শিব কি বিষ্ণুর ধ্যান করেন ?

 




🚫 বৈষ্ণবদের দাবী : 

শিব হল বিষ্ণুর শ্রেষ্ঠ ভক্ত বৈষ্ণব। ভাগবত পুরাণে কথিত আছে, শিব সর্বদা শ্রীহরির নাম জপ করে, ধ্যান করে। পদ্মপুরাণেও বলা আছে শিব সর্বদা শ্রীহরির নামে মগ্ন থাকেন। তিনি পঞ্চমুখে রাম নাম গায়ন করেন, কৃষ্ণকথা বলেন, শ্রীবিষ্ণুর আরাধনাকেই শ্রেষ্ঠ বলেছেন। বৈষ্ণব শাস্ত্রে শিবকে বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে।

_____________________________________________


🔥 শৈবদের পক্ষ থেকে শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী বৈষ্ণবদের দাবীকে বৈষ্ণদের‌ই শাস্ত্র থেকে অসত্য প্রমাণ করতে গিয়ে বলেছেন :


হে বৈষ্ণব মহোদয়/মহোদয়া !

  আপনি যে পদ্মপুরাণ, ভাগবত পুরাণ ইত্যাদি বৈষ্ণবীয় ভাবধারার আধিক্যে পূর্ণ পুরাণ গুলির বচনকে প্রামাণিক বলে মেনে নিয়ে উল্লেখ করেছেন, সেই পদ্মপুরাণ ভাগবত পুরাণ, বৃহন্নারদীয় পুরাণ ইত্যদি পুরাণেই — প্রভু শিব কোন কারণে শ্রীবিষ্ণুর/শ্রীরামচন্দ্রের/শ্রীকৃষ্ণের গুণগান করে থাকেন — সেই রহস্য ফাঁস করা আছে। 


আপনারা বৈষ্ণবরা নিজেদের প্রাণপ্রিয় এই শাস্ত্রগুলি যদি ভালো করে অধ্যয়ন করতেন, তাহলে প্রভু শিবকে পরমেশ্বর বলবার স্থানে বিষ্ণুভক্ত বৈষ্ণব বলে দাবী করতেন না।

সনাতন ধর্মের যে কোনো ধর্মীয় মান্যতা মান্যতা শাস্ত্রের বচনের মাধ্যমেই প্রামাণিক বলে মান্য ও গণ্য হয়।  কোনো দেবদেবীর সম্পর্কে কাল্পনিক কাহিনী রচনা করে সমাজে প্রচার করে বেড়ানোর মতো কর্ম হল অধর্ণের লক্ষণ। তাই সনাতন ধর্মের কোন বিষয়টি সত্য আর কোনটি অসত্য, তা সর্বদা শাস্ত্রের আলোকেই গ্রহণ করতে হয় । 

যা অসত্য কাহিনী, যা শাস্ত্রের বচন নয়, তা কখনোই ধর্মের উন্নতি ঘটায় না,বরং ধর্ম থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

তাই সনাতন ধর্ম সম্পর্কে যা কিছু মান্যতা সমাজে প্রচলিত হচ্ছে তার মধ্যে যতটুকু শাস্ত্রে আছে সেটিই মীমাংসা করে মান্য করা উচিত, কোনো অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কার ছড়িয়ে সনাতন ধর্মের উন্নতি সাধন সম্ভব নয়। সকল সনাতনীর কর্তব্য হল শাস্ত্রের যা নির্দেশ রয়েছে তা মান্য করা, নিজের কাল্পনিক মনগড়া কাহিনী সর্বোপরি নয়, একমাত্র শাস্ত্রের বচন‌ই সর্বোপরি । শাস্ত্র যা বলে তা ই একমাত্র গ্রহণ করবেন, নিজের ব্যক্তিগত ধারণাকে নয়। তাই সেই শাস্ত্রের বচনকেই উদ্ধৃত করে আমি সত্য উন্মোচন করছি ।


এখন 🌷 বিষ্ণুভক্ত/কৃষ্ণভক্ত/রামভক্ত বৈষ্ণবদের প্রশ্ন তাহলে কৈলাসে যে শিব বসে ধ্যান করেন, সেটি কিসের জন্য করেন  ? 


শঙ্কর উবাচ্- 

ধ্যায়েনকিঞ্চিৎ গোবিন্দননমস্যেহকিঞ্চন ॥২৪৮

নোপাস্যেকিঞ্চনহরেনজপিষ্যেহকিঞ্চন 

কিন্তু নাস্তিকজন্তুনাং প্ৰবৃত্ত্যৰ্থমিদংময়া ॥২৪৯

[(তথ্যসূত্র - চৌখাম্বা প্রকাশনির প্রকাশিত - পদ্মপুরাণ/পাতাল খন্ড/ ১১৪ নং অধ্যায়)/(নবভারত প্রকাশনির প্রকাশিত - পদ্মপুরাণ/পাতালখণ্ড/৬৯ অধ্যায়/২৯৮-৩১০ শ্লোক)]

✅ অর্থ : হে গোবিন্দ! বস্তুত আমি কারোর‌ই ধ্যান করিনা, কাউকে প্রণাম করিনা, কাউকে উপাসনা করিনা এবং কারও জপ করিনা। নাস্তিকদেরকে এবং জগৎবাসিকে শিক্ষা প্রদানের নিমিত্তে আমি নিজ ইচ্ছায় নিজ বিধি নিয়মে আবদ্ধ হই মাত্র। কেননা আমিই পরমেশ্বর।


বিশ্লেষণ  — পদ্মপুরাণে উক্ত অধ্যায়ের প্রসঙ্গে পরমেশ্বর শিবকে সন্ধা করতে দেখে আশ্চর্য হয়ে শ্রী হরি বিষ্ণু জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনি কার ধ্যান করেন, কার জপ করেন, কার উপাসনা করেন? 

পরমেশ্বর শিব শ্রীহরির প্রশ্নের উত্তরে বললেন যে, শিব কাউকে ধ্যান করে না বা প্রণাম করে না কারো উপাসনা করে না তিনি কারণ নাম জপ‌ও করে না শুধুমাত্র তিনি নাস্তিক ও অন্যান্য সমগ্র জগত বাসি কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি নিজের ইচ্ছেমতো নিজের বিধিতে তিনি আবদ্ধ হন অর্থাৎ সকলকে তিনি শুধুমাত্র শিক্ষা দেবার কার্যটুকু করেন,যা শিবের‌ই লীলামাত্র। তাই পরমেশ্বর শিব কখনোই রাম নাম জপ ও করেন না তিনি রাম কে প্রণাম ও করেন না তিনি রামের ধ্যান করেন না তিনি রামকে পুজো করেন না, তিনি শুধুমাত্র লীলাবশত নিজের ভক্তের উচ্চ প্রশংসা করেন মাত্র। কারণ তিনি তাঁর ভক্তদের প্রতি স্নেহ করেন এবং ভালবাসেন তাই তিনি স্নেহবশত তো তার ভক্তদের স্মরণ করে থাকেন বা তাদের গুণগান গেয়ে থাকেন।


 এই একই কথা শিবমহাপুরাণে পরমেশ্বর শিব বলেছেন -

চলুন দেখে নেওয়া যাক -

সর্বে রুদ্রং ভজন্ত্যেব রুদ্রঃ কঞ্চিদ্ভজেন্ন হি ।

স্বাত্মনা ভক্তবাৎসল্যাদ্ভজত্যেব কদাচন ॥ ১৫

[তথ্যসূত্র – শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্রসংহিতা/অধ্যায় ৪২]

☘️অর্থ – সবাই ভগবান রুদ্র তথা পরমেশ্বর শিবের ভজনা করেন, কিন্তু পরমেশ্বর শিব কারোর ভজন করেন না, কখনো কখনো ভক্তবৎসলবশত তিনি নিজেই নিজের ভক্তের প্রশংসা রূপে ভজনা করে থাকেন ॥ ১৫


অত‌এব, পরমেশ্বর শিব বা কৈলাসপতি রুদ্রদেব‌ও কখনোই বৈষ্ণব নন, শিব কখনোই পঞ্চমুখে রামনাম‌ও করেন না। তিনি রামের গুণগান করেন শুধুমাত্র রামের শিবভক্তির মহানতার কারণে। কিন্তু কলিরচর বৈষ্ণবেরা সেই পরমসত্যকে ধামাচাপা দিয়ে অসত্য কাল্পনিক গল্পের ভাণ্ডার খুলে পরমেশ্বর শিবকে বিষ্ণুদাস/কৃষ্ণদাস/রামদাস বানানোর অপপ্রচেষ্টা করে চলেছে।


ভাগবতপুরাণেও বলা হয়েছে, পরমেশ্বর শিব জগতের হিতের জন্য জপ ধ্যান করবার লোকাচার পালন (অভিনয়) করেন মাত্র —

বিদ্যাতপোযোগপথমাস্থিতং তমধীশ্বরম্ ।

চরন্তং বিশ্বসুহৃদং বাৎসল্যাল্লোকমঙ্গলম্ ॥ ৩৫

(ভাগবত পুরাণ/৪র্থ স্কন্ধ/৬ অধ্যায়/৩৫ নং শ্লোক)

✅ অর্থ : ঈশ্বর মহাদেব হলেন সমগ্র বিশ্বসংসারের সুহৃদ, স্নেহবশত তিনি সবার কল্যাণকারী, তিনি একমাত্র লোকহিতের জন্যই বিদ্যার চর্চা, উপাসনা, চিত্রের একাগ্রতা আর ধ্যানযোগের দ্বারা সমাধি আদি তপ-সাধনার আচরণ করতে থাকেন ।


🟦 আরো দেখুন 👇 

ধ্যায়ে ন কিঞ্চিদ্গোবিন্দ নমস্যে হু ন কিঞ্চন ।

কিন্তু নাস্তিকজন্তুনাং প্ৰবৃত্ত্যৰ্থমিদং ময়া ॥২০০

দর্শনীয়ং হরে চৈতদন্যথা পাপকারিণঃ ।

তস্মাল্লোকোপকারার্থমিদং সর্বং কৃতং ময়া ॥২০১

ওমিত্যুৎক্ত্বা হরিরথ তং নত্বা সমতিষ্ঠত ।

অথ তে গৌতমগৃহং প্রাপ্তা দেবর্ষয়স্তদা ॥ ২০২

[বৃহন্নারদীয় পুরাণ/পূর্বার্ধ/৭৯ অধ্যায়/ ২০০-২০২ শ্লোক]


অর্থ — পরমেশ্বর শিব বললেন, হে গোবিন্দ ! না আমি কারোর ধ্যান করি, না আমি কাউকে নমস্কার করি‌ । তবুও শুধুমাত্র মনুষ্যগণ যাতে নাস্তিক প্রবৃত্তির শিকার না হয়ে যায় সেই কারণে আমি এই উপাসনা ইত্যাদি কার্য নিজে করে অন্যদের কাছে উদাহরণ উপস্থাপন করে থাকে ॥ ২০০

হে হরি ! এই প্রকারে স্বয়ং আমি এই কার্য করে অন্যদের জন্য কাছে এইভাবে উপাসনা করবার পথ দর্শন করিয়ে দিই, যদি আমি এভাবে পথ না দেখাই তবে সমস্ত লোক পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে যেতে থাকবে । সমস্ত লোকের উপকারের উদ্দেশ্যেই আমি এই উপাসনার অভিনয় মাত্র করি । এ কথা শুনে শ্রী হরি ওম উচ্চারণ করতে করতে ‘আপনি উচিত বচন বলেছেন’ — এভাবে বলে শ্রী হরি মহেশ্বর কে নতমস্তকে প্রণাম করলেন। এরপর তখন সমস্ত দেবতা এবং ঋষিগণ গৌতমের আশ্রমে পৌঁছে গেলেন ॥ ২০১-২০২


♦️ আরো দেখুন 👇 

ব্রহ্মা বিষ্ণুশ্চ রুদ্রস্য স্বাসাধারণরূপতঃ ।

স্ববিভূত্যাত্মনা চাপি  কুর্বাতে এব সেবনম্ ॥ ৫৫

রুদ্রঃ স্বেনৈব রূপেণ বিষ্ণোশ্চ ব্রহ্মণস্তথা ।

সেবনং নৈব কুরুতে বিভূতের্বা দ্বয়োরপি ॥ ৫৬

কেবলং কৃপয়া রুদ্রো লোকানাং হিতকাম্যয়া ।

স্ববিভূত্যাত্মনা বিষ্ণোর্ব্রহ্মণশ্চাপরস্য চ ॥ ৫৭

করোতি সেবাং হে বিপ্রাঃ কদাচিৎসত্যমীরিতম্ ।

ন তথা ব্রহ্মণা বিষ্ণুর্ণ ব্রহ্মা ন পুরন্দরঃ ॥ ৫৮

[স্কন্দমহাপুরাণ/সূতসংহিতা/যজ্ঞবৈভবখণ্ড/উত্তরার্দ্ধ/ (সূতগীতা) অধ্যায় ২]

অর্থ — ব্রহ্মা তথা বিষ্ণু নিজের রূপ তথা অবতার নিয়ে সেই অবতার আদি বিভূতিরূপ ধরেও সর্বদা ভগবান রুদ্রের ভজনা করেন। রুদ্র কোনোভাবেও‌ এদের সেবা করেন না ।

কখনো কখনো শুধুমাত্র কৃপাবশত মানুষ কে হিত শেখাবার জন্য ব্রহ্মাদি কে পূজ্য বলেন বা নিজের অবতারাদি বিভূতিরূপ দ্বারা বিষ্ণু, ব্রহ্মাদির সেবা করে দেন মাত্র । 

কিন্তু বিষ্ণু-ব্রহ্মা কৃপাবশত শিবের পূজা করে দেন এমনটা নয় ॥ ৫৫-৫৮


সুতরাং, পরমেশ্বর শিব যে শ্রীহরি বিষ্ণু বা কৃষ্ণ অথবা রামের ধ্যান করেন না, তা প্রমাণিত হয়ে গেল বৈষ্ণবদের মান্য পুরাণ শাস্ত্রের বচন থেকেই। বরং জগতবাসী কে সাধন মার্গের দিকে আগ্রহ করবার জন্য শিবাবতার কৈলাসবাসী ভগবান রুদ্রদেব ধ্যান করবার লোকাচার(অভিনয় কার্য‌) পালন করেন মাত্র। কখনো কখনো নিজের অংশস্বরূপ থেকে প্রকট হওয়া গণের মাধ্যমে বিষ্ণুর নেওয়া অবতার দের কার্য‌ সিদ্ধি করবার জন্য গণ কে প্রেরণ করেন।

শিবের প্রকৃত বাস্তব সত্যকে সরিয়ে এই বিভিন্ন দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রকাশের জন্য সেই দেবদেবীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে তাদের ভক্তি করবার জন্য শিবের দ্বারা অভিনীত চরিত্রকে কোথাও কোথাও বৈষ্ণব বা শাক্ত ইত্যাদি বলে উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র। 

জগতের সকল জীবেদের নাস্তিক হবার পথ থেকে আস্তিক হবার পথ প্রদর্শন করবার উদ্দেশ্যে প্রভু শিব নিজেই বিভিন্ন দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন, সেগুলিই পুরাণে কথিত হয়ে থাকে। প্রত্যেক কল্পে এক একটি নির্দিষ্ট দেবতা বা কোনো নির্দিষ্ট দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার হয়, সেই দেবদেবীকে জনপ্রিয় করতে, তাদের সম্পর্কে জগৎসংসারের কাছে পরিচয় করাবার জন্য পরমেশ্বর শিব নিজেই সেই দেবতা বা দেবীর মহিমাকে বর্ণনা করেন। বেদ, আগম-তন্ত্র, পুরাণ সব‌ই পরমেশ্বর শিবের‌ বর্ণনায় প্রকাশ পেয়েছে, অন্য কারোর দ্বারা নয়। সুতরাং, সাধারণ ভাবেও যদি বিচার করা হয় তবে বুঝতে পারা যায় যে, প্রভু শিবের ইচ্ছাতেই বিভিন্ন মতপথ সৃষ্টি হয়েছে। 

এখন অনেকে প্রশ্ন করবেন যে, এত দেবদেবীর কি প্রয়োজন? 

শিব‌ই তো সব, তাহলে সরাসরি শিব নিজের পথ না দেখিয়ে অনান্য দেবদেবী পথ দেখাতে গেলেন কেন ?

এই প্রশ্নের‌ও উত্তর আছে।

দেখুন, জীব সরাসরি শিব লাভ করলে তো আর সৃষ্টির খেলাটাই সমাপ্ত হয়ে যাবে, যত বেশি জটিল তত‌ই সেই সৃষ্টির খেলা পরম আনন্দদায়ক।

জীবের মধ্যে শিবের চেতনা লাভের জন্য যোগ্যতার প্রয়োজন পড়ে, প্রত্যেক দেবদেবীরূপে পরমেশ্বর শিব‌ই বিভিন্ন ভাবে জীবকে নিজ পরম স্বরূপ শিবের কাছে পৌঁছে দেবার কাজেই দায়িত্ব পালন করছেন।


শিবমহাপুরাণের উমাসংহিতা ও শিবগীতায় উল্লেখ আছে —

  জীবরূপী মানুষ কোনো জন্মে পাপ করে নরকভোগ করে, তারপর পুনরায় বিভিন্ন বৃক্ষযোনীতে জন্ম নিয়ে মৃত্যুপ্রাপ্ত হয়ে, ক্রমশ কীটপতঙ্গ,পাখী ও পশু হয়ে বারংবার জন্ম নিয়ে মৃত্যুপ্রাপ্ত হয়ে অবশেষে মানুষ হয়ে জন্ম নেন। এরপর তিনি পুণ্য কর্ম করে স্বর্গ লোকে গিয়ে আনন্দ উপভোগ করে পুনরায় মনুষ্য জন্ম প্রাপ্ত করেন। এভাবেই পাপ করলে নরক ও পুণ্য করলে স্বর্গ প্রাপ্তি করেন, এভাবে বারংবার মনুষ্যজন্মই প্রাপ্তি করেন। কিন্তু এর মধ্যে কোনো এক জন্মে মানুষ পুণ্যকর্মের বলশক্তির দ্বারা ক্রমশ ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি, সূর্য ইত্যাদি দেবতাদের প্রতি ভক্তি পরায়ণ হয়ে ওঠেন ও সৎকর্ম করে বারংবার স্বর্গলাভ করে আবার পুনরায় মনুষ্য জন্ম লাভ করেন। পূর্বজন্মে যে দেবতার ভক্তি করা হয়, তার ভক্তি পূর্ণ হলে, সেই দেবতার থেকেও যে দেবতার ক্ষমতা ও শক্তি অধিক, পরবর্তীতে জন্মে জন্মে এইভাবেই ক্রমশ প্রত্যেক দেবতার ভক্তি করতে করতে কখনো গণেশভক্ত, কখনো কার্তিকেয়র ভক্ত, কখনো বিষ্ণু ভক্ত, কখনো দেবীর ভক্ত হয়ে জন্ম নেয় মানুষ। প্রত্যেক দেবদেবীর ভক্তি সম্পন্ন হলে মানুষ সেই দেবদেবীর লোকে চলে যায়।


 তারপর আবার জন্ম নেন, এই কোটি কোটি জন্ম ধরে জীব এত সৎকর্ম করবার ফলে যে পুণ্য অর্জন করেন, সেই পুণ্যের দ্বারা অবশেষে সেই জন্মে তার হৃদয়ে অজানা কারণেই শিবের প্রতি আকর্ষণ অনুভব হয়, তখন সেই জীব শিবভক্তি লাভ করে — এই কথা শিবগীতার প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে। এরপর সেই জীব শিবের পূজা ইত্যাদি করতে করতে আরো কয়েকটি জন্ম নিয়ে ক্রমশ শিব উপাসনা করতে করতে শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত হতে শুরু করে, যখন ভক্তি সত্য হয়, তখন‌ই তার হৃদয়ে শিবের বিষয়ে জানবার তীব্র ইচ্ছা ও আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকে। তখন প্রভু শিব সেই ভক্তকে শিবচরিত্র তথা শিবজ্ঞান লাভ করিয়ে দেবার জন্য পথপ্রদর্শন করে দেন, তখন কোনো না কোনোভাবে একজন প্রকৃত শৈবগুরুর সন্ধান পেয়ে যান ঐ জীব। শিব জ্ঞান অর্জন করতে করতে শিবের প্রকৃত বাস্তব স্বরূপ জেনে জীব কৃতার্থ হয়ে যান, নিজের অন্তরে ও সর্বত্র পরমেশ্বর শিবের‌ই অস্তিত্ব অনুভব করতে অরতে অদ্বৈত শৈব জ্ঞানে পরিপূর্ণ হয়ে পাপপুণ্যের ঘেরাটোপের উপরে উঠে জন্মমৃত্যুর চক্র থেকে সদাহর্বদার জন্য মুক্ত হয়ে শিবের লীন হয়ে শিবত্ব লাভ করেন।


একবার ভেবে দেখুন একজন সাধারণ জীবাত্মা মোক্ষ লাভ করবার জন্য কতগুলি জন্ম পেরিয়ে তবে শিবলাভ করে।


 এইভাবেই নাস্তিক ও জগতবাসীকে শিবের পথে আনবার জন্য‌ই তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী প্রত্যেক পদক্ষেপে প্রভু শিব নিজেই বিভিন্ন দেবতারূপ ধরে শিবলাভের পথেই জীবকে অগ্রসর করাচ্ছেন।


তাই সনাতন ধর্মে বিভিন্ন দেবদেবীর পূজার্চনা হয়ে থাকে।

জীবেদের মধ্যে সবাই তো সরাসরি শিবলাভে সমর্থ হন না, পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে অবশেষে শিবপ্রাপ্তি করতে সক্ষম হয় জীব।


শাস্ত্র প্রমাণ দেখুন 👇 

অন্যং ভজন্তি যে নিত্যং তস্মিংস্তে লীনতাং গতাঃ ।

তেনৈব রুদ্রং তে প্রাপ্তাঃ কালেন মহতা বুধাঃ ॥১৬

রুদ্রভক্তাস্তু যে কেচিত্তৎক্ষণং শিবতাং গতাঃ ।

অন্যাপেক্ষা ন বৈ তেষাং শ্রুতিরেষা সনাতনী ॥১৭

[তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/কোটিরুদ্রসংহিতা/অধ্যায় ৪২]

☘️ অর্থ — যে সমস্ত ব্যক্তি অন্য দেবতাকে নিত্য ভজনা করেন তারা সেই দেবতাতেই লীন হয়ে বহু সময় অতীত হলে অবশেষে সেই দেবতার মাধ্যমে পরমেশ্বর শিব কে প্রাপ্ত করার সৌভাগ্য লাভ করেন। কিন্তু যারা শিবভক্ত তারা ওই সময়েই সরাসরি শিবতত্ত্ব কে প্রাপ্ত করে নেন কেননা তাদের অন্য কোন দেবতার প্রয়োজন পড়ে না, ইহাই সনাতন শ্রুতি ॥১৬ - ১৭


🔥 বিশ্লেষণ - বৈষ্ণব হোক বা শাক্ত, গাণপত্য হোক বা সৌর সকলেই অন্তিমে শিবে বিলীন হন, যেহেতু তারা অন্য দেবতার ভক্ত তাই তারা প্রথমে তাদের আরাধ্যতে লয় হবার পর অন্তিমে শিবে বিলীন হন, কারণ, শিব‌ই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর। কিন্তু যারা শিবভক্ত শৈব তারা যেহেতু সরাসরি সেই পরমেশ্বর শিবের ভক্ত তাই তারা অনায়াসেই শিবে লীন হয়ে শিবপ্রাপ্ত করেন, এটি চিরন্তন সত্য বেদবাক্য ।


এবার বুঝলেন তো?! শিব কোন কারণে অনান্য দেবদেবীর প্রশংসা করেন। 

 এত গুহ্য রহস্য বোঝবার মতো ক্ষমতা সবার মধ্যে তৈরি হয় না, যারা আজ বৈষ্ণব শাক্ত বলে নিজেদের দাবী করছেন আর পরমেশ্বর শিবের‌ পরমত্বকে খণ্ডন করবার জন্য অপপ্রয়াস করে চলেছেন, সেই সব শিবনিন্দুকেরা বহু কষ্ট ভোগ করে অবশেষে কোনো এক জন্মে শিবভক্তি তথা শিবজ্ঞান লাভ করে শৈব হয়েই শিবপ্রাপ্তি করবেন। কারণ শিব ছাড়া অন্য আর কোনো গতি নেই।


একজন প্রকৃত বৈষ্ণবের ভক্তি পূর্ণ হলে ভগবান বিষ্ণু তার নিজের ভক্তকেও শিবভক্তির পথে চালিত করে শৈব করে দেন। প্রমাণ দেখুন 👇

• শিব হরিভক্তি প্রদানকারী নন বরং শ্রীহরি শিবভক্তি প্রদানকারী হবার শাস্ত্রীয় প্রমাণ 


মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি......

এবার বলুন ! যদি কেউ কোনো একটি বিশেষ কোনো একটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলবার কারণে অভিনয় করেন, তবে কি তার অভিনীত চরিত্র টি ঐ ব্যক্তির প্রকৃত চরিত্র বলে মেনে নেওয়া কোনো বুদ্ধিমানের স্বভাব হতে পারে ?


যারা অভিনয় আর বাস্তব জীবনের পার্থক্য বুঝতে পারেন না তারা নিতান্তই অপরিপক্ক অপরিনত জীব বলেই গণ্য।


সুতরাং, পরমব্রহ্ম শিবকে বিষ্ণুভক্ত বৈষ্ণব বলে চিহ্নিত করা বৈষ্ণবদের কোন পর্যায়ে জীব তা পাঠকবৃন্দগণ বুঝে নিন। 


সিদ্ধান্ত 

 পরমেশ্বর শিব বাস্তবে কোনোভাবেই বিষ্ণুভক্ত নন, বৈষ্ণব নন। শাস্ত্র বলছে, পরমেশ্বর শিবের কোনো উপাস্য‌ দেবদেবীই নেই। তাই মহাদেবকে বৈষ্ণব বলা যায় না। অভিনয় বশত বিষ্ণু তথা অনান্য দেবদেবীর প্রশংসা করেন মাত্র প্রভু শিব, যা তার বাস্তব চরিত্র নয়। তাই শাস্ত্রের যেখানেই শিব দ্বারা অনান্য দেবদেবীর প্রশংসা বা উপাসনার উল্লেখ থাকুক তা মূলত লোকাচার অভিনয় মাত্র বলে চিহ্নিত হয়, প্রভু শিব হলেন স্বয়ং সাক্ষাৎ পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর।

আশা করি বৈষ্ণবেরা নিজেদের মান্য বৈষ্ণবাচারের আধিক্য সমন্বিত পদ্মপুরাণ ভাগবত পুরাণ ইত্যাদির বচনকে সম্মানের সহিত মান্য করে নেবেন। যদি মান্য না করেন তবে তারা আর প্রকৃত ধার্মিক বৈষ্ণব বলে গণ্য হবেন না। কেননা যারা নিজেদের মান্য শাস্ত্রের একটি বচন মান্য করেন অপরটি বচন মান্য করেননা, তারা স্বার্থান্বেষী ছিড়া আর কিছু নন, যিনি প্রকৃত বৈষ্ণব তিনি শাস্ত্রের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল বচনকেই সম্মানের সহিত গুরুত্ব ও মান্য বলে স্বীকার অবশ্যই করবেন। নমঃ শিবায় 🙏 


                  — মহামান্য শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জীর উপস্থাপন করা শাস্ত্র প্রমাণ ও তার ভিত্তিতে যে যুক্তি তিনি উপস্থাপন করেছেন, এরপর আর কোনো সংশয় অবশিষ্ট থাকে না।


সকল সনাতনীর উচিত পরমেশ্বর শিবের নামে অসত্য কথা প্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা। কারণ, ধর্মের দোহাই দিয়ে বিষ্ণুভক্তির দোহাই দিয়ে যারা ধর্মের মূল সিদ্ধান্ত কে নাকচ করে, তাকে ধর্মের মধ্যে ভেদাভেদ করা বোঝায়, এটিই ধর্মের জন্য হানিকারক।


আসুন আমরা সকল সনাতনীরা পরমেশ্বর শিবের অদ্বিতীয়তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে সনাতন ধর্মকে সঠিক পথে চলতে সহযোগিতা করি। সকল অধার্মিক পাপী ছদ্মধার্মিক, শাস্ত্র সিদ্ধান্ত বিকৃতকারী পাষণ্ডরা সমাজ থেকে দূর হোক, সকল শিবনিন্দুকের পতন নিশ্চিত হোক, সকল গোঁড়ামিতে পূর্ণ মানসিকতার অবসান ঘটুক, সত্য সনাতন ধর্মের প্রচার হোক। সনাতন শৈব ধর্মের জয় হোক।


পরমশৈব নারায়ণের জয়

শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩 

হর হর মহাদেব 🚩 


[পোষ্ট গুলি লিখতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়, পাঠকবৃন্দ আপনারা যদি এই পোস্টটি শেয়ার করেন তবে আমাদের পরিশ্রম সার্থক হবে, অনুগ্রহ করে এই পোস্টটি শেয়ার করুন আপনার টাইমলাইনে ও বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রুপে, যাতে সত্য সকলে জানতে পারে, আপনার সুস্থতা ও পরমেশ্বর শিবের কৃপা যাতে আপনার উপর বর্ষিত হয় সেই কামনা করি। যারা আমাদের পোস্টটি কে পুনরায় পোস্ট করতে চান তারা অবশ্যই সম্পূর্ণ কপি পেস্ট করবেন, লেখাগুলিকে ছাটকাট করবেন না, যিনি প্রকৃত লেখক তার পরিশ্রমকে কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য অবশ্যই সেই লেখকের নাম ও প্রতিষ্ঠানের নাম কেটে বাদ দিয়ে পোস্ট না করে সম্পূর্ণ পোস্ট করবেন।]


©️ কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT 


#বৈষ্ণবমতবাদখণ্ডন #বৈষ্ণবমতখণ্ডন #অপপ্রচারদমন #অপপ্রচারখণ্ডন #পরমেশ্বশিব #শৈবধর্ম #ISSGT

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ