বেদ বলছে, বিষ্ণুকে সারথী করে ॐ মন্ত্রে শিবপূজা জীবের একমাত্র লক্ষ্য
ভূমিকা —
বর্তমান কলিযুগে সনাতনীদের মধ্যে বেশিরভাগ ব্যক্তিই আরাধ্য বিষয় নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে আছে। এক এক জন ব্যক্তি এক একটি দেবী দেবতাকে আরাধ্যা বা আরাধ্য ভেবে তার ভজনা করে চলেছেন, তাদের ধারণ হল তাদের পছন্দের দেবতাই সর্বোপরি। কিন্তু এই আরাধ্য বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছে আমাদের সনাতন ধর্মের আদি শাস্ত্র - বেদ ।
আসুন আমরা সকল বিভ্রান্তির অবসান ঘটিয়ে বেদের আলোকে সকলের জন্য সঠিক পথের অনুসন্ধান করি ।
♦️ মূল আলোচ্য বিষয় ♦️
কৃষ্ণ-যজুর্বেদের অমৃতনাদ উপনিষদের ২য় মন্ত্রে বলা হয়েছে —
ওঙ্কাররথমারুহ্য বিষ্ণুং কৃত্বাথ সারথিম্ ।
ব্রহ্মলোকপদান্বেষী রুদ্রারাধনতৎপরঃ ॥ ২
[তথ্যসূত্র : কৃষ্ণ যজুর্বেদ/অমৃতনাদ উপনিষদ/২য় মন্ত্র]
অর্থ — ॐ-কার রূপী রথে আরোহন করে, শ্রী বিষ্ণুকে নিজের সারথি বানিয়ে, ব্রহ্মলোকের পরম পদকে চিন্তা করে জ্ঞানী ব্যক্তির সর্বদা দেবাদিদেব পরমেশ্বর রুদ্রের (শিবের) উপাসনাতে মগ্ন থাকা উচিত ॥ ২
ব্যাখ্যা : সনাতনীরা যে ॐ-কার মহামন্ত্র জপ করেন, সেই মহামন্ত্র মূলত পরমেশ্বর শিবের উদ্দেশ্যেই জপ করা হয়, কারণ, ॐ-কার পরমশিব বাচক মহাবীজ মন্ত্র। শ্রীবিষ্ণু হলেন পরম শিবভক্ত শৈব। শ্রীবিষ্ণু শিবভক্তির পথ দেখিয়ে দেন ॐ-কার জপকারী শিবভক্তকে, যাতে শিবভক্ত প্রভু শিবের আরাধনায় মগ্ন হয়ে ব্রহ্মপদলাভ করে শিবে লীন হতে পারেন। তাই বেদের এই মন্ত্রে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তির উচিত কার্য হল ব্রহ্মলোক (শিবলোক) প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে প্রথমে ॐ-কার রথ হিসেবে ভেবে নিয়ে, ॐ-কার শিববীজ মন্ত্র জপ করা, শ্রীবিষ্ণু সাক্ষাৎ শৈবগুরু হিসেবে ভূমিকা পালন করে ঐ ॐ-কার রূপী রথের সারথী হয়ে সেটিকে পরমেশ্বর শিবের আরাধনার দিকে নিয়ে যান, শিব আরাধনা করলেই ব্রহ্মলোক অর্থাৎ শিবের লোকই প্রাপ্তি হয়ে যায়।
অর্থাৎ, এখান থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল যে, বেদের বচন ॐ-কার মহামন্ত্র শিব প্রাপ্তির জন্যই উপস্থিত।
ॐ-কার বিষ্ণু বা অন্য কোনো দেবদেবীকে প্রাপ্ত করায় না বরং তাদের মূল স্বরূপ শিবের প্রাপ্তি করায়। বেদ এখানে সকল জীবের জন্য নির্দেশনা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সকল জীবের আরাধ্য একমাত্র শিব হওয়া উচিত, অন্য সকল দেবদেবী শিবপ্রাপ্তি করাবার পথ দেখিয়ে সহায়ক হয়ে থাকেন, তাই অমৃতনাদ উপনিষদের এই ২নং মন্ত্র বিষ্ণুকে আরাধ্য নয় বরং একমাত্র শিবকেই আরাধ্য হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছে। তাই ॐ-কার শিব প্রাপ্তিই করায়, শিবপ্রাপ্তির অর্থই হল সকল দেবদেবীকে প্রাপ্ত করে নেওয়া, কারণ সকল দেবদেবীরূপে প্রভু শিবই লীলা করছেন, তাই শিব প্রাপ্ত হলেই সকল কিছুর প্রাপ্তি হয়ে যায়, আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
_______________________________________________
এই ॐ-কারের দেবতা কে ?
উত্তর :
বেদ বলছে — ॐ-কারের দেবতা একমাত্র রুদ্র অর্থাৎ পরমেশ্বর শিব।
এই বিষয়ে বিস্তারিত শাস্ত্রীয় প্রমাণ সহ ব্যাখ্যা জানবার জন্য এখানে ক্লিক করুন 👇
ॐ-কার একমাত্র পরমেশ্বর শিব, অন্য আর কেউ নয়
_______________________________________________
সিদ্ধান্ত —
বেদের বাণী শ্রুতি বলে পরিচিত। তাই ব্যাস সংহিতা স্মৃতি শাস্ত্রের ১ম অধ্যায়ের ৪নং শ্লোক অনুযায়ী বেদের বচনই সর্বোপরি তথা বলবান। তাই যেহেতু মহাদেবই সকল দেবতার রূপ ধারণ করে লীলা করছেন, তাই বেদ অনুযায়ী সকলের মূলকারণস্বরূপ ঐ পরমেশ্বর শিবই সকলের পরম আরাধ্য বলে জানা উচিত। সনাতন ধর্মের বেদ শাস্ত্রের বচন অনুসারে এখানে শিব প্রাপ্তির পথে ভগবান বিষ্ণু হলেন সারথি মাত্র, তিনি ॐ-কার জপকারী শিবভক্তকে শিবের কাছে পৌঁছে দেন। যদিও বেদ অনুযায়ী পরমেশ্বর শিবই বিষ্ণুরূপটি ধরে লীলা করছেন। তথাপি শিবরূপ সকল কিছুর প্রধান কারণ হওয়ায় বেদ বলেছে শিবই একমাত্র ধ্যেয় তথা আরাধ্য ও আরাধনার যোগ্য।
🔖নন্দীটীকা — রুদ্রহৃদয় উপনিষদের ৩৮ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে,
ধনুস্তারং শরো হ্যাত্মা ব্রহ্ম তল্লক্ষ্যমুচ্যতে ।
অপ্রমত্তেন বেদ্ধব্যং শরবত্তন্ময়ো ভবেৎ ॥ ৩৮ ॥
অর্থ : (উদাহরণ দিয়ে বলছি) প্রণব (ॐ) -কে ধনুক, আত্মাকে বাণ বানিয়ে, ব্রহ্মকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে সেই লক্ষ্য কে ভেদ করা উচিত - আলস্য-প্রমাদ কে পরিত্যাগ করে । লক্ষ্যকে ভেদকারী বানের মতো সাধক ব্যক্তির উচিত পরমব্রহ্ম শিবে তন্ময় হয়ে লীন থাকা ॥ ৬ ॥
আবার, দেবীভাগবত মহাপুরাণেও একই কথা বলা হয়েছে,
প্রণবো ধনুঃশরো হ্যাত্মা ব্রহ্ম তল্লক্ষ্যমুচ্যতে ।
অপ্রমত্তেন বেদ্ধব্যং শরবত্তন্ময়ো ভবেৎ ॥ ৬ ॥
[দেবীভাগবত পুরাণ/৭ম স্কন্ধ/৩৬ অধ্যায়/৬ শ্লোক]
অর্থ : (উদাহরণ দিয়ে বলছি) প্রণব (ॐ) -কে ধনুক, আত্মাকে বাণ বানিয়ে, ব্রহ্মকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে সেই লক্ষ্য কে ভেদ করা উচিত - আলস্য-প্রমাদ কে পরিত্যাগ করে । লক্ষ্যকে ভেদকারী বানের মতো সাধক ব্যক্তির উচিত পরমব্রহ্ম শিবে তন্ময় হয়ে লীন থাকা ॥ ৬ ॥
✅ মহাভারতেও বলা হয়েছে ॐ-কার দ্বারা শিবের প্রবেশ করা হয়ে থাকে —
ওঙ্কাররথমারুহ্য তে বিশন্তি মহেশ্বরম্ ।
অযং স দেবযানানামাদিত্যে দ্বারমুচ্যতে ॥ ৪৫
অযঞ্চ পিতৃযানানাং চন্দ্রমা দ্বারমুচ্যতে । ...৪৬
যং জ্ঞাত্বা ন পুনর্জন্ম মরণং চাপি বিদ্যতে ।
যং বিদিত্বা পরং বেদ্যং বেদিতব্যং ন বিদ্যতে ॥ ৪১
যং লব্ধা পরমং লাভ নাধিকং মন্যতে বুধঃ ।
যাং সূক্ষ্মাং পরমাং প্রাপ্তিং গচ্ছন্নব্যয়মক্ষয়ম্ ॥ ৪২
(মহাভারত/অনুশাসন পর্ব/১৫ অধ্যায়)
অর্থ — প্রসিদ্ধ সাধুগণ ওঙ্কারস্বরূপ রথে আরোহণ করে সাক্ষাৎ সেই মহেশ্বরেই প্রবেশ করে। এই শিবই সাক্ষাৎ সূর্যস্বরুপে দেবযানের দ্বার হন এবং সেই শিবই সাক্ষাৎ চন্দ্রস্বরুপে পিতৃযানের দ্বার হন। যাকে জানার পর জন্ম ও মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করা যায়, যাকে জানার পর অন্য কিছু আর অজানা থাকে না, যাকে লাভ করার পর অন্যকিছু আর অলভ্য থাকে না, সেই সূক্ষ্ম পরম প্রাপ্তিই হলেন অক্ষয় মহাদেবই।
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
লেখনীতে — ©শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT


মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন