একমাত্র শিবই পরমব্রহ্ম, দেবী হল তার শক্তি - বলছে শাক্তদের দেবীভাগবত পুরাণ
ভূমিকা —
সনাতন ধর্মে সত্য একটিই, পরমতত্ত্বও একটি, আর ব্রহ্মসত্তাও একটিই। কিন্তু, বর্তমান এই কলিযুগে সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মের প্রকৃত জ্ঞান না থাকার ফলে মানুষ হয়ে গিয়েছে বিভ্রান্ত। আজ সনাতন ধর্মে বৈষ্ণব মতবাদ, শাক্ত মতবাদ, গাণপত্য মতবাদ, সৌর মতবাদ, নব্য ব্রহ্মবাদী মতবাদ তথা এদের পৃথক পৃথক সম্প্রদায় তৈরি হয়েছে। এমনকি শৈবরাও একটি মতবাদ, একটি সম্প্রদায় মাত্র - এমনটা প্রচার করছে বৈষ্ণব, শাক্ত, নব্য ব্রহ্মবাদীগণ । যদিও শৈব কোনো মতবাদ নয়,
শাস্ত্র অনুযায়ী 👉 শৈবধর্মই সনাতন ধর্ম, তা প্রমাণ করাও হয়েছে।
কিন্তু বাকি মতবাদ সম্প্রদায়ের বক্তব্য হল শাক্ত মতবাদ অনুযায়ী শাক্ত সম্প্রদায়ের কাছে শক্তিপ্রাধান্য শাস্ত্র গুলিই শাক্তদের কাছে মান্য শাস্ত্র।
শাক্তদের দাবী অনুসারে —
শাক্তদের মত —
(১) শাক্তদের মতবাদে, শক্তিই একমাত্র লক্ষ্যবস্তু, শুধুমাত্র শক্তিই ব্রহ্ম। শিব, বিষ্ণু বা অন্য কোনো দেবদেবী শাক্তদের সর্বোচ্চ অন্তিম ধ্যেয় নন।
(২) শক্তি প্রাধান্য শাস্ত্রে একমাত্র শক্তিকেই সর্বোচ্চ ব্রহ্ম বলে স্বীকার করা হয়েছে।
(৩) শাক্তদের আরাধ্যা ‘দেবী শক্তি’র কোনো স্বামী নেই, তিনি অদ্বিতীয়া। শাক্ত শাস্ত্রে, শিব ব্রহ্ম নন, শক্তিই একমাত্র ব্রহ্ম।
(৪) দেবীশক্তি জন্ম দেন শিবকে, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকেও জন্ম দেন - তাই দেবীকে ত্রিদেব জননী বলে। লীলাবশত দেবীশক্তি নিজের ডানদিক থেকে পুরুষকে জন্ম দিয়েছেন। তাই দেবী ছাড়া আর কেউই সর্বোচ্চ সত্তা নন।
(৫) শক্তি ছাড়া শিব হল মৃতদেহের মতো শব। শক্তি ছাড়া শিবের কিছুই করবার ক্ষমতা নেই।
(৬) শাক্তদের জন্য দেবীলোক মণিদ্বীপ ই সর্বোচ্চ লোক, শক্তির উপাসকেরা দেবীর কাছেই যাবেন, অন্য কোনো লোকে যায় না শাক্তরা। শিবলোকে শৈবরা যাবেন, আমাদের দেবীলোক আর শিবলোক ভিন্ন ভিন্ন।
(৭) শৈবদের জন্য শৈব পুরাণ, শৈব আগম-তন্ত্র ইত্যাদি বিভিন্ন শৈবশাস্ত্রে শিব সর্বোচ্চ, সেখানে দেবী, বিষ্ণু ও অনান্য দেবদেবী শিবের থেকে বড় নয়।
বৈষ্ণবদের জন্য বৈষ্ণবীয় পুরাণ, পঞ্চরাত্র-তন্ত্র আগম ইত্যাদি শাস্ত্রে বিষ্ণু সর্বোচ্চ, সেখানে দেবী, শিব ও অনান্য দেবদেবী বিষ্ণুর থেকে বড় নয়।
আবার, শাক্তদের জন্য শক্তি দেবীর শাক্তবিষয় পুরাণ, শাক্ততন্ত্র ইত্যাদি শাস্ত্রে শক্তিই সর্বোচ্চ, এখানে বিষ্ণু, শিব ও অনান্য দেবদেবী দেবীর থেকে বড় নয়।
সেই হিসেবে শাক্ত দের কাছে শক্তিই সর্বোচ্চ।
________________________________________________
আমাদের শৈবদের সিদ্ধান্ত —
(১) সনাতন ধর্মের অনুসারে, ‘সিদ্ধান্ত’ এক ও অদ্বিতীয়। ‘সত্য’ - এক ও অদ্বিতীয়, তাই পরমাত্মা হল এক ও অদ্বিতীয়। শাক্তদের কাছে এক রকমের পরমাত্মা - দেবী, বৈষ্ণবদের কাছে এক রকমের পরমাত্মা - বিষ্ণু, এমনভাবে এক এক জনের কাছে নির্দিষ্ট এক এক রকমের পরমাত্মা আছে - এমন বিভিন্নতা সম্ভব নয়। কারণ সনাতন ধর্ম একটিই, তাই সনাতন ধর্মে নিরাকার নির্গুণ পরমব্রহ্ম হলেন একমাত্র ‘পরমশিব’, তিনিই সত্য। সেই হিসেবে শাক্তদের শাস্ত্রেও পরমশিবকেই ‘ব্রহ্ম’ বলে স্বীকার করা হয়েছে। সেই পরমশিবের ইচ্ছাই হল বিমর্শময় শক্তিদেবী ।
(২) শক্তিকে শাস্ত্রে ব্রহ্ম বলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা মূলত ব্রহ্মের সহিত যেহেতু শক্তি অভিন্ন -এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয়েছে ব্রহ্মের শক্তিও অভিন্নতার কারণে ‘ব্রহ্ম’ বলে চিহ্নিত হন মাত্র। এখানে ব্রহ্ম-পরমশিব হলেন কারণসত্তা, শক্তি হল ব্রহ্মের কার্যগতসত্তা।
ব্রহ্ম-শিবকে সকল কিছুর কারণ বলা হল, তিনিই সকল কিছুর সৃষ্টি,স্থিতি,প্রলয় করেন। তিনিই ত্রিদেব উৎপন্ন করেন, সকল দেবতার রূপ ধারণ করেন। এটি তিনি তার নিজেরই অভিন্ন শক্তির মাধ্যমে করেন, শিবের এই শক্তির মধ্যেই জগত প্রকাশ পায়, স্থিত হয়, আবার লয় হয়ে শক্তিতেই লীন হয়ে যায়। শক্তি শিবেই অভিন্নভবে স্থিত হওয়ায় শিবই সবকিছুর একমাত্র কারণ বলে উল্লেখ হয়েছে শাস্ত্রে, আবার শক্তিই সবকিছুর একমাত্র কারণ এটিও বলা হয়েছে শাস্ত্রে, এখানে ‘অভিন্নতা’ হল উভয় দৃষ্টিকোণকে সত্য হিসেবে গণ্য করবার উপযুক্ত মাধ্যম।
এই কারণে শক্তি প্রাধান্য শাস্ত্রে উল্লেখ হয়েছে - একমাত্র শক্তিই সমগ্র জীব-জগতের, ত্রিদেব সহ সকল দেবতাদের সৃষ্টি স্থিতি বিনাশ করেন, আবার এই শাক্ত শাস্ত্রেই উল্লেখ হয়েছে - শক্তি দেবী হলেন ব্রহ্মের ‘ইচ্ছা’।
উদাহরণ হিসেবে বলি, একই দেহে অভিন্ন ভাবে থেকেও মস্তিষ্কের নির্দেশে হস্ত কার্য করছে, হস্তের কার্য করাকে দেখে কোনো ব্যক্তি বলতেই পারেন, হাতই হল কার্য করবার কারণ । আবার এই হস্তের কার্য করবার প্রধান কারণ যেহেতু মস্তিষ্ক, তাই মস্তিষ্কই এই কার্য করছে বলেও অন্য কোনো ব্যক্তি দাবী করছেন।
এখানে মস্তিষ্ক - ব্রহ্ম (শিব), হস্ত - শক্তি (দেবী)।
অর্থাৎ হস্তরূপী দেবী কার্যরূপী জগত তৈরী করছেন একথাও ঠিক, তাই শক্তি সব কিছু করছেন একটা সত্য, আবার ঐ হস্ত মস্তিষ্করূপী পরমশিবের সহিত একই দেহে অভিন্ন ভাবে থাকায় শাস্ত্রে বলা হয়েছে ব্রহ্ম-পরমশিবই সবকিছুর কারণ । অর্থাৎ ব্রহ্ম শিব এবং তার শক্তি হলেন দেবী, দেবী শিবের সহিত অভিন্নতার দৃষ্টিকোণের বিচারের কারণে ব্রহ্ম বলে উক্ত হন মাত্র। মূলত তিনি ব্রহ্মের শক্তি।
(৩) অবশ্যই শাক্তদের আরাধ্যা দেবীশক্তির পতি আছেন, দেবীর সেই স্বামী হলেন সাক্ষাৎ ‘শিব’, ইনিই হলেন শৈবদের আরাধ্য। এই শিব ত্রিদেবের উৎপত্তিকর্তা, ত্রিদেবের মধ্যে থাকা রুদ্রদেব নন।
(৪) শাক্তদের আরাধ্যা শক্তি দেবী - যাদের উৎপন্ন করেছেন, তারা হল ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্রদেবকে। নিজের স্বামী অর্থাৎ শিবকে কখনোই দেবী উৎপন্ন করেননি, প্রকৃতি পুরুষ উৎপন্ন করেছেন তিনি। কিন্তু কিছু শাক্ত ব্যক্তির এই ভ্রম হয়েছে যে, সাধারণ প্রকৃতি পুরুষের মধ্যে থাকা পুরুষকে শিব বলে ভেবে, শিবের জন্ম দেবীর জন্ম হয়েছে দেবী থেকে -এটি ভাবছে। কিন্তু শৈবরা যখন বলেন যে, শিব হলেন দেবীর স্বামী, তখন বেশ কিছু শাক্তরা বলেন দেবী লীলা বশত পুরুষ জন্ম দিয়ে সেই শিবকে নিজের স্বামী বানিয়েছেন। কিন্তু শাস্ত্র বলছে শিবের জন্ম নেই, আর পরমাত্মারও জন্ম নেই। সুতরাং দেবীর স্বামী শিব অর্থাৎ ব্রহ্মের জন্ম নেই। একথাও দেবী নিজে দেবীভাগবত পুরাণে বলেছেন।
(৫) পরমশিব নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্ম, সেখানে সকল মায়ার জগত ও জগতের মধ্যে চলা সকল বিভিন্নতা বৈচিত্র্যতা লীন হয়ে যায়, ফলে এই অবস্থায় কোনো দৃশ্যমান বিশ্বের অস্তিত্ব নেই, ফলে এই অবস্থায় স্থিত সর্বোচ্চ পরমার্থিক শিবের অবস্থা কে বোঝানোর জন্য একটি জীবের মৃতদেহ অর্থাৎ শব কে উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে মাত্র। শিবের শক্তি শিবেরই নিজের, অন্য কেউ নন। শাস্ত্রে বলা হয়েছে পরমব্রহ্ম একজনই, তিনি ছাড়া কোনোকিছুই নেই, সুতরাং সেই শিবের থেকে শিবের প্রেরণায় নিজেকে দ্বিতীয় হিসেবে দেখবার ইচ্ছে হয় তখনই এক থেকে দ্বিতীয় হবার এই ইচ্ছাকেই রূপরেখা দান করতে শিবেরই প্রেরণায় শিবেরই শক্তি কার্যগতরূপ ধারণ করে জগত ও জীব হয়ে ওঠেন, অর্থাৎ নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্ম পরমশিবের মধ্যেই সাকার জগত সৃজন হয় শক্তির দ্বারা। তাই শক্তি হল জগতের কারণ, বৈচিত্র্যতা সৃষ্টির কারণ, কিন্তু শিবের কোনো বিকার নেই। শিব নিজেই শক্তি দিয়ে নিজের অন্তরে জগত রচনা করে নিজেকে সাজিয়ে তোলেন, শক্তির প্রকাশ ছাড়া যেহেতু শিবের মধ্যে কোনো বিভিন্নতার বৈচিত্র্যময় বস্তুর অস্তিত্ব ফুটে ওঠে না, তাই দার্শনিক দৃষ্টিতে শক্তি ছাড়া শিব হল শব - এই কথা শোনা যায়। কিন্তু বাস্তবে তার ব্যাখ্যা বৃহৎ, প্রকৃত পক্ষে শক্তি কখনোই শিব থেকে ভিন্ন নয়। শিবের নিরাকার নির্গুণ অবস্থাকে শবের সাথে তুলনা করা হয়েছে মাত্র, সেই নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্মে শক্তি হলেন জগতের স্পন্দন জাগানোর কারণ, তাই শিবের হস্তরূপী শক্তিকে প্রধান হিসেবে ধরে নিয়ে শিবকে শব বলে চিহ্নিত করা হয়েছে মাত্র, এতে শিবের ক্ষমতা শক্তির থেকে কম - এমন ভাবনা যারা করে তারা মরিচীকাকে সত্য ভাবার মতো ভ্রমে পড়েছেন মাত্র। মূলত পরমেশ্বর শিবের থেকে কখনোই ভিন্ন নন, সুতরাং শিবের নিজ ক্ষমতাকেই শক্তি বলে, আর শিব নিজের ক্ষমতাকে দিয়েই নিজেকে জগতরূপে বিচিত্রতায় পরিপূর্ণ বিরাট বিশ্ব রচনা করেন, এত কিছু রচনা করেও তিনি এই সকল মায়ার জগতের প্রভাব থেকে মুক্ত, তাই শাস্ত্রে শিবকে নির্গুণ বলা হয়েছে, অর্থাৎ সকল মায়ার গুণের প্রভাব থেকে শিব হলেন মুক্ত, তিনি সর্বত্র আছেন, তাই তাকে শান্ত- স্থির বলা হয়। হস্ত ছাড়া মস্তিষ্ক মৃত একথাটির দ্বারা হস্তকে বড় করে দেখানো হলেও, প্রকৃত সত্য হল - হস্ত কখনোই মস্তিষ্কের থেকে ভিন্ন নয়, মস্তিষ্কের উপরেই হস্ত কার্য করবার জন্য নির্ভর করেন, তাই কারণরূপী মস্তিষ্ক (পরমশিবই) প্রধান, আর তার কার্যরূপী হস্ত (শক্তি) হল তার প্রকাশ। শিব জগত হতে না চাইলে শক্তিও প্রকাশ হননা, জগত প্রকাশিত না হলেও শিবের অস্তিত্বে সংকট আসে না, তাই নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্ম-পরমশিব স্বতন্ত্র - একথা বলেছেন শাস্ত্র নিজেই। তাই ‘শক্তি ছাড়া শিব হল শব মাত্র’ - এই কথার আক্ষরিক অর্থকে সত্য বলে মানলে, সেই মান্যকারী ব্যক্তি অল্পবুদ্ধিযুক্ত ।
(৬) পরমশিব নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্ম, তিনি নিজেকে দ্বিতীয় হিসেবে প্রকট করবার ইচ্ছায় সাকার রূপ ধারণ করলেন, সেই রূপটি হল - পাঁচমুখ-দশহাতযুক্ত শ্বেত বর্ণের দিব্যদেহধারী, ত্রিনয়ন সম্পন্ন, এই রূপকে সদাশিব বলা হয় (বিরাটরূপী মহাসদাশিব)। ইনি শিবলোকে অবস্থিত পরমেশ্বর শিব। ইনিই নিজ হৃদয় থেকে দেবী শক্তির রূপ প্রকট করেন, তিনিই শাক্তদের আরাধ্যা দেবী, দেবীকে শিবা বলা হয়ে থাকে। এই সদাশিব পঞ্চকৃত্যকারী, আর দেবীও পঞ্চকৃত্যকারিনী। এই সদাশিবের থেকে ত্রিদেব প্রকট হয়েছে তাই সদাশিবকে ত্রিদেব জনক বলে। এই সদাশিব আর দেবী যেহেতু অভিন্ন, তাই শাক্ত শাস্ত্রে বলা হয়েছে শক্তি থেকে ত্রিদেব উৎপন্ন হয়েছে, তাই দেবী হলেন ত্রিদেব জননী। ত্রিদেব হলেন - ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও কৈলাসপতি রুদ্র। এই ত্রিদেবের জনক ও জননী হলেন সদাশিব ও দেবী। নব্য শাক্তরা দেবীকে ত্রিদেব জননী বললেও, সদাশিবও যে ত্রিদেব জনক সেটি জানেন না, জানতে পারলেও এড়িয়ে যান অথবা অমান্য করেন। এই ত্রিদেব তার জনক জননীর কাছে মাথা নত করেন, শ্রদ্ধা প্রণাম করেন। শাক্তরা সেই কাহিনী দেখে ত্রিদেবের মধ্যে থাকা রুদ্রদেবকেই একমাত্র বলে ভেবে দেবীকে শিবের জননী বলে চিহ্নিত করে থাকেন, যা বুদ্ধিহীনতার পরিচয় মাত্র।
তাই শাক্তদের আরাধ্য দেবীর দেবীলোক মণিদ্বীপ মূলত শিবলোকেরই অংশ, তাই এই লোক শিবদ্বীপ নামে পরিচিত। শাক্তদের শাস্ত্র দেবীভাগবত পুরাণেই তা উল্লেখিত হয়েছে। আর শিবমহাপুরাণেও একই কথা বলা হয়েছে।
(৭) বুদ্ধিহীনতার কারণে কাল্পনিক ভাবনার বশে বহু অজ্ঞ ব্যক্তিগণ মনে করেন এক এক শাস্ত্রে এক এক দেবদেবী সর্বোচ্চ। কিন্তু প্রাচীন মুনি ঋষিগণ সকলেই পরমেশ্বরের প্রদান করা শাস্ত্রের নিরিখে এক ও অদ্বিতীয় পরমতত্ত্ব কে ? - তা নির্ণয়ের জন্য বেদ, আগম, পুরাণ, ন্যায় শাস্ত্র, মীমাংসা শাস্ত্র, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ইতিহাস ইত্যাদি শাস্ত্র দিয়েছেন। তার প্রমাণের ভিত্তিতেই আমাদের প্রকৃত ব্রহ্ম কে ? তা নিরূপণ করা ধর্মসঙ্গত কার্য বলেই গণ্য । নিজের ইচ্ছে মতো যে কোনো মতামত দিলেই সেটি সনাতন ধর্মের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হয় না। ধর্ম যখন একটিই পরমেশ্বরও একটিই, আর ঐ একজন পরমেশ্বরের কথাই বেদ বলছে, ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ - এখন সেই পরমেশ্বর যে একমাত্রই শিব, তা আমরা সকল শাস্ত্রের নিরিখে প্রমাণ করেছি। তিনিই নিজের শক্তিকে কার্যগত রূপ দিয়ে সকল দেবদেবীর রূপ ধারণ করে লীলা করছেন মাত্র, সুতরাং সকলের মধ্যে ঐ পরমশিবই স্থিত আছেন। কিন্তু শাক্তদের দাবী হল, এক এক মতবাদের পুরাণ তন্ত্র নাকি এক এক দেবদেবীকেই তার নিজস্ব সম্প্রদায়ে সর্বোচ্চ বলে মান্যতা দিয়েছে।
শাক্তদের এমন দাবী সত্য নয়, কারণ শাক্তদের শাস্ত্র ও বৈষ্ণবদের শাস্ত্রেও প্রভু শিবকেই কখনো প্রত্যক্ষ আবার কখনো পরোক্ষভাবে একমাত্র পরমেশ্বর বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। বর্তমান কালের তথাকথিত শাক্তমতবাদ কে পৃথক সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত করে সাম্প্রদায়িক রূপরেখা দান করবার জন্য শাক্তরা এই সত্য কে স্বীকার করতে চান না, কিন্তু এই সকল শাক্তব্যক্তিদের কাছে যে শক্তির মাহাত্ম্যে পরিপূর্ণ শাস্ত্র গুলি শাক্তশাস্ত্র বলে প্রামাণিক ও গণ্য বলে মান্য হয়, সেই সকল শাস্ত্রের মধ্যেই প্রভু শিবকে অদ্বিতীয় পরমেশ্বর বলে ঘোষনা করা হয়েছে, দেবী হলেন ঐ ব্রহ্ম-শিবের শক্তি। কিন্তু তথাকথিত এইসকল শাক্তগণ নিজেদের শক্তি প্রধান ভাবনার অহংকার কে বজায় রাখবার জন্য সেই সত্য স্বীকার করতে চায় না। সকল শাস্ত্র সহিত সনাতন ধর্মে একমাত্র পরমেশ্বর শিবই সত্য ও সর্বোচ্চ।
(৮) ব্রহ্ম-পরমশিব সম্পর্কে সাধারণ অজ্ঞানী জীবকে দেবীই ব্রহ্মবিদ্যা প্রদান করে জ্ঞানী করে তোলেন, ফলে দেবীর প্রকৃত স্বরূপ ও ব্রহ্ম-শিবের প্রকৃত স্বরূপ নির্ণয় করে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয় জীব, এভাবেই জীব শিবস্বরূপ লাভ করে চিরতরে মুক্তি লাভ করেন। তাই দেবীকে জ্ঞানদায়িনী ব্রহ্মবিদ্যা বলে শাস্ত্রে চিহ্নিত করা হয়েছে।
________________________________________________
________________________________________________
আমাদের শৈবদের উপরোক্ত সিদ্ধান্ত সত্য - এটি বহু শাস্ত্র থেকে আমরা আগেই প্রমাণ করেছি, কিন্তু এটি শাক্ত দের কাছে বলা হলে তারা এটিকে অমান্য করেন।
শাক্তদের বক্তব্য হল, শৈব শাস্ত্রে শিবের মাহাত্ম্যই সর্বোচ্চ, সেখানে দেবী ব্রহ্ম নন, শিব হলেন ব্রহ্ম। কিন্তু শাক্ত শাস্ত্রে দেবীই একমাত্র ব্রহ্ম, যেমন দেবীভাগবত পুরাণে - একমাত্র শাক্তদের আরাধ্যা দেবীশক্তিই হলেন একমাত্র ব্রহ্ম।
তাই আমি শৈবদের সিদ্ধান্তকেই এবার শাক্তদের শাস্ত্র থেকেই সত্য প্রমাণ করে দেখাবো, দেবীভাগবত পুরাণের বচনের উপর ভিত্তি করেই প্রমাণ ও যুক্তি সহ উপস্থাপন করে দেখাবো যে,
একমাত্র শিবই পরমব্রহ্ম, দেবী হল তার শক্তি
— বলছে শাক্তদের দেবীভাগবত পুরাণ
_______________________________________________
________________________________________________
(১) মনিদ্বীপ বাসিনী দেবী ভুবনেশ্বরীর কি পতি (স্বামী) নেই ?
✅ উত্তর — শাক্তদের দাবী হল, মনিদ্বীপে বসবাসরত দেবী ভুবনেশ্বরীর নাকি কোনো স্বামী নেই।
অথচ দেবীভাগবত পুরাণে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে যে, স্বয়ং ত্রিদেবের জননী মণিদ্বীপবাসিনী ভগবতী দেবীর পতি অর্থাৎ স্বামী আছেন । চলুন এই বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক শাক্তদেরই শাস্ত্র থেকে।
ত্রিদেবের মধ্যে পরিগণিত হওয়া সংহার কর্তা রুদ্রদেব শাক্তদের আরাধ্যা দেবীকে সম্বোধন করে বললেন,
মণিদ্বীপবাসিনী ভগবতী ভুবনেশ্বরী পরাম্বিকা দেবী তার পতি (স্বামী) পরমপুরুষের সহিত সর্বদা রমণ (অবস্থান) করতে থাকেন ।
প্রমাণ দেখুন 👇
রময়সে স্বপতিং পুরুষং সদা
তব গতিং ন হি বিদ্ম বয়ং শিবে ॥ ১২
[দেবীভাগবত পুরাণ/৩য় স্কন্ধ/৫ম অধ্যায়/১২ নং শ্লোক]
অর্থ : হে দেবী শিবে ! আপনি সদা আপনার পতি (স্বামী) পরম পুরুষ (সদাশিব) -এর সহিত রমনে রত থাকেন, আপনার এই কার্যক্রমের বিষয়ে আমরা এর অধিক আর কি জানবো ॥ ১২
[বিশ্লেষণ : ‘রময়সে স্বপতিং পুরুষং সদা’ এই পদে সরাসরি বলা হয়েছে, শাক্তদের আরাধ্যা দেবী নিজের স্বামীর সাথেই থাকেন]
🔴 সিদ্ধান্ত — শাক্তগণ নিজেরাই নিজেদের আরাধ্যা দেবীর সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত নন, শাক্তদেরই শাস্ত্র দেবীভাগবত থেকে প্রমাণিত হল - দেবীর স্বামী রয়েছে।
________________________________________________
(২) দেবী স্বয়ং একমাত্র ব্রহ্ম নাকি ব্রহ্মের শক্তি ?
✅ উত্তর — দেবীভাগবত পুরাণে এই বিষয়ে স্পষ্ট করে উল্লেখ করে বলা হয়েছে
♦️ দেবী হলেন ব্রহ্মের ইচ্ছাশক্তি —
দুর্জ্ঞেয়াল্পধিয়াং দেবী যোগগম্যা দুরাশয়া।
ইচ্ছা পরাত্মনঃ কামং নিত্যানিত্যস্বরূপিণী ॥ ৫২ ॥
[দেবীভাগবত পুরাণ/৩য় স্কন্ধঃ/৩য় অধ্যায়/৫২নং শ্লোক]
অর্থ : অল্পজ্ঞ ব্যক্তির কাছে দুর্জ্ঞেয়া এই দেবী, যোগের দ্বারাই তাকে জানা সম্ভব, নচেৎ তিনি দুরাশয়া । তিনিই পরমাত্মার ইচ্ছাশক্তি নিত্যানিত্য স্বরূপিনী ॥ ৫২
দেবীভাগবতের টীকাতে টীকাকার লিখেছেন :
ইচ্ছেতি। ইচ্ছাশক্তিরুমাকুমারীতি শিবসূত্রপ্রতিপাদ্যা। তৎ কিং জড়া নেত্যাহ। নিত্যা-নিত্যস্বরূপিণীতি। নিত্যং ব্রহ্মানিত্যং মায়া তদুভয়রূপিণী মায়াশবলব্রহ্মরূপিণীত্যর্থঃ। তথা চ ভগবত্যা উভয়াত্মকত্বাৎ কদাচিদ্ৰহ্মরূপেণৈব বর্ণনং কদাচিত্তচ্ছক্তিরূপেণৈষ বর্ণনমিতীচ্ছাশক্তিরূপত্বেন বর্ণনেহপি দোষাভাবঃ। তথাচ স্মৃতিঃ। হ্রীঙ্কার উভয়াত্মক ইতি। শিবশক্ত্যাত্মক ইত্যর্থঃ। হ্রীং ব্রহ্মেতি শ্রুতেশ্চ ॥ ৫২ ॥
[বিশ্লেষণ : যাদের জ্ঞান হয়নি, তারা কখনোই দেবীর প্রকৃত স্বরূপ নির্ণয় করতে পারেনা, দেবী হলেন পরমাত্মার ইচ্ছা - যেমন একজন ব্যক্তির ইচ্ছা ঐ ব্যক্তির থেকে ভিন্ন নয়, তেমন ভাবে পরমাত্মার থেকে তার ইচ্ছাস্বরূপী শক্তি দেবী কখনোই ভিন্ন নন। তাই এই শ্লোকের পদে বলা হয়েছে ‘ইচ্ছা পরাত্মনঃ’ তিনিই নিত্য পরাশক্তি আবার অনিত্য অবিদ্যা শক্তি। আমাদের শৈবদের তথা সমগ্র সনাতন ধর্মেরই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিবসূত্রেও শক্তিকে ‘ইচ্ছাশক্তিরুমাকুমারী’ বলা হয়েছে। সেই বিষয়টি স্বয়ং দেবীভাগবত পুরাণের ভাষ্যাকার এখানে এই শ্লোকের টীকাভাষ্য করতে গিয়ে সরাসরি সেই শিবসূত্র উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ শিবের ইচ্ছাকে শক্তি বলে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।]
আরো দেখুন 👇
🟦 দেবীভাগবত পুরাণে বিষ্ণু ব্রহ্মা ও রুদ্রদেবকে সম্বোধন করে দেবীর বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন —
মূলপ্রকৃতিরেবৈষা সদা পুরুষসঙ্গতা ।
ব্রহ্মাণ্ডং দর্শয়ত্যেষা কৃত্বা বৈ পরমাত্মনে ॥ ৬০ ॥
দ্রষ্টাসৌ দৃশ্যমখিলং ব্রহ্মাণ্ডং দেবতাঃ সুরৌ! ।
তস্যৈষা কারণং সর্ব্বা মায়া সর্ব্বেশ্বরী শিবা ॥ ৬১ ॥
[দেবীভাগবত পুরাণ/৩য় স্কন্ধঃ/৩য় অধ্যায়/৬০-৬১ নং শ্লোক]
অর্থ : এই দেবীই সেই আদ্যা মূলপ্রকৃতি ; ইনি নিরস্তরই সেই চিদানন্দময় পুরুষের সহিত সংমিলিত হয়ে রয়েছেন; এই দেবী সনাতনীই নিজ প্রভাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড রচনা করে পরমাত্মাকে প্রদর্শন করে থাকেন।
হে সুরদ্বয়! ব্রহ্মা শঙ্কর! এই অখিল ব্রহ্মাণ্ড এবং এতদন্তর্গত দেবতা প্রভৃতির শরীর সমস্তই দৃশ্যপদার্থ আর কুটস্থ চৈতন্য স্বরূপ পরমাত্মাই জীবত্ব উপাধি অঙ্গীকার করে প্রত্যেক শরীরেই সাক্ষিরূপে বিরাজ করে থাকেন; কিন্তু, এ উভয়বিধ বিষয়েরই একমাত্র কারণ এই সর্বেশ্বরী সমষ্টি দেবী শিবারই মায়াশক্তি জানবেন ॥ ৬০-৬১
🔸 এবার শিবমহাপুরাণের বচন লক্ষ্য করুন —
পরব্রহ্মমহেশস্য শক্তিরাদ্যা সনাতনী ।
উমা যা সমভিখ্যাতা ত্রৈলোক্যজননী পরা ॥ ৩
সতী হৈমবতী তস্যা অবতারদ্বয়ং শ্রুতম্ ।..॥ ৪
(তথ্যসূত্র - শিবমহাপুরাণ/উমাসংহিতা/অধ্যায় ৪৫)
অর্থ – সূতজী বললেন, পরব্রহ্ম মহেশ্বরের যে সনাতনী আদ্য ভাগ শক্তি হিসেবে আছে তিনি উমা নামে পরিচিত। তিনিই ত্রিলোক উৎপন্নকারিনী ত্রিলোকের মাতা পরাশক্তি ॥৩
সেই শক্তির দুই অবতার হলেন সতী ও হৈমবতী পার্বতী - এটি আমরা শুনেছি ॥ ৪
আরো দেখুন 👇
আবার ভগবান বিষ্ণু বলছেন, ব্রহ্মকে দেবীই সদ্ অসদ্ জগত রূপে বিস্তারিত হতে সহযোগিতা করেন। অর্থাৎ দেবী যে ব্রহ্মের প্রকাশরূপ শক্তি, তা এখানে স্পষ্ট হচ্ছে,
দেখুন —
জ্ঞাতং ময়াখিলমিদং ত্বয়ি সন্নিবিষ্টং
ত্বত্তোঽস্য সম্ভবলয়াবপি মাতরদ্য ।
শক্তিশ্চ তেঽস্য করণে বিততপ্রভাবা
জ্ঞাতাধুনা সকললোকময়ীতি নূনম্ ॥ ৩০ ॥
বিস্তার্য সর্বমখিলং সদসদ্বিকারং
সন্দর্শযস্যবিকলং পুরুষায় কালে।..॥ ৩১
ন ত্বামৃতে কিমপি বস্তুগতং বিভাতি
ব্যাপ্যৈব সর্বমখিলং ত্বমবস্থিতাসি।
শক্তিং বিনা ব্যবহৃতো পুরুষোঽপ্যশক্তো
বম্ভণ্যতে জননি বুদ্ধিমতা জনেন ॥ ৩২ ॥
[দেবীভাগবত পুরাণ/৩য় স্কন্ধ/৪র্থ অধ্যায়/৩০-৩১ নং শ্লোক]
অর্থ : হে জননী! আজ আমি জেনে গিয়েছি যে, এই সমগ্র বিশ্ব আপনার মধ্যেই অন্তর্নিহিত এবং সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও লয়ও আপনি-ই করেন। এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিতে আপনারই বিস্তৃত প্রভাবময় শক্তিই প্রধান কারণ ; অতএব আমি জেনে গেছি যে আপনিই সমগ্র লোকজগতে ব্যাপ্ত ॥ ৩০
এই সদ্ ও অসদ্-সমস্ত জগতের বিস্তার ঘটিয়ে আপনি (শক্তি) সেই চিদ্ব্রহ্ম পুরুষ (পরমশিব) কে যথাসময়ে সমগ্ররূপে (সাকার জীব-জগতরূপে) তা উপস্থাপন করেন।..॥৩১
হে জননী! আপনার থেকে বিচ্ছিন্ন এমন কোনও বস্তুও এখানে দৃশ্যমান নয়। আপনিই সমগ্র জগৎকে পরিব্যাপ্ত করে অবস্থান করছেন। বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা বলেন, আপনি শক্তিদেবী কে ছেড়ে সেই পরমপুরুষও কিছুই প্রকাশ করেননা ॥ ৩২॥
[বিশ্লেষণ — দেখুন ৩১ নং শ্লোকে স্পষ্ট ভাবে শৈবদের সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, এখানে বলা হয়েছে - ব্রহ্মকে সাকার জগৎ হিসেবে শক্তিদেবীই উপস্থাপন করেন, আমরা শৈবরা পূর্বেই বলেছি যে, শিবের শক্তিই শিবকে নিরাকার নির্গুণ অবস্থার মধ্য থেকে জীব-জগত রূপে সাজিয়ে তোলেন। ফলে সকল বস্তুতে শক্তি রয়েছে, আর এই শক্তিরূপে ঐ একমাত্র পরমেশ্বর শিবই রয়েছেন। এটিই মীমাংসা।
৩২ নং শ্লোকে পরমপুরুষ ব্রহ্মের শক্তিকে প্রাধান্যতা দিয়ে বলা হয়েছে যে, পরমপুরুষও শক্তিকে ছাড়া এই জগৎ প্রকাশ করেন না, অর্থাৎ এখানে পরমব্রহ্ম শিবের অক্ষমতাকে বোঝানো হয়নি বরং শক্তি দ্বারাই একমাত্র জগৎ প্রকাশিত হয়, তাই শক্তির স্তুতি করতে গিয়ে শ্রীবিষ্ণু বলেছেন নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্ম পরমপুরুষও শক্তিকে ছেড়ে জগৎ প্রকাশ করেন না। শক্তি মূলত ব্রহ্মের সহিত অভিন্নই, তাই ব্রহ্মের অক্ষমতা বলে কিছু সম্ভব নয়, কারণ শক্তিটাই ব্রহ্মের নিজস্ব। অর্থাৎ এখানে পরিশেষে পরমপুরুষ ও শক্তিকে কার্যগত দৃষ্টিতে পৃথক ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শক্তি হল দেবী, আর পরমপুরুষের প্রকাশের জন্য শক্তি দায়ী। সুতরাং শক্তি যে তার পরমপুরুষ ব্রহ্মের সহিত অবস্থান করেন তা এখানে আবারো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।]
🟦 দেবী শক্তি ও তার স্বামী পরমপুরুষের বিষয়ে আরো বিস্তারিত প্রমাণ দেখুন —
🔸 প্রসঙ্গ : ব্রহ্মা স্পষ্ট করে বর্ণনা করে দিয়েছেন "দেবী ও তার স্বামী পরমাত্মা"কে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে এবং সাধারণ মানুষের মতোই সেই পরমপুরুষ ব্রহ্মের সাথে দেবী কিভাবে অবস্থান করে রয়েছেন, এই বিষয়ে সে বিষয়ে প্রশ্নও করেছেন, কেননা বেদ বলেছে ব্রহ্ম একজন, তাহলে পরমপুরুষ ও তার শক্তি ভুবনেশ্বরী দেবী কিভাবে থাকতে পারেন ?
এই বিষয়ে প্রশ্নও করেছেন দেবীকে —
অকর্তাগুণস্পষ্ট এবাদ্য দেবো
নিরীহোঽনুপাধিঃ সদৈবাকলশ্চ।
তথাপীশ্বরস্তে বির্তীর্ণং বিনোদং
সুসম্পশ্যতীত্যাহুরেবং বিধিজ্ঞাঃ ॥ ৪০ ॥
দৃষ্টাদৃষ্টবিভেদেঽস্মিন্ প্রাক্ত্বত্তো বৈ পুমান্ পরঃ।
নান্যঃ কোঽপি তৃতীয়োঽস্তি প্রমেয়ে সুবিচারিতে ॥ ৪১ ॥
ন মিথ্যা বেদবাক্যং বৈ কল্পনীয়ং কদাচন।
বিরোধোঽয়ং ময়াত্যন্তং হৃদয়ে তু বিশঙ্কিতঃ ॥ ৪২ ॥
একমেবাদ্বিতীয়ং যদ্ ব্রহ্ম বেদা বদন্তি বৈ।
সা কি ত্বং বাপ্যসৌ বা কিং সন্দেহং বিনিবর্তয় ॥ ৪৩ ॥
[দেবীভাগবত পুরাণ/৩য় স্কন্ধ/৫ম অধ্যায়/৪০-৪১নং শ্লোক]
অর্থ : শাস্ত্রজ্ঞ মনীষিগণ বলেন যে, ঈশ্বর নির্গুণ, নিষ্ক্রিয়, নিরুপাধিক, নিরংশ ও নিরীহ হয়েও আপনার (শক্তির) সুবিস্তীর্ণ সংসাররূপ লীলা নিরীক্ষণ করতে থাকেন ॥ ৪০
যে সকল মূর্ত ও অমূর্তভেদ সংসারের মধ্যে দেখা যায়, তাতে আপনার (দেবীর) পূর্ব্বাধারভূত অপর এক পুরুষ আছেন, সেই প্রমেয় পদার্থ বিচার বিষয়ে আপনাদের এই উভয় ব্যতীত তৃতীয় আর কোন বস্তুই নেই ॥ ৪১
বেদবাক্য মিথ্যা বলে কল্পনা করা কদাচই কর্তব্য নয়। অনুভব দ্বারা প্রকৃতি-পুরুষরূপ পদার্থদ্বয় প্রতিভাত হচ্ছে, কিন্তু শ্রুতি অদ্বৈতের কথাই বলছে, অতএব মাতঃ! আমি (ব্রহ্মা) হৃদয় মধ্যে এ বিষয়ের বিরোধ আশঙ্কা করছি ॥ ৪২
‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ অদ্বিতীয় ব্রহ্মপদার্থ একটিই, সমগ্র বেদ এই কথাই বলছে, জননি! সেই অদ্বিতীয় পদার্থ কি শুধুই আপনি (ভুবনেশ্বরী) ? নাকি সেই পুরুষই অদ্বিতীয় পদার্থ ? আপনি আমার এই সংশয় নিরাকরণ করুন ॥৪৩
[বিশ্লেষণ : ৪০নং শ্লোকে বলা হয়েছে, ব্রহ্ম নির্গুণ অর্থাৎ গুণের প্রভাব থেকে মুক্ত, তিনি সকল কিছু দেখেন, সবকিছুর সাক্ষী তিনি।
৪১নং শ্লোকে বলা হয়েছে মূর্তিমান সাকার ও অমূর্তি নিরাকার এই দুই ধরণের বিচারে, দেবীর চেয়েও পূর্ববর্তী অর্থাৎ দেবীর চেয়েও ঊর্ধ্বে দেবীর চেয়ে তত্ত্বগত ভাবে ভিন্ন এক অপর পুরুষ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে দেবীভাগবত পুরাণে। এই শ্লোকেই বলা হয়েছে, এই পরমপুরুষ ও দেবী ছাড়া আর কোনো বস্তুই নেই। অর্থাৎ দেবী ভাগবত শাক্তদের শাস্ত্র হয়েও শাক্তদের দেবীর চেয়েও ঊর্ধ্বে থাকা এক পুরুষকে স্বীকার করে নিয়েছে।
৪২ নং শ্লোকে বলা হয়েছে বেদবাক্যকে কখনোই মিথ্যা বলে ভাবা উচিত নয়, । অথচ দেখুন! শাক্ত দের দেবীভাগবত পুরাণ স্বয়ং নিজেই স্বীকার করছে যে, দেবীর পূর্বেও এক পুরুষ রয়েছেন।
তবে বেদে যেখানে বলা হয়েছে অদ্বৈতবাদ শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ একমাত্র পরমেশ্বর রয়েছেন, ব্রহ্মা ও শক্তি অভেদ। তাহলে শক্তির চেয়েও ঊর্ধ্বে যে পুরুষ রয়েছে, এতে ব্রহ্ম ও শক্তি কি ভিন্ন ভিন্ন বলে মনে হচ্ছে না !
৪৩ নং শ্লোকে ব্রহ্মা দেবীকে জিজ্ঞাসা করে বলেছেন, বেদে একামেবাদ্বিতীয়্ অর্থাৎ ব্রহ্ম একজনই, তাহলে শক্তির ঊর্ধ্বেও একজন পুরুষ আছেন, এমনটা কেন হবে ? ঐ পুরুষ আর শক্তি কি ভিন্ন ? ]
🟤 ব্রহ্মার কথা শুনে দেবী উত্তর দিয়ে বললেন,
দেব্যুবাচ।
সদৈকত্বং ন ভেদোঽস্তি সর্ব্বদৈব মমাস্য চ ।
যোঽসৌ সাহমহং যার্সো ভেদোঽস্তি মতিবিভ্রমাৎ ॥ ২
আবয়োরন্তরং সূক্ষ্মং যো বেদ মতিমান্ হি সঃ।
বিমুক্তঃ স তু সংসারান্মুচ্যতে নাত্র সংশয়ঃ ॥ ৩ ॥
একমেবাদ্বিতীয়ং বৈ ব্রহ্ম নিত্যং সনাতনম্।
দ্বৈতভাবং পুনর্যাতি কাল উৎপৎসুসংজ্ঞকে ॥ ৪ ॥
যথাদীপস্তথোপাধের্যোগাৎ সঞ্জায়তে দ্বিধা।
ছায়েবাদর্শমধ্যে বা প্রতিবিম্বং তথাবয়োঃ ॥ ৫ ॥
ভেদ উৎপত্তিকালে বৈ সর্গার্থং প্রভবত্যজ!।
দৃশ্যাদৃশ্যবিভেদোঽয়ং দ্বৈবিধ্যে সতি সর্ব্বথা ॥ ৬ ॥
[দেবীভাগবত পুরাণ/৩য় স্কন্ধ/৬ষ্ঠ অধ্যায়/২-৬ নং শ্লোক]
অর্থ : দেবী বললেন, হে ব্রহ্মন! সেই পুরুষের এবং আমার সর্বদাই একত্বভাব, আমাদের কোনও ভেদ নেই। যিনি পুরুষ সেই আমি এবং যে আমি সেই পুরুষ; তবে যে, শক্তি ও শক্তিমানে ভেদবুদ্ধি হয়, একমাত্র মতিবিভ্রমকেই তার কারণ বলে জানবে ॥ ২
যে সাধক আমাদের উভয়ের (শক্তি ও শক্তিমানের) ভেদ-বিষয়ক সূক্ষ্মতত্ত্বের ভিত্তিতে বুঝতে পারে, অর্থাৎ স্বরূপত ভেদ না থাকিলেও কেবল কার্যত ভেদমাত্র - এই বিষটি যার অনুভূত হয়েছে, একমাত্র সেই তত্ত্বজ্ঞ পুরুষই সংসারবন্ধন হতে মুক্ত হয় সন্দেহ নেই ॥ ৩
একজন অদ্বিতীয় ব্রহ্ম বস্তু আছেন, তিনি নিত্য সনাতন স্বরূপ হইলেও সৃষ্টি করবার সময়ে তিনিই দ্বৈতভাব (একাধিকরূপ) ধারণ করে থাকেন ॥ ৪
যেমন একমাত্র দীপ উপাধি-যোগে দ্বৈধভাব প্রাপ্ত হয়, যেমন একমাত্র মুখ, দর্পণরূপ উপাধিযোগে প্রতিবিম্বিত হয়ে আরেকটি একাধিক রূপ প্রাপ্ত হয়, যেমন একমাত্র পুরুষ ছায়ারূপ উপাধিযোগে দ্বিত্বপ্রাপ্ত হয়, সেইরূপ মায়ার কার্য্যরূপ অন্তঃকরণের উপাধিতে প্রতিবিম্বিত হলেই আমাদের (ব্রহ্মতে ব্রহ্মের থেকে একাধিক সত্ত্বার অস্তিত্ব স্বীকৃত হয়ে ব্রহ্ম ও শক্তি হিসেবে দুটি ভিন্ন ভিন্ন সত্ত্বা বিদ্যমান, এমনই) ভেদ প্রতীয়মান হয় ॥ ৫
হে অজ ব্রহ্মণ ! জগত নির্মাণ করবার জন্য সৃষ্টিকালে ভেদ দর্শিত হবেই। তখন দৃশ্য-অদৃশ্যের প্রতীতি হওয়া অনিবার্য। কেননা বিনা ভেদে সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব ॥ ৬
[বিশ্লেষণ :
২নং শ্লোকে দেবী নিজ মুখে বলছেন, সেই পুরুষের সাথে দেবীর একত্বভাব সর্বদাই আছে, অর্থাৎ অভিন্নতা। শিব ও শক্তি অভিন্ন, পৃথক নয়। যাদের মতিভ্রম হয়েছে তারাই শিব শক্তিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে মনে করে ।
৩নং শ্লোকে দেবী বলছেন,ঐ পরমপুরুষ ও দেবী স্বরূপ গত ভাবে অভিন্ন হয়েও, একমাত্র কার্যগত কারণে দেবী ও সেই ব্রহ্মপুরুষের মধ্যে সূক্ষ্ম ভেদ চিহ্নিত করা হয়ে থাকে, এই কার্যকারণগত সূক্ষ্ম ভেদ চিহ্নিত করে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে যিনি চিনে নিতে পারেন সেই ব্যক্তিই চিরতরে মুক্তি লাভ করে। অর্থাৎ ব্রহ্ম ও শক্তি অভিন্ন, কিন্তু ব্রহ্মের শক্তিকে দেবী বলে, যেমন ব্যক্তি আর ব্যক্তি মন এক হয়েও সূক্ষভেদ বর্তমান, আবার ভেদ হয়েও একত্ব বর্তমান, ঠিক তেমনভাবেই এই সূক্ষ্ম বিষয়টি জেনে যে ব্যক্তি শক্তির ঊর্ধ্বে থাকা ব্রহ্মকে আর ব্রহ্মের শক্তিকে দেবী বলে জানতে পারেন, তাদেরই মোক্ষ নিশ্চিত বলে জানিয়েছেন শাক্তদের আরাধ্যা দেবী নিজেই। এবার ভাবুন, শৈবদের সিদ্ধান্তকেই দেবী নিজে স্বীকৃতি দিয়েছেন দেবীভাগবতে। শাক্তদের মতবাদের কোনোকিছুই প্রমাণিত হওয়া সম্ভবই না এখানে।
৪নং শ্লোকে দেবী স্পষ্ট ভাবে বলছেন যে, ঐ ব্রহ্ম একজনই, তিনি যখন ইচ্ছা করেন তখন তিনিই দ্বিতীয় হয়ে থাকেন অর্থাৎ পরমশিব এক থেকে দ্বিতীয় হবার ইচ্ছা করে নিজেকেই বিভিন্নরূপ দান করেন। খেয়াল করুন, এখানে দেবী কোথাও বলেননি যে দেবী একা ছিলেন, দেবী থেকে ঐ পরমপুরুষ প্রকট হয়েছে - একথা বলেননি, সুতরাং, কোনো শাক্ত ব্যক্তি যদি মনে করেন যে, তিনি নিজের ইচ্ছে মতো জোরপূর্বক ঐ ব্রহ্মকে শুধুমাত্র দেবী বলে চিহ্নিত করবেন, তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ দেবীভাগবতেই পরিস্কার করে দেবী নিজেই ব্রহ্ম ও শক্তি শব্দের মধ্যে শক্তি ও ব্রহ্ম দুটি শব্দের পৃথক পৃথক ভাবে চিহ্নিতকরণ করেছেন, দেবী হলেন শক্তি আর ঐ শক্তির উপাসকই এই কারণে শাক্ত, তা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ব্রহ্মা ৪১ নং শ্লোকে স্পষ্টভাবে বলেছেন দেবীর চেয়েও ঊর্ধ্বে একজন পুরুষ রয়েছেন, সুতরাং কোনো শাক্ত বা অন্য কোনো ব্যক্তির পক্ষে নিজের ইচ্ছে মতো সেই ব্রহ্মপুরুষটিই হল দেবী - এমনটা বলে চিহ্নিতকরণ করা সম্ভব নয়।
৫নং শ্লোকে দেবী বলছেন, একটি দীপ থেকে আরেটি দীপ জ্বেলে দিলে একই দীপের মতো দুটো ভিন্ন দীপ জ্বলে তেমনই ব্রহ্ম ও শক্তি এক হয়েও সূক্ষ্ম তত্ত্বগত দৃষ্টিকোণে ভিন্নতা আছে।
একটি আয়নাতে একজন ব্যক্তি হয়েও তার প্রতিচ্ছবিতে যেমন দুটি ব্যক্তি দেখায় যা এক হয়েও সূক্ষ্মভাবে ভেদ রয়েছে, তেমনভাবে ব্রহ্ম ও শক্তি এক হয়েও সূক্ষ্ম তত্ত্বগত দৃষ্টিকোণে ভিন্নতা আছে।
একজন ব্যক্তির ছায়া যেমন তারই সাথে অভিন্ন তবুও ঐ ব্যক্তিই প্রধান আর প্রতিবিম্ব তার হয়েও ছায়া হিসেবে চিহ্নিত হন, ব্রহ্ম ও শক্তি এক হয়েও সূক্ষ্ম তত্ত্বগত দৃষ্টিকোণে ভিন্ন হিসেবে চিহ্নিত হন।
৬নং শ্লোকে দেবী স্বয়ং নিজেই বলছেন, অদ্বৈত ব্রহ্ম থেকে তার ইচ্ছাস্বরূপী শক্তি প্রকট হওয়া মাত্রেই সৃষ্টি হচ্ছে জগত। আর সৃষ্টি হতে গেলে ব্রহ্ম থেকে শক্তি অভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও ভেদ হিসেবে শক্তি হিসেবে দৃশ্যমান হবেই। কারণ জগত সৃষ্টি করবার জন্য শক্তিই প্রয়োজন। যেমন গোমাতা থেকে দুধ আসে, দুধ থেকে দই। এখন এই দই দুধ থেকেই আসে, দুধ ছাড়া দই তৈরী করা অসম্ভব। আর দুধ গোমাতার মধ্যেই অবস্থান করে, গোমাতা দুধ দ্বারা দই তৈরী হতে দেন। একইভাবে শিবই গোমাতারূপে শক্তিরূপী দুধ প্রকাশ করেন, আর দুধ থেকে দইরূপী জগত তৈরী হয়। দই তৈরী হতে গেলে দুধই দরকার, ঠিক একইভাবে জগৎ তৈরি হতে গেলে শক্তির দরকার। যেমন গোমাতা থেকে দুধ আসে, তেমনই শিব থেকে শক্তি প্রকাশ হয়, তথাপি এক হয়েও ভিন্নতা থাকে। কারণ যতক্ষণ না সৃষ্টি হচ্ছে ততক্ষণ শিবের মধ্যেই শক্তি শিব হয়েই নিহিত থাকে, সৃষ্টি হওয়ার ইচ্ছা হতেই শক্তি হিসেবে শিব প্রকট হন, তখনই শিব ও শক্তি হিসেবে সূক্ষ্ম ভেদ পরিলক্ষিত হয়। ভেদ না হলে সৃষ্টি সম্ভব ই নয়। কারণ অভেদ অবস্থায় অদ্বিতীয় পরমেশ্বর শিবই থাকেন, সৃষ্টি হলে ভিন্নতা সৃজন হয়ে, অদ্বৈততার মধ্যেও বিভিন্নতা বৈচিত্র্যতা সৃষ্টি হয়। এটিই দেবী বললেন।]
আরো দেখুন 👇
♦️ রুদ্রদেবকে ত্রিদেব জননী দেবী ভগবতী ভুবনেশ্বরী স্বয়ং বলছেন, ভুবনেশ্বরী গুণাতীত অবস্থায় পরমাত্মার সহিত অবস্থান করেন —
নির্গুণঃ পরমাত্মাসৌ নতু দৃশ্যঃ কদাচন।
সগুণা নির্গুণা চাহং সময়ে শঙ্করোত্তমা ॥ ৭০ ॥
সদাহং কারণং শম্ভো ন চ কার্য্যং কদাচন।
সগুণা কারণত্বাদ্বৈ নির্গুণা পুরুষান্তিকে ॥ ৭১ ॥
[দেবীভাগবত পুরাণ/৩য় স্কন্ধ/৬ষ্ঠ অধ্যায়/৭০-৭১ নং শ্লোক]
অর্থ : দেবী বললেন, হে শঙ্কর! পরমাত্মা (পরমশিব/সদাশিব) নির্গুণ, তিনি ঐ পরমাবস্থায় কখনোই (সাধারণ) দৃশ্যমান নন, পরমপ্রকৃতিরূপিণী আমি সৃষ্টি ইত্যাদি কার্যের সময় সগুণা (সাকার) আর সংহারের পর সমাধি সময়ে নির্গুণা (পরমশিবে একাত্ম) হয়ে অবস্থান করে থাকি ॥ ৭০
হে শম্ভো ! আমি অনাদি, অতএব সততই এই সংসারের কারণরূপে বিদ্যমান থাকি কাৰ্য্যরূপ (পরমার্থ বিচারে) কখনই হই না। হে শঙ্কর! আমি যখন কারণরূপিণী হই তখনই সগুণা (সাকার হই), আর যখন সেই পুরুষের কাছে সেই পরমাত্মার (পরমশিবের) সহিত অভিন্নভাবে অবস্থান করি, তিনটি গুণের সাম্যাবস্থা হেতু গুণ উদ্ভবের অভাব হলে তখনই আমি নির্গুর্ণা (এক পরমশিবে একাত্ম) হয়ে অবস্থান করে থাকি ॥ ৭১
[বিশ্লেষণ : ৭০ নং শ্লোকে দেবী বললেন, পরমশিব সর্বদাই নিরাকা নির্গুণ, তাকে দর্শন করা কখনোই কোনোভাবেই সম্ভব নয়, তার সাকার সদাশিবরূপ দর্শন করা সম্ভব হতে পারে। ঐ নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্মের শক্তি গুণযুক্ত হয়ে সাকার হন, জগত তৈরী করেন, আবার সকল কিছুই সংহার করে শিবেই লীন হয়ে শক্তিও নির্গুণ শিব হয়ে অবস্থান করেন, এই অবস্থায় শিবের সহিত শক্তি একাত্ম হয়ে থাকেন ।
৭১নং শ্লোকে দেবী নিজের আত্মস্বরূপ ঐ পরমপুরুষের ব্রহ্মের দৃষ্টিকোণে ‘আমি’ শব্দে শব্দায়মান করে, ব্রহ্মের লক্ষণ বলছেন, কারণ হিসেবে থাকা ব্রহ্ম কখনোই সেই পরমার্থিক পরমশিব অবস্থায় কার্যরূপ হন না, বরং ঐ অবস্থা অবিকৃত থাকে। কিন্তু যখন সংসার রচনার কারণ রূপে শক্তি হিসেবে অবস্থান নেন তখন দেবীই সাকার জীবজগত তথা সকল দেবদেবীর রূপ প্রকট করেন সত্ব রজঃ তমো গুণের মাধ্যমে সগুণ হয়ে।
কিন্তু যখন সত্ব রজঃ তমো গুণ নাশ হয়ে যায় তখন সাকার জগৎ অবশিষ্ট থাকে না, তখন শক্তি নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মে নিহিত হয়ে গিয়ে অদ্বৈত অবস্থায় স্থিত হন, তাই এক্ষেত্রে পরমশিবে স্থিত ঐ নিহিত শক্তি কে নির্গুণা বলে সম্বোধন করা হয়েছে।]
🔷 শাক্তদের মান্য শাস্ত্র দেব্যুথর্বশীর্ষম উপনিষদ দেবী পরমাত্মার শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছে,
প্রমাণ দেখুন 👇
এষাঽঽত্মশক্তি । এষাবিশ্বমোহিনী । পাশাঙ্কুশধনুর্বাণধরা ।
এষামহাবিদ্যা । য এবং বেদং স শোকং তরতি ॥১৫
[অথর্ববেদ/দেব্যুথর্বশীর্ষম উপনিষদ/১৫ নং মন্ত্র]
অর্থ – ইনি (দেবী) পরমাত্মার শক্তি, ইনি বিশ্ব মোহিনী, পাশ অঙ্কুশ ধনু ও বানধারিণী ।ইনি শ্রীমহাবিদ্যা। যে তাকে এই ভাবে জানে শোকের দুস্তর সাগর পার হয়ে যায় ॥১৫
🔴 সিদ্ধান্ত — শাক্তগণ নিজেরাই নিজেদের আরাধ্যা দেবীর সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত নন, শাক্তদেরই শাস্ত্র দেবীভাগবত পুরাণ থেকে প্রমাণিত হল - দেবী হলেন ব্রহ্মের শক্তি, সাক্ষাৎ ব্রহ্ম নন।
ব্রহ্ম হলেন দেবীর স্বামী, আর দেবী হলেন সেই ব্রহ্মের শক্তি। আমাদের শৈব সিদ্ধান্ত সত্য প্রমাণিত হল।
___________________________________________________________________________________
___________________________________________________________________________________
চলুন এবার দেবীভাগবত পুরাণের এই দেবী আর তার পতি ব্রহ্মের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক —
(৩) দেবীকে শাস্ত্রে কেন ব্রহ্ম বলে সম্বোধন করা হয় ? কেন দেবী কখনো কখনো নিজেকে ব্রহ্ম দাবী করেন ?
✅ উত্তর —
🟦 (১) পরমব্রহ্ম ও তার শক্তিদেবী ভুবনেশ্বরীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সাক্ষাৎ দেবী ভাগবত পুরাণ বলছে —
যয়া ব্যাপ্তমিদং সর্বং ভগবত্যা চরাচরম্ ।
মোহদা জ্ঞানদা সৈব বন্ধমোক্ষপ্রদা সদা ॥ ৫৩ ॥
রাজোবাচ।
ভগবন্! ব্রুহি মে তস্যাঃ স্বরূপং বলমুত্তমম্।
উৎপত্তিকারণং বাপি স্থানং পরমকঞ্চ যৎ ॥ ৫৪ ॥
ঋষিরুবাচ।
ন চোৎপত্তিরনাদিত্বান্নৃপ ! তস্যাঃ কদাচন ।
নিত্যৈব সা পরা দেবী কারণানাঞ্চ কারণম্ ॥ ৫৫ ॥
বর্ততে সর্বভূতেষু শক্তিঃ সর্বাত্মনা নৃপ ।
শববচ্ছক্তিহীনন্ত প্রাণী ভবতি সর্বথা ॥ ৫৬ ॥
চিচ্ছক্তিঃ সর্বভূতেষু রূপং তস্যাস্তদেব হি।
আবির্ভাবতিরোভাবৌ দেবানাং কার্যসিদ্ধয়ে ॥ ৫৭ ॥
যদা স্তবস্তি তাং দেবা মনুজাশ্চ বিশাম্পতে !।
প্রাদুর্ভবতি ভূতানাং দুঃখনাশায় চাম্বিকা ॥ ৫৮ ॥
নানারূপধরা দেবী নানাশক্তিসমন্বিতা।
আবির্ভবতি কাৰ্য্যার্থং স্বেচ্ছয়া পরমেশ্বরী ॥ ৫৯ ॥
দৈবাধীনা ন সা দেবী যথা সর্বে সুরা নৃপ! ।
ন কালবশগা নিত্যং পুরুষার্থপ্রবর্ত্তিনী ॥ ৬০
অকর্তা পুরুষো দ্রষ্টা দৃশ্যং সর্বমিদং জগৎ।
দৃশ্যস্য জননী সৈব দেবী সদসদাত্মিকা ॥ ৬১ ॥
পুরুষং রঞ্জয়ত্যেকা কৃত্বা ব্রহ্মাণ্ডনাটকম্ ।
রঞ্জিতে পুরুষে সর্বং সংহরত্যতিরংহসা ॥ ৬২ ॥
তয়া নিমিত্তভূতাস্তে ব্রহ্মবিষ্ণুমহেশ্বরাঃ ।
কল্পিতাঃ স্বস্বকার্য্যেযু প্রেরিতা লীলয়া ত্বমী ॥ ৬৩ ॥
স্বাংশং তেষু সমারোপ্য কৃতাস্তে বলবত্তরাঃ।
দত্তাশ্চ শক্তয়স্তেভ্যো গীর্লক্ষ্মীর্গিরিজা তথা ॥ ৬৪ ॥
তে তাং ধ্যায়ন্তি দেবেশাঃ পুজয়ন্তি পরাং মুদা।
জ্ঞাত্বা সর্বেশ্বরীং শক্তিং সৃষ্টিস্থিতিবিনাশিনীম্ ॥ ৬৫ ॥
[দেবীভাগবত পুরাণ/৫ম স্কন্ধ/৩৩ অধ্যায়৫৩-৬৫/ নং শ্লোক]
অর্থ : সেই ভগবতী এই সচরাচর বিশ্ব সংসারে ব্যাপ্ত করে মোহ দ্বারা বন্ধনে আবদ্ধ করছেন, আবার তিনিই জ্ঞান দিয়ে মুক্তি প্রদান করছেন ॥ ৫৩
রাজা বললেন, ব্রহ্মন! তাঁর স্বরূপ কি প্রকার ? উত্তম বলই বা কিরূপ ? উৎপত্তির কারণ কি ? এবং তাঁহার পরম স্থানই বা কোথায় ? আপনি এই সমস্ত বিষয় আমাকে বিশেষ করে বলুন ॥ ৫৪
ঋষি বললেন, নরপাল! তিনি অনাদি , অতএব তাঁর কখনো উৎপত্তিও নেই, সেই পরমাপ্রকৃতি নিত্যা এবং তিনি নিয়তই সমস্ত কারণেরও কারণ হয়ে থাকেন, অতএব তাঁর তুল্য বলবতী আর কে হতে পারে ? ॥ ৫৫
হে রাজস্! তিনি শক্তিরূপে সমস্ত পদার্থ মধ্যেই সর্বতোভাবে বিরাজমান রয়েছেন ; সুতরাং জীব শক্তিবিহীন হলে মৃতদেহের মতো স্পন্দহীন হয়ে থাকে ॥ ৫৬
এই চরাচর বিশ্বমণ্ডলে যে সকল পদার্থ বিদ্যমান আছে সেই সমস্তই পরমদেব ব্রহ্ম (পরমশিব), সুতরাং তার চিৎ স্বরূপ শক্তিও (ভুবনেশ্বরী দেবী) সকল প্রান্তেই বিরাজ করছে ; অতএব এই শক্তির রূপও ব্রহ্মই তাহাতে সন্দেহ নেই (যেহেতু অগ্নিশক্তি আর অগ্নির মধ্যে ভিন্নতা নেই) । তবে, কেবল দেবগণের কার্য সম্পাদন করবার নিমিত্তই সময়ে সময়ে তাঁর আবির্ভাব ও তিরোভাব হয়ে থাকে ॥ ৫৭
হে রাজস্ ! দেবগণ ও মানবগণ যখন তাঁহার স্তব করেন তখনই অম্বিকা প্রাণীগণের দুঃখ নিবারণ করবার জন্য প্রাদুর্ভূত হন ॥ ৫৮
সেই পরমেশ্বরী দেবী বিভিন্ন রূপ ধারণ করে নানা প্রকার শক্তিগণের রূপে নিজ ইচ্ছানুসারেই দেবকার্য্যের নিমিত্ত আবির্ভূত হয়েন ॥ ৫৯
নৃপবর! কাল ও দৈব তাঁর হতেই উৎপন্ন সুতরাং তিনি দেবগণের ন্যায় দৈবের অধীন অথবা কালেরও বশীভূতা নন বস্তুত তিনি পুরুষার্থ অনুসারে জীবগণকে নিয়ত কার্য্যে প্রবর্তিত করিয়া থাকেন ॥ ৬০ ॥
সেই পরমপুরুষ (পরমার্থরূপে) কার্য্য করেন না, কেবল সকলের সাক্ষীরূপে বিদ্যমান থাকেন। এই সমস্ত জগৎ দৃশ্য ; সেই দেবী এই অখিলের কার্য্য ও কারণস্বরূপা সুতরাং তিনিই এই সমস্ত দৃশ্যমান বিশ্বের সৃষ্টি করে থাকেন ॥ ৬১
তিনি একাকিনীই এই ব্রহ্মাণ্ডনাটক প্রকটিত করে ঐ পরমপুরুষকে (জগতরূপে বিচিত্রতায়) রঞ্জিত করেন এবং পরমপুরুষ রঞ্জিত (জগতরূপে প্রকটিত হয়ে সৃষ্টি) হলেই অতি সত্বরে আবার সেই জগতের সংহার করে থাকেন ॥ ৬২
ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বর (এই ত্রিদেব) সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারকর্তা - এটি লোকপ্রবাদ মাত্র, বস্তুত তাঁরা সৃষ্টি স্থিতি সংহারের নিমিত্ত মাত্র। প্রকৃত পক্ষে ভগবতী লীলার জন্য এদের কল্পনা করে স্ব স্ব কার্য্যে নিয়োজিত করে রেখেছেন মাত্র ॥ ৬৩
ভগবতী নিজ অংশ সমর্পণ করে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে নিজ শক্তি সরস্বতী লক্ষ্মী ও গিরিনন্দিনী (পার্বতী) দান করে তাঁদের বলশালী করেছেন ॥ ৬৪
সেই ত্রিদেবগণ ঐ মহাশক্তিকে সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারকারিণী জেনে আনন্দে তাঁদের ধ্যান ও পূজারূপে শ্রদ্ধা করে থাকেন ॥ ৬৫
[বিশ্লেষণ : ৫৩ নং শ্লোকে বলা হয়েছে দেবী বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে আছেন তিনি সকলকে মায়ায় আবদ্ধ করে রেখেছেন আবার তিনি জ্ঞান প্রদানের মাধ্যমে সেই সকলকে মুক্তি দেন ।
৫৪ নং শ্লোকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, শক্তিদেবীর প্রকৃত স্বরূপ কি ?
৫৫ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, দেবী হলেন পরমা প্রকৃতি, তার থেকে সকল কিছুর উৎপত্তি হয় তার কোন উৎপত্তি নেই, অর্থাৎ শক্তির কোনো জন্ম হয় না, এর কারণ হল শিব যেহেতু অজন্মা, তাই তার শক্তিও অজন্মা। শিবের শক্তির সমান আর কেউ হতে পারে না।
৫৬ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, শক্তি সকল পদার্থের মধ্যে বিরাজমান রয়েছে।
৫৭ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, সমগ্র চরাচর বিশ্বে যে সকল পদার্থ আছে সেই সমস্তই হলো সেই পরমব্রহ্ম। এই কারণে তার শক্তিও সর্বত্রই রয়েছে, কারণ ব্রহ্ম ও তার শক্তি অভিন্ন। তাই ব্রহ্মের সহিত শক্তির অভিন্নতার কারণে শক্তিকে ব্রহ্ম বলে সম্বোধন হয়ে থাকে মাত্র। শুধুমাত্র শক্তি কখনোই ব্রহ্ম নয়, ব্রহ্মের সহিত অভিন্নতার দৃষ্টিকোণের বিচারের কারণে শক্তিও ব্রহ্ম বলে উক্ত হন মাত্র। সেই শক্তি প্রকট হয়ে দেবগণের কার্য করে উদ্ধার করে দেন, কার্য শেষে অন্তর্ধান হন।
৬১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, দেবী স্বামী পরমপুরুষ এই মায়ার জগতে প্রবেশ করেন না, তিনি সকলকিছু দর্শন করে সকল কিছুর সাক্ষী হয়ে থাকেন, দেবী এই জগতের রচনা ও কার্য করে থাকেন।
৬২ নং শ্লোকে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, দেবীশক্তি একাই তার পরমপুরুষ ব্রহ্মকে ব্রহ্মের মধ্যেই জগতের রচনা করে যেন ব্রহ্মকে সাজিয়ে রঞ্জিত করে তোলেন আবার ঐ সকল রূপের সংহারও করেন।
৬৩ ও ৬৪ নং শ্লোকে দেবী ত্রিদেবকে সৃষ্টি করেন বলা হয়েছে, কিন্তু ঐ ত্রিদেবের মধ্যে থেকে কার্যটি দেবীই করছেন, তা বলা হয়েছে। এই সব দেবতার রূপ তো উপলক্ষ্য মাত্র। ঐ ত্রিদেবকে সহযোগিতার জন্য দেবীই নিজের অংশ থেকে সরস্বতী লক্ষ্মী ও গৌরীকে প্রদান করেছেন।]
এবিষয়ে আরো দেখুন 👇
🔴 (২) দেবী স্বয়ং নিজেই বলছেন যে, তিনি নিজে কখনোই সাক্ষাৎ ব্রহ্ম নন বরং আত্মরূপে ব্রহ্ম সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত হন মাত্র —
অহমেবাস পূর্বন্তু নান্যৎকিঞ্চিন্নগাধিপ ।
তদাত্মরূপং চিৎসম্বিৎপরব্রহ্মৈকনামকম্ ॥ ২ ॥
অপ্রতর্ক্যমনির্দ্দেশ্য মনৌপম্যমনাময়ম্।
তস্য কাচিৎ স্বতঃসিদ্ধা শক্তির্মায়েতি বিশ্রুতা ॥ ৩ ॥
[দেবীভাগবত পুরাণ/৭ম স্কন্ধ/৩২ অধ্যায়/২-৩ নং শ্লোক]
অর্থ : সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র আমিই বিদ্যমান ছিলাম, তখন আর কিছুই ছিল না। আমারই (অন্তরস্থ) আত্মস্বরূপ কে চিৎসম্বিৎ পরব্রহ্ম ইত্যাদি নামে নির্দেশ করে থাকে ॥ ২
আমার (শক্তির) আত্মা (পরমশিব) অনুমানের অতীত, লক্ষ্যের অতীত, উপমার অতীত ও জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি বিকারের অতীত পদার্থ । আমার আত্মার স্বতঃসিদ্ধ এক শক্তি আছে, ঐ শক্তি ‘মায়া’ নামে বিখ্যাত ॥ ৩
[বিশ্লেষণ : দেবী বলছেন, ‘আমি’ শব্দে চিহ্নিত পরমেশ্বর সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র বিদ্যমান ছিলেন, তখন আর কিছুই ছিল না, এখানে দেবী আমি শব্দে ব্রহ্মকে কে বোঝাচ্ছেন, কারণ পরবর্তী শ্লোকে দেবী ‘তদাত্মরূপং’ পদ ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ দেবীর অন্তরে স্থিত সেই আত্মরূপকে এখানে দেবী ইঙ্গিত করেছেন। দেবী আরো বলছেন, দেবীকে ব্রহ্ম বলতে যাকে ইঙ্গিত করা হয়, তা মূলত দেবীর অন্তরে থাকা ঐ আমিরূপ আত্মতত্ত্বসত্তাকেই পরমব্রহ্ম নামে নির্দেশ করা হয়, দেবীকে নয়।
৩নং শ্লোকে দেবী বলছেন, দেবীর অন্তস্থ আত্মা (ব্রহ্ম) অনুমান করাটাও সম্ভব নয়, সেই আত্মা স্বরূপ শক্তি হলেন দেবী, ঐ দেবীর অপরাশক্তি মায়া নামে বিখ্যাত। অর্থাৎ শাক্তদের শাস্ত্রে শাক্তদেরই আরাধ্যা দেবী নিজেই নিজেকে ব্রহ্ম বলবার রহস্য উন্মোচন করেছেন।]
এবার দেখুন 👇
মহাভারতেও পরমেশ্বর মহাদেব দেবী পার্বতীকে বলছেন —
রূপং বিদ্ধি মহাভাগে ! প্রকৃতিস্ত্বং পরাে হ্যহম্ ॥৩৮
অহম বিষ্ণুরং ব্রহ্মা হ্যহম্ যজ্ঞস্তথৈব ।
আবয়োর্ন চ ভেদোঽস্তি পরমার্থস্ততোঽবলে ।
তথাপি বিদ্মস্তে ভেদং কিং মাং ত্বং পরিপৃচ্ছসি ॥৩৯ “
(সপ্তবিংশত্যাধিকদ্বিশততমোহধ্যায়ঃ, শান্তিপর্ব, মহাভারতম্)
অর্থ — মহাদেব দেবী পার্বতীকে বললেন- আমিই ব্রহ্ম(শিব), তুমিই ব্রহ্মশক্তি(পার্বতী) , আমিই ভােক্তা , তুমি ভােগ্যা । তুমি প্রকৃতি , আমিই পুরুষ ॥৩৮
আমিই বিষ্ণু, আমিই ব্রহ্মা এবং আমিই যজ্ঞ , ইহাই পরমার্থ যে তোমাতে(পার্বতী) আমাতে(শিব) কোনো ভেদ নেই। তথাপি আমরা জানি যে তোমাতে আমাতে পরস্পরের ভেদ আছে(ব্যবহারিক পর্যায়ে) ॥৩৯
অর্থাৎ, পরমার্থিক অবস্থায় শক্তি পরমশিবেই লীন হয়ে থাকে, তাই শক্তি অভিন্নভাবে শিবে থাকেন -এই পরমার্থিক দৃষ্টিতে শিবশক্তিতে ভেদ নেই, শিবের সহিত শক্তি অভিন্ন বা শক্তিকে ব্রহ্ম - এমনটা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু শিব সর্বদাই ব্রহ্ম, শক্তি তার প্রকাশ - সাক্ষাৎ ব্রহ্ম নন, এই কারণে মহাদেব বলছেন, শিব ও শক্তি ব্যবহারিক পর্যায়ের বিচারে ভিন্ন। শক্তি সাক্ষাৎ ব্রহ্ম নন, শক্তি শিবের সহিত অভিন্ন হবার দৃষ্টিকোনের কারণে শাস্ত্রে কখনো কখনো ব্রহ্মে বলে কথিত হন মাত্র, মূলত দেবী হলেন ব্রহ্মের শক্তি। তাই শাক্ত মতবাদে শক্তিই একমাত্র ব্রহ্ম -এমন সিদ্ধান্ত কখনোই শাস্ত্রসম্মত নয়, বরং সাক্ষাৎ দেবীভাগবতের বচনের বিপরীত হল এই অবার্চিন দাবী।
🔴 সিদ্ধান্ত — শাক্তগণ নিজেরাই নিজেদের আরাধ্যা দেবীর অবস্থান সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত নন, শাক্তদেরই শাস্ত্র দেবীভাগবত পুরাণ থেকে প্রমাণিত হল - দেবী কে ব্রহ্ম বলে সম্বোধন কারণ হল - দেবী হলেন ব্রহ্মের শক্তি, তিনি অভিন্ন অবস্থায় থাকেন বলে তাকে ব্রহ্ম বলা হয়, যেমন - কারোর নাম ধরে ডাকলে তার শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে আলাদা ভাবে ডাকতে হয় না, তেমন ভাবে দেবীকেও শিবের সহিত অভিন্ন - এই দৃষ্টিকোণে দেবীকেও ব্রহ্ম বলা হয়, কিন্তু তা বলে হস্ত মস্তিস্ক বলে গন্য হয় না, তেমন ভাবেই - শক্তি যেহেতু শিবের কার্যগত সত্তা, তাই শক্তিদেবী সাক্ষাৎ ব্রহ্ম নন।
ব্রহ্ম হলেন দেবীর স্বামী, আর দেবী হলেন সেই ব্রহ্মের শক্তি। আমাদের শৈব সিদ্ধান্ত সত্য প্রমাণিত হল।
________________________________________________
(৪) শাক্তদের শাস্ত্র কি শুধু দেবীর আরাধনা বা স্মরণ করার কথার নির্দেশ রয়েছে ?
✅ উত্তর — দেবীভাগবত পুরাণে শাক্তদের আরাধ্যা দেবী এই পরমাত্মা দেব ও দেবী উভয়ের শরণ নিতে বলেছেন ত্রিদেবকে —
ত্রিদেবের উদ্দেশ্যে সেই পরমাত্মার সম্পর্কে দেবী বললেন —
পরমাত্মা পুমানাদ্যো ন কার্যং ন চ কারণম ॥ ৭৭
স্মর্ত্তব্যাহং সদা দেবাঃ পরমাত্মা সনাতনঃ ।
উভয়োঃ স্মরণাদেব কার্যসিদ্ধিরসংশয়ম্ ॥ ৮০ ॥
[দেবীভাগবত পুরাণ/৩য় স্কন্ধ/৬ষ্ঠ অধ্যায়/৭৭, ৮০ নং শ্লোক]
অর্থ : আদি পুরুষ সনাতন পরমাত্মা কার্য নন আবার কারণও নন, এই প্রপঞ্চ সমুদয় মায়ারই কার্য মাত্র ॥ ৭৭
হে দেবগণ ! তোমরা সততই আমার এবং সনাতন পরমাত্মার স্মরণ কোরো, উভয়ের স্মরণ করলে কার্যসিদ্ধি বিষয়ে কিছুমাত্রই সন্দেহ থাকবে না ॥ ৮০
⬛আরো দেখুন 👇
ওমিত্যেবং ধ্যায়থাত্মানং স্বস্তি ।
বঃ পারায় তমসঃ পরস্তাৎ ॥ ৯ ॥
[দেবীভাগবত পুরাণ/৭ম স্কন্ধ/৩৬ অধ্যায়/৯ শ্লোক]
অর্থ : দেবগণ ! তোমরা ওমকার অবলম্বনপূর্বক সেই পরমাত্মার ধ্যান করো। তোমাদের কল্যাণ হোক, তাতে তোমরা অবিদ্যা-তামিশ্র সমুদ্রের পরপারে গমন করতে পারবে। অবিদ্যা-বিরহিত ব্রহ্মাত্মস্বরূপগমনে সমর্থ হতে পারবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই ॥ ৯ ॥
🔶দেবী সকল কে বলেছেন ॐ কার জপের দ্বারাই ব্রহ্ম কে লক্ষ্য বানাতে -
প্রণবো ধনুঃশরো হ্যাত্মা ব্রহ্ম তল্লক্ষ্যমুচ্যতে ।
অপ্রমত্তেন বেদ্ধব্যং শরবত্তন্ময়ো ভবেৎ ॥ ৬ ॥
[দেবীভাগবত পুরাণ/৭ম স্কন্ধ/৩৬ অধ্যায়/৬ শ্লোক]
অর্থ : (উদাহরণ দিয়ে বলছি) প্রণব (ॐ) -কে ধনুক, আত্মাকে বাণ বানিয়ে, ব্রহ্মকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে সেই লক্ষ্য কে ভেদ করা উচিত - আলস্য-প্রমাদ কে পরিত্যাগ করে । লক্ষ্যকে ভেদকারী বানের মতো সাধক ব্যক্তির উচিত পরমব্রহ্ম শিবে তন্ময় হয়ে লীন থাকা ॥ ৬ ॥
🔖নন্দীটীকা — রুদ্রহৃদয় উপনিষদের ৩৮ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে,
ধনুস্তারং শরো হ্যাত্মা ব্রহ্ম তল্লক্ষ্যমুচ্যতে ।
অপ্রমত্তেন বেদ্ধব্যং শরবত্তন্ময়ো ভবেৎ ॥ ৩৮ ॥
অর্থ : (উদাহরণ দিয়ে বলছি) প্রণব (ॐ) -কে ধনুক, আত্মাকে বাণ বানিয়ে, ব্রহ্মকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে সেই লক্ষ্য কে ভেদ করা উচিত - আলস্য-প্রমাদ কে পরিত্যাগ করে । লক্ষ্যকে ভেদকারী বানের মতো সাধক ব্যক্তির উচিত পরমব্রহ্ম শিবে তন্ময় হয়ে লীন থাকা ॥ ৬ ॥
________________________________________________
________________________________________________
(৫) শাক্তদের আরাধ্যা দেবী শক্তি যে পরমপুরুষের সহিত রমণ করে থাকেন, দেবী যে পরমাত্মাকে পরমপুরুষ বলে চিহ্নিত করেছেন, দেবী যে পরমপুরুষকে ব্রহ্ম ও নিজেকে তার শক্তি বলে চিহ্নিত করেছেন, যে পরমপুরুষ কে নিজের পূর্ববর্তী পুরুষ বলে ইঙ্গিত করেছিলেন, সেই দেবীর স্বামীর কে ?
তার নাম কি ?
✅ উত্তর —উপরোক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে দেবীভাগবত পুরাণ থেকে স্পষ্ট ভাবে স্বয়ং ত্রিদেবের জননী মণিদ্বীপবাসিনী ভগবতী দেবীর স্বামীর অস্তিত্ব রয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে, দেবী সেই পরমপুরুষ কে ব্রহ্ম এবং নিজেকে তার শক্তি বলে স্পষ্ট করে চিহ্নিতও করে দিয়েছেন। দেবী স্বয়ং নিজেই বলেছেন সকলকে সেই পরমাত্মার স্মরণ নেবার জন্য। চলুন এবার দেবীর সেই পরমপুরুষ পরমাত্মা স্বামীর নাম কি ? তা জেনে নেওয়া যাক স্বয়ং দেবীভাগবত পুরাণ থেকে, দেবীর নিজের মুখ থেকেই নিঃসৃত বচন থেকে -
প্রসঙ্গটি হল, মহিষাসুর দেবী দুর্গাকে বিবাহ করবার জন্য তাম্রের মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন, তখন তাম্রকে দেবী বললেন,
দেব্যুবাচ।
গচ্ছ তাম্র পতিং ব্ৰূহি মুমূর্ষুং মন্দচেতসম্ ।
মহিষং চাতিকামার্তং মূঢ়ং জ্ঞানবিবর্জিতম্ ॥ ২
যথা তে মহিষী মাতা প্রৌঢ়া যবসভক্ষিণী ।
নাহং তথা শৃঙ্গবতী লম্বপুচ্ছা মহোদরী ॥ ৩
ন কাময়েঽহং দেবেশং নৈব বিষ্ণুং ন শঙ্করম্ ।
ধনদং বরুণং নৈব ব্রহ্মাণং ন চ পাবকম্ ॥ ৪
এতান্ দেবগণাণাহিত্বা পশুং কেন গুণেন বৈ।
বৃণোম্যহং বৃথা লোকে গর্হণা মে ভবেদিতি ॥ ৫
নাহং পতিংবরা নারী বর্ততে মে পতিঃ প্রভুঃ।
সর্বকর্তা সর্বসাক্ষী হ্যকর্তা নিঃস্পৃহঃ স্থিরঃ ॥ ৬
নির্গুণো নির্মমোঽনন্তো নিরালম্বো নিরাশ্রয়ঃ।
সর্বজ্ঞঃ সর্বগঃ সাক্ষী পূর্ণঃ পূর্ণাশয়ঃ শিবঃ ॥ ৭
সর্বাবাসক্ষমঃ শান্তঃ সর্বদৃক্ সর্বভাবনঃ।
তং ত্যক্ত্বা মহিষং মন্দং কথং সেবিতুমুৎসহে ॥ ৮
[দেবীভাগবত পুরাণ/৫ম স্কন্ধ/১২ অধ্যায়/২-৮ নং শ্লোক]
অর্থ : দেবী বললেন, হে তাম্র! তুমি তোমার প্রভু মহিষের কাছে যাও এবং সেই মৃত্যুর জন্য উদ্যত, মন্দবুদ্ধি, অতিমাত্রায় কামাতুর ও জ্ঞানশূন্য সেই মূর্খকে গিয়ে বলো — যেমন তোমার মাতা মহিষী ঘাসখেকো, প্রৌঢ়া, বিশাল শৃঙ্গযুক্ত, লম্বা লেজওয়ালা এবং বৃহৎ উদরবিশিষ্ট, আমি তেমন নই ॥ ২-৩ ॥
আমি না দেবরাজ ইন্দ্রকে চাই, না বিষ্ণুকে, না সংহার কর্তা শঙ্কর, না কুবেরকে, না বরুণকে, না ব্রহ্মাকে, এমনকি অগ্নিদেবকেও আমি চাই না। যখন আমি এই দেবতাদেরই উপেক্ষা করেছি, তখন এক পশুকে কোন গুণে আমি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বরণ করবো ? এতে তো জগতে আমারই নিন্দা হবে ! ॥ ৪-৫ ॥
আমি এমন কোনো সাধারণ নারী নই, যে স্বামী বেছে নেবো। আমার পতিদেব হলেন (স্বামী) স্বয়ং পরম প্রভু, তিনি সকল কার্যের কর্তা, সকল কিছুর সাক্ষী, তবু কিছুই করেন না অর্থাৎ অকর্তা ; তিনি ইচ্ছাহীন, চিরন্তন, নির্গুণ (সকল গুণের প্রভাব থেকে মুক্ত), মোহহীন, অনন্ত, নিরালম্ব, আশ্রয়হীন (তার আশ্রয়দাতা অন্য আর কেউ নেই), সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী, সাক্ষী, পূর্ণ, পূর্ণ-আশয়যুক্ত পরমেশ্বর শিব ॥ ৬-৭
তিনি সকলকে আশ্রয় দিতে সক্ষম, তিনি শান্ত, সকলকেই দর্শনকারী এবং সকলের ভাবনা সম্পর্কে জ্ঞাত তিনি। এমন সেই প্রভু শিবকে ছেড়ে আমি কেন ঐ মূর্খ মহিষকে আমার স্বামী করতে চাইবো ? ॥ ৮ ॥
[বিশ্লেষণ : দেবীভাগবত পুরাণে শাক্তদের দেবী স্বয়ং বলেছেন, দেবীর স্বামী হলেন সেই প্রভু শিব, যে শিব নির্গুণ, যে শিবের অন্য কেউ আশ্রয় দাতা, যিনি স্থির শান্ত, যিনি স্বয়ং সম্পূর্ণ, যিনি সর্বজ্ঞ, যিনি ত্রিদেবের মধ্যে থাকা সংহার কর্তা শঙ্কর নন। বরং ত্রিদেবের পিতা শিব হলেন ঐ শাক্তদের উপাসিতা দেবীর স্বামী। এই শিব নির্গুণ হবার কারণে এনার জন্মও সম্ভব নয়, ত্রিদেবের মধ্যে থাকা সংহার কর্তা রুদ্রের উৎপত্তি লীলাবশত দেবী ও সদাশিবের মাধ্যমে হতে পরে, কিন্তু দেবী থেকে সাক্ষাৎ শিবের জন্ম হয় না, বেদও বলেছে শিব অজন্মা, অর্থাৎ শিবের জন্ম নেই।]
✅দেবীভাগবত পুরাণের ন্যায় একই কথা শিবপুরাণেও বলা হয়েছে -
প্রসঙ্গ : শুম্ভ দেবীকে বিবাহ করবার জন্য যখন প্রস্তাব পাঠিয়েছিল তখন দেবী বললেন -
দেব্যুবাচ ।
অদ্বিতীয়ো মহেশানঃ পরব্রহ্ম সদাশিবঃ ।
তত্ত্বং ন বিদুর্বেদা বিষ্ণ্বাদীনাং চ কা কথা ॥ ৫৯ ॥
তস্যাহং প্রকৃতিঃ সূক্ষ্মা কথমন্যং পতিং বৃণে ।
সিংহী কামাতুরা নৈব জাম্বুকং বৃণুতে ক্বচিৎ ॥ ৬০ ॥
[শিবমহাপুরাণ/উমা সংহিতা/৪৭ অধ্যায়/৫৯-৬০ নং শ্লোক]
অর্থ : দেবী বললেন — মহেশ অদ্বিতীয় পরব্রহ্ম সদাশিব, তাঁর প্রকৃত তত্ত্বটি ঠিক করে বেদও জানেন না, তাহলে বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতারাই বা কীভাবে জানবে! ? ॥ ৫৯ ॥
আমি তো তাঁরই সূক্ষ্ম প্রকৃতি — আমার সেই স্বামী কে ছেড়ে অন্য কাউকে গ্রহণ করবো কীভাবে ?
যেমন এক সিংহী কামাচ্ছন্ন হলেও কখনও শিয়ালকে স্বামীরূপে গ্রহণ করে না। ॥৬০॥
শিব যে পরমাত্মা পরমপুরুষ তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু শাক্তরা বলবেন যে শিব তো শক্তি থেকেই জন্ম নেয়, তাই আমি দেবীর বচন থেকেই প্রমাণ করছি, পরমাত্মা শিবের কোনো জন্ম নেই, তিনি অজন্মা। দেখুন দেবী স্বয়ং বলছেন -
পরমাত্মার জন্ম মৃত্যু নেই —
ন জায়তে ম্রিয়তে তৎকদাচিন্নায়ং ভূত্বা ন বভুব কশ্চিৎ ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ॥ ৩২॥
[দেবীভাগবত পুরাণ/৭ম স্কন্ধ/৩৪ অধ্যায়/৩২ নং শ্লোক]
অর্থ : এই পরব্রহ্মরূপ পরমাত্মার কখনও জন্ম বা মরণ হয় না, এবং ইনি জন্ম হয়ে বিদ্যমান থাকেন না, কিন্তু উৎপন্ন না হয়ে নিরন্তর বিদ্যমান আছেন। কারণ ইনি অজ, নিত্য, সনাতন ও পুরাতন এবং জীবের পাঞ্চভৌতিক শরীর বিনষ্ট হলেও ইনি কদাচই বিনষ্ট হন না ॥ ৩২
আরো দেখুন -
শাক্ত দের আরাধ্যা এই দেবী ভুবনেশ্বরীর স্বামী হলেন শিব, দেবী হলেন শিবের প্রিয়া অর্থাৎ পত্নি। দেখুন প্রমাণ -
[দেবীভাগবত পুরাণ/৯ম স্কন্ধ/১ অধ্যায়/১৪ শ্লোক]
অর্থ : এই দেবী ভুবনেশ্বরী গণেশের জননী, দুর্গা, শিবের পত্নী ও শিবেরই রূপ হওয়ায় শিবরূপা বলে বিখ্যাত — সেই দেবীই বিষ্ণুকে মায়ায় আবদ্ধকারী, সকল নরের আশ্রয়দায়িনী নারায়ণী এবং পূর্ণব্রহ্ম-স্বরূপা। ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবতা, মুনি ও মনুগণ সকলেই তাঁর পূজা ও স্তব করেন। তিনি সকলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, অনাদি-সনাতনী এবং শিব-স্বরূপা।
🔴 সিদ্ধান্ত — শাক্তগণ নিজেরাই নিজেদের দেবীভাগবত পুরাণ তথা শাক্ত শাস্ত্র সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত নন, শাক্তদেরই শাস্ত্র দেবীভাগবত পুরাণ থেকে প্রমাণিত হল - দেবীর স্বামী হলেন - ব্রহ্ম, সেই ব্রহ্মের নাম শিব, তার সাথে শিব মহাপুরাণের বচনও মিলে গিয়েছে।
অর্থাৎ, দেবী ভাগবত পুরানেও শিবই ব্রহ্ম বলে স্বীকৃত, শৈবদের সিদ্ধান্ত প্রমাণিত হল শাক্তদের মান্য শাস্ত্র দেবীভাগবত থেকে।
________________________________________________
________________________________________________
(৫) শাক্তদের আরাধ্যা শক্তি দেবী ভুবনেশ্বরীর দেবীলোক
মণিদ্বীপ কি শিবলোকের থেকে ভিন্ন ?
✅ উত্তর — উপরোক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে দেবীভাগবত পুরাণ থেকে প্রথমেই প্রমাণিত হয়েছে যে, দেবী নিজের দেবীলোকে পরমপুরুষ শিবের সহিত রমণ করতে থেকে অবস্থান করেন। সুতরাং, দেবীর সহিত শিবও থাকেন সেখানে - এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এবার দেখুন,
শাক্তদের আরাধ্যা দেবী ভগবতী ভুবনেশ্বরী যে দেবীলোকে থাকনে, তা মণিদ্বীপ নামে বিখ্যাত, কিন্তু সেই দ্বীপের আরও একটি নাম হল ‘শিবদ্বীপ’ - একথা বলছে স্বয়ং দেবীভাগবত পুরাণ —
(ঘটনা প্রসঙ্গ : নারদের কাছে ব্রহ্মা দেবীলোক দর্শনের বিবরণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ত্রিদেব (ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও সংহার কর্তা রুদ্রদেব) - এক সাথে একটি উড়ন্ত বিমানে চড়ে দেবীলোক দর্শনের জন্য অগ্রসর হয়েছিলেন, দেবীলোকে পৌঁছে তারা বিভিন্ন বিস্ময়কর ঘটনা দেখলেন, নিজেদের মতোই অসংখ্য ত্রিদেবকে দেখতে পেলেন, তারপর তারা সাক্ষাৎ দেবীকে দর্শন করলেন এবং দেবীর ঐ মণিদ্বীপকে শিবদ্বীপ বলেও সম্বোধন করেছেন স্বয়ং ব্রহ্মা ! । প্রমাণ দেখুন 👇
শৃণু নারদ! বক্ষ্যামি যদ্দষ্টং তত্র চাদ্ভুতম্।
নখদর্পণমধ্যে বৈ দেব্যাশ্চরণপঙ্কজে ॥ ১৪ ॥
ব্রহ্মাণ্ডমখিলং সৰ্ব্বং তত্র স্থাবরজঙ্গমম্।
অহং বিষ্ণুশ্চ রুদ্রশ বায়ুরগ্রির্যমো রবিঃ ॥ ১৫ ॥
বরুণঃ শীতগুত্ত্বষ্টা কুবেরঃ পাকশাসনঃ।
পর্ব্বতাঃ সাগরা নদ্যো গন্ধর্ব্বাপ্সরসস্তথা ॥ ১৬ ॥
বিশ্বাবসুশ্চিত্রকেতুঃ শ্বেতশ্চিত্রাঙ্গদস্তথা।
নারদস্তুম্বরুশ্চৈব হাহাহুহুস্তথৈব চ ৷ ১৭ ॥
অশ্বিনৌ বসবঃ সাধ্যাঃ সিদ্ধাশ্চ পিতরস্তথা।
নাগাঃ শেষাদয়ঃ সর্ব্বে কিন্নরোরগরাক্ষসাঃ ॥ ১৮ ॥
বৈকুণ্ঠো ব্রহ্মলোকশ্চ কৈলাসঃ পর্ব্বতোত্তমঃ।
সর্বং তদখিলং দৃষ্টং নখমধ্যস্থিতঞ্চন ॥ ১৯ ॥
মজ্জন্মপঙ্কজং তত্র স্থিতোহহং চতুরাননঃ।
শেষশায়ী জগন্নাথস্তথাচ মধুকৈটভৌ ॥ ২০ ॥
শ্রীভগবানুবাচ।
এবং দৃষ্টং ময়া তত্র পাদপদ্মনখে স্থিতম্।
বিস্মিতোহহং ততো বীক্ষ্য কিমেতদিতিশঙ্কিতঃ ॥ ২১ ॥
বিষ্ণুশ বিস্ময়াবিষ্টঃ শঙ্করশ্চ তথাস্থিতঃ।
তাং তদা মেনিরে দেবীং বয়ং বিশ্বস্য মাতরম্ ॥ ২২ ॥
ততো বর্ষশতং পূর্ণং ব্যতিক্রান্তং প্রপশ্যতঃ!
সুধাময়ে শিবে দ্বীপে বিহারং বিবিধং তদা ॥ ২৩ ॥
সখ্য ইব তদা তত্র মেনিরেহস্মানবস্থিতান্।
দেব্যঃ প্রমুদিতাকারা নানাভরণমণ্ডিতাঃ ॥ ২৪ ॥
[দেবীভাগবত পুরাণ/৩য় স্কন্ধ/৪র্থ অধ্যায়/১৪-২৪ নং শ্লোক]
অর্থ : হে নারদ! সে স্থানে আর একটা যে অদ্ভুত ব্যাপার দেখেছিলাম সেটিও বলছি শ্রবণ করো, সেই সকল দেব কন্যাগণের নৃত্যগানাদি দেখতে দেখতে সহসা মহাদেবী ভগবতীর চরণপঙ্কজের দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখি যে, সেখানে তার নখের মধ্যে যেন দর্পণ রয়েছে আর তার মধ্যে স্থাবর-জঙ্গমময় অখিল ব্রহ্মাণ্ড দেদীপ্যমান রূপে বিরাজিত রয়েছে; অর্থাৎ বন, ভূমি, পর্ব্বত, নদ, নদী ও সাগর প্রভৃতি স্থাবর বস্তু সকল এবং সূর্য্য, চন্দ্র, বায়ু, বরুণ, অগ্নি, যম, কুবের, প্রজাপতি দ্বষ্টা ও মহেন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ; অধিক কি আমি, বিষ্ণু ও রুদ্রদেব পর্যন্তও পরিলক্ষিত হতে লাগল। তারপর আবার দেখি যে, গন্ধর্ব ও অপ্সরাবৃন্দ প্রভৃতি উপদেবদেবগণ এবং গন্ধর্ব প্রধান বিশ্বাবসু, চিত্রকেতু, চিত্রাঙ্গদ, শ্বেত, নারদ, তুম্বুরু ও হাহাহূহূও বিরাজ করছেন। অপরদিকে স্বর্বৈদ্য অশ্বিনীকুমারদ্বয়, অষ্টবসু, সাধ্যগণ, সিদ্ধগণ, পিতৃগণ, অনন্তাদি নাগগণ এবং কিন্নর, উরগ ও রাক্ষসগণ পর্য্যন্তও যথানিয়মে অবস্থিত রয়েছে ॥১৪-১৮ ॥
এই সমস্ত দৃশ্য দর্শনের পর, দেখলাম যে, ঊর্দ্ধভাগে বৈকুণ্ঠধাম, ব্রহ্মলোক ও পরম পূজনীয় কৈলাস পর্বত নিত্যরূপে বিরাজ রয়েছে ; ফলকথা এই যে, একমাত্র সেই চরণপঙ্কজস্থ নখদর্পণের মধ্যেই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত বস্তুই দর্শন হয়ে গেল ॥ ১৯
এমন কি, সেখানে অনন্ত শয্যায় শায়িত থাকা জগৎপতি ভগবান্ বিষ্ণু এবং তাঁহার নাভিদেশে আমার (ব্রহ্মার) জন্মভূমিরূপ সেই পদ্ম দেখতে পেলাম ; তার মধ্যে আমিও এইরূপ চতুর্মুখে পরিশোভিত হইয়া উপবিষ্ট হয়ে রয়েছি। এরপরে দেখি যে, আবার আমার বিরোধী দানবপ্রধান মধুকৈটভও যুদ্ধলালসায় আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে ॥ ২০ ॥
লোকপিতামহ ভগবান্ বললেন, সেই সময়ে আমি সেই মহাদেবী ভগবতীর চরণপঙ্কজস্থ নখরশুধাংসু মধ্যে যে এই সমস্ত অদ্ভুত ব্যাপার সন্দর্শন করেছিলাম, তাতে আর কোনো সংশয় হয়নি ; পরন্তু সেই সকল ব্রহ্মাণ্ডের ব্যাপার দেখিয়া একেবারে বিস্মিত হইয়া সশঙ্কচিত্তে ভাবিলাম যে, এ আবার কি ?॥ ২১
রে বৎস! কেবল আমিই নই, আমার সাথে থাকা ভগবান্ বিষ্ণু এবং সংহারকর্তা শঙ্কর পর্যন্তও বিস্ময়ের সাগরে যেন নিমগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন ; ফলে, তখন আমরা তিনজনেই তাঁকে বিশ্বসংসারের জননী বলেই বুঝতে পেরেছিলাম ॥২২
তখন, এইরূপে সেই সুধাময় শিবদ্বীপে মহাদেবীর নানাবিধ লীলা বিহারাদি দেখতে দেখতে আমাদের পূর্ণ শত বছর অতিবাহিত হয়ে গেল ॥ ২৩
কিন্তু, যতদিন আমরা সেই স্থলে অবস্থান করেছিলাম, সেই সময় সেখানে সেই মহাদেবীর সহচরী বিচিত্র বসন আবরণে পরিশোভিত মূর্তিমতী প্রমোদরূপিণী দিব্যাঙ্গনারীগণ আমাদের ত্রিদেব কে নিজের সখি বলেই মনে করতেন ॥ ২৪
[বিশ্লেষণ : শাক্তদের শাস্ত্র দেবীভাগবত পুরাণেই, মণিদ্বীপ শিবদ্বীপ নামে চিহ্নিত হয়েছে। অর্থাৎ, শৈবদের সিদ্ধান্ত অনুসারেই দেবীভাগবত পুরাণ বর্ণিত আছে, এইখানে আলাদা করে কোথাও শাক্তদের জন্য আলাদা শাক্তসিদ্ধান্ত উৎপত্তি হবার নামগন্ধও নেই। আমরা শৈব রা বলেছিলাম, ত্রিদেব জনক সদাশিব ও ত্রিদেব জননী দেবী হলেন শিবলোকবাসী, এই দেবী শিবলোকেই শিব দ্বারা প্রদান করা মণিদ্বীপে অবস্থান করেন, তাই মনিদ্বীপ শিবলোকের থেকে আলাদা কিছু নয়। কিন্তু শাক্তরা এটি মানতে নারাজ, কিন্তু শাক্তদের শাস্ত্র থেকেই প্রকৃত সত্য বের হয়ে এল, আর শৈবদের সিদ্ধান্তকেই শাক্তদের মান্য শাস্ত্র দেবীভাগবত পুরাণ পূর্ণ মান্যতা দিয়ে রেখেছে, তা প্রমাণিত হল। সুতরাং, শাক্ত মতবাদ বলে কিছুই হয় না, শাক্ত সিদ্ধান্ত বলেও কিছু হয় না। প্রাচীন কালে শৈবদেরই কিছু অংশ শক্তির উপাসনা কে প্রাধান্যতা দিয়ে উপাসনা করতে করতে কালক্রমে শাক্তমতবাদ সম্প্রদায় নামক নূতন পথের সূচনা ঘটিয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র সসম্প্রদায় বলে দাবী করছে মাত্র, কিন্তু যেখানে তাদের মান্য শাস্ত্র গুলিই তাদের মতবাদ খণ্ডন করে দিয়ে বসে আছে, সেখানে এই সব নব্য শাক্ত মতবাদের কোন গ্রহণযোগ্যতাই নেই। সনাতন ধর্মে বিভাজন ঘটিয়ে এই সকল সম্প্রদায় গুলিই আজ বহু মতপথ তৈরীর জন্য দায়ী। নিজস্বতা দেখাবার জন্য প্রকৃত পরমেশ্বর শিবকে সরিয়ে তার জায়গায় শক্তিকে ব্রহ্ম বানিয়ে নতুন মতবাদ সৃষ্টি করবার প্রয়াসকারী এই নব্য শাক্তগণ সনাতন ধর্মে একটি সিদ্ধান্তকে একাধিক বানিয়েছে, ফলে এই অপসম্প্রদায় গুলির অনুসারীও বেড়েছে, আর শৈবদের সাথে সিদ্ধান্তগত পার্থক্য তৈরী হয়েছে, যেখানে শাক্তদের সিদ্ধান্ত শাক্তদের শাস্ত্রেই অনুপস্থিত, বরং শৈবদের সিদ্ধান্ত কে সমর্থন করে হয়েছে শক্তি বিষয়ক পুরাণ ইত্যাদিতে।]
🔴 সিদ্ধান্ত — শাক্তগণ নিজেরাই নিজেদের দেবীভাগবত পুরাণ তথা শাক্ত শাস্ত্র সম্পর্কে অবগত না থাকবার কারণে বিভ্রান্তিতে রয়েছেন। দেবী সর্বদাই শিবের সহিতই বসবাস করেন। তাই দেবীলোক একাধারে শিবলোকই বটে। অর্থাৎ, শৈবদের সিদ্ধান্ত এইখানেও সত্য ও প্রামাণিক বলেই গন্য হল।
________________________________________________
________________________________________________
(৬) দেবী ভাগবত পুরাণে উল্লেখিত শাক্তদের আরাধ্যা শক্তি দেবী ভুবনেশ্বরীর সহিত শিবমহাপুরাণের শিবের কোনো মিল আছে ?
✅ উত্তর — হ্যা অবশ্যই আছে, শ্রীবিষ্ণু মণিদ্বীপে পৌছে দেবীর স্তুতি করে দেবীকে পঞ্চকৃত্যকারিনী ভুবনেশ্বরী বলে সম্বোধন করেছেন, বলছে দেবী ভাগবত পুরাণ —
একদাং তাং মহাদেবীং দেবীং শ্রীভুবনেশ্বরীম্ ।
তুষ্টাব ভগবান্বিষ্ণুর্যুবতীভাবসংস্থিতঃ ॥ ২৬
শ্রীভগবানুবাচ ।
সচ্চিদানন্দরূপিণ্যৈ সংসারারণয়ে নমঃ ।
পঞ্চকৃত্যবিধাত্র্যৈ তে ভুবনেশ্যৈ নমো নমঃ ॥ ২৮
[দেবীভাগবত পুরাণ/৩য় স্কন্ধ/৪র্থ অধ্যায়/২৬,২৮ নং শ্লোক]
অর্থ : একবার নারীরূপে পরিবর্তিত হয়ে গিয়ে শ্রীবিষ্ণু মহাদেবী ভগবতী শ্রীভুবনেশ্বরী দেবীর স্তুতি করতে লাগলেন — ॥ ২৬
শ্রীভগবান বিষ্ণু বললেন, সচ্চিদানন্দরূপিণী তথা সংসারের যোনিস্বরূপা দেবীকে নমস্কার। আপনি পঞ্চকৃত্যকারিনী বিধাত্রী, হে শ্রী ভুবনেশ্বরী দেবী আপনাকে নমস্কার ॥ ২৮
একই ভাবে পরমশিবের সাকার রূপ যিনি, সেই শিবলোকবাসী সদাশিবকে পঞ্চকৃত্যকারী বলা হয়েছে।
প্রমাণ দেখুন,
নমো নিষ্কলরূপায় নমো নিষ্কলতেজসে ।
নমঃ সকলনাথায় নমস্তে সকলাত্মনে ॥ ২৮
নমঃ প্রণববাচ্যায় নমঃ প্রণবলিঙ্গিনে ।
নমঃ সৃষ্ট্যাদিকর্ত্রে চ নমঃ পঞ্চমুখায় তে ॥ ২৯
পঞ্চব্রহ্মস্বরূপায় পঞ্চকৃত্যায় তে নমঃ ।
আত্মনে ব্রহ্মণে তুভ্যমনন্তগুণশক্তয়ে ৷৷ ৩০
সকলাকলরূপায় শম্ভবে গুরবে নমঃ ।..॥ ৩১
[শিবমহাপুরাণ/বিদ্যেশ্বর সংহিতা/১০ অধ্যায়/২৮-৩১ নং শ্লোক]
অর্থ : হে প্রভু শিব ! আপনি নিষ্কলরূপ, আপনাকে নমস্কার করি, আপনি নিষ্কলতেজ রূপে বর্তমান, আপনাকে নমস্কার করি। আপনি সকলের নাথ (স্বামী) আপনাকে নমস্কার করি, আপনি সকলের মধ্যে থাকা আত্মা, আপনাকে নমস্কার করি। প্রণবের বাচ্য একমাত্র আপনি, আপনাকে নমস্কার করি, প্রণবলিঙ্গ স্বরূপ আপনাকে নমস্কার করি। সৃষ্টিকর্তারূপ আপনাকে নমস্কার করি, পাঁচমুখধারী প্রভু আপনাকে নমস্কার করি। পাঁচমুখধারী আপনি পঞ্চব্রহ্মস্বরূপে পাঁচটি কৃত্য (সৃষ্টি, পালন, সংহার, তিরোভাব ও অনুগ্রহ কার্য) কারী আপনাকে নমস্কার করি । আপনি আত্মা তথা ব্রহ্ম, আপনার অনন্ত গুণ ও সমস্ত শক্তি আপনার । সকল ও নিষ্কলরূপ প্রভু শম্ভু, হে গুরুদেব আপনাকে নমস্কার করি ।
🔴 সিদ্ধান্ত — শাক্তদের মান্য দেবীভাগবত পুরাণ ও শৈবদের মান্য শাস্ত্র শিবমহাপুরাণ অনুসারে শিব পঞ্চকৃত্যকারী ও শিবের পত্নি শক্তি দেবী পঞ্চকৃত্যকারিনী । অর্থাৎ, শাক্তদের শাস্ত্রের দেবী ও শিব আলাদা আর শৈবদের শাস্ত্রের শিব ও দেবী আলাদা -এমন ভাবনা করবার কোনো কারণ নেই, শৈবদের শাস্ত্র ও শাক্তদের মান্য করা শাস্ত্রের শিব ও দেবী একই।
________________________________________________
________________________________________________
শিবের পত্নী দেবীকে শিবা বলা হয় —
জ্ঞান দায়িনী শিবা
মণিদ্বীপবাসিনী দেবীকে ভগবান শ্রীবিষ্ণু অম্বিকা ও শিবা বলে সম্বোধন করেছেন —
ত্রাতা ত্বমেব মম মোহময়াদ্ভবাব্ধেস্ত্বাং অম্বিকে সততমেতি মহার্তিহ চ ।..॥ ৪৮
নমো দেবী মহাবিদ্যে নমামি চরণৌ তব ।
সদা জ্ঞানপ্রকাশং মে দেহি সর্বার্থদে শিবে ॥ ৪৯
[দেবীভাগবত পুরাণ/৩য় স্কন্ধ/৪ম অধ্যায়/৪৮-৪৯ নং শ্লোক]
অর্থ : হে অম্বিকে ! আপনিই আমাকে এই মোহময় ভবসাগর হতে আমাকে রক্ষা করতে পারেন ।..॥ ৪৮
হে দেবী ! আপনাকে নমস্কার ! হে মহাবিদ্যা ! আমি আপনার চরণে নতমস্তক হয়ে প্রণাম করছি। হে সর্বার্থদাত্রী শিবে ! আপনি জ্ঞানরূপী প্রকাশের দ্বারা আমার হৃদয়কে আলোকিত করুন ॥ ৪৯
[বিশ্লেষণ : ৪৯ নং শ্লোকে "সদা জ্ঞানপ্রকাশং" পদে দেবীকে জ্ঞানদায়িনী শিবা বলা হয়েছে, অর্থাৎ দেবী হলে ব্রহ্মবিদ্যা, তিনি ব্রহ্মজ্ঞান দিয়ে শিব লাভ করিয়ে দেন।]
♦️ দেবাতারা দেবী দুর্গার প্রকট হবার সময় সর্বপ্রথম ও শেষে যে নামে সম্বোধন করে স্তুতি করেন তা হল — ‘শিবা’ নাম।
প্রমাণ 👇
দেবা উচুঃ ।
নমঃ শিবায়ৈ কল্যাণ্যৈ শান্ত্যৈ পুষ্ট্যৈ নমো নমঃ ।
ভগবত্যৈ নমো দেব্যৈ রুদ্রাণ্যৈ সততং নমঃ ॥ ২৩
মায়য়াং যা স্থিতা জ্ঞাতা মায়য়া ন চ তামজাম্ ।
অন্তঃস্থিতা প্রেরয়তি প্রেরয়িত্রীং নুমঃ শিবাম্ ॥ ২৬
[দেবীভাগবত পুরাণ/৫ম স্কন্ধ/৯ম অধ্যায়/১১ নং শ্লোক]
অর্থ : শিবাকে নমস্কার, কল্যাণী, শান্তি ও পুষ্টি দেবীকে বারংবার নমস্কার । ভগবতীকে নমস্কার, দেবী রুদ্রানী কে নিরন্তর নমস্কার ॥ ২৩
যিনি মায়ার মধ্যে স্থিত থেকেও মায়ার দ্বারা জ্ঞাত নন, যিনি মায়ার মধ্যেই বিরাজমান হয়ে মায়াকেই প্রেরণা প্রদান করেন, জন্মরহিত তথা প্রেরণাদায়িনী ভগবতী শিবাকে আমি নমস্কার করি ॥ ২৬
[বিশ্লেষণ : ২৩ নং শ্লোকে দেবতারা "নমঃ শিবায়ৈ" পদ উল্লেখ করে দেবীকে নমস্কার করেছেন । শিব মহাপুরাণের বায়বীয় সংহিতার উত্তর খণ্ডের ১৩ অধ্যায়ের ৫৪ নং শ্লোকে পরমেশ্বর শিব বলেছেন শিবের "নমঃ শিবায়" -এই মহামন্ত্রের মতো এই "নমঃ শিবায়ৈ" মন্ত্রটিই দেবীর মূল মহামন্ত্র।]
🔴 সিদ্ধান্ত — পরমেশ্বর শিবের মতোই শিবের শক্তি দেবীর নাম, স্থান, মন্ত্র, রূপ সকলকিছুই শিবসম্পর্কিত ।
________________________________________________
(৭) শাক্তরা বলেন, ত্রিদেব কে শাক্তদের আরাধ্যা দেবী জন্ম দিয়েছেন, তবে কি ত্রিদেব কে শুধুমাত্র দেবী উৎপন্ন করেছেন ?
✅ উত্তর — না, ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র - এই তিন দেবতা শুধুমাত্র দেবী থেকে উৎপন্ন হয়েছে - এই কথা সম্পূর্ণভাবে সত্য নয়। শাস্ত্রে ত্রিদেবের উৎপত্তি দেবীর থেকে হবার কারণে, দেবীকে ত্রিদেবের জননী বলা হয়েছে । আবার শাস্ত্রে, পরমেশ্বর সদাশিব থেকে ত্রিদেবের উৎপত্তি হয়েছে এই কথাও শাস্ত্রে বলা হয়েছে।
চলুন শাস্ত্র থেকে প্রমাণ দেখে নেওয়া যাক,
♦️ শ্রীবিষ্ণু বলছেন, ত্রিদেব দেবী থেকে উৎপন্ন হয়ে থাকেন, দেবী হলেন পরাপ্রকৃতি রূপা —
ব্রহ্মাহমীশ্বরবরঃ কিল তে প্রভাবাৎ
সর্বে বয়ং জনিযুতা ন যদা তু নিত্যাঃ।
কেঽন্যে সুরাঃ শতমখপ্রমুখাশ্চ নিত্যা
নিত্যা ত্বমেব জননী প্রকৃতিঃ পুরাণা ॥ ৪২
[দেবীভাগবত পুরাণ/৩য় স্কন্ধ/৪র্থ অধ্যায়/৪২ নং শ্লোক]
অর্থ : ব্রহ্মা, আমি (বিষ্ণু) এবং শঙ্কর (সংহার কর্তা) — আমরা সকলেই আপনার প্রভাব থেকেই উৎপন্ন।
যখন আমরাই চিরস্থায়ী নই, তখন ইন্দ্র প্রভৃতি অন্য দেবতারা কীভাবে চিরন্তন হতে পারে?
সমস্ত চরাচর জগতের জননী তথা নিত্যা প্রকৃতিরূপে আপনিই একমাত্র চিরন্তন ॥ ৪২ ॥
♦️ এবার দেখুন, ত্রিদেব উৎপন্ন হয়েছেন সদাশিব থেকে —
পুরা যদা শিবো দেবো নির্গুণো নির্বিকল্পকঃ ।
অরূপঃ শক্তিরহিতশ্চিন্মাত্রঃ সদসৎপরঃ ॥ ১২ ॥
অভবৎসগুণঃ সোঽপি দ্বিরূপঃ শক্তিমান্প্রভুঃ ।
সোমো দিব্যাকৃতির্বিপ্র নির্বিকারী পরাৎপরঃ ॥ ১৩ ॥
তস্য বামাঙ্গজো বিষ্ণুর্ব্রহ্মাহং দক্ষিণাঙ্গজঃ ।
রুদ্রো হৃদয়তো জাতোঽভবচ্চ মুনিসত্তম ॥ ১৪ ॥
সৃষ্টিকর্তাভবং ব্রহ্মা বিষ্ণুঃ পালনকারকঃ ।
লয়কর্তা স্বয়ং রুদ্রস্ত্রিধাভূতঃ সদাশিবঃ ॥ ১৫ ॥
[শিব মহাপুরাণ/রুদ্র সংহিতা/সতী খণ্ড/২য় অধ্যায়/১২-১৫ নং শ্লোক]
অর্থ : সবকিছুর পূর্বে পরমদেব পরমশিব নির্গুণ, নির্বিকল্প, নিরাকার, শক্তিরহিত (শক্তির দ্বৈতভাবের প্রকাশহীন অবস্থা), চিন্ময় এবং সৎ ও অসৎ -এর ঊর্ধে স্থিত স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তারপর সেই প্রভুই সগুণ এবং শক্তিমান হয়ে বিশিষ্ট রূপ ধারণ করে স্থিত হন এবং তাঁর সঙ্গে ভগবতী উমাও বিরাজ করছিলেন। হে বিপ্রবর! পরমেশ্বর শিব দিব্য আকৃতিতে সুশোভিত ছিলেন। তাঁর মনে কোনো বিকার ছিল না। তিনি তাঁর পরাৎপর স্বরূপে (সদাশিব হিসেবে) প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
মুনিশ্রেষ্ঠ! তাঁর (সদাশিবের) বাম অঙ্গ থেকে ভগবান বিষ্ণু, দক্ষিণ অঙ্গ থেকে আমি ব্রহ্মা এবং মধ্য-অঙ্গ অর্থাৎ হৃদয়(বা পৃষ্টদেশ) থেকে রুদ্রদেব প্রকটিত হয়েছেন। আমি ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা; ভগবান বিষ্ণু জগৎ পালনকারী; স্বয়ং রুদ্র সংহার কর্তা। এইভাবে পরমেশ্বর সদাশিব স্বয়ংই নিজেকে (শক্তির মাধ্যমে) বিভক্ত করে তিনটিরূপ ধারণ করে অবস্থিত ॥ ১২-১৫
আবার দেখুন, দেবীভাগবতেই বলা হয়েছে শিব হল বিষ্ণুর জন্মদাতা -
স হি সর্ব্বেশ্বরো দেবো বিষ্ণোরপি চ কারণম্।
সুষুপ্তস্থাননাথঃ স বিষ্ণুনা চ প্রপূজিতঃ ॥ ২১ ॥
(দেবীভাগবত/৫ম স্কন্ধ/১ম অধ্যায়/২০- নং শ্লোক)
অর্থ : সুষুপ্তির আধারভূত যে কারণ শরীর, সর্বেশ্বর শিব সেই কারণ দেহের অধিষ্টাতা স্বরূপ, সুতরাং তিনি বিষ্ণুরও জনক (পিতা) ; অতএব স্বয়ং বিষ্ণুর সেই কারণেই মহাদেব কে পূজা করে থাকেন ॥ ২১
[বিশ্লেষণ : শাস্ত্রে শিব ও দেবী শিবা উভয়ই ত্রিদেবের পিতা মাতা বলে উক্ত হয়েছেন, দেবীভাগবত পুরাণে রুদ্র বলতে দুই প্রকারের রুদ্রের কথা বলা হয়েছে, একটি মূল রুদ্র অর্থাৎ দেবীর স্বামী সদাশিব, আর সেই সদাশিবের থেকে অংশস্বরূপ আরেকটি রুদ্র অবতার নিয়েছেন, এই অবতার নেওয়া রুদ্র হলেন ত্রিদেবের মধ্যে থাকা সংহারকর্তা রুদ্রদেব,
প্রমাণ দেখুন -
ইচ্ছয়া ব্রহ্মণো বক্ত্রাদ্বরদানার্থমুদ্বভৌ।
মূলরুদ্রস্যাংশভূতো রুদ্রনামা দ্বিতীয়কঃ ॥ ২৬ ॥
সোঽপি পূজ্যোঽস্তি সর্বেষাং মূলরুদ্রস্য কা কথা।..॥ ২৭ ॥
(দেবীভাগবত/৫ম স্কন্ধ/১ম অধ্যায়/২৬-২৭ নং শ্লোক)
অর্থ : পরমেশ্বর শিব ব্রহ্মাকে বরদান করবার ফলে ব্রহ্মার কপাল থেকে মূল রুদ্রের (প্রধান সদাশিবের) থেকে আরেকটি দ্বিতীয় রুদ্র(অংশ অবতার স্বরূপে) উৎপন্ন হয়েছিলেন । মূল রুদ্র অর্থাৎ প্রধান রুদ্র যিনি তিনি সদাশিব নামে বিখ্যাত, এই সদাশিব সর্বদাই সকলের পূজ্য ॥ ২৬-২৭
সুতরাং, দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারেও সদাশিবের উল্লেখ রয়েছে খুবই গোপনীয় ভাবে, এই কারণে মায়ায় মোহিত থাকা ব্যক্তিগণ এই সত্য জানতে না পেরে, কাল্পনিক শাক্ত মতবাদের জন্ম দিয়ে শাস্ত্র বিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত সমাজে ছড়িয়ে সম্প্রদায় বাড়িয়ে চলেছে, এতে সনাতন ধর্মের মধ্যে বিভাজন বৃদ্ধি পাচ্ছে, প্রকৃত শৈবধর্ম থেকে এইসব বিভ্রান্তির কারণে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে আজ শাক্ত মতবাদ নামক নতুন সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দিয়ে চলেছে, আর ধর্মের প্রকৃত সিদ্ধান্ত আরও চাপা পড়ে যাচ্ছে এই মনগড়া মতবাদ গুলির কারণে।]
🔴 সিদ্ধান্ত — শাক্তরা বলেন দেবী একাই ত্রিদেব কে সৃষ্টি করে, শিবকেও জন্ম দেন। কিন্তু, দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে, রুদ্র দুই প্রকারের । দেবী যে রুদ্র কে জন্ম দেন সেই রুদ্র সাক্ষাৎ মূল রুদ্র (সদাশিব) নন, আর শিবের জন্ম হয় না সেটিও প্রমাণিত হয়েছে। দেবী যে রুদ্র কে জন্ম দেন সেই রুদ্র হলেন সংহার কর্তা রুদ্র, এই সংহার কর্তা রুদ্র আবার উৎপন্ন হয়েছে মূল রুদ্র অর্থাৎ সদাশিব থেকে।
আর সেই কারণেই শিবমহাপুরাণে সদাশিব থেকে ত্রিদেব উৎপত্তি হয়েছে এই কথা বলা হয়েছে।
________________________________________________
সবকিছুর শেষে বলি,
শাক্ত দের প্রাণপ্রিয় শাক্তশাস্ত্র দেবী ভাগবত পুরাণে -
শৈব শিবভক্তগণ শৈব শাস্ত্র অনুযায়ী দেবীকে শিবের বিমর্শতা বলে থাকেন, স্বয়ং শাক্তদের দেবী সেই সিদ্ধান্ত কে মান্যতা দিয়ে শৈবদের সিদ্ধান্তকে সর্বজনমান্য সিদ্ধান্ত বলে মান্যতা দিয়েছেন , প্রমাণ দেখুন 👇
বিমর্ষ ইতি তাং প্রাহু শৈবশাস্ত্রবিশরদাঃ ।..॥ ১০
[দেবীভাগবত পুরাণ/৭ম স্কন্ধ/৩২ অধ্যায়/১০ নং শ্লোক]
অর্থ : শৈব-শাস্ত্র-তত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতগণ শক্তিকে (শিবের) বিমর্শ বলেন ।
[বিশ্লেষণ : শিবের শক্তি হল শিবের বিমর্শতা - এই সিদ্ধান্ত হল শৈবদের ত্রিক দর্শনের ত্র্যম্বক পরম্পরা (কাশ্মীর শৈব পরম্পরা) -এর সিদ্ধান্ত। আর সেই সিদ্ধান্ত কে দেবী নিজে উল্লেখ করে শৈবদের মান্যতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সুতরাং একমাত্র শৈব সিদ্ধান্তই সনাতন ধর্মের প্রকৃত অদ্বিতীয় সিদ্ধান্ত। এই বিষয়ে আর কোন সংশয় রইল না ।]
________________________________________________
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
- শিব ব্রহ্ম, শিবই দেবীভাগবত পুরাণের সর্বোচ্চ ও অন্তিম সত্তা, একমাত্র শিবই শৈব ও শাক্ত উভয়ের অন্তিম লক্ষ্য ও অন্তিম গতি।
- শিবের ইচ্ছাই হলেন শক্তি দেবী, এই শক্তি উপাধি দ্বারা ব্রহ্ম নামে ভূষিত হন মাত্র, কিন্তু তার প্রকৃত পরিচয় হল, তিনি ব্রহ্মের শক্তি। দেবী তার শরণাগত জীবকে জ্ঞান দ্বারা শিবকে লাভ করবার যোগ্যতা তৈরী করে দেন।
- শিব নিজের শক্তি প্রকাশের দ্বারা ত্রিদেব কে উৎপন্ন করেন, তাই শক্তিদেবী কে ত্রিদেব জননী বলে। আর সদাশিব হলেন ত্রিদেব জনক।
- শিব কখনোই শব নন, কারণ শক্তি কখনই শিব থেকে আলাদাই হন না। তাই পরিণাম হিসেবে শব হওয়াও সম্ভব নয়। শক্তি শিবের অন্তর থেকে প্রকাশ না হলে জগত তৈরী হবে না, নির্বিকার শিব অবস্থা বহাল থাকবে, তাই নিরাকার নির্গুণ অবস্থা কে শবের সাথে তুলনা করা হয় মাত্র, কিন্তু এইখানে মনে রাখা উচিত শক্তি হল শিবেরই ইচ্ছা, তাই শিব নির্বিকার শবের মতো থাকবেন নাকি জীবন্তের মতো মায়ার জগত বহাল রাখবেন, সেটিও শিবের নিজস্ব বিষয়। তাই এই উপমা ব্যবহার করে সর্বশক্তিমান শিবকে তুচ্ছ দেখানোর চেষ্টা শুধুই বৃথা।
- দেবী শিবলোকেই সদাশিবের সহিত থাকেন, তাই দেবীর মনিদ্বীপ শিবলোকেরই অংশ, আলাদা নয়।
- শাক্ত হোক বা শৈব হোক - সবার জন্য সত্য একটিই, সনাতন ধর্মও একটিই। তাই যেহেতু শাক্তদের দেবীভাগবত পুরাণও শৈবদের শিবমহাপুরাণের সহিত একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, তাই শাক্তদের আলাদা কোন সিদ্ধান্ত থাকতেই পারে না, কারণ এই ধার্মিক বিষয়ে জা কিছু দাবী করা হয়, তা অবশ্যই শাস্ত্রে উল্লেখ থাকতে হয়, কোনো মানুষ যদি ভাবে যে সে নিজের মনগড়া কাল্পনিক ধারনাকে নতুন মতবাদ হিসেবে সমাজে প্রচার করবে, তা কখনোই গ্রহণ যোগ্য হয় না, কারণ, কোনো মানুষের মনগড়া মতবাদ ঈশ্বরের সিদ্ধান্ত হিসেবে গন্য হয় না, মানুষের ভুল ত্রুটি হতে পারে, কিন্তু ঈশ্বরের ভুল ত্রুটি হয় না। তাই ঈশ্বরের দেওয়া শাস্ত্র বচনকেই প্রামাণ্য বলে মানতে হয়, প্রাচীন কালের সকল মুনি ঋষি - এই কারণেই বেদ, আগম, পুরাণ, ইতিহাস ইত্যাদি শাস্ত্রের বচন কেই প্রামাণ্য বলে মেনেছেন। মনগড়া কাল্পনিক মতবাদ কে খণ্ডাবার জন্যে শাস্ত্রের বচনের উপর নির্ভর করে তার দ্বারাই খণ্ডন করে সত্য উন্মোচন করে ধর্মের মান ও সত্য কে নির্ণয় করতে বলেছেন। সুতরাং, যেখানে শাক্তদের বিশ্বাস করা নব্য মতবাদের কোন অস্তিত্বই শাক্তদের মান্য করা প্রামাণ্য শাস্ত্রে নেই তাই এই দেবীভাগবত পুরাণের ভিত্তিতেই শাক্তদের নব্য সম্প্রদায়, নব্য সিদ্ধান্ত খণ্ডিত ও অগ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হল।
তাই আসুন আমরা সকলে সত্য সনাতনকে তুলে ধরি, সত্য সনাতন শৈবধর্মের এক ও অদ্বিতীয় পথে চলি। প্রকৃত সত্যের মাধ্যমেই ধর্ম স্থাপন সম্ভব, কাল্পনিক ধারণায় বিশ্বাসী হয়ে মনগড়া মতপথ বানিয়ে সেই পথে ধর্মকর্ম করা সম্ভব নয়, এতে ধর্ম স্থাপন সম্ভব নয়।
আমাদের শাস্ত্রে যেভাবে বিধান ও ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয়েছে, তার উপর ভিত্তি করেই আমাদের চলতে হবে।
নমো হিরণ্যবাহবে হিরণ্যবর্ণায়
হিরণ্যরূপায় হিরণ্যপতয়ে অম্বিকাপতয়
উমাপতয়ে পশুপতয়ে নমো নমঃ॥
(কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০ম প্রপাঠক/২২ অনুবাক)
অর্থ — যার হিরণ্যবর্ণের অর্থাৎ সোনার মতো উজ্জ্বল বর্ণের আভাযুক্ত বাহু রয়েছে, যার দিব্যদেহের বর্ণ সোনার মতো উজ্জ্বল, যিনি সোনার মতো উজ্জ্বল রূপধারী, যিনি অম্বিকা অর্থাৎ শিবাদেবীর স্বামী, যিনি উমা অর্থাৎ পার্বতী দেবীর পতি সেই পশুপতি পরমেশ্বর শিবের প্রতি নমস্কার ।
জয় মা ভুবনেশ্বরী
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
🔥 সত্য উন্মোচনে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য গুরুদেব জী
© কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT


মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন