেই ॥ ৪০-৪১
হে মুনে বামদেব ! আপনি সাক্ষাৎ শৈবাদ্বৈতবেত্তাদের মধ্যে উৎকৃষ্ট একজন আর শিবজ্ঞানের উপদেশ তথা শৈবাচারের প্রদর্শক বলে বিখ্যাত ॥ ৪২
________________________________________________
🚫 আদিশঙ্করাচার্য্য পন্থী স্মার্তবাদীদের দাবী — (২)
কিন্তু আমাদের আদি শঙ্করাচার্য পন্থীদের অদ্বৈতবাদ একমাত্র বেদের অদ্বৈতবাদ । শৈব দের অদ্বৈতবাদ কি বেদে প্রতিপাদিত অদ্বৈতবাদ ?
আর একমাত্র শিবই কেন ব্রহ্ম হতে যাবে ?
🔥 অদ্বৈত শৈব মহাপাশুপত শৈবপক্ষ থেকে খণ্ডন —
অবশ্যই ! শিবই একমাত্র পরমেশ্বর পরমব্রহ্ম। কারণ, বেদে পরমেশ্বর শিবকেই একমাত্র নির্গুণ নিরাকার ওমকার সাকার ব্রহ্ম বলা হয়েছে। পরমেশ্বর শিবই সকল দেবতার রূপ ধারণ করেন, পরমেশ্বর শিবই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-রুদ্রের উৎপত্তিকর্তা।পরমেশ্বর শিবই একমাত্র অদ্বৈত , আর সেই পরমেশ্বর শিবকেই জানবার জন্য যে অদ্বৈতজ্ঞান রয়েছে, তাকে শৈব অদ্বৈতবাদ বলে। যার শত শত প্রমাণ রয়েছে বেদ পুরাণ ইত্যাদি শাস্ত্রের।
(১) বেদের অদ্বৈতবাদই একমাত্র শৈব অদ্বৈতবাদ, কারণ পুরাণ শাস্ত্রেও বলা হয়েছে যে সর্বজগতের সবকিছুতে একমাত্র পরমেশ্বর শিবকেই যিনি দেখেন তিনিই পরমাদ্বৈতবাদী। তিনিই বৈদিক। প্রমাণ দেখুন —
সাক্ষীমাত্রতয়া নিত্যং যঃ পশ্যতি স পশ্যতি ।
পরমাদ্বৈতনিষ্ঠা হি নিষ্ঠাকাষ্ঠা সুদুর্লভা ॥১৩৪
শিবাদন্যতয়া ভ্রান্ত্যা দ্বৈতং বা বেদচেৎপশুঃ ।
পরমাদ্বৈতবিজ্ঞানী স্বয়ং তু পরদেবতা ॥১৩৫
তস্যৈব পরমা মুক্তির্ন হি সংশয়কারণম্ ।
গৌতমস্য মুনেঃ শাপাদ্দধীচস্য চ শাপতঃ ॥১৩৬
জন্মান্তরকৃতাৎপাপাদযমর্থো ন রোচতে ।
মহাপাপবতাং নৃণাং পরমাদ্বৈতবেদনে ॥১৩৭
প্রদ্বেষো জায়তে সাক্ষাদ্বেদজন্যে শিবোহপি চ।
মহাপাপবতাং নৃণাং শিবজ্ঞানস্য সাধনে ॥১৩৮
সর্বাঙ্গোদ্ধৃলনে তির্যক্রিপুঞ্জ চ ধারণে।
রুদ্রাক্ষধারণে রুদ্রলিঙ্গস্যৈব তু পূজনে ॥১৩৯
প্রদ্বেষো জায়তে নিত্যং শিবশব্দজপেহপি চ। ১৪০
বেদাদিতমহাদ্বৈতপরিজ্ঞানস্য বৈভবম্ ।
ন শক্যং বক্তুমস্মাভিস্তস্মাদেবোপরম্যতে ॥ ১৫৩
[তথ্যসূত্র - স্কন্দপুরাণ/সূতসংহিতা/যজ্ঞবৈভবখণ্ড/উপরিভাগ/(ব্রহ্মগীতা) অধ্যায় ৪]
অর্থ – সবার সাক্ষী নিজেরূপ আত্মাকে জেনে যিনি সমগ্র জগতকে সদা সাক্ষী মাত্রই বলে বুঝে নেয় তিনি বাস্তবিক বুদ্ধিমান, এটিই পরম অদ্বৈতের নিষ্ঠা । এই নিষ্ঠার চরমসীমা পাওয়া ভীষণ দুর্লভ ॥ ১৩৩-১৩৪
বিভ্রান্ত হয়ে আমরা যদি শিবকে ছেড়ে অন্য কিছু আছে বলে ভাবতে শুরু করি তবে আমরা পশু । পরম অদ্বৈতের অনুভব কারী ব্যক্তিই সাক্ষাৎ পরমদেবতা ॥ ১৩৫
তার সেই স্থিতি পরম মুক্তি বলে জানবে, এতে কোন সংশয় নেই। গৌতম আর দধীচির দেওয়া অভিশাপের কারণে তথা পূর্বজন্মকৃত পাপবশত ‘শিবই একমাত্র আমিরূপ আত্মা ভাবের পরমাদ্বৈত’ ভাবের বিষয় বুঝতে সক্ষম হয় না, এই বিষয়ে রুচিও হয় না । ঘোরপাপী ব্যক্তি সর্বদা "পরম অদ্বৈত শৈবজ্ঞান" কে দ্বেষ করে। বৈদিক বানীতে, শিবের উপর, শিবজ্ঞানের চর্চার উপায়কে, ভস্ম ধারণকে, ত্রিপুণ্ড্র তিলক ধারণের উপর, রুদ্রাক্ষধারণে, শিবলিঙ্গপূজা, শিবনাম জপ করতে দেখে এসব শৈব আচার অনুষ্ঠানের উপর একমাত্র পাপীদেরই ক্রোধ হয়, হিংসা হয়। অনেক জন্ম নিয়ে শ্রোত ও স্মৃতি শাস্ত্রোক্ত কর্ম শ্রদ্ধাপূর্বক করতে থাকার ফলে সেই ব্যক্তির শিব কৃপার দ্বারা পরম অদ্বৈতের অনুভব হয়ে থাকে, অদ্বৈত নিষ্ঠা আমারও(ব্রহ্মার) আরাধ্য(লক্ষ্যবস্তু) ॥ ১৩৬-১৪১
বেদপ্ত মহান এই অদ্বৈত এর জ্ঞানের মাহাত্ম্য আমি সম্পূর্ণ বলতে পারবো না, অতএব এত পর্যন্ত বলেই সন্তোষ প্রদান করছি ॥ ১৫৩
(২) এবার দেখুন অদ্বৈতবাদে একমাত্রই পরমেশ্বর শিবই লাভ হয়ে থাকে, একথা স্বয়ং বেদ বলছে —
তর্কতশ্চ প্রমাণাচ্চ চিদেকত্বব্যবস্থিতেঃ ।
চিদেকত্বপরিজ্ঞানে ন শোচতি ন মুহ্যতি ॥ ৪৬ ॥
অদ্বৈতং পরমানন্দং শিবং যাতি তু কেবলম্ ॥ ৪৭ ॥
[রুদ্রহৃদয় উপনিষদ]
অর্থ — যুক্তি আর প্রমাণ এই উভয় দ্বারাই চিৎ-এর একতা(অদ্বিতীয়তা) -র পরিপুষ্ট হয় (অর্থাৎ পরমাত্মা শিব ও জীবাত্মা অদ্বিতীয়)। সুতরাং, চিৎ -এর একত্বের বোধ হয়ে গেলে মানুষ ন কখনো শোকগ্রস্ত হয় আর না মোহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয় (বরং এসবের থেকে মুক্ত হয়ে যায়)। সেই মনুষ্য অদ্বৈত পরমানন্দ স্বরূপ শিব কে লাভ করে নেয় (যাকে মোক্ষ/নির্বাণ/কৈবল্যপদ/শিবত্ব লাভ বলা হয়) ॥ ৪৬-৪৭ ॥
(৩) সকলের মধ্যে অন্য কোনো দেব-দেবী নয় বরং সকলের মধ্যে একমাত্র পরমেশ্বর শিবকেই যিনি দেখেন তিনিই প্রকৃত অদ্বৈতবাদী, তিনিই সকল বর্ণের বিধি নিষেধ থেকে মুক্ত হয়ে অতিবর্ণাশ্রমী হয়ে যান, যা বেদান্তে(উপনিষদে) বর্ণিত আছে —
চণ্ডালদেহে পঞ্চাদিশরীরে ব্রহ্মবিগ্রহে ॥ ২৫
অন্যেষু তারতম্যেন স্থিতেষু পুরুষোত্তম ।
ব্যোমবৎসর্বদা ব্যাপ্তঃ সর্বসম্বন্ধবর্জিতঃ ॥ ২৬
একরূপো মহাদেবঃ স্থিতঃ সোঽহং পরামৃতঃ ।
ইতি যো বেদ বেদান্তৈঃ সোঽতিবর্ণাশ্রমী ভবেৎ ॥ ২৭
[তথ্যসূত্র - স্কন্দমহাপুরাণ/সূতসংহিতা/মুক্তিখণ্ড/অধ্যায় নং ৫]
অর্থ — তিনিই অতিবর্ণাশ্রমী হন যার অকম্প দৃঢ় নিশ্চয় হয় যে, পশু আদি অর্থাৎ চণ্ডালের শরীর থেকে ব্রহ্মার শরীর পর্যন্ত অন্য বস্তু হোক , বা তার তারতম্যেই অবস্থিত হোক, সেই সমস্ত রকমের বন্ধন থেকে যিনি রহিত সেই পরমেশ্বর মহাদেব আকাশের ন্যায় সকলের মধ্যেই এক আত্মা রূপেই স্থিত, আর সেই পরমেশ্বর মহাদেব আমিই(আত্মারূপে)। এই ভাব লক্ষণযুক্ত যিনি, তাকেই বেদবেদান্তে অতিবর্ণাশ্রমী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে ॥ ২৫-২৭
📒স্কন্দমহাপুরাণের কথন অনুসারে বেদেও অতিবর্ণাশ্রমী নিয়ে বলা হয়েছে যে, সাধারণ বর্ণাশ্রমে যারা রয়েছেন তাদের মুক্তির জন্য, অতিবর্ণাশ্রমীদের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে, দেখুন —
দ্বিতীয় খন্ড ॥
যঃ শতরুদ্রিযমধীতে সোঽগ্নিপূতো ভবতি । স বাযুপূতো ভবতি । স আত্মপূতো ভবতি । স সুরাপানাৎপূতো ভবতি ।
স ব্রহ্মহত্যাযাঃ পূতো ভবতি । স সুবর্ণস্তেযাৎ পূতো ভবতি ।
স কৃত্যাকৃত্যাৎ পূতো ভবতি । তস্মাদবিমুক্তমাশ্রিতো ভবতি ।
অত্যাশ্রমী সর্বদা সকৃদ্বা জপেৎ ।
অনেন জ্ঞানমাপ্নোতি সংসারার্ণবনাশনম্ । তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং কৈবল্যং পদমশ্রুতে কৈবল্যং পদমশ্রুত ইতি ॥ ২৫ ॥
[কৈবল্য উপনিষদ, দ্বিতীয় খণ্ড]অর্থ — যে মনুষ্য এই শতরুদ্রিয় পাঠ করে সে অগ্নির সাদৃশ্য পবিত্র হয়ে যায়, বায়ুর মতো সুচিতার বরণ করে, সে আত্মপূজা(পরমাত্মা শিবের সহিত একত্ব) করে সে সুরাপান ও ব্রহ্মহত্যার দোষ থেকেও মুক্ত হয়ে যায়, স্বর্ণ চুরির মতো পাপ থেকে মুক্ত হয়ে যায়, শুভাশুভ কর্মের দ্বারা উদ্ধার হয়ে যায়। ভগবান সদাশিবের প্রতি সমর্পিত ব্যক্তি অবিমুক্তস্বরূপকে প্রাপ্ত করে। যিনি অত্যাশ্রমী(যে ব্যক্তি বর্ণাশ্রম ও চতুরাশ্রমের বিধিনিষেধের ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছেন), সেই কৈবল্যপদপ্রাপ্তকারী(শিবপদে স্থিত) ব্যক্তিকে সর্বদা অনুসরণ করা উচিত অথবা অন্তত একবার এই কৈবল্য উপনিষদের পাঠ অবশ্যই করা উচিত ॥ ২৫ ॥
তপঃ প্রভাবাদ্দেবপ্রসাদাশ্চ ব্রহ্ম হ শ্বেতাশ্বতরহথ বিদ্বান।
অত্যাশ্রমিভ্যঃ পরমং পবিত্রং প্রোবাচ সম্যগৃষিসঙ্ঘজুষ্টম্।।২১
[শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, অধ্যায় ৬]অর্থ — বিদ্বান শ্বেতাশ্বতর তপঃপ্রভাবে ও দেবপ্রসাদে ঋষিকুল সেবিত ব্রহ্ম-শিবকে সম্যক্ বিদিত হইয়াছিলেন এবং পরে পরমপবিত্র অত্যাশ্রমীদিগকে ঐ ব্রহ্মজ্ঞান সম্পর্কে বলেছিলেন।। ২১
শিব মহাপুরাণেও শৈবদেরই অতিবর্ণাশ্রমী বলা হয়েছে —
অতিবর্ণাশ্রমী নিত্যং শিবোঽহং ভাবনাৎপরাৎ ।
শিবযোগী চ নিয়তমীশানেনাপি ধারয়েৎ ॥৩৭
[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/বিদ্যেশ্বর সংহিতা/২৪নং অধ্যায়]
অর্থ — যারা বর্ণাশ্রমের বিধিনিষেধের ঊর্দ্ধে উঠে গেছেন তারা অতিবর্ণাশ্রমী, তারা নিত্য আমিরূপী আত্মাই শিব —এমন ভাবনাতে তৎপর থাকেন, এনাদেরই শিবযোগী বলে, এনারা ঈশানমন্ত্র দ্বারা ভস্ম ধারণ করে থাকেন।।৩৭
এই শিবজ্ঞানী শৈবরা ব্রাহ্মণদেরও সেব্য অর্থাৎ বর্ণাশ্রমের অন্তর্ভুক্ত ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র ইত্যাদি ভাবনা যুক্ত সংকীর্ণবাদীদের জন্য সর্বদা বর্ণাশ্রম থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়া অতিবর্ণাশ্রমী শৈবরা সর্বদাই সেবার যোগ্য। প্রমাণ দেখুন 👇
তস্মাদ সেব্য নমস্কার্যাঃ সদা ব্রহ্মবিদস্তথা।।৩২
বর্ণাশ্রমীবিনির্মুক্তা বর্ণাশ্রমপরায়ণৈঃ।।৩৩
(লিঙ্গমহাপুরাণ, পূর্ব্বভাগ, অধ্যায় ২৮)
অর্থ — বর্ণাশ্রমের নিয়ম থেকে মুক্ত হয়ে বর্ণাশ্রমের ঊর্ধ্বে উঠে যারা 'অতিবর্ণাশ্রমী শৈব' হয়ে গেছেন সেই সমস্ত ব্রহ্মজ্ঞানী/শিবজ্ঞানী শৈবদের সমক্ষে সর্বদা নত হয়ে নমস্কার সহ সেবা করবে বর্ণাশ্রমী (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র) গণ ॥ ৩২-৩৩
🔴পরমেশ্বর শিবের ভক্ত শৈব রা সর্বদা সকল বিধি নিষেধের থেকে মুক্ত, দেখুন -
স্বতন্ত্রঃ খলু শংকরঃ ।। ৪৬
মহাদেবস্য ভক্তাশ্চ তদ্ভক্তা অপি দেহিনঃ ।
স্বতন্ত্রতা বেদবিচ্ছ্রেষ্টাঃ কিং পুনঃ স মহেশ্বরঃ ।। ৪৭
[স্কন্দমহাপুরাণ/সূতসংহিতা/যজ্ঞবৈভবখণ্ড/উপরিভাগ/(সূতগীতা) ৩ অধ্যায়/ ৪৬-৪৭ নং শ্লোক]
অর্থ - পরমেশ্বর শিব সকল বিধি নিষেধের থেকে মুক্ত, স্বতন্ত্র। যখন পরমেশ্বর শিবের অদ্বৈতবাদী অতিবর্ণাশ্রমী ভক্তশৈবরাই স্বতন্ত্র, তখন মহেশ্বরের স্বতন্ত্রতার বিষয়ে আর কি বলব ?।
👉 যিনি অতিবর্ণাশ্রমী তিনি শিবস্বরূপ হন।
আর যিনি শিব যোগী শৈব তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তাকে নির্দিষ্ট কোনো বর্ণে বাঁধা যায় না। ব্রাহ্মণের চেয়েও শ্রেষ্ঠ হলো অতিবর্ণাশ্রমী।
আর আপনারা তো ব্রাহ্মণ্যবাদী, জাতপাতের বেড়াজালের নিয়মেই সীমাবদ্ধ। আপনাদের আদি শঙ্করাচার্য চণ্ডাল শূদ্রদের ঘৃণা করতেন, অন্যদিকে সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম বলে মানতেন। যা পরস্পর স্ববিরোধী ভাবনা। তাই স্বয়ং বাবা কালভৈরব এসে আদিশঙ্করাচার্যের ব্রাহ্মণ হবার এই জাতপাতের অহংকার কে নাশ করে দিয়েছিলেন।
আর আমাদের শৈবদের এই জ্ঞান আদি শঙ্করাচার্যের জন্মের পূর্ব থেকেই ছিল, কারণ আমরা শৈবরা অতিবর্ণাশ্রমী। তাই লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য বিচার করলে শৈবদের সাথে আদি শঙ্করাচার্য্য ও আপনাদের তুলনা করলে আপনাদের নগন্যতা স্পষ্ট হয়ে যায়।
(৪) এবার প্রভু শিবই একমাত্র পরমেশ্বর তার প্রমাণ দেখুন, বেদ শাস্ত্র বলছে, পরমেশ্বর শিব স্বয়ংই ॐ, শিবই সাকার পরমব্রহ্ম, আবার শিবই নিরাকার পরমব্রহ্ম। পরমব্রহ্ম শিবকে ছাড়া দ্বিতীয় অন্য কোনো পরমেশ্বর নেই। প্রমাণ —
শিব ॐ-কার 👇
প্রযতঃ প্রণবো নিত্যং পরমং পুরুষোত্তমম্।
ওঙ্কারং পরমাত্মনং তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু ॥ ২০
(‘ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২০’ এবং
ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/ ৪ নং অধ্যায় / ১১ নং খিলা/২০ মন্ত্র)
অর্থ – যিনি প্রণবরূপি নিত্য (শাশ্বত) পরমপুরুষোত্তম (সর্বশ্রেষ্ঠ/পরাকাষ্ঠা/পুরুষ/ব্রহ্ম), যিনি সাক্ষাৎ ॐ-কার ও স্বয়ং পরমাত্মা, সেই পরমব্রহ্ম শিবের প্রতি (আমার/আমাদের) মন সংকল্পিত হউক ॥
শিব নিরাকার 👇
যোহসৌ সর্বেষু বেদেষু পঠতে হ্যজ ঈশ্বরঃ।
অকাযো নির্গুণোহধ্যাত্মা তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত ॥ ২৩
(‘ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২৩’ এবং
ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/ ৪ নং অধ্যায় / ১১ নং খিলা/২৩ মন্ত্র)
অর্থ – সমগ্র বেদ পাঠ করলে যাকে একমাত্র ঈশ্বর বলে জানা যায়, যিনি (পরমার্থে) একমাত্র নিরাকার নির্গুণ, সেই পরমেশ্বর শিবের প্রতি আমার মন সংকল্পিত হোক ॥
শিব সাকার রূপধারী 👇
কৈলাসশিখরাভাসা হিমবদিগরিসংস্থিতা।
নীলকন্ঠং ত্রিনেত্রং চ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু ॥ ২৫
(‘ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২৫’ এবং
ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/ ৪ নং অধ্যায় / ১১ নং খিলা/২৫ মন্ত্র)
অর্থ - কৈলাস পর্বতের শিখরে হিমগিরিতে যিনি বিরাজমান, যিনি নীলকণ্ঠ, ত্রিনেত্রধারী সেই পরমব্রহ্ম শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হউক ॥
📂ব্রহ্মা বিষ্ণু চেয়েও শ্রেষ্ঠ একমাত্র পরমেশ্বর শিব, তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই, প্রমাণ —
পরাৎপরতরো ব্রহ্মা তৎপরাৎপরতো হরিঃ ।
তৎপরাৎপরতো হ্যেষ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু ॥ ১৮
[ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/শিবসংকল্পসূক্ত]
এবং (ঋগ্বেদ সংহিতা/খিল ভাগ /৪/১১)
অর্থ — সর্বোপরি হলেন ব্রহ্মা । তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হরি এবং এনাদের চেয়েও যিনি পরমতম তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ‘ঈশ’ ( ঈশান/ঈশ্বর/সদাশিব) সেই শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হোক ।
🔶এবার দেখুন ! এই একই মন্ত্রকে আরো বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে
অথর্ববেদে শরভ উপনিষদের মধ্যে 👇
পরাৎপরতরং ব্রহ্মা যৎপরাৎপরতো হরিঃ ।
পরাৎপরতরোঃ ঈশঃ তস্মাৎ তুল্যোঽধিকো ন হি ॥২৯
(শরভ উপনিষদ/২৯নং মন্ত্র)
অর্থ – যিনি পরাৎপর ব্রহ্মা, তাঁর থেকেও অধিক পরাৎপর হলেন হরি। কিন্তু হরির থেকেও অধিক যিনি পরাৎপর তিনিই হলেন ঈশ(সদাশিব), সেই প্রভু শিবের সমান তথা তাঁর চেয়ে অধিক কেউ নেই ,কারণ শিবই সর্বোচ্চ সত্ত্বা পরমব্রহ্ম।
(৫) বিষ্ণু ও অনান্য সকল দেবতার রূপ পরমেশ্বর শিবই ধারণ করেন, বেদ বলেছে এই কথা —
প্রভু শিবই শ্রীবিষ্ণুরূপ ধারণ করে পালন কার্য করছেন(অথর্বশির উপনিষদ/২/২),
ব্রহ্মারূপ ধারণ করে প্রভু শিবই জাগতিক সংসার সৃজন করছেন(অথর্বশির উপনিষদ/২/১), আবার রুদ্র রূপ ধারণ করে সংহার করছেন।
বিভিন্ন দেবতার রূপে প্রভু শিবই প্রকাশমান(অথর্বশির উপনিষদ/২/১-৩৩)।
কিন্তু এই দেবতারা পরমেশ্বর শিবের অনিত্য রূপ ভেদ মাত্র। তাই এনাদের কখনোই অক্ষয় নিত্য পরমব্রহ্ম বলে স্বীকার করা হয়না, বেদই বলেছে শিবই একমাত্র ধ্যেয়, বিষ্ণু সহ অনান্য সব দেবতা প্রকৃত ধ্যেয় বস্তু নন।
দেখুন —
এক এব শিবো নিত্যস্ততোহন্যসকলং মৃষা ।
তস্মাৎসর্বাপরিত্যজ্য ধ্যেযান্বিষ্ণবাদিকারান্ ॥ ৩০
(শরভ উপনিষদ/৩০নং মন্ত্র)
অর্থ – শিবই একমাত্র নিত্য, অন্য সকল কিছুই মিথ্যা। এই কারণে বিষ্ণু সহ সকল দেবতাকে পরিত্যাগ করে শিবকেই ধ্যেয় বলে জানা উচিত ॥ ৩০
(৬) বেদের ভস্মজাবাল উপনিষদে পরমেশ্বর শিবকে ত্রিদেবের জন্মদাতা এবং ত্রিদেবের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে, অদ্বৈত বলা হয়েছে। শিব থেকে স্বতন্ত্র অন্য কোনো ব্রহ্ম নেই, নিরাকার ব্রহ্মের একটি অনিত্যরূপ নন শিব। শিব স্বয়ং পরমব্রহ্ম, ব্রহ্ম শব্দে শিবকেই ইঙ্গিত করা হয়ে থাকে, একথার প্রমাণ স্বয়ং বেদই দিয়েছে, দেখুন 👇
বৃষভারূঢ়ং হিরণ্যবাহুং হিরণ্যবর্ণং হিরণ্যরূপং পশুপাশবিমোচকং পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলং ঊর্ধ্বরেতং বিরূপাক্ষং বিশ্বরূপং সহস্রাক্ষং সহস্রশীর্ষং সহস্রচরণং বিশ্বতোবাহুং বিশ্বাত্মানং একং অদ্বৈতং নিষ্কলং নিষ্ক্রিয়ং শান্তং শিবং অক্ষরং অব্যয়ং হরি-হর-হিরণ্যগর্ভ-স্রষ্টারং অপ্রমেয়ং অনাদ্যন্তং রুদ্রসূক্তৈরভিষিচ্য সিতেন ভস্মনা শ্রীফল দলৈশ্চ ত্রিশাখৈরার্দ্রৈর-নার্দ্রৈর্বা ॥
[তথ্যসূত্র : ভস্মজাবাল উপনিষদ/২/৭]
অর্থ — যিনি বৃষভ নন্দীকে বাহন বানিয়ে তার উপর আরূঢ় হন, যার বাহু হিরণ্য অর্থাৎ স্বর্ণালী বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল, দিব্যদেহ স্বর্ণালী বর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল, যার রূপ মাধুর্য স্বর্ণালী বর্ণের ন্যায়, যিনি জীবরূপী সকল পশুর পাশরূপী বন্ধন কে মোচন করেন, যিনি স্বয়ং ব্রহ্মপুরুষ, কৃষ্ণপিঙ্গলরূপী অর্ধনারীশ্বর হিসেবে একই দেহে শক্তিদেবী উমা কে ধারণ করেন, যিনি ঊর্ধ্বরেতরূপে দেহের অভ্যন্তরের ঊর্ধ্বে সহস্রারচক্রে সকল শক্তির উৎস স্থিত, যার অসাধারণ বিরূপ ত্রিনেত্র রয়েছে, বিশ্বের সকল রূপ যার, চারিদিকে যার হাজার হাজার নেত্র রয়েছে, হাজার হাজার মস্তক রয়েছে, হাজার হাজার চরণ রয়েছে, যার বিশ্বের সকল দিকে হস্ত রয়েছে, যিনি বিশ্বের সকলের আত্মা, যিনি এক ও অদ্বিতীয় সত্ত্বা, যিনি সমস্ত কলার অতীত হিসেবে নিরাকার সত্ত্বা, যিনি সকল কিছুর স্রষ্টা ও পরিচালনাকারী হয়েও হয়েও নিজে নিষ্ক্রিয়ভাবে স্থিত তথা শান্ত রূপে সমস্তদিকে সমানভাবে শান্ত তথা স্থির, সেই প্রভু হলেন স্বয়ং শিব, এই প্রভুই অক্ষরব্রহ্ম ॐ-কার, এই প্রভুই অব্যয় অর্থাৎ বিনাশহীন, এই প্রভু শিব(সদাশিব)ই ত্রিদেবরূপী হরি(বিষ্ণু), হর(কৈলাসপতি রুদ্র) ও হিরণ্যগর্ভ(ব্রহ্মা)-র সৃজন কর্তা, তিনি অপ্রমেয়রূপে অসীম, তিনি অনাদি, তার অন্ত নেই, রুদ্রসূক্ত (শতরুদ্রিয়) পাঠপূর্বক তার (দুধ তথা জল দ্বারা) স্নান-অভিষেক করা হয়, ভস্ম প্রদান করা হয়, শ্রীফল রূপী বেলগাছের বেলফল ও ত্রিশাখাযুক্ত ভেজা বা শুকনো বেলপাতা প্রভৃতি সহ (ধুতরা প্রভৃতি বন্য)ফুল তাকে অর্পন করা হয় (আমি সেই প্রভু শিবের ধ্যানে মগ্ন) ।
• ত্রিদেব নাশ হয়ে গেলেও একজনই তখনও বর্তমান থাকেন, ভস্মজাবাল উপনিষদের বেদমন্ত্রে সেই ত্রিদেব (ব্রহ্মা-বিষ্ণু-কালরুদ্র) -এর চেয়েও ঊর্ধ্বে থাকা অদ্বিতীয় পরমব্রহ্ম শিবের কথা স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করা আছে। প্রমাণ দেখুন 👇
কৈলাসশিখরাবাসমোঙ্কারস্বরূপিণং মহাদেবং উমার্ধকৃতশেখরং সোমসূর্যাগ্নিনয়ন মনন্তেন্দুরবিপ্রভং ব্যাঘ্রচর্মাম্বরং মৃগহস্তং ভস্মোদ্ধূলিতবিগ্রহং তির্যক্ ত্রিপুণ্ড্ররেখা বিরাজমানভালপ্রদেশং স্মিতসম্পূর্ণ পঞ্চবিধ পঞ্চাননং বীরাসনারূঢ়মপ্রমেয়মনাদ্যনন্তং নিষ্কলং নির্গুণং শান্তং নিরঞ্জনমনাময়ং হুং ফট্ কুর্বাণং শিব নাম অন্যনিশমুচ্চরন্তং হিরণ্যবাহুং হিরণ্যরূপং হিরণ্যবর্ণং হিরণ্য নিধিং অদ্বৈতং চতুর্থং ব্রহ্মবিষ্ণুরুদ্রাতীতমেকমাশাস্যং ভগবন্তং শিবং প্রণম্য মুহুর্মুহুরভ্যর্চ্য শ্রীফলদলৈস্তেন ভস্মনা চ নতোত্তমাঙ্গঃ কৃতাঞ্জলিপুটঃ
[অথর্ববেদ/ভস্ম জাবাল উপনিষদ /১/১]
অর্থ — যিনি ব্যাঘ্রচর্ম পরিধান করেন, মৃগমুদ্রা হস্তে ধারণ করেন, সমগ্র দেহে ভস্ম মেখে থাকেন, যিনি কপালে ত্রিপুণ্ড্র তিলন ধারণ করেন, স্মিতহাস্যে পাঁচটিমুখ সম্পন্ন তিনি বীরাসনে বসেন, তিনিই নিষ্কল(নিরাকার পরমশিব) নির্গুণ(সকল মায়ার অতীত), শান্ত, তিনিই নিরঞ্জন। হুং ফট্ ইত্যাদি বলে শিব নাম অহর্নিশি উচ্চারণ করে সেই হিরণ্যবর্ণরূপী, হিরণ্যবাহু, হিরণ্যরূপ যার সেই প্রভুই অদ্বিতীয়, তিনিই জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তির ঊর্ধ্বে থাকা চতুর্থপদ সমাধীতে প্রাপ্ত হন যে প্রভু, যিনি নারায়ণ, ব্রহ্মা ও কালরুদ্র — এই ত্রিদেবেরও অতীত হলেন ভগবান শিব, সেই প্রভুকে প্রণাম করে বারংবার অর্চনাপূর্বক বেলফল ও বেলপত্র তথা ভস্ম দিয়ে তার কাছে বারবার নত মস্তকে কৃতাঞ্জলিপুটে নিজেকে সমর্পণ করছি।
দেখুন — ত্রিদেবের স্রষ্ঠা ও তাদের ঊর্ধ্বে থাকা প্রভু শিবই অদ্বিতীয় পরমব্রহ্ম বলেই বেদ দ্বারাই প্রমাণিত হল। শিবই একমাত্র অদ্বৈত ব্রহ্ম, অন্য কোনো দেবতা ব্রহ্ম নন। বেদের মধ্যে থাকা অদ্বৈত দর্শনকেই একমাত্র শৈব পরমাদ্বৈত অদ্বৈতবাদ বলে, যা শৈবাগম শাস্ত্রে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। পরম অদ্বৈতবাদ দ্বারা একমাত্র শিবই পরমেশ্বর, বিষ্ণু বা অন্য কেউ নয়।
• মনে রাখবেন মুখ্য উপনিষদ ও গৌণ উপনিষদ বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। ১০টি উপনিষদ মূখ্য বাকি গুলি সাম্প্রদায়িক হবার কারণে সেগুলি গৌণ উপনিষদ - এমন ভাবলে আপনি চরম মূর্খ। কারণ, বেদের কোথাও মূখ্য-গৌণ উপনিষদের বিভক্তিকরণ করবার মতো প্রমাণ নেই। প্রমাণ ছাড়া নিজের নব্য ব্রহ্মবাদকে স্থাপনের জন্য শৈব বৈষ্ণব শাক্ত দের সাম্প্রদায়িক উপনিষদগুলি গৌণ বলে ঘোষনা করা আদিশঙ্করাচার্যের অনুসারী স্মার্তবাদীদের ষড়যন্ত্র মাত্র। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কখনোই এই দাবী গ্রহণযোগ্য নয়।
বেদের মুক্তিকা উপনিষদ অনুসারে ১০৮ উপনিষদই বেদ বলে মান্য। তাই সকল উপনিষদের বচনকে পর্যবেক্ষণ ও মীমাংসা করেই যা সিদ্ধান্ত বের হবে, তা সত্য বলে জেনে তা মান্য করা আমাদের সনাতনীদের প্রধান কর্তব্য ও ইহাই ধর্ম।
______________________________________________
🚫 আদিশঙ্করাচার্য্য পন্থী স্মার্তবাদীদের দাবী — (৩)
আদিগুরু শঙ্করাচার্যের পরম্পরা সনাতন ধর্মের সবচেয়ে পুরাতন ও একমাত্র প্রাচীনতম পরম্পরা। শ্রীনারায়ণ থেকে শুরু করে ব্রহ্মা, ব্রহ্মা থেকে বশিষ্ঠ, বশিষ্ঠ থেকে পরাশর, পরাশর থেকে ব্যাসদেব, ব্যাসদেব থেকে শুকদেব, শুকদেব থেকে পতঞ্জলী, পতঞ্জলীর শিষ্য গৌড়পাদাচার্য, গৌড়পাদাচার্য থেকে গোবিন্দপাদ এবং গোবিন্দপাদাচার্য থেকে আদিগুরু শঙ্করাচার্য্য ভগবৎপাদ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে আমাদের গুরুপরম্পরা ।
কিন্তু শৈবদের পরম্পরা প্রাচীন নয়।
🔥 অদ্বৈত শৈব মহাপাশুপত শৈবপক্ষ থেকে খণ্ডন —
এটি আপনাদের আদিশঙ্করবাদীদের নিজস্ব ব্যক্তিগত মতামত, আপনাদের মতানুসারে আপনাদের পরম্পরা যদি নারায়ণ থেকে আরম্ভ হয়ে থাকে তবে বেদ অনুযায়ী নারায়ণ যে অসর্বজ্ঞ তা বৃহৎজাবাল উপনিষদের শ্রুতিতে উল্লেখ রয়েছে। সর্বজ্ঞ একমাত্র প্রভু শিব, তাই পরমেশ্বর শিবের থেকেই সমগ্র সনাতন ধর্মের গুরু পরম্পরা প্রকট হয়েছে। কারণ, বেদ আগম পুরাণ তথা সমগ্র সনাতন শাস্ত্র পরমেশ্বর শিবেরই বাক্য, পরমেশ্বর শিবই সকল শাস্ত্রের প্রকটকর্তা। তাই পরমেশ্বর শিব ছাড়া আর অন্য কেউ আদিগুরু হতে পারেনা । পরমেশ্বর শিবের থেকেই সনাতন ধর্মের একমাত্র শৈবপরম্পরা আরম্ভ হয়েছে। আপনারা আদিশঙ্করবাদীরা যে সকল মহাত্মাদের আপাদের আচার্য ভেবে রেখেছেন তারাও প্রত্যেকেই শৈব তথা শৈব আচার্য ছিলেন। আপনাদের পিতা সমতুল্য শৈব রা, শৈব পরম্পরা আপনাদের আদি শঙ্করাচার্যপন্থী স্মার্তবাদীদের চেয়েও অধিক পুরাতন ও সনাতন ধর্মের একমাত্র গুরুপরম্পরা। প্রাচীনকালে সকলেই শৈব ছিলেন। সেখান থেকেই আপনারা স্মার্ত শঙ্করাচার্যপন্থীদের শাখা প্রকট হয়েছে মাত্র ।
(১) সনাতন ধর্মের সমস্ত শাস্ত্র-বিদ্যা পরমেশ্বর শিব থেকে এসেছে, প্রমাণ দেখুন,
🔶 বিষ্ণু কে বেদ প্রদান করেছিলেন স্বয়ং পরমেশ্বর শিব -
নিগমং শ্বাসরূপেণ দদৌ তস্মৈ ততো হরঃ।
বিষ্ণবে চ প্রসন্নাত্মা মহেশঃ করুণাকরঃ ॥৫
ততো জ্ঞানমদাত্তস্মৈ রহস্যং পরমাত্মনে।
পরমাত্মা পুনর্মহ্যং দত্তবান্ কৃপয়া মুনে ॥৬
[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সৃষ্টিখণ্ড/৯নং অধ্যায়]
অর্থ - ব্রহ্মা বললেন, সেই সময় করুণাকর পরমেশ্বর শিব প্রসন্নচিত্তে শ্রীবিষ্ণুকে শ্বাসরূপে বেদ প্রদান করেছেন। হে মুনে ! এরপরে পরমাত্মা শিব শ্রীহরিকে এই বেদের গুহ্য জ্ঞান প্রদান করার পর আমাকে (অর্থাৎ ব্রহ্মাকেও) সেই বেদ প্রদান করেছিলেন ॥৫-৬
আরো দেখুন, বেদপতি পরমেশ্বর শিব -
যেনৈব বিষ্ণবে দত্তাঃ সর্বে বেদাঃ সনাতনাঃ ।
বর্ণামাত্রা হ্যনেকাশ্চ ধ্যানং স্বস্য চ পূজনম্ ॥২২
ঈশানঃ সর্ববিদ্যানাং শ্রুতিরেষা সনাতনী ।
বেদকৰ্ত্তা বেদপতিস্তস্মাচ্ছং ভুরুদাহৃতঃ ॥২৩
[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্রসংহিতা/৪২নং অধ্যায়]
অর্থ - যিনি বিষ্ণুকে সনাতন বেদের উপদেশ দিয়েছেন। অনেক বর্ণ, অনেক মাত্রা, ধ্যান তথা নিজের(অর্থাৎ শিবের) পূজার রহস্য বলেছেন। সেই ঈশান শিব সম্পূর্ণ বিদ্যার অধিপতি – এটি সনাতনী শ্রুতি অর্থাৎ বেদ এই কথা বলে, এই কারণে পরমেশ্বর শিবকে ‘বেদের প্রকটকর্তা’ তথা ‘বেদপতি’ বলা হয় ॥২২-২৩
আরো দেখুন, শরভ উপনিষদে পরমেশ্বর শিব কে ব্রহ্মাদি সকল দেবতার পিতা ঘোষণা করা হয়েছে, তিনিই বেদের প্রকট কর্তা -
প্রভুং বরেণ্যং পিতরং মহেশং
যো ব্রহ্মাণং বিদধাতি তস্মৈ ।
বেদাংশ্চ সর্বান্প্রহিণোতি চাগ্র্যং
তং বৈ প্রভুং পিতরং দেবতানাম্ ॥
[তথ্যসূত্র - শরভ উপনিষদ/২নং মন্ত্র]
অর্থ - সেই প্রভু শিবই সর্বপ্রথম প্রজাপতি ব্রহ্মাকে ধারণ করেন। সেই প্রভুই ধরণের যোগ্য, তিনিই প্রভু, তিনিই পিতা মহেশ্বর, তিনিই শ্রেষ্ঠ। তিনিই বেদের প্রথম প্রেরক পরমেশ্বর, তিনিই সবার প্রভু এবং সমস্ত দেবতাগণেরও পিতা ॥
🔷তন্ত্র, যন্ত্র, বৈদ্য, জ্যোতিষ, সামুদ্রিক ইত্যাদি বহু শাস্ত্রের প্রকটকর্তা স্বয়ং প্রভু শিব, প্রমাণ দেখুন -
তন্ত্রশাস্ত্রং সযন্ত্রং হি সপঞ্চাঙ্গং মহেশ্বরঃ ।
বভাষে মহিমানং চ তত্তদ্দেববরস্য বৈ ॥৫১
সেতিহাসকথাং তেষাং ভক্তমাহাত্ম্যমেব চ ।
সবর্ণাশ্রমধর্মাংশ্চ নৃপধর্মান মুনীশ্বর ॥৫২
সুতস্ত্রীধর্মমাহাত্ম্যং বর্ণাশ্রমমনশ্বরম্ ।
বৈদ্যশাস্ত্রং তথা জ্যোতিঃশাস্ত্রং জীবসুখাবহম ॥৫৩
সামুদ্রিকং পরং শাস্ত্রমন্যচ্ছাস্ত্রানী ভূরিশঃ ।
কৃপাং কৃত্বা মহেশানো বর্ণয়ামাস তত্ত্বতঃ ॥৫৪
[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতার/সতীখণ্ড/২৩নং অধ্যায়]
অর্থ - মহেশ্বর পাঁচ অঙ্গসহিত তন্ত্রশাস্ত্র, যন্ত্রশাস্ত্র তথা ভিন্ন ভিন্ন দেবতাদের মহিমা রহস্য বিষয়ক তত্ত্ব উদ্ঘাটন করে শোনালেন। তিনি দেবতাদের ভক্তদের মহিমা, ইতিহাস, বর্ণাশ্রমধর্ম, রাজধর্ম নিরূপন করলেন। পুত্রধর্ম, স্ত্রী ধর্মের মাহাত্ম্য সহিত বর্ণাশ্রমের অবিনাশী গাথা শোনালেন, তিনি জীবেদের সুখপ্রদানকারী বৈদ্যক শাস্ত্র (অর্থাৎ চিকিৎসাশাস্ত্র) ও জ্যোতিষ শাস্ত্র প্রদান করলেন, প্রভু পরমেশ্বর শিব কৃপাবশত উত্তম সামুদ্রিক শাস্ত্র সহ অনান্য আরো বহু শাস্ত্র প্রকাশ করলেন ॥৫১- ৫৪
🔶 শৈব আগম শাস্ত্রের প্রকট কর্তা প্রভু শিব, প্রমাণ -
শ্রীকন্ঠেন শিবেনোক্তং শিবায়ৈ চ শিবাগমঃ ।
শিবশ্রিতানাং কারুন্যাচ্ছ্রেয়সামেক সাধনম্ ॥৩৯
[তথ্যসূত্র শিবমহাপুরাণ/বায়বীয়সংহিতা/ উত্তরখণ্ড/৭নং অধ্যায়]
অর্থ - পরমেশ্বর শ্রীকন্ঠ শিব ভগবতী শিবা(পার্বতী) দেবীকে যে জ্ঞানের উপদেশ করেছেন তা শিবাগম (অর্থাৎ শৈব আগম) নামে বিখ্যাত । শিবের আশ্রিত মার্গে যে সকল ভক্ত আছেন, তাদের প্রতি কৃপা করে কল্যানের একমাত্র সাধন এই শৈব আগমের জ্ঞান উপদেশ করেছেন মহেশ্বর ॥৩৯
🔷 সকল শাস্ত্র পরমেশ্বর শিবের দেওয়া, প্রমাণ -
অঙ্গানি বেদাশ্চত্বারো মীমাংসা ন্যায়বিস্তরঃ ।
পুরাণং ধর্মশাস্ত্রং চ বিদ্যাশ্চৈতাশ্চতুৰ্দশা ॥২৫
আয়ুর্বেদো ধনুর্বেদো গান্ধর্বশ্চেত্যনুক্রমাৎ ।
অর্থশাস্ত্রং পরং তস্মাদ্বিদ্যা হ্যষ্টাদশ স্মৃতাঃ ॥২৬
অষ্টাদশানাং বিদ্যানামেতাসাং ভিন্নবর্ত্মনাম্ ।
আদিকর্তা কবিঃ সাক্ষাৎ শূলপাণিরিতি শ্রুতিঃ ॥২৭
[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/বায়বীয়সংহিতা/পূর্বখণ্ড/১ম অধ্যায়]
অর্থ - ছয় বেদাঙ্গ, চার বেদ, মীমাংসা, বিস্তারিত ন্যায়শাস্ত্র, পুরাণ এবং ধর্মশাস্ত্র - এই চোদ্দটি হল বিদ্যা। এরই সাথে আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গন্ধর্ববেদ(অর্থাৎ সঙ্গীতশাস্ত্র) ও অর্থশাস্ত্রকে - একত্রে ধরে এই বিদ্যা আঠারোটি হয়। এগুলি পরস্পর ভিন্ন, এই সব বিদ্যার আদিকর্তা অর্থাৎ প্রকাশকারী হলেন সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শূলপানি শিব, তিনি মহান কবি - ইহাই শ্রুতির বক্তব্য ॥২৫-২৭
🔶সনাতন ধর্মের সকল শাস্ত্র প্রভু শিবেরই বাক্য, প্রমাণ -
সদাশিব উবাচ্
মদ্বাক্যাদখিলংশুদ্ধ্যেন্মদ্বাক্যাদমৃতং বিষম্ ।
মদ্বাক্যাদখিলাবেদা মদ্বাক্যাদ্দেবতাদয়ঃ ॥২২৭
মদ্বাক্যাদ্ধর্মবিজ্ঞানং মদ্বাক্যান্মোক্ষ উচ্চত্যে ।
পুরাণন্যাগমাশ্চৈব স্মৃতয়ো মম বাক্যতঃ ॥২২৮
[তথ্যসূত্র - পদ্মপুরাণ/পাতাল খণ্ড/১১৪ নং অধ্যায়]
অর্থ - পরমেশ্বর সদাশিব বললেন, আমার বাক্য মাত্রেই অখিল বিশ্বসংসার শুদ্ধ হয়ে যায়। আমার বাক্যে বিষও অমৃত হয়ে যায়। আমার বাক্যই হল সমগ্র বেদ শাস্ত্র । আমার বাক্যেই দেবতারা দেবত্ব প্রাপ্ত হন। আমার বাক্যই সাক্ষাৎ ধর্ম ও বিজ্ঞান স্বরূপ। আমার বাক্যেই জীব মোক্ষলাভ করে। সমগ্র পুরাণ, আগম এবং স্মৃতিশাস্ত্র সবই আমার বাক্য ।
[পরমেশ্বর শিব ছাড়া সনাতন ধর্মের অস্তিত্ব ই নেই, তাই অসর্বজ্ঞ নারায়ণ থেকে যাদের পরম্পরা আরম্ভ হয়েছে বলে শোনা যায় তারা যে ভিত্তিহীন, এই বিষয়ে আর কোনো সন্দেহই থাকে না।
(২) ব্রহ্মা ও নারায়ণকে স্বয়ং পরমেশ্বর শিব দীক্ষা দিয়েছিলেন, প্রমাণ দেখুন -
নন্দীকেশ্বর উবাচ
পুনস্তয়োস্তত্র তিরঃ পটং গুরুঃ
প্রকল্প্য মন্ত্রং চ সমাদিশৎ পরম।
নিধায় তচ্ছীর্ষ্ণি করাম্বুজং
শনৈরুদঙ্মুখং সংস্থিতয়োঃ সহাম্বিকঃ ॥ ২৫
ত্রিরুচ্চার্যাগ্রহীন্মন্ত্রং যন্ত্রতন্ত্রোক্তিপূর্বকম্ ।
শিষ্যৌ চ তৌ দক্ষিণায়ামাত্মানং চ সমার্পয়ৎ ॥ ২৬
প্রবদ্ধহস্তৌ কিল তৌ তদন্তিকে
তমূচতুর্দেববরং জগদ্ গুরুম্ ॥ ২৭
[শিবমহাপুরাণ/বিদ্যেশ্বর সংহিতা/১০ অধ্যায়]
অর্থ — নন্দিকেশ্বর বললেন, তারপর জগদম্বা পার্বতীর সঙ্গে গুরুবর মহাদেব উত্তরাভিমুখে বসে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে আচ্ছাদনকারী বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত করে তাঁদের মস্তকে নিজের করকমল রেখে ধীরে ধীরে মন্ত্রোচ্চারণ করে তাঁদের মন্ত্রের উপদেশ দিলেন। মন্ত্র-তন্ত্রে উল্লিখিত বিধিপালনপূর্বক তিনবার মন্ত্র উচ্চারণ করে ভগবান শিব সেই দুই শিষ্যকে মন্ত্রদীক্ষা দিলেন। তখন তাঁরা দুজন গুরুদক্ষিণারূপে নিজেদেরই সমর্পণ করলেন এবং হাত জোড় করে তাঁর নিকটে দণ্ডায়মান হয়ে সেই দেবেশ্বর জগৎগুরুর স্তব করলেন ।
আরো দেখুন,
[নারায়ণ ও ব্রহ্মা উভয়েই পরমেশ্বর শিবের কাছেই দীক্ষিত হয়েছিলেন, সুতরাং আদি শঙ্করাচার্যবাদীদের নারায়ণ থেকে শুরু হওয়া পরম্পরার বিশ্বাস, পুরাণ শাস্ত্র নাকচ করে দিয়েছে, প্রমাণিত হল ব্রহ্মা বিষ্ণু উভয়েই শৈব দীক্ষায় দীক্ষিত ছিলেন।]
(২) সনাতন ধর্মের প্রকৃত নাম শিবধর্ম, যা স্বয়ং পরমেশ্বর শিব দ্বারা কথিত, এতেই ধর্ম প্রতিষ্ঠিত যা পাশুপত পরম্পরার ধর্ম নামেও বিখ্যাত, এই পাশুপত শৈব সনাতন ধর্ম শ্রেষ্ঠ যা শিলাদপুত্র নন্দী মহারাজ প্রতিষ্ঠা করেছছন আর ভগবান কার্তিকেয় তা পালন পূর্বক অনান্য ঋষিমুনিগণের কাছে তা প্রচার করে জানিয়েছেন। স্কন্দমহাপুরাণ থেকে প্রমাণ দেখুন —
রুদ্রেণ কথিতাঃ শিবধর্মাঃ সনাতনাঃ ।..॥৩৮
এতে ধর্মাঃ সুপ্রতিষ্ঠাঃ শৈলাদেন প্রতিষ্ঠিতাঃ ॥৪২
ধর্ম পাশুপতঃ শ্রেষ্ঠঃ স্কন্দেন প্রতিপালিতাঃ ॥৪৩
[তথ্যসূত্র: স্কন্দমহাপুরাণ/মাহেশ্বরখণ্ড/কেদারখণ্ড/৭ম অধ্যায়]
অর্থ: পরমেশ্বর শিব দ্বারা কথিত শিবধর্ম সনাতন নামে পরিচিত ॥৩৮
উক্ত শিবধর্মেই ধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত আছে, যা শিলাদসূত নন্দী প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই পাশুপতধর্ম শ্রেষ্ঠ, যা ভগবান কার্তিকেয় প্রতিপাদন করেছেন ॥ ১৪২-৪৩
(৩) প্রাচীনকালে সকলেই শৈব ছিলেন,
প্রমাণ দেখুন —
হিতায় সর্বমর্ত্যানাং শিবধর্মং সনাতনম্।
যেন সিদ্ধাঃসুরা দৈত্যা গন্ধর্বোরগরাক্ষসাঃ ॥৮
ঋষয়ঃ কিন্নরা যক্ষস্তথা কিংপুরুষাদয়ঃ।
তথা তথা বিবিধাশ্চান্যে শিবধর্ম পরায়ণাঃ ॥৯
সম্পূজ্যাঃ সসুরাঃ সর্বে তদ্ভক্তাঃ শিবধার্মিকাঃ ।..॥১০
[তথ্যসূত্র : শিবধর্মপুরাণ/১ম অধ্যায়]
অর্থ - মৃত্যুলোকবাসী সকল জীবের জন্য সনাতন শিবধর্ম পরমহিতকারক। এই কারণে, সমস্ত সিদ্ধগণ, দেবতাগণ, দৈত্যগণ, গন্ধর্বগণ, নাগগণ, রাক্ষসগণ, ঋষিগণ, কিন্নরগণ, যক্ষগণ তথা কিংপুরুষাদি ও অনান্য বিবিধ সকলেই শিবধর্ম পরায়ণ হয়েছেন এবং দেবতাদের সাথে শিবের পূজা করে তারা ভক্তিপূর্বক শিবধার্মিক অর্থাৎ শৈব হয়েছেন ॥৮-১০
[এখান থেকে প্রমাণিত হয়ে গেল যে, শৈবধর্ম ই সনাতন ধর্ম, প্রাচীন কালে কেউ অশৈব ছিলেন না, আদি শঙ্করাচার্য পন্থীদের অদ্বিতীয়তার অহংকার নাশ হল]
🔶 এবার দেখুন বশিষ্ঠ ঋষি স্বয়ং নিজেই একজন শৈব আচার্য ছিলেন, শিবমহাপুরাণে প্রজাপতি ব্রহ্মা তার মানসপুত্র মহর্ষি বশিষ্ঠকে বলেছেন সন্ধ্যাদেবীকে দীক্ষা প্রদান করবার জন্য, সেই প্রসঙ্গ দেখুন —
ব্রহ্মোবাচ
বসিষ্ঠ পুত্র গচ্ছ ত্বং সন্ধ্যাং জাতাং মনস্বিনীম্ ।
তপসে ধৃতকামাং চ দীক্ষস্বৈনাং যথাবিধি ॥ ৩৬
[শিব মহাপুরাণ/রুদ্র সংহিতা/সতীখণ্ড/৫ অধ্যায়]
অর্থ — ব্রহ্মাজী বললেন, হে পুত্র বশিষ্ঠ ! তপস্যা করবার বিচার করে যাওয়া আমার যে মনস্বিনী পুত্রী সন্ধ্যার কাছে যাও, তাকে দীক্ষা প্রদান করো ।
• উক্ত অধ্যায়ের ৫৬নং শ্লোকে ‘শরীরধৃগ্ ব্রহ্মচর্যং বিলসন্তং জটাধরম্’ অর্থাৎ ‘তেজস্বী ব্রহ্মচর্য পালনকারী বশিষ্ঠ জী জটাধারণ করেছিলেন’ বলে উল্লেখ আছে । শৈবরাই জটাধারণ করেন, এটি শৈবদেরই বৈশিষ্ট্য।
এবার দেখুন সন্ধ্যা দেবীকে দীক্ষা দেবার সময় বশিষ্ঠ জী কি করলেন —
বসিষ্ঠ উবাচ
পরমং যো মহত্তেজঃ পরমং যো মহত্তপঃ ।
পরমঃ পরমারাধ্যঃ শম্ভুর্মনসি ধার্যতাম্ ॥ ৬০
ধর্মার্থকামমোক্ষাণাং য একস্ত্বাদিকারণম্ ।
তমেকং জগতামাদ্যং ভজস্ব পুরুষোত্তমম্ ॥ ৬১
মন্ত্রেণানেন দেবেশং শম্ভুং ভজ শুভাননে ।
তেন তে সকলাবাপ্তির্ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ ॥ ৬২
ॐ নমঃ শঙ্করায়েতি ওমিত্যন্তেন সন্ততম্ ।
মৌনং তপঃ সমারম্ভং তন্মে নিগদতঃ শৃণু ॥ ৬৩
[শিব মহাপুরাণ/রুদ্র সংহিতা/সতীখণ্ড/৫ অধ্যায়]
অর্থ — বশিষ্ঠ জী বললে, হে দেবী ! যিনি মহান তেজঃস্বরূপ, মহান তপ তথা পরম আরাধ্য শম্ভু আছেন, মন থেকে তুমি তার ধ্যান করো ॥ ৬০
যিনি ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষের একমাত্র আদিকারণরূপ সেই সংসারের একমাত্র কারণ পুরুষোত্তমদের মধ্যেও উত্তম শিবের ভজনা করো ॥ ৬১
হে শুভাননে ! তুমি এই মন্ত্রের দ্বারা দেবেশ্বর শম্ভুর ভজনা করো, এর দ্বারা তোমার সমস্ত পদার্থের প্রাপ্তি হয়ে যাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই ॥ ৬২
‘ॐ নমঃ শঙ্করায় ॐ’ - এই মন্ত্রের দ্বারা মৌন হয়ে এই প্রকারে তপস্যা আরম্ভ করো, আমি বিধি বিষয়ে বলছি শোনো ॥ ৬৩
[ এখানে প্রমাণিত হল — বশিষ্ঠ জী শৈব আচার্য হবার কারণেই জটা ধারণ করতেন এবং দীক্ষা দেবার সময়ে শিবমন্ত্রই উপদেশ করেছিলেন]
• বশিষ্ঠ জী যে শৈবাচারী ছিলেন তার আরো পরোক্ষ প্রমাণ রয়েছে পদ্মপুরাণে —
অথ বসিষ্ঠো ভস্মাদায়াভিমন্ত্র্য ।
ব্রহ্ম-রাক্ষসং মোচয়ামাস পপ্রচ্ছ কো ভবানিতি ।।৫৪
[পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/৭১ অধ্যায়]
অর্থ — বশিষ্ঠদেব রামের গাত্রে মন্ত্রপূত ভস্ম নিক্ষেপ করিয়া ব্রহ্মরাক্ষস থেকে মুক্ত করলেন ।
♦️ এবার দেখুন পরাশর স্বয়ং নিজেই একজন শিবভক্ত শৈব ছিলেন। বশিষ্ঠ ঋষির পুত্র শক্তি, শক্তির পুত্র পরাশর মুনি। এই পরাশর মুনি যখন তার মাতা অদৃশ্যন্তীর গর্ভে ছিল তখন বশিষ্ঠ জীর উদ্দেশ্যে ভগবান বিষ্ণু বলেছিলেন তোমার পৌত্র(নাতি) একজন মহান শিবভক্ত হবেন, প্রমাণ দেখুন —
রুদ্রভক্তশ্চ গর্ভস্থো রুদ্রপূজাপরায়ণঃ ।
রুদ্রদেবপ্রভাবেণ কুলং তে সন্তরিষ্যতি ॥ ২২
[লিঙ্গপুরাণ/পূর্বভাগ/৬৪ অধ্যায়]
অর্থ - হে মুনি ! তোমার যে পৌত্র এখন গর্ভস্থ অবস্থায় তার মায়ের গর্ভে রয়েছে, সে শিবভক্ত হয়ে শিবপূজা পরায়ণ হবে। শিবের কৃপার প্রভাবে তোমার কুলের উদ্ধার হবে ।
[ এখানে প্রমাণিত হল — পরাশর মুনি জী শৈব ছিলেন]
♦️এবার দেখুন পরাশর মুনির পুত্র বেদব্যাস জী স্বয়ং নিজে একজন শিবভক্ত শৈব শিরোমণি ছিলেন। শিব মহাপুরাণের বিদ্যেশ্বর সংহিতাতে পুরাণ বিষয়ে ব্যাসদেবের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাকে শৈব শিরোমণি বলা হয়েছে
প্রমাণ দেখুন —
শৈবং পুরাণমমলং শিবকীর্তিতং তদ্
ব্যাসেন শৈবপ্রবণেন চ সংগৃহীতম্ ।..।। ৬৫
[শিব মহাপুরাণ/বিদ্যেশ্বর সংহিতা/২ অধ্যায়]
অর্থ - এই নির্মল শিব মহাপুরাণ পরমেশ্বর শিব দ্বারাই প্রতিপাদিত হয়েছে, একে শৈবশিরোমণি ব্যাস সংক্ষেপে সংকলিত করেছেন ।
🧿অনেকে দাবী করতে পারেন যে, ব্যাসদেব বৈষ্ণব ছিলেন। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। কারণ এটি ঠিক যে ব্যাসদেব প্রথমে বিষ্ণুকেই একমাত্র পরমেশ্বর মনে করতেন। কিন্তু তার অহংকার কে বিনাশ করে দিয়েছিলেন স্বয়ং নন্দী মহারাজ, তারপর থেকে ব্যাসদেব মহাদেবেরই ভক্ত তথা শৈব হয়ে যান । এই বিষয়ে স্কন্দ মহাপুরাণ এর কাশীখণ্ডের উত্তরার্ধের ৯৫ তম অধ্যায়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে ।
♦️এবার দেখুন বেদব্যাস জীর পুত্র শুকদেব স্বয়ং নিজে একজন শৈব শিরোমণি ছিলেন, তিনি শিবেরই ধ্যান করতেন, এই কথা বেদের শরভ উপনিষদে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রমাণ দেখুন —
বসিষ্ঠবৈযাসকিবামদেববিরিঞ্চিমুখ্যৈহৃদি ভাব্যমানঃ ।
সনৎসুজাতাদিসনাতনাদ্যৈরীভ্যো মহেশো ভগবানাদিদেবঃ ॥ ১৯
[তথ্যসূত্র - শরভ উপনিষদ/১৯নং মন্ত্র]
অর্থ – বসিষ্ঠ, বামদেব, বিরিঞ্চি (ব্রহ্মা) এবং শুকদেবের ন্যায় ঋষি নিরন্তরভাবে যে প্রভুর ধ্যানে মগ্ন থাকেন এবং সনৎ সুজাত আদি, সনাতন আদি ঋষি যে প্রভুর স্তুতি করে থাকেন, সেই ভগবান মহেশ্বর হলেন দেবতাদেরও পূর্ববর্তী আদিদেব (পরমেশ্বর)।
[দেখুন, শুকদেবও শৈব প্রমাণিত হয়ে গেলেন]
♦️ এবার দেখুন ঋষি পতঞ্জলী স্বয়ং নিজে একজন শৈব আচার্য ছিলেন,
প্রমান দেখুন —
অস্থিব্যাঘ্রপুরং নাম তিল্লিকাননমধ্যগম্ ।
যত্র নৃত্যন্তমীশানং পর্য্যুপাস্তে পতঞ্জলিঃ ॥ ৪২
(স্কন্দমহাপুরাণ/মাহেশ্বরখণ্ড/অরুণাচল মাহাত্ম্য/উত্তরার্দ্ধ/২ অধ্যায়/৪২ নং শ্লোক)
অর্থ — তিল্লিকাননের মধ্যে স্থিত ব্যাঘ্রপুর নামক নামক এক তীর্থে পতঞ্জলি নৃত্যকারী নটরাজ ঈশানের উপাসনা করেন ।
🔖নন্দীকেশ্বর কাশিকার উপর ব্যাঘ্রপাদমুনির পুত্র সাক্ষাৎ মহর্ষি উপমন্যু শৈবাচার্য জী ভাষ্য করেছেন। তিনি নন্দীকেশ্বর কাশিকার ভাষ্যে যা উল্লেখ করেছেন, তা দেখুন এবার 👇
ইহ খলু সকললোকনায়কঃ পরমেশ্বর পরমশিবঃ সনক-সনন্দন সনৎকুমারাদীন্ শ্রোতৃন্ নন্দিকেশ্বর-পতঞ্জলি ব্যাঘ্রপাদ-বসিষ্ঠাদীংশ্চ উদ্ধর্তুকামো ঢক্কানিনাথব্যাজেন চতুর্দশ সূত্রাত্মকং তত্ত্বমুপদিদেশ । (শ্রীনন্দিকেশকাশিকা)
অর্থ — এরপর সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধিপতি পরমশিব, হাতের ডমরু বাজানোর ছলে ১৪ টি সূত্র শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত সনক, সনন্দন, সনৎকুমার এবং নন্দীকেশ্বর, পতঞ্জলি, ব্যাঘ্রপদ এবং বশিষ্ঠ প্রভৃতিকে এটিকে আরো বিস্তারিত করে প্রচারের নির্দেশ দেন।
তদনু তে সর্বে মুনীন্দ্রবর্যাঃ চিরকালমাশ্রিতানামস্মাকং চতুর্দশসূত্রাত্মকং তত্ত্বমুপদিদেশেতি মত্বা অস্য সূত্রজালস্য তত্ত্বার্থ নন্দিকেশ্বরো জানাতীতি নন্দিকেশ্বরং প্রণিপত্য পৃষ্টবন্তঃ । তেষু পৃষ্টবৎসু স ষড়বিংশতিকারিকারূপেণ তত্ত্বং সূত্রাণামুপদেষ্টুমিচ্ছন্নিদমাচচক্ষে নৃত্তেতি । (শ্রীনন্দিকেশকাশিকা)
অর্থ — এর পর, সেই মহামুনিগণ এইভাবে ভাবলেন: “পরমেশ্বর স্বয়ং আমাদের যেসব মুনিগণেদের তাদের চৌদ্দটি সূত্র সম্পর্কে অবগত করিয়েছেন। নন্দীকেশ্বর মহারাজ এই সূত্রগুলির প্রকৃত তাৎপর্য জানেন।” নন্দীকেশ্বরকে অভিবাদন জানিয়ে তারা নন্দীমহারাজকে জিজ্ঞাসা করলেন। তাদের জিজ্ঞাসা শুনে তারপর ঐ সূত্রগুলির তাৎপর্য বোঝাবার জন্য তিনি তাদের ছাব্বিশটি শ্লোকে (কারিকা) ব্যাখ্যা করলেন, যা শুরু হয়েছিল এভাবে। (সেগুলিই শ্রীনন্দীকেশ কাশিকা নামে বিখ্যাত)
আরো দেখুন, স্কন্দউপপুরাণ অর্থাৎ শিবভক্তবিলাসে সূতমুনি ঐ গ্রন্থশাস্ত্র পাঠের সর্বপ্রথমে পরমেশ্বর শিব সহ সকল শৈব আচার্য দের স্মরণ করে তারপর এই শিবভক্তিবিলাস বলতে আরম্ভ করেছিলেন, এবার সেই প্রমাণ দেখুন —
ইতি পৃষ্টো মুনিবরৈঃ সূতঃ সর্বার্থতত্ত্ববিৎ ।
নমস্কৃত্বা মহাভাগঃ শিবায় গুরুমূর্তয়ে ॥ ১১
বিঘ্নেশং ভারতীং দেবীং মহাসেনং চ নন্দিনম্ ।
মহাবিষ্ণুং চ ধাতারং পার্বতীমদ্রিকন্যকাম্ ॥ ১২
বেদব্যাসমগস্ত্যং চ ব্যাঘ্রপাদং পতঞ্জলিম্ ।
দধীচি ভার্গবং রামং জৈমিনিং গৌতমং ভৃগুম্ ॥ ১৩
উপমন্যুং চ কৌন্তেয়ং মার্কণ্ডেয়ং মহামুনিম্ ।
বেদশাস্ত্রগুরুনন্যান্ সম্প্রদায়গুরুনপি ॥ ১৪
শিবভক্তান্ মহাভাগান্ নত্বায়ং করণৈস্ত্রিভিঃ ।..॥ ১৫
[স্কন্দউপপুরাণ(শিবভক্তবিলাস)/১ম অধ্যায়/১১-১৫ নং শ্লোক]
অর্থ — মুনিগণেরা যখন সর্ব তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত সূত মুনিকে জিজ্ঞাসা করলেন তখন সূত জী প্রথমে এভাবে প্রণাম করতে করতে বললেন, আমি সেই শ্রীগুরু দক্ষিণামূর্তি শিবকে প্রণাম করি, তারই সহিত গণেশ, দেবী সরস্বতী, কার্তিকেয়, নন্দী মহারাজ, মহাবিষ্ণু, ব্রহ্মা, মাতা হৈমবতী পার্বতীদেবী, গুরু ব্যাসদেব, ঋষি অগস্ত্য, ব্যাঘ্রপাদ মুনি, ঋষি পতঞ্জলি, মহর্ষি দধীচি, পরশুরাম, জৈমিনি, ঋষি গৌতম, ভৃগু ঋষি, মহর্ষি উপমন্যু, শিবভক্ত কৌন্তেয়(অর্জুন), মার্কণ্ডেয় আদি শিবভক্ত শৈব আচার্যদের, তার সহিত বেদ শাস্ত্রের অনান্য যত গুরু আছেন তাদের তথা শৈব পরম্পরার মধ্যে থাকা অনান্য সকল সম্প্রদায়ের শৈবগুরু তথা সকল শিবভক্ত কে একত্রে মন,বাণী ও শরীর এই তিন প্রকারেই নমস্কার করি ॥ ১১-১৫
[লক্ষ্য করুন, শৈব আচার্য দের প্রণাম করতে গিয়ে পতঞ্জলী কেও শৈব হিসেবে প্রণাম করেছেন সূতমুনি, অর্থাৎ মহর্ষি পতঞ্জলি যে একজন শৈব আচার্য ছিলেন, এতে আর কোনো সন্দেহই থাকে না।]
• ভৃগু ঋষি প্রথমে বিষ্ণুভক্ত ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে বিষ্ণুকে ত্যাগ করে শৈব হয়ে যান (প্রমাণ : লিঙ্গমহাপুরাণ/উত্তরভাগ/অধ্যায় নং ৫/১৫৫-১৫৬ নং শ্লোক)
এছাড়া ১৮ জন শৈব সিদ্ধার দের মধ্যে মহর্ষি পতঞ্জলি অন্যতম একজন। তিনি মহেশ্বরের নটরাজ রূপ দর্শন করে কৃতার্থ হবার জন্যই শেষনাগ থেকে অবতার গ্রহণ করে ব্যাঘ্রপুরে নৃত্যরত নটরাজের উপাসনা করে তার দর্শন লাভ করেছিলেন। যে নটরাজকে দক্ষিণ ভারতে ‘চিদম্বর’ বলে ডাকা হয়।
এখন আপনাদের আদি শঙ্করাচার্য্যের স্মার্তবাদীদের মতানুসারে,
আদি শঙ্করের গুরুদেব গোবিন্দপাদ(চন্দ্রশর্মা) জী সেই চিদম্বরে গিয়ে ব্যাকারণের জ্ঞান অর্জন করতে চেয়েছিলেন। চিদাম্বরমে পতঞ্জলির ব্যাকরণের ব্যাখ্যা শোনার জন্য তিনি দক্ষিণে আসছিলেন। নর্মদা নদীর তীরে তিনি গৌড়পাদকে দেখতে পান, যিনি পতঞ্জলির অভিশাপে অনুমতি ছাড়াই শিক্ষা পূর্ণ হবার পূর্বেই শিক্ষাস্থান ত্যাগ করার জন্য ব্রহ্মরাক্ষসে পরিণত হয়েছিলেন। পতঞ্জলি আদেশ দিয়েছিলেন যে গৌড়পাদ যখন বিদ্যা শেখার জন্য উপযুক্ত শিষ্য পাবেন তখন অভিশাপ থেকে মুক্ত হবেন। চন্দ্র শর্মার আগমনের আগ পর্যন্ত, যে পণ্ডিতই সেই পথে এসেছিলেন, ব্রহ্মরাক্ষসরূপী গৌড়পাদ তাদের প্রত্যেকে একটি জটিল শব্দের সমাপ্তিতে ভুল করেছিলেন , ফলে ব্রহ্মরাক্ষস তাদের গ্রাস করেছিলেন। কিন্তু চন্দ্র শর্মা ব্যতিক্রম প্রমাণিত হয়েছিলেন। তিনি সঠিক সমাপ্তিটি দিয়েছিলেন। অভিশাপ অপসারণের সময় এসেছিল। গৌড়পাদ চন্দ্র শর্মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি কোথায় যাচ্ছেন। পতঞ্জলির শিক্ষা শিখতে তিনি চিদাম্বরমের কাছে যাচ্ছেন, গৌড়পাদ বলেন যে চিদাম্বরমের ব্যাখ্যা শেষ হয়ে গেছে এবং তিনি নিজেই যুবকটিকে শিক্ষা দেবেন বলে জানান। কিন্তু শর্ত ছিল যে ব্রহ্মরাক্ষস যে গাছে বসেছিলেন সেখান থেকে না নেমে এবং ঘুমিয়ে না থেকে শিষ্যকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যা পতঞ্জলি শিখিয়েছিলেন তা চন্দ্রশর্মাকে শিখতে হবে। লেখার উপকরণ না পেয়ে, চন্দ্র শর্মা তার উরুতে গভীর আঁচড় মারলেন এবং বেরিয়ে আসা রক্ত দিয়ে গাছের পাতায় যা শেখানো হয়েছিল তা লিখে ফেললেন। নয় দিন ধরে রাত-দিন এই নির্দেশনা অব্যাহত ছিল। এভাবে শিষ্যকে নয় দিন ধরে না খেয়ে থাকতে হয়েছিল এবং না ঘুমিয়ে থাকতে হয়েছিল। তার নির্দেশনা শেষ হওয়ার পর, চন্দ্র শর্মা ঐ পাতাগুলি সংগ্রহ করে একটি থোকায় বেঁধে তার গুরুর কাছ থেকে বিদায় নেন। তারপর বহু ঘটনার কথা আপনারা উল্লেখ করেন।
এই ঘটনার কথা যে আপনাদের আদি শঙ্কর পন্থীদেরই দাবী, তা আপনাদেরই Sri Kanchi Kamakoti Sankara Mandir প্রকাশনির থেকে প্রকাশিত ‘Preceptors of Advaita’ নামক পুস্তকের ৪৫ নং পৃষ্ঠায় ‘Govinda Bhagavatpāda’ অনুচ্ছেদে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।
কিন্তু শেষ মেষ এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে ঐ মহর্ষি পতঞ্জলির মাধ্যমেই আপনারা আদিশঙ্করবাদীরা সনাতন ধর্মের একমাত্র আদি, শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র নিরপেক্ষ অদ্বৈত ব্রহ্মবাদী পরম্পরার বলে নিজেদের দাবী করেন।
এই ধরণের দাবী কতটা হাস্যকর একটু ভাবুন,
যেখানে প্রাচীন মুনি ঋষি সকলেই শৈব ছিলেন, ব্রহ্ম বলতে সকলেই পরমেশ্বর শিবকেই জেনে একমাত্র শিবেরই ধ্যান করতেন, শৈবাচার পালন করতেন। সেখানে পঞ্চদেবতার পঞ্চায়তন পূজার একটা মতবাদ এনে ব্রহ্মবাদের দোহাই দিয়ে পরমেশ্বর শিবকে ছেড়ে যে কোনো দেবতার ভক্ত তার পছন্দের দেবদেবীকে ব্রহ্ম হিসেবে মেনে নিয়ে, সেই দেবতা বা দেবীর থেকে শিব জন্ম নেওয়া একজন সাধারণ দেবতা হিসেবে ভেবে নিতে পারবে বলে চরম বেদবিরুদ্ধ মতবাদ স্থাপন করেছেন, তাও আবার সেসব বলেছছন ব্রহ্মবাদের অছিলায়। আর তা সমাজে প্রতিষ্ঠিতও করে ফেলেছেন।
লজ্জা থাকা উচিত আপনাদের, আপনারা শৈবদের মহাপাশুপত পরম্পরার আচার্যদের কে আদিশঙ্করাচার্যের গুরু পরম্পরা বলে দাবী করেন।
অথচ তারা সকলেই শৈবাচার পালনকারী ছিলেন। আপনারা শ্রীনারায়ণ থেকে আপনাদের পরম্পরা আরম্ভ হয় বলেছেন অথচ সেটিও সম্পূর্ণ ভ্রান্ত মতবাদ বলেই প্রমাণিত হল, কেননা পরমেশ্বর শিবই সবার গুরু, তার কাছ থেকে সনাতন ধর্ম এবং ধর্মের সকল শাস্ত্রের প্রকটকর্তা ও বক্তা পরমেশ্বর শিবই।
তাই গুরুপরম্পরা পরমেশ্বর শিব থেকেই শুরু হবে এটিই স্বাভাবিক।
যদিও আপনাদের আদি শঙ্করাচার্য্যের স্মার্তবাদীদের মধ্যেই দলাদলি আছে, আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ তো বলে বসে যে, আদিশঙ্করাচার্যের পরম্পরা নাকি দক্ষিণামূর্তি শিবের কাছ থেকে আরম্ভ হয়। তা সে যাই বলুন আপনারা তাতে সত্য বদলে যাবে না।
শৈব দের পরম্পরা ও শৈব আচার্যরাই যে আদিশঙ্করাচার্য সহ আপনাদের পিতা সমতুল্য তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট । সুতরাং আপনাদের এসব মিছা আত্মসুখ ও অহংকারে আমাদের শৈব ও শৈবপরম্পরার কিছু এসে যায় না ।
আপনাদের আদিশঙ্করবাদীদের নিজস্ব পরম্পরা বলতে তো কিছুই নেই, আমাদের শৈব দের কাছ থেকে শৈব আচার্য দেরই ধার করে নিয়ে আপনাদের নব্য নকল অদ্বৈত বাদী আদিশঙ্করপন্থী দের সব কিছু চলছে। কত বড় হাস্যকর বিষয় ।
(৪) মহর্ষি শ্বেত আচার্য হলেন এই পাশুপত শৈব সনাতন ধর্ম পরম্পরার প্রথম শৈব আচার্য
______________________________________________
🚫 আদিশঙ্করাচার্য্য পন্থী স্মার্তবাদীদের দাবী — (৪)
ঠিক আছে সব বুঝলাম, কিন্তু পঞ্চদেবতার পূজায় তো ভক্ত নিজের মতো করে নিজের পছন্দের দেবতাকে ব্রহ্ম বলে মানতেই পারেন, এতে সমস্যা কি ? শুধু মাত্র শিবই কেন ব্রহ্ম হতে যাবেন ?
🔥 অদ্বৈত শৈব মহাপাশুপত শৈবপক্ষ থেকে খণ্ডন —
পঞ্চদেবতার পূজায় ভক্ত নিজের মতো করে নিজের পছন্দের দেবতাকে ব্রহ্ম বলে মানলে অবশ্যই সমস্যা আছে, কারণ, আত্মজ্ঞানহীন হয়ে অনিত্য কোনো দেবতার পূজায় মানুষের লাভ তো কিছু হয় ই না, উল্টে সে আরো অন্ধকারে প্রবেশ করে, একথা বেদের ঈশ উপনিষদের ৯নং মন্ত্রে বলা আছে।
সমস্ত দেবতা হল একমাত্র পরমেশ্বর শিবের বিভিন্ন স্বরূপ, সুতরাং যে কোনো দেবদেবীকে পূজার সময় পরমব্রহ্ম শিবই যে ঐ দেবতার রূপে উপস্থিত আছেন, এমন ভাবনা করলেই তা আত্মজ্ঞান বলে গণ্য, এর দ্বারাই প্রকৃত পূজা হয়, কিন্তু যিনি নিজের মতো করে যে কোনো দেবদেবী কে পরমব্রহ্ম ভাবতে শুরু করে, আর পরমেশ্বর শিবের প্রকাশিত ঐ দেবদেবী এমন মনে করে না, সে আত্মজ্ঞানহীন, এর ফলে সেই দেবদেবীর ভক্ত নরক গমন করে। প্রমাণ দেখুন 👇
পরমেশ্বর শিব বললেন,
যেহন্যথা সম্প্রপশ্যন্তি মদ্ভিন্নং দেবতান্তরম্।
তে যান্তি নরকান্ ঘোরান নাহং তেষু ব্যবস্থিতঃ ॥১১৬
[কুর্মমহাপুরাণ/উপরিভাগ/অধ্যায় ১১]
অর্থ - যারা আমাকে (শিব) ভিন্ন অনান্য দেবতা সকলকে অন্য প্রকারে দর্শন করে, তারা ঘোর নরকে গমন করে এবং আমি সাক্ষাৎ শিব সেই সব ব্যক্তিগণের আত্মাতে ব্যবস্থিত থাকি না ॥১১৬
অর্থাৎ, নিজের ইচ্ছেমতো যেকোনো দেবদেবী কে পরমব্রহ্ম বা প্রধান বলে ভেবে পূজা করা যাবে না, কারণ সনাতন ধর্মের শাস্ত্র এই নির্দেশ দেয়নি।
আপনারা আদিশঙ্করবাদীরা ভেবে বসে আছেন যে, সকল দেবতার মধ্যে সামঞ্জস্যতা স্থাপন করবার জন্য আদিশঙ্করাচার্য প্রথমবার পঞ্চদেবতার পূজার প্রচলন করেছিলেন, যা আপনাদের ভ্রম মাত্র। কারণ, আমাদের শৈবদের শিবমহাপুরাণের মধ্যেই পঞ্চদেবতার উল্লেখ করে তাদের পূজা করতে বলা হয়েছে শিবলিঙ্গের সহিত, প্রমাণ দেখে নিন 👇
বিঘ্নেশাদিত্যবিষ্ণুনামম্বায়াশ্চ শিবস্য চ ।
শিবস্য শিবলিঙ্গং চ সর্বদা পূজয়েদ্ দ্বিজঃ ॥ ৮
[শিব মহাপুরাণ/বিদ্যেশ্বর সংহিতা/১৬ অধ্যায়]
অর্থ — দ্বিজদের উচিত গণেশ, সূর্য, বিষ্ণু, অম্বিকা ও শিবপ্রতিমা তথা শিবের শিবলিঙ্গকে সর্বদা পূজা করা।
এখন দেখুন! আমরা শৈবরাই প্রভাতকালে উঠে ঈশানের স্বরূপ সূর্যকে পূজা করি, তারপর পূজা কালে সর্ব প্রথম গুরুদেব সহ গণেশকে পূজা করি, তারপর সকল শিবভক্ত ও শৈবাচার্যগণকে স্মরণ ও তাদের উদ্দেশ্যে ফুল জল নিবেদন করবার শিবলিঙ্গে পরমশৈব বিষ্ণুর পূজা করি, তারপর অম্বিকা সহিত সদাশিবকে স্মরণ করে শিবলিঙ্গ ও গৌরীপীঠে পূজা করি। তাহলে পঞ্চদেবতার পূজার প্রচলন কারা সর্বপ্রথম করে এসেছেন বলুন ?
আদিশঙ্করাচার্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে অসত্য কথা বলে প্রচার করার অর্থ হল ধর্মের বিপরীতে যাওয়া।
আদিশঙ্করাচার্যের জন্মের পূর্বে বহু যুগ থেকে পঞ্চদেবতার পূজা শৈবরাই করে আসছে। আপনারা আদিশঙ্করবাদীরা কি আমাদের শৈবদের পঞ্চদেবতার পূজাকে আমাদের নতুন করে শেখাতে এসেছেন ? যদি শেখানোর ভাবনা চিন্তা করে থাকেন তাহলে আপনারা বড় ভুল করছেন, কারণ আমাদের জন্য শাস্ত্র ও শৈবাচার্য গুরুগণ রয়েছেন। আমাদের কোনো অশৈবাচারীদের কাছ থেকে ধর্মাচরণ শেখবার প্রয়োজন নেই।
🟪 এবার দেখুন 👇
পঞ্চদেবতার মধ্যেও একমাত্র শিবই প্রধান, এটি শিবমহাপুরাণ বলেছে, আদিশঙ্করাচার্যের জন্মের আগে থেকে শিবমহাপুরাণ রয়েছে জগতে। সুতরাং পঞ্চদেবতার মধ্যে কে প্রধান সেটিও একমাত্র শাস্ত্র ই ঠিক করে দেবে, আদিশঙ্করাচার্য ঠিক করবার কেউ নন। প্রমাণ দেখুন 👇
যাবদগৃহাশ্রমে তিষ্ঠেত্তাবদাকারপূজনম্।
কুর্যাৎ শ্রেষ্ঠস্য সুপ্রীত্যা সুরেষু খলু পঞ্চসু ॥৮২
অথবা চ শিবঃ পূজ্যো মূলমেকং বিশিষ্যতে।
মূলে সিক্তে তথা শাখাঃ তৃপ্তাঃ সন্ত্যখিলাঃ সুরাঃ ॥৮৩
[শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সৃষ্টিখণ্ড/১২নং অধ্যায়]
সরলার্থ : মানুষ যতক্ষণ গৃহস্থাশ্রমে (সংসারে) থাকে, ততক্ষণ পঞ্চাবরণ দেবতা এবং তাঁর মধ্যে শ্রেষ্ঠ পরমেশ্বর শিবের বিগ্রহ পরম ভক্তি সহকারে পূজা করা উচিত, অথবা যিনি সবকিছুর একমাত্র মূল, সেই ভগবান শিবের পূজাই সব থেকে বড়ো, কারণ শিবরূপ বৃক্ষের মূলে জল সিঞ্চন করলে শাখাস্থানীয় সমস্ত দেবতা স্বতঃই তৃপ্ত হয়ে যান ৷ ৮২ - ৮৩
সিদ্ধান্ত — পঞ্চদেবতার পূজার প্রচলন শৈবদেরই, যার প্রমাণ শিবমহাপুরাণ দিয়েছে। শিবের পঞ্চ আবরণ দেবতার মধ্যে বা সমস্ত দেবতার মধ্যেও উৎকৃষ্ট যিনি, সেই পরমেশ্বর শিবের আরাধনাই সর্বোপরি। তাকেই ভজনা করা উচিত, তার পূজাতেই সমস্ত দেবতা তৃপ্তি লাভ করেন। এই কারণে একমাত্র পরমব্রহ্ম হলেন একমাত্র প্রভু শিব, অন্য কেউ নয়। সকলেই শিবের রূপ, অন্য কারোর প্রকাশিত রূপ শিব নয়।
______________________________________________
🚫 আদিশঙ্করাচার্য্য পন্থী স্মার্তবাদীদের দাবী — (৫)
আপনি জানেন আদিশঙ্করাচার্য জী স্বয়ং শিব অবতার। কূর্মপুরাণের পূর্বভাগের ২৯ অধ্যায়ের ৩৩ নং অধ্যায়ে
করিষ্যত্যবতারাণি শঙ্করো নীললোহিতঃ। শ্রৌতস্মার্ত্তপ্রতিষ্ঠার্থং ভক্তানাং হিতকাম্যয়া।।
ভবিষ্যোত্তর পুরাণ অনুযায়ী কলিকালের দুইসহস্র বৎসর ব্যতীত হলে ভগবান শিবের চতুর্শিষ্যগণ সহিত মর্ত্যভুমে অবতরণের কথা বর্ণিত হয়েছে -
"কল্যব্দে দ্বিসহস্রান্তে লোকানুগ্রহকাম্যয়া ।
চতুর্ভিঃ সহ শিষ্যেস্তু শংকরোহবতরিষ্যতি।।
(ভবিষ্যোত্তর.৩৬)
ভবিষোত্তর পুরাণে বলা হয়েছে ভগবান নীললোহিত শঙ্কর কলিযুগে চারজন শিষ্য নিয়ে অবতরিত হয়ে শ্রৌতস্মার্ত মার্গকে সুগম করবেন। তাহলে আপনারা শৈবরা শিবাবতার আদিগুরু শঙ্করাচার্য্যকে নিন্দা করছেন কেন ?
সনাতন ধর্ম কে রক্ষা করবার জন্য়ে আদিগুরু শঙ্করাচার্য্য দশনামি সম্প্রদায় বানিয়েছিলেন।
🔥 অদ্বৈত শৈব মহাপাশুপত শৈবপক্ষ থেকে খণ্ডন —
আপনারাই তো বলেন সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম - সব কিছুই ব্রহ্ম।
আপনারাই বলেন তৎ ত্বমসি ব্রহ্ম - তুমিও ব্রহ্ম ।
তাহলে আদি শঙ্করাচার্য্যই শুধু শিব অবতার কেন হবেন ? এই সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সকল জীব জড় বস্তু ই তো শিব অবতার ।
আর রইল চারজন শিষ্য নিয়ে অবতরিত হবার কথা, ওহে আপনাদের মতিভ্রম ঘটেছে।
নীললোহিত শঙ্কর শব্দে আদি শঙ্করাচার্য নয় বরং নীলকন্ঠ শিব এই অর্থে বুঝিয়েছে। আর কলিযুগে ভগবান লকুলীশ অবতার রূপে পরমেশ্বর শিবই অবতরণ করবেন, একথা শাস্ত্রে বর্ণিত রয়েছে। শিবমহাপুরাণ থেকে দেখুন 👇
ভবিষ্যামি তদা ব্রহ্মণ্ লকুলী নাম নামতঃ ॥ ৪৭
কায়াবতার ইত্যেবং সিদ্ধক্ষেত্রং পরং তদা ।
ভবিষ্যতি সুবিখ্যাতং যাবদ্ ভূমির্ধরিষ্যতি ॥ ৪৮
তত্রাপি মম তে শিষ্যা ভবিষ্যন্তি তপস্বিনঃ ।
কুশিকশ্চৈব গর্গশ্চ মিত্রঃ কৌরুষ্য এব চ ॥ ৪৯
যোগিনা ব্রাহ্মণা বেদপারগা উর্ধ্বরেতসঃ ।
প্রাপ্য মাহেশ্বরং যোগং গমিষ্যন্তি শিবং পুরম্ ॥ ৫০
বৈবস্বতেঽন্তরে সম্যক্ প্রোক্তা হি পরমাত্মনা ।
যোগেশ্বরাবতারাশ্চ সর্বাবর্তেষু সুব্রতাঃ ॥ ৫১
ব্যাসাশ্চৈবাষ্টবিংশক্তা দ্বাপরে দ্বাপরে বিভো ।
যোগেশ্বরাবতারাশ্চ প্রারম্ভে চ কলৌ কলৌ ॥ ৫২
যোগেশ্বরাবতারাণাং যোগমার্গপ্রবর্দ্ধকাঃ ।
মহাশৈবাশ্চ চত্বারঃ শিষ্যাঃ প্রত্যেকমব্যয়াঃ ॥ ৫৩
এতে পাশুপতাঃ শিষ্যা ভস্মোদ্ধূলিতবিগ্রহাঃ ।
রুদ্রাক্ষমালাভরণাস্ত্রিপুণ্ড্রাঙ্কিতমস্তকাঃ ॥ ৫৪
শিষ্যা ধর্মরতাঃ সর্বে বেদবেদাঙ্গপারগাঃ ।
লিঙ্গার্চনরতা নিত্যং বাহ্যাভ্যন্তরতঃ স্থিতাঃ ॥ ৫৫
ভক্ত্যা ময়ি চ যোগেন ধ্যাননিষ্ঠা জিতেন্দ্রিয়াঃ ।
সংখ্যয়া দ্বাদশাধিক্যশতং চ গণিতা বুধৈঃ ॥ ৫৬
[শিব মহাপুরাণ/শতরুদ্র সংহিতা/৫ অধ্যায়]
অর্থ — পরমেশ্বর শিব বললেন, ভবিষ্যতে সেখানে আমার নাম হবে লকুলী। এইভাবে আমার এই কায়াবতার উৎকৃষ্ট সিদ্ধক্ষেত্র নামে কথিত হবে। যে পর্যন্ত এই পৃথিবী টিকে থাকবে, ততদিন তা লোকে বিখ্যাত থাকবে। সেই অবতারেও আমার চারজন তপস্বী শিষ্য হবেন, তাঁদের নাম কুশিক, গর্গ, মিত্র ও পৌরুষ্য হবে। তাঁরা বেদের পারঙ্গামী ঊর্ধ্বরেতা ব্রাহ্মণ যোগী হবেন এবং মাহেশ্বর যোগ প্রাপ্ত করে শিবলোকে চলে যাবেন।
উত্তম ব্রত পালনকারী মুনিগণ! পরমাত্মা শিব এইভাবে বৈবস্বত মন্বন্তরের সকল চতুর্যুগীর যোগেশ্বর-অবতারগণের সম্যভাবে বর্ণনা করেছিলেন। বিভো! আঠাশজন ব্যাস ক্রমশঃ এক এক করে প্রত্যেক দ্বাপরে হবেন এবং যোগেশ্বরাবতার হবেন প্রত্যেক কলিযুগের প্রারম্ভে। প্রত্যেক যোগেশ্বরাবতারের সঙ্গে তাঁর চার অবিনাশী শিষ্যও হবেন, যাঁরা হবেন মহাশিবভক্ত ও যোগমার্গের বৃদ্ধিকারী। পশুপতির এই শিষ্যদের দেহে ভস্ম বিভূষিত থাকবে, ললাট ত্রিপুঞ্জে সুশোভিত ও রুদ্রাক্ষের মালা তাঁদের অলংকার হবে। এই সব শিষ্যই ধর্মপরায়ণ, বেদ-বেদাঙ্গের পারগামী বিদ্বান এবং সর্বদা বাহ্যাভ্যন্তরে লিঙ্গার্চনে তৎপর থাকবেন। তাঁরা শিবে ভক্তিপরায়ণ হয়ে যোগপূর্বক ধ্যানে নিষ্ঠা রাখবেন ও জিতেন্দ্রিয় হবেন। বিদ্বানেরা এঁদের সংখ্যা একশত বারো বলেছেন।
উপরোক্ত প্রমাণ থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কলিযুগের প্রারম্ভে পরমেশ্বর শিব তার চারজন শিষ্য নিয়ে প্রকট হয়েছিলেন, সেই অবতারের নাম লকুলীশ/নকুলীশ। তার চার শিষ্যের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। তারা সকলেই বেদেরই বিদ্বান, শৈব পাশুপত পরম্পরাভুক্ত। এখানে শঙ্করাচার্যের নামগন্ধও নেই।
সুতরাং আদিশঙ্করাচার্যবাদী অন্ধ অনুসারীগণেদের ধারণা কাল্পনিক মাত্র প্রমাণিত হয়ে গেল।
এবার আমার শৈবপক্ষ থেকে কিছু প্রশ্ন রয়েছে।
আদি শঙ্করাচার্য যদি শিব অবতার ই হতে তবে কি মহাদেব বেদের মধ্যে থাকা গুহ্য অদ্বৈত শৈব সিদ্ধান্তের বিপক্ষে প্রচার করতে পারেন ?
যে পাশুপত পরম্পরার দর্শন অদ্বৈত, সেই পাশুপত পরম্পরা, তার পাশুপত শৈব অদ্বৈত দর্শনকে আদি শঙ্করাচার্য কিভাবে তার লেখা ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে অসামঞ্জস্য বলে ঘোষণা করেছিলেন ?
আদি শঙ্করাচার্য্য যদি প্রকৃত পক্ষে শিব অবতার হতেন তবে শৈব আগম শাস্ত্র কে কাল্পনিক কি করে ঘোষনা করলেন ? যে শৈব আগম শ্রুতিসম্মত, তাকে কাল্পনিক বলে কি করে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ?
আদিশঙ্করাচার্য যদি শিব অবতার হতেন তবে তিনি ব্রহ্ম সত্য জগত মিথ্যা বলে শক্তির অস্তিত্বকে অস্বীকার করা মাত্র ‘শঙ্কর বিজয়ম’ মতে আদ্যাশক্তির কাছে শিক্ষা পেলেন কেন ?
যদিও আদিশঙ্করাচার্য ঐ শিক্ষা পাবার পর প্রপঞ্চসার তন্ত্র লিখে আমাদের শৈবদের অদ্বৈতবাদকেই স্বীকার করে গিয়েছেন, সৌন্দর্যলহরীর ভাষ্য হল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আদিশঙ্করাচার্য যদি সত্যিই প্রকৃতপক্ষে শিবের অবতার হতেন তবে তিনি সবকিছুকে ব্রহ্ম বলবার পরেও চণ্ডাল শূদ্র বলে ঘৃণা কেন করতেন ?
আদিশঙ্করের ভাবনা অনুসারে আদিশঙ্করের অদ্বৈতবাদ ই যদি সর্বোপরি হয়ে থাকে তবে কালভৈরব জী এসে আদিশঙ্করাচার্য কে তার এই জাতপাত এর গোঁড়া মনভাবের অহংকার কে ধ্বংস করে আমাদের শৈবদের অতিবর্ণাশ্রম দৃষ্টিকোণের অদ্বৈততার আভাস কেন দিয়ে গিয়েছিলেন ?
আমাদের কোনো শৈব পরম্পরার কোনো আচার্য আজ পর্যন্ত আদি শঙ্করাচার্য কে শিব অবতার বলে স্বীকার করেননি। তাই আদি শঙ্করাচার্য্যের স্মার্তবাদীরা যতই আদিশঙ্করাচার্যকে শিবাবতার মানুন, আমাদের কাছে উনি কখনোই শিবাবতার নন। উনি শৈব গুরুপরম্পরার থেকে নিজের আধ্যাত্মিক যাত্রা আরম্ভ করলেও শৈব অদ্বৈত মার্গ থেকে বের হয়ে মূলত তিনি নিজস্ব ব্যক্তিগত মতপথ তৈরি করে সেই পথেই চলেছিলেন মাত্র ।
👉আদি শঙ্করাচার্য্য সবার আদিগুরু নন। আদি গুরু একমাত্র পরমেশ্বর শিব, আর অন্য কেউ নন, সবার গুরু পরমেশ্বর শিব (শিবমহাপুরাণ/বায়বীয়সংহিতা/উত্তর খণ্ড/অধ্যায় ৬)
🔶আদি শঙ্করাচার্য্য কখনোই দশনামি সম্প্রদায় সৃষ্টি করেননি, বরং এই দশনামি সম্প্রদায় শৈবদের অশ্রৌত অতিমার্গিক পরম্পরার সাধু ছিলেন। এনারা প্রাচীন কাল থেকে বেদের কর্মকাণ্ড থেকে স্বতন্ত্র হয়ে সমাজের কাছে অবৈদিক বলে অভিহিত হতেন। এনারা নিজেদের শরীরকেই বস্ত্র মেনে নিয়ে বাহ্যিক পোশাক ত্যাগ করে বস্ত্রহীন ভাবে তপস্যা করতেন। শাস্ত্র চর্চা না করে সরাসরি আত্মজ্ঞান লাভের চেষ্টা করতেন। আদি শঙ্করাচার্য্য অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সহিত তাদের মধ্যে থাকা কিছু সাধুকে নিজের বশ্যতা স্বীকার করিয়ে তাদের দিয়ে বহু শিষ্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে সমাজে প্রচার করিয়ে দিলেন যে আদি শঙ্করাচার্য্য দশনামি সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছেন। এভাবেই সমগ্র দশনামী পরম্পরা বর্তমানে আদিশঙ্করাচার্যের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিনত হয়ে যায়। কিন্তু প্রাচীন কালে এই দশনামী পরম্পরা শৈবদেরই একটি পরম্পরা বলেই গণ্য হত। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শক্তির সহায়তায় এইভাবেই সমাজে শৈবদের রীতিনীতি, মান্যতা, সংস্কার, দর্শন ও পরম্পরার অবনতি ঘটানো হয়েছে।
দশনামী পরম্পরা শৈবদেরই, এ বিষয়ে চৌখাম্বা সুরভারতী প্রকাশনির প্রকাশিত স্পন্দকারিকা (কাশ্মীর ত্র্যম্বক শৈব পরম্পরার মান্য শাস্ত্র) নামক পুস্তকে ডা. শ্যামাকান্ত দ্বিবেদী আনন্দ জী দ্বারা লিখিত ‘পরিচয় এবং পৃষ্ঠভূমি’ তে উল্লেখ করা হয়েছে। দেখুন 👇
______________________________________________
অন্তিম প্রমাণ এইখানে ক্লিক করে দেখে নিন 👇
সনাতন ধর্মের একমাত্র প্রাচীন গুরু পরম্পরা পাশুপত শৈবাপরম্পরার আচার্য ও তাদের শিষ্যদের নাম সমূহ
______________________________________________
সিদ্ধান্ত
(১) আদিশঙ্করাচার্যের স্মার্তপরম্পরার তুলনায় সনাতনধর্মের আদি ও অদ্বিতীয় পরম্পরা শৈব পরম্পরা,
(২)আদিশঙ্করাচার্যের স্মার্তপরম্পরার তুলনায় সনাতন ধর্মের একমাত্র প্রাচীনতম দর্শন হল শৈব পরম অদ্বৈত দর্শন,
(৩) প্রাচীনকালে সকলেই শিবভক্ত শৈব ছিলেন,
(৪) প্রাচীনকালের সকল মুনিঋষিগণ শৈব আচার্য ছিলেন,
(৫) আদিশঙ্করাচার্যের পূর্ববর্তী আচার্যগণও শৈব ছিলেন,
(৬) সনাতন ধর্মের এক ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বর হলেন শিব,
(৭) আদিশঙ্করাচার্যের নব্যব্রহ্মবাদের চেয়েও পুরাতন যে ব্রহ্মবাদ রয়েছে সেই ব্রহ্ম বলতে পরমেশ্বর শিবকেই বোঝানো হয় ।
(৮) অতিবর্ণাশ্রমী শৈব রা বর্ণাশ্রমী স্মার্ত শঙ্করাচার্যপন্থীদের চেয়ে সর্বোত্তম ।
(৯) আদি শঙ্করাচার্যের স্মার্তপরম্পরা শৈবপরম্পরার থেকেই উদ্ভূত একটি অবার্চিন শাখা মাত্র ।
(১০) শৈবধর্মই বর্তমানে সনাতন ধর্ম নামে পরিচিত হবার কারণে, শৈবধর্মই সর্বোৎকৃষ্ট।
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
সত্য উন্মোচনে — ©শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন