পরমেশ্বর শিবের শাসনে থাকা ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু, সূর্য তথা অন্য কোনো দেবতাকেই পরমব্রহ্ম মান্য করা যাবে না - এটি হল বেদের আদেশ
॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥
ভূমিকা —
বর্তমান কালে দেখা যায়, সনাতনীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো সূর্য চন্দ্র বায়ু প্রভৃতি যে কোনো দেবতাকে পরমব্রহ্ম বলে দাবি করে সেই নিজের ব্যক্তিগত ধারণার উপর ভিত্তি করে বলে বেড়ায় যে, সেই তাদের আরাধ্য দেবতার থেকে সকল কিছু সৃষ্টি হয়েছে, এমনকি প্রভু শিবও নাকি সেই দেবতার থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এমন ধরনের দাবি করে বেদ পুরান ইত্যাদি সকল শাস্ত্রের বিপক্ষে চলে যাচ্ছেন আজকালকারের তথাকথিত ধার্মিকেরা। তাই বেদ ও পুরাণের সহায়তায় প্রকৃতপক্ষে দেবতাদের মধ্যে পরমেশ্বর কে তা নির্ণয় করা হল এই প্রবন্ধে।
সূর্যদেব, বায়ুদেব, চন্দ্রদেব আদি দেবতারা কি স্বয়ং পরমব্রহ্ম নাকি অন্য কেউ পরমব্রহ্ম তা দেখে নেওয়া যাক। প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে সংশয় দূর করা হবে। প্রশ্ন কর্তার উত্তর দিচ্ছেন শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী।
(প্রশ্ন — ১) যে ব্যক্তির আরাধ্য হলেন সূর্যদেব, তিনি নিজের আরাধ্য সূর্যদেব একমাত্র পরমব্রহ্ম বলে ভাবলে এবং তার থেকে সকল দেবতা ও সকল কিছু উৎপন্ন হয়েছে - এমনটা ভাবলে এতে দোষ কোথায় ?
একই ভাবে যদি কেউ চন্দ্রদেব বা বায়ুদেবের ভক্ত হয়ে এই একই ভাবনা ভাবেন তাহলে সমস্যা কিসের ?
শ্রী নন্দীনাথ শৈবাচার্যের উত্তর — দেখুন ! মানুষ নিজের মতো যেমন ইচ্ছা তেমন কল্পনা করে ভাবতেই পারে কিন্তু তা কি গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে ? কোনটি ধর্ম ! কোনটি অধর্ম ! কি করা উচিত ! কি করা অনুচিত ! এই বিষয়ে আমাদের জন্য একমাত্র শাস্ত্রই ভরসা । শাস্ত্র আমাদের সকল সনাতনী দের সূর্য, চন্দ্র, বায়ু, অগ্নি প্রভৃতি সকল দেবদেবীর বিষয়ে জানিয়েছে, কোন দেবতা কি কি লীলা করেছেন, অন্য দেবতার সাথে সম্পর্ক কি, কার কাহিনী কেমন - এই বিষয়ে আমরা সবাই যা কিছু জানতে পেরেছি, তা একমাত্র শাস্ত্রের মাধ্যমেই জানতে পেরেছি। যেমন - ভগবতগীতার বাণী সকল সনাতনী ব্যক্তি শ্রদ্ধা করেন ও মেনে চলেন । কারণ, এটি আমাদের শাস্ত্র, এই শাস্ত্রের বাণী অনুসারেই মানুষ নিজের জন্য কোনটি উচিত আর কোনটি অনুচিত তা জানতে পারেন । ঠিক একই ভাবে - কে সূর্যদেব, কে চন্দ্রদেব, কে বায়ুদেব, কে অগ্নিদেব এই সকল দেবতার সঠিক পরিচয়, ক্ষমতা ও তাদের কাহিনী সম্পর্কে আমরা সঠিক তথ্য শাস্ত্র থেকেই জানতে পারবো । নিজের যা মনে হবে তার উপর ভিত্তি করে যদি সত্য নির্ণয় হত তাহলে শাস্ত্রের আর কি প্রয়োজন থাকতো । তাই সকল দেবতার বিষয়ে সঠিক তথ্য জানবার জন্য আমাদের উচিত সর্বদা শাস্ত্রের উপর নির্ভর করা।
ভগবতগীতার ১৬ অধ্যায়ের ২৩ নং শ্লোকে বলা হয়েছে - যারা শাস্ত্র অমান্য করে নিজের ব্যক্তিগত ধারণা ও বিশ্বাসকে মেনে চলে তার কখনো কোনো সুখ লাভ হয় না, পরলোকেও কোনো গতি হয় না।
সুতরাং, আমাদের উচিত সর্বদাই শাস্ত্র যেমনটা উল্লেখ করে বলেছে, সেই অনুসারেই সব কিছু মান্য করে চলা । কোন দেবতার বিষয়ে কিছু বলবার ক্ষেত্রে শাস্ত্রে সেই দেবতার বিষয়ে যা বলা হয়েছে একমাত্র সেই অনুসারেই বলা উচিত । তাই মানুষ নিজের আরাধ্য কে নিজের মতো যেমন ইচ্ছা তেমন কল্পনা করে ভাবতেই পারে কিন্তু যদি সেই ধারণা শাস্ত্রের সাথে মিলে না যায় তবে সেই ধারণা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যিনি শাস্ত্রের বলা বচন অনুসারে কোন কিছু দাবী করেন, একমাত্র তার বলা কথাটিই গ্রহণযোগ্য, শাস্ত্র বহির্ভূত কোনো কিছু গ্রহণযোগ্য নয়।
(প্রশ্ন — ২) বেদে তো সূর্য, চন্দ্র, বায়ু, অগ্নি প্রভৃতি সকল দেবতাকেই পরমব্রহ্ম হিসেবে বহু স্তুতি সূক্ত মন্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে । তবে সূর্য, চন্দ্র, বায়ু, অগ্নি প্রভৃতি সকল দেবতার ভক্তরা নিজের ইচ্ছা মতো নিজের আরাধ্য দেবতাকে একমাত্র পরমব্রহ্ম বলে ভাবলে এবং তার থেকে সকল দেবতা ও সকল কিছু উৎপন্ন হয়েছে - এমটা ভাবলে এতে দোষ কোথায় ?
শ্রী নন্দীনাথ শৈবাচার্যের উত্তর — আপনার প্রশ্নটি খুবই চমৎকার ! এই প্রশ্ন টি বহু মানুষের মনে হয়ে থাকে। এবার মীমাংসা টা জানলেই সত্য সম্পর্কে আপনার ধারণা স্থির হয়ে যাবে ।
বেদে দেবতাদের পরমেশ্বর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, একথা সত্য। কিন্তু তা বলে সকল দেবতার মধ্যে এক একজন দেবতা নির্দিষ্ট ভাবে কখনোই আলাদা আলাদা এক একটা পরমেশ্বর হতে পারেন না। কারণ, এই বেদেই বলা আছে যে,
অগ্নি,বায়ু, ইন্দ্র আদি দেবতারা অহঙ্কারের বশীভূত হয়ে পড়েছিলেন। তখন স্বয়ং ব্রহ্ম দেবতাদের সামনে যক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়ে দেবতাদের ক্ষমতা সীমিত পরিসরের বলে বুঝিয়ে শিক্ষা দেন। প্রমাণ দেখুন 👇
ব্রহ্ম হ দেবেভ্যো বিজিগ্যে তস্য হ ব্রহ্মণো বিজয়ে দেবা অমহীয়ন্ত ত ঐক্ষন্তাস্মাকমেবায়ং বিজয়োহ স্মাকমেবায়ং মহিমেতি ॥ ১
তদ্ধৈষাং বিজজ্ঞৌ তেভ্যো হ প্রাদুর্বভূব তন্ন ব্যজানত কিমিদং যক্ষমিতি ॥ ২
(তথ্যসূত্র — সামবেদ/কেন উপনিষদ/৩/১মন্ত্র)
অর্থ — দেবতাদের পক্ষে স্বয়ং ব্রহ্মই এই যুদ্ধ জয় করেছিলেন। এই জয় ব্রহ্মেরই, কিন্তু এই জয় নিজেদের মনে করে দেবতারা অহঙ্কারী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা ভাবলেন, 'এ জয় আমাদেরই-এর সব কৃতিত্ব আমাদের প্রাপ্য।'
ব্রহ্ম অবশ্যই দেবতাদের মিথ্যা অভিমানের কথা জেনে তাঁদেরই কল্যাণার্থে তাঁদের সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই দিব্যমূর্তিকে দেবতারা চিনতে পারলেন না।
বেদ মন্ত্র থেকেই প্রমাণিত হয়ে গেল, ইন্দ্র সহ সমস্ত দেবতারা অহংকারের বশবর্তী হয়েছিলেন, সেই দেবতাদের ক্ষমতা সীমিত। সেই প্রকৃত জ্ঞান দেবতাদের কাছে প্রমাণ করে দেবার জন্য স্বয়ং ব্রহ্ম প্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন দেবতাদের সামনে ।
অর্থাৎ, স্বয়ং ব্রহ্ম আর ইন্দ্র আদি দেবতারা যে এক নন, তা প্রমাণিত হয়ে গেল। এমনকি দেবতাদের ক্ষমতা ব্রহ্মের ক্ষমতার চেয়ে খুবই নগণ্য - একথা বেদের কেন উপনিষদ সাক্ষী। যিনি ব্রহ্ম - তার কোনো অহংকার থাকতে পারে না, আর যার অহংকার থাকে তিনি কখনো ব্রহ্ম হতে পারেন না। অহংকারে বশীভূত দেবতারা কখনোই স্বয়ং পরমব্রহ্ম নন। তাই কেউ যদি ভাবেন যে তার আরাধ্য দেবতা সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি, বায়ু, ইন্দ্রই একমাত্র পরমেশ্বর পরমব্রহ্ম, এনার থেকে সবাই উৎপন্ন হয়েছে — এমন ধরণের ভাবনাকে সাক্ষাৎ বেদ অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করে দিয়েছে। আর যেখানে স্বয়ং বেদ নিজে সিদ্ধান্ত দেয়, সেই সিদ্ধান্ত মান্য করা প্রত্যেক সনাতনী ব্যক্তির পরম ধর্ম। যারা বেদ শাস্ত্রের বাণী গ্রহণযোগ্য মনে করে না তাদের দুর্গতি অবশ্যম্ভাবী। এ কারণে পরমব্রহ্ম কে - তা নির্ণয় না করে নিজের ইচ্ছামতো যাকে তাকে পরমব্রহ্ম বলে ঘোষণা করে দেওয়া একমাত্র মুর্খামি।
এবার দেখুন বেদেই বলা হয়েছে —
পরমেশ্বরের শাসনের ভয়ে সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি,বায়ু, ইন্দ্র আদি দেবতারা নিজের নিজের দায়িত্ব পালনের কার্য করে চলেছেন, প্রমাণ দেখুন 👇
ভীষাঽস্মাদ্বাতঃ পবতে। ভীষোদেতি সূর্যঃ। ভীষাঽম্মাদগ্নিশ্চেন্দ্রশ। মৃত্যুধাবতি পঞ্চম ইতি। সৈষাঽঽনন্দস্য মীমাংসা ভবতি। যুবা স্যাৎসাধুযুবাঽধ্যায়কঃ। আশিষ্ঠো দ্রঢ়িষ্ঠো বলিষ্ঠঃ। তস্যেয়ং পৃথিবী সর্বা বিত্তস্য পূর্ণা স্যাৎ। স একো মানুষ আনন্দঃ। তে যে শতং মানুষা আনন্দাঃ ।।১
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় উপনিষদ/২/৮/১]
অর্থ – পরব্রহ্ম পরমেশ্বরের ভয়ে বায়ু নিজ কার্য সম্পাদন করেন। এঁর ভয়ে সূর্য যথাকালে উদিত হন এবং ঠিক সময়ে অস্তগামী হন। এঁর ভয়ে অগ্নি, ইন্দ্র এবং পঞ্চম স্থানীয় মৃত্যু-এঁরা সকলে নিজ নিজ কর্ম নিয়মপূর্বক সুব্যবস্থিতরূপে সম্পাদন করেন। যদি এঁদের সুব্যবস্থাপক কেউ না থাকেন তাহলে নিখিল সংসারের কর্ম কীভাবে হত? এতদ্দ্বারা প্রমাণিত হয় যে কোনো একজন সত্য, জ্ঞান এবং আনন্দস্বরূপ পরব্রহ্ম পরমাত্মা অবশ্যই বিদ্যমান আছেন এবং তাঁকে মানুষ লাভ করতে পারে।।
তাহলে এবার ভেবে দেখুন, যদি বেদ অনুসারে, সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি,বায়ু, ইন্দ্র আদি দেবতারা পরমেশ্বর হতেন, তাহলে সেই বেদেই পরমেশ্বরের শাসনের ভয়ে সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি,বায়ু, ইন্দ্র আদি দেবতারা নিজের নিজের কার্য করে চলেছেন - এমনটা কেন বলা হয়েছে ?
বেদে আবার কোন নূতন পরমেশ্বরের কথা বলা হয়েছে, যে পরমেশ্বরের ভয়ে সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি,বায়ু, ইন্দ্র আদি দেবতারা নিজের নিজের কার্য করে চলেছেন ?
উত্তর টা এবার বেদ থেকেই দেখে নিন —
যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে ।
ভীষাস্মাদ্বাতঃ পবতে । ভীষোদেতি সূর্যঃ । ভীষাস্মাদগ্নিশ্চেন্দ্রশ্চ ॥ ১০
(ভস্ম জাবাল উপনিষদ/২য় অধ্যায়/৮-১০ নং মন্ত্র)
অর্থ — আমাকেই (শিবকে) যথাযথভাবে জেনে (জীবের) অমৃতত্ব (মোক্ষ) লাভ হয়। একমাত্র আমাকে (শিবকে) জেনেই শোকের উত্তরণ ঘটে। যে জীব একমাত্র আমাকে (জীবের অন্তরে থাকা আত্মাস্বরূপ শিবকে) জানতে পারে সেই জীবের সংসারের দুঃখরূপী রোগ বিনষ্ট হয়ে যায়। এই (সংসারের বন্ধন থেকে উৎপন্ন হওয়া দুঃখ থেকে মুক্ত করবার) কারণেই আমিই হলাম রুদ্র — যে রুদ্র সকলের পরম গন্তব্য। সেই আমিই সকল রূপের আকারের ধারক ॥ ৮ ॥
যেখান থেকে সমস্ত প্রাণী ও সৃষ্ট জগৎ উৎপন্ন হয়, যার দ্বারা এরা জীবিত থাকে, যার মধ্যেই সমস্ত কিছু অবশেষে বিলীন হয়, তাকে (শিবকে) জেনে এবং উপলব্ধি করেই উপাসনা করা উচিত। আমি (শিব) সেই তত্ত্ব(পরমশিব তত্ত্ব), আমাকেই দেবতারা সহ সমগ্র বিশ্ব স্তুতি ও উপাসনা করে ॥ ৯ ॥
আমার (শিবের) ভয়ে বায়ু প্রবাহিত হয়, আমার ভয়ে সূর্য উদয় হয়, আমার ভয়ে অগ্নি ও চন্দ্র নিজেদের কর্তব্য পালন করে ॥ ১০ ॥
বেদ সরাসরি পরমেশ্বর বলতে প্রভু শিবকেই স্বীকার করেছেন। তার শাসনের ভয়ে সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি,বায়ু, ইন্দ্র আদি দেবতারা নিজের নিজের দায়িত্ব পালনের কার্য করে চলেছেন ।
🔶বেদের বিভিন্ন মন্ত্রে দেবতাদের পরমেশ্বর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে , কিন্তু তা মূলত ঐ সকল দেবতার অভ্যন্তরে কারণরূপী শিব স্থিত রয়েছেন — এই দৃষ্টিকোণে বলা হয়েছে , অন্য কারণে নয়। পরমেশ্বর শিবই সকল দেবতার উৎপত্তিকর্তা, পরমেশ্বর শিবই সকল দেবতার রূপ ধারণ করে বহু দেবতারূপে প্রতিভাত হচ্ছেন মাত্র, প্রমাণ দেখুন ঃ
🔶 পরমেশ্বর শিবের থেকে দেবতাদের উৎপত্তি —
যো দেবানাং প্রভবশ্চোদ্ভবশ্চ বিশ্বাধিপো রুদ্রো মহর্ষিঃ।
হিরণ্যগর্ভং জনয়ামাস পূর্বং সনো বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুনক্তু ॥ ৪
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৩য় অধ্যায়/৪নং মন্ত্র)
অর্থ — দেবতাদের উৎপত্তি ও সমৃদ্ধির কারণ যিনি, যিনি রুদ্র, বিশ্বচরাচরের প্রভু এবং সর্বজ্ঞ, যিনি সৃষ্টির শুরুতে হিরণ্যগর্ভকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি আমাদের শুভবুদ্ধি দান করুন (অর্থাৎ, ভালো-মন্দ এবং নিত্য-অনিত্য বিচারের ক্ষমতা, যার দ্বারা শীঘ্র আমরা আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারি)।
🔶শরভ উপনিষদে পরমেশ্বর শিব কে ব্রহ্মাদি সকল দেবতার পিতা ঘোষণা করা হয়েছে, তিনিই বেদের প্রকট কর্তা -
প্রভুং বরেণ্যং পিতরং মহেশং
যো ব্রহ্মাণং বিদধাতি তস্মৈ ।
বেদাংশ্চ সর্বান্প্রহিণোতি চাগ্র্যং
তং বৈ প্রভুং পিতরং দেবতানাম্ ॥ ২
মমাপি বিষ্ণোর্জনকং দেবমীড্যং
যোঽন্তকালে সিযলোকান্সংজহার
স একঃ শ্রেষ্ঠশ্চ সর্বশাস্তা স এব বরিষ্ঠশ্চ ॥ ৩ ॥
[তথ্যসূত্র - শরভ উপনিষদ/২নং শ্লোক]
অর্থ - সেই প্রভু শিবই সর্বপ্রথম প্রজাপতি ব্রহ্মাকে ধারণ করেন। সেই প্রভুই ধরণের যোগ্য, তিনিই প্রভু, তিনিই পিতা মহেশ্বর, তিনিই শ্রেষ্ঠ। তিনিই বেদের প্রথম প্রেরক পরমেশ্বর, তিনিই সবার প্রভু এবং সমস্ত দেবতাগণেরও পিতা ॥ ২
সেই প্রভু (শিব) আমার (ব্রহ্মা) এবং বিষ্ণুদেবেরও পিতা, উনিই অন্তিম সময়ে (মহাপ্রলয়) সম্পূর্ণ বিশ্বের বিনাশ করেন,সেই দেব কে নমস্কার করি, তিনি একাই নিয়ামক, তিনি শ্রেষ্ঠ এবং বরিষ্ঠ (সর্বাগ্রে বরনীয়) ॥ ৩
[মনে রাখবেন, বেদে বলা হয়েছে যে, সৎ (নিত্য) পরমেশ্বর একজনই, কিন্তু বিপ্রগণ তাকে বিভিন্ন নামে ডেকে থাকেন, একং সদ বিপ্রা বহুধা বদন্তি (ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৪৬)]
এবার দেখুন, সেই একজন পরমেশ্বর প্রকৃতপক্ষে কে ?
🔶 সকল দেবতার রূপ ধারণ করেন একমাত্র পরমেশ্বর শিব —
ॐ যো বৈ রুদ্রঃ স ভগবান্যশ্চ ব্রহ্মা তস্মৈ বৈ নমো নমঃ ॥ ১ ॥
যো বৈ রুদ্রঃ স ভগবান্যশ্চ বিষ্ণুস্তস্মৈ বৈ নমো নমঃ ॥ ২
যো বৈ রুদ্রঃ স ভগবান্যশ্চ স্কন্দস্তস্মৈ বৈ নমো নমঃ ॥ ৩
যো বৈ রুদ্রঃ স ভগবান্যশ্চেন্দ্রস্তস্মৈ বৈ নমো নমঃ ॥ ৪
যো বৈ রুদ্রঃ স ভগবান্যশ্চাগ্নিস্তস্মৈ বৈ নমো নমঃ ॥ ৫
যো বৈ রুদ্রঃ স ভগবান্যশ্চ বায়ুস্তস্মৈ বৈ নমো নমঃ ॥ ৬
যো বৈ রুদ্রঃ স ভগবান্যশ্চ সূর্যস্তস্মৈ বৈ নমো নমঃ ॥ ৭
যো বৈ রুদ্রঃ স ভগবান্যশ্চ সোমস্তস্মৈ বৈ নমো নমঃ ॥ ৮
(অথর্ব-শির উপনিষদ/২য় কণ্ডিকা/১-৮ নং মন্ত্র)
অর্থ —
যে ভগবান রুদ্র(শিব) ভগবান ব্রহ্মা স্বরূপ ধারণ করে অখিলব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করছেন, সেই পরমেশ্বর রুদ্রকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি ॥ ১
যে ভগবান রুদ্র(শিব) ভগবান বিষ্ণুস্বরূপ ধারণ করে অখিলব্রহ্মাণ্ড পালন করছেন, সেই পরমেশ্বর রুদ্রকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি ॥ ২
যে ভগবান রুদ্র(শিব) ভগবান স্কন্দস্বরূপ ধারণ করে দেবতাদের সেনাপতিত্ত্ব করছেন, সেই পরমেশ্বর রুদ্রকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি ॥ ৩
যে ভগবান রুদ্র(শিব) ভগবান ইন্দ্রস্বরূপ ধারণ করে ব্রহ্মাণ্ডে বারিবর্ষণ করছেন, সেই পরমেশ্বর রুদ্রকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি ॥ ৪
যে ভগবান রুদ্র(শিব) অগ্নিস্বরূপ ধারণ করে ব্রহ্মাণ্ডে পাক কার্য সাধন করছেন, সেই পরমেশ্বর রুদ্রকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি ॥ ৫
যে ভগবান রুদ্র(শিব) বায়ুস্বরূপ ধারণ করে ব্রহ্মাণ্ডে প্রাণরূপে বিদ্যমান আছেন, সেই পরমেশ্বর রুদ্রকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি ॥ ৬
যে ভগবান রুদ্র(শিব) সূর্যের স্বরূপ ধারণ করে ব্রহ্মাণ্ডে তাপ প্রদান করছেন, সেই পরমেশ্বর রুদ্রকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি ॥ ৭
যে ভগবান রুদ্র(শিব) চন্দ্রের স্বরূপ ধারণ করে ব্রহ্মাণ্ডে অমৃতবর্ষণ করছেন, সেই পরমেশ্বর রুদ্রকে পুনঃ পুনঃ প্রণাম করি ॥ ৮
🔶 সেই সকল দেবতার রূপ পরমেশ্বর শিব ধারণ করলেও, তাদের চেয়েও একমাত্র প্রভু শিবই শ্রেষ্ঠ —
তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরং তং দেবতানাং পরমং চ দৈবতম্।
পতিং পতীনাং পরমং পরস্তাদ্ বিদাম দেবং ভুবনেশমীড্যম্ ॥ ৭
ন তস্য কার্যং করণং চ বিদ্যতে ন তৎসমশ্চাভাধিকশ্চ দৃশ্যতে।
পরাস্য শক্তিবিবিধৈব শ্রয়তে স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ ॥ ৮
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৬ষ্ঠ অধ্যায়/৭-৮নং মন্ত্র)
অর্থ — সমস্ত ঈশ্বরপদ প্রাপ্তকারী দেবতাদের থেকে পরম হলেন মহেশ্বর । সমস্ত দেবতাদের চেয়েও পরমদেবতা, তিনি সংসারের সমস্ত পতিদেরও পতি, তিনি সকল কিছুর মধ্যে পরমতম স্তর, সেই ভুবনের একমাত্র ঈশ্বর ভুবনেশ পরমেশ্বর শিবই আরাধ্য, তাকেই নিজের অন্তরের আত্মাস্বরূপ বলে জানা উচিত ॥ ৭
(পরমার্থিক দৃষ্টিতে) না তার (শিবের) কোনো কার্যগত শরীর (বা প্রয়োজন) আছে, আর না তার কোনো করণীয় আছে, না তার সমতুল্য অন্য কেউ আছে, সেই পরমেশ্বর শিবের চেয়ে উৎকৃষ্ট আর অন্য কাউকে দেখা যায় না । সেই অদ্বিতীয় শিবের মধ্যে থেকেই স্বাভাবিকভাবে প্রকাশিত তার অভিন্ন পরাশক্তি, শিবের এই স্বাভাবিক অদ্বিতীয় পরাশক্তিই নানারকম ভাবে অর্থাৎ জ্ঞানশক্তি ক্রিয়াশক্তি ও বলশক্তি রূপে বিদ্যমান। ইহাই বেদশাস্ত্রের বচন ॥ ৮
🔶 সকল দেবতাদের থেকে একমাত্র পরমেশ্বর শিবের শক্তি সবথেকে বেশি, প্রভু শিবের থেকে শক্তিশালী আর কেউ নেই, কথা বলছে স্বয়ং বেদ —
অর্হন্ বিভৰ্ষি সায়কানি ধন্বার্হন্ নিষ্কং যজতং বিশ্বরূপম্ ।
অর্হন্নিদং দয়সে বিশ্বমভ্বং ন বা ওজীয়ো রুদ্র ত্বদস্তি ॥ ১০ ॥
(ঋগ্বেদ/শাকল শাখা/২য় মণ্ডল/সূক্ত-৩৩/১০ নং মন্ত্র)
অর্থ — হে রুদ্রদেব (শিব) ! আপনি বাণ ও ধনুক ধারণ করে থাকেন,
হে পূজনীয় প্রভু ! আপনিই বহুরূপে একমাত্র বিশ্বরূপধারী।আপনিই সমস্ত বিশ্বভুবনের রক্ষাকর্তা, আপনার চেয়ে অধিক বলবান কেহই নেই ॥ ১০
🔶 পরমেশ্বর শিবের শাসনের নিয়মে শাসিত হন সকল দেবতারা —
যো দেবানামধিপো যম্মিল্লোকা অধিশ্রিতাঃ ।
য ঈশে অস্য দ্বিপদশ্চতুষ্পদঃ কস্মে দেবায় হবিষা বিধেম ॥ ১৩
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৪র্থ অধ্যায়/১৩নং মন্ত্র)
অর্থ — তিনি (শিব) সকল দেবতার নিয়ামক এবং সকল জগতের আশ্রয়। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীকেও তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি ব্রহ্ম, তিনি আনন্দস্বরূপ। ঘৃতাহুতি দিয়ে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করি ॥ ১৩
আরো দেখুন, কেন উপনিষদে বর্ণিত - দেবতাদের অহংকার চূর্ণ করবার জন্য যক্ষরূপে যিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন দেবতাদের সামনে, সেই যক্ষ হলেন পরমেশ্বর শিব স্বয়ং —
ॐ ব্রহ্ম হ বা ইদমগ্র আসীৎ স্বয়ম্ভে্ব কমেব। তদৈক্ষত-মহদ্ বৈ যক্ষম্, তদেকমেবাস্মি, হন্তাহং মদেব মন্মাত্রং দ্বিতীয়ং দেবং নির্মম ইতি..॥ ১
(তথ্যসূত্র: গোপথ ব্রাহ্মণ/পূর্বভাগ/প্রথম প্রপাঠক/১নং মন্ত্র)
অর্থ — ॐ-কার স্বরূপ স্বয়ম্ভূ পরম ব্রহ্ম প্রথমে একা ছিলেন। তখন তিনি দেখলেন (অনুভব করলেন), আমি তো মহান যক্ষ, এক এবং অদ্বিতীয়। ঠিক আছে-আমি আমার থেকে আমার মতো দ্বিতীয় একজন দেবতাকে নির্মাণ করবো।
লক্ষ করুন, এখানে সরাসরি ব্রহ্মের কথা বলা হয়েছে, আর ব্রহ্মই একমাত্র নিত্য ও সৎ । আর সেই ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয় ছিলেন, সেই ব্রহ্ম নিজেকে ঐ অবস্থায় যক্ষ বলে দাবী করেছেন, কেন উপনিষদের মধ্যেও এই যক্ষকে মাতা পার্বতী ব্রহ্ম বলেই পরিচয় দিয়েছিলেন। যক্ষ রূপ একমাত্র পরমেশ্বর শিবেরই, এর প্রমাণ শিবমহাপুরাণের শতরুদ্র সংহিতার ১৬নং অধ্যায়ে কাহিনী সহ উল্লেখিত হয়েছে, এছাড়াও লিঙ্গমহাপুরাণ, স্কন্দমহাপুরাণ, দেবীভাগবত পুরাণে রয়েছে।
আরো দেখুন, ঐ বেদেই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে সবকিছু সৃষ্টির পূর্বে যখন কিছুই ছিল না, তখন একমাত্র শিব ছিলেন —
যদাহতমস্তন্ন দিবা ন রাত্রিঃ
ন সন্নচাসৎ শিব এব কেবলঃ ।
তদক্ষরং তৎ সবিতুর্বরেণ্যং
প্রজ্ঞা চ তস্মাৎ প্রসূতা পুরাণী ॥ ১৮
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৪র্থ অধ্যায়/১৮নং মন্ত্র)
অর্থ — এমন একসময় ছিল যখন অজ্ঞানতা ছিল না এবং তার কুফলও ছিল না। তখন দিনও ছিল না, রাতও ছিল না; 'অস্তি'ও ছিল না, 'নাস্তি'ও ছিল না। কেবলমাত্র শুধু সেই নির্বিশেষ পরমব্রহ্ম শিবই ছিলেন। সূর্যমণ্ডলের অধীশ্বর দেবতারাও এই ব্রহ্মের (শিবের) পূজা করেন। এই ব্রহ্ম থেকেই সেই সনাতন প্রজ্ঞা উৎসারিত, যা আমাদের সকলেরই কাম্য, যা গভীর মনন ও বিচারের ফল এবং যা পরম্পরাক্রমে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে ॥ ১৮
সুতরাং, দিনের আলোর ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেল যে, বেদে একমাত্র প্রভু শিব ছাড়া অন্য কোনো দেবতা কোনোভাবেই পরমেশ্বর হতে পারেন না , কারণ পরমেশ্বর হবার লক্ষণ শিব ছাড়া অন্য আর কোনো দেবতার মধ্যে নেই ।
-------------------------------------------------------------------------------------------------
এমনকি ঐ দেবতাদের ক্ষমতাও নেই যে তারা পরমেশ্বর শিবের শিবলোকে পোঁছাতে পারে, আর শিবলোকের চেয়ে শ্রেষ্ঠ অন্য আর কিছুই নেই, এ কথাও বেদ বলছে,
🔶 রুদ্রহৃদয় উপনিষদ থেকে প্রমাণ দেখুন —
ন তত্র চন্দ্রার্কবপুঃ প্রকাশতে ন বান্তি বাতাঃ সকলা দেবতাশ্চ ।
স এষ দেবঃ কৃতভাবভূতঃ স্বয়ং বিশুদ্ধো বিরজঃ প্রকাশতে ॥ ৪০ ॥
(রুদ্রহৃদয় উপনিষদ/ ৪০ নং মন্ত্র)
অর্থ — পরমাত্মার যে নিত্যধামে সূর্য তথা চন্দ্র প্রকাশ দিতে সক্ষম নয়, যেখানে বায়ুদেব প্রবাহিত হয় না, যেখানে অন্য দেবতারাও পৌঁছাতে পারেন না, সেই নিত্যধামের পরমাত্মা শিব সাধক ব্যক্তির দ্বারা চিন্তন করবার মাধ্যমে শুদ্ধ এবং নির্গুন স্বরূপে প্রকাশিত হন ॥ ৪০ ॥
🔶 নৃসিংহপূর্বতাপনী উপনিষদ থেকে প্রমাণ দেখুন —
তদ্বা এতৎপরমং ধাম মন্ত্ররাজাধ্যাপকস্য যত্র ন সূর্যস্তপতি যত্র ন বায়ুর্বাতি যত্র ন চন্দ্রমা ভাতি যত্র ন নক্ষত্রাণি ভান্তি যত্র নাগ্নির্দহতি যত্র ন মৃত্যুঃ প্রবিশতি যত্র ন দুঃখং সদানন্দং পরমানন্দং শান্তং শাশ্বতং সদাশিবং ব্রহ্মাদিবন্দিতং যোগিধ্যেয়ং পরমং পদং যত্র গত্বা ন নিবর্তন্তে যোগিনঃ ॥ ২০
(অথর্ববেদ/নৃসিংহ পূর্বতাপনী উপনিষদ/পঞ্চমোপনিষদ)
🔴 অর্থ — এই মন্ত্ররাজ জপ করে জপকারী ব্যক্তি সেই পরমধাম প্রাপ্ত করেন, যেখানে বায়ু গমন করে না, যেখানে সূর্য তাপ দেয় না, যেখানে চন্দ্রের প্রকাশ নেই, সেখানে নক্ষত্র চমকায় না, যেই স্থানে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয় না তথা যেখানে মৃত্যুর প্রবেশ নেই, যে স্থান সর্বদা দুঃখরহিত, যেখানে সর্বদাই আনন্দ বিরাজ করে, যা পরমানন্দদায়ক স্থান, শান্ত, শাশ্বত, যেখানে স্বয়ং প্রভু সদাশিব বিরাজমান, সেই প্রভু শিবই ব্রহ্মা সহ সকল দেবতাদের দ্বারা বন্দনীয় হন, তিনি যোগীব্যক্তিদের একমাত্র পরম লক্ষ্যবস্তু, যা পরমপদ নামে বিখ্যাত, যেখানে সাধকেরা পৌঁছে গেলে সংসার থেকে মুক্ত হয়ে যায়, আর কখনো সংসারে ফিরতে হয় না ॥ ২০
🔶 বেদের বাণী কে সমর্থন করে পুরাণ শাস্ত্রেও একই কথা বলা হয়েছে —
ন তত্র সূর্যশ্চন্দ্রশ্চ তারকা বিদ্যুতোঽনলঃ ।
বিভান্তি শঙ্করে সাক্ষাৎ স্বয়ংভানে চিদাত্মকে ॥ ৪৫
তমেব সকলং ভান্তমনুভাতি স্বভাবতঃ ।
তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি তত এব হি ॥ ৪৬
ন তত্র চন্দ্রার্কবপুঃ প্রকাশতে ন বান্তি বাতাঃ সকলাশ্চ দেবতাঃ ।
স এষ দেবঃ কৃতভূতভাবনঃ স্বয়ং বিশুদ্ধো বিরজঃ প্রকাশতে ॥ ৪৭
[স্কন্দমহাপুরাণ/সূতসংহিতা/যজ্ঞবৈভবখণ্ড/উপরিভাগ/(ব্রহ্মগীতা) ৭ অধ্যায়/ ৪৫-৪৭ শ্লোক]
অর্থ — সেই মহেশ্বর এর (শিবলোকের) বিষয়ে সূর্য চন্দ্র তারা বিদ্যুৎ অগ্নি আদি কেউই আলোর প্রকাশ দিতে সক্ষম হয়না, সেই পরমেশ্বর শঙ্কর তো স্বয়ংই সাক্ষাৎ জ্ঞানরূপ, অতএব প্রত্যগ্ রূপে তিনি ভাসিত হয়ে আছেন ॥ ৪৫
শিবের স্বভাবতঃ ভাসিত হবার মাধ্যমেই অনান্যরা ভাসিত হন মাত্র । শিবের প্রকাশের সব কিছু ভাসিত হয় ॥ ৪৬
এই কারণে শিবকে বিষয় করে চন্দ্র তথা সূর্যের বিম্ব শিবকে প্রকাশ দিতে সক্ষম হতে পারেনা, বায়ুও শিবের দিকে বয়ে যেতে সক্ষম নন, সমস্ত দেবতা কখনোই পরমশিবকে বিষয় করতে পারেনা, সকল জীবের কল্যানকারী সেই মহাদেব স্বয়ং নিজের শুদ্ধ নির্মল স্বভাব দ্বারাই ভাসিত হন ॥ ৪৭
----------------------------------------------------------------------------------------------------
এবার, প্রভু শিবই একমাত্র পরমেশ্বর তার প্রমাণ দেখুন,
বেদ শাস্ত্র বলছে, পরমেশ্বর শিব স্বয়ংই ॐ, শিবই সাকার পরমব্রহ্ম, আবার শিবই নিরাকার পরমব্রহ্ম। পরমব্রহ্ম শিবকে ছাড়া দ্বিতীয় অন্য কোনো পরমেশ্বর নেই। প্রমাণ —
শিব ॐ-কার 👇
প্রযতঃ প্রণবো নিত্যং পরমং পুরুষোত্তমম্।
ওঙ্কারং পরমাত্মনং তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু ॥ ২০
(‘ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২০’ এবং
ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/ ৪ নং অধ্যায় / ১১ নং খিলা/২০ মন্ত্র)
অর্থ – যিনি প্রণবরূপি নিত্য (শাশ্বত) পরমপুরুষোত্তম (সর্বশ্রেষ্ঠ/পরাকাষ্ঠা/পুরুষ/ব্রহ্ম), যিনি সাক্ষাৎ ॐ-কার ও স্বয়ং পরমাত্মা, সেই পরমব্রহ্ম শিবের প্রতি (আমার/আমাদের) মন সংকল্পিত হউক ॥
শিব নিরাকার 👇
যোহসৌ সর্বেষু বেদেষু পঠতে হ্যজ ঈশ্বরঃ।
অকাযো নির্গুণোহধ্যাত্মা তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত ॥ ২৩
(‘ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২৩’ এবং
ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/ ৪ নং অধ্যায় / ১১ নং খিলা/২৩ মন্ত্র)
অর্থ – সমগ্র বেদ পাঠ করলে যাকে একমাত্র ঈশ্বর বলে জানা যায়, যিনি (পরমার্থে) একমাত্র নিরাকার নির্গুণ, সেই পরমেশ্বর শিবের প্রতি আমার মন সংকল্পিত হোক ॥
শিব সাকার রূপধারী 👇
কৈলাসশিখরাভাসা হিমবদগিরিসংস্থিতা।
নীলকন্ঠং ত্রিনেত্রং চ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু ॥ ২৫
(‘ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২৫’ এবং
ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/ ৪ নং অধ্যায় / ১১ নং খিলা/২৫ মন্ত্র)
অর্থ - কৈলাস পর্বতের শিখরে হিমগিরিতে যিনি বিরাজমান, যিনি নীলকণ্ঠ, ত্রিনেত্রধারী সেই পরমব্রহ্ম শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হউক ॥
📂ব্রহ্মা বিষ্ণু চেয়েও শ্রেষ্ঠ একমাত্র পরমেশ্বর শিব, তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই, প্রমাণ —
পরাৎপরতরো ব্রহ্মা তৎপরাৎপরতো হরিঃ ।
তৎপরাৎপরতো হ্যেষ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু ॥ ১৮
[ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/শিবসংকল্পসূক্ত]
এবং (ঋগ্বেদ সংহিতা/খিল ভাগ /৪/১১)
অর্থ — সর্বোপরি হলেন ব্রহ্মা । তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হরি এবং এনাদের চেয়েও যিনি পরমতম তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ‘ঈশ’ ( ঈশান/ঈশ্বর/সদাশিব) সেই শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হোক ।
🔶এবার দেখুন ! এই একই মন্ত্রকে আরো বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে
অথর্ববেদে শরভ উপনিষদের মধ্যে 👇
পরাৎপরতরং ব্রহ্মা যৎপরাৎপরতো হরিঃ ।
পরাৎপরতরোঃ ঈশঃ তস্মাৎ তুল্যোঽধিকো ন হি ॥২৯
(শরভ উপনিষদ/২৯নং মন্ত্র)
অর্থ – যিনি পরাৎপর ব্রহ্মা, তাঁর থেকেও অধিক পরাৎপর হলেন হরি। কিন্তু হরির থেকেও অধিক যিনি পরাৎপর তিনিই হলেন ঈশ(সদাশিব), সেই প্রভু শিবের সমান তথা তাঁর চেয়ে অধিক কেউ নেই ,কারণ শিবই সর্বোচ্চ সত্ত্বা পরমব্রহ্ম।
বিষ্ণু ও অনান্য সকল দেবতার রূপ পরমেশ্বর শিবই ধারণ করেন, বেদ বলেছে এই কথা —
প্রভু শিবই শ্রীবিষ্ণুরূপ ধারণ করে পালন কার্য করছেন(অথর্বশির উপনিষদ/২/২),
ব্রহ্মারূপ ধারণ করে প্রভু শিবই জাগতিক সংসার সৃজন করছেন(অথর্বশির উপনিষদ/২/১), আবার রুদ্র রূপ ধারণ করে সংহার করছেন।
বিভিন্ন দেবতার রূপে প্রভু শিবই প্রকাশমান(অথর্বশির উপনিষদ/২/১-৩৩)।
কিন্তু এই দেবতারা পরমেশ্বর শিবের অনিত্য রূপ ভেদ মাত্র। তাই এনাদের কখনোই অক্ষয় নিত্য পরমব্রহ্ম বলে স্বীকার করা হয়না, বেদই বলেছে শিবই একমাত্র ধ্যেয়, বিষ্ণু সহ অনান্য সব দেবতা প্রকৃত ধ্যেয় বস্তু নন। দেখুন —
এক এব শিবো নিত্যস্ততোহন্যসকলং মৃষা ।
তস্মাৎসর্বাপরিত্যজ্য ধ্যেযান্বিষ্ণবাদিকান্সুরান্ ॥ ৩০
(শরভ উপনিষদ/৩০নং মন্ত্র)
অর্থ – শিবই একমাত্র নিত্য, অন্য সকল কিছুই মিথ্যা। এই কারণে বিষ্ণু সহ সকল দেবতাকে পরিত্যাগ করে শিবকেই ধ্যেয় বলে জানা উচিত ॥ ৩০
--------------------------------------------------------------------------------------
সিদ্ধান্ত
পরমেশ্বর একজনই, একাধিক পরমেশ্বর নেই। তাহলে, প্রভু শিবকে ছেড়ে কোনো ব্যক্তি যদি নিজের ইচ্ছা মতো নিজের পছন্দের কোনো দেবতা কে একমাত্র পরমেশ্বর বলে মনে করে তাহলে বেদের বাকি মন্ত্র গুলি মুল্যহীন হয়ে খণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে । তাই বেদ তথা অনান্য শাস্ত্রের বচন না মেনে যার যেমন ইচ্ছে সে নিজের মতো করে যে কোনো দেবতাকে পরমেশ্বর ভাবতে শুরু করলে তিনি যে বেদবিরোধী হয়ে যাবেন, তা প্রমাণ হয়ে গেল । একমাত্র ও শুধুমাত্র প্রভু শিবই পরমেশ্বর, অন্য আর কেউ পরমেশ্বর নন। সকল রূপ পরমেশ্বর শিবের, শিব ছাড়া আর কিছুই নেই ।
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
লেখনীতে — ©শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন