সন্ধ্যাকালে একমাত্র পরমেশ্বর শিবের পূজা করা সকল সনাতনীর কর্তব্য
ভূমিকা —
বর্তমান সময়ে সনাতনীরা নিজ ধর্মের নির্দিষ্ট আচার অনুষ্ঠান পালন না করে, বিভক্ত হয়ে গিয়ে যে যেমন পারছে তেমন ভাবে নিজের ইচ্ছে মতো যা মনে হয় তা করছে। এভাবেই বর্তমানে এই কলিযুগের সনাতনীরা সনাতন ধর্মের নির্দিষ্ট আচার নিয়মগুলিকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের মন যা বলে সেই অনুযায়ী কার্যক্রম করে চলেছে, এতে সমাজ আরো অবনতির দিকে এগিয়ে চলেছে। ঠিক এমন প্রকারে সন্ধ্যাকালে মূলত কার উপাসনা করা উচিত - সে বিষয়ে সনাতনীদের বিন্দুমাত্র জ্ঞান অবশিষ্ট নেই। খুবই দুঃখ লাগে এই সনাতন ধর্মের করুণ অবস্থা দেখে। এক সময় গুরুকুল ছিল, সেখানে শৈবাগম, বেদ, পুরাণ, ইতিহাস ইত্যাদি শাস্ত্রসমূহ পাঠ করানো হতো, কিন্তু বর্তমানে জ্ঞানপাপী কিছু ব্যক্তি নিজের কাল্পনিক মনগড়া মান্যতাকে টিকিয়ে রাখবার জন্য বলে বেড়ায় শাস্ত্রজ্ঞান বৃথা, শাস্ত্র দ্বারা নাকি ঈশ্বর লাভ হয় না । এই ধরণের অজুহাত দিয়ে শাস্ত্রের বিজ্ঞান থেকে মানুষের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ফলে, সঠিক জ্ঞান ও প্রকৃত মান্যতা সম্বন্ধে মানুষ অনভিজ্ঞ রয়ে গিয়েছে। এভাবেই জ্ঞানের অভাবে মানুষ সন্ধ্যাকালে সন্ধ্যা পূজা করছে অন্ধের মতো, সন্ধ্যাকালে প্রকৃত পক্ষে একমাত্র কার পূজা করা হয়ে থাকে ? — এ বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান নেই।
সন্ধ্যাকালে মূলত কার উপাসনা করা উচিত, সে বিষয়ে আমি শাস্ত্র প্রমাণ উল্লেখ করে উত্তর উপস্থাপন করছি । যেমনভাবে তৃতীয়া তিথিতে মা গৌরী পূজিত হন, চতুর্থীতে শ্রীগণেশ পূজিত হন, ষষ্ঠীতে শ্রীকার্তিকেয় পূজিত হন, এই মুহূর্ত গুলি যেমনভাবে নির্দিষ্ট একজনের জন্যই নির্দিষ্ট হয়ে থাকে, তেমন ভাবেই প্রতিদিন প্রদোষ কালে অর্থাৎ প্রতিদিনের বৈকালিক সন্ধ্যাবেলায় একমাত্র একজনের উদ্দেশ্যেই গৃহে সন্ধ্যাপূজা করা উচিত। চলুন সে বিষয়ে শাস্ত্র কি বলছে তাতে আলোকপাত করি।
সন্ধ্যা কালে একমাত্র কার পূজা করা সকল সনাতনীর কর্তব্য ?
উত্তর —
কৈলাস শৈল ভবনে ত্রিজগজ্জনিত্রীং গৌরীং নিবেশ্য কনকাঞ্ছিতরত্নপীঠে। নৃত্যং বিধাতুমভি বাঞ্ছতি শূলপাণৌ দেবাঃ প্রদোষ সময়েহনু ভজন্তি সর্বে ॥৭৬
বাগদ্দেবী ধৃতবল্লকী শতমখো বেনুং দধৎ পদ্মজম্ভালোরিদ্রকরো রমা ভগবতী গেয় প্রয়োগান্বিতা।
বিষ্ণুঃ সান্দ্রমৃদঙ্গ বাদগেটুদেবাঃ সমন্তাৎ স্থিতাঃ সেবন্তে তমনু প্রদোষ সময়ে দেবং মৃড়ানীপতিম্ ॥৭৭
গন্ধর্বযক্ষপত গোরগসিদ্ধসাধ্যা বিদ্যাধরামবর অপ্সরসাং গণাশ্চ। যে অন্যে ত্রিলোেকনিলয়াঃ সহ ভূতবর্গাঃ প্রাপ্তে প্রদোষসময়ে হরপার্শ্বসংস্থাঃ ॥৭৮
অতঃ প্রদোষে শিব এক এব পূজ্যো অথ নান্যে হরিপদ্মজাদ্যাঃ। তস্মিন মহেশে বিধিনেজ্যমানে সর্বে প্রসীদন্তি সুরাধিনাথাঃ ॥৭৯
[তথ্যসূত্র - স্কন্দপুরাণ/ব্রহ্মখণ্ড/উত্তরখণ্ড/৬নং অধ্যায়/৭৬-৭৯নং শ্লোক]
অর্থ — পরমেশ্বর শূলপাণি শিব প্রদোষ সময়ে (অর্থাৎ সন্ধ্যা কালে) তার নিবাসস্থান কৈলাসে স্থিত কনকাঞ্চিত রত্নপীঠে ত্রিজগতের জননী পার্বতী দেবীকে বসিয়ে তিনি তার নৃত্য আরম্ভ করেন, তখন সকল দেবতা সেই কৈলাসে গিয়ে উপস্থিত হন । বাগ্ দেবী অর্থাৎ সরস্বতী দেবী বীণা বাদন করেন, দেবরাজ ইন্দ্র বাঁশি বাজাতে থাকেন, ব্রহ্মা তাল প্রদান করেন, লক্ষ্মী দেবী ও ভগবতী পার্বতী দেবী সঙ্গীত গায়ন করেন, শ্রী হরি বিষ্ণু মৃদঙ্গ বাজাতে থাকেন এবং বাকি সকল দেবতা প্রদোষ (অর্থাৎ সন্ধ্যা কালে) বিভিন্ন প্রকারে মৃড়াণীপতি নটরাজ শিবের সেবা করতে থাকেন । গন্ধর্ব, যক্ষ, পতগ-উরগ, সিদ্ধসাধ্য, বিদ্যাধর, বরঅপ্সরা, গণ, পর-অপর ত্রিলোকনিবাসী ভূতপ্রেতগণ মহাদেবের কাছে এই সময়ে কৈলাসে উপস্থিত থাকেন। অতএব, প্রদোষ অর্থাৎ সন্ধ্যা কালে একমাত্র শিবই পূজনীয় ব্রহ্মা, হরি বা অন্য কোন দেবতাই সন্ধ্যা কালে পূজার জন্য প্রধান পুজ্য হিসেবে উপযুক্ত নন। এই বিধি অনুযায়ী পরমেশ্বর শিবের পূজা সন্ধ্যাবেলায় করলে সমস্ত দেবতাই প্রসন্ন হয়ে যান ॥৭৬-৭৯
ব্যাখ্যা —
লক্ষ্য করুন, সন্ধ্যাকালে সকল দেবতারা কৈলাসে গিয়ে উপস্থিত হন, সেখানে তখন পরমেশ্বর শিব নৃত্য করেন, ব্রহ্মা বিষ্ণু সহ সকল দেবতা বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে পরমেশ্বর শিবের নৃত্য দর্শন করেন। পরমেশ্বর শিবের গণ, গন্ধর্ব, যক্ষ, ঋষিমুনি, সিদ্ধগণ, অপ্সরা সকলেই ঐ সন্ধ্যাকালে পরমেশ্বর শিবের কৈলাসে উপস্থিত থাকেন। এখান থেকে স্পষ্ট করেই বোঝা যাচ্ছে যে ‘পরমেশ্বর শিব’ হলেন সকলেন মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এমনকি স্কন্দমহাপুরাণের শ্লোকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ‘অতঃ প্রদোষে শিব এক এব পূজ্যো অথ নান্যে হরিপদ্মজাদ্যাঃ’ অর্থাৎ,
প্রদোষে - সন্ধ্যাবেলায়,
শিব এক এব পূজ্যো - শিবই একমাত্র ও শুধুমাত্র পূজার যোগ্য,
অথ নান্যে হরিপদ্মজাদ্যাঃ - হরি পদ্মযোনী-ব্রহ্মা বা অন্য কেউ নন।
সরলভাবে বললে, সন্ধ্যাবেলায় শিবই একমাত্র ও শুধুমাত্র পূজার যোগ্য, হরি পদ্মযোনী-ব্রহ্মা বা অন্য কেউ নন।
সুতরাং এখান থেকে স্পষ্ট ভাবে প্রমানিত হয়ে গেল যে, সন্ধ্যাবেলায় প্রত্যেক সনাতনী ব্যক্তির উচিত শুধুমাত্র পরমেশ্বর শিবের পূজা করা, সন্ধ্যাবেলায় যে পূজা করা হবে তা কখনোই শ্রীহরি, ব্রহ্মা বা অন্য কোনো দেবদেবীর উদ্দেশ্যে নয়, একথা শাস্ত্রের ।
অথচ বর্তমানকালে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়েছে, তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো স্বেচ্ছাচার করে সন্ধ্যাবেলার সময় পরমেশ্বর শিবকে ছেড়ে অন্য যেকোনো দেবদেবীর উদ্দেশ্যে পূজার্চনা করছে, সন্ধ্যাকালে গৃহস্থরা নিজেদের গৃহে পরমেশ্বর শিবকে প্রাধান্যতা না দিয়ে যে কোনো দেবদেবীকে সিংহাসনে বসিয়ে পূজা করছে। এর ফলে শাস্ত্রের নির্দেশ দেওয়া বিধিবিধানের উল্লঙ্ঘন হচ্ছে, ফলে ধর্মের হানি হচ্ছে, আর এভাবেই মানুষ ক্রমাগত ধর্মপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে কর্মফলে আবদ্ধ হয়ে অধোগতি প্রাপ্ত করছে। এই ধরণের ধর্মবিচ্যুত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা অনান্য ব্যক্তিরও ধর্মবিচ্যুতি ঘটে, ফলে বিপুলসংখ্যক জনগণ এভাবেই আজ ধর্মবিচ্যুতির পথে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় শুধুমাত্র পরমেশ্বর শিবকে পূজা না করে, তার স্থানে অনান্য দেব দেবীর উদ্দেশ্যে সন্ধ্যার ধূপ দীপ প্রদান করে, যা তারই ধর্মবিচ্যুতির কার্যক্রম।
অতএব, সন্ধ্যা বেলায় যার উদ্দেশ্য পূজা করা হয়ে থাকে সেই একমাত্র পরমেশ্বর শিবের উদ্দেশ্যেই সন্ধ্যার ধূপ, দীপ ইত্যাদি জ্বেলে পূজার্চনা করা উচিত। অনান্য দেবদেবী সন্ধ্যা বেলায় পূজা পাবার ক্ষেত্রে গৌণ, কারণ, শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, সন্ধ্যা বেলায় সকল দেবদেবী পরমেশ্বর শিবের সেবার ব্যস্ত থাকেন, সরস্বতী দেবী বীণা বাজাতে থাকেন, শ্রীহরি মৃদঙ্গ বাজাতে থাকেন, ব্রহ্মা তাল প্রদান করতে থাকেন, লক্ষ্মীদেবী ও ভগবতী পার্বতী দেবী শিবের উদ্দেশ্যে সঙ্গীত গায়ন করতে থাকেন, ইন্দ্র বাঁশি বাজাতে থাকেন, অনান্য দেবদেবী তথা সকলে পরমেশ্বর শিবের সেবা করতে থাকেন। তাই এখান থেকে স্পষ্টভাবে অবগত হওয়া গেল যে, সন্ধ্যাকালে পরমেশ্বর শিবের পূজা-আরতি করতে ব্যস্ত থাকে সকল দেবদেবী স্বয়ং নিজেই ।
তাই সন্ধ্যাকালে পূজ্য একমাত্র পরমেশ্বর শিব ছাড়া আর অন্য কোনো দেবদেবী নন।
(প্রশ্ন - ১) আমি যদি শিবপূজা না করে সন্ধ্যা বেলায় আমার পছন্দের আরাধ্য বা আরাধ্যা কোনো দেবদেবীকে পূজা করি তবে এতে আপনার কি সমস্যা বলুন তো ?
উত্তর — আমার কোনো সমস্যা নেই, আমার কেন সমস্যা হতে যাবে ? সন্ধ্যাবেলায় মূলত কার উপাসনা করা উচিত সেই প্রসঙ্গে শাস্ত্রে যে বিধান দেওয়া হয়েছে আমি শুধুমাত্র তা উল্লেখ করেছি, যাতে মানুষ ধর্ম থেকে চ্যুত না হয়ে যায়। আর আপনি বললেন - আপনি শিবপূজা না করে আপনার পছন্দ মতো কোনো দেবদেবী কে পূজা করবেন। এটি আপনার ব্যক্তিগত মতামত, কিন্তু আপনার ব্যক্তিগত মতামত তো আর সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। সকলের জন্য একমাত্র শাস্ত্রের নির্দেশই প্রযোজ্য। তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে, যদি কেউ সন্ধ্যাকালে পরমেশ্বর শিবের অর্চনা না করে তবে তার দুর্গতি অবশ্যম্ভাবী, প্রমাণ দেখুন 👇
যে নার্চয়ন্তি গিরিশং সময়ে প্রদোষে যে নার্চিতং শিবমপি প্রণমন্তি চান্যে। এতৎ কথাং শ্রুতিপুটৈর্ন পিবন্তি মূঢ়ান্তে জন্মজন্মসু ভবন্তি নরা দরিদ্রাঃ ॥৭৪
[তথ্যসূত্র - স্কন্দ পুরাণ/ব্রহ্মখণ্ড/উত্তরখণ্ড/৬নং অধ্যায়]
অর্থ — যে ব্যক্তি সন্ধ্যাকালে পরমেশ্বর শিব কে পূজার্চনা বা প্রণাম করেন না কিংবা শিব মহিমার কথা পাঠ বা শ্রবণ করেন না, সেই জ্ঞানহীন, মূঢ়ব্যক্তি জন্মে জন্মে দরিদ্র অর্থাৎ গরিব হয়ে থাকেন ॥৭৪
— শাস্ত্র প্রমাণ সহ বলছি, আপনি যদি সনাতন ধর্মের বিষয়ে শাস্ত্রের বিধিমত না চলেন তবে আপনার পতন অনিবার্য, কারণ আপনি যদি নিজের ইচ্ছে মতো সন্ধ্যাকালে শিবপূজা করতে অনিচ্ছুক হন তবে শাস্ত্রই আপনার মতো ব্যক্তির জন্য যে দুর্গতি অপেক্ষা করছে, তার স্পষ্ট বর্ণনা করে রেখেছেন। সুতরাং, আপনি আপনার জেদবশত সন্ধ্যাবেলায় শিবপূজা না করে যদি অন্য কোনো দেবদেবীর পূজা করেন সেক্ষেত্রে আপনি আপনার কৃতকর্মের ফল ভোগ করবেন, এতে আপনিই দায়ী থাকবেন। আপনি শাস্ত্রের নির্দেশিত পথে চলবেন নাকি নিজেকে অনেক বড় জ্ঞানী ভেবে অহংকার বশত যা মনে হয় তা করবেন - এটি আপনার ব্যক্তিগত বিষয়, আপনি যেমন কর্ম করবেন তেমন ফল ভোগ করবেন। এখানে আমার কি সমস্যা থাকতে পারে, আমি শুধু শাস্ত্রের বিধানকে লোকসমাজে তুলে ধরছি, যার গ্রহণযোগ্য মনে হবে সে গ্রহণ করবে, আর যার মনে হবে এসব মান্য করবার প্রয়োজন নেই, সে মান্য করবে না। এতে আমার কিছুই লাভ ক্ষতি নেই। আমার প্রচেষ্টা শুধু এতটুকুই যে, মানুষ যেন সঠিক পথে পরিচালিত হয়, যাতে সনাতনীরা সকলে সংঘবদ্ধ হয়ে এক হয়, বিভিন্ন মতপথের অশাস্ত্রীয় কাল্পনিক মান্যতার ফাঁদে পড়ে যাতে সনাতনীরা সনাতন ধর্মের মূলস্রোত থেকে ছিটকে না যায়, শাস্ত্রই সনাতন ধর্মের দলিল হওয়ার কারণে শাস্ত্রের মধ্যে যা নির্দেশনা আছে তা আমি তুলে ধরি। আপনি সেই নির্দেশনা মানবেন নাকি নরকে ঠাঁই পেতে চাইবেন সেটির সিদ্ধান্ত আপনিই নেবেন।
____________________________________________
(প্রশ্ন — ২) ধরুন, আমি যদি আমার পছন্দের দেব দেবীকে সন্ধ্যায় ধূপ দীপ জ্বেলে পূজা করলাম, আর তার সাথে শিবকেও ধূপদীপ দেখিয়ে দিলাম, এতে কি শাস্ত্রের বাক্য মান্য হয়ে যাবে ?
উত্তর — না, এমন কার্যকে শাস্ত্রবাক্যের সাথে ছলনা করা বোঝায় । কারণ, আপনি যখন সন্ধ্যা বেলায় পূজা করছেন তখন আপনার মনের মধ্যে আপনার পছন্দের দেবদেবীর প্রতিই সন্ধ্যাপূজার ভাবনা রয়েছে, শিবের প্রতি নয়। আপনি বাধ্য হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিবপূজা করলেন, অর্থাৎ আপনি সন্ধ্যাকালের পূজার সময় নিজের পছন্দের দেবদেবীকেই প্রধান মূখ্য মনে করে পূজা করেছেন, পরমেশ্বর শিবকে আপনি গৌণ মনে করে বাধ্য হয়ে পূজা করেছেন। ফলে শাস্ত্রে যেখানে পরমেশ্বর শিবকেই সন্ধ্যাবেলায় পূজার প্রধান উপাস্য বলে নির্দেশ দিয়েছে, সেই শাস্ত্রের বচনকে আপনি অমান্য করেছেন। সুতরাং এতে আপনার সন্ধ্যা পূজা সম্পন্ন তো হলোই না বরং আপনি ছলনা করবার দায়ে দোষী হয়ে গেলেন। কারণ স্কন্দমহাপুরাণের শ্লোকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ‘অতঃ প্রদোষে শিব এক এব পূজ্যো অথ নান্যে হরিপদ্মজাদ্যাঃ’ অর্থাৎ, সন্ধ্যাবেলায় শিবই একমাত্র ও শুধুমাত্র পূজার যোগ্য, হরি পদ্মযোনী-ব্রহ্মা বা অন্য কেউ নন।
তাই শাস্ত্রের বিধানকে আইনের ফাঁক ভেবে ছলনার আশ্রয় নিলে আপনিই ফাঁসবেন।
____________________________________________
(প্রশ্ন — ৩) তাহলে আপনি কি বলতে চাইছেন যে, আমি আমার আরাধ্য দেবদেবীকে সরিয়ে সন্ধ্যাবেলায় শুধু শিবপূজা করবো ?
উত্তর — আমি বলবার কেউ নই, আমার কথা প্রমাণ নয়, শাস্ত্র যা বলছে তা আমি উল্লেখ করেছি মাত্র, শাস্ত্রের যে নির্দেশ আমি উল্লেখ করেছি সেটিই মান্য, ধর্মের ক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত মতামত গ্রহণযোগ্য নয়। আপনি সনাতন ধর্মের মূলস্রোত থেকে ছিটকে গিয়ে জ্ঞানের অভাবে অনান্য দেবদেবীকেই আপনি নিজের আরাধ্য বানিয়েছেন, এখানে শাস্ত্র দায়ী নয়, আপনি দায়ী। শাস্ত্র বলে রেখেছে যে সনাতন ধর্মের পরমেশ্বর একজনই, তারই ভজনা করো, কিন্তু আপনারা সেই নির্দেশ সম্পর্কে অবগত হতে পারেননি তাই প্রভু শিবকে ছেড়ে অনান্য দেবদেবীকে আরাধ্য বানিয়েছেন। আপনি নিজের ফাঁদে নিজেই আবদ্ধ হয়ে গিয়েছেন, এতে আমার কি করবার আছে, সনাতন ধর্মেরই বা কি করা আছে। প্রত্যেক সনাতনী ব্যক্তির জন্য একমাত্র প্রভু শিবের আরাধনা করা উচিত। তার কারণ হল, তিনিই একমাত্র পরমেশ্বর।
প্রভু শিবই একমাত্র পরমেশ্বর তার প্রমাণ দেখুন,
বেদ শাস্ত্র বলছে, পরমেশ্বর শিব স্বয়ংই ॐ, শিবই সাকার পরমব্রহ্ম, আবার শিবই নিরাকার পরমব্রহ্ম। পরমব্রহ্ম শিবকে ছাড়া দ্বিতীয় অন্য কোনো পরমেশ্বর নেই। প্রমাণ —
শিব ॐ-কার 👇
প্রযতঃ প্রণবো নিত্যং পরমং পুরুষোত্তমম্।
ওঙ্কারং পরমাত্মনং তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু ॥ ২০
(‘ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২০’ এবং
ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/ ৪ নং অধ্যায় / ১১ নং খিলা/২০ মন্ত্র)
অর্থ – যিনি প্রণবরূপি নিত্য (শাশ্বত) পরমপুরুষোত্তম (সর্বশ্রেষ্ঠ/পরাকাষ্ঠা/পুরুষ/ব্রহ্ম), যিনি সাক্ষাৎ ॐ-কার ও স্বয়ং পরমাত্মা, সেই পরমব্রহ্ম শিবের প্রতি (আমার/আমাদের) মন সংকল্পিত হউক ॥
শিব নিরাকার 👇
যোহসৌ সর্বেষু বেদেষু পঠতে হ্যজ ঈশ্বরঃ।
অকাযো নির্গুণোহধ্যাত্মা তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্ত ॥ ২৩
(‘ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২৩’ এবং
ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/ ৪ নং অধ্যায় / ১১ নং খিলা/২৩ মন্ত্র)
অর্থ – সমগ্র বেদ পাঠ করলে যাকে একমাত্র ঈশ্বর বলে জানা যায়, যিনি (পরমার্থে) একমাত্র নিরাকার নির্গুণ, সেই পরমেশ্বর শিবের প্রতি আমার মন সংকল্পিত হোক ॥
শিব সাকার রূপধারী 👇
কৈলাসশিখরাভাসা হিমবদগিরিসংস্থিতা।
নীলকন্ঠং ত্রিনেত্রং চ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু ॥ ২৫
(‘ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/২৫’ এবং
ঋগ্বেদ সংহিতা/খিলানি/ ৪ নং অধ্যায় / ১১ নং খিলা/২৫ মন্ত্র)
অর্থ - কৈলাস পর্বতের শিখরে হিমগিরিতে যিনি বিরাজমান, যিনি নীলকণ্ঠ, ত্রিনেত্রধারী সেই পরমব্রহ্ম শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হউক ॥
📂 ব্রহ্মা বিষ্ণু চেয়েও শ্রেষ্ঠ একমাত্র পরমেশ্বর শিব, তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই, প্রমাণ —
পরাৎপরতরো ব্রহ্মা তৎপরাৎপরতো হরিঃ ।
তৎপরাৎপরতো হ্যেষ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু ॥ ১৮
[ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/শিবসংকল্পসূক্ত]
এবং (ঋগ্বেদ সংহিতা/খিল ভাগ /৪/১১)
অর্থ — সর্বোপরি হলেন ব্রহ্মা । তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হরি এবং এনাদের চেয়েও যিনি পরমতম তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ‘ঈশ’ ( ঈশান/ঈশ্বর/সদাশিব) সেই শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হোক ।
🔶এবার দেখুন ! এই একই মন্ত্রকে আরো বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে
অথর্ববেদে শরভ উপনিষদের মধ্যে 👇
পরাৎপরতরং ব্রহ্মা যৎপরাৎপরতো হরিঃ ।
পরাৎপরতরোঃ ঈশঃ তস্মাৎ তুল্যোঽধিকো ন হি ॥২৯
(শরভ উপনিষদ/২৯নং মন্ত্র)
অর্থ – যিনি পরাৎপর ব্রহ্মা, তাঁর থেকেও অধিক পরাৎপর হলেন হরি। কিন্তু হরির থেকেও অধিক যিনি পরাৎপর তিনিই হলেন ঈশ(সদাশিব), সেই প্রভু শিবের সমান তথা তাঁর চেয়ে অধিক কেউ নেই ,কারণ শিবই সর্বোচ্চ সত্ত্বা পরমব্রহ্ম।
বিষ্ণু ও অনান্য সকল দেবতার রূপ পরমেশ্বর শিবই ধারণ করেন, বেদ বলেছে এই কথা —
প্রভু শিবই শ্রীবিষ্ণুরূপ ধারণ করে পালন কার্য করছেন(অথর্বশির উপনিষদ/২/২),
ব্রহ্মারূপ ধারণ করে প্রভু শিবই জাগতিক সংসার সৃজন করছেন(অথর্বশির উপনিষদ/২/১), আবার রুদ্র রূপ ধারণ করে সংহার করছেন।
বিভিন্ন দেবতার রূপে প্রভু শিবই প্রকাশমান(অথর্বশির উপনিষদ/২/১-৩৩)।
কিন্তু এই দেবতারা পরমেশ্বর শিবের অনিত্য রূপ ভেদ মাত্র। তাই এনাদের কখনোই অক্ষয় নিত্য পরমব্রহ্ম বলে স্বীকার করা হয়না, বেদই বলেছে শিবই একমাত্র ধ্যেয়, বিষ্ণু সহ অনান্য সব দেবতা প্রকৃত ধ্যেয় বস্তু নন। দেখুন —
এক এব শিবো নিত্যস্ততোহন্যসকলং মৃষা ।
তস্মাৎসর্বাপরিত্যজ্য ধ্যেযান্বিষ্ণবাদিকান্সুরান্ ॥ ৩০
(শরভ উপনিষদ/৩০নং মন্ত্র)
অর্থ – শিবই একমাত্র নিত্য, অন্য সকল কিছুই মিথ্যা। এই কারণে বিষ্ণু সহ সকল দেবতাকে পরিত্যাগ করে শিবকেই ধ্যেয় বলে জানা উচিত ॥ ৩০
— উপরোক্ত বেদবানী থেকে প্রমাণিত হল যে, একমাত্র প্রভু শিবই উপাসনার যোগ্য। তাকে ছেড়ে নিজের ইচ্ছে মতো যে কোনো দেবদেবীকে আরাধ্য বানানোর অর্থ আপনি নিজেই নিজেকে ঠকিয়ে চলেছেন, কারণ সনাতন ধর্মের শাস্ত্রের মধ্যে যা নির্দেশ রয়েছে তা আপনি পালন করেন না।
(প্রশ্ন — ৩) তাহলে আপনি কি বলতে চাইছেন, শিব ছাড়া অন্য কোনো দেবদেবীকে পূজা করা যাবে না ?
উত্তর — আমি কিছু বলিনি, বেদ যা বলেছে তা তুলে ধরেছি মাত্র। আপনি অবশ্যই সকল দেবদেবীর পূজা করতে পারেন, কিন্তু তার একটি দৃষ্টিকোণ আছে, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি যে কোনো দেবদেবীর পূজা করতে পারেন। সেই দৃষ্টিকোণ টি হল,
আপনি যে কোনো দেবদেবীকে পূজা করবার সময় মনে ভাবনা করবেন যে, আপনার সামনে যে দেব-দেবীর বিগ্রহ প্রতিমা রয়েছে, সেই দেবদেবী রূপে পরমেশ্বর শিবই আপনার সম্মুখে স্থিত আছেন। অর্থাৎ সকল দেব-দেবীর রূপে একমাত্র পরমেশ্বর শিবই অবস্থিত আছেন, এই দৃষ্টিকোণে যদি আপনি দেব-দেবীদের দেখতে পারেন, তবেই আপনি সঠিক পথে যে কোন দেবদেবীর পূজার্চনা করতে পারেন। প্রমাণ দেখুন এখানে ক্লিক করে 👇
বিষ্ণু ও অনান্য দেবতাদের মধ্যে একমাত্র শিবকেই পরম কারণ বলে না জানলে মোক্ষ অসম্ভব
কিন্তু আপনি যদি আপনার ইচ্ছেমতো যেকোনো দেবদেবীকে একমাত্র শ্রেষ্ঠ মনে করতে থাকেন, বা তাদেরকে একমাত্র পরম ব্রহ্ম বলে মানতে শুরু করেন, তবে বেদে যে নির্দেশ দেওয়া আছে, আপনি তার বিপক্ষে গিয়ে স্বয়ং বেদবিরুদ্ধ হয়ে অধর্মী হিসেবে গণ্য হবেন।
আপনি পরমেশ্বর শিব কে ছেড়ে অন্য যেকোনো দেবদেবীকে একমাত্র পরমেশ্বর বলে ধারণা করতে পারেন না। এ বিষয়ে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বেদে।
সুতরাং শাস্ত্র আপনাকে সত্যরূপ পরমেশ্বর শিবকে চিনিয়ে দিচ্ছে, এখন আপনি যদি শাস্ত্রের কথা না মেনে চলেন, তবে ভগবদ্গীতা অনুযায়ী আপনার কোনো গতিই হবে না। বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করে দেখুন 👇
শাস্ত্র অমান্যকারী ব্যক্তির শাস্তি ও ধার্মিক ব্যক্তির করণীয় কর্তব্য
সুতরাং অবশ্যই সকল সনাতনী ব্যক্তির উচিত প্রতিদিনের সন্ধ্যা বেলায় সকল দেবতার আরাধ্য পরমেশ্বর শিবেরই একমাত্র আরাধনা করা । পরমেশ্বর শিবকে মূল সিংহাসনে স্থাপন করে পূজা করা উচিত, এরপর তার সেবায় নিয়োজিত থাকা অনান্য দেবদেবীর পূজা করতে পারেন, তবে মনে রাখতে হবে যে, সকল দেবদেবীর মধ্যে পরমেশ্বর শিবই বিরাজমান। কিন্তু দেবদেবী স্বরূপ গুলি অনিত্য এবং পরমেশ্বর শিব হলে নিত্য সত্তা , তাই মূল তথা প্রধান হিসেবে পরমেশ্বর শিবেরই ভজনা করবেন, প্রভু শিবের অনিত্য স্বরূপ দেবদেবীদের পূজা শিবপরিবারের গণদেবতা হিসেবে গৌণ হিসেবে করবেন। এভাবে পরমেশ্বর শিবের পূজা সন্ধ্যা বেলায় করলে মানুষ নিজের সকল দুঃখ থেকে উদ্ধার হয়ে যান । দেখুন আমাদের শাস্ত্র বলেছে —
যে বৈ প্রদোষসময়ে পরমেশ্বরস্য কুর্বন্ত্যনন্যমনসোহস্ত্রি সরোজপুজাম্। নিত্যং প্রবৃদ্ধধনধান্য কলত্র পুত্রসৌভাগ্যসম্পদধিকান্ত ইহৈব লোকে ॥৭৫
[তথ্যসূত্র - স্কন্দ পুরাণ/ব্রহ্মখণ্ড/উত্তরখণ্ড/৬নং অধ্যায়]
অর্থ — যে মনুষ্য প্রদোষ সময়ে অনন্য মনে পরমেশ্বর শিবের শ্রীচরণপদ্ম পূজা করে, এই সংসারেতে তার নিত্যধন অর্থাৎ মোক্ষ, ধান্য, স্ত্রী, পুত্র তথা সন্তান, সৌভাগ্য ও সম্পদ লাভ হয় ॥৭৫
অতএব আসুন, আমরা সকলে এক ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বর শিবের আরাধনা করবার মধ্যে দিয়ে সকল সনাতনীদের একতাবদ্ধ করি, আমাদের আরাধ্য হোক এক, আমাদের ধ্বনী হোক এক, আমাদের আদর্শ হোক এক। তবেই সনাতন ধর্মের উন্নতি হওয়া সম্ভব।
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
🔥 সত্য উন্মোচনে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
©কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
নম পার্বতীপতয়ে হর হর মহাদেব 🙏🙌
উত্তরমুছুন