⚠️নব্য রামানুজী বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী বৈষ্ণবদের দ্বারা আরোপিত পরমেশ্বর শিবের উপর মিথ্যা দাবীর খণ্ডন—
👉প্রথমে দেখে নেওয়া যাক বৈষ্ণবদের দাবী —
বৈষ্ণবপক্ষের দাবী—
তদাহুরেকো হ বৈ নারায়ণ আসীন্ন ব্রহ্মা নেশানো নাপো নাগ্নীষোমৌ নেমে দ্যাবাপৃথিবী ন নক্ষত্রাণি ন সূর্যো ন চন্দ্রমাঃ।"( মহোপনিষদ ১/১)-------সৃষ্টির আদিতে কেবল পরম পুরুষ নারায়ণ ছিলেন।ব্রহ্মা ছিল না,শিব ছিল না,আপ(জল),অগ্নি, সোমাদি দেবগণ ছিল না, দ্যুলোক ছিল না, আকাশে নক্ষত্র ছিল না এবং সূর্য-চন্দ্রও ছিল না।
শৈব পক্ষদ্বারা খণ্ডন —
👉প্রথমে বলে রাখি যে- মহো উপনিষদ কোনো মান্য উপনিষদ নয় এবং মুক্তিকা উপনিষদ অনুসারে ১০৮ টি উপনিষদের মধ্যেও মহো উপনিষদের নাম পাওয়া যায় না, বড়জোর "মহৎ" নামের উপনিষদ উপলব্ধ। অর্থাৎ মহো উপনিষদ নামের এটি একটি অর্বাচীন উপনিষদ। তাই মহো উপনিষদের কি বলা আছে তা নিয়ে শৈবদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু, এই নব্য রামানুজী বৈষ্ণবেরা যেহেতু মহো উপনিষদ কে ব্যাবহার করে সাধারণ মানুষদের ভুল বোঝায়, তাই আমরা অদ্বৈত শৈবরা এই মিথ্যা অর্বাচীন অপদাবীর খণ্ডন অবশ্যই করবো এবং সত্য সবার সামনে তুলে ধরবো।
কিছুক্ষণের জন্য মহো উপনিষদ কে মান্য বলে ধরে তার বিশ্লেষণ করা আরম্ভ করলাম এবার।
👉এখানে যাঁরা কেবল এই কয়েকটি শ্লোক বা মন্ত্রের এক পদ(Line) পড়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান যে, শিব নেই বা শিব নারায়ণের পরে এসেছেন — তারা প্রকৃতপক্ষে পুরো উপনিষদের বক্তব্য না পড়েই ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
এখানে যদিও বৈষ্ণবদের এই অবান্তর দাবীর কোনো যৌক্তিকতা নেই। তারপরেও বৈষ্ণবদের দৃষ্টিকোণে যদি যাচাই করি তাহলেও উক্ত মহো উপনিষদের বাক্য শ্রুতির বিরোধীতা করছে। কেননা শ্রুতিতে বলা হয়েছে যে—
যদাতমস্তন্ন দিবা ন রাত্রি ন সৎ ন চ অসৎ শিব এব কেবলঃ ।
তদক্ষরং তৎ সবিতুর্বরেণ্যং প্রজ্ঞা চ তস্মাৎ প্রসৃতা পুরাণী ॥ ১৮
[শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৪/১৮]
অর্থ — যখন না দিন ছিলো, না রাত ছিলো, না সৎ ছিলো, না অসৎ ছিলো, না আলো ছিলো, না অন্ধকার ছিলো, কেবল পরমেশ্বর শিব ছিলো। তিনিই (শিবই) অক্ষর, তিনিই (শিবই) সবিতার বরণীয় তেজ, তাঁহা হইতেই (শিব) সনাতন জ্ঞান প্রসৃত হয় ।। ১৮
👉তাহলে এখানে বৈষ্ণবদের উপর প্রশ্ন উঠে যে, এখানে কি শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ভুল বলেছে ? নাকি উক্ত বাক্যটা প্রক্ষিপ্ত ? কেননা শ্বেতাশ্বতরে একমাত্র ব্রহ্ম বলতে প্রভু শিবকেই বুঝিয়েছে। তাছাড়াও শ্বেতাশ্বতর হলো সর্ব মান্য উপনিষদ। তাহলে এখানে একটি অর্বাচীন উপনিষদ দ্বারা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের মান্য বাক্য কীভাবে খণ্ডিত হয় ?? শ্রুতি পরস্পর বিরোধী কীভাবে হতে পারে? তবে এবার সেই জ্ঞানহীন, অর্থের অনর্থকারী নব্য রামানুজী বকরামুণ্ডী বৈষ্ণবদের খণ্ডনের দিকে যাওয়া যাক—
👉অথর্বশিখা উপনিষদ (২) এর বক্তব্য —
এই উপনিষদে বলা হয়েছে —
"দেবাশ্চেতি সংধত্তাং সর্বেভ্যো দুঃখভযেভ্যঃ সংতারযতীতি তারণাত্তারঃ"
— যিনি সমস্ত দেবতাদের হৃদয়ে বাস করেন, সমস্ত দুঃখ ও ভয়ের উৎস থেকে রক্ষা করেন, সেই রক্ষাকারীকে 'তার' বলা হয়।
"সর্বে দেবাঃ সংবিশন্তীতি বিষ্ণুঃ"
— যাঁর মধ্যে সমস্ত দেবতা প্রবেশ করেন বা মিলিত হন, তিনিই ‘বিষ্ণু’ (সর্বব্যাপী চেতনা)।
"সর্বাণি বৃহযতীতি ব্রহ্মা"
— যিনি সব কিছুকে মহত্ব দান করেন, সমস্ত কিছুর বিস্তার যাঁর দ্বারা ঘটে, তিনি ‘ব্রহ্মা’।
"সর্বেভ্যোঽন্তস্থানেভ্যো ধ্যেযেভ্যঃ প্রদীপবত্প্রকাশযতীতি প্রকাশঃ"
— যিনি সমস্ত অভ্যন্তরীণ স্তরে, ধ্যানযোগ্য বিষয়ের মধ্যে প্রদীপের মত আলোকিত করেন, তিনি হলেন ‘প্রকাশ’।
"প্রকাশেভ্যঃ সদোমিত্যন্তঃ শরীরে বিদ্যুদ্বদ্দ্যোতযতি মুহুর্মুহুরিতি বিদ্যুদ্বত্প্রতীযাদ্দিশং দিশং"
— সেই চেতনা আমাদের দেহের অভ্যন্তরে ক্রমাগত বিদ্যুৎ-চমকের মত আলো ছড়ায়, এক মুহূর্তেও বহু দিক দিয়ে অনুভবযোগ্য হয়।
"ভিত্ত্বা সর্বাংল্লোকান্ব্যাপ্নোতি ব্যাপযতীতি ব্যাপনাদ্ব্যাপী মহাদেবঃ"
— যিনি সমস্ত লোক বা জগতকে ভেদ করে, স্পর্শ করে, সবদিকে নিজেকে বিস্তার করেন— সেই সর্বব্যাপী শক্তিই ‘মহাদেব’।
অর্থাৎ—
"ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র ও ইন্দ্র এই চারজনই সব সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেন, সব ইন্দ্রিয় ও কর্মের উপাদান নিয়ন্ত্রণ করেন। কিন্তু শিব তাঁদের সবার মধ্যবর্তী স্থানে বিরাজমান, যেমন আকাশ সবকিছুর ভিতর থেকেও আলাদা এবং সর্বদা অচল ও অপরিবর্তনীয়।"
এখানে বোঝানো হয়েছে যে, শিবই সর্বোচ্চ এবং চিরস্থায়ী শক্তি। তিনি সবার উৎস এবং সকলের ঊর্ধ্বে। এখানে মূল বিষয়টা বুঝতে হবে, মহো উপনিষদে যে ঈশানের কথা বলা হয়েছে তা, ত্রিদেবের অন্তর্গত কালাগ্নি রুদ্রের কথা বলেছে। এখানে কালাতীত সদাশিবের কথা মোটেও বোঝানো হয়নি। কেননা সদাশিব অজন্মা, যখন কিছুই ছিলো না, তখন কেবল শিবই ছিলো। তাই বোঝা উচিত শাস্ত্রে কখন পরশিবের কথা বলছে আর কখন কালাগ্নি রুদ্রের কথা বলছে।
👉বৈদিক নারায়ণ মানেই শিব —
ঋগ্বেদ (৫.৩.৩) মন্ত্রে বলা আছে —
তব শ্রিয়ে মরুতো মর্জয়ন্ত রুদ্র ষত্তে জনিম চারু চিত্রম্।
পদং যদ্বিষ্ণোরূপমং নিধায়ি তেন পাসি গুহ্যং নাম গোনাম্।।
শ্রীপতি এই মন্ত্রের ব্যাখ্যায় বলেন—
"তব শ্রীয়ে" মানে — শিবের শক্তি, 'শ্রী' রূপে প্রকাশিত হয়ে বিষ্ণুকে সহায়তা করেন।
"রুদ্র" হলেন সেই প্রভু — যার শক্তির প্রকাশ 'শ্রী', যিনি বিষ্ণুর সহায়।
"পদম্ যদ্ বিষ্ণোঃ" — অর্থাৎ, বিষ্ণুর অধিষ্ঠান (পদ) স্থাপন করেন উমামহেশ্বর।
এবং সেই গোপনীয় অধিষ্ঠানকে রক্ষা করেন রুদ্রই।
"গো" এখানে মানে — পরম দীপ্তি, যা বিষ্ণুর লোক বৈকুণ্ঠ (Vaikuntha)-তে প্রবাহিত হয়, যা আসলে বৈষ্ণবী শক্তি।
তাই, নারায়ণ সীমাবদ্ধ কেবল প্রতিষ্ঠাকলা পর্যন্তই।
👉ব্যাখ্যা—
"তব শ্রীয়ে" — শিবের শক্তি 'শ্রী' রূপে প্রকাশিত হয়—
এখানে "শ্রী" শব্দটি শিবের শক্তির প্রকট রূপকে নির্দেশ করে। শিবের শক্তি কখনোই শুধুমাত্র নিষ্ক্রিয় বা অজ্ঞেয় নয়, বরং তা এক বিশেষ রূপে (শ্রী) সক্রিয় হয়, যা সৃষ্টির রক্ষক হিসেবে কাজ করে। 'শ্রী' বলতে কেবল সৌন্দর্য বা প্রাচুর্য নয়, বরং শক্তির একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ বোঝানো হয়েছে। এ শক্তি বিষ্ণুকে সহায়তা প্রদান করে, অর্থাৎ, শিবের শক্তির মাধ্যমেই বিষ্ণুর সৃষ্টির কাজ সম্ভব হয়।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট — শিবের শক্তি কোনো বাহ্যিক বা পৃথক শক্তি নয়, বরং বিষ্ণুর কার্যকলাপের সহায়ক শক্তি হিসেবে উপস্থিত থাকে। শিবের শক্তি বিষ্ণুর সৃষ্টিতে সঞ্চালিত হতে থাকে, যা পরবর্তীতে সমস্ত সৃষ্টি, পালন ও প্রলয়ের কাজ সম্পাদিত করে।
"রুদ্র" — তিনি সেই প্রভু, যাঁর শক্তির প্রকাশ 'শ্রী' এবং যিনি বিষ্ণুর সহায়—
রুদ্র হলেন শিবের এক বিশেষ রূপ, যিনি শক্তি (শ্রী) রূপে বিষ্ণুর সহায়তা করেন। এখানে রুদ্র শব্দটি শুধু এক দেবতার নাম নয়, বরং একটি শক্তির প্রকাশ — যা সৃষ্টির কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
বিশেষত, "রুদ্র" শব্দটি সৃষ্টির সময়ের শক্তি বা ক্ষমতার পরিপূর্ণ প্রকাশকে নির্দেশ করে। শিব এবং রুদ্রের মধ্যে পার্থক্য হল শিব সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থায় অবিকৃত অবস্থায় থাকেন, আর রুদ্র সৃষ্টির পরবর্তী সময়ে সৃষ্টির নিয়মিত কার্য সম্পাদন করেন।
শ্রীপতির ভাষ্যে রুদ্রের শক্তি হচ্ছে বিষ্ণুর সহায়ক শক্তি, যা সম্পূর্ণ সৃষ্টির কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তার সঠিক ক্রমপালন নিশ্চিত করে।
"পদম্ যদ্ বিষ্ণোঃ" — বিষ্ণুর অধিষ্ঠান স্থাপন করেন উমামহেশ্বর—
"পদম্ যদ্ বিষ্ণোঃ" এর মাধ্যমে বলা হয়েছে যে, বিষ্ণুর পদ বা অধিষ্ঠান (যে স্থানে তিনি অবস্থান করেন বা কার্যকরী হন) রুদ্র তথা শিবের শক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। পদ এখানে দেহ বা অবস্থানের প্রতীক, যা বিষ্ণুর কর্মের স্থানকে নির্দেশ করে। এটি বোঝায় যে, বিষ্ণুর কার্যকলাপের যে কেন্দ্রীকরণ এবং সৃষ্টির যে রূপান্তর ঘটে, তা শিবের শক্তির মাধ্যমে সম্ভব হয়।
এটি একটি সূক্ষ্ম তত্ত্ব — যেটি শিব ও বিষ্ণুর একতা তুলে ধরে, অর্থাৎ রুদ্রই বিষ্ণুর কর্মের পৃষ্ঠপোষক। বিষ্ণু নিজে স্থিতির দেবতা হলেও, তিনি কার্যক্রম করতে পারেন শিবের শক্তির মাধ্যমে। তাই "পদম্ যদ্ বিষ্ণোঃ" বলার মাধ্যমে শ্রীপতি এক ধাপ এগিয়ে বলেন, বিষ্ণু তাঁর শ্রী বা শক্তি দ্বারা নয়, বরং শিবের শক্তির মাধ্যমে কাজ করেন।
"গো" — পরম দীপ্তি, যা বিষ্ণুর লোক বৈকুণ্ঠে প্রবাহিত হয়, যা আসলে বৈষ্ণবী শক্তি—
এখানে "গো" শব্দটি যে "দীপ" বা "আলো" এর প্রতিনিধিত্ব করে, তা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীপতি বোঝাতে চাচ্ছেন যে, গো (অথবা দীপ্তি) হলো সেই শক্তি বা জ্ঞান, যা বিষ্ণুর লোক বৈকুণ্ঠে প্রবাহিত হয়। এটি এক ধরনের দিব্য আভা, যা শিবের শক্তির মাধ্যমে বিষ্ণু বা লক্ষ্মী (শ্রী) এর মধ্যে স্থান পায় এবং পরবর্তীতে তা বৈষ্ণবী শক্তি হিসেবে প্রকাশিত হয়।
এটি প্রমাণিত হয় যে, শক্তি (শ্রী) কখনোই শুধুমাত্র বিষ্ণুর সাথে সম্পর্কিত নয়। বরং, শক্তির উৎস শিব, যার মাধ্যমে পরম জ্ঞান ও দীপ্তি বৈকুণ্ঠের (বিষ্ণুর অবস্থানস্থল) মধ্যে প্রবাহিত হয়। এই তত্ত্বটি শিব ও বিষ্ণুর সম্পর্কের গভীরতা বর্ণনা করে, যেখানে শিব একদিকে পরম জ্ঞান বা শক্তির আধার, অন্যদিকে বিষ্ণুর দেহতত্ত্বে ও শক্তিতে একীকৃত।
"নারায়ণ সীমাবদ্ধ কেবল প্রতিষ্ঠাকলা পর্যন্তই"—
এটি একটি গভীর দর্শন। এখানে শ্রীপতি বলছেন যে, নারায়ণ (বিষ্ণু) তাঁর সীমাবদ্ধতা কেবল প্রতিষ্ঠাকলা বা সৃষ্টির সময় পর্যন্ত। অর্থাৎ, বিষ্ণুর শক্তি (শ্রী) শিবের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতে থাকে। বিষ্ণু নিজে সেই আদিগন্ত সত্তা, কিন্তু তাঁর কার্যকলাপ বা গতি একমাত্র শিবের শক্তির মাধ্যমে স্থিতি পায়।
অতএব, বিষ্ণু নিজের অধিকারী শক্তি নিজেই পালন করেন, কিন্তু শিবের শক্তি তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, যাতে পুরো ব্রহ্মাণ্ড সঠিকভাবে পরিচালিত হয়।
শ্রীপতির এই ভাষ্য আমাদের শিব, বিষ্ণু ও শক্তির মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের এক অসাধারণ দর্শন প্রদান করে। শিবের শক্তি বিষ্ণুকে সহায়তা করে, বিষ্ণুর পদ স্থাপন করতে সহায়তা করে, এবং সবশেষে শিবই সেই শক্তি ও গোপন জ্ঞান রক্ষা করেন, যা প্রকৃতপক্ষে বিষ্ণুর সৃষ্টির সঠিক ক্রম বজায় রাখে।
শিবই একমাত্র পরমেশ্বর। সমস্ত দেবতা, এমনকি বিষ্ণুরূপ চিরন্তন পদও শিবের ইচ্ছায় বা শক্তিতে স্থাপিত। তিনি সকল গোপন জ্ঞানের ধারক ও রক্ষক। দেবগণ তাঁর গৌরবেই অলংকৃত হন, এবং তিনি সকল সৃষ্টির উৎসস্থানে বিরাজ করেন।
অর্থাৎ, শিবই নারায়ণের পদ (উপাধি) দান করেছেন।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৫.৬) বলছে—
তদ্ বেদগুহ্যোপনিষৎসু গূঢ়ং তদ্ ব্রহ্মা বেদতে ব্রহ্মযোনিম্। যে পূর্বদেবা ঋষয়শ্চ তদ্ বিদু-স্তে তন্ময়া অমৃতা বৈ বভূবুঃ ॥৬
অর্থ — শিবই সেই গূঢ় তত্ত্ব যা উপনিষদে গোপনে বলা হয়েছে। তিনি ব্রহ্মারও উৎস। প্রাচীন ঋষিরা ও দেবতারা যাঁকে চিনেছিলেন, তাঁরাই অমর হয়েছেন।
এই বক্তব্য প্রমাণ করে, হিরণ্যগর্ভ (ব্রহ্মা)-এরও উৎস শিব।
👉এখানে একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় যে- এখানে শিবকে শাস্ত্রে গূঢ় তত্ত্ব বলা আছে যিনি সকল শাস্ত্রের মধ্যে বিশেষত বেদ, উপনিষদ ইত্যাদিতে। এবং শিবই সেই গূঢ় তত্ত্ব যাকে জানলে জীব মুক্ত হয়ে যায়। তবে এই প্রসঙ্গে সামান্য ব্যাখ্যা করা যাক—
"রুদ্রে যত্তে ত্রয়ী পরং নাম ওস্মৈ হুত যমেষ্টসি"
[তৈত্তিরীয় সংহিতা/১/৮/১৪]
অর্থ — হে রুদ্র, প্রতিকর্মে শিব, রুদ্র, ত্র্যম্বক ইত্যাদি তোমার যে নাম প্রশস্ত আছে তাই তুমিই, যে নাম যমেরও পূজিত, সে তোমার নামের উদ্দেশ্যে এ জলরূপ হবি আহুতি দিচ্ছি।
👉ব্যাখ্যা—
“ত্রয়ী পরং নাম” — গূঢ়তা ও গাম্ভীর্য প্রকাশ করে:—
“পরং নাম” অর্থাৎ "পরম বা গূঢ় নামসমূহ"—যা তত্ত্বগত অর্থ, উপাসনা, গূঢ় শব্দচিহ্নে প্রকাশিত। এই "নাম" কেবল শব্দমাত্র নয়, বরং তারা হল—
শক্তির সূচক
চেতনার রূপ
ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বার
যেমন, “ত্র্যম্বক”, “রুদ্র”, “শিব”—এসব নাম বহুরৈখিক অর্থ বহন করে, যা নিরাকার পরসশিবের সাকার ধ্যানরূপ।
এই কারণে উপনিষদের অনেক অংশে শিব সরাসরি নেই, কিন্তু “আত্মা, ঈশান, সর্বজ্ঞ, মৃত্যুঞ্জয়”—এইসব পদে তাঁর তত্ত্ব গূঢ়ভাবে নিহিত।
উপনিষদে শিবতত্ত্ব গূঢ়ভাবে বিদ্যমান:—
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (বিশেষত অধ্যায় ৩ ও ৬) :
এখানে বহু জায়গায় রুদ্র/শিবকে পরম ব্রহ্ম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে—
“একো হি রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্থুঃ” — রুদ্রই একমাত্র, দ্বিতীয় কেউ নেই।
“তং ঈশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরং...” — দেবতাদের মধ্যে তিনি পরম ঈশ্বর, মহেশ্বর।
এগুলো ইঙ্গিত করে যে শিব/রুদ্রতত্ত্ব উপনিষদে ব্রহ্মতত্ত্বের গূঢ় ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পায়, সহজভাবে নয়।
“যমেষ্টসি” — দেবতাদেরও গূঢ়পূজ্য:
মন্ত্রের এই অংশ “যমেষ্টসি” বোঝায়, যমের মতো ধার্মিক শক্তিরাও এই নাম পূজা করে।
এটি বোঝায়:
পরম রুদ্র/শিব তত্ত্ব দেবতাদের ঊর্ধ্বতর।
ধর্ম, মৃত্যু ও ন্যায়বিচার—সবই তাঁর অধীন।
এর অর্থ হল, এই রূপ সাধারণ যজ্ঞানুষ্ঠানের বাইরে, গূঢ় তত্ত্বজ্ঞান ও আত্মোপলব্ধির মাধ্যমেই উপলব্ধি হয়।
গূঢ়তার কারণ:—
শিবতত্ত্ব কেন গূঢ়ভাবে নিহিত?
শিব নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ, যিনি রূপেও আছেন, রূপাতীতও। বেদ-উপনিষদে শিবের নাম, রূপ, ও শক্তি গূঢ়ভাবে গুপ্ত ও আভাসিত। শিবতত্ত্বের উপলব্ধি পেতে হলে চাই তপস্যা, মনোনিবেশ ও জ্ঞান। যা নব্য রামানুজী বৈষ্ণবদের নেই। নাহলে একটা অর্বাচীন উপনিষদ থেকে প্রক্ষিপ্ত শ্লোক দেখিয়ে শিবকে ছোট করতো না।
👉পরমেশ্বর শিবই প্রকৃত নারায়ণ —
এখানে ‘নারায়ণ’ শব্দটি ব্যবহার করা হলেও, তা কোনো পার্থক্যযুক্ত দেহধারী সত্ত্বাকে নয়, বরং সর্বব্যাপী চেতন একমাত্র পরমসত্ত্বা শিবকে নির্দেশ করে। সেই পরমসত্ত্বা শিব যখন সৃষ্টি না করে নিস্পন্দ অবস্থায় থাকেন, তখনই তিনি “কল্যাণময়, শুদ্ধ, নির্জন, নিরাকার”।
‘শিব’ অর্থেই আদিতম, নিষ্ক্রিয়, অদ্বৈত ব্রহ্ম — যিনি সৃষ্টি বা কর্মের বাইরে, তত্ত্বের কেন্দ্রে বিরাজমান। আবার সেই শিবই কর্মের স্তরে ‘নারায়ণ’ রূপে জলে শয়ন করেন, মহামায়ার দ্বারা সৃষ্টিকে ধারণ করেন এবং জগতকে স্থাপন করেন।
এখানে দর্শনীয় বিষয় হলো—
👉শিব হলেন বিরাট ব্রহ্ম, নির্বিকল্প রূপ।
👉নারায়ণ হলেন সেই শিবের ক্রিয়াশীল, সৃষ্টিপরিচালক রূপ।
শিব সংকল্প সূক্তম এ বলা হয়েছে—
ॐকারং চতুর্ভুজং লোকনাথং নারায়ণম্।
সর্বস্থিতং সর্বগতং সর্বপব্যাপ্তং তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্প মস্তু ॥ ২২ ॥
[ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২২ এবং ঋগ্বেদ খিলভাগ/৪/১১/২২]
অর্থ — যিনি চতুর্ভুজ (চারহাত বিশিষ্ট), অখিলব্রহ্মাণ্ডের স্বামী, সর্বত্রবিরাজমান, সর্বজ্ঞাতা সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী সেই নারায়ণরূপী পরমেশ্বর শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হোক ॥ ২২ ॥
"ভগবান শিবই ওংকার, তাঁর চারটি বাহু, তিনি সব জগতের পালনকর্তা। তিনি নারায়ণ, যিনি জলে অবস্থান করেন, তিনি সর্বত্র বিরাজমান। আমার মন যেন সর্বদা পরমেশ্বর শিবের প্রতিই স্থির থাকে।"
এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে — "নারায়ণ" নামটি শিবেরই এক রূপ।
এ প্রসঙ্গে শাস্ত্রে অনেক প্রমাণ পাওয়া যায় যেখানে নারায়ণকে শিবের রূপ বলা হয়েছে। তবে দেখে নেওয়া যাক—
সংভক্ষ্য সর্বভূতানি যুগান্তে পৰ্য্যুপস্থিতে।
যঃ শেতে জলমধ্যস্থস্তং প্রপদ্যেহম্বুশায়িনম্ ॥ ১০১ ॥
[মহাভারত/শান্তিপর্ব/অধ্যায় ২৭৭/১০১ শ্লোক]
অর্থ — প্রলয়কাল উপস্থিত হইলে, যিনি সমস্ত ভূতকে উদরস্থ করিয়া জলমধ্যে শয়ন করেন, সেই জলশায়ী নারায়ণরূপী মহাদেবের শরাণাপন্ন হইতেছি ॥ ১০১ ॥
এবং একই প্রমাণ রয়েছে পুরাণেও —
শিবই জলে শয়ণকারী নারায়ণ। [বামনপুরাণ/অধ্যায় ৪৭/১৫৩]
শিবই জলে শয়ণকারী নারায়ণ। [ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ/প্রক্রিয়াপাদ/অধ্যায় ৩১/২৭২]
শিবই সংহারে সর্বভূতকে উদরস্থ করে জলমধ্যে শয়ন করেন, শিবই সেই জলশায়ী নারায়ণ। [ব্রহ্মপুরাণ/অধ্যায় ৪০/৮৮
যঃ শেতে শেষশয়নে বিশ্বমাবৃত্য মায়য়া।
স্বাত্মাস্বানুভূতিযোগেন তস্মৈ বিশ্বাত্মনে নমঃ।।৬৩
[কূর্মপুরাণ/পূর্বভাগ/অধ্যায় ১০/৬৩]
অর্থ — যিনি(মহাদেব) স্বীয় আত্মার অনুভূতিযোগে মায়া দ্বারা বিশ্বকে আবৃত করিয়া শেষশয্যায় শয়ন করিয়া রহিয়াছেন, সেই বিষ্ণুমূর্তি পুরুষকে নমস্কার ।।৬৩।।
বৈষ্ণবদের তথাকথিত সাত্ত্বিক পুরাণেই রাজা জনক পরমেশ্বর শিবকে বলছেন যে, শিবই নারায়ণ মূর্তি। অর্থাৎ শিবই যে নারায়ণ রূপে জগৎ পালন করে তা পদ্মপুরাণ থেকেই প্রমাণ হয়ে যায়। এবার বৈষ্ণবরা হয়তো নিজেদের সাত্ত্বিক পুরাণকে প্রক্ষিপ্ত বলে দেবে।
চলুন তবে দেখে নেওয়া যাক—
ত্রিভুবনমূর্তে বেদপুরাণমূর্তে যজ্ঞমূর্তে স্তোত্র-মূর্তে শাস্ত্রমূর্তে, স্বধামূর্তে নারায়ণমূর্তে সর্ব্ব দেবতামূর্তে ত্রয়ীময় ত্রয়ীপ্রমাণ ত্রয়ীনেত্র সামপ্রিয় বসুধারাপ্রিয় ভক্তিপ্রিয় ভক্তসুভাভক্তবিদূরস্তুতিপ্রিয় ধূপপ্রিয় দীপপ্রিয় ঘৃতক্ষীরপ্রিয় দ্রোণকবরবীরপ্রিয় শ্রীপত্রপ্রিয় কমলকহলারপ্রিয় নন্দ্যাবর্তপ্রিয় বকুলপ্রিয় যূথিকাপ্রিয় কোকনদপ্রিয় গ্রীষ্মজলাবাসপ্রিয় যমনিয়মপ্রিয় নিয়তেন্দ্রিয়প্রিয় জপপ্রিয় শ্রাদ্ধপ্রিয় গানপ্রিয়, গায়ত্রীপ্রিয় পঞ্চব্রহ্মপ্রিয় সদাচারপ্রিয় গোত্রোৎসাদিকমলভবহরিহরনয়নসমর্চ্চিতপাদকমলজয়প্রদ হরিপ্রার্থিতজলোৎপাটিতচক্রপ্রদর্শকৃৎস্মৃতিযুক্তিপ্রদ স্মৃতিমঙ্গল প্রদমহ্যাং জয় নমস্তে নমস্তে ॥ ১০০
ইতি স্তোত্রমাকর্ণ্য ভগবান ভবো রাজন মুরাচ বরদোঽহং বরং বৃণু ॥ ১০১
[পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/৭১ অধ্যায়]
অর্থ — হে মহাদেব ! আপনি লোক মূর্তি, আপনি ত্রিভুবনমূর্তি বেদ-পুরাণ আপনার মূর্তি। আপনি যজ্ঞমূর্তি, স্তোত্র-মূর্তি, শাস্ত্রমূর্তি, স্বধামূর্তি ও নারায়ণের মূর্তি রূপে বিরাজমান রয়েছেন, সমস্ত দেবতা আপনার মূর্তি। আপনি বেদমন্ত্র, আপনি বেদ-সমূহের প্রমাণ এবং বেদসমূহও আপনাকে প্রমাণ করিয়া থাকে। তিন বেদ আপনার তিন নেত্র। আপনি সামপ্রিয়, বসুধারাপ্রিয়, ভক্তিপ্রিয়, যাহা ভক্তজনের সুলভ, অভক্তের পক্ষে নিতান্ত দুর্লভ, তাদৃশ স্তুতি আপনার প্রিয়, আপনি ধূপপ্রিয়, দীপপ্রিয়, আপনি ঘৃতদুগ্ধপ্রিয়, আপনি দ্রোণকরবীরপুষ্পপ্রিয়, বিল্বপত্রপ্রিয়, কমলকহ্লার পুষ্প-প্রিয়, নন্দ্যাবর্তমণ্ডল-প্রিয়, এবং বকুল, যূথিকা ও কোকনদ-পুষ্পপ্রিয়। গ্রীষ্মকালে জলে বাস আপনার প্রিয়। আপনি যমনিয়মপ্রিয়; জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি আপনার প্রিয়। আপনি জপপ্রিয় । শ্রদ্ধাপূর্বক প্রদত্ত দ্রব্যে আপনার প্রীতি। গানে আপনার প্রীতি। গায়ত্রীতে আপনার প্রীতি। আপনার নিজের পঞ্চব্রহ্মস্বরূপেই প্রীতি। আপনি সদাচারে তুষ্ট হন। সকল দেবতা সহ ব্রহ্মা আপনার পূজা করেন, শ্রীহরি বিষ্ণু নিজ চক্ষু তুলে আপনার পাদপদ্মে সমর্পণ করে পূজা করিয়াছেন। শ্রীহরির প্রার্থনায় আপনি আপনার চরণাঙ্গুল দিয়ে জল হতে লীলামাত্রেই সুদর্শনচক্র উৎপাদন করেছিলেন। আপনিই পৃথিবীতে স্মৃতি-শাস্ত্রোক্ত যুক্তি, এবং স্মৃতিশাস্ত্রোক্ত শুভকৰ্ম্ম সকলের প্রচার করিয়াছেন। আপনার জয় হউক। আপনাকে পুনঃপুনঃ নমস্কার। এইরূপ স্তব শ্রবণ করে ভগবান্ মহেশ্বর সেখানে আবির্ভূত হয়ে রাজাকে বললেন, আমি বর দিতে এসেছি, তুমি বর প্রার্থনা করো।
এই সমস্ত প্রমাণ একত্র করে দেখা যায়, শাস্ত্রানুসারে “জলশায়ী নারায়ণ”, যিনি সৃষ্টি-পূর্ব প্রলয়কালে একমাত্র অস্তিত্বশীল সত্তা, তিনি আদিতে ও অন্তে একমাত্র শিব। তিনি বিশ্বরূপ, বিষ্ণুরূপ, ব্রহ্মারূপ—সবই তিনিই। নারায়ণ নামটি কেবল তাঁর এক বিশেষ তত্ত্বীয় ও কর্মরূপ ব্যাখ্যা করে, কিন্তু সত্ত্বাগত দিক থেকে তিনি স্বয়ং শিব।
এই প্রসঙ্গে কুণ্ডিকা উপনিষদে বলা আছে যে —
নারায়ণোঽহং নরকান্তকোঽহং পুরান্তকোঽহং পুরুষোঽহমীশঃ ।
অখণ্ডবোধোঽহমশেষসাক্ষী নিরীশ্বরোঽহং নিরহং চ নির্মমঃ ॥ ১৭
[কুণ্ডিকা উপনিষদ/১৭]
অর্থ — আমিই নারায়ণ, আমিই নরকান্তক (যিনি নরকারসুরকে বধ করেছেন), আমিই পুরান্তক (ত্রিপুরান্তক) শিব, আমিই পুরুষ তথা ঈশ্বর। আমিই অখণ্ড বোধ স্বরূপ, সমস্ত প্রাণীদের সাক্ষী, আমিই ঈশ্বররহিত (যার উপর আর অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক নেই), অহংকার রহিত তথা মমতারহিতও আমিই ।।
এখানে আত্ম-অভিনিবেশের মাধ্যমে পরমাত্মার সঙ্গে একাত্ম বোধের নিখুঁত অভিব্যক্তি ঘটেছে। এখানে "আমি নারায়ণ", "আমি পুরান্তক শিব", "আমি ঈশ্বর", "আমি অখণ্ড বোধ"— এসব পরিচয়ে যোগী নিজের ভেতরের পরমসত্তাকে উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু এই উপলব্ধি একটি দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্পষ্টতই শিবতত্ত্বের সঙ্গে মিলে যায়।
শিব—অদ্বৈত চৈতন্যের প্রকাশ—
শিব মানেই পরমচৈতন্য, কল্যাণময় ব্রহ্ম, যিনি রূপ ও গুণ ছাড়িয়ে অনন্ত, অজন্মা এবং নিরাকার। শ্লোকে বলা হয়েছে— "अखण्डबोधोऽहम्", অর্থাৎ আমি অখণ্ড চৈতন্য। এই বোধ কোনো ব্যক্তিগত আত্মার নয়, বরং সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা সেই চৈতন্যের, তিনিই পরচৈতন্যস্বরূপ শিব যিনি সকলকে চেতনা প্রদান করেন।
নারায়ণ ও শিব — অভিন্ন ব্রহ্ম—
যদিও প্রথমেই বলা হয়েছে— “নারায়ণোঅহম্”, তবুও পরবর্তী অংশে “পুরান্তকোঅহম্” (ত্রিপুরাসুরবিনাশী শিব) উচ্চারিত হয়েছে। শাস্ত্রসম্মতভাবে শিব ও নারায়ণ উভয়েই এক অভিন্ন, কেননা মূল তত্ত্বটাই হলো শিবতত্ত্ব যিনি বিভিন্ন ভাবে লীলা করছেন। তার মধ্যে শিবের অন্যতম লীলামূর্তি হলো নারায়ণ। যিনি জলমধ্যে শয়ণ করেন, এবং জগতকে পালন করেন। তাই শাস্ত্রে নারায়ণও শিবের একাত্ম দেখানো দেখানো হয়েছে অনেক অংশে।
এইভাবে নারায়ণ নামটি যদিও ব্যবহৃত হয়েছে, তা শিবতত্ত্বের প্রতিই ইঙ্গিত করে, কারণ মূল অনুভব হচ্ছে— “আমি এক ও অদ্বিতীয় পরমস্বরূপ, যিনি রূপ-নাম-সীমার ঊর্ধ্বে”। আর এটাই হলো শিবের তুরীয় সত্ত্বা, তাই শ্রুতিশাস্ত্রে বলছে— “ শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্ চতুর্থং মন্বন্তে স আত্মা স বিজ্ঞেয়” [মাণ্ডুক্য উপনিষদ/৭]।।
'আমি ঈশ্বররহিত', 'আমি নির্মম'—শিবের স্বরূপ
“নিরীশ্বরোঅহম্”— আমি এমন এক সত্তা, যাঁর উপর আর কোনো শাসক নেই। এমন চরম সর্বোচ্চ অবস্থা একমাত্র শিবের ক্ষেত্রেই উপযুক্ত, কারণ শিবের তত্ত্বই বলে— তিনি স্বয়ম্ভূ, নিজশক্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং নিয়ন্ত্রণের অতীত।
“নির্মমঃ”— মমতাহীন, কিন্তু তা নিষ্ঠুরতার অর্থে নয়, বরং রাগ-দ্বেষের ঊর্ধ্বে থাকা এক সম-ভাবের চেতনাস্বরূপ।
এই উপনিষদীয় শ্লোকটিতে যোগীর উপলব্ধি, আত্মা ও পরমাত্মার অবিচ্ছেদ্যতার ঘোষণা— সব মিলিয়ে যে পরমসত্তার দর্শন ফুটে ওঠে, তা শিবতত্ত্বেই নিখুঁতভাবে মেলে। এই শিব না কোনো রূপে সীমাবদ্ধ, না কোনো দেবত্বে— তিনি একমাত্র অদ্বৈত পরমাত্মা, যাঁর সঙ্গে একাত্ম হওয়া মানেই মোক্ষ, মানেই চূড়ান্ত আত্মসিদ্ধি।
🔶মহাভারতে শিব বিষ্ণুকে আশীর্বাদ করে বলেন যে —
পরমেশ্বর শিব বলেন —
মৎ প্রসাদান্মনুষ্যেষু দেবগন্ধর্বযোনিষু ।
অপ্রমেয়বলাত্মা ত্বং নারায়ণ ভবিষ্যসি ॥ ৮০ ॥
(মহাভারত, অনুশাসন পর্ব, অধ্যায় ২০১, শ্লোক ৮০)
অর্থ — "পরমেশ্বর শিব বলেন — আমার কৃপায় তুমি 'নারায়ণ' নামে খ্যাত হবে। তোমার শক্তি ও বীর্য অপরিমেয় হবে — যা মানুষ, দেবতা বা গন্ধর্বদেরও ছাড়িয়ে যাবে।"
পরমেশ্বর শিবের প্রতি বিষ্ণুর প্রণাম (লিঙ্গ পুরাণ, পূর্বভাগ, অধ্যায় ৯)—
ভগবান বিষ্ণু নিজেই শিবকে প্রণাম করে বলেন—
নমস্তুভ্যং নমো নারায়ণায় চ ।
নমো হিরণ্যগর্ভায় আদিদেবায় তে নমঃ ॥ ২৫
অর্থ — "সবকিছুর পালনকর্তা আপনাকে প্রণাম। নারায়ণ এবং হিরণ্যগর্ভ, আদিদেব — আপনাকেই নমস্কার।"
✅ সিদ্ধান্ত—
যতই শাস্ত্র পড়ে দেখা হয়, একটাই সত্য বারবার সামনে আসে— সেই একমাত্র সর্বশক্তিমান সত্য সত্ত্বা, যিনি নিজেই নিজের প্রকাশ, যিনি সব জানেন, সবার ভিতরে আছেন, আবার যিনি রূপ-নামের ঊর্ধ্বে থেকেও ইচ্ছামতো নানা রূপে প্রকাশিত হন— তিনি হলেন শিব।
শ্রুতি, স্মৃতি— সব শাস্ত্রই একবাক্যে বলে যে, শিবই পরম ব্রহ্ম। আর যেসব দেবতার কথা শাস্ত্রে আছে— যেমন নারায়ণ বা বিষ্ণু— তাঁরা সবাই মহান ও পূজনীয় হলেও, তাঁদের অস্তিত্বও শেষ পর্যন্ত শিবতত্ত্বের মধ্যেই মিলে যায়।
শিব হলেন সেই চিরন্তন পুরুষ, যিনি কোনও শুরু বা শেষ ছাড়া সর্বত্র বিরাজমান। তিনি শুধু একটি নাম নয়, তিনিই সেই নিরাকার ও নির্গুণ ব্রহ্ম, যিনি নিজের ইচ্ছায় নানা রূপে, নানা গুণে প্রকাশিত হন। এজন্যই শাস্ত্রে বলা হয়েছে: "শিবই একমাত্র ব্রহ্ম, তাঁর বাইরে কিছু নেই।"
সুতরাং, নিরপেক্ষভাবে এবং শাস্ত্রসম্মতভাবে বিচার করলে দেখা যায়, শিবই সর্বোচ্চ সত্য, আর অন্য সব দেবতা সেই পরম শিবতত্ত্বের বিভিন্ন দিক মাত্র।
——————————————————————————————————————————————
👉এবার আসা যাক শ্রুতিতে ব্যবহৃত ‘নারায়ণ’ পদের ব্যাকরণ ভিত্তিক ব্যাখ্যাতে —
“নারায়ণ”—একটি নাম, একটি তত্ত্ব, এবং একটি বিতর্ক।
প্রচলিত ধারণায়, "নারায়ণ" নামটি প্রায়শই বিষ্ণুর সঙ্গে যুক্ত। বহু বৈষ্ণব পণ্ডিত ও ভক্তরা দাবি করেন, এই নামটি শুধুমাত্র বিষ্ণুকেই বোঝায়। অথচ বৈদিক ও পুরাণীয় সাহিত্যে “নারায়ণ” শব্দটি শুধুমাত্র বিষ্ণুর নয়, বরং ব্রহ্মা, রুদ্র, এমনকি সর্বব্যাপী পরশিবের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে।
👉পাণিনিসূত্র ও ব্যাকরণিক প্রেক্ষাপট
পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে একটি বিখ্যাত সূত্র আছে—
পূর্বপদাৎ সংজ্ঞায়ামগঃ ॥ ৮.৪.৩ ॥
👉এটির ব্যাখ্যায় ভট্টোজি দীক্ষিত বলেন—
সমস্তপদে যদি প্রথম অংশে ‘র’ বা ষ’ থাকে, এবং তা যদি কোনো নামের (সংজ্ঞা) অংশ হয়, তবে দ্বিতীয় অংশে উপস্থিত 'ন' অক্ষর 'ণ' হয়ে যায় (ণত্ব প্রাপ্ত হয়), যদি মাঝখানে গ-কার না থাকে।
এর বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায় ‘শূর্পনখা’, ‘বার্ধীণসঃ’ ইত্যাদিতে। এগুলো proper noun না হয়েও, শুধুমাত্র নাম (সংজ্ঞা) হওয়ায় ণত্ব লাভ করেছে।
তাহলে এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি—
Proper noun না হলেও কোনো “name” যদি সমাস হয়, এবং রেফ বা ষ থাকে প্রথম পদে, তবে ণত্ব ঘটে,
অর্থাৎ নারায়ণ শব্দে ন > ণ হওয়াটা একেবারে নিয়মসিদ্ধ
অতএব, যারা বলেন "নারায়ণ" শব্দে "ণ" থাকার মানে এটি proper noun (Vishnu) — তারা ভুল ব্যাখ্যা করছেন।
👉সব শব্দই পরমেশ্বর শিবের প্রকাশ—
শব্দ, নাম, রূপ — সবই পরম শিবের বিকাশিত শক্তি (শব্দশক্তি/শক্তি-তত্ত্ব)।
“নাম” মানেই কোন সত্তার বৈশিষ্ট্য প্রকাশ।
যেহেতু শিব সকল বৈশিষ্ট্যের আধার, তাই সব নামই শিবকে প্রকাশ করে।
তাই শ্রুতিতে ‘নারায়ণ’ নাম দ্বারা প্রতিপাদ্য বস্তু এক পরশিবই।
👉ব্যাখ্যা—
‘নার’ + ‘আয়ন’ – শৈব দৃষ্টিতে অর্থ
‘নারায়ণ’ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে পাই—
‘নার’ = জীব/জল/সত্তা
‘আয়ন’ = আশ্রয়, গতি, গমনস্থান
অর্থ— “যার মধ্যে সমস্ত ‘নার’ (জীবসত্তা/জ্ঞান/জল) আশ্রয় নেয়” — তিনিই নারায়ণ।
এই প্রসঙ্গে শাস্ত্রে বলেছে—
"নরাণামানং যম্মাতেন নারায়ণঃ স্মৃতঃ"।।
[ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ/প্রক্রিয়াপাদ/অধ্যায় ৫/৩৬]
নরগণের একমাত্র গতি/আশ্রয় বলেই পরমাত্মাকে নারায়ণ বলে।।
👉এই সংজ্ঞা দ্বারা শিবই প্রতিপাদিত হয়, কেননা—
১. শিব সর্বব্যাপী—
"সর্বব্যাপী স ভগবান্ তস্মাৎ সর্বগতঃ শিবঃ"
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/শ্বেতাঃ উঃ/৩/১১]
অর্থাৎ সাক্ষাৎ পরমেশ্বর শিবই সর্বব্যাপী।
এ প্রসঙ্গে ঋগবেদে বলা আছে—
সর্বস্থিতং সর্বগতং সর্বপব্যাপ্তং তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্প মস্তু।।
[ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২২ এবং ঋগ্বেদ খিলভাগ/৪/২২]
২. শিব সব কিছুর গতি ও গন্তব্য—
তস্মাদহং রুদ্রো যঃ সর্বেষাং পরমা গতিঃ।।৮।।
[ভস্মজাবাল উপনিষদ/২/৮]
এই (সংসারের বন্ধন থেকে উৎপন্ন হওয়া দুঃখ থেকে মুক্ত করবার) কারণেই আমিই হলাম রুদ্র যে রুদ্র সকলের পরম গতি ও গন্তব্য ॥ ৮ ॥
এবং শ্রুতিতে আরও বলা আছে—
সর্ব্বতঃ পাণিপাদং তৎ সর্বতোহক্ষিশিরোমুখম্।
সর্ব্বতঃ শ্রুতিম শ্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি ॥ ১৬ সর্ব্বেন্দ্রিয়গুণাভাসং সর্ব্বেন্দ্রিয়বিবর্জিতম্।
সর্বস্য প্রভুমীশানং সর্বস্থ্য শরণং সুহৃৎ ॥ ১৭
[শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৩ অধ্যায়/১৬-১৭ নং মন্ত্র]
পরমেশ্বর ঈশান শিবের সর্বত্র পাণিপাদ, সর্বত্র চক্ষুঃ শির ও মুখ, সর্বত্র শ্রবণ, এবং তিনি সংসারে সকলকেই ব্যাপিয়া অবস্থিতি করিতেছেন।।।১৬।।
পরমেশ্বর ঈশান শিবের শরীর অপ্রাকৃত, অতএব উহার প্রত্যেক অবয়বে সকল ইন্দ্রিয়ের ধর্মই প্রকাশ পেয়ে থাকে। তাঁর প্রাকৃত কোন ইন্দ্রিয়ই নাই। তিনি সকলের প্রভু ও নিয়ন্তা; তিনি সকলের সুহৃৎ ও আশ্রয়।।১৭॥
শ্রুতিতে বলা আছে— "সর্বে বৈ রুদ্রঃ" [তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০/২৪/১] ইত্যাদি শ্রুতি বাক্য দ্বারা এটা জানা যায়, সর্ব কিছুই রুদ্র দ্বারা পরিচালিত।
তাই নারায়ণ বলতে, পরম শিবই।
নারায়ণ একটি গুণবাচক, অবস্থাবাচক, ও দর্শনবাচক শব্দ। এর অর্থ শুধুমাত্র “বিষ্ণু” দেবতা নয়, বরং সেই সর্বসত্তার আশ্রয়, যিনি সকল নরের গন্তব্য। শ্রুতি ও স্মৃতি শাস্ত্র সমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শিবই সেই চূড়ান্ত আশ্রয়, চূড়ান্ত গতি, ও সর্বজ্ঞ সর্বব্যাপী সত্তা।
অতএব—
নারায়ণ বলতে বোঝানো হয় পরমেশ্বর শিবকেই, যিনি রুদ্র রূপে জীবের সমস্ত গতি, গন্তব্য ও শরণ।
👉ঋগ্বেদের শিবসঙ্কল্পসূক্তে ‘নারায়ণ’ নামের ব্যবহার
ঋগ্বেদের শিবসঙ্কল্প সূক্ত—
ॐকারং চতুর্ভুজং লোকনাথং নারায়ণম্।
সর্বস্থিতং সর্বগতং সর্বপব্যাপ্তং তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্প মস্তু ॥ ২২
[ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২২ এবং ঋগ্বেদ খিলভাগ/৪/২২]
এই মন্ত্রে ‘নারায়ণ’ নামটি শিবসঙ্কল্পের (অর্থাৎ শিব-ইচ্ছার) অংশ হিসেবে প্রার্থনা করা হয়েছে।
এর দ্বারা বোঝা যায়—
ঋগ্বেদের মতো প্রাচীন স্তোত্রেও ‘নারায়ণ’ নামটি শিবের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।
এটি শৈব দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রমাণ, যা বলে—শব্দটি যাকে নির্দেশ করে তা প্রেক্ষাপটভিত্তিক।
👉পুরাণসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি—
লিঙ্গ পুরাণ (১/১৮/২৫)—
“সর্বায় চ নমস্তুভ্যং নমো নারায়ণায় চ ।”
শিবের উদ্দেশে প্রার্থনা করে বলা হচ্ছে — তোমাকেই নারায়ণ বলা হচ্ছে।
কূর্ম পুরাণ (১/৬/৩) ও বিষ্ণু পুরাণ (১/৩/৪)—
"ब्रह्मा नारायणाख्यस्तु सुष्वाप सलिले तदा"।
“नारायणाख्यो भगवान् ब्रह्मा लोकपितामहः।”
ব্রহ্মাকেও নারায়ণ নামে সম্বোধন করা হচ্ছে।
অর্থাৎ শৈব দর্শন বলে, নারায়ণ নামটি কেবল বিষ্ণুর ‘ব্যক্তি’ নয়, বরং একটি ‘তত্ত্ব’—যে তত্ত্ব শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, সকলেই ধারণ করতে পারেন।
👉শৈবাগমে ও কাশ্মীর শৈব দর্শনে বলা হয়—
শব্দ (nāma) ও রূপ (rūpa) সবই পরম শিবের বিকাশ
বহু মুখে শিব — বিভিন্ন ধর্ম, মূর্তি, নাম, অথচ এক সত্তা
সুতরাং “নারায়ণ” নাম শিবের মুখেও প্রকাশ পেতে পারে।
শিবসূত্র (১.১)—
“চৈতন্যমাত্মা” — চৈতন্যই আত্মা
এই চৈতন্য, এই সর্বব্যাপী আত্মা — শিব।
আর ‘নারায়ণ’ শব্দেও এই সর্বচৈতন্যের আশ্রয় ভাবনা প্রকাশ পায়।
👉‘নারায়ণ’ নাম কেবল proper noun বা বিষ্ণুর ব্যক্তিনির্দেশ নয়। এটি এক সর্বব্যাপক পরশিবেরই তত্ত্ব, যা বিভিন্ন উপাসনায় নানা রূপে ব্যবহৃত। ব্যাকরণ ও অর্থভেদ অনুসারে, এই নাম শিবের জন্য প্রযোজ্য। শাস্ত্রতে তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
শৈব দর্শন বলে—সব নাম, সব রূপ, সব শব্দ—শেষ পর্যন্ত শিবেরই প্রকাশ।
👉শাস্ত্রে বলা হয়েছে—
আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র (৪/৯/২৭) বলছে—
"সর্বাণি হ বা অস্য নামধেয়ানি"
সব নামই রুদ্রের।।
এই প্রসঙ্গে শ্রুতিতে পরমেশ্বর শিব বলছেন—
সোঽহং সর্বাকারঃ ॥ ৮
[ভস্মজাবাল উপনিষদ/২/৮]
সেই আমিই সকল রূপের আকারের ধারক ॥ ৮ ॥
অর্থাৎ—পরমতত্ত্ব পরশিবের সব নামই এক চেতনার বিভিন্ন রূপ, যার কেন্দ্রে রয়েছেন রুদ্র। কেননা, জগতের যত নাম ও রূপ তা বস্তুত রুদ্রেরই, কারণ রুদ্র'ই সর্বব্যাপী।
যেমন—
‘সূর্য’ মানে কেবল জ্যোতির্ময় নক্ষত্র বা আকাশের রোদ নয়, সে ঈশ্বররূপেও পূজিত হন।
‘গঙ্গা’ শুধু নদীর নাম নয়, সে এক দেবী।
তেমনই—
‘নারায়ণ’ কেবল বিষ্ণুর নাম নয় —
এটি শিব, ব্রহ্মা ও সর্বজনের আশ্রয়রূপ এক পরম সত্যের বহুবচন। সেই পরম সত্য এক পরশিবই।
👉তাই সিদ্ধান্ত হলো—
ব্যাকরণে যেভাবে বলা হয়েছে, সেইমতো ‘নারায়ণ’ শব্দে ‘ণ’ আসা স্বাভাবিক।
এই শব্দ কোনো একক দেবতার একচেটিয়া নাম নয়।
ধর্ম, দর্শন ও ভাষা—এই তিনের মিলেই ‘নারায়ণ’ শব্দের পূর্ণতা।
তাই সকলদিক বিবেচনা করে এটাই জানা যায় যে, শ্রুতিতে 'নারায়ণ' বলতে সেই এক সর্বব্যাপী পরমেশ্বর পরশিবই।
👉এখানে বিষয়টি বুঝতে হবে বেদে কোন শব্দ কি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ একই শব্দ বেদে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই কোথাও নারায়ণ শব্দটা দেখলে তাকে অর্থের অপপ্রয়োগ করে পৌরাণিক চতুর্ভুজ নারায়ণ দাবী করলে তা হবে চরম মূর্খতা। কেননা শ্রুতিতে নারায়ণটা কে তা ইতি মধ্যেই বিশদে বর্ণনা করছি। দরকার পড়লে আবার উপরে স্ক্রল করে পড়ে নিন।
আমরা কখনই এমন অর্বাচীন দাবীকে খণ্ডন করতাম না। কেননা এখানে মহো উপনিষদ কোনো মান্য শাস্ত্র নয়, ইহা একটি অর্বাচীন উপনিষদ মাত্র। খণ্ডন করার একমাত্র কারণ হলো, সাধারণ মানুষ শাস্ত্র ও তত্ত্বগত জ্ঞান হতে অনভিজ্ঞ। তাই সাধারণ মানুষকে যাতে বিভ্রান্ত করে ভুলটা সঠিক বলে চালিয়ে দেওয়া না হয় সে জন্যই, ছাগমুখ বৈষ্ণবদের এই অবান্তর দাবী খণ্ডাতে হলো।
এই সমস্ত প্রমাণ থেকে বোঝা যায়:
উপনিষদে যিনি "নারায়ণ" নামে উল্লেখিত — তিনি আসলে শিবই।
শিবই — ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র প্রভৃতি সব দেবতার উৎস।
"নারায়ণ" নামটিও শিবের কৃপায় বিষ্ণু লাভ করেন।
কিছু বৈষ্ণব প্রচারক এই শ্লোকগুলিকে আংশিক ব্যবহার করে সাধারণ ভক্তদের বিভ্রান্ত করেন মাত্র।
সুতরাং বৈষ্ণবদের যে নব্য দাবী ছিলো যে সৃষ্টির আদিতে কেবল পরমপুরুষ নারায়ণ ছিলেন, ব্রহ্মা বা ঈশান কেউই ছিলেন না, তা অদ্বৈত শৈবপক্ষ থেকে খণ্ডিত করা হলো।
নমঃ শিবায় 🙏
নমঃ শিবায়ৈ🙏
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে ✊🚩
“সর্বে হ্যেষ রুদ্রস্তস্মৈ রুদ্রায় নমো অস্তু”
✍️অপপ্রচার দমনে— অন্তিক ভট্টাচার্য্য (শম্বরনাথ শৈব)
🌻বিশেষ কৃতজ্ঞতা— আমার গুরু শ্রী নন্দীনাথ শৈবাচার্য ও আমার আদর্শ শ্রী রোহিত কুমার চৌধুরী শৈবজী।
কপিরাইট ও প্রচারে— আন্তর্জাতিক শিবশক্তি জ্ঞান তীর্থ (International Shiva Shakti Gyan Tirtha)
বিঃ দ্রঃ — লেখাটি অনুকরণ করলে সম্পূর্ণ করবেন, কোনো রকম কাটছাট গ্রহণযোগ্য নয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন