মাংসভোজী ব্যক্তি কি শিবের কৃপা পেতে পারে ?



ভূমিকা —

 কলিযুগে সনাতন ধর্মের বহু মানুষ পশুর মাংস  আহারের বিপক্ষে কথা বলেন, তাদের দাবী হল, পশু বধ করে মাংস আহার করলে দেবদেবী সন্তুষ্ট হন না। মাংস ভক্ষণকারী ব্যক্তির পূজা গ্রহণ করেন না কোনো দেবদেবী। মাংস দিয়ে দেবদেবীকে পূজা করা অত্যন্ত পাপজনক বলে মনে করেন এই সকল ব্যক্তিগণ।

আমাদের সনাতন ধর্মের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় শাস্ত্রের বচন অনুসারে, সঠিক বা ভুল নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও মানুষের জন্য শাস্ত্রের বচন‌ই হল একমাত্র বিধান । যারা শাস্ত্রের বচন অনুসারে জীবনযাপন না করেন তাদের দুর্গতি লাভ হয়। তাই শাস্ত্রের এমন একটি ঘটনা প্রসঙ্গ এখানে উপস্থাপন করবো যার দ্বারা এই সকল ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটবে এবং পরম সত্য অবগত হতে পারবে জনসাধারণ।


বিশেষ তথ্য -

(১) শ্রীরামচন্দ্র কি প্রাণী বধ করে তার মাংস আহার করতেন ?

(২) শ্রীকৃষ্ণ কি পশুশিকার, পশুমাংস ভক্ষণ, পশুবলি ও বিবাহ অনুষ্ঠানে সকলকে পশুমাংস ভক্ষণ করাতেন ? 

__________________________________________________

 মাংসভোজী ব্যক্তি কি শিবের কৃপা পেতে পারে ?


উত্তর : এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে সনাতন ধর্মের শাস্ত্রে উল্লেখিত একটি কাহিনীর মধ্যে। শাস্ত্র‌ই হল ধর্মের ভিত্তি। উচিত অনুচিত কার্যের নির্ণয় শাস্ত্র‌ই করে দেয়। তাই প্রত্যেক সনাতনী ব্যক্তির সর্বদাই শাস্ত্রের বচনে শ্রদ্ধা রাখা উচিত ।


স্কন্দ মহাপুরাণের মাহেশ্বর খণ্ডের অন্তর্গত কেদারখণ্ডের ৫ম অধ্যায়ের ১১১-১৯৭ নং শ্লোকে উপস্থিত এমন একটি কাহিনী আমি বর্ণনা করছি, যেটির মূল প্রসঙ্গ : পরমেশ্বর শিবকে মাংস দিয়ে পূজা করে মহাকাল পদ লাভ করেছেন এক পশুর মাংসভোজী এক ব্যাধ।

[খেয়াল রাখবেন : কিরাত বা ব্যাধ শব্দ দ্বারা পশু শিকারীদের বোঝানো হয়ে থাকে। এখানে নন্দী নামটি একজন মনুষ্য বৈশ্য (ব্যবসায়ী) ব্যক্তির।]

শ্লোক উপস্থাপন করলে অধিক দীর্ঘ হতো এই প্রবন্ধটি, তাই শুধু মাত্র শ্লোক গুলির অনুবাদ উপস্থাপন করা হল।

🕉️ পরমেশ্বর শিবকে মাংস দিয়ে পূজা করে মহাকাল পদ লাভ করেছেন এক পশুর মাংসভোজী এক ব্যাধ।

 লোমশ বললেন, আমি এই স্থানে এক প্রাচীন ইতিহাস কীর্তন করছি। পূর্বকালে অবন্তীপুরে নন্দী নামক এক বৈশ্য বাস করতেন, সে সর্বদা শিব ধ্যানে নিরত হয়ে শিব পূজায় নিবিষ্ট হয়ে থাকতো। তার তপোবনে একটি শিবলিঙ্গ ছিল। সে নিত্যই সেই লিঙ্গার্চনা করতো । সেই শিব বল্লভ প্রত্যেকদিন প্রভাতে উষাকালে উত্থিত হয়ে লিঙ্গার্চনায় একান্ত নিবিষ্ট হয়ে থাকতো। সে প্রত্যেকদিন বেদ-বেদাঙ্গ পারগ ব্রাহ্মণদের সাহায্যে পঞ্চামৃত দ্বারা যথাবিধি লিঙ্গ অভিষেক করতো এবং যথাশাস্ত্র লিঙ্গার্চনায় নিরত হতো। 

এভাবেই শিবলিঙ্গ স্নান করিয়ে ঐ বৈশ্য নানাবিধ পুষ্প, মুক্তাফল, ইন্দ্রনীল, গোমেদ, বৈদুর্য্য, নীলকান্ত ও মাণিক্যাদি দ্বারা তাঁর অর্চনা করতো। মহাভাগ নন্দী বৈশ্য এইভাবে বহু বছর ধরে সেই বিজনস্থ শিবলিঙ্গকে বিবিধ ভোগ দ্বারা অর্চ্চনা করে চলেছিলেন। ইতিমধ্যে একদিন এক মৃগয়ায় (পশুশিকারে) আসক্ত থাকা ব্যাধ (পশুশিকারী) সেই লিঙ্গপূজাস্থানে এসে উপস্থিত হলেন। ঐ ব্যাধ নিয়ত প্রাণি হিংসক, অবিবেক-পর ও সর্বদাই পাপাচার। সে বহু শ্বাপদ-সমাকীর্ণ গিরি-কন্দরে এইভাবেই বিচরণ করে বহু প্রাণী হত্যা করতে করতে ঐ স্থানে যদৃচ্ছাক্রমে আগমন করলো। সেই ব্যাধ তৃষ্ণায় পীড়িত হয়ে উঠেছিল। সে সেই বনের মধ্যে থাকা সরোবরের জল দেখে শীঘ্র তাতে প্রবেশ করলো। ঐ দুষ্টাত্মা তার সমস্ত মৃগয়াসামগ্রী সরোবরের তীরে রাখলো এবং জলের মধ্যে নেমে গণ্ডুষ পরিত্যাগপূর্ব্বক জল পান করে সেখান থেকে উঠে এল ॥ ১১১-১২২ ॥

তীরে উঠেই সম্মুখে এক আশ্চর্য্যময় শিবালয় দর্শন করলো। সে দেখলো, পৃথক পৃথক ভাবে নানা রত্নের উপহার দিয়ে কে যেন শিবলিঙ্গের পূজা করেছে। ব্যাধ সেই দেখে লিঙ্গপূজার আয়োজন করলো। সে ঐ সময় সেখানে থাকা শিবলিঙ্গের উপরের সকল উপহাররূপ রত্ন ইত্যাদি সবকিছু ছড়িয়ে আশেপাশে ফেলে দিল ।

তারপর সে নিজেই লিঙ্গপূজায় মন দিল। ব্যাধ নিজের মুখে ভরে আনা জল দিয়ে শিবলিঙ্গ স্নান করালো। এক হাতে অনেক বেলপাতা দিল, আর অন্য হাতে মৃগের (হরিণের) মাংস অর্পণ করলো। এভাবে পূজা করে সেই ব্যাধ শিবলিঙ্গের সামনে দণ্ডবৎ প্রণাম করে মনে মনে সংকল্প করে বললো —“আজ থেকে আমি সযত্নে নিয়মিত শিবপূজা  করবো। হে শঙ্কর, তুমি আমার স্বামী, আমি তোমার ভক্ত।” এই বলে সে নিজের ঘরে ফিরে গেল।

কিরাত যেভাবে পূজা করে গিয়েছিল, পরে সেখানে নন্দী বৈশ্য সেই সব দেখে ভাবতে লাগল—“এ কী হলো ? আমার পূজায় কি কোনো ত্রুটি হয়েছে ? শুনেছি, শিবপূজায় নিবিষ্ট হ‌ওয়া ব্যক্তির উপাসনার পথে অনেক বাধা-বিঘ্ন আসে, আমারো কি ভাগ্যবিপর্যয় বশত সেই বিঘ্নের উপস্থিত হয়েছে  ?”

এইরকম ভাবে অনেকক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে নন্দী বৈশ্য শিবমন্দির ধুয়ে পরিষ্কার করে নিজের বাড়ি ফিরল।

তারপর নন্দী বৈশ্যের পুরোহিত নন্দীকে বিষন্ন দেখে তাকে জিজ্ঞেস করলেন— “তুমি এত বিমনষ্ক কেন হয়ছ পড়েছো ?”

নন্দী তখন পুরোহিতকে বললো, হে দ্বিজ আজ আমি শিবের কাছে অমেধ্য বস্তু দেখেছি ; কে যে এই কার্য করেছে, তা আমি কিছুই জানি না। তখন পুরোহিত নন্দী কে বললেন, তুমি রত্ন ইত্যাদি তারা পূজা করে এসেছো, ওই সকল পূজা দ্রব্য যে ব্যক্তি আশেপাশে ছড়িয়ে ফেলেছে, সে মূঢ় , এতে সন্দেহ নেই। কোনটি কার্য আর কোনটি অকার্য এ বিষয়ে তার কোন জ্ঞান আছে বলে মনে হয় না। অতএব হে প্রভো ! তুমি এ সম্বন্ধে আর বিন্দুমাত্র চিন্তা কোরো না । 

 ভোর রাতে  সেই নন্দী বৈশ্য তার পুরোহিতকে ডেকে নিয়ে আবার শিবমন্দিরে গেল। আগের দিন ব্যাধ যা করেছিল, সেখানে তারা আবার সেই এক‌ই অবস্থা হয়ে থাকতে দেখলো। তারপর নন্দী বৈশ্য অনেক রত্ন ও উপহার দিয়ে একাদশ রকমের অভিষেক সহকারে পঞ্চোপচারে সুন্দরভাবে শিবপূজা করলো এবং ব্রাহ্মণদের সঙ্গে  মহাদেবকে নানাভাবে স্তুতি ইত্যাদি করলো।

নন্দীর স্তোত্রপাঠে প্রায় দুই প্রহর সময় কেটে গেল। ঠিক তখনই এক মহাকালের মতোই যেন দেখতে এমন ভীষণ শক্তিশালী এক পুরুষ ধনুক হাতে নিয়ে সেই দিক দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল।  

ওই ভীষণ রূপ দেখে নন্দী বৈশ্য ভয়ে কাঁপতে লাগল, পুরোহিতও ভয় পেয়ে গেলেন। গত দিন কিরাত যেভাবে পূজা করেছিলো, সেইভাবে সেইসময় পূজা করলো । নন্দী যে সব সামগ্রী দিয়ে পূজা করেছিলো, সে পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল এবং নিজে আবার বেলপাতা অর্পণ করতে লাগলো। তারপর নিজের মুখের জল দিয়ে লিঙ্গ স্নান করিয়ে, সেই কিরাত পশুর মাংসের নৈবেদ্য দিল শিবকে। শেষে দণ্ডবৎ প্রণাম করে মাটি থেকে উঠে নিজের গৃহে চলে গেল।

 নন্দী বৈশ্য ও পুরোহিত ব্যাকুল চিত্তে সেই আশ্চর্য ঘটনা দেখে বহু চিন্তা করলো এবং পরক্ষণে নন্দী বৈশ্য বহু বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে ডেকে এনে সব কথা খুলে বলল, “হে ব্রাহ্মণগণ, এখন আমি কী করব ? তা আপনারা বলুন ।

তখন ব্রাহ্মণেরা ধর্মশাস্ত্র দেখে আলোচনা করে বললেন, “এই বিঘ্ন এমন‌ই গুরুতর, যা দেবতারাও নিবারণ করতে পারবে না। তাই হে বৈশ্যসত্তম !  তুমি লিঙ্গটি নিজের গৃহে এনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করো।”

নন্দী তাদের পরামর্শ মেনে শিবলিঙ্গটি উৎপাটন করে মন্দির থেকে তুলে এনে নিজের ঘরে শাস্ত্র অনুযায়ী প্রতিষ্ঠা করলেন। নবরত্নমণ্ডিত সুবর্ণ পীঠ বানিয়ে দিলেন এবং অনেক উপাচার দ্বারা সেই সময় শিবলিঙ্গের অর্চনা করলেন।

 পরবর্তী দিন সেই কিরাত যথাসময়ে শিবমন্দিরে এসে উপস্থিত হলো। কিন্তু সে ঐ মন্দিরের মধ্যে তাকিয়ে সেই শিবলিঙ্গ আর দেখতে পেলেন না। তখন সে মৌন ভাব পরিত্যাগ করে কাতর কন্ঠে কাঁদতে লাগলেন এবং বললেন, হে শম্ভো ! তুমি কোথায় চলে গিয়েছো ? এখনই আমায় দর্শন দান করো । আমি যদি এখনই তোমায় দেখতে না পাই, তাহলে নিশ্চয়ই আমি এই দেহ পরিত্যাগ করবো । হে শম্ভো ! হে জগন্নাথ ! হে ত্রিপুরান্তক ! হে রুদ্র ! হে মহাদেব ! তুমি নিজেই নিজেকে দেখিয়ে দাও ॥ ১৩৫-১৫৫ ॥

 এইভাবে আক্ষেপ মধুর বাক্য বলে সেই কিরাত সদাশিবকে দর্শন দানের জন্য উত্তেজিত করতে লাগলেন। অতঃপর উদ্দাম অনুরাগ ভয়ে বীর ব্যাধ নিজের জঠর (পেট) ভেদ করল এবং ক্রোধের সহিত অনুরাগ বশত গর্জন করতে করতে বললো, “ হে শম্ভো ! তুমি তোমার স্বরূপ প্রদর্শন করো । আমাকে ত্যাগ করে তুমি কোথায় যাবে ?” এই বলে কিরাত নিজের অন্ত্রের মাংস কেটে হাতে নিয়ে সেই গর্তে নিক্ষেপ করলো (যেখানে শিব লিঙ্গ স্থিত ছিল, শিবলিঙ্গ উৎপাটন করবার ফলে শিবলিঙ্গের স্থানটি গর্তের আকারে পড়ে ছিল) এবং নিজের হৃদয়কে শান্ত করে পাশেই থাকা সরোবরে স্নান করলো। তারপর আগের মতোই ব্যগ্রভাবে বেলপাতা ও জল এনে যথাযথ ভাবে পূজা করল এবং শেষে দণ্ডবৎ প্রণাম করে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ল। তারপর সেখানেই ধ্যানস্থ হয়ে পড়ল কিরাত।

এই সময় প্রমথ-পরিবৃত রুদ্রদেব প্রাদুর্ভূত হলেন। তাঁর আকার কর্পূরের মতো গৌরবর্ণ ও প্রভাসমন্বিত ; তিনি কপর্দ্দী চন্দ্রশেখর-রূপে বিরাজিত। এই ভগবান রুদ্র সেই কিরাতকে নিজের হাত দিয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, হে মহামতে! মহাপ্রাজ্ঞ, বীর! তুমিই আমার ভক্ত, অতএব তোমার মনের যা অভীষ্ট আছে, তাহা তুমি চেয়ে নাও । রুদ্র এই কথা বললে, মহাকালের রূপের মতো দেখতে সেই ব্যাধ আনন্দে ও পরম ভক্তিযুক্ত হয়ে মাটিয়ে দণ্ডবৎ পতিত হল। 

এরপর রুদ্রদেবকে সে বললো, 

      “হে প্রভো! আমি আপনার নিকট বর প্রার্থনা করছি। হে রুদ্র! আমি আপনার দাস আর আপনি আমার প্রভু; এ বিষয়ে সন্দেহ মাত্র নাই। আপনি ইহা অবগত হয়ে জন্মে জন্মে আমার যাতে আপনার প্রতি ভক্তি হতে পারে, আমাকে সেই বর প্রদান করুন। 

হে ভব! তুমি মাতা, তুমি পিতা, তুমি বন্ধু, তুমি সখা, তুমি গুরু, তুমি মন্ত্রবেদ্য এবং তুমি মহামন্ত্র। তুমি ছাড়া অন্য আর কিছুই ত্রিভুবনে নাই। ভগবান ভব কিরাতের এমন নিষ্কাম বাক্য শ্রবণ করে তাকে নিজের প্রধান পার্ষদ ও দ্বারপালের পদ প্রদান করলেন। তখন ডমরু নাদে, ভেরীর ঝংকার রবে ও শঙ্খের শব্দে ত্রিভুবন নিনাদিত হয়ে উঠল। ঐ সময়ে হাজার হাজার দুন্দুভি ও পটহ ধ্বনিত হতে লাগলো। 

 এদিকে নন্দী বৈশ্য সেই বাদ্যধ্বনি শ্রবণ করে যেখানে প্রমথ-পরিবৃত শিব অবস্থান করছিলেন, সেই তপোবনে সবিস্ময়ে শীঘ্রই গেলেন । সেখানে গিয়ে নন্দী কিরাতকেও দেখতে পেল এবং বিস্মিত হয়ে উত্তম সমাধিযোগে কিরাতকে স্তব করবার অভিপ্রায়ে বিনীতভাবে বলতে লাগলেন, হে পরন্তপ ! তুমিই শম্ভুর প্রকৃত ভক্ত, তুমি শম্ভুকে এখানে এনেছো ; অতএব তুমিই শম্ভুর ভক্ত ব্যক্তি, আমি যে এখানে এসেছি, এটিও তুমিই প্রভু শম্ভুর নিকট নিবেদন করে দাও । কিরাত সেই কথা শ্রবণ করে কিরাত শীঘ্রই সেই নন্দী নামক বৈশ্যের হাত ধরে শঙ্করের কাছে নিয়ে গেল ॥  ১৫৬-১৭৪ ॥


তখন পরমেশ্বর রুদ্র স্মিত হাস্য করে কিরাতকে লীলার ছলে বললেন, আমাদের কাছে সামনে তুমি কাকে এনেছো ?

এই কথা শুনে কিরাত পরমেশ্বর শঙ্করকে এই সম্পর্কে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে তারপর বললেন, হে দেব ! এই ব্যক্তি সর্বদা তোমার ওই ভক্ত এবং তোমার ওই পূজায় নিরত ; নানা রত্ন, মাণিক্য, উচ্চাবচ পুষ্প, ধন এমন কি জীবন প্রদান করেও তোমার পূজা করে থাকে, এতে সন্দেহ নেই। হে ভক্তবৎসল ! অতএব এই নন্দী কে আমার মিত্র বলে আপনি বিদিত হোন। 

তখন মহাদেব বললেন, আমি বৈশ্য জাতের নন্দীকে তো জানি না ; হে মহামতে ! মহাকাল ! তুমি আমার এবং সখা ; যারা সর্ব উপাধী বর্জিত মনস্বী ব্যক্তি, একমাত্র তারাই আমার প্রিয় ভক্ত এবং তারাই বিশিষ্ট শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি । 

 কিরাত বললো, “হে তাত! আমি তোমার ভক্ত এবং এই নন্দী আমার প্রিয় সখা।”

এই কথা শুনে পরমেশ্বর শম্ভু তখন সেই কিরাত ও নন্দী এই উভয়কেই স্বীয় পার্ষদের মধ্যে পরিগণিত করে নিলেন। অনন্তর সেখানে মহান উজ্বল বহু বিমান এসে উপস্থিত হল। মহানুভব কিরাতের জন্য সেই বৈশ্য‌ও উদ্ধার হয়ে গেলেন। তাঁরা উভয়ে বেগগামী বিমানে চড়ে কৈলাস পর্বতে পৌঁছে গেলেন এবং সেখানে গিয়ে মহাত্মা মহেশ্বরের সারূপ্য (শিবের মতো রূপ) প্রাপ্ত হলেন। তখন গিরিজা পার্বতী দেবী শিবসহ তাঁদের নীরাজিত (বরণ আরতি) করলেন। অনন্তর সেই গজগামিনী দেবী স্মিত হাস্যপূর্বক বললেন, “হে মহাদেব ! যেমন তুমি (লীলাধারী পরমেশ্বর), তেমন এরা দুই জন (পরম শিবভক্ত) ; এতে সন্দেহ কিছুই নেই । কি সারূপ্য, কি গতি-ভঙ্গীমা, কি হাস্য করবার ধরণ, কি আকার-ইঙ্গিত, সর্বপ্রকারেই এরা তোমার ন্যায় সুশোভিত হয়ে উঠেছেন। যাই হোক, আমি কিন্তু নিশ্চয়ই কেবল তোমাকেই সেবা করতে  এসেছি।”

 দেবীর সেই কথা শুনে কিরাত এবং বৈশ্য উভয়েই তৎক্ষণাৎ শঙ্করের দিকে ঘুরে পরান্মুখ হয়ে বললেন, 

 “হে দেব ত্রিলোচন! আমরা আপনার অনুকম্পাহ হতে ইচ্ছা করি। আমরা আপনার দ্বারপাল হয়েই নিত্য অবস্থান করবো। হে দেব ! আপনাকে আমরা পুনঃপুনঃ নমস্কার করি। 

ভগবান ভব (মহাদেব) তাদের অভিপ্রায় বিদিত হয়ে বললেন, “তোমাদের পরম ভক্তিগুণে বাঞ্ছিত বিষয় সিদ্ধ হউক।” মহাদেব এই কথা বললে সেই দিন হতেই কিরাত এবং বৈশ্য তাঁর দ্বার-পালপদে বিরাজ করতে লাগলো।

 হে বিপ্রগণ! শিবের দ্বারদেশে থেকে তখন হতে তারা প্রতি মধ্যাহ্নে শিবদর্শন লাভ করতে লাগিল। নন্দী এবং মহাকাল এই উভয়েই শিববল্লভ ; তারা প্রীতিভরে বলতে লাগল, আমরা উভয়েই সেই এক সদাশিব ছাড়া আর কিছুই ন‌ই।

 তখন মহাদেব একটা আঙ্গুল উন্নমিত(উঠিয়ে সম্মতি) করে জানিয়ে দিলেন এবং নন্দী নিজের দুই আঙ্গুল উন্নত করলেন। এইরূপ সংজ্ঞান্বিত হয়ে তারা মহাত্মা মহাদেবের দ্বারদেশে অবস্থান করতে লাগলেন। 

হে মহাভাগ ঋষিগণ! শ্রবণ করুন, পুরাকালে শৈলাদ (নন্দীকেশ্বর) কর্তৃক এই অনন্ত শিবধৰ্ম কীর্তিত হয়েছে। হে বিপ্রগণ ! শৈলাদ দুষ্কৃতাত্মা প্রাণিবর্গের প্রতি কৃপা করে এই সকল বিষয় বলেছিলেন। যারা পাপী, অধার্মিক, অন্ধ, মূক, পঙ্গু, অকুলীন, দুরাত্মা বা শ্বপচ মানব, অথবা অনান্য যে কোনো প্রকার লোকই হোক, শিবভক্তির দ্বারা পুরস্কৃত হয়ে তারা সকলেই দেবদেব শূলপাণির সান্নিধ্য প্রাপ্ত হতে পারে। যে সকল পণ্ডিত সিকতাময় (বালি বা মাটির তৈরী) লিঙ্গের অর্চনা করেন, তারা রুদ্রলোকে প্রয়াণ করে থাকেন, এ বিষয়ে আর বিচার আলোচনা কিছুই নেই ॥ ১৭৫-১৯৭ ॥


 (স্কন্দ মহাপুরাণ/মাহেশ্বর খণ্ড/কেদারখণ্ড/৫ অধ্যায়/১১১-১৯৭ শ্লোক)


✅ শ্রী নন্দীনাথ শৈবকৃত ব্যাখ্যা : উপরোক্ত কাহিনী দ্বারা বোঝা গেল, পরমেশ্বর শিব কোনো মূল্যবান উপাচার বা নিরামিষ আমিষ ভক্ষণের নিয়ম নীতির নির্ভর করে কৃপা প্রদান করেন না, এমনকি পরমেশ্বর শিব বলেছেন কোনো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, চণ্ডাল ইত্যাদি কোনো জাতির বিচারও তিনি করেন না, তিনি সকলকেই সমান দৃষ্টিতে দেখেন, তার কাছে ভক্তের প্রকৃত ভক্তিই গ্রহণযোগ্য। প্রভু শিব কে ভক্তিসহকারে মাংস প্রদান করলেও প্রভু শিব প্রসন্ন হয়ে তা গ্রহণ করেন।

প্রভু শিব মূলত ফল বা মাংস কোনো কিছুই আহার করেননা, তিনি শুধু তার ভক্তের ভাব দেখেন, যা ভক্ত ভক্তি সহকারে মহাদেবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন, প্রভু শিব নিজের ভক্তের ভক্তি সমন্বিত বস্তুর মাধ্যমে ভক্তি ভাব‌ই গ্রহণ করেন। উচ্চকোটীর কোনো ভক্ত যদি প্রভু শিবের কাছে ভক্তি সমন্বিত আহার্য বস্তু অর্পন করে প্রভু শিবকে তা ভক্ষণ করে নেবার জন্য প্রার্থনা করেন, তবে প্রভু শিব নিজের ভক্তের জন্য লোকাচার বশত সেই ভক্তি সহকারের দেওয়া আহার্য বস্তু গ্রহণ করে নেন। মূলত তার কোনো আহারের প্রয়োজন নেই, তিনি স্বয়ং সকল বস্তুর মধ্যে অবস্থিত, তাহলে তার আহারের প্রয়োজন কি ? । আসলে তিনি নিজের ভক্তের প্রতি বাৎসল্য বশত ভক্তের হৃদয়কে আনন্দ প্রদানের জন্য ভক্তের ইচ্ছে পূরণ করেন মাত্র। 
সুতরাং, ব্যাধের প্রদান করা হরিণের মাংস তথা মুখে ভরে আনা জলে কোনো অপবিত্রতা নেই, সেখানে উদ্দেশ্য ছিল শুধু প্রভু শিবকে যেকোনো প্রকারে সেবা করা। সাধারণ মানুষ এতে অপবিত্রতা খুঁজতে পারেন, সাধারণ মানুষ প্রভু শিবকে মাংস প্রদানের বর্ণনা দেখে ঘৃণায় আঁতকে উঠতে পারেন, কিন্তু প্রভু শিব জগতের প্রত্যেকটি অণু-পরমাণুর মধ্যে অবস্থিত, তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে তিনি বিশ্বরূপ, অর্থাৎ বিশ্বের প্রত্যেকটা রূপে প্রভু শিব‌ই অবস্থান করছেন। ঈশ্বরের কাছে কোন কিছুই পবিত্র অপবিত্র নয়, সাধারণ জীবের ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণে জীব যেটিকে ঘৃণ্যবস্তু মনে করে, অপবিত্র মনে করে, ভক্তিমান ব্যক্তি সর্বত্র ঈশ্বর রয়েছেন - এমনটা ভেবে তিনি যে কোন অবস্থায় যেকোনো দ্রব্য দ্বারা পরমেশ্বর শিবের আরাধনা করে শিবকৃপা প্রাপ্ত করেন।
তাই হৃদয়ের বিশুদ্ধ ভক্তি ভাব‌ই সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম, এই ভক্তি ভাবের দ্বারাই মাংস ও মুখে লালা মিশ্রিত জল প্রভু শিব প্রসন্ন হয়ে স্বীকার করেছেন। জীব হলো ঈশ্বরের কাছে শিশু সমতুল্য, অবুঝ শিশু যেমন খেলার ছলে কোনো কার্য করলে প্রকৃত বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাতে রুষ্ট হয়ে বরং প্রসন্ন হন। ঠিক তেমনভাবেই প্রভু শিব তার ভক্তদের নিজের সন্তান ভেবে তাদের করা ভক্তিভাবের দ্বারাই প্রসন্ন হয়ে যান। 
যে ব্যক্তি জ্ঞানী, তিনি জানেন নিজের দেহের মধ্যে থাকা আত্মাই পরমাত্মা, সর্বত্র এই আত্মারূপী পরমাত্মাই  রয়েছেন। তাই বিশ্বাস সকল জীবজগৎ রূপে যেহেতু আমিরূপ এক পরমাত্মাই রয়েছেন, সেহেতু সেই দৃষ্টিকোণে  মাংস ভক্ষণ করলেও তা মূলত নিজের‌ পরমাত্মার স্বরূপের‌ই ভিন্ন রূপ বলে জেনে ভক্ষণ করাতে কোনো পাপ হয় না। কারণ বেঁচে থাকতে গেলে জীবন্ত উদ্ভিদ বা পশু-পাখীর বধ করেই তার দ্বারা জীবন রক্ষা করতে হয়। প্রাণ হত্যাই যদি পাপ হয় তবে আমাদের দেহে প্রতি মুহূর্তে কোটি কোটি জীবানু শ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করছে, আর  আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী অনাক্রম্যতা শক্তি তাদের ধ্বংস করছে, তাহলে ভেবে দেখা উচিত যে, আমরা প্রতি সেকেন্ডে কত কোটি কোটি জীব বধ করছি, সেই জীব আকারের ছোট হোক অথবা বড় হোক, প্রাণ তো নাশ হচ্ছেই। তাহলে এক্ষেত্রে কেন পাপ লাগছে না ? 


আসলে মানুষ জীবন্ত বস্তু বধ করে তা আহার করেই বেঁচে আছে। তাই জগতকে নিজের পরমাত্ম স্বরূপ বলে উপলব্ধি করে পশু মাংস ভক্ষণেও পাপ লাগে না। একথা স্বয়ং স্কন্দপুরাণেই বলা হয়েছে। 
দেখুন,

অভক্ষ্যং ব্রহ্মবিজ্ঞানবিহীনস্যৈব দেহিনঃ ।

ন সম্যগ্জ্ঞানিনস্তস্য স্বরূপং সকলং খলু ॥৭

অহমন্নং তথাঽন্নাদ ইতি হি ব্রহ্মবেদনম্ ।

ব্রহ্মবিদ্গ্রসতি জ্ঞানাৎসর্বং ব্রহ্মাত্মনৈব তু ॥৮

ব্রহ্মক্ষত্রাদিকং সর্বং যস্য স্যাদোদনং সদা ।

যস্যোপসেচনং মৃত্যুস্তজ্জ্ঞানী তাদৃশঃ খলু ॥৯

ব্রহ্মাস্বরূপং বিজ্ঞাতুর্জ্ঞানাত্তত্তস্য ভাসতে ।

তথা সতি জগদ্ভোজ্যং ভবেৎ বিজ্ঞানিনঃ খলু ॥১০

[তথ্যসূত্র : স্কন্দমহাপুরাণ/সূতসংহিতা/যজ্ঞবৈভবখণ্ড/পূর্বভাগ/৪৫ অধ্যায়]

🌷 অর্থ — ভক্ষ্য-অভক্ষ্য (আমিষ-নিরামিষ) -এর বিভাজন শুধুমাত্র তার জন্য প্রযোজ্য, যিনি ব্রহ্ম জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হননি, যিনি নিজেকে শুধু দেহমাত্র ভাবেন। কিন্তু যিনি শিবজ্ঞান অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন তার জন্য এইসব খাদ্যবস্তুর বিভাজন নেই, কারণ(তিনি জানেন) সবকিছুই যে তার‌ই আত্মস্বরূপ ॥৭

‘যা খাওয়া হয়, আর যিনি আহার করেন, সে আমিই’ - এটিই ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তির অনুভব ।জ্ঞানের ফলস্বরূপ ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তি ব্রহ্মরূপে দর্শন করে উভয় প্রকার খাদ্য‌ই আহার করেন ॥৮

যার কাছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় আদি সমস্ত জগত ভাতের মতো আর মৃত্যু শাকের মতো সেই পরমশিবকে অনুভবকারী শিবজ্ঞানীও তেমন হন ॥৯

বিজ্ঞাতা ব্যক্তির স্বরূপ আসলেই ব্রহ্ম, আর এটি জ্ঞান দ্বারা অজ্ঞান সরলেই জানা যায়, তাই শিবজ্ঞানীর জন্য সমগ্র জগত ই ভোজ্য ॥১০


🔥 বিশ্লেষণ  : শিবজ্ঞানী শৈবদের জন্য আমিষ নিরামিষ খাদ্যের ভাগাভাগি নেই। যারা শিবজ্ঞানী নয় তারাই নিরামিষ আমিষ নিয়ে গোঁড়ামি করে ।



__________________________________________________


🔥 সিদ্ধান্ত : মাংসভোজী ব্যক্তিও শিব ভক্তির মাধ্যমে শিবের কৃপা পেতে পারেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। যদি মাংস ভোজনে শিব কৃপা না পাওয়া যেতো তাহলে শাস্ত্রে এই কাহিনীর উল্লেখ থাকতো না।  

________________________________________________


শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩 

হর হর মহাদেব 🚩 


তথ্য সংগ্রহে ও লেখনীতে — শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য গুরুদেব জী 

কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ