বিষ্ণু হলেন প্রকৃতিরূপী নারী, পরমেশ্বর শিব একমাত্র পরমপুরুষ
॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥
ভূমিকা - সনাতন ধর্ম অনুসারে, সনাতন ধর্মের একমাত্র ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বর শুধুমাত্র শিব। এই পরমেশ্বর শিবই বৃহৎ হবার কারণে ব্রহ্ম শব্দে চিহ্নিত হন । কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে লোককথা ও লোকমান্যতার প্রভাব এতটাই বিস্তার লাভ করেছে যে, তারা একমাত্র শ্রীবিষ্ণুকেই পরমপুরুষ ভাবতে শুরু করেছেন। কিন্তু শাস্ত্র বলছে বলেছে একমাত্র পরমেশ্বর শিবই হলেন পরমপুরুষ, শ্রীবিষ্ণু হলেন তার শক্তিরই একটি অপরা স্বরূপ যোনী, সেখান থেকে ব্রহ্মা উৎপন্ন হন। এবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা শাস্ত্র প্রমাণ উল্লেখ করে করা হল এখানে।
____________________________________________________________________________________
বিষ্ণু হলেন প্রকৃতিরূপী নারী, পরমেশ্বর শিব একমাত্র পরমপুরুষ
প্রভু শিবই পরমপুরুষ বলে উক্ত হন, তিনি নিজের অদ্বিতীয় অবস্থা থেকে দ্বিতীয় হবার জন্য শক্তি প্রকাশ করেন। এই শক্তি অনেকগুলি অবস্থা রয়েছে, যার মধ্যে পরাশক্তি হল শিবের নিজের ইচ্ছাশক্তি, যা ব্রহ্মবিদ্যা বলে শাস্ত্রে উল্লেখিত হয়েছে। এই শক্তিকে প্রভু শিব একটি রূপদান করেছেন যা জাগতিক সংসারের দৃষ্টিতে নারীরূপ হিসেবে ধরা দেয়। তাই এই পরাশক্তিকে শিবের সহিত অভিন্নতার কারণে দেবী হিসেবে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করে শিবপত্নী বা শিবপ্রিয়া ইত্যাদি শব্দে ভূষিত করা হয়ে থাকে। এই নিরাকার পরমেশ্বর পরমব্রহ্ম শিব সাকার রূপে সদাশিব হন, আর তার ইচ্ছা - পরাশক্তি (ব্রহ্মবিদ্যা) নামে প্রকট হয়ে সদাশিবের সহিত অবস্থান করেন। এই পরাশক্তি থেকে অপরাশক্তি প্রকট হয়। অপরাশক্তিও শক্তিরই একটি মায়া রূপ, তাই সাধারণ ভাষায় অপরাশক্তিকে মায়া বা প্রকৃতি বলে। এই প্রকৃতি থেকেই বিষ্ণু উৎপন্ন হন এবং বিষ্ণুর নাভী থেকে লীলাবশত শিবের বীজ স্বরূপ ব্রহ্মা প্রকট হন মাত্র। এই কারণে ক্ষেত্র বিশেষে শ্রীবিষ্ণুকে প্রকৃতি অর্থাৎ পরাশক্তির অপরা রূপ হিসেবেই শাস্ত্রে উল্লেখিত হয়েছে। শ্রীবিষ্ণু প্রকৃতি তত্ত্ব থেকে উৎপন্ন হবার কারণে তাকেও প্রকৃতি বলেই চিহ্নিত করা হয়েছে শাস্ত্রে । সহজ ভাষায় বলা যায় — বিষ্ণু হলেন প্রকৃতির অন্তর্গত পুরুষ রূপধারী দেবীশক্তি অর্থাৎ নারী। তাই শাস্ত্রে শ্রীবিষ্ণুকে দেবীর মতো যোনী অর্থাৎ উৎস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মাতৃযোনীর গর্ভে পিতা নিজের বীজ প্রদান করলে মাতৃযোনী থেকে যেমন সন্তান উৎপন্ন হয়, তেমন ভাবেই শ্রীবিষ্ণুরূপী দেবীর গর্ভে পুরুষরূপী মহেশ্বর বীজ বপন করেন ফলে সেখান থেকে ব্রহ্মা উৎপন্ন হন। আর এই ব্রহ্মাকে এই কারণেই হিরণ্যগর্ভ বলা হয়, যে গর্ভ শ্রীবিষ্ণু নিজে ধারণ করেন। স্বয়ং শিব এই হিরণ্যগর্ভকে জন্ম হতেও দেখেন।
[উল্লেখ্য : এখানে শ্রীবিষ্ণু ও শিবের লীলা কোনো রকমভাবে সমকামীতার মতো কু-মনোভাবের জন্ম দেয় না।]
১ম প্রমাণ — বায়ুপুরাণ থেকে দেখুন 👇
হরি ও হরের সংযোগ থেকে ভগবান ব্রহ্মার জন্ম হয়েছে ঃ
এষ বীজী ভবান্ বীজনহং যোনিঃ সনাতনঃ ।
[বায়ুপুরাণ/প্রক্রিয়াপাদ/২৪ অধ্যায়/৬৭ নং শ্লোক]
অর্থ — ব্রহ্মার উদ্দেশ্যে শ্রীহরি নারায়ণ বললেন, সেই সনাতন ভব (রুদ্র/শিব) হলেন বীজদাতা - বীজী, তুমি (ব্রহ্মা) হলে সেই বীজ, আর আমি (বিষ্ণু) সেই বীজ বপনের স্থান - যোনী।
____________________________________________________________________________________
২য় প্রমাণ দেখুন — শিবমহাপুরাণ ও লিঙ্গমহাপুরাণ থেকে 👇
হরি হলেন প্রকৃতি (নারীস্বরূপা) এবং শিব হলেন পুরুষ :
শিবমহাপুরাণে একই কথা বলা হয়েছে, বীরভদ্র নৃসিংহরূপী নারায়ণকে বলছেন,
প্রকৃতিস্ত্বং পুমান্ রুদ্রস্ত্বয়ি বীর্যং সমাহিতং ।
ত্বন্নাভিপঙ্কজাজ্জাতঃ পঞ্চবক্ত্রঃ পিতামহঃ ॥ ৪০
(শিবমহাপুরাণ/শতরুদ্র সংহিতা/অধ্যায় ১১/৪০নং শ্লোক) এবং (লিঙ্গমহাপুরাণ/পূর্বভাগ/অধ্যায় ৯৩/৪০নং শ্লোক)
অর্থ — আপনি(বিষ্ণু) প্রকৃতি, রুদ্র হলেন পুরুষ। তিনি আপনাতে (বিষ্ণুতে) নিজের বীর্যরূপী বীজ বপন করেছেন, এই কারণেই আপনার (বিষ্ণুর) নাভিকমল থেকে পাঁচমুখযুক্ত ব্রহ্মা উৎপন্ন হয়েছে ।
____________________________________________________________________________________
৩য় প্রমাণ দেখুন — বায়ুপুরাণ থেকে 👇
আত্মানং প্রকৃতিং বিদ্ধি মাং বিদ্ধি পুরুষং শিবম্ ।
ভবানর্দ্ধশরীরং মে ত্বহং ভব যতৈব চ ॥ ২৩
[বায়ুপুরাণ/২৫ অধ্যায়/২৩ নং শ্লোক]
অর্থ — তুমি তোমার নিজ দেহকে প্রকৃতি এবং আমি তোমার দেহের মধ্যে থাকা আত্মা শিব, আমাকে পুরুষ বলেই জেনে রাখো। তুমি আমার অর্দ্ধদেহ, আমিও তোমার অর্ধদেহ।
____________________________________________________________________________________
৪র্থ প্রমাণ দেখুন — কূর্ম মহাপুরাণ থেকে 👇
পরমেশ্বর সদাশিব বিষ্ণু কে বললেন -
ভবান্ প্রকৃতিরব্যক্তমহং পুরুষ এব চ।
ভবান্ জ্ঞানমহং জ্ঞাতা ভবান মায়াহমীশ্বরঃ ॥
ভবান্ বিদ্যাত্মিকা শক্তিঃ শক্তিমানহমীশ্বরঃ ॥৮৪
(কূর্মপুরাণ/পূর্ব ভাগ/৯ অধ্যায়/ ৮৪নং শ্লোক) (সৌর পুরাণ/২৪ অধ্যায়)
অর্থ — তুমি (বিষ্ণু) অপ্রকাশ্য প্রকৃতি, আর আমি (শিব) পুরুষ। তুমি জ্ঞান, আর আমি জ্ঞাতা। তুমি মায়া, আর আমি ঈশ্বর। তুমি জ্ঞান থেকে জন্ম নেওয়া শক্তি, আর আমি সেই শক্তির অধীশ্বর।
____________________________________________________________________________________
৫ম প্রমাণ দেখুন — স্কন্দ মহাপুরাণ থেকে 👇
ব্রহ্মোৎপত্তিঃ
কল্পান্তরে পুনস্তস্মিন্ ব্রহ্মণ্যুপরতে হরিঃ ।
পরান্তকালে স্ত্রীভূত্বা বিষ্ণুরীশং বশং নয়ৎ ।
অরমচ্চ ততো ব্রহ্মা বিষ্ণাবুদভবৎ পুরা ॥
তদ্বিষ্ণুঃ শিবপূজায়া মাহাত্ম্যাৎ কিল শূলিনঃ ।
দয়িতেতি শ্রুতো লোকে পূজা সর্বস্য কামধুক্ ॥
[স্কন্দ পুরাণ/শঙ্কর সংহিতা/শিব রহস্য খণ্ড/উপদেশ কাণ্ড/অধ্যায় ৬৫–৬৬]
অর্থ — ব্রহ্মার উৎপত্তির কাহিনী - অন্য এক কল্পে, যখন ব্রহ্মা আর বিদ্যমান ছিলেন না, তখন মহাপ্রলয়ের সময় হরি (বিষ্ণু) নারী-রূপ ধারণ করে ঈশকে (শিবকে) মোহিত করেছিলেন। সেই ঐশ্বরিক মিলন থেকেই অতীতে বিষ্ণুর থেকেই পুনরায় ব্রহ্মার জন্ম হয়েছিল। সেই বিষ্ণু, শিব পূজার মাহাত্ম্যের কারণে জগতে ‘শূলিধর (শিব)-এর প্রিয়তম’ নামে পরিচিত হলেন। অতএব, শিবের উপাসনাই সকল কামনা-বাসনা পূরণকারী বলে গণ্য হয়।
____________________________________________________________________________________
৬ষ্ঠ প্রমাণ দেখুন — কূর্ম মহাপুরাণ থেকে 👇
ভগবান শ্রীবিষ্ণু ব্রহ্মা কে বললেন -
অয়ং দেবো মহাদেবঃ স্বয়ংজ্যেতিঃ সনাতনঃ।
অনাদিনিধনোহচিন্ত্যো লোকানামীশ্বরো মহান ॥ ৫৭
শঙ্করঃ শম্ভুরীশানঃ সর্বাত্মা পরমেশ্বরঃ।
ভূতানামধিপো যোগী মহেশো বিমলঃ শিবঃ ॥ ৫৮
এষ ধাতা বিধাতা চ প্রধানপুরুষেশ্বরঃ।
যং প্রপশ্যন্তি যতয়ো ব্রহ্মভাবেন ভাবিতাঃ ॥ ৫৯
সৃজত্যেষ জগৎ কৃৎস্নং পাতি সংহরতে তথা।
কালো ভূত্বা মহাদেবঃ কেবলো নিষ্কলঃ শিবঃ ॥ ৬০
ব্রহ্মাণং বিদধে পূর্ব্বং ভবন্তং যঃ সনাতনঃ।
বেদাংশ্চ প্রদদৌ তুভ্যং সোহয়মায়াতি শঙ্করঃ ॥ ৬১
অস্যৈব চ অপরাং মূর্তিং বিশ্বযোনিং সনাতনীম্।
বাসুদেবাভিধানং মামবেহি প্রপিতামহ ॥ ৬২
কিং ন পশ্যসি যোগেশং ব্রহ্মাধিপতিমব্যয়ম্।
দিব্যং ভবতু তে চক্ষুর্যেন দ্রক্ষসি তৎপরম্ ॥ ৬৩
ব্ধা চৈবং তদা চক্ষুর্বিষ্ণোর্লোকপিতামহঃ।
বুবুধে পরমেশানং পূরতঃ সমবস্থিতম্ ॥ ৬৪
স লব্ধা পরমং জ্ঞানমৈশ্বরং প্রপিতামহঃ।
প্রপেদে শরণং দেবং তমেব পিতরং শিবম্ ॥ ৬৫
(কূর্মপুরাণ/পূর্ব ভাগ/৯ অধ্যায়/৬২ নং শ্লোক)
অর্থ : ভগবান বিষ্ণু ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় পরমভাব জেনে উত্থিত হয়ে পিতামহ ব্রহ্মাকে বললেন, ইনিই দেবাদিদেব মহাদেব এবং স্বয়ং জ্যোতিঃস্বরূপ, সনাতন, অনাদিনিধন, অচিন্ত্য, সর্বপ্রাণীর ঈশ্বর, শঙ্কর, শম্ভু, ঈশান, সর্ব্বাত্মা, পরমেশ্বর, ভূতগণের অধিপতি, যোগী, মহেশ, বিমক, শিব। ইনিই ধাতা বিধাতা ও প্রকৃতিপুরুষের ঈশ্বর। যতিগণ (যোগীগণ) ব্রহ্মভাবে ভাবিত এনাকেই দর্শন করেন। এই অদ্বিতীয় নিষ্কল (অর্থাৎ অংশশূন্য) মহাদেবই সমস্ত জগৎ সৃজন করে চলেছেন, রক্ষা করে চলেছেন এবং কালরূপে সংহার করে চলছছেন। ৫৩-৬০।
যে সনাতন পুরুষ পূর্বকালে আপনাকে সৃজন করেছেন এবং বেদ সকল আপনাকে দান করেছেন, সেই শঙ্করই এসেছেন। হে পিতামহ। বাসুদেব নামে বিখ্যাতা সনাতনী বিশ্বযোনি এই শিবেরই অপরা মূর্ত্তি (নশ্বর প্রকৃতি/অপরা শক্তি) বলে আমাকে (শ্রী হরিকে) জানুন । আপনি কি অব্যয় ব্রহ্মাধিপতি যোগেশকে দেখতে পারছেন না ? আপনার দিব্য চক্ষু হোক, যে চক্ষু দ্বারা শ্রেষ্ঠ পদার্থকে দর্শন করতে পারেন। লোকপিতামহ ব্রহ্মা বিষ্ণু হতে দিব্যচক্ষু লাভ করে সম্মুখে অবস্থিত পরমেশ্বরকে জানতে পারলেন। ব্রহ্মা, ঈশ্বরবিষয়ক পরম জ্ঞান লাভ করে মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন।
[ লক্ষ্য করুন - দেখুন ! ভগবান শ্রীবিষ্ণু নিজে বলছেন যে, তিনি শিবের অপরা যোনী রূপ। শ্রীবিষ্ণু নিজেই নিজেকে নশ্বর বলে স্বীকার করেছেন]
শ্রীবিষ্ণুর নারীসুলভ ইচ্ছাতেই তার প্রকৃত স্বরূপের পরিচয় পাওয়া যায়।
৭ম প্রমাণ দেখুন — স্কন্দ মহাপুরাণ থেকে 👇
শাস্তা উৎপত্তিঃ
পুনঃ কদাচিচ্ছ্রীকান্তো ন্যগ্রোধবন ঈশ্বরম্ ॥ ২৫
আরাধ্যাস্মাদ্ বরং বদ্রে প্রসন্নাৎ পার্বতীপতেঃ ।
ত্বয়া রন্তুমপেক্ষেশাধুনা ভূত্বা রমণ্যহম্ ॥ ২৬
দেয়ো বরো মমাধীশ প্রসন্নো যদি শঙ্কর ।
দত্বৈবমীশ্বরস্তস্মৈ বরমন্তর্ধিমায়যৌ ॥ ২৭
ততস্তু কারণে দেবমমৃতং ক্ষীরসাগরাৎ ।
গৃহীতমসুরৈর্ বিষ্ণুর্ মোহিন্যাকারমাস্থিতঃ ॥ ২৮
তেনাসুরান্ মোহয়িত্বা পায়য়িত্বামৃতং সুরান্ ।
ঊর্ধ্বরেতসমীশানমপি মোহমুপানযৎ ॥ ২৯
রমমাণো মহেশেন মোহিন্যাকারমস্থিতঃ ।
লেভে চ পুত্রং শাস্তারং কামারাতেরপীশ্বরাৎ ॥ ৩০
[স্কন্দ মহাপুরাণ/শঙ্কর সংহিতা/শিব রহস্য খণ্ড/উপদেশ কাণ্ড/অধ্যায় ৬৬]
অর্থ —
শাস্তা নামক একজন শিবগণের উৎপত্তির কাহিনী -
একসময় ন্যগ্রোধ অরণ্যে শ্রীকান্ত ভগবান বিষ্ণু - ঈশ্বর শিবের উপাসনা করলেন এবং শিব সন্তুষ্ট হলে পার্বতীপতির কাছে একটি বর প্রার্থনা করলেন। বিষ্ণু প্রার্থনা করে বললেন —
“হে প্রভু! যদি আপনি সন্তুষ্ট হন, তবে আমায় এই বর দিন— আমি আপনার সঙ্গে মিলন-রস অনুভব করার জন্য এক অতুল সুন্দরী নারীর রূপ ধারণ করতে চাই।”
ভগবান শংকর সেই বর প্রদান করলেন এবং তারপর অন্তর্ধান করলেন ॥ ২৫–২৭ ॥
পরবর্তীতে দেব-দানবরা যখন অমৃত লাভের জন্য ক্ষীরসাগর সমুদ্র মন্থন করল, তখন অমৃত দানবরা ছিনিয়ে নিল। তাদের প্রতারণা করার জন্য ভগবান বিষ্ণু মোহিনী রূপ ধারণ করলেন। সেই মায়ার মোহে পড়ে দানবরা প্রতারিত হল এবং দেবতারা অমৃত পান করতে সক্ষম হল।
এমনকি রুদ্র — যিনি সাধারণত জাগতিক কামনা-বাসনার অতীত — তিনিও মোহিনীর এই রূপে মুহূর্তের জন্য নিজের দেওয়া বরদানের কারণে মোহিত হলেন। মোহনরূপী বিষ্ণুর সঙ্গে মিলন-আনন্দে নিমগ্ন হয়ে রুদ্র এক পুত্রের জন্ম দিলেন।
এইভাবে জন্মলেন শাস্তা (অয়্যাপ্পা) — কামদেবের শত্রু রুদ্রের পুত্র, যিনি মোহিনী রূপী বিষ্ণুর দৈব সংযোগে আবির্ভূত ॥ ২৮–৩০ ॥
এখন অনেকেই ভাবতে পারেন যে, এটি কেমন করে সম্ভব ?
হ্যা ! পরমেশ্বরের ইচ্ছেয় যে কোনো কিছু ঘটে যাওয়া অবশ্যই সম্ভব ।
আগেই বলেছি যে শ্রী হরি বিষ্ণু হলেন পরাশক্তির প্রকৃতিরূপ, তাই বিষ্ণু প্রকৃতপক্ষে শিবের পত্নি মা উমার প্রকৃতিগত পুরুষরূপ, কিন্তু তিনি আসলেই উমা, তাই তিনি পুরুষরূপে নয় বরং স্ত্রীরূপ (মোহিনী অবতার) ধারণ করে শিবকেই স্বামী হিসেবে লাভ করে থাকেন, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। দেখুন বেদ নিজেই বলছে যে উমা হলেন বিষ্ণু । পরবর্তী শাস্ত্র বচন দেখুন -
৮ম প্রমাণ দেখুন —
কৃষ্ণ-যজুর্বেদের রুদ্রহৃদয় উপনিষদ থেকে 👇
রুদ্রস্য দক্ষিণে পার্শ্বে রবির্ব্রহ্মা ত্রয়োঽগ্নয়ঃ ॥ ৩ ॥
বামপার্শ্বে উমা দেবী বিষ্ণুঃ সোমোঽপি তে ত্রয়ঃ ।
যা উমা সা স্বয়ং বিষ্ণুর্য়ো বিষ্ণুঃ স হি চন্দ্রমাঃ ॥ ৪ ॥
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/রুদ্রহৃদয় উপনিষদ/৩-৪ নং মন্ত্র]
অর্থ — সাকার ব্রহ্ম রুদ্রদেবের দক্ষিণ পার্শ্বে সূর্য, ব্রহ্মা তথা তিন প্রকারের অগ্নি(গার্হপত্য, দক্ষিণাগ্নি আর আহবনীয়) বিদ্যমান রয়েছে ॥ ৩ ॥
(পরমেশ্বর শিবের) বাম পাশে পরমেশ্বরী উমা, শ্রীবিষ্ণু, চন্দ্র - এই তিনজন অবস্থিত থাকেন। যিনি উমা, তিনিই হলেন স্বয়ং বিষ্ণু আর তিনিই চন্দ্রস্বরূপ ॥ ৪ ॥
বিশ্লেষণ ঃ
পরমেশ্বর শিবের বামদিকে থাকেন উমা, আর বিষ্ণু উমার রূপ হবার কারণে তিনিও বাম দিকেই থাকেন। এমনকি পরমেশ্বর শিবের বাম দিকের শক্তির প্রকৃতিভাগ থেকে হরি উৎপন্ন হয়েছেন।
[তথ্যসূত্র : শিবমহাপুরাণ/রুদ্রসংহিতা/সৃষ্টিখণ্ড/অধ্যায় ৯/৫৬ নং শ্লোক]
এমনকি বৈষ্ণবদের পদ্মপুরাণ থেকে প্রমাণ দেখুন -
বামতো হরিম্ ॥৫
(তথ্যসূত্র - পদ্মপুরাণ/ পাতালখণ্ড/১০৮ নং অধ্যায়)
অর্থ — পরমেশ্বর সদাশিব নিজের বামভাগ থেকে শ্রীহরিকে সৃষ্টি করেন।
অর্থাৎ, উপরোক্ত ব্যাখ্যা শাস্ত্র দ্বারা প্রমাণিত ।
____________________________________________________________________________________
৯ম প্রমাণ দেখুন — ঋগ্বেদ থেকে 👇
ভগবান ব্রহ্মা হলেন - মহেশ্বরের বীজ, যা নারায়ণের নাভি-স্থানে (গর্ভে) স্থাপিত হয়েছিল ঃ
তমিদ্ধর্ভঃ প্রথমং দধ্রে আপো যত্র দেবাঃ সমগচ্ছন্ত বিশ্বে।
অজস্য নাভাবধ্যেকমর্পিতং যস্মিন্ বিশ্বানি ভূবনানি তস্থুঃ॥
[ঋগ্বেদ/শাকল শাখা/১০ মণ্ডল/৮২ সূক্ত/৬ মন্ত্র]
অর্থ — জলই প্রথম সেই গর্ভকে ধারণ করেছিল, যেখানে সমস্ত দেবতারা একত্র হয়েছিলেন। সেই এক বীজ অবস্থান করেছিল অজন্মা (নিরাকার-অনাদি সত্তা শিবের)-র দ্বারা প্রকটিত জল (বিষ্ণু) স্বরূপের নাভিতে, এবং সেই স্থানেই সমগ্র জগত অবস্থান করে।
____________________________________________________________________________________
১০ম প্রমাণ দেখুন —
কৃষ্ণ-যজুর্বেদের রুদ্রহৃদয় উপনিষদ থেকে 👇
রুদ্রাৎপ্রবর্ততে বীজং বীজযোনির্জনার্দনঃ ।..॥ ৭ ॥
[কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/রুদ্রহৃদয় উপনিষদ/৭ নং মন্ত্র]
অর্থ — পরমেশ্বর ‘পরারুদ্র শিব’ই সকল কিছুর উৎপত্তির কারণরূপী বীজ, আর সেই কারণরূপী বীজ বপন করবার জন্য যোনীস্বরূপ (প্রকৃতি) হলেন জনার্দন নারায়ণ ।..॥ ৭ ॥
____________________________________________________________________________________
শেষে বেদ মন্ত্র উচ্চারণ করে শুধু বলছি —
সর্বো বৈ রুদ্রঃ তস্মৈ রুদ্রায় নমো অস্তু ।
পুরুষো বৈ রুদ্রঃ সন্মহো নমো নমঃ ॥
(কৃষ্ণযজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০ম প্রপাঠক/২৪ নং অনুবাক)
ঋতং সত্যং পরং ব্রহ্ম পুরুষং কৃষ্ণপিঙ্গলম্ ।
ঊর্ব্বরেতং বিরূপাক্ষ বিশ্বরূপায় বৈ নমঃ ॥
(কৃষ্ণ-যজুর্বেদ/তৈত্তিরীয় আরণ্যক/১০ম প্রপাঠক/২৩ নং অনুবাক)
সিদ্ধান্ত
সমগ্র শাস্ত্র প্রমাণের দ্বারা একমাত্র পরমেশ্বর প্রভু শিবই পরমপুরুষ এবং শ্রীবিষ্ণু প্রকৃতি যোনী নারীস্বরূপা বলে প্রমাণিত হল।
____________________________________________________________________________________
আরও দেখুন এইখানে ক্লিক করে 👇
পরমেশ্বর শিব কি নারী ধরে গোপেশ্বর হয়েছিলেন ?
____________________________________________________________________________________
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
লেখনীতে — © শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT


মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন