শ্রীকৃষ্ণ কি পশুশিকার, পশুমাংস ভক্ষণ, পশুবলি ও বিবাহ অনুষ্ঠানে সকলকে পশুমাংস ভক্ষণ করাতেন ?
ভূমিকা —
বর্তমানে সনাতন ধর্ম এমন একটি সংকীর্ণ মানসিকতার যুগের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যেখানে মানুষ আত্মজ্ঞান লাভের হবার বিষয়ে চিন্তা না করে তার পরিবর্তে ভোজন বিষয়ে চর্চাকেই ধর্মের একমাত্র গতি নির্ণয়ের মানদণ্ড হিসেবে চর্চা করে চলেছে।
এক পক্ষ, রক্ত মাংসের জীবকে আহার হিসেবে ভক্ষণ করে, যাকে সরল ভাষায় বলা হলা হয় আমিষ খাদ্য।
অন্যপক্ষ, তন্তু জাতীয় উদ্ভিজ্জ জীবকে আহার হিসেবে ভক্ষণ করে নিজেদের নিরামিষাশী বলে দাবী করে ।
আমরা সনাতনী, তাই আমরা যদি আহারের বিষয়ে কি ভক্ষণ করা উচিত আর কি ভক্ষণ করা উচিত নয় বলে জানতে চাই তবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আমাদের সনাতন ধর্মের শাস্ত্রে যে বিধান তথা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেটিই মেনে চলতে হবে, কারোর ব্যক্তিগত মতামত বা আজ্ঞা আমাদের সনাতনীদের জন্য মান্য নয় ।
শাস্ত্রের মধ্যে আমিষ ও নিরামিষ উভয় খাদ্যকেই আহার হিসেবে গ্রহণ করবার নির্দেশ আছে । কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় — নিরামীষভোজী ব্যক্তিগণ অত্যন্ত গোঁড়া মানসিকতার দ্বারা উদ্ভিজ্জ খাদ্যের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখবার জন্য বিভিন্ন রকমের অপপ্রচার করেন, শাস্ত্রের আমিষ ভোজনের নির্দেশ নেই বলে দাবী করেন । বিশেষত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ দাবী করেন যে, প্রাচীন কালে কেউ মাছ মাংস ইত্যাদি আমিষ আহার করতেন না। কিন্তু শাস্ত্র বলছে অন্য কথা, বৈষ্ণবদের আরাধ্য বিষ্ণুর অবতার শ্রীরামচন্দ্র মাংস ভক্ষণ করতেন, তার অসংখ্য প্রমাণ শাস্ত্রে রয়েছে। আমরা সেই বিষয়ে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছি, তা দেখতে পারেন 👉 শ্রীরামচন্দ্র কি প্রাণী বধ করে তার মাংস আহার করতেন ?।
এরই সাথে শ্রী বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণও মাংস ভক্ষণ করেছেন, আমরা এই বিষয়েই বৈষ্ণব দের মান্য যে সকল শাস্ত্র রয়েছে তা থেকেই কয়েকটি প্রমাণ তুলে ধরছি। বৈষ্ণবরা দাবী করেন — যারা ক্রোধী, অহংকারী, হিংসা কারী, কামুক স্বভাবের ব্যক্তি তারা হল তামসিক, তাই নিরামিষ আহার করলে নাকি মানুষ ক্রোধহীন, অহংকারহীন, হিংসাহীন, কামহীন হয়ে যায় মানুষ, তারা আর তামসিক থাকেন না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাস্তবতা এটির সম্পূর্ণ বিপরীত, বৈষ্ণবেরাই নিরামিষ আহার করে শ্রীকৃষ্ণ/হরি/রাম কে একমাত্র শ্রেষ্ঠ দাবী করে, শিব ও অনান্য দেবদেবীকে তুচ্ছ তথা নিকৃষ্ট সেবক মাত্র মনে করে। যদি কোনো শিবভক্তের সাথে বৈষ্ণবরা কথা বলেন, সেখানে তারা শিব কে শ্রীকৃষ্ণ/হরি/রামের সেবক বলে দাবী করে বসে, শ্রীকৃষ্ণের/হরি/রামের উপাসনাই শ্রেষ্ঠ আর বাকি সব নিকৃষ্ট - এমন ধরণের কথা বলে শিবভক্তদের অপমানিত করে, শিবভক্তিকে আঘাত করে নিজের হরিভক্তিকে শ্রেষ্ঠতম প্রমাণিত করতে চেষ্টা করে। যারা মাছ-মাংস ইত্যাদি আমিষ আহার করে তাদের রাক্ষস প্রেতাত্মা বলে অবজ্ঞা করে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে থাকে আর নিজেদের নিরামিষ আহারের দরুন শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম প্রমাণ করবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কেউ যদি জবাব দেন তবে তার সাথে অপযুক্তি দিয়ে তর্ক করতে থাকে, শেষে যুক্তি তর্কে না পেরে উঠলে ক্রোধ করতে শুরু করে, শেষে না পারলে ‘আপনি রাবণ, বাণাসুর, দৈত্য, রাক্ষস, পিশাচ’ - ইত্যাদি ইত্যাদি বহু অপমানজনক কটু বাক্য ব্যবহার করে অপশব্দ বলে দেন, তারপর সেখান থেকে বিদায় নেন।
ফলে এখান থেকে নিরামিষ আহার করেও বৈষ্ণবদের মধ্যে তামসিকগুণ থেকে মুক্ত হবার লক্ষণ দেখা যায় না, বরং তারা নিরামিষ ভোজন করেও আমিষাশী দের তুলনায় অধিকতর তামসিক গুণের শিকার হয়ে অন্যদের হিংসা, আত্ম-অহংকার করতে থাকে।
তাই আমি এই প্রবন্ধে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা পশু হত্যা ও পশু মাংস ভক্ষণের বিষয়ে শাস্ত্রে উল্লেখিত বচন তথ্য প্রমাণ সহ তুলে ধরেছি। যাতে নিরামিষ আহার নিয়ে অহংকারে মত্ত থাকা বৈষ্ণবেরা এটা বুঝতে পারে যে, শাস্ত্রে আমিষ নিরামিষ উভয় প্রকারের আহারই স্বীকার্য হয়েছে। আর শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ীই তাদেরই আরাধ্য শ্রীকৃষ্ণ/শ্রীরাম/হরি মাংস ভক্ষণ করেছেন, এতে দোষের কিছু নেই।
________________________________________________
পশু শিকার করে শ্রীকৃষ্ণ আনন্দ লাভ করেন, বলছে মহাভারত —
বাসুদেবস্তু পার্থেন তত্রৈব সহ ভারত!।
উবাস নগরে রম্যে শক্রপ্রস্থে মহামনাঃ ॥৬৩॥
ব্যচরদ্ যমুনাতীরে মৃগয়াং স মহাযশাঃ।
মৃগান্ বিধ্যন্ বরাহাংশ্চ রেমে সার্দ্ধং কিরীটিনা ॥৬৪॥
[হরিদাস সিদ্ধান্ত বাগীশ দ্বারা অনুবাদিত বিশ্ববানী প্রকাশনীর ‘মহাভারত/অদিপর্ব/সুভদ্রাহরণপর্ব/২১৪ অধ্যায়/৬৪ শ্লোক’]
অর্থ — কিন্তু বাসুদেব-শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সহিত সেই মনোহর ইন্দ্রপ্রস্থনগরেই রইলেন ॥৬৩৷
তিনি মৃগয়া করতে করতে যমুনাতীরে বিচরণ করতেন এবং অর্জুনের সহিত মিলিত হয়ে হরিণ ও শূকর বিদ্ধ করে আনন্দিত হতেন ॥৬৪॥
📃ব্যাখ্যা -
বর্তমানকালে বৈষ্ণবেরা দাবি করে থাকে যে অর্জুন সহ পঞ্চপাণ্ডব হলেন শ্রেষ্ঠ ভক্ত বৈষ্ণব। এখন মজার বিষয় হল, অর্জুন যদি বৈষ্ণব হয়ে থাকেন, তবে এখানে দেখা যাচ্ছে অর্জুন পশু হত্যা করছেন আনন্দ উপভোগের জন্য, এমনকি বৈষ্ণবদের আরাধ্য স্বয়ং শ্রী হরি কৃষ্ণ সেই অর্জুনের সহিত মিলিত হয়ে হরিণ ও বন্য শূকর হত্যা করে আনন্দ লাভ করতে লাগলেন। মৃগয়া করা পশু অবশ্যই ভক্ষণীয় হয়ে থাকে, কেননা শুধুমাত্র আনন্দ লাভের জন্য পশু হত্যা করা কখনোই ধর্ম সংগত নয়, কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া পশু হত্যা করার কোনো ধর্মসঙ্গত বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না, মৃগয়া করাই হয় পশু শিকার করে সেই পশুর মাংস ভক্ষণের জন্য।
এছাড়া মহাভারতের বনপর্বে স্পষ্ট করে উল্লেখ রয়েছে যে, পঞ্চপান্ডবেরা অজ্ঞাতবাসে গিয়ে বনের পশু হত্যা করে তার মাংস আহার করে বনের সমস্ত পশু সমাপ্ত করে ফেলেছিলেন।
তাহলে দেখুন, বর্তমান কালের বৈষ্ণবদের আহার আর পঞ্চপান্ডবসহ অর্জুনের আহার পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এমনকি বৈষ্ণবদের আরাধ্য শ্রীহরি-কৃষ্ণ পর্যন্ত পশুহত্যা করে মাংস ভক্ষণ করতেন। যমুনার তীরে অর্জুনের সহিত শ্রীকৃষ্ণ হরিণ ও বন্য শুকর বধ করে আনন্দ লাভ করতে লাগলেন - এই বচনে হরিণ কে মৃগ আর বন্য শূকরকে বরাহ শব্দে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে কোন অলংকারিক ব্যাখ্যা সম্ভব নয়, কারণ, শ্লোকে ‘ব্যচরদ্ যমুনাতীরে মৃগয়াং’ বলে সরাসরি যমুনার তীরে বিচরণ করে মৃগয়া শব্দ উল্লেখ রয়েছে। এখানে বরাহ-মৃগ শব্দের আলংকারিক সংকেত বলে বোঝানো যাবে না, কেননা, প্রসঙ্গ টি সম্পূর্ণভাবে পশু শিকার করবার বিষয় বলা হয়েছে।
অর্থাৎ, বৈষ্ণবদের দাবীতে বৈষ্ণবরাই ফেঁসে গেলেন, অর্জুন সহ পঞ্চপাণ্ডব যদি বৈষ্ণব হয়ে থাকেন তবে তারা তো মাংস আহার করেছেন, তাহলে বর্তমানের বৈষ্ণবেরা কি পঞ্চপান্ডবের থেকেও অনেক বড় বৈষ্ণব হয়ে গেছেন ? পঞ্চপান্ডবের মত মাংস আহারে বৈষ্ণবদের সমস্যা কোথায় ? যেখানে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ পশু হত্যা করছেন ও মাংস ভক্ষণ করছেন। এবং তার ধর্ম সংগত বলেই পরিচিত হচ্ছে, এতে বৈষ্ণবদের সমস্যা কোথায় ? হ্যা সমস্যা হল অহংকারে। যদি সত্য মেনে নেন বৈষ্ণবেরা তবে তাদের মতবাদের শ্রেষ্ঠত্ব আর থাকবে না, অহংকারও করতে পারবেন না, তাই বৈষ্ণবরা নিজেদের শাস্ত্র থেকেই নিজেদের দাবীর পরস্পর বিরোধী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ যে পশুহত্যা করে আনন্দ লাভ করতেন তা প্রমাণিত, আর পরোক্ষভাবেও এটি প্রমাণিত যে, শ্রীকৃষ্ণ নিশ্চয়ই ঐ মৃগয়া কথা হরিণ ও বন্য শূকরের মাংস ভক্ষণ করেছেন।
________________________________________
শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন পশু বলি দিয়ে পূজা করতে, বলছে বিষ্ণুপুরাণ —
শ্রীকৃষ্ণ উবাচ ।
তস্মাদেগাবর্ধনঃশৈলো ভবদ্ভির্বিবিধার্হণৈঃ ।
অর্চ্যতাং পূজ্যতাং মেধ্যান্ পশূন্ হত্বা বিধানতঃ ॥৩৮
(তথ্যসূত্র — বিষ্ণুপুরাণ/৫ম অংশ/১০ম তম অধ্যায়/৩৮ নং শ্লোক)
অর্থ — ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, অতএব আপনারা বিধিপূর্বক মেধ্য পশুদের বলি দিয়ে বিবিধ সামগ্রী দ্বারা গোবর্ধন পর্বতের পূজা করুন ।
📃ব্যাখ্যা —
বৈষ্ণব দের দেওয়া সিদ্ধান্তের বিপক্ষে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ , তিনি পশুবলি দিয়ে গোবর্ধন পূজা করতে বলেছেন।
________________________________________
শ্রীকৃষ্ণ মাংস ভক্ষণ করেন, বলছে মহাভারত —
যজনান্তে তদন্নং তু তৎ পয়ো দধি চোত্তমম্ ।
মাংসং চ মায়য়া কৃষ্ণো গিরির্ভূত্বা সমশ্রুতে ॥ ২১
[মহাভারত/হরিবংশ পুরাণ/বিষ্ণুপর্ব/১৭ অধ্যায়/২১ শ্লোক]
অর্থ — যজ্ঞের শেষে অন্ন, দুধ, দই সহ মাংস ভক্ষণ করলেন শ্রীকৃষ্ণ, তিনি গিরিরূপ ধরেছিলেন মায়া প্রকাশের দ্বারা ॥ ২১
📃ব্যাখ্যা — বৃন্দাবনবাসী গোবর্ধন পর্বতের পূজা করেছিলেন, তার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করেছিলেন, সেই যজ্ঞে অন্ধ, দুধ, দই, পশুর বলি দিয়ে তার মাংস আহুতি দেওয়া হয়েছিল। যখন যজ্ঞ শেষ হয়েছিল তখন শ্রীকৃষ্ণ সেই পূজাকে স্বীকার করে নিতে গিয়ে ঐ অন্ন, দুধ, দই ও পশুর মাংস ভক্ষণ করে নিলেন, সকলের চোখে যাতে এই দৃশ্য না ধরা পড়ে তাই গিরি অর্থাৎ পর্বতের রূপ ধারণ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ মায়ার দ্বারা। সুতরাং, শ্রীকৃষ্ণ যে রূপই ধারণ করে থাকুক না কেন মাংসটা শ্রীকৃষ্ণই ভক্ষণ করেছেন, তা এখানে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত।
ধরুন একটা উপমা দিই, একজন মানুষ যদি ছদ্মবেশ ধরে চুরি করে, তবে তিনি কি চোর নন ?
নিঃসন্দেহে তিনি চোর। আর এটি তো পূজা অর্থাৎ এটি নিছক কোনো অভিনয় নয়, এখানে বৃন্দাবনবাসী গোবর্ধন পর্বতের পূজা করেছেন, শ্রীকৃষ্ণ ছদ্মবেশ ধারণ করে সেই সকল বস্তু এমনকি মাংসও ভক্ষণ করে নিলেন, এই কার্যের জন্য দায়ী কি অন্য কেউ ? না ! অন্য কেউ নয়, একমাত্র ই শ্রীকৃষ্ণই সেই খাদ্য ভক্ষণ করেছেন অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ মাংস ভক্ষণ করেছেন — এটি প্রমাণিত। হতে পারেন তিনি মহাশক্তিধর, আমরা সামান্য মনুষ্য, কিন্তু তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, তিনি পূজাতেও মাংস দেওয়াকে অনুমোদন করেছেন এবং তা ভক্ষণ করে আমিষাশীদের সাথে সাথে পশুবলির বিধানকেও সত্য ও মান্য বলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দিয়েছেন। আর সেই কারণেই তার ঘটানো উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আমরা শাস্ত্র থেকে তথ্যপ্রমাণ সহ এখানে উপস্থাপন করেছি। যাতে সত্য প্রকাশিত হয়।
________________________________________
শ্রীকৃষ্ণের বিবাহের সময় শ্রীকৃষ্ণ সকলকে পশু মাংস ভক্ষণ করিয়েছিলেন —
গবাং লক্ষং ছেদনঞ্চ হরিণানাং দ্বিলক্ষ কম্।
চতুর্লক্ষং শশানাক কুৰ্ম্মাণাঞ্চ তথা কুরু ॥ ৬০
দশলক্ষৎ ছাগলানামবীনাং তচ্চতুর্গুণম্।
পর্ব্বণি গ্রামদেব্যৈ চ বলিং দেহি চ ভক্তিতঃ ॥ ৬১
এতেষাৎ মাংসপক্কঞ্চ ভোজনার্থক কারয়।
পরিপূর্ণং ব্যঞ্জনানাং সামগ্রীং কুরু ভূমিপ ॥ ৬২
(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ/শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ড/অধ্যায় ১০৫)
অর্থ — তিনি (শ্রীকৃষ্ণ) এক লক্ষ গোসাপ, দুই লক্ষ হরিণ, চার লক্ষ শশক এবং কুৰ্ম্মচ্ছেদন করান। দশ লক্ষ ছাগল, তদপেক্ষা চতুর্গুণ মেষ পূর্ণিমাদিনে গ্রাম্যদেবীর নিকটে ভক্তিপূর্বক বলিদান করান। এই সকলের মাংস ভোজনার্থে পাক করান। হে ভূমিপতে ! ব্যঞ্জনাদি সামগ্রী পরিপূর্ণরূপে প্রস্তুত করান ।
📃ব্যাখ্যা — শ্রীকৃষ্ণ নিজের বিবাহের সময় গোসাপ, হরিন, খরগোশ, কচ্ছপ, ছাগল, ভেড়াকে বলি দিয়ে, সেই মাংস সকলের ভোজনের জন্য রান্না করে তা পরিবেশন করেন। এই কথা বৈষ্ণবদের প্রিয় বৈষ্ণবশাস্ত্র ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। এখন বৈষ্ণব রা ঠিক করুক, এই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের বচন মানবে নাকি ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
________________________________________
পশুবলি দেবার জন্য পশু শিকার করেন শ্রীকৃষ্ণ, বলছে ভাগবত পুরাণ —
প্রস্থাপনোপানয়নৈরপত্যানাং মহোৎসবান্।
বীক্ষ্য যোগেশ্বরেশস্য যেষাং লোকাঃ বিসিস্পিরে ॥ ৩৩
যজন্তং সকলান্ দেবান্ কাপি ক্রতুভিরূর্জিতৈঃ।
পূর্তয়ন্তং কচিদূ ধর্ম কূপারামমঠাদিভিঃ॥ ৩৪
চরন্তং মৃগয়াং ক্বাপি ইযমারুস সৈন্ধবৎ।
ঘ্নন্তং ততো পশূন্ মেধ্যান্ পরীতং যদুপুঙ্গবৈঃ॥৩৫
[তথ্যসূত্র : ভাগবত পুরাণ/১০ম স্কন্ধ/৬৯ অধ্যায়/৩৫ শ্লোক]
অর্থ — (নারদ দেখলেন) কোনো গৃহ থেকে কন্যাদের বিদায় দেওয়া হচ্ছে, আবার কোথাও নতুন কন্যাদের আহ্বানের আয়োজন চলছে।
যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা অনুষ্ঠিত এই বিরাট উৎসবসমূহ দেখে সকলেই বিস্মিত চমকিত হয়ে যেতেন ॥ ৩৩
কোথাও দেখা যাচ্ছে - মহাযজ্ঞের মাধ্যমে দেবতাদের যজ্ঞ ও পূজা করা করছেন শ্রীকৃষ্ণ, আবার কোথাও কূপ (কুয়ো), উদ্যান (বাগান), মঠ প্রভৃতি নির্মাণ করে ইষ্টাপূর্ত ধর্মকর্ম পালন করছেন ॥ ৩৪
কোথাও দেখা যাচ্ছে - শ্রেষ্ঠ যাদবগণ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সিন্ধু দেশীয় ঘোড়ায় চড়ে মৃগয়ায় (শিকার করতে) গমন করছেন, আর সেই মৃগয়ায় কেবল যজ্ঞের জন্য উপযুক্ত পবিত্র পশুদেরই বধ করছেন ॥ ৩৫
📃ব্যাখ্যা — ভাগবত পুরাণের ১০ম স্কন্ধের ৬৯তম অধ্যায়ের ৩৫ নং শ্লোকের মধ্যে বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ তার যাদবকুলের অনান্য যাদবদের সহিত যজ্ঞের জন্য বনে পশু শিকার করতে গিয়েছেন। অর্থাৎ, এই বাক্য থেকে এটি প্রমাণিত হয় যে,
শ্রীকৃষ্ণ যেহেতু যজ্ঞের জন্য বনে পশু শিকার করতে গিয়েছেন, সেহেতু - যজ্ঞে যে সেই বন্য পশু হত করা হয়েছে তা শ্লোকের এই "ঘ্নন্তং" পদ দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
আর যেহেতু যজ্ঞে পশু বলি হয়েছে তা অবশ্যই ভক্ষণও করেছেন শ্রীকৃষ্ণ, তার কারণ হল - যজ্ঞে বলি দেওয়া পশুর মাংস কে ভক্ষণ করতে নির্দেশ দিয়েছে স্বয়ং শাস্ত্র । প্রমাণ দেখুন 👇
👉 স্বস্ত্যয়ন বাক্য বলে পশুমাংসের হুতাবিশিষ্ট ভক্ষণ করতে হবে
নিয়োগাত্ তু প্রাশ্নীয়াত্ স্বস্ত্যয়ন ইতি ।।৩৫।।
(আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র/৪/৯/৩৫)
অর্থ — স্বস্ত্যয়ন বাক্য বলে অবশ্যই পশুমাংসের হুতাবিশিষ্ট মাংস ভক্ষণ করবেন।।
অর্থাৎ, যজ্ঞে পশুবলি দিয়ে তার মাংস যজ্ঞের অগ্নিতে আহুতি দেবার পর, অবশিষ্ট যে বলি দেওয়া পশুর মাংস রয়ে যাবে তা - স্বস্তি মন্ত্র পাঠ করে অবশ্যই ভক্ষণ করতে হবে।
আরো দেখুন, কূর্মপুরাণ বলছে —
আমন্ত্রিতন্ত যঃ শ্রাদ্ধে দৈবে বা মাংসমুৎসৃজেৎ।
যাবন্তি পশুরোমাণি তাবতো নরকান্ ব্রজেৎ ॥ ৪২
[কূর্মপুরাণ/উপরিভাগ/১৭ অধ্যায়/৪২ শ্লোক]
অর্থ — যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রিত বা দৈব বলিকর্মে নিযুক্ত হয়ে মাংস ভক্ষণ না করে, সে ব্যক্তি পশুর যতগুলি লোম আছে, তত বৎসর নরকভোগ করে থাকে ।
সুতরাং, শ্রীকৃষ্ণ যে যজ্ঞের জন্য বনে পশু শিকার করে সেই বন্য পশু বলি দিয়ে সেই পশুর মাংস খেয়েছেন, এতে কোন সন্দেহই নেই । আর এতে কোন অধর্মও হয়নি, কেননা এটিই শাস্ত্রের বিধান।
________________________________________________
ছদ্মধার্মিক বৈষ্ণবদের বিরম্বনা —
যদিও বৈষ্ণবেরা এই সব শাস্ত্র প্রমাণ দেখে যখন বুঝতে পারে যে তাদের মিছা অহংকার শাস্ত্রের বচনের সামনে টিকতে পারেনি, তখন বৈষ্ণবদের মধ্যে কেউ কেউ দাবী করে যে, এসব মিথ্যা কথা, কেউ বলে, এগুলো শাস্ত্রের মধ্যে পরবর্তী কালে বিকৃতি করে ঢোকানো হয়েছে , তাই এসব নকল বিধান মান্য নয়। কেউ বলেন, শাস্ত্র দিয়ে ঈশ্বর লাভ হয় না, তাই শাস্ত্র দিয়ে কি হবে ? ভক্তিই সব ।
এই ভাবে শাস্ত্রের প্রমাণ কে চোখের সামনে দেখেও অমান্য করবার বৃথা অজুহাত আমদানি করতে থাকে বর্তমানকালের বৈষ্ণবেরা।
আমার প্রশ্ন হল, মাংস ভক্ষণের প্রমাণ দেখে যদি বলেন এগুলি মিথ্যা, এগুলি পরবর্তীকালের নকল বিকৃত লেখা ! তবে আমিষাশীরাও তো বলতে পারে যে, যেখানে মাংস ভক্ষণে নিষেধ করা হয়েছে সেটিও পরবর্তীকালের নকল বিকৃত লেখা। তাহলে আপনারা কি আমিষাশীদের দাবী করা এই কথাটি মেনে নিতে পারবেন ?
এক্ষেত্রে তো আপনারা নিরামিষাশী বৈষ্ণবেরা এই দাবী মানতে পারবেন না, তাহলে আপনাদের দাবী মানবার তো কোনো যৌক্তিকতাই নেই, কেননা আপনারা তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই ভিত্তিহীন দাবী করেন, সুতরাং আপনাদের এই অজুহাত সম্পূর্ণরূপী খণ্ডন হল ।
আর রইল বাকি শাস্ত্র দ্বারা ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না ?
আপনাদের ঐ জন্মাষ্টমী পালিত করবার সময় তিথির উল্লেখ কোথায় পেয়েছেন ? সনাতন ধর্মের শাস্ত্রে নাকি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কানে কানে এসে বলে গেছেন ?
আগম, বেদ, পুরাণ, ইতিহাস প্রভৃতি শাস্ত্র যদি কোনো কাজেরই না হয়ে থাকে তবে ঈশ্বর এই শাস্ত্র গুলি কোন উদ্দেশ্যে দিয়েছিলেন ?? এই শাস্ত্রগুলি সনাতনীরা অধ্যয়ন করবে না তো কি মুসলমানেরা খ্রিষ্টানেরা পড়বে ??
শাস্ত্রের বচন যদি মান্যই না হয়ে থাকে তবে ভগবদ্গীতা পাঠ করেন কেন ??
প্রাচীনকালে আপনাদেরই রামানুজ ইত্যাদি বহু বৈষ্ণব আচার্যগণেরা শাস্ত্রের বচনকে প্রাধান্যতা দিয়েছেন, তার উপর নিজের মতো করে ভাষ্য রচনা করেছেন। স্মার্তবাদী শঙ্করাচার্য পর্যন্ত উপনিষদ, ভগবদ্গীতা, ব্রহ্মসূত্রের উপর ভাষ্য রচনায় করেছেন। আধুনিক কালের স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত বেদান্ত অনুযায়ী চলবার শিক্ষা দিয়েছেন। তাহলে এনারা সবাই কি মূর্খ ? আর একমাত্র আপনিই পণ্ডিত ?
শাস্ত্রের বিধিবিধান মানুষকে একটি নিয়মিত জীবনের পথে অভ্যাস করিয়ে ঈশ্বর লাভের পথে অগ্রসর হবার পথ দেখায়, শাস্ত্র থেকে সকল দেবদেবী ও প্রাচীন মুনি ঋষিদের কার্যকলাপ সম্পর্কে জেনে আমাদের কি করা উচিত সেই সিদ্ধান্ত নেবার শিক্ষা অর্জন করা যায়। আর শাস্ত্র ফেলে দিয়ে আপনি ঈশ্বরের পথে অগ্রসর হবার মার্গকেই নস্যাৎ করতে চাইছেন শুধুমাত্র নিজের অহংকার ও অন্ধজেদ কে বজায় রাখবার জন্য।
এটিই আপনাদের পতনের কারণ, শাস্ত্র কে অমান্য করলে আপনার কি দুর্গতি হতে পারে তা জেনে নিন 👇
শাস্ত্র অমান্যকারী ব্যক্তির শাস্তি ও ধার্মিক ব্যক্তির করণীয় কর্তব্য
🔶🔖🔶 প্রকৃতপক্ষে, এই কট্টর নিরামিষবাদ আমাদের সনাতন ধর্মের অংশ নয়, বৌদ্ধদের মতবাদ এটি। বৌদ্ধ রা যজ্ঞে পশু বলি দেবার কট্টর বিরোধী। বুদ্ধ অবতার নিয়ে মায়ামোহ রূপে ভগবান শ্রীবিষ্ণু অসুর-দৈত্যদের মায়ায় মোহিত করে সনাতন ধর্ম থেকে বিচ্যুত করবার জন্য কট্টর নিরামিষাশী ও যজ্ঞে পশুবলি দেবার বিরুদ্ধে হবার উপদেশ দিয়েছিলেন দেখুন 👇
পুনশ্চ রক্তাম্বরধৃঙ্ মায়ামোহো জিতেন্দ্রিয়ঃ ।
অন্যানাহাসুরান্ গত্বা মৃদ্বল্পমধুরাক্ষরম্ ॥১৬॥
স্বর্গার্থং যদি বো বাঞ্ছা নির্বাণার্থমথাসুরাঃ ।
তদলং পশুঘাতাদিদুষ্টধর্মৈর্নিবোধত ॥১৭॥
মায়ামোহঃ স দৈতেয়ান্ধর্মমত্যাজয়ন্নিজম্ ॥২০॥
নৈতদ্যুক্তিসহং বাক্যং হিংসা ধর্মায় চেষ্যতে ॥২৬॥
[বিষ্ণু পুরাণ/৩ অংশ/অধ্যায় ১৮]
অর্থ — এরপর সেই জিতেন্দ্রিয় মায়ামোহ (বুদ্ধ) রক্তবস্ত্র পরিধান করে অন্যান্য অসুরদের কাছে গিয়ে, নম্র, সংক্ষিপ্ত ও মধুর ভাষায় বলল — “হে অসুরগণ! যদি তোমরা স্বর্গলাভ বা মোক্ষলাভের ইচ্ছা করো, তবে পশুহিংসা প্রভৃতি দুষ্টকর্ম পরিত্যাগ করে জ্ঞানলাভ করো।” ॥ ১৬-১৭
মায়ামোহ অসুরদের তাদের নিজ ধর্ম (স্বধর্ম অর্থাৎ সনাতন ধর্ম) থেকে বিচ্যুত করিয়ে দিল ॥ ২০
(বুদ্ধের অনুসারী অসুরেরা বলে বেড়াতে লাগলেন) “হিংসার দ্বারাও ধর্ম সাধিত হয়”— এই কথা কোনক্রমেই যুক্তিসম্মত নয় ॥ ২৬
এবার দেখুন পাঠকবৃন্দ ! বর্তমানের কট্টর নিরামিষাশী বৈষ্ণবেরাও সনাতন ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে এই বৌদ্ধদের নীতি অনুসরণ করে নাস্তিক বৌদ্ধদের পথেই হাঁটছেন। সুতরাং সকল সনাতনীদের এই বর্তমান কট্টর নিরামিষাশী বৈষ্ণবদের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া থেকে বিরত থাকাটাই ধর্মসঙ্গত, নচেৎ আপনারা নামেই সনাতনী থাকবেন ঐ অসুর দৈত্যদের মতো, আসলেই আপনারা পশুবলির বিরোধীতা করে নিজেদের পতনের কারণ নিজেরাই হবেন।
পশুবলি বা পশুমাংস ভক্ষণ করা যদি সনাতন ধর্মের পাপ কাজ হতো তবে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ নিজে পশুবলি দিতেন না, মৃগয়া করে পশুর মাংস আহার করতেন না। মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিচার বিবেচনা করে ধর্মসম্মত পথে পদার্পণ করুন ।
________________________________________________
সিদ্ধান্ত —
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পশু হত্যা করে মাংস ভক্ষণ করেছেন, তা শাস্ত্র থেকেই প্রমাণিত। তাই পশুবলির বিরোধিতা করবার কোনো যৌক্তিকতা নেই। মাংস ভক্ষণকারী আমিষাশী দের কটুক্তি করবারও কোনো যুক্তি নেই। বরং বর্তমানকালের নিরামিষ আহারের অহংকারে জীবন-যাপন করা বৈষ্ণবেরা নিজেরাই নিজেদের শাস্ত্র সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। পশু বলি এবং পশু মাংস ভক্ষণের বিরোধিতা করতে করতে বৈষ্ণবেরা নিজেদের অজান্তেই নাস্তিক বৌদ্ধদের পথ অবলম্বন করা শুরু করেছেন, তা বৈষ্ণবেরা নিজেরাই এখনও জানেন না।
________________________________________________
এই প্রবন্ধটি এখানে সমাপ্ত হল ।
নন্দী মহারাজের জয়
পরমেশ্বর শিবের জয়
শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩
হর হর মহাদেব 🚩
সত্য উন্মোচনে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী
কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন