শ্রীরামচন্দ্র কি প্রাণী বধ করে তার মাংস আহার করতেন ?



॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥

ভূমিকা


 শ্রীরাম কি মাংস ভক্ষণ করেছিলেন, নাকি মাংস ভক্ষণ করেননি, তা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের বিভিন্ন মতামত রয়েছে।

একপক্ষের দাবী - শ্রীরাম কখনো মাংস ভক্ষণ করেননি,

আবার অন্য আরেক পক্ষের মত হলো - শ্রীরাম মাংস ভক্ষণ করেছেন। 

এখানে বিচার করলে দেখা যায় যে, রামায়ণে মাংস ভক্ষণ নিয়ে যে সব শব্দপ্রমাণ পাওয়া যায়, সে সবকিছু কে প্রক্ষিপ্ত ঘোষণা করে দেয় প্রথমপক্ষ। অর্থাৎ যেখানে মাংস ভক্ষণের বা মৃগয়া করবার উল্লেখ পাওয়া যায়, সেই শব্দপ্রমাণকে প্রক্ষিপ্ত(পরবর্তীকালের সংযোজন) বলেই দাবী করেন পূর্বপক্ষ।

কিন্তু, আমার কথা হল - রামায়ণের একটি অংশকে আপনি মান্য করতে পারছেন, অথচ ঐ রামায়ণেরই অন্য যে অংশে মাংস ভক্ষণের উল্লেখ করা হয়েছে সেই অংশকে অস্বীকার করছেন! – এটি কি কোনো ন্যায় সঙ্গত বিচার হতে পারে ?

রামায়ণে মধ্যে শ্রীরামের ফল-মূল, মধু ইত্যাদির মাধ্যমে জীবন ধারণ করবার কথা উল্লেখ থাকলেও আবার মৃগয়া করা, বরাহ, রুরু, পৃষত, গোধা ইত্যাদি পশুর উল্লেখ পাওয়া যায়, যা শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ বধ করেছিলেন। যেখানে কিছু নিজেদের ভক্ষণের উদ্দেশ্যে, কিছু ধর্ম কার্যের উদ্দেশ্যে, কিছু কুঠিরে আগত ঋষি-মুনিদের ভোজন করানোর উদ্দেশ্যে।  এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল নিচের প্রবন্ধে । সমগ্র প্রবন্ধ টি পড়বার পরে নিজের যুক্তি ও নিরপেক্ষ বিচার কাজে লাগিয়ে নিজেই সত্য চয়ন করুন। 


বিষয় - শ্রীরামচন্দ্রের মাংস আহার


 যে শ্লোকবাক্যকে দৃশ্যমান করে পূর্বপক্ষ দাবী করে যে, শ্রীরাম মাংস আহার করেননি তা দেখে নেওয়া যাক —

চতুর্দশ হি বর্ষাণি বৎস্যামি বিজনে বনে।
মধু মূল ফলৈঃ জীবন্ হিত্বা মুনিবদামিষম্।। ২৯
[বাল্মিকী রামায়ণ/অযোধ্যাকাণ্ড/২০ সর্গঃ/২৯]

অর্থ  শ্রীরাম বলছেন, আমি বনে বাস করবো ১৪ বছরের জন্য। ফল-মূল, মধু দ্বারা জীবন ধারণ করবো এবং মুনির ন্যায় আমিষ ত্যাগ করবো।।

অর্থাৎ উক্ত শ্লোক থেকে তো শব্দ প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মুনির ন্যায় আমিষ ত্যাগ করে বনবাসের জীবন কাটাবেন। 

কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন আছে! তাহলো শ্রীরাম যদি আমিষ ত্যাগ পূর্বক ১৪ বছর বনবাসের জীবন অতিবাহিত করেন তবে, উক্ত রামায়ণে যেখানে বরাহ, ঋষ্য, মহারুরু, পৃষত, গোধা, কৃষ্ণমৃগ ইত্যাদি পশুকে বধ করা এবং ভক্ষণ করার যে শব্দপ্রমাণ পাওয়া যায় তা উক্ত শ্লোকাংশ "হিত্বা মুনিবদামিষম্" দ্বারা বিরোধ ঘটে। অর্থাৎ শাস্ত্র নিজেই নিজের বিরোধীতা করছে। তাহলে এখানে মীমাংসা কি হবে ?

এখানে "হিত্বা মুনিবদামিষম্" এই পদের মধ্যেই মীমাংসার মূল চাবি লুকিয়ে আছে। তাহলে উক্ত শ্লোকে আবার নজর দেওয়া যাক। উক্ত শ্লোকে দ্বিতীয় বাক্যের প্রথম অংশে বলা আছে যে—

"মধু মূল ফলৈঃ জীবন্" 

অর্থাৎ মধু, মূল, ফল দ্বারা জীবন বাহিত করা। অর্থাৎ এটা একটা প্রতিজ্ঞার মতো হয়ে গেলো যে শ্রীরাম ১৪ বছর মধু, ফল, মূল দ্বারা জীবন নির্বাহ করবেন। এই বাক্যের অর্থ কি শ্রীরাম ১৪ বছর মধু, ফল, মূল দ্বারা জীবন নির্বাহ করবেন ? এর বাইরে আর যা আছে তা কি তিনি গ্রহণ করবেন না?
যদি তাই হয় তাহলে আমি একটি প্রশ্ন করে জিজ্ঞাসা করছি শ্রীরাম ১৪ বছর জলও পান করবেন না!! কারণ, পূর্বপক্ষের যুক্তি অনুযায়ী, শ্রীরাম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সেটিই পালন করবেন, তাহলে এখানে তো জলের কথা উল্লেখ নেই কেবল, মধু, ফল, মূলের কথায় বলা আছে।
কিন্তু উক্ত শ্লোকে এমনও বলা নেই যে —

"মধু মূল ফলৈঃ এব জীবন্

অর্থাৎ একমাত্র মধু, মূল ও ফল দ্বারাই জীবন বাহিত করবো, উক্ত শ্লোকে এমন শব্দপ্রমাণ নেই। উক্ত শ্লোকে বলা আছে - আমি মধু, মূল ও ফল দ্বারা জীবন বাহিত করবো। তার মানে এই নয় যে শুধু এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো। কারণ, এমন হলে যেখানে মাংস ভক্ষণের উল্লেখ পাওয়া যায়, তার দ্বারা এই বাক্যের বিরোধ ঘটবে। যেহেতু শ্রীরাম একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য বনে বাস করবেন তাই স্বাভাবিক যে শ্রীরামের সব ধরনের বন্য আহারের উপর জীবন নির্ভর করতে হবে। তাই শ্রীরাম বলছে আমি মধু, মূল ও ফল দ্বারা জীবন অতিবাহিত করবো। কিন্তু, তার মানে এই নয় যে, শ্রীরাম কখনো মাংস আহার করবেন না। এখানে এমন প্রমাণ নেই বললেই চলে।
তাহলে এবার অনেকে এটাই বলবে যে, "হিত্বা মুনিবদামিষম্" উক্ত শব্দ প্রমাণ দ্বারা তো এটাই প্রমাণ হয় যে, শ্রীরাম আমিষ ত্যাগ করবেন বলেছেন। তাহলে, এখানে স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, শ্রীরাম মাংস আহার করেননি।

হ্যাঁ এটা ঠিক যে, উক্ত শ্লোকে বলা আছে আমিষ ত্যাগ করার কথা। কিন্তু, এখানে আমিষ বলতে কি মাংস কে বুঝিয়েছে নাকি অন্যকিছু ?
তা দেখে নেওয়া দরকার উক্ত শ্লোকে দ্বিতীয় বাক্যের পরবর্তী অংশে কি বলা আছে — 

"হিত্বা মুনিবদ্ আমিষম্

অর্থাৎ বনবাসী মুনির ন্যায় আমিষ ত্যাগ পূর্বক। এখানে কিন্তু এটা উল্লেখ করেনি যে, আমিষ অর্থে মাংস বুঝিয়েছে নাকি অন্যকিছু ! এখানে জানার বিষয় হলো, শ্রীরাম যখন রাজ্য ছেড়ে বনবাসে গিয়েছিলেন, তখন সম্পূর্ণরূপে একজন যোগীর ন্যায় বেশভূষা ও আচরণ ছিলো। তাহলে একজন যোগী/মুনি যেভাবে বনের মধ্যে জীবন নির্বাহ করে, ঠিক একই ভাবে শ্রীরামও জীবন নির্বাহ করার কথাই বলছিলেন। 
তাহলে দেখার বিষয় হলো, একজন যোগী/মুনির স্বভাব কেমন হয়। আর শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে জানা যায় একজন যোগী/মুনির স্বভাব হয়, কামনাবাসনা থেকে মুক্ত।

উক্ত বাক্যে যেখানে বলা আছে "হিত্বা মুনিবদামিষম্" এখানে আমিষ বলতে কি বোঝানো হয়েছে তাও দেখার বিষয়। উক্ত আমিষ শব্দ নিয়ে কোষ গ্রন্থে বলা আছে—

"উপাদানেহপ্যাভিষং স্যা"
[অমরকোষ/নানার্থ বর্গঃ/৬৮৩]

অর্থাৎ আমিষ অর্থে উপাদান প্রভৃতি বুঝায়। এখানে উপাদান বলতে, মাংসও বোঝায় আবার ভোগ্যবস্তুও বোঝায়। 

সংস্কৃত শব্দকোষ দ্বারা আমিষ শব্দের অর্থ হলো —

১. Non vegetarian food...
২. Desire..

অর্থাৎ এখানেও আমিষের অর্থ হয় মাংস এবং কামনাবিষয়বস্তু।

আবার বৈদিক শব্দকোষে আমিষের অর্থে বলা হয়েছে—

১.ফল
২. মাংস

এখানে ঋগবেদের একটি প্রমাণ উপস্থাপন করে আমিষ দ্বারা দুই অর্থ বোঝানো হয়। উক্ত ঋগবেদে রয়েছে—

"ন্যূংখয়ন্তে অধি পক্ক আমিষি"
[ঋগ্বেদ সংহিতা/১০/৯৪/৩] 

উক্ত আমিষ শব্দে এখানে, ফলকেও বোঝানো হয়েছে আবার মাংসকেও বোঝানো হয়েছে।

উণাদিকোষ গ্রন্থে আমিষ অর্থে বলেছে —


"অমের্দীর্ঘ‌শ্চ" [১.৪৬]

পদ০ অমেঃ ৫.১, দীর্ঘঃ ১.১, চ - অব্য০ ।

অনু০ - 'অবিমহ্যোষ্ট‌িষচ্‌' (উণাদি সূত্র/১.৪৫) দ্বারা 'টিষচ্‌' -এর অনুবর্তন ।

সং০ - অম ইত্যেতস্মাদ্‌ ধাতোঃ টিষচ্‌ প্রত্যয়ো ভবতি, ধাতোঃ স্থানে দীর্ঘাদেশশ্চ

ব্যাখ্যা - অমেঃ এটি পঞ্চম্যন্ত পদ। ধাতু কে দীর্ঘ আদেশ বলা হয়েছে। অতঃ 'অতশ্চ' পদ উপলব্ধ হয় ।
অম্‌ ধাতুর অচ্‌ (অকার) -এর স্থানে দীর্ঘ আদেশ (আকার) হয় ।

অর্থ - অম্‌ ধাতুর দ্বারা টিষচ্‌ প্রত্যয় হয় আর ধাতুর অচ্‌ -এর দীর্ঘ আদেশ হয় ।

স্বা০দ০ বৃ০ - টিষচ্‌ [ধাতোর্দীর্ঘ‌শ্চ] অমন্তি গচ্ছন্তি যেন তৎ আমিষং মাংসাং বা । অথবাঽমন্তি রোগিণো ভবন্তি যেন ভক্ষিতেন তদামিষম্‌, ইত্যেকার্থঃ ।

উক্ত উণাদিকোষ থেকে আমিষের অর্থে এটাই জানা যায় যে, আমিষ অর্থ উপলক্ষ্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ আমিষ অর্থে মাংসকে বোঝায় আবার আমিষ অর্থে এমনকিছু বোঝায় যা ভক্ষণে মানুষ অসুস্থ হয়।

তাহলে উক্ত শ্লোক দ্বারা দুটো অর্থ বের হয়, পূর্বপক্ষ(কট্টর নিরামিষবাদী) -দের কথা অনুসারে
যদি আমিষ শব্দের অর্থ এখানে শুধুমাত্র মাংস ই হয়,
 তবে —

চতুর্দশ হি বর্ষাণি বৎস্যামি বিজনে বনে।
মধু মূল ফলৈঃ জীবন্ হিত্বা মুনিবদামিষম্।।

[বাল্মিকী রামায়ণ/অযোধ্যাকাণ্ড/২০ সর্গঃ/২৯]

অর্থ   শ্রীরাম বলছেন, আমি ১৪ বছরের জন্য বনে বাস করবো। ফল-মূল, মধু দ্বারা জীবন ধারণ করবো এবং মুনির ন্যায় মাংস আহার ত্যাগ করবো।। --- এমন অর্থ বের হয়।


আর যদি উত্তরপক্ষ অনুসারে
 আমিষ শব্দের অর্থ কামনাযুক্ত ভোগ্যবিষয়বস্তু হয়,
তবে —
চতুর্দশ হি বর্ষাণি বৎস্যামি বিজনে বনে।
মধু মূল ফলৈঃ জীবন্ হিত্বা মুনিবদামিষম্।।

[বাল্মিকী রামায়ণ/অযোধ্যাকাণ্ড/২০ সর্গঃ/২৯]

অর্থ   শ্রীরাম বলছেন, আমি ১৪ বছরের জন্য বনে বাস করবো। ফল-মূল, মধু জাতীয় ইত্যাদি দ্বারা জীবন ধারণ করবো এবং মুনির ন্যায় কামনাযুক্ত ভোগ্যবিষয়বস্তু ত্যাগ করবো।।  --- এমন অর্থ বের হচ্ছে ।

তাহলে এখনে কোনটা উপযুক্ত তা সবার কাছেই পরিস্কার হয়ে গেলো।

কারণ, আমি যদি প্রথম অর্থকে নিয়ে বলি যে রামচন্দ্র মাংস না খাওয়ার কথা বলেছিলেন বনবাসের পূর্বে , তাহলে এখানে শ্রীরামের ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন উঠে আসে, কারণ বনবাসের সময়ে  শ্রীরাম বহু পশুর মাংস ভক্ষন করেছিলেন । তাই পূর্বপক্ষের অর্থ গ্রহণ করলে শ্রীরামের উপর প্রশ্ন উঠে যাবে।
 যেমন ধরুন, শ্রীরাম কি ১৪ বছরে জল পান করেননি! কারণ উক্ত শ্লোকে জলের উল্লেখ নেই। তাহলে জল ছাড়া ১৪ বছর তারা কীভাবে ছিলেন ?
১৪ বছর একটানা কেবল ফল, মূল এবং মধু দ্বারা কীভাবে জীবন ধারণ সম্ভব হবে ??
আমি এটা মেনে নিলাম বনের মধ্যে ফলমূলাদির অভাব হয় না কিন্তু, একটা ভাবনার বিষয় হল যে সারাবছরই কি ফল পাওয়া যাবে ??
বা রোজ মধু সংগ্রহ করাও কি সম্ভব? বা একটানা ১৪ বছর মূল দ্বারাও জীবন নির্বাহ করা কি সম্ভব ??
এখানে হয়তো অনেকে বলবে যে রাম সাক্ষাৎ ভগবান তাহলে, উনার দ্বারা এসব অসম্ভব এর কিছুই নয়।

এক্ষেত্রে তাদের একটি বিশেষ কথা স্মরণ করিয়ে দিই - 
আমরা জানি শ্রীরাম হলেন ভগবান বিষ্ণুর অবতার, তাই সেক্ষেত্রে শ্রীরাম ভগবান - তা ঠিক কথা। কিন্তু, উনি যখন রাবণকে বধ করার উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে অবতারিত হয়েছেন তখন উনি একজন মানবরূপেই লীলা করছেন। তাই এক্ষেত্রে শ্রীরামকে একজন মানুষের ন্যায় মনে করাটাই যুক্তিসঙ্গত হবে। কেননা মানব দ্বারাই রাবণ বধ সম্ভব, অন্যথায় নয়। তাই এখানে প্রশ্ন উঠে আসে যে, মানবরূপে লীলা করা অবস্থায় শ্রীরাম ১৪ বছর জল ছাড়া, কেবল ফল, মূল, মধু দ্বারা কীভাবে জীবন নির্বাহ করবে ?

কারণ জল ছাড়া যদি ১৪ বছর থাকতেই পারে তাহলে শ্রীরাম এমন কেন বলছে যে, উনি ১৪ বছর বনের মধ্যে ফল, মূল, মধু দ্বারা জীবন বাহিত করবে। তার তো কোনো খাবারেরই দরকার নেই। তাহলে শ্রীরাম খাদ্য গ্রহণ করার কথা কেন বললেন ?

এর কারণ হলো ভগবান বিষ্ণু রাম অবতার নিয়ে পৃথিবীতে মানব রূপে লীলা করছেন। তাই শ্রীরাম সম্পূর্ণ নিয়ম মেনেই সব করছেন। সকল কিছুর মর্যাদা বজায় রাখছেন। তাই শ্রীরামকে মর্যাদা পুরুষোত্তম বলা হয়। 
তাই এক্ষেত্রে একজন মানুষ যেভাবে জীবন অতিবাহিত করে, সেরূপ শ্রীরামও একই ভাবে জীবন নির্বাহ করার কথাই উক্ত শ্লোকে বলছিলেন। 


এবার যদি দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করি তাহলে এক্ষেত্রে দেখা যায় শ্রীরাম মাতা কৌশল্যাকে এরূপ বলছেন যে- আমি ১৪ বছর বনে বাস করবো। এবং জীবন নির্বাহ করার জন্য, ফল, মুল, মধু ইত্যাদি বন্য উপাদান গ্রহণ করবো। এবং একজন মুনির ন্যায় সকল কামনাযুক্ত ভোগ্যবস্তু পরিত্যাগ করবো। 
একজন যোগী/মুনির স্বভাবই হয় কামনাবাসনা মুক্ত, অল্পতেই সন্তুষ্ট এবং উপলব্ধ বস্তু দ্বারাই জীবন নির্বাহ করেন। তাই শ্রীরাম বলেছেন "হিত্বা মুনিবদ্ আমিষম্" অর্থাৎ একজন মুনির ন্যায় কামনাবাসনা যুক্ত ভোগ্যবস্তু পরিত্যাগ পূর্বক জীবন অতিবাহিত করবো।
রাম যখন বনে গমণ করেন তখন তার পরনে ছিলো, গেরুয়া বস্ত্র, রুদ্রাক্ষ। যা একজন মুনির ব্যক্তিত্বকে দর্শায়। 

রামায়ণ অনুষ্টপ ছন্দে রচিত অর্থাৎ ৩২ অক্ষর শ্লোক বিশিষ্ট। তাহলে অনুষ্টপ ছন্দ অনুযায়ী উক্ত শ্লোক ৪ চরণ ও প্রতি চরণে ৮ অক্ষর বিশিষ্ট হবে। তাহলে চরণ গুলোর বর্গীকরণ হবে কিছুটা এমন—

"চতুর্দশ হি বর্ষাণি"— অর্থাৎ সময়কে বোঝানো হচ্ছে। 

"বৎস্যামি বিজনে বনে"— থাকার স্থান বোঝানো হচ্ছে।

"মধু মূল ফলৈঃ জীবন্"— যেসব বন্য দ্রব্য দ্বারা জীবন নির্বাহ করবে তা বোঝায়।

"হিত্বা মুনিবদ্ আমিষম্"— কামনাযুক্ত ভোগ্যবিষয়বস্তু ত্যাগ করা মুনির ন্যায় বোঝায়।

এটাই হয় উক্ত শ্লোকের মূল অর্থ। এখন যদি এখানে যদি বলা হয় মাংস আহার ত্যাগ করার কথা বলা হয়েছে তাহলে এই কথার কোনো যুক্তি সঙ্গত অর্থই হয় না।
এখানে প্রথম চরণ দ্বারা শ্রীরাম সময়কে নির্দেশ করে বলছেন কতদিনের জন্য বনে যাচ্ছেন। 
দ্বিতীয় চরণে শ্রীরাম বলছেন থাকার স্থান। 
তৃতীয় চরণে শ্রীরাম বলছেন যেসব খাদ্যের দ্বারা জীবন নির্বাহ করবেন তার কথা। 
এবং চতুর্থ চরণে বলছে একজন মুনির ব্যক্তিত্ব যেমন ঠিক সেইভাবে থাকবার কথা। 

তাহলে এখানেই এই অর্থ হয় না যে মুনি কেবল মাংস আহার ছাড়াই জীবন নির্ধারণ করেন। না, এটা কদাপি নয়। কেননা মুনির চরিত্র হয় সকল বিষয়াসক্ত থেকে মুক্ত। সাধারণ জীবন, অল্পতেই সন্তুষ্ঠ। ঠিক এই কথাটাই শ্রীরাম বলেছেন আমি একজন বিষয়াসক্তির থেকে মুক্ত মুনির ন্যায় জীবন কাটাবো। 

তাহলে সম্পূর্ণ শ্লোকের সঠিক অর্থ হয়—

চতুর্দশ হি বর্ষাণি বৎস্যামি বিজনে বনে।
মধু মূল ফলৈঃ জীবন্ হিত্বা মুনিবদামিষম্।।

[বাল্মিকী রামায়ণ/অযোধ্যাকাণ্ড/২০ সর্গঃ/২৯]

অর্থ   শ্রীরাম বলছেন, আমি ১৪ বছরের জন্য বনে বাস করবো। ফল-মূল, মধু জাতীয় ইত্যাদি দ্বারা জীবন ধারণ করবো এবং মুনির ন্যায় কামনাযুক্ত ভোগ্যবিষয়বস্তু ত্যাগ করবো।।

তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রথম অর্থ গ্রহণ করলে অর্থাৎ আমিষের অর্থে মাংস শব্দ গ্রহণ করলে যে একটা বিরোধ দেখা যায় ও শ্রীরামের উপর যে প্রশ্নগুলো উঠে আসতো তা এক্ষেত্রে হছে না এবং উক্ত শ্লোকের মীমাংসা হওয়াও সম্ভব হয়েছে।

তাই এখানে শ্রীরামের মাংস গ্রহণ করাটা মোটেও দোষের কিছুই হয় না ৷ 
কেননা, উনি মানব রূপে লীলা করছেন। আর দ্বিতীয়ত উনি, বনে বাস করতে গেছেন একটি দীর্ঘ সময়ের জন্য। আর শাস্ত্রেও বলা আছে জীবন নির্বাহ করার জন্য মাংস আহার করা যাবে এতে কোনো দোষ আরোপিত হবে না। অগস্ত্য আদি অনেক মুনিরা মৃগ, পক্ষি ইত্যাদি দ্বারা জীবন নির্বাহ করেছিলেন। তাই এক্ষেত্রে শ্রীরামের মাংস আহার করা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। 

খুবই সাধারণ একটি উদাহরণ দ্বারা বিষয়টি বোঝাচ্ছি—
সাধারণত কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে যদি তার গৃহে ভোজনের জন্য নিমন্ত্রণ করে, তবে সে ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে এটিই বলে যে - "আজ দয়া করে আমার গৃহে দুটো ডাল ভাত গ্রহণ করবেন" এখন তাহলে ডাল ভাতের এই অর্থই কি হয়, শুধুমাত্র দুটি ভাতের কণা দ্বারা শুধুমাত্র ডাল দ্বারাই ভোজের নিমন্ত্রণ সম্পন্ন করবে ?
বা কোনো ব্যক্তি যখন অন্য কোনো ব্যক্তির খোঁজখবর জিজ্ঞেস করে সেখানেও অনেকে এটিই বলে - "এই দুটো ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে আছি" 
তাহলে কি এখানেও এই অর্থ ধরে নেব যে, সেই ব্যক্তি শুধুমাত্র ডাল আর দুটি ভাতের কণা খেয়েই বেঁচে আছে ?

এখন উপরের দুটি উদাহরণে শুধুমাত্র ডাল আর ভাতের উল্লেখ করা আছে, এখানে কিন্তু জলের উল্লেখ করা নেই। তার অর্থ কি এই যে, যাকে ভোজনের জন্য নিমন্ত্রণ করা হয়েছেম, তাকে জল প্রদান করা হবে না! বা যিনি বললেন দুটো ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে আছে্ন, তিনিও জল পান করেন না কেবল, ডাল আর ভাত খেয়েই বেঁচে আছে! এমনটাও কি হয় কখনো ?

আসলে এখানে মূল বিষয় টা বুঝতে হবে। এখানে যে ডাল ভাতের উল্লেখ করা হলো তা উপমা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু, যে ব্যক্তি নিমন্ত্রণ করলেন তিনি তো শুধুমাত্র ডাল আর ভাত দিয়ে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিকে আপ্যায়ণ করবেন এমন তো নয় ! উনি নিজের সামর্থ্য অনুসারে উপযুক্ত ব্যবস্থা করবেন। তেমনই অন্য দিকে যে ব্যক্তি বললেন এই দুটো ডাল ভাত খেয়েই বেঁচে আছি, তিনিও নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী খেয়ে পড়েই বেঁচে আছেন। কিন্তু দুদিকেই বলার ধরণটা এমন না যে, কেবল ডাল ও দুটি ভাতের দানার উপর নির্ভর।

তাহলে এখানেও এই বিষয় টি উপমার আলঙ্কারিক অর্থ হিসেবে বুঝতে হবে । শ্রীরাম যখন বললেন "মধু, মূল ও ফল" দ্বারা জীবন নির্বাহ করবে তার মানে এই নয় যে, শ্রীরাম কেবল মধু, ফলমূল খেয়েই জীবন ধারণ করবেন। উনি এটা বোঝানোর উদ্দেশ্যেই বললেন উক্ত কথাটা। কারণ বনে সাধারণত এসব বস্তুই উপলব্ধ।

🔴এই আমিষ প্রসঙ্গে আরও একটু পরিস্কার ভাবে বলা যাক—

জালন্ধর উবাচ—
কিমসি, শূলিনো, গেহে রত্নজাতং মহামুনে।
তন্মমাচক্ষু সকলং নাস্তি যুদ্ধং নিরামিষম্।। ২।।

[পদ্মপুরাণ/উত্তরখণ্ড/অধ্যায় ১০/২]

অর্থ  হে মহামুনে! শূলপাণির গৃহে কি কি রত্ন আছে, তৎসমূদর আমার নিকট ব্যক্ত করুন। নিরামিষ যুদ্ধ কখনো সম্ভব নহে।।

তাহলে এবার এখানে কি অর্থকে ঘুরিয়ে ধরে নেবো যে, এখানে নিরামিষ অর্থে জলন্ধর শাক-সবজি জাতীয় খাদ্যকে বোঝাচ্ছে ? কারণ এখানেও তো নিরামিষ উল্লেখ আছে ! 

আসলে এখানে নিরামিষ বলতে ভোগ্যবিষয়মুক্ত অবস্থা বোঝানো হয়েছে। তাই জালন্ধর বলছেন যে রুদ্রের ঘরে ধন রত্ন আছে কি না সেটি বলো। কারণ, যেখানে ভোগ্যবস্তু উপলব্ধ হবে না সেই যুদ্ধ অর্থহীন। 
তাই এখানে বিষয়টা বুঝতে হবে যে, কেন কথাটা বলা হচ্ছে! কারণ একদিকে দেখা যাচ্ছে শ্রীরাম, মাংসের স্বাদ বলে দিচ্ছেন, বিভিন্ন প্রকার হরিণ শিকার করছে, রান্না করছে, আথিতেয়তা গ্রহণ করছেন, আবার অন্যদিকে দেখাযাচ্ছে রাম বলছে আমিষ ত্যাগ করবো, তাই এখানে নিরপেক্ষ ভাবে বিষয়টা বিচার করতে হবে। কারণ এসব শব্দ প্রমাণ একেবারে মিথ্যা বা প্রক্ষিপ্ত হয় না। উপরের প্রমাণ থেকে স্পষ্ট ভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে - আমিষ এবং নিরামিষ অর্থে স্থান কাল পাত্র ভেদে কামনাযুক্ত ভোগ্যবিষয়বস্তুকে বোঝায়।।

তাহলে এবার দেখে নেওয়া যাক কিছু প্রমাণ যেখানে বলা আছে, মাংস আহার ও প্রদান, মৃগয়া করার কথা। 
রামায়ণের প্রথম প্রমাণে বলা আছে যেখানে দেবী সীতা মাতা গঙ্গাকে, সুরা মাংসভাত দ্বারা অর্চ্চনা করার উল্লেখ রয়েছে —

সুরাঘটসহস্রেণ মাংসভূতৌদনেন চ।
যক্ষ্যে ত্বাং প্রীয়তাং দেবি পুরীং পুনরুপাগতা।। ৮৯

[বাল্মিকী রামায়ণ/অযোধ্যাকাণ্ড/৫২ সর্গঃ/৮৯]

অর্থ   হে দেবী গঙ্গা প্রসন্ন হও! আমার পতি ও দেবর অযোধ্যায় ফিরে এলে তোমাকে সহস্র কলস সুরা ও মাংস যুক্ত পলান্ন (মাংস ভাত) দ্বারা তোমার অর্চ্চনা করবো।।

উক্ত শ্লোকে কি বলা আছে দেখুন। ওখানে বলা হয়েছে "মাংসভূতৌদনেন চ" অর্থাৎ মাংস-ঘি-ভাত একসাথে রান্না করে প্রদান করবে, যাকে পলান্ন বা পোলাও বলা হয়। দেবী সীতা এরূপ বচন দিয়েছিলেন মাতা গঙ্গাকে যে, শ্রীরাম অযোধ্যাতে আবার ফিরে এলে, হাজার কলস সুরা, ও ঘি, মাংস সমন্বিত পোলাওভাত রান্না করে তার দ্বারা মাতা গঙ্গার অর্চ্চনা করবে।

পরবর্তীতে দেখে নেবো আসলেই কি শ্রীরাম, লক্ষ্মণ ও সীতা মাংস গ্রহণ করেছেন নাকি না।

এবার পরবর্তী প্রমাণে দেখে নেবো যেখানে বলা আছে যে, 
শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ বহুপ্রকারের হরিণ বধ করেন এবং তা আহার করেন। 
তবে দেখে নেওয়া যাক —

তৌ তত্র হত্বা চতুরো মহামৃগান্
বরাহমৃশ্যং পৃষতং মহারুরুম্

আদায়
মেধ্যং ত্বরিতং বুভুক্ষিতৌ
বাসায় কালে যযতুর্বনস্পতিম্ ।। ১০২

[বাল্মিকী রামায়ণ/অযোধ্যাকাণ্ড/৫২ সর্গঃ/১০২]

অর্থ   অনন্তর রাম সুসমৃদ্ধ সস্যবহুল বৎস দেশে উপস্থিত হয়ে লক্ষ্মণের সহিত বরাহ, ঋষ্য, পৃষত ও মহারুরু এই চার প্রকার মৃগ বধ করলেন এবং উহাদের পবিত্র মাংস গ্রহণ পূর্ব্বক সায়ংকালে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত্ত হয়ে বনমধ্যে প্রবিষ্ট হলেন।

এখানে পরিস্কার ভাবেই বলা আছে "হত্বা চতুরো মহামৃগান্‌" এর অর্থ হয় - চার প্রকারের হরিণ বধ করেছে। এবং সেই হরিণ গুলোর মাংস ভক্ষণ করেছে। অর্থাৎ এখানে এবিষয়টা দিনের আলোর মতো পরিস্কার যে শ্রীরাম মাংস আহার করেছিলেন। কিন্তু মাংস আহার কেন করেছেন তা ধীরে ধীরে প্রকাশ করা হবে। 

এবার পরবর্তী প্রমাণে কি বলা আছে তা দেখে নেব —

ক্রোশমাত্রং ততো গত্বা ভ্রাতরৌ রামলক্ষ্মণৌ।
বহুন্ মেধ্যান্ মৃগান্ হত্বা চেরতুর্যমুনাবনে।। ৩২
[বাল্মিকী রামায়ণ/অযোধ্যাকাণ্ড/৫৫ সর্গঃ/৩২]

অর্থ   অনন্তর রাম ও লক্ষ্মণ তথা হইতে ক্রোশ মাত্র গমন পূর্ব্বক বহুসংখ্য পবিত্র মৃগ বধ করিয়া বনমধ্যে ভোজন করিলেন এবং মাতঙ্গসঙ্কুল বানরবহুল বিপিনে মুখে বিচরণ করিয়া নিশাকালে সমতল নদীতীরে আশ্রয় লইলেন।।

দেখুন এখানেও বলা আছে "বহুন্‌ মেধ্যান্‌ মৃগান্‌ হত্বা" অর্থাৎ বহু সংখ্যক হরিণ বধ করলো। "হত্বা" অর্থ হত্যা বা বধ করা। তারমানে এখানেও দেখা যায় শ্রীরাম মাংস আহার করেছিলেন।

এবার পরবর্তী প্রমাণের দিকে যাওয়া যাক—

তাং নিষ্ঠিতাং বন্ধকটাং দুট্টা রামঃ সুদর্শনাম্।
শুশ্রূষমাণমেকাগ্রমিদং বচনমব্রবীৎ।। ২১

সুন্দর শক্ত কাষ্ঠ-নির্মিত দৃঢ়ভিত্তি পর্ণকুটীর দেখে, একান্ত নিষ্ঠাবান সেবাপরায়ণ সুদর্শন লক্ষ্মণকে রাম বললেন —

ঐণেয়ং মাংসমাহৃত্য হালাং যক্ষ্যামহে বয়ম্।
কর্তব্যং বাস্তুশমনং সৌমিত্রে চিরজীবিভিঃ।। ২২
মৃগং হত্বাহহনয়
ক্ষিপ্রং লক্ষ্মণেহ শুভেক্ষণ।
কর্তব্যঃ শাস্ত্রদৃষ্টো হি বিধিধর্মমনুস্মর।। ২৩
ভ্রাতুর্বচনমাজ্ঞায় লক্ষ্মণঃ পরবীরহা।
চকার চ যথোক্তং হি তং রামঃ পুনরব্রবীৎ।।২৪
ঐপেয়ং শ্রপয়দ্বৈতচ্ছালাং যক্ষ্যামহে বয়ম্।
ত্বর সৌম্যমুহূর্তোহয়ং ধ্রুব দিবসো হায়ম্।। ২৫
স লক্ষ্মণঃ
কৃষ্ণ মৃগং হত্বা মেধ্যং প্রতাপবান্।
অথ চিক্ষেপ সৌমিত্রিঃ সমিন্ধে জাতবেদসি।। ২৬
তৎ তু পক্ষং সমাজ্ঞায় নিষ্টপ্তং হিন্নশোণিতম্।
লক্ষ্মণঃ পুরুষব্যাঘ্রমথ রাঘবমব্রবীৎ।। ২৭
অয়ং
সর্বঃ সমস্তাঙ্গঃ শূতঃ কৃষ্ণমৃগো ময়া।
দেবতা দেবসংকাশ যজস্ব কুশলো হাসি।।২৮

[বাল্মিকী রামায়ণ/অযোধ্যা কাণ্ড/৫৬ সর্গঃ/২১-২৮]

অর্থ   এক্ষণে আমাদিগকে মৃগমাংস আহরণ করিয়া গৃহযাগ করিতে হইবে। যাঁহারা বহুদিন জীবন ধারণের বাসনা করেন, তাঁহাদিগের বাস্তুশান্তি করা আবশ্যক। অতএব তুমি অবিলম্বে মৃগবধ করিয়া আন। শাস্ত্রনির্দিষ্ট বিধি পালন করা সর্ব্বতোভাবেই শ্রেয় হইতেছে। তখন লক্ষণ বন হইতে মৃগবধ করিয়া আনিলেন। তদ্দর্শনে রাম পুনরায় তাঁহাকে কহিলেন, বৎস! তুমি গিয়া এই মৃগের মাংস পাক কর; আমি স্বয়ংই বাস্তুশান্তি করিব। দেখ, অদ্যকার দিবসের নাম ধ্রুব এবং এই মুহূর্তও সৌম্য, অতএব তুমি এই কার্য্যে যত্নবান হও। তখন লক্ষ্মণ প্রদীপ্ত বহ্নিমধ্যে পবিত্র মৃগ-মাংস নিক্ষেপ করিলেন এবং উহা শোণিতশূন্য ও অত্যন্ত উত্তপ্ত হইয়াছে দেখিয়া, রামকে কহিলেন আর্য্য! আমি এই সর্ব্বাঙ্গপূর্ণ কৃষ্ণবর্ণ মৃগ অগ্নিতে পাক করিয়া আনিলাম, আপনি এক্ষণে গৃহযাগ আরম্ভ করুন।।

অর্থাৎ এখানেও পরিস্কার শব্দ প্রমাণ পাওয়া যায় হরিণ শিকার করা এবং তার মাংস রান্না করার। তাহলে এখানেও দেখা যাচ্ছে পরোক্ষ ভাবে রান্না করা সেই মাংস তারা গ্রহণ করেছেন। কেননা উপরের প্রমাণ থেকে এটা স্পষ্ট যে শ্রীরাম মাংস গ্রহণ করেন। "কৃষ্ণ মৃগং হত্বা মেধ্যং প্রতাপবান্" ইত্যাদি বাক্য দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে যজ্ঞের উদ্দেশ্যে হরিণ বধ করে তা অগ্নিতে রান্না করে গৃহযাগ কার্য সম্পন্ন করেন। এবং সেই মাংস দেবতার উদ্দেশ্যে বলি (উপাচারের একটা ভাগ) হিসেবে নিবেদন করে। আর শাস্ত্রে বলা আছে যজ্ঞাংশ, দেবতার উদ্দেশ্যে, পিতৃ কার্যের উদ্দেশ্যে প্রদান করা মাংস ভক্ষণ করা উচিত [মনুস্মৃতি/৫ অধ্যায়]। তাই এটাও পরোক্ষভাবে প্রমাণিত হয় শ্রীরাম মাংস আহার করেছেন।

এর পরবর্তী প্রমাণ দেখে নেব যেখানে নিষাদগণের রাজা গূহ ভরতকে মাংস, মাছ ও মধু নিবেদন করেন। তাহলে দেখে নেওয়া যাক—

ইত্যুস্বোপায়নং গৃহ্য মৎস্যমাংসমধূনি চ।
অভিচক্রাম ভরতং নিষাদাধিপতির্গুহ।।১০
অন্তি মূলফলং চৈতন্নিষাদৈঃ স্বয়মর্জিতম্।
আদ্রং শুঙ্কং তথা
মাংসং বন্যং চোচ্চাবচং তথা।।১৭।

[বাল্মিকী রামায়ণ/অযোধ্যা কাণ্ড/৮৪ সর্গঃ/১০/১৭]

অর্থ   নিষাদপতি জ্ঞাতিবর্গকে এই রূপ অনুমতি করে, মৎস্য, মাংস, ও মধু উপহার নিয়ে ভরতের নিকট গেলেন।
নিষাদেরা বন্য ফল মূল আহরণ করে রেখেছে, আদ্র ও শুষ্ক মাংস এবং অরণ্য সুলভ অন্যান্য খাদ্যও সংগৃহীত আছে, এই সকল গ্রহণ করুন।।

ভরত যখন শ্রীরামের খোঁজে বনে প্রবেশ করলেন, তখন ভরত একটা সময় পর জেলেদের রাজা গূহের রাজ্যে প্রবেশ করেন। এবং গূহ ছিলেন শ্রীরামের পরম মিত্র। সে সুবাদে রাজা গূহ, ভরতকে আথিতেয়তা ধর্ম পালনের জন্য, মাংস, মাছ এবং মধু নিবেদন করেন। এবং অথিতীর ধর্ম সেসব গ্রহণ করা। তাই এখানে দেখা যায় যে, ভরতও মাংস আহার করেছেন। এবং রাজা গূহ এও বলেছেন ভরতের সাথে আগত সৈন্যদের জন্য মাংস তথা অন্যান্য বন্য খাওয়ার আছে তা যেন ভরত গ্রহণ করেন। যাতে পরবর্তী যাত্রায় আহারের সমস্যা লঘু হয়। 

তারপর ভরত নিজের সৈন্যদের নিয়ে ঋষী ভরদ্বাজের আশ্রমে পৌঁছালেন। এবং সেই আশ্রমে পৌঁছে ভরত সহ সকল সৈন্যরা দেখলেন যে —

আজৈশ্চাপি চ বারাহৈর্নিষ্ঠানবরসঞ্চয়ৈঃ।
ফলনির্মূহসংসিন্ধৈঃ সূপৈর্গন্ধরসান্বিতৈঃ।। ৬৭
পুষ্পঙ্কজবতীঃ পূর্ণাঃ শুক্লস্যান্নস্য চাভিতঃ।
দদৃশুবিস্মিতান্তত্র নরা লৌহীঃ সহস্রশঃ।। ৬৮
বভূবুর্বনপার্শ্বেযু কৃপাঃ পায়সকর্দমাঃ।
তাশ্চ কামদুঘা গাবো ক্রমাশ্চাসন্ মধুচ্যুতঃ।। ৬৯
বাপ্যো মৈরেয়পূর্ণাশ্চ মৃষ্ট
মাংসচয়ৈবৃর্তাঃ।
 প্রতপ্তপিঠরৈশ্চাপি 
মার্গমায়ূরকৌক্কুটৈঃ।। ৭০

[বাল্মিকী রামায়ণ/অযোধ্যাকাণ্ড/৯১ সর্গঃ]

অর্থ  ভরতের সাথে আগত সকল সৈন্য দেখলেন যে, চারদিকে শুক্লান্নপূর্ণ স্বর্ণ ও রজতপূর্ণ বহু সংখ্যক পাত্র রয়েছে। ঐ সকল পাত্রে ফলের রসসিদ্ধ সুগন্ধি সূপ (ঝোল বিশেষ), উৎকৃষ্ট ব্যঞ্জন, ছাগ ও বরাহ মাংস রয়েছে। বনবিভাগস্থ কূপ সমূহে পায়েসের কর্দ্দম দৃষ্ট হলো তাদের। ধেনুগণ অভীষ্ট প্রদান এবং বৃক্ষ সকল মধু ক্ষরণ করতে লাগলো। পরিতপ্ত পিঠরপক্ক মৃগ, ময়ুর ও কুক্কুটের মাংসে এবং মদ্যে দিঘীসকল পরিপূর্ণ হয়েছে।।

ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রমে খাদ্যের কোনো অভাব ছিলো না। যেখানে ফলমূল থেকে শুরু করে, বিভিন্ন পশুর মাংস, ময়ুরের মাংস, বন্য মোরগের মাংস, পায়েস, দুধ, মধু এবং সুরা দিঘী ছিলো। সেই রাত ভরত তার সৈন্য সহ, ভরদ্বাজ ঋষির আশ্রমে অতিবাহিত করেন৷ পরবর্তী দিন সকালে, ঋষি ভরদ্বাজ যখন ভরতকে দেখলেন তখন বললেন —

কচ্চিদত্র সুখা রাত্রিস্তবাস্মদ্বিষয়ে গতা।
সমগ্রন্তে জনঃ কচ্চিদাতিথ্যে শংস মেহনঘ।।৩

[বাল্মিকী রামায়ণ/অযোধ্যাকাণ্ড/৯২ সর্গঃ]

অর্থ  'পূতচরিত্র ভরত! বলো, আশ্রমে তোমার রাত্রি সুখে অতিবাহিত হয়েছে তো! তোমার সঙ্গে আগত পরিজনেরা সকলে পরিতৃপ্ত তো ?

ঋষি ভরদ্বাজ ভরতকে জিজ্ঞেস করছে, উনার আশ্রমে সকলেই তৃপ্ত হয়েছে তো। অর্থাৎ রাত্রের আহার এবং নিদ্রা দ্বারা ভরত এবং তার সৈন্যরা তৃপ্ত হয়েছে কিনা তা জিজ্ঞেস করতে, তার প্রত্যুত্তরে ভরত বললেন —

তমুবাচাঞ্জলিং কৃত্বা ভরতোহভিপ্রণম্য চ।
আশ্রমাদুপনিষ্ক্রান্তমূষিমুত্তমতেজসম্ ॥ ৪
[বাল্মিকী রামায়ণ/অযোধ্যাকাণ্ড/৯২ সর্গঃ]

অর্থ  আশ্রমগৃহ থেকে বহিরাগত অত্যন্ত তেজস্বী সেই ঋষিকে প্রণাম করে ভরত করজোড়ে বললেন-

সুখোষিতোহস্মি  ভগবন্ সমগ্রবলবাহনঃ।
বলবত্তর্পিতশ্চাহং বলবান্ ভগবংস্তুয়া।। ৫

[বাল্মিকী রামায়ণ/অযোধ্যাকাণ্ড/৯২ সর্গঃ]

অর্থ  'ভগবন্! সৈন্যবাহিনী ও বাহনাদিসহ আমরা সকলে বনে খুব সুখেই বাস করলাম; আপনি আমাদের সকলকে পূর্ণরূপে পরিতৃপ্ত করেছেন।

ভরত এখানে ঋষি ভরদ্বাজকে এই স্বীকারোক্তি দিলেন যে, উনার আথিতেয়তায় ভরত সহ সৈন্যরা সকলে তৃপ্ত হয়েছে। এবং ভরত আরও বলছে যে —

অপেক্রমসন্তাপাঃ সুভিক্ষাঃ সুপ্রতিশ্রয়াঃ।
অপি প্রেষ্যানুপাদায় সর্বে স্ম সুসুখোষিতাঃ।। ৬

[বাল্মিকী রামায়ণ/অযোধ্যাকাণ্ড/৯২ সর্গঃ]

অর্থ  সেবকসহ সপরিজন আমাদের সকল ক্লান্তি দূরীভূত হয়েছে এবং উত্তম অন্নপানাদি দ্বারা আমরা সকলেই সবিশেষ পরিতৃপ্ত। উত্তম আশ্রয়ে আমরা সকলেই সুখে রাত্রি অতিবাহিত করেছি।

অর্থাৎ এখানে ভরত বলছে তারা সকলে ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রমে তৃপ্তি সহকারে অন্ন পানাদি গ্রহণ করেছেন। আর ঋষি ভরদ্বাজের আশ্রমে ফল থেকে শুরু মাংস, সুরা সবই বিদ্যমান ছিলো। তাই এখানে দেখা যায় ভরত নিজেই বলছেন তিনি সেসব নিজে গ্রহণ করেছেন এবং সৈন্যরাও গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ ভরতও মাংস আহার করেছেন।

এবার পরবর্তী প্রমাণে আসা যাক—

তাং তদা দর্শয়িত্বা তু মৈথিলীং গিরিনিম্নগাম্।
নিষসাদ গিরিপ্রন্থে সীতাং মাংসেন ছন্দয়ন্।। ১
ইদং মেধ্যমিদং স্বাদু নিষ্টপ্তমিদমগ্নিনা।
এবমান্তে স ধর্মাত্মা সীতয়া সহ রাঘবঃ। ২

[বাল্মিকী রামায়ণ/অযোধ্যাকাণ্ড/৯৬ সর্গঃ]

অর্থ   একদিন রাম সীতাকে পার্বত্য নদী দেখিয়ে নানাবিধ মাংসের দ্বারা সন্তুষ্ট করে সীতার সঙ্গে এক পার্বত্য শিলার উপর উপবেশন করলেন।
সীতাসহ উপবিষ্ট ধর্মাত্মা রাম সীতাদেবীকে বলতে লাগলেন- 'প্রিয়ে! এই ফলাদি পবিত্র, তথা সুস্বাদু মাংস অগ্নিতে পাক হচ্ছে।।

দেখুন কি বলা হচ্ছে- নানাবিধ মাংসের দ্বারা সন্তুষ্ট করলো দেবী সীতাকে। এবং এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে দেবী সীতাও মাংস আহার করেছেন।

এখানে বলা হচ্ছে "মেধ্যমিদং" অর্থাৎ উপাসনার নিমিত্তে বধ করা পশুর মাংস আগুনে পরিপাক করা। এবং আরও বলা হচ্ছে "স্বাদু" অর্থাৎ খেতে খুবই ভালো সুস্বাদু অর্থে। তাহলে এখানে একটা প্রশ্ন ওঠে আসে, তাহলো- শ্রীরাম যদি মাংস কখনো ভক্ষণ করে না থাকেন, তাহলে কীভাবে জানলো যে তা খেতে সুস্বাদু??
 স্বাভাবিকভাবেই না খেলে বস্তুটার স্বাদ সম্পর্কে কীভাবে জানবে ??
কেউ কি না খেয়ে খাবাবের স্বাদ বলতে পারবে! এটা কি সম্ভব??
অর্থাৎ এখানেও ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় যে শ্রীরাম মাংস আহার করেছেন। 

এবার দেখা যাক পরবর্তী প্রমাণে কি বলা আছে। দেবী সীতাকে অপহরণ করার জন্য রাবণ যখন সন্যাসীর বেশ ধারণ করে কুঠিরে আসেন, তখন দেবী সীতা ছদ্মবেশী রাবণকে বলেন—

সমাশ্বস মুহূর্তং তু শক্যং বস্তুমিহ ত্বয়া।। ২২
আগমিষ্যতি মে ভর্তা বন্যমাদায় পুষ্কলম্।
রুরুন্ গোধান্ বরাহাংশ্চ হত্নাহহদায়ামিষং বহু।। ২৩।

[বাল্মিকী রামায়ণ/অরণ্যকাণ্ড/৪৭ সর্গঃ/২২/২৩] 

অর্থ   হে দ্বিজগণ! যদি কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে ক্ষণকাল বিশ্রাম করুন। আমার স্বামী পর্যাপ্ত পরিমাণে বন্য ফল মূল এবং রুরু, বরাহ, গোধা হত্যা করে ও প্রচুর আমিষ গ্রহণ পূর্বক আগমন করবেন।।

সন্যাস বেশ ধারণকারী রাবণ ও দেবী সীতার কথোপকথনের একটা পর্যায়ের দেবী সীতা, সন্ন্যা‌সীবেশধারী রাবণকে বলেন, আপনি চাইলে আমার কুঠিরে থাকতে পারবেন। আমার স্বামী বন থেকে ফলমূল, রুরু, বরাহ, গোধা ও প্রচুর আমিষ জাতীয় খাদ্য নিয়ে কুঠিরে আসবেন। ততক্ষণ অপেক্ষা করার কথা দেবী সীতা ছদ্মবেশী রাবণকে বলেন। 

অর্থাৎ এখানে এই বিষয়ের প্রমাণ পাওয়া যায় যে,
শ্রীরাম মাংস দ্বারাও জীবন নির্বাহ করতেন। নাহলে এত প্রকারের হরিণ শিকার করার আলাদা কি কারণ?? তার থেকে এটাই জানা যায় শ্রীরাম কেবল ফলমূল ও মধুর উপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করেননি। 

এবার এর পরবর্তী প্রমাণ দেখে নেওয়া যাক—
রামোহথ সহসৌমিত্রির্বনং গত্বা স বীর্যবান।
ধূলান্ হত্বা মহারোহীননুতস্তার তং দ্বিজম্।। ৩২
রোহিমাংসানি চোদ্ভূত্য পেশীকৃত্বা মহাযশাঃ।
শকুনায় দদৌ রামো রম্যে হরিতশাদ্বলে।। ৩৩

[বাল্মিকী রামায়ণ/অরণ্যকাণ্ড/৬৮ সর্গঃ/৩২/৩৩]

অর্থ   তারপর রাম লক্ষণের সাথে বনে গমন করে স্থুলকায় মৃগ বধ পূর্বক তাদের মাংস গ্রহণান্তর প্রত্যাগত হয়ে, জটায়ুর উদ্দেশ্যে পিণ্ড দানার্থ তৃণ বিস্তৃত করলেন। এবং তৎসমস্ত মাংস খণ্ডে খণ্ডে ছেদন ও পিণ্ড করে, রমণীয় হরিতশাদ্বলে জটায়ুকে প্রদান করলেন।।

এখানেও হরিণ বধ করার শব্দ প্রমাণ পাওয়া যায়। অর্থাৎ পিণ্ড দানের জন্য মাংস অবশ্যই প্রয়োজনীয়। তাই শ্রীরাম লক্ষ্মণের সাথে বনে গিয়ে হরিণ শিকার করে আনেন এবং সেই হরিণের মাংস নিজে খণ্ড খণ্ড করে কেটে পিণ্ড দানের উদ্দেশ্যে জটায়ুকে প্রদান করেন।
তাই এখানে উপরোক্ত সকল শব্দ প্রমাণ থেকে এটা জানা যায় রাম মাংস আহার করেছিলেন।

এখানে বেশকিছু স্থানে একটা শব্দ খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় আর তাহলো- “মেধ্যান্‌”। [যাস্ক নিরুক্ত/৩/১৭] অনুযায়ী মেধ্য/মেধ্যান্‌/মেধা ইত্যাদি শব্দ দ্বারা যজ্ঞ বা উপাসনাকে বোঝায়। 
[অমরকোষ/বিশেষ্যনিঘ্ন-বর্গঃ/৭]পবিত্রং মেধ্যঞ্চ” যার অর্থ হয় মেধ্য শব্দে পবিত্র কিছু বোঝায়। আর যজ্ঞ/উপাসনা পবিত্র কার্যই বটে। তাই এখানে পরোক্ষ ভাবে এটাই বোঝা যায় মেধ্য অর্থে বিশেষ আচার পালন করাকে বোঝায়। 
মেধায়াং বিকল্প[আশ্বলায়ণ শ্রৌতসূত্র/৩/২/১৪] উক্ত সূত্র প্রমাণ অনুযায়ী মেধ্য শব্দের অর্থ হয় উপাসনার নিমিত্তে পশুকে আহুতি দেওয়া। 
এবং “মেধো রভীয়ান ইতি পশ্বভিধানে" [আশ্বলায়ণ শ্রৌতসূত্র/৩/৪/১৪], মন্ত্রে মেধ এবং রভীয়ান হচ্ছে পশুবাচী শব্দ

অর্থাৎ মেধ্য/মেধ্যান্‌ ইত্যাদি শব্দ দ্বারা এটাই বোঝা যাচ্ছে যে, বিশেষ আচার বা উপাসনার নিমিত্তে পশুকে বধ করে, সেই পশুর বিভিন্ন অঙ্গ দ্বারা আহুতি দেওয়া। 

[আশ্বলায়ণ শ্রৌতসূত্র/৩/৪/৪], [আশ্বলায়ণ শ্রৌতসূত্র/৩/৪/৬][আশ্বলায়ণ শ্রৌতসূত্র/৩/৬/২] উক্ত প্রমাণ দ্বারা এটা জানা যায় যে, পশুর বিভিন্ন অঙ্গ দ্বারা আহুতি দেওয়া।

তাই এবার এখানে বিষয়টা পরিস্কার হয়ে গেলো যে শ্রীরাম বিশেষ আচার পালনের নিমিত্তে বিভিন্ন প্রকারের হরিণ বধ করে, তা দ্বারা সেই বিশেষ আচার পালন করতেন এবং অবশিষ্টাংশ নিজেরাই গ্রহণ করতেন। কারণ রামায়ণে অযোধ্যাকাণ্ডে ৫৬ তম সর্গে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় যেখানে শ্রীরাম লক্ষ্মণকে আদেশ দেন হরিণ শিকার করে আনতে এবং তার মাংস রান্না করতে। এবং পরবর্তী দেখা যায়, শ্রীরাম সেই হরিণের মাংস দ্বারা গৃহযাগ সম্পন্ন করেন। যাগ কথার অর্থ - যজ্ঞ।

তাই এবার সকল আলোচনা শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে শ্রীরাম বনবাসে নিজের জীবন নির্বাহ ছাড়াও বিশেষ উপাসনার জন্য বিভিন্ন পশু শিকার করতো এবং তা আহুতি দিতো ও আহার করতো। কারণ শ্রীরাম শুরুতেই বলেছিলেন যে “হিত্বা মুনিবদ্‌” অর্থাৎ একজন মুনির ন্যায় থাকবো। আর মুনিরা বিশেষ আচারের জন্য বিভিন্ন পশু দ্বারা যজ্ঞকাজ পালন করেন। শ্রীরামও একই কাজ করেছেন।

সবচেয়ে বিশেষ একটা কথা হলো- 

অনেকে এখানে মৃগ, রুরু, পৃষত, বরাহ, গোধা এসব পশুবাচী নামের অর্থে জোরপূর্বক ফলমূল অর্থ করে এটাই প্রমাণ করতে চায় যে, শ্রীরাম কখনো মাংস আহার করেনি।
কিন্তু, এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও ন্যায় সঙ্গত নয়। কেননা শব্দের বৈদিক প্রয়োগ আর ঐতিহাসিক প্রয়োগের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকে৷ আর যদি পশুবাচী শব্দের অর্থে ফলমূল করতেই হয় তাহলে এটা দেখতে হবে যে, উক্ত ফলমূলাদি অর্থের সাথে সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ মিলছে কিনা। কেননা যেখানে যেখানে, মৃগ, রুরু, পৃষত, গোধা ইত্যাদি পশুর উল্লেখ আছে সেখানে, "হত্বা", " মেধ্যান্‌" "মাংস", " মাংসদৌনেন", "পক্ক" ইত্যাদি আরও অনেক শব্দ দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, ঐ প্রসঙ্গে উক্ত শব্দ দ্বারা বিভিন্ন পশুকে শিকার করা, যজ্ঞে আহুতি দেওয়া, ভাতের সাথে মাংস একসাথে রান্না করা, আগুনে মাংস পরিপাক করা ইত্যাদি বোঝায়। তাই এখানে জানা যায় শ্রীরাম মাংস আহার করেছিলেন।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

তারপরেও কিছু প্রমাণ আমি শব্দকোষ থেকে দেখাবো যেখানে মৃগ, রুরু, বরাহ, গোধা ইত্যাদিকে পশুবাচী বলা হয়েছে। তবে দেখে নেওয়া যাক সেসব প্রমাণ—

প্রথমে আসা যাক মৃগ শব্দের অর্থে  
মৃগ অর্থে শাস্ত্রে অনেকার্থ বুঝিয়েছে। কেননা স্থান, কাল, পাত্র ভেদে এক শব্দের অনেক অর্থ হয়। কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৃগ শব্দে হরিণ বা পশুবাচী অর্থই বলেছে।
"মৃগে কুরুঙ্গ বাতায়ু হরিণাহজিনষোময়ঃ" [অমরকোষ/সিংহাদি-বর্গঃ/১৬], এখানে মৃগ অর্থে হরিণকেই বোঝায়। "পশবোহপি মৃগা" [অমরকোষ/নানার্থ-বর্গঃ/৬২] এখানেও মৃগ শব্দে পশু ও হরিণ বোঝায়। এবং উণাদিকোষ গ্রন্থে একটা মৃগ সম্বন্ধিত একটা শব্দ পাওয়া যায় যেখানে "মৃগয়ুঃ" [উণাদিসূত্র/১/৩৭] শব্দে ব্যাধ কে বোঝায়, অর্থাৎ যে শিকার করে। 
এসব ছাড়াও যাস্ক নিরুক্তে অনেক স্থানে মৃগ অর্থে পশু বুঝিয়েছে। যদিও নিরুক্ত বেদের শব্দের অর্থকেই প্রতিপাদিত করে। তারপরেও কিছু শব্দ প্রমাণ দেখাবো যেখানে মৃগ হলো পশুবাচী শব্দ। [যাস্ক নিরুক্ত/৬/২৪/১] অনুযায়ী "মৃগ" শব্দে সিংহ বাঘের ন্যায় পশু বোঝায়। এবং বেদেও একটি শব্দ প্রমাণ পাওয়া যায় যেখানে মৃগ অর্থে পশু বুঝিয়েছে— "অস্মন্‌ মৃগং ন ব্রা মৃগয়ন্তে" [ঋগবেদ সংহিতা/৮/২/৬] অর্থাৎ, ব্যাধ যেমন মৃগকে অন্বেষণ করেএখানে "ব্যাধ" পদ টা উপস্থিত থাকার জন্য বোঝা যায় যে, "মৃগ" শব্দ পশুবাচী। কেননা ব্যাধ এর কাজ হলো মৃগয়া করা অর্থাৎ পশু শিকার করা। তাই এখানে উক্ত সব কোষ ও নিরুক্ত প্রমাণ থেকে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে মৃগ অর্থে হরিণ বোঝায়। 

এবার আসা যাক রুরু/মহারুরু অর্থে  

রুশাতিভ্যাং ক্ক্রুন্
[উণাদিকোষ/৪/১০৪]
পদ০ - রুশাতিভ্যাং ৫.২, ক্রুন্ ১.১ সং০ - রু ণ্যন্ত
শদ্ - ইত্যেতাভ্যাং ধাতুভ্যখং ক্রুন্প্রত্যয়ঃ স্যাৎ ।
স্বা০দ০ বৃ০ - রৌতি শব্দং করোতীতি রুরুঃ, মৃগভেদো বা । শীয়তে শাততীতি শত্রুঃ । প্রজ্ঞাদিত্বাদ্ (অ০ ৫.৪.৩৮) অণ্ । ‘শাত্রবঃ’ বৈরী ।
উদাহরণ - (১) রুরুঃ (মৃগ বিশেষ) - রৌতি শব্দং করোতি । রু শব্দে । রু ক্রুন্-অনুবন্ধলোপ, সু ।

আমি এখানে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যাতে যাচ্ছি না। শুধু এটাই দেখাচ্ছি যে এখানে শব্দ প্রমাণ রয়েছে যেখানে, "রুরু" অর্থে মৃগবিশেষ বোঝাচ্ছে। অর্থাৎ বিশেষ প্রজাতির হরিণ। 

এবার আসা যাক পৃষত অর্থে — 

বর্ত্তমানে পৃষবৃহন্মহজ্জগচ্ছতৃবচ্চ
[উণাদিকোষ/২/৮৫]
পদ০ - বর্ত্তমানে ৭.১, পৃষবৃহন্মহজ্জগচ্ছতৃবৎ - অব্য০, চ - অব্য০ ।
সং০- বর্ত্তমানে গম্যমানে পৃষৎ বৃহৎ মহৎ জগৎ ইত্যেতে শব্দাঃ । শতৃপ্রত্যয়ান্তা নিপাত্যন্তে ।

পৃষদাদয়ো বর্তমানার্থবাচকা অতিপ্রত্যয়ান্তা নিপাত্যন্তে, শতৃবচ্চৈষাং কার্য ভবতীতি। পর্ষতি সিঞ্চতি হিনস্তি বা তৎ পৃষৎ, মৃগবিশেষো বিন্দুর্বা । পৃষতী, পৃষন্তি ; স্ত্রিয়াং পৃষতী। বর্হতি বর্ধতেঽসৌ বৃহৎ । মহত্যর্থে ত্রিলিঙ্গঃ ;
স্ত্রিয়াং ‘বৃহতী’

উদাহরণ - (১) পৃষৎ (বূন্দ, এক মৃগ) - পর্ষতি পর্ষতি সিঞ্চতি হিনস্তি বা । পৃষু সেচনছ । পৃষ্ শতৃ-পৃষ্ শপ্ শৎ - অনুবন্ধলোপ- পৃষ্ অ অৎ- ‘অতো গুণে’ পে পররূপ । সু, অপৃক্ত সকার কা লোপ ।


আরও দেখে নেবো—
পৃষিরঞ্চজিভ্যাং কিৎ
[উণাদিকোষ/৩/১১১]
পদ০ - পৃষিরঞ্চজিভ্যাং ৫.২, কিৎ ১.১
অনু০ - ‘ভৃভ্যোঽতচ্’ (উ.সূ. ৩.১১০) দ্বারা ‘অতচ’ -এর  অনুবর্তন । 
সং০ - পৃষ্ রজ্ ইত্যেতাভ্যাং ধাতুভ্যামতচ্ স্যাৎ স চ কিৎসংজ্ঞঃ ।
ব্যাখ্যা - পৃষ্ আর বজ্ - এই ধাতুর থেকে উপরে অতচ্ প্রত্যয় হয় আর সেটি কিৎসংজ্ঞঃক হয় । প্রত্যয় কে কিৎ করা প্রয়োজন - লঘুপধ বোনের নিষেধ আর অনুনাসিকলোপ ।
স্বা০দ০ বৃ০ - পর্ষতি সিঞ্চতীতি পৃষতঃ, বিন্দুর্মৃগো বা । রজতি প্রিয়ং ভবতীতি রজতম, রূপ্যং শুক্লং বা।
উদাহরণ - (১) পৃষতঃ (বিন্দু, হরিণ) - পর্ষতি সিঞ্চতি । পৃষু সেচা । পৃষ্ অতচ্ - ‘অনিদিতাং হল উপধা০’ দ্বারা অনুনাসিকলোপ, সু ।

এখানেও আমি বিস্তারিত ব্যাখ্যাতে যাচ্ছি না কেবল শব্দ প্রমাণ দেখাচ্ছি। উক্ত উণাদিকোষ অনুযায়ী পৃষত অর্থেও বিশেষ প্রজাতির হরিণকে বোঝায়। 

এবার আসা যাক বরাহ অর্থে 
"বরাহঃ শূকরো" [অমরকোষ/সিংসাদি-বর্গঃ/৪] এখানে বরাহ অর্থে স্পষ্ট ভাবেই শূকর বলা হয়েছে। [অমরকোষ/বিশেষ্যনিঘ্ন-বর্গঃ/১৪] এখানে "বরাহ" অর্থকে পশুবাচী বোঝায়। আমি উপরে মৃগ শব্দকে বোঝাতে গিয়ে বলেছিলাম যে, নিরুক্ত শ্রুতি শব্দের অর্থকেই প্রতিপাদিত করে। তাই একি শব্দের বৈদিক প্রয়োগ ও ঐতিহাসিক প্রয়োগের মধ্যে বৃহৎ পার্থক্য থাকে৷ কারণ একি অর্থ দ্বারা বিভিন্ন অর্থকে বোঝানো হয়। কিন্তু, নিরুক্ত ও বেদের মধ্যে কিছু স্থানে বরাহ অর্থে পশুবাচী বুঝিয়েছে, সেই হেতু আমি উক্ত শব্দ প্রমাণ উপস্থাপন করছি— [যাস্ক নিরুক্ত/৫/৪/৩][যাস্ক নিরুক্ত/৫/৪/৪] অনুযায়ী "বরাহ" শব্দ পশুবাচী অর্থে ব্যবহৃত। এবং এই প্রসঙ্গে ঋগবেদেও একটা শব্দ প্রমাণ দৃশ্যমান হয়— "শতং মহিষান্‌ ক্ষীরপাকমোদনং বরাহমিন্দ্র এমুষম্‌" [ঋগবেদ সংহিতা/৮/৭৭/১০] অর্থাৎ, ইন্দ্র শত মহিষ পায়েস রান্না করা অন্ন ও বরাহ দান করেন। তাই উক্ত শব্দ প্রমাণ থেকে এটাই জানা যায় বরাহ পশুবাচী শব্দ যার দ্বারা শূকরকে বোঝানো হয়।

আর [অমরকোষ/সিংহাদি-বর্গঃ/১১] অনুযায়ী, "গোধা" অর্থে গুইসাপ বোঝায়। 

এখানে শুধু মাত্র বোঝানোর অর্থে দেখানো হয়েছে যে, মৃগ, রুরু, বরাহ, পৃষত, গোধা অর্থে বিভিন্ন পশুকে বোঝায়। যদিও এত বিশ্লেষণের দরকার ছিলোনা। কারণ অধিকাংশ শাস্ত্রে এসব হলো পশুবাচী নাম তাই এখানে আলাদা করে শব্দকোষ গ্রন্থ থেকে প্রমাণ করার দরকার ছিলো না। দেখালাম শুধু মাত্র একটাই কারণে, সমাজে এমন অনেক ব্যক্তিরা আছেন যারা শাস্ত্রের মীমাংসা দিতে না পেরে উক্ত প্রসঙ্গটাকেই প্রক্ষিপ্ত বলে ঘোষণা করে দেয়। কিন্তু এটা কি ভেবে দেখার বিষয় নয় যে, শাস্ত্রের মধ্যে অর্ধেক মান্য অর্ধেক মান্য নয়! এটা কীভাবে হতে পারে ?
যদি উক্ত প্রসঙ্গের মীমাংসা দেওয়া যায়, তাহলে তা প্রক্ষিপ্ত কেন হবে! সেই কারণে প্রত্যেকটা শব্দের অর্থ শব্দকোষ থেকে দেখানো হলো। 

সাধারণ মানুষেরা যে ব্যাপার টা নিয়ে বেশি তর্ক করে তা হলো আমিষ আর নিরামিষ নিয়ে। গুটিকয়েক লোক যারা মনে করেন কেবল নিরামিষই হলো সাত্ত্বিক। আর আমিষ হলো তামসিক। তাই এই সাত্ত্বিক তামসিকের চক্করে পড়ে এরা শাস্ত্রকেই প্রক্ষিপ্ত বলে ঘোষণা করে দেয়।

 শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে নিরামিষ, আমিষ এসব তেমন পাওয়া যায় না বললেই চলে। শাস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ভক্ষ্য-অভক্ষ্য এর প্রসঙ্গ। অর্থাৎ কি খাওয়া উচিত আর কি খাওয়া উচিত নয়। এই ব্যাপারে নিরপেক্ষ শাস্ত্র মনুস্মৃতির ৫ অধ্যায়ের ১ থেকে ৫৬ নং শ্লোক পর্যন্ত পড়লে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায় সত্য কি মিথ্যা কি।

আমিষ বলতে কী জাতীয় খাদ্যকে বোঝায়! যেসব খাদ্যের মধ্যে প্রোটিন/ফ্যাট রয়েছে সেসব খাদ্যকে আমিষ বলে গণ্য করা হয়। আমিষ উদ্ভিদ ও প্রাণী দুই থেকেই প্রাপ্ত হওয়া যায়। সাধারণত যেসব খাদ্যকে মানুষ নিরামিষ বলেই চালাই, যাচাই করলে দেখা যায় সেসবের মধ্যেই আমিষের মাত্র বেশি। আর যেসব খাদ্যকে আমিষ বলে চালাই সেসবে মোটেও আমিষ নেই বললেই চলে।
যেমন— গম, সয়াবিন, দুধ, সিমের বিচি, বাদাম, ডাল এসবকে নিরামিষ বলে চালালেও, দেখা যায় এসবে আমিষ বেশি।
পক্ষান্তরে, পেঁয়াজ, রসুন কে আমিষ বলে চালালেও  এখানে দেখা যায় যে, এসবে আমিষ নেই বললেই চলে। তাই এখানে আমিষ নিরামিষ নিয়ে অহেতুক তর্ক করাটা বোকামিই বটে। মাংস খাওয়া মানেই সে তামসিক আসুরিক প্রভৃত্তি সম্পন্ন এসব ভাওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই না। এই প্রসঙ্গে বালির বচন পাওয়া যায় ভক্ষ্য অভক্ষ্য নিয়ে। বালি শ্রীরামকে বলেছিলেন যে—

"পঞ্চ পঞ্চনখা ভক্ষ্যা ব্রহ্মক্ষত্রেষু রাঘব।
শশকঃ শল্লকী গোধা খড়গঃ কূৰ্ম্মশ্চ পঞ্চমঃ"॥ ৩৫ ॥
[বাল্মিকী রামায়ণ/কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড/১৬ সর্গঃ]

অর্থ   হে রাঘব! ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যে পাঁচটি পঞ্চনখবিশিষ্ট প্রাণী ভক্ষ্য রূপে প্রচলিত আছে-শশক, শল্লকী (সজারু), গোধা (গোসাপ), খড়গ (গণ্ডার) এবং পঞ্চম কূৰ্ম্ম ॥ ৩৫ ॥

এবং এর পরের শ্লোকে অভক্ষ্য নিয়ে বলেছিলেন যে—
"শৃগাল, কুমির, বানর, কিন্নর ও নর" এসব হলো অভক্ষ্য। অর্থাৎ এখানে বালি শুধু মাত্র একটা ধারণা দেয় যে পঞ্চ নখ বিশিষ্ট প্রাণীর মধ্যে কোন গুলো গ্রহনীয় ও কোন গুলো বর্জনীয়। কেননা ওখানে শ্রীরাম বালিকে বধ করেছিলেন, যেখানে বালি পঞ্চনখ বিশিষ্ট প্রানী ছিলো। তাই সেই প্রসঙ্গেই বালি এরূপ শ্রীরামকে বলেছিলেন। 

তাই শ্রীরামও যেহেতু ক্ষত্রিয় ছিলেন, সেহেতু উনার মাংস ভক্ষণে কোনো রকম দোষ হয় না ।

শ্রীরাম বলেছিলেন- "মধু মূল ফলৈ জীবন্‌" অর্থাৎ মধু, ফল, মূল দ্বারা জীবন ধারণ করবেন। কিন্তু, ফলের মধ্যেও যাচাই করলে দেখা যায় অধিকাংশ ফল আমিষ সম্পন্ন। 
যেমন— আম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, পেয়ারা, কমলালেবু, কলা, কিশমিশ ইত্যাদি আরও অনেক। 
তারমানে শ্রীরাম যদি কেবল ফল খেয়েই জীবন ধারণ করে থাকেন। তাহলেও তো উনি আমিষ গ্রহণ করেছেন।
এবার হয়তো অনেকে বলবে, এসব তো উদ্ভিজ আমিষ, এসব গ্রহণ করলে সমস্যা নেই। তাহলে তাদের বলে রাখি, জীবজন্তুরাও উদ্ভিজ আমিষ গ্রহণের পরেই নিজেদের পুষ্ট করতে পারে। অর্থাৎ উদ্ভিদ থেকেই জীবজন্তুরা নিজেদের শরীরে আমিষ মজুত করে। তাই এখানে শ্রীরামের মাংস আহার নিয়ে অহেতুক আপত্তি দেখানোর কোনো দরকারই নেই। আর শ্রীরাম যেহেতু একজন ক্ষত্রিয়, তাই শ্রীরামের ক্ষেত্রে মৃগয়া করাটা স্বাভাবিক। কেননা মৃগয়া করা ক্ষত্রিয়ের স্বভাব। এই প্রসঙ্গে শ্রীরাম বালিকে বলেছিলেন—

"যান্তি রাজর্ষয়স্তাত মৃগয়াং ধৰ্ম্মকোবিদাঃ।
লিপ্যন্তে ন চ দোষেণ নিঘ্নন্তোহপি মৃগান্ বহুন্" ॥ ১৮ ॥
[বাল্মিকী রামায়ণ/কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড/১৭ সর্গঃ]

অর্থ   তাত! ধৰ্ম্ম বিষয়ে বিচক্ষণ রাজর্ষিগণ ও মৃগয়া করে থাকেন এবং বহু মৃগ বধ করেও দোষলিপ্ত হন না।।১৮।।

আর রামায়ণ থেকে আমি ইতি মধ্যেই বহু শব্দপ্রমাণ দেখিয়েছি যেখানে শ্রীরাম মৃগয়া করেছেন। বিভিন্ন পশুকে শিকার করেছেন। তাই এখানে শ্রীরামের বক্তব্য অনুযায়ী শ্রীরামের মৃগয়া করাটাও অপরাধমূলক নয় । 
আর যেহেতু শ্রীরাম ধর্মের বাহক তাই উনি যদি উনার কর্ম না করে তাহলে তাতে সংসারের অবনতিই হবে। কারণ শ্রীরাম পরব্রহ্ম শিবের একটি লীলামূর্তি।
এই প্রসঙ্গে ভগবদ্‌ গীতায় বলা আছে যে —

"উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্যাং কর্ম চেদহম্‌।
সঙ্করস্য চ কর্তা স্যাম্‌ উপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ"।।
[ভগবদ্‌ গীতা/৩/২৪]

অর্থ  ঈশ্বর বলছেন, আমি যদি কর্ম না করি তবে সমস্ত লোক ভ্রষ্ট হবে। আমি বর্ণসঙ্করাদি সামাজিক বিশৃঙ্খলার কারণ হবো এবং তার ফলে প্রজা বিনষ্ট হবে।।২৪।।

পরমব্রহ্ম শিবের ইচ্ছাকে নিয়মিত করতেই শ্রীরাম মানবরূপে লীলা করছেন। আর যেহেতু শ্রীরাম ক্ষত্রিয়, তাই তিনি নিজের ক্ষত্রিয়ধর্ম পালন করছেন। তাই শ্রীরাম যদি মানব রূপের মর্যাদা রাখবার জন্যে মৃগয়া অথবা মাংস আহার করেও থাকেন তাহলে এখানে দোষ কেন হবে ? উনি তো এসব অভিনয় মাত্র করছেন, কারণ শ্রীরামচন্দ্র হলেন পরমব্রহ্ম শিবেরই লীলা মূর্তি।

শ্রীরামের মাংস আহারের প্রমাণ যদি প্রক্ষিপ্ত হয় তাহলে, হনুমানজীর চোখে দেখা লঙ্কাতে রাবণের মহলে রাবণের জন্য যেসব খাদ্যবস্তু রান্না করা হয়েছিলো সেসবও প্রক্ষিপ্ত বলে মানতে হবে। কেননা এখানে মৃগ, বরাহ, মাংস, ছাগ, মেষ, মহিষ বলতে পশুকেই সরাসরি বুঝিয়েছে। এবং মাংস বলতে পশুর মাংসকেই সরাসরি বুঝিয়েছে। এখানে তো অন্য কোনো অর্থ করেনি। যেমন, অনেকেই - মৃগ, বরাহ, মেষ, ছাগ, মহিষ, মাংস বলতে ফলমূলকে বোঝায়! এমন তো কিছু এখানে অর্থ করেনি। কেন করেনি? কারণ এসব রাবণের জন্য সেই কারণে ?
বলে রাখা ভালো যে, রাবণও কিন্তু মহান বিদ্বান ছিলেন ১৪ শাস্ত্রের মহাজ্ঞানী ছিলেন।
ঋষি পুত্র ছিলেন, তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাই সম্মানের দিকে শ্রীরাম যেমন, রাবণও তাই। কিন্তু দুজনের আদর্শ ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন।
তবে প্রশ্ন হলো এখানে এসে এসব শ্লোক বা হনুমানজীর চোখে দেখা সম্পূর্ণ প্রসঙ্গটা প্রক্ষিপ্ত হলো না কেন ?
তবে দেখে নেওয়া যাক সেসব প্রমাণ—

সর্বকামৈরুপেতাং চ পানভূমিং মহাত্মনঃ।
দদর্শ কপিশার্দূলস্তস্য রক্ষঃপতেগৃহে।।
মৃগাণাং মহিষাণাং চ বরাহাণাং চ ভাগশঃ
তত্র ন্যস্তানি মাংসানি পানভূমৌ দদর্শ সঃ।।
[বাল্মিকী রামায়ণ/সুন্দরকাণ্ড/১১ সর্গঃ/১৩-১৪]

অর্থ  কপিশ্রেষ্ঠ শ্রীহনুমান সেই মহাকায় রাক্ষসরাজের ভবনে সর্বপ্রকার ভোগোপকরণে সজ্জিত পানভূমি দেখতে পেলেন। সেই পানভূমিতে আলাদা-আলাদা করে মৃগ, মহিষ ও শূকরের মাংস রাখা ছিল।।

রৌক্নেযু চ বিশালেষু ভাজনেষ্বপ্যভক্ষিতান্‌।
দদর্শ কপিশার্দুলো ময়ূরান্ কুকুটাংন্তথা।।১৫
বরাহ বাধ্রীণসকান্ দধিসৌবর্চলায়ুতান।
শল্যান্ মৃগময়ূরাংশ হনুমানন্ববৈক্ষত।।১৬
[বাল্মিকী রামায়ণ/সুন্দরকাণ্ড/১১ সর্গঃ]

অর্থ  বানরসিংহ শ্রীহনুমান তথায় সোনার বড় বড় পাত্রে দধি ও লবণ মিশ্রিত ময়ূর, কুকুট, শূকর, ছাগ, সজারু, হরিণ ও ময়ূরের মাংস দেখতে পেলেন। সেগুলি তখনও অভক্ষিত অবস্থায় ছিল।।

কুকলান্ বিবিধাংশ্ছাগান্ শশকানর্ধভক্ষিতাম্।
মহিষানেকশল্যাংশ্চ মেষাংশ্চ কৃতনিষ্ঠিতান্।।১৭
লেহ্যানুচ্চাবচান্ পেয়ান্ ভোজ্যান্যুচ্চাবচানি চ।
তথাম্ললবণোত্তং সৈর্বিবিধৈ রাগখাণ্ডবৈঃ।।১৮
[বাল্মিকী রামায়ণ/সুন্দরকাণ্ড/১১ সর্গঃ]

অর্থ  কুকল নামক পক্ষির মাংস, বিবিধ ছাগ মাংস, খরগোশ, অর্ধভক্ষিত মহিষ মাংস, একশলা নামক মৎস্য ও ভেড়ার মাংস- এই সমস্ত রন্ধনপূর্বক পাক করে রাখা ছিল। এগুলির সঙ্গে অনেক প্রকার চাটনিও ছিল। বিবিধ প্রকারের ভক্ষ্য ও পেয় পদার্থ বিদ্যমান ছিল। রসনার শৈথিল্য দূর করার জন্য অম্ল ও লবণের মিশ্রণে আঙুরাদি বিবিধ রাগ ও খাণ্ডব রক্ষিত ছিল।।

                                          --   তাহলে উপরোক্ত শ্লোক গুলি থেকে সরাসরি বোঝায় যাচ্ছে, সেই সময়ে রাজা মহারাজাদের মাংস আহার করার ধারণা সম্পূর্ণ সঠিক। কিন্তু আমার প্রশ্ন এখানেও একই, শ্রীরামের ক্ষেত্রে যেখানে পশু ও মাংস শব্দের অর্থ ফলমূল হয়ে যায় বা প্রক্ষিপ্ত হয়ে যায়, তাহলে তা রাবণের ক্ষেত্রে এসে সঠিক কেন হবে? যদি প্রক্ষিপ্ত হয়, তাহলে সম্পূর্ণটা হোক, আলাদা ভাবে একটি প্রসঙ্গ কেন প্রক্ষিপ্ত হবে ?

মূল কথা হলো, যা আমি ইতি মধ্যেই উপরে বলেছি যে, কোনো বিষয়ের মীমাংসা যদি দিতে না পারে তবে তাকে প্রক্ষিপ্ত ঘোষণা করে একদল ব্যক্তিরা (আধুনিক বৈষ্ণব তথা কট্টর নিরামিষ বাদী রা) ।

এবার আসা যাক বৈষ্ণব তথা অন্যান্য নিরামিষবাদীদের ভণ্ডামির চেহারা উন্মোচন করতে। রামায়ণের সুন্দর কাণ্ডের ৩৬ নং সর্গের ৪১ নং শ্লোকের ভুল ব্যাখ্যা করে এরা প্রমাণ করতে চাইছে যে, রাম কখনো মাংস আহার করেননি। শুধু তাই নয়, ওখানে এমন ব্যাখ্যা করেছেন যে, শুধু রাম একা নয় সমস্ত রঘুবংশের কেউ-ই মাংস আহার করেননি। তার সাথেও মধুও কেউ পান করেননি। কিন্তু এখানে আমার বেশ কিছু প্রশ্ন বৈষ্ণব তথা বিরামিষবাদীদের করতে চাই ! তা হলো— 

১. অন্যান্য স্থানে যেখানে মাংসের অর্থ দ্বারা ফল বোঝানো হয়েছে, তাহলে এখানে মাংসের অর্থ দ্বারা ফল কেন বোঝাবে না ?

২. রামায়ণের উল্লেখ আছে রাম হলো ধর্ম স্বরূপ। তাহলে অযোধ্যা কাণ্ডের ২০ তম সর্গের ২৯ নং শ্লোকে যেখানে রাম বলেছেন- “মধু মূল ফলৈ জীবন্‌” অর্থাৎ এসব বন্য দ্রব্যাদি দ্বারা বনবাসের জীবন নির্বাহ করবো। তাহলে রাম যেখানে নিজেই বললেন যে, মধু, ফল, মূল ইত্যাদি জাতীয় খাদ্য দ্বারা জীবন নির্বাহ করবে, তাহলে হনুমান কীভাবে বললেন যে রঘুবংশীয় কেউই মধু পান করেন না ? তাহলে এখানে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য কতটা যৌক্তিক ? তাহলে হনুমান কি রামের শব্দকে খণ্ডন করলো ? তাহলে এবার কি এটা মেনে নিতে হবে নাকি যে, রাম রঘুবংশীয় ছিলেন না ?

৩. উক্ত বাল্মীকি রামায়ণের সুন্দর কাণ্ডের ৩৬ তম সর্গের সম্পূর্ণ প্রসঙ্গে হনুমানজী রামের শোকাগ্রস্থ অবস্থার কথা মাতা সীতাকে বলছেন। এবং এটিও বলেছেন, শ্রীরামচন্দ্র মাতা সীতার বিয়োগে অত্যন্ত শোকার্ত হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। তাহলে এখানে উক্ত প্রসঙ্গের সাথে সম্পূর্ণ রঘুবংশের মাংস, মধু খাওয়া না খাওয়া নিয়ে কি সম্পর্ক?

এবার আসা যাক মূল বিষয়ে। 

আসলে সুন্দর কাণ্ডের ৩৬ তম সর্গে হনুমানজী ও মাতা সীতার কথোপকথন রয়েছে। যেখানে হনুমানজী নিজেকে রামের সেবক বলে পরিচয় দেন এবং এটিও বলেন যে রামের বর্তমান কি অবস্থা হয়ে আছে । উক্ত সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ পড়লে জানা যাবে ওখানে হনুমানজী মাতা সীতাকে বলছেন যে, রাম অত্যন্ত শোকাগ্রস্থ হয়ে আছেন । তিনি না ঠিক মতো ঘুমান, না ঠিক মতো আহার করেন । এসব বলতে বলতে হনুমানজী  অবশেষে মাতা সীতাকে বলেন যে, শ্রীরাম মাতা সীতার চিন্তায় এতটা বিভোর হয়ে থাকে যে, উনি মাংস মধু ভক্ষণ করাও ত্যাগ দিয়েছেন। কেবল ফল, মূল খেয়েই আছেন। কিন্তু ঐ প্রসঙ্গের মধ্যে "রাঘব" শব্দটিকে 'রাম' অর্থ না করে ওখানে এই বৈষ্ণব তথা নিরামিষভোজীরা 'রঘুবংশ' করে অর্থের অনর্থ করে, সবার সামনে উপস্থাপন করলো যে, রঘুবংশের কেউ-ই মাংস, মধু খায় না।

 কোন প্রসঙ্গে কোন প্রসঙ্গ নিয়ে এলো এই বৈষ্ণব তথা নিরামিষবাদীরা ? কোথায় রাম শোকার্ত হয়ে সব খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে সে অর্থকে পালটে দিয়ে বৈষ্ণব তথা নিরামিষভোজীরা অর্থ বললেন রঘুবংশীয় কেউ-ই মাংস, মধু গ্রহণ করেন না। যেখানে কথা হচ্ছিল - রামের অবস্থার বিষয়ে, সেখানে মাতা সীতা কে হনুমান জী কি রামের কথা বলতে বলতে হটাৎ করে রঘুবংশে কে মাংস খায় আর কে খায় না সে বিষয়ে বলতে যাবেন ? আমার প্রশ্ন হল, মা সীতা তো নিজে স্বয়ং রঘুবংশের কুলবধূ, মা সীতা কি রঘুবংশের আহার সম্পর্কে জানতেন না ? তিনি হনুমানের কাছে রঘুবংশে মাংস আহার করা হয় কি না সে বিষয়ে কেন জানতে যাবেন ? 
তাছাড়া প্রসঙ্গ টা হল - রামের অবস্থার বিষয় নিয়ে, রঘু বংশের বিষয়ে নয়। সুতরাং, শ্লোকে থাকা "রাঘব" শব্দটিকে 'রাম' অর্থ না করে 'রঘুবংশ' অর্থ বানানো টা সম্পূর্ণ যুক্তিহীন  ও  অবিবেচকের মতো কাজ।


এবার তবে দেখে নেওয়া যাক সমগ্র প্রসঙ্গ সহিত উক্ত শ্লোকের প্রকৃত অর্থ —
তবাদর্শনজেনার্যে শোকেন পরিপূরিতঃ ।
ন শর্ম লভতে রামঃ সিংহার্দিত ইব দ্বিপঃ ॥ ৩৭
ন মাংসং রাঘবো ভুঙ্ক্তে ন চৈব মধু সেবতে ।
বন্যং সুবিহিতং নিত্যং ভক্তমশ্রাতি পঞ্চমম্ ॥ ৪১
নৈব দংশান্ ন মশকান্ ন কিটান্ ন সরীসৃপান্ ।
রাঘবোঽপনয়েদ গাত্রাৎ ত্বদ্গতেনান্তরাত্মনা ॥ ৪২
নিত্যং ধ্যানপরো রামো নিত্যং শোকপরায়ণঃ ।
নান্যচ্চিন্তয়তে কিঞ্চিৎ স তু কামবশং গতঃ ॥ ৪৩
অনিদ্রঃ সততং রামঃ সুপ্তোঽপি চ নরোত্তমঃ ।
সীতেতি মধুরাং বাণীং ব্যাহরন্ প্রতিবুধ্যতে ॥ ৪৪
দৃষ্ট্বা ফলং বা পুষ্পং বা যচ্চান্যৎ স্ত্রীমনোহরম্ ।
বহুশো হা প্রিয়েত্যেবং শ্বসংস্ত্বামভিভাষতে ॥ ৪৫

[বাল্মিকী রামায়ণ/সুন্দরকাণ্ড/৩৬ সর্গ/ ৩৭-৪৫ নং শ্লোক]

অর্থ — হে আর্যে ! আপনাকে না দেখবার কারণে উৎপন্ন হওয়া শোক তার (রামের) হৃদয় ভরে থাকে, অতএব শ্রীরাম সিংহের দ্বারা পীড়িত হয়ে হাতির মতো কোনো ক্ষণে কোনো মুহূর্তে শান্তি পাচ্ছেন না ॥ ৩৭

(এই মুহূর্তে) শ্রী রামচন্দ্র না মাংস গ্রহণ করছেন আর না মধু সেবন করছেন, তিনি যেন নিত্য বানপ্রস্থের উপযোগী হলে যেমন বিহিত ফল মূল ভক্ষণ করতে হয়, তা গ্রহণ করছেন মাত্র আর পঞ্চমদিনে শরীর ধারণের উপযুক্ত অন্য গ্রহণ করছেন ॥ ৪১
সেই রামচন্দ্রের চিত্ত সদাই আপনারই প্রতি লেগে থাকে। অতএব এই অবস্থায় তার শরীরে ধূলিকণা লেগে গেলে, মশা, পোকামাকড় আর সাপ পর্যন্ত উপস্থিত হলে তবুও তার কোনো বোধ থাকে না ॥ ৪২
শ্রীরামচন্দ্র আপনার প্রেমে বশীভূত হয়ে সদাই আপনার ধ্যানে যেন মগ্ন থাকেন আর নিরন্তর আপনারই বিরহে শোকগ্রস্ত হয়ে ডুবে থাকেন। আপনাকে ছেড়ে অন্য কোন কথা তিনি কখনো চিন্তাই করেন না ॥ ৪৩
আপনার চিন্তায় মগ্ন থাকবার কারণে নরোত্তম শ্রীরামের ঠিকমত নিদ্রাও আসে না । যদি কখনো নিদ্রায় চোখ বন্ধ হয়েও আসে তবুও ‘সীতা-সীতা’ এই মধুর বাণী উচ্চারণ করতে করতে তিনি তাড়াতাড়ি জেগে ওঠেন ॥ ৪৪
কোনো ফল, ফুল অথবা স্ত্রীদের মন জয়কারী অন্য কোন বস্তুকে তিনি যখন দেখেন তখন লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে বারংবার হা প্রিয়ে ! হা প্রিয়ে ! বলতে বলতে আপনাকেই ডাকতে থাকেন ॥ ৪৫







দেখুন এবার এখানেই কি বলা হয়েছে। একই বাল্মিকী রামায়ণের সুন্দরকাণ্ডের ৩৬ তম সর্গের ৪১ নং শ্লোকে হনুমানজী মাতা সীতাকে বলছেন যে- রামচন্দ্র মাংস, মধু এসব খাওয়া ত্যাগ করেছে। উনি কেবল, বনে উৎপন্ন ফল-মূল আহার করেন এখন। আর শরীর ধারণ করার মতো আহার গ্রহণ করেন। 
     কিন্তু, পাখণ্ডী বৈষ্ণব তথা নিরামিষভোজীরা শ্লোকের মূল অর্থকে পরিবর্তন করে অন্য অর্থ করে দিলেন। এসব ছাড়াও সম্পূর্ণ প্রসঙ্গের আগে ও পরবর্তী শ্লোক পড়লে স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে শ্রীরাম তার পত্নী সীতার বিয়োগে এতটা শোকার্ত যে তিনি সব ছেড়ে কেবল দেবী সীতার চিন্তায় পড়ে থাকেন। এবং শ্রীরাম এমনভাবেই চিন্তায় ডুবে থাকেন যে, তার নিজের আশে পাশে, মশা, মাছি, সাপ ইত্যাদি ঘোরাফেরা করলেও তা নিয়ে শ্রীরামের কোনো বোধ থাকে না। শ্রীরাম কেবল সীতার চিন্তায় মগ্ন থাকেন। তাই হনুমানজী মাতা সীতাকে বলছেন যে, শ্রীরাম সীতার চিন্তায় এতটাই মগ্ন থাকেন যে উনি মাংস, মধু খাওয়া ত্যাগ করেছেন। তাই এখানে সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ না পড়ে কেবল একটা শ্লোককে বিকৃত করে অনুবাদ করলে তা কখনোই মান্য নয় এবং শ্লোকের ভুল অনুবাদ দ্বারা এও প্রমাণিত হবে না যে, শ্রীরাম মাংস আহার করতেন না। 

     যাদের ন্যূনতম জ্ঞান আছে তারাও বুঝবে যে এর সঠিক অর্থ কোনটি হতে পারে। এর আগে দেখা যায় শ্রীরাম মাতা সীতাকে বলছেন যে অগ্নিতে সুস্বাদু মাংস রান্না হচ্ছে। আবার পক্ষান্তের এখানে হনুমানজী সীতাকে বলছেন রঘুবংশীয় কেউ-ই মাংস খান না মধু সেবন করেন না। তাহলে প্রশ্ন তো এখানে ওঠে যে, মাংস না খেয়ে শ্রীরাম মাংসের স্বাদ মাতা সীতাকে কীভাবে বলে দিলেন ? 
তাই এখানে বৈষ্ণব তথা নিরামিষভোজীরা যে অর্থের উদাহরণ দিয়েছে, তা সম্পূর্ণ প্রসঙ্গের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না থাকার কারণে উহা মান্য বলে স্বীকার করা যাচ্ছে না  এবং উক্ত মিথ্যাচার সঠিক অর্থ ও যুক্তি দ্বারা শৈবপক্ষ থেকে উপস্থাপন করে, তথাকথিত বৈষ্ণব ও নিরামিষভোজীদের অপব্যাখ্যার খণ্ডন করা হল ৷

----------------------------------------------------------------------------- 

এবার আসা যাক মহাভারতের অনুশাসনপর্বের প্রসঙ্গে। যেখানে রাম নামে একজন রাজার নাম উল্লেখ করে এটাই প্রমাণ করতে চাইছে যে, শ্রীরাম কখনো মাংস খায়নি। তবে, দেখে নেওয়া যাক উক্ত শ্লোকে কি বলা আছে—

শ্যেনচিত্রেণ রাজেন্দ্র! সোমকেন বৃকেণ চ।
রৈবতেন রন্তিদেবেন বহুনা সৃঞ্জয়েন চ ॥১০১৷৷ 
ঐতৈশ্চান্যৈশ্চ রাজেন্দ্র! কৃপেণ ভরতেন চ।
দুষ্মন্তেন করুষেণ রামালর্কনলৈস্তথা।
বিরূপাশ্বেন নিমিন! জনকেন চ ধীমতা ॥১০২৷৷
ঐলেন পৃথুনা চৈব বীরসেনেন চৈব হ।
ইক্ষাকুণা শম্ভুনা চ শ্বেতেন সগরেণ চ॥১০৩৷৷
অজেন ধুন্ধুনা চৈন তথৈব চ সুবাহুনা।
হর্য্যশ্বেন চ রাজেন্দ্র! ক্ষুপেণ ভরতেন চ ॥১০৪
এতৈশ্চান্যৈশ্চ রাজেন্দ্র! পুরা মাংসং ন ভক্ষিতম্।
শারদং কৌমুদং মাংসং ততস্তে স্বর্গমাপ্নুবন্ ॥১০৫৷

[মহাভারত/অনুশাসনপর্ব/অধ্যায় ১০০/১০১-১০৫]

অর্থ  রাজশ্রেষ্ঠ! শ্যেনচিত্র, সোমক, বৃক, রৈবত, রন্তিদেব, বসু ও সৃঞ্জয় ইহারা ও অন্যান্য রাজারা এবং কূপ, ভরত, দুষ্মন্ত, করূষ, রাম, অলর্ক, নল, বিরূপার্শ্ব, নিমি, জ্ঞানী জনক, পুরূববা, পৃথু, বীরসেন, ইক্ষ্বাকু, শম্ভু, শ্বেত, সগর, অজ, ধুন্ধুমাব, সুবাহু, হর্যাশ, ক্ষুপ ও ভরত ইহাবা ও অন্যান্য রাজারা শরৎকালে কার্ত্তিকমাসে মাংস ভক্ষণ করিতেন না, তাহাতেই তাঁহারা স্বর্গ লাভ করিয়াছেন।।১০১-১০৫॥

দেখুন প্রথমত যা বলতে চাই তা হলো— এখানে রাম নাম দ্বারা এটা প্রমাণ হয়না যে, এটা ত্রেতার রঘুবীর শ্রীরাম। কেননা এমন স্পষ্ট শব্দ প্রমাণ এখানে নেই। তাই এখানে এইটা একমত হওয়া যায় না এই রাম দ্বারা ত্রেতার শ্রীরামকে বোঝাচ্ছে। তাছাড়াও এখানে বলা হয়েছে যে তারা কেবল “শরৎকালে ও কার্তিক” মাসে মাংস আহার ত্যাগ করতেন। কিন্তু এর বাইরেও যে মাংস খেতেন না তার কোনো শব্দ প্রমাণ নেই। যার থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, সেসব রাজারা “শরৎকাল ও কার্তিকমাস” বাদে সারাবছর মাংস আহার করতেন। শ্লোক থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়াও কিছু ব্যক্তির দাবী হল, রাম বলতে শ্রীরামকেই নাকি বোঝানো হয়। কিন্তু, মহাভারতেই বলা হয়েছে যে বলরামকেও রাম নামে সম্বোধন করা হয়। তবে দেখে নেওয়া যাক সেই প্রমাণ —

ননু রামোহব্রবীদ্রাজন! ত্বাং সদা যদুনন্দনঃ।
দুর্য্যোধনসমো নাস্তি গদায়ামিতি বীর্য্যবান্ ॥২৬৷৷
[মহাভারত/সৌপ্তিকপর্ব/অধ্যায় ১০/২৬]

অর্থ  মহারাজ ! বলবান যদুনন্দন রাম বলেছেন,‘গদাযুদ্ধে পৃথিবীতে দুর্য্যোধনের সমান আর কেহ নাই’ ॥২৬।।

দেখুন এখানে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে যে- যদুনন্দন রাম, যিনি দূর্যোধনের গদাচালনার শিক্ষা গুরু ছিলেন। তাই এখানে স্পষ্ট শব্দপ্রমাণ থেকে এটা প্রমাণিত হচ্ছে রাম বলতে বলরামকেও বোঝানো হচ্ছে। এবার আরও কিছু প্রমাণ দেখে নেবো —

রামেণাতিবলেনৈতন্ত্রোক্তপূর্ব্বং কদাচন।
ন গদেন ন শাম্বেন যদিদং প্রার্থিতং স্বয়া ॥৩২॥
[মহাভারত/সৌপ্তিকপর্ব/অধ্যায় ১৩/৩২]

অর্থ  তুমি এই যাহা প্রার্থনা করিলে, মহাবল রাম, শাম্ব এবং গদও ইহা কখনও প্রার্থনা করেন নাই ॥৩২॥

অশ্বথামা যখন শ্রীকৃষ্ণের নিকট সুদর্শন চক্র যাচনা করেছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ এরূপ বলেন যে আমার নিজের আপন জনেরাও এমন কখনো বলেনি। তার মধ্যে ছিল রাম অর্থাৎ বলরাম, শাম্ব এবং গদ। এখানেও স্পষ্ট শব্দপ্রমাণ দৃশ্যমান যে রাম বলতে বলরামকে বোঝাচ্ছে। 
এবার দেখে নেবো পুরাণ থেকে —

ব্রহ্মোবাচ ।
বৈবস্বতেহস্তরে প্রাপ্তে যাদবান্বয়সম্ভবঃ।
রামো নাম যদা মর্ত্যো মৎসস্ববলমাশ্রিতঃ।।১৭।।
[মৎস্যপুরাণ/অধ্যায় ৪/১৭]

অর্থ  ব্রহ্মা বললেন, বৈবস্বত মনুর অধিকারকালে মদীয় সব-বলাশিত যদুবংশাবতংস রাম নামে জনৈক অসুরধ্বংসী মানব যখন দ্বারকায় বাস করবেন।।

এখানে প্রজাপতি ব্রহ্মাজী বলছেন, যদুবংশীয় রাম নামে একজন বাস করবেন। ওখানে সম্পূর্ণ প্রসঙ্গটা অধ্যয়ন করলে এটাই সুনিশ্চিত হওয়া যায় যে, এখানে রাম বলতে যদুবংশীয় বলরামের কথা বলা হয়েছে। তাই যারা মহাভারতের অনুশাসনপর্বের রাম নাম টা উল্লেখ করে এটা প্রমাণ করতে চাইছেন যে- উক্ত তথ্যে রাম বলতে সীতাপতি রামকে বোঝাচ্ছে তা সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক। কেননা ইতি মধ্যেই দেখানো হলো যে, রাম বলতে বলরামকেও সম্বোধন করা হয়। তাই এখানে আর অপযুক্তি খাটবে না। তাছাড়াও উক্ত তথ্যে স্পষ্ট শব্দপ্রমাণ সহ বলা আছে যে- “শরৎকাল ও কার্তিকমাসে” মাংস আহার ত্যাগ করতেন, এখানে মাংসভোজী ছিলেন না এমনটা কিন্তু বলা নেই৷ ওখানে একটা সময় নির্ধারন করে দেওয়া হয়েছে — কখন মাংস ত্যাগ করতে হবে সে বিষয়ে। তাই উক্ত তথ্য প্রমাণ থেকে এটা কদাপি প্রমাণিত হয় না যে, সীতাপতি শ্রীরাম মাংস আহার করতেন না। কেননা উক্ত অনুশাসনপর্বে উল্লেখিত রাম আর সীতাপতি শ্রীরাম যে এক‌ই ব্যক্তি, তার উপযুক্ত শব্দপ্রমাণ নেই। আবার রাম বলতে বলরামকেও বোঝায় তার শব্দপ্রমাণ মহাভারতেই আছে। তাই এখানে শংকা অমীমাংসিত রয়ে গেলো যে, উক্তপর্বে রাম বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে। তাই অনুশাসনপর্বের সেই রাম শব্দ থেকে এটা প্রমাণিত হচ্ছে না যে, সীতাপতি শ্রীরাম মাংস আহার করতেন না। আর সেই রাম, বলরাম হোক বা (তর্কের খাতিরে কিছুক্ষণের জন্য ধরে নিলাম) সীতাপতি শ্রীরাম, তারা মাংস আহার ত্যাগ করলেও তা কেবল শরৎকাল ও কার্তিক মাসের জন্য সীমাবদ্ধ ছিলো, বাদবাকী সময়ে মাংস অবশ্যই আহার করেছেন। তাই মূল কথা এই যে, এখানে উপযুক্ত শব্দপ্রমাণের অনুপস্থিতির কারণে শ্রীরাম যে মাংস আহার করতেন না, তা প্রমাণিত হয় না। এবং ওখানে রাম বলতে যে সীতাপতি শ্রীরামকে বোঝানো হয়েছে তাও স্পষ্ট নয়, বরং যদুবংশীয় রাম নামক ব্যক্তি কে বোঝানো হয়েছে,  সীতাপতি রাম তো রঘুবংশের, যদুবংশের নন। 

 তাছাড়া দেখুন, শ্রীরাম হলেন একজন লীলা অবতার, উনি অভিনয় মাত্র সব করছেন। তাই এখানে মাংস আহার করলে শ্রীরামের উপর দোষ আরোপিত হবে এমন কোনো কথা নেই। কেননা তিনি একজন মানুষের ন্যায় জীবন ধারণ করছেন। তাই একজন মানুষ নিজের জীবিকা বা বিশেষ আচারের জন্য যদি মাংস গ্রহণ করেও থাকেন, তবে তাতে কোনো দোষ আরোপিত হয় না। কারণ ব্রহ্মই দাতা, ব্রহ্মই ভোক্তা। এপ্রসঙ্গে শ্রুতিতে বলা আছে যে — 

"অহমন্নাদো৩হহমান্নাদোহহমান্নাদঃ"
[তৈত্তিরীয় উপনিষদ/৩/১০]
অর্থ  সমস্ত ভোগ্যবস্তু, এসবের ভোক্তা জীবাত্মা এবং উভয়ের সংযোগকর্তা পরমেশ্বর একমাত্র আমিই। 

ভোগ্যবস্তু অর্থাৎ অন্ন, ভোক্তা অর্থাৎ যে অন্নকে ভক্ষণ করে, এবং যিনি নিজেই অন্নরূপ এবং যিনি নিজেই ভোক্তা হয়ে অন্নকে ভক্ষণ করছেন তিনিই পরমেশ্বর।
এই প্রসঙ্গে আরও বলা আছে যে—

"অহম্‌ অন্নম্‌ অন্নম্‌ অদন্তম্‌ অদ্মি"
[তৈত্তিরীয় উপনিষদ/৩/১০]
অর্থ  যে নিজের জন্য অন্নরূপ সমস্ত ভোগের উপভোগ করে, সেই ভক্ষণকর্তাকে আমিই অন্নরূপে ভক্ষণ করি। 

ভোগ্যবস্তু, ভোক্তা সবই হলো এক পরমেশ্বর। এই জগৎ ই পরমেশ্বরের অবয়ব। তাই এখানে শ্রীরাম হয়ে যিনি মাংস ভক্ষণ করছেন তিনিই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম যেহেতু মায়ার জগতে সরাসরি প্রবেশ করেননা, তাই তিনি নির্বিকার থেকে নিজের অংশভূত লীলাবিগ্রহ দ্বারা সমস্ত কার্য করান৷ সেই অবিনাশী নির্বিকার পরমব্রহ্ম শিবের লীলাবিগ্রহের মধ্যে একটি হলেন শ্রীরাম৷ যিনি মানবরূপে লীলা করছেন৷ তাই এক্ষেত্রে শ্রীরামের মাংস ভক্ষণে শ্রীরামের মর্যাদার কিছুমাত্র উলঙ্ঘন হয় না। 
কারণ, তাত্ত্বিক ভাবে ভোগ্যবস্তু এবং ভোক্তা রূপে এক ব্রহ্মই বিদ্যমান "সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম" [ছান্দোগ্য উপনিষদ/৩/১৪/১] এই সবকিছুই তো ব্রহ্ম। তাই সবকিছুই যখন ব্রহ্ম সেখানে শ্রীরামের ক্ষেত্রে অন্য কোনো নিয়ম আরোপিত হবে না। তাই এক্ষেত্রে মীমাংসা হলো শ্রীরাম যখন মানব রূপে লীলা করছেন, তাই একজন মানবের স্বভাব অনুযায়ী শ্রীরামের মাংস আহার কোনো দোষযুক্ত নয়। তাই এখানে বিষয়টাকে প্রক্ষিপ্ত না বলে, উপযুক্ত চিন্তা ভাবনা দ্বারা বোঝার চেষ্টা করায় ন্যায় সঙ্গত ও বুদ্ধিমানের কাজ।

তাই সিদ্ধান্ত হলো— 


১. শ্রীরাম শুধু ফল-মূল ও মধুর উপর নির্ভর করে বনবাসের জীবন নির্বাহ করেননি।
২. শ্রীরাম বনবাসের জীবন নির্বাহে মাংস আহার করেছেন। 
৩. উপাসনা এবং জীবন নির্বাহ দুই দিকেই প্রয়োজন অনুসারে মাংস গ্রহণ করেন শ্রীরাম।

শ্রীরাম না একাধারে ফল,মূল, মধু খেয়েছেন না মাংস। প্রয়োজন অনুসারে যখন যা সুলভ হয়েছে তাই গ্রহণ করেছেন। যেমনটা বিভিন্ন ঋষি-মুনিরা করে থাকেন, যখন যা উপলব্ধ হয় তা দিয়েই জীবন নির্বাহ করে। কারণ তারা অল্পতেই সন্তুষ্ট। আর শ্রীরামও ছিলেন অল্পতে সন্তুষ্ট।
আশা রাখি এই বিষয়ের সবার যে সন্দেহ টা ছিলো তার সমাধান করতে পেরেছি।

♦️ যদি শাস্ত্র প্রমাণ দেখেও কেউ শাস্ত্রের বচন কে সত্য বলে বিশ্বাস না করে , যারা নিজেদের নিরামিষাশী ভাবনার গোঁড়ামিতাকে জোর করে ধরছ রাখবার জন্য শাস্ত্র কে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, অবিশ্বাস করে তাদের জন্য এই লিঙ্ক টি র‌ইল, দেখে নিন 👇




জয় শ্রীরাম ✊🚩
ॐ নমঃ শিবায় 🙏
ॐ সাম্বসদাশিবায় নমঃ 🙏
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩 
হর হর মহাদেব 🚩 

✍️সত্য উন্মোচনেঃ— শ্রী অন্তিক ভট্টাচার্য্য (শম্বরনাথ শৈব)

🌻বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ— আমার গুরু শ্রী নন্দীনাথ শৈবাচার্য ও শ্রী রোহিত কুমার চৌধুরী শৈবজী।

কপিরাইট ও প্রচারেঃ— আন্তর্জাতিক শিবশক্তি জ্ঞান তীর্থ (International Shiva Shakti Gyan Tirtha)

আরো দেখুন 👇 


মন্তব্যসমূহ

  1. আমাদের সমস্ত প্রাচীন আচার্যগণ রামচন্দ্রের মাংস আহারের বিপক্ষে ছিলেন। তাদের এই মত যে রামচন্দ্র মাংস আহার করেন নি।

    প্রথম আপত্তি:-
    সুরাঘটসহস্রেণ মাংসভূতৌদনেন চ। মক্ষ্যৈত্বাং প্রীমতাং দেবি পুরীং পুনরুপাগতা।।
    অনুবাদ:- যখন আমি অযোধ্যা ফিরব তখন সহস্র দেব-দূর্লভ সামগ্রী ও রাজাদেরও ভোগের অতীত বস্তুর দ্বারা আপনার পূজা দেব।

    পর্যবেক্ষণ:- সুরাঘট" ও "মাংস" এই দুইটা নিয়ে সমস্যা হয়।
    সুরাঘট: কিন্তু প্রাচীন টীকাকার "শিবসহায়" রামায়ণের অন্যতম এক টীকা "রামায়ণ শিরোমণি" তে সুরাঘটের সন্ধি বিচ্ছেদ করেন সুর+অঘট= সুরাঘট হিসেবে, যথা:-"সুরেষু দেবেষু ন ঘটন্তে" অর্থাৎ, সুরাঘট শব্দে সুর অর্থ দেবতা আর অঘট অর্থ যা ঘটা সম্ভব না বা দুর্লভ।
    মাংস: মাংস দিয়ে যে পশুর মাংস হবে এমন না। কেননা বৈদিক অভিধান নিরুক্ত অনুযায়ী মাংস শব্দ ভিন্ন অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। নিরুক্ত ৪/৩ এ বলা হয়েছে- " মাংসং মাননং বা মানসং বা মনোহস্মিন্সীদতীতি বা।" অর্থাৎ যা মানের যোগ্য কিংবা যা দ্বারা মনের রুচি বৃদ্ধি পায়। মাংস দিয়ে শুধু পশুর মাংস (meat) বুঝাবে তা নয়, মাংস দিয়ে ফলের নরম অংশ তথা শাঁসকে (flesh)ও বুঝানো হয়। আর প্রচীন টীকাকার "শিবসহায়" মাংস শব্দের অর্থ করেন, "মা নাস্তি অংসো রাজভোগো যস্যাং" অর্থাৎ, যা রাজদের ভোগেও প্রাপ্য হয় না এমন দূর্লভ বস্তু সামগ্রী।

    দ্বিতীয় আপত্তি:-
    তাং তদা দর্শমিত্বা তু মৈথিলীং গিরিনিম্নগাম্। নিম্নসাদ গিরিপ্রস্থে সীতাং মাংসেন ছন্দমন্।। ইদং মেধ্যমিদং স্বাদু নিস্টপ্তমিদমগ্নিনা। এবমান্তে স ধর্মাত্মা সীতমা সহ রাঘবঃ।।
    অনুবাদ:- এইভাবে মিথিলেশকুমারী সীতাকে মন্দাকিনী নদীর দর্শন করানোর সময় রামচন্দ্রজী পর্বতের সমতল প্রদেশে তাঁর সাথে বসে পড়লেন এবং তপস্বীদের ভোগোপযগী ফলমূলের দ্বারা মাতা সীতার মানসিক প্রসন্নতাকে বৃদ্ধি করে উনার প্রযত্ন করলেন। ধর্মাত্মা রঘুনন্দন সীতাজীর সাথে এই প্রকারে কথা কথা বলছিলেন- 'পিয়! এই ফল পরম পবিত্র। ইহা অত্যন্ত সুস্বাদু এবং ইহা ভালভাবে আগুণে পাকানো হয়েছে।

    পর্যবেক্ষণ:- উপরোক্ত ( প্রথম আপত্তি) আলোচনায় দেখানো হয়েছে মাংস কেবল পশুর মাংস নয়। ফলমূল ইত্যাদিকেও বুঝায়। রামায়ণ শিরোমণি টীকায় বলা হচ্ছে "মাংসেন তাপসোপভোগ্যফলাদিনা" অর্থাৎ, মাংস শব্দে তপস্বীদের খাওয়ার উপযোগী ফলমূল বোঝায়।

    যারা যুক্তি দেখায় যে, ভগবান রামচন্দ্র মাংস আহার করতেন। এমন দাবী করা ব্যক্তিদের সমস্ত দাবী গুলোকে নিমিষেই খণ্ডন করা যায়। যেহেতু আচার্যদেবগণ রাম চন্দ্র আমিষ আহারের বিপক্ষে ছিলেন। এবং তাদের সমস্ত দাবী গুলো খণ্ডন করা যায় সে প্রেক্ষাপটে বলা যেতে পারে। রামচন্দ্র মাংস ভক্ষণ করতেন না। এমন কথা রামায়ণেই আছে।

    ন মাংস রাঘবো ভূঙ্ক্তে ন চাপি মধুসেবতে।
    (সুন্দর কান্ড ৩৬।৪১)
    "রাঘব রাম না মাংস খান, না মদ্য পান করেন।"

    নিচের স্ক্রিনশর্ট লক্ষ্য করুন। পঞ্চানন তর্করত্ন রামায়ণের সংস্কৃত শ্লোকের অর্থ ঘুরিয়ে রামচন্দ্রের মাংস আহারের পক্ষে ছিলেন। যেমন, পঞ্চানন সুন্দর করে নিত্যং এর অংশে সায়াহ্নে করেছেন। যিনি নিত্য নিরামিষাশী ছিলেন। তিনি কি আবার, রাগব মধু-পান ও মাংস ভোজন পরিত্যাগ করিয়া কেবল সায়াহ্নে অরণ্যজাত সুবিহিত ওদন ভোজন করিয়া থাকেন।

    যদিও রামচন্দ্র বিশ্বরূপে আপনাকে আমাকে প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ডকে ভক্ষণ করবেন এবং প্রতি মুহূর্তে ভক্ষণ করছেন। কিন্তু রামচন্দ্র ব্যক্তি রূপে মাংস ভক্ষণ করলে সমস্ত শাস্ত্রের সঙ্গে বিরুদ্ধ চলে আসে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ভাইয়ের কি মাথায় সমস্যা আছে? কপি-পেস্ট না করে নিজের বুদ্ধিমত্তাতে কাউন্টার করুন। আপনি যে দাবীগুলো করেছেন তারই খণ্ডন উপরে বিস্তারিত ভাবে দিলাম। সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ না পড়ে কেবল দু একটা শ্লোক তুলে দাবী করলে তা সত্য হয়ে যায় না। উপযুক্ত শব্দ প্রমাণ লাগে।

      আর আপনার মন্তব্য দেখে মনে হচ্ছে আপনি সম্পূর্ণটা পড়েননি। আর পড়লেও বুঝেননি।

      মুছুন
    2. ইহা ভ্রান্ত ধারণা যে সকল আচার্যগণ রামচন্দ্রের মাংস ভক্ষণে অবিশ্বাস করিয়াছেন। ধর্মসম্রাট করপাত্রী মহারাজ স্বকীয় ‘রামায়ণ মীমাংসা’ গ্রন্থে প্রাচীন ‘তিলক’ টীকার উদ্ধৃতি প্রদান করিয়া প্রমাণ করিয়াছেন যে, শ্রীরাম মাংস ভক্ষণ করিয়াছিলেন। তদুপরি, শ্রীবৈষ্ণব আচার্য গোবিন্দরাজও ‘ভূষণ' নামক নিজ ব্যাখ্যাগ্রন্থে রামের মাংস ভোজনকে অনুমোদন প্রদান করিয়াছেন।

      মুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ