শিবকে গিলে খাওয়ার জন্য কি দেবী ধূমাবতী নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন ?
ভূমিকা —
বর্তমান সময়ে শাস্ত্রজ্ঞানহীন মানুষ সংখ্যা সমাজে অধিক, ফলে আজগুবি কাহিনী শুনিয়ে মানুষ কে প্রভাবিত করে তাদের কাছে অপপ্রচার করা খুবই সহজ। কিন্তু যদি শাস্ত্রের সঠিক জ্ঞান লাভ করা ব্যক্তিদের সংখ্যা এই সমাজে বেশি থাকতো, তবে কখনোই অপপ্রচার বৃদ্ধি পেত না। পরমেশ্বর শিবকে নাকি গ্রাস করবার কারণে দেবী ধূমাবতী নামে বিখ্যাত হয়েছেন - এমন দাবী করে শক্তি উপাসক শাক্ত ব্যক্তিগণ। তাদের এমন বক্তব্যের উদ্দেশ্য হল - “দেবী সর্বোচ্চ শক্তিশালী, তাই তিনি শিবকেও গ্রাস করে নিতে সক্ষম, শিব দেবীর ক্ষমতার সামনে তুচ্ছ” । এই কারণে শাক্তদের এই দাবী করতে দেখা যায়।
এই কথা আদৌও সত্য নাকি কাল্পনিক বিশ্বাস তা শাস্ত্রের নিরিখেই প্রমাণিত করা হবে।
________________________________________________
শাক্তদের বিশ্বাস ও দাবী :
কৈলাস পর্বত-এ পার্বতী যখন শিবের কাছে আহার চেয়েছিলেন এবং শিব দিতে দেরি করলেন, তখন পার্বতী শিবকে গ্রাস করেছিলেন। এক মুহূর্ত পর পার্বতীর দেহ থেকে ধূম নির্গত হতে শুরু করে। তাই তিনি ধূমাবতী নামে পরিচিত। ধূমাবতী তাঁর স্বামী শিবের গ্রাসের কারণে বিধবা রূপী। শিব ছাড়াও দেবী একাই থাকতে পারেন।
________________________________________________
🔷শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য গুরুদেব জীর দ্বারা শৈবপক্ষ থেকে প্রকৃত সত্য উন্মোচন :
দেবীর ধূমাবতী নামে বিখ্যাত হবার কারণটি শিবমহাপুরাণের উমা সংহিতার ৪৭ নং অধ্যায়ে উল্লেখ হয়েছে —
এবং বিজ্ঞাপিতো দৈত্যো ধূম্রলোচনসংজ্ঞকঃ।
গত্বা হিমাচল প্রাহ ভূবনেশীমুমাংশজাম্ ॥ ৪৭ ॥
ভর্তুর্মমান্তিকং গচ্ছ নো চেত্ত্বাং ঘাতয়াম্যহম্ ।
বষ্ট্যাসুরাণাং সহিতঃ সহস্রাণাং নিতম্বিনি॥ ৪৮ ॥
দেব্যুবাচ —
দৈত্যরাদ্ প্রেষিতো বীর হংসি চেৎ কিং করোমি তে ।
পরন্ত্বসাধ্যং গমনং মন্যে সংগ্রামমন্তরা ॥ ৪৯ ॥
ইত্যুক্তস্তামন্বধাবদ্ দানবো ধূম্রলোচনঃ ।
হুঁকারোচ্চারণেনৈব তং দদাহ মহেশ্বরী ॥ ৫০ ॥
ততঃ প্রভৃতি সা দেবী ধূমাবতিউচ্যতে ভূবি ।
আরাধিতা স্বভক্তানাং শত্রুবর্গনিকর্তিনী ॥ ৫১ ॥
ধূম্রাক্ষে নিহতে দেব্যা বাহনেনাতিকোপিনা ।
চর্বিতাস্তদ্গণা সর্বেঽপলায়ন্তাবশেষিতাঃ॥ ৫২ ॥
[শিবমহাপুরাণ/উমা সংহিতা/৪৭ অধ্যায়/৪৭-৫২ নং শ্লোক]
অর্থ : শুম্ভের আদেশ পেয়ে দৈত্য ধূম্রাক্ষ হিমালয়ে গেল এবং উমার অংশ থেকে প্রকটিত ভগবতী ভুবনেশ্বরীকে বলল-'নিতম্বিনি! আমার প্রভুর কাছে চলো, নাহলে তোমাকে মেরে ফেলব। আমার সঙ্গে ষাট হাজার অসুর সৈন্য আছে।' ॥ ৪৭-৪৮
দেবী বললেন-
ওহে বীর! তোমাকে দৈত্যরাজ পাঠিয়েছে। আমাকে যদি মেরেই ফেলো তো কী করব। কিন্তু বিনা যুদ্ধে আমার ওখানে যাওয়া অসম্ভব। আমার এরকমই মনে হয় ॥ ৪৯
দেবী এই কথা বলায় দানব ধূম্রাক্ষ দৌড়ে তাঁকে ধরতে এলো। কিন্তু মহেশ্বরী শুধু 'হূং' উচ্চারণ করেই তাকে ভস্ম করে দিলেন ॥ ৫০
তখন থেকে এই দেবী ভূতলে ধূমাবতী নামে অভিহিত হলেন। ধূমাবতীর আরাধনা করলে তিনি তাঁর ভক্তদের শত্রুসংহার করেন ॥ ৫১
ধূম্রাক্ষ মারা গেলে দেবীর বাহন সিংহ কুপিত হয়ে তার সাথী সমস্ত অসুরকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলল। যারা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেল, তারা দৌড়ে পালাল ॥ ৫২
________________________________________________
বিশ্লেষণ : শিবমহাপুরাণে দেবীর ধূমাবতী নাম হবার কারণ উল্লেখ হয়েছে। কিন্তু, শাক্তরা যে দাবী করে বলেন শিবকে গ্রাস করে দেবীর শরীর থেকে ধোঁয়া ওঠার কারণে দেবীকে ধূমাবতী বলা হয়, একথার কোনো শাস্ত্রীয় প্রমাণ নেই, শুধু মাত্র লোকমুখে প্রচারিত একটি ভ্রান্ত কাল্পনিক কাহিনী সমাজে প্রচারিত হয়েছে মাত্র, আর তার শিকার বানিয়েছে পরমেশ্বর শিবকে। আর এসব লোককথা সমাজে ভীষনভাবে ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে টিভি সিরিয়ালে এগুলি দেখানো হয়ে চলেছে। অথচ কোনো শাক্ত তন্ত্রে শাক্তদের দাবী করা এবিষয়ের কোনো রকম উল্লেখ নেই। কাল্পনিক কাহিনী সমাজে প্রচারিত হয়ে তার ভিত্তিতে শিবের অক্ষমতা প্রমান করবার লীলা চলছে।
এই কারণেই এটি কলিযুগ। এই যুগে অধার্মিকদের অপকৌশলের দ্বারা অপপ্রচার বৃদ্ধি পাবে, এটিই স্বাভাবিক। তাই ধর্মের উপর বসে থাকা পরমেশ্বর শিবের নিন্দা করে অধর্ম প্রচার করাটা এ যুগে কলির স্বাভাবিক লক্ষণ।
শাস্ত্রের মধ্যে বলা হয়েছে -
মহাবিদ্যা দেবী ধূমাবতীর সাথে তারই মহাবিদ্যাপতি ধূমবান অবস্থান করেন। এই ধূমবান হলেন পরমেশ্বর শিবের মহাবিদ্যাপতি স্বরূপ লীলামূর্তি।
প্রমাণ দেখুন 👇
ধূমবান্ সপ্তমঃ শম্ভুঃ সর্বকামফলপ্রদঃ ।
ধূমাবতী শিবা তত্র সদুপাসককামদা ॥৮
[শিবমহাপুরাণ/শতরুদ্র সংহিতা/১৭নং অধ্যায়/৮ নং]
অর্থ : পরমেশ্বর শিবের প্রকটিত সপ্তমতম বিদ্যাপতি ধূমবান নামে বিখ্যাত।
এনার বিদ্যাশক্তির নাম ধূমাবতী। দেবী ধূমাবতী দশমহাবিদ্যার সপ্তমতম মহাবিদ্যা।
ইনি পার্বতী দেবীর প্রকটিত একজন ভয়ঙ্কররূপী শক্তিস্বরূপা। ধূমবান ও ধূমাবতী উভয়েই ভক্তের কামনা পূরণ করে দেন।
🔷 সুতরাং, সরাসরি পরমেশ্বর শিবের অবর্তমানে দেবীর একাকিনী অস্তিত্ব থাকার বিষয়টির শাস্ত্রীয় প্রামাণিকতাই নেই, তাছাড়া এটি অযৌক্তিক। কারণ শিব হলেন স্বয়ং সাক্ষাৎ ব্রহ্ম, ব্রহ্মের শক্তি হলেন দেবী। তাই ব্রহ্মকে নাশ করা অসম্ভব। এসব কল্পকাহিনী অজ্ঞানীদের আনন্দ দিতে পারে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞানীদের কাছে হাস্যকর বিষয় মাত্র।
________________________________________________
সিদ্ধান্ত
শিবমহাপুরাণের বচন অনুসারে - দেবীর নাম ধূমাবতী হয়েছে ধূম্রাক্ষ (ধূম্রলোচন) কে বধ করবার কারণে। শিবকে গ্রাস করে নিবার পর দেবীর শরীরে ধোঁয়া ওঠার গল্পটি নিছক কল্পনা মাত্র তথা কোনো শাস্ত্রে এখনো উল্লেখ পর্যন্ত হয়নি, তাই এই বিষয়ে শাক্তদের দাবী করা কাহিনী যেহেতু শাক্তদেরই শাস্ত্রে উপলব্ধ নেই, সেহেতু ধূমাবতী বিষয়ে সনাতন ধর্মের অন্য যে শাস্ত্রে এর বিষয়ে অল্পবিস্তরও বর্ণনা উল্লেখ পাওয়া গেছে, সেটিই গ্রহণ করা ন্যায় সম্মত।
তাই শিবমহাপুরাণের বচন সর্বজন স্বীকৃত। কারণ এটি সনাতন ধর্মেরই শাস্ত্র।
আর
যারা শাস্ত্র বচন দেখেও তাচ্ছিল্য করে, শাস্ত্র বচন অমান্য করে তাদের কোন গতি তো হবেই না, বরং পতন অনিবার্য, এইখানে ক্লিক করে দেখুন 👉 শাস্ত্র অমান্যকারী ব্যক্তির শাস্তি ও ধার্মিক ব্যক্তির করণীয় কর্তব্য
________________________________________________
জয় মা পরাশক্তি পার্বতীদেবী
জয় মা ধূমাবতী
জয় ধূমবান বাবা
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
লেখনীতে — ©শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
#ॐনমঃশিবায় #সনাতনধর্ম #হরহরমহাদেব #সদাশিব #ISSGT #শৈবধর্ম #হিন্দুধর্ম #শৈব #Sadashiva #Sadashiv #তারা #তারাপীঠ #কালী #দশমহাবিদ্যা


মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন