যারা নিজের অজান্তেই “হরি হর” এক বলছেন, শাস্ত্র বলছে — তাদের জন্য মলের কৃমি হবার শাস্তি অপেক্ষা করছে

 




॥ ॐ নমঃ শিবায় ॥

ভূমিকা —

 সনাতন ধর্মের আজ এই কলিযুগে এমন বেহাল দশা হয়েছে, যার ফলে সনাতন ধর্মের মূল সত্য বিষয়টি আজ শাস্ত্রের তথ্য প্রমাণ, বচন কে অগ্রাহ্য করে মানুষ নিজের মনের ভাবনা কে সত্য বলে ভাবে। একজন সঠিক মার্গে অগ্রসর ব্যক্তি নিজের মনে উত্থিত হ‌ওয়া ভাবনা কে সত্য মনে করে , আবার ভুল পথে চালিত হয়ে সেই পথকেই সঠিক ভেবে নিয়ে নিজের মন মানসিকতা অনুযায়ী সেই ভুল পথে চলতে থাকা ব্যক্তিও নিজেকে সঠিক মনে করে। এখন বিচার করবার বিষয় হল, মন‌ই যদি সকল কিছু জানাতে সক্ষম হতো তবে শাস্ত্রের কি প্রয়োজন আছে ? পরমেশ্বর কেন এত শাস্ত্রবচন কেন দিলেন ? 

অর্থাৎ, কারোর ব্যক্তিগত মত বা ধারনা/ভাবনা কখনোই সত্যের পথ নির্ণয়ের মাপকাঁঠি নয়, যদি এটিই মাপকাঁঠি হতো তবে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের নিজের ইচ্ছা মতো যেকোনো ধারণা করা মার্গই সত্যের মার্গ বলে মান্য করলেই তা সত্য বলে মান্য হয়ে যেতো, একজন ব্যক্তি যেটিকে সত্য বলে ধারণা করতো আরেকজন ব্যক্তি আরেক ধরণের অন্য কোনো ধারণা কে সত্য বলে দাবী করতো। এতে কার ধারণা সত্য আর কার ধারণা অসত্য, তা কোনোভাবে নির্ণয় করা যেত না, কিন্তু সত্য কখনোই কোনো ব্যক্তির নিজস্ব ব্যক্তিগত ধারণার উপর নির্ভর করে না। কোনটি প্রকৃত পক্ষে সত্য -  তা পরমেশ্বরের বচন থেকেই জানতে হয়। এই কারণে পরমেশ্বরের দেওয়া শাস্ত্রে পরমেশ্বরের যে বচন রয়েছে তার অনুসারেই আমাদের সত্য নির্ণয় করতে হয়, অন্য কোনো ব্যক্তির ভাবনা অনুসারে কোনটি সঠিক বা কি মানা উচিত - তা নির্ভর করে না। 

সমাজে আজ দেখা যায়, মানুষ দাবী করে থাকে যে, হরি হর এক, এনাদের মধ্যে ভিন্নতা করলে নরকে যায় মানুষ। সঠিক ভাবে শাস্ত্র পড়েননি এমন ব্যক্তিদের মুখে প্রায়ই বলতে শোনা যায় যে, হরি এবং হর সম্পূর্ণ ভাবে সমান। আমি এই বিষয়ের উপর একটি বিস্তারিত প্রবন্ধ লিখেছিলাম, সেটি দেখে নিতে পারেন, এইখানে ক্লিক করে 👉 হরি হর সংক্রান্ত প্রশ্ন ও তার উত্তর 

কিন্তু এই প্রবন্ধে আমরা হরি আর পরমেশ্বর শিব কে সকল দৃষ্টিকোণ থেকে সমান বলার ফল কি হতে পারে তা দেখাবো। তারই সাথে পরমেশ্বর শিব ও হরির মধ্যে ভেদ থাকবার কথাও শাস্ত্রে স্বীকার করা হয়েছে, এখন তা কিরূপে ভেদ দর্শিত হয়েছে সেই বিষয়ে আলোকপাত করবো।

হরি আর পরমেশ্বর শিব কে সকল দৃষ্টিকোণ সমান বলে দাবী করা কতটা যুক্তিযুক্ত এই বিষয়ে শাস্ত্র কি বলছে চলুন দেখে নেওয়া যাক।  - এই বিষয়ে কোনো ব্যক্তির নিজস্ব মতামত গ্রহণযোগ্য নয় ।


________________________________________________

আলোচনার পূর্বে কিছু প্রাথমিক বিশ্লেষণ 

আমাদের শাস্ত্রের বহু স্থানে "হরি হর এক" বলা হয়েছে, এই কথা ভুল নয়, ঠিক।

 কিন্তু এখানে একটি আশঙ্কা জেগে ওঠে, যদি হরি হর সম্পূর্ণ ভাবে এক হয়ে থাকেন,  তবে কি 

শিব = বিষ্ণু - হলে, পার্বতীপতি শিব কে বিষ্ণু বলে দাবী করে "পার্বতী দেবীর স্বামী বিষ্ণু" - এমনটি ভাবা কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব ?

না,  এটা কখনোই সম্ভব নয় । অর্থাৎ হরি ও হর এক বলা হলেও বাস্তবে কিন্তু সম্পূর্ণভাবে বিষ্ণু ও শিব সমান নন বলেই মানতে হচ্ছে।

অনেকেই দাবী করেন যে, হরি আর হর কে শাস্ত্রে বহু স্থানে অভেদ বলা হয়েছে, তাই শুধু শিব কে শ্রেষ্ঠ বলা যাবে না। 

এমন ধরণের যুক্তির খণ্ডন করছি, দেখুন -

শিবমহাপুরাণে পুরাণের শতরুদ্র সংহিতার ৭ নং অধ্যায়ে পরমেশ্বর শিব নন্দী মহারাজ কে বলেছেন — হে নন্দী তোমার আমার মধ্যে কোনো ভেদ নেই। দেখুন 👇 

শিব উবাচ

বৎস নন্দিন্ মহাপ্রাজ্ঞ মৃত্যোর্ভী‌তিঃ কুতস্তব।

ময়ৈব প্রেষিতৌ বিপ্রৌ মৎসমস্ত্বং ন সংশয়ঃ ॥ ১০ ॥

[তথ্যসূত্র — শিবমহাপুরাণ/শতরুদ্র সংহিতা/৭ অধ্যায়]

অর্থ — পরমেশ্বর শিব (নন্দীকে) বললেন, হে বৎস ! হে নন্দিন্ ! হে মহাপ্রাজ্ঞ ! তোমার মৃত্যুতেও ভয় কোথায় ? আমি সেই দুজন ব্রাহ্মণকে পাঠিয়েছিলাম, তুমি তো আমারই সমান, এতে কোনো সংশয় নেই ।

 উপরক্ত শাস্ত্র বচন থেকে জানা গেল যে, পরমেশ্বর শিব তার ভক্ত নন্দী কে বলছেন যে শিব ও নন্দীর মধ্যে কোনো ভেদ নেই। এখন তবে প্রশ্ন হল - তাহলে কি নন্দীকে পার্বতী দেবীর স্বামী বলে দাবী করা যাবে ?

উত্তর হল - না, কখনোই বিষ্ণু বা নন্দী মহারাজ কে পার্বতী দেবীর স্বামী বলা যাবে না। ঠিক একই ভাবে বিষ্ণুর সাথে যতই শিব কে এক বলা হোক, তা সকল দৃষ্টিকোণ থেকে কখনোই এক নয়। 


খেয়াল করুন, 

নন্দী মহারাজ পরমেশ্বর শিবের তপস্যা করেছেন। শিব ও নন্দী মহারাজ যদি সকল দৃষ্টিকোণ থেকে অভেদ হতেন তবে নন্দী মহারাজ পরমেশ্বর শিবের তপস্যা কেন করলেন ? 

নন্দী মহারাজ পরমেশ্বর শিবের তপস্যা করবার পর পরমেশ্বর শিব দর্শন দিয়ে নন্দী মহারাজ কে " মৃত্য হলেও ভয় কোথায় ? আমি আর তুমি তো সমান - অভেদ" এই বচন বলে ছিলেন। 

এখন প্রশ্ন হল, এই সমান বা অভেদ বলবার তাৎপর্য কি ? এর তাৎপর্য হল পরমেশ্বর শিব নন্দী মহারাজ কে বলে এটিই বোঝাতে চেয়েছেন যে, মৃত্যু তো দেহের হয়, আত্মার মৃত্যু হয় না, এই আত্মা রূপে শিবই রয়েছেন সকল জীবের মধ্যে, অর্থাৎ শিব ভিন্ন তো কিছুই নেই। শিবের লীলাবশত শিবের জীব রূপ প্রকট হয় শিবের থেকে, সূর্যের ন্যায় পরমাত্মা শিবের প্রকাশিত আত্মা কিরণ হয়ে প্রকাশিত হয়ে পঞ্চভূতের দেহ কে পোশাকের ন্যায় ধারণ করে জীব বলে পরিচিতি লাভ করেন, আপাত দৃষ্টি তে যেন মনে হয় জীব শিব থেকে আলাদা, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে  জীবের আত্মা শিব থেকে ভিন্ন নয়। তাই পরমেশ্বর শিব বলেছেন যে, হে নন্দী তুমি তো আমারই সমান অর্থাৎ তুমি তো প্রকৃত পক্ষে শিব, অন্য কেউ নয়। বাহ্যিক দৃষ্টি তে দেহ নন্দী হিসেবে দৃশ্যমান হলেও পরমার্থি‌ক দৃষ্টিতে নন্দী বা বিষ্ণু রূপে একা পরমেশ্বর শিবই রয়েছেন, শিব ভিন্ন অন্য আর কেউই নেই। 

পরমেশ্বর শিব নিজেই বিষ্ণু, নন্দী বা অন্য সকল কিছু রূপে রয়েছেন । বাহ্যিক রূপে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধরে বিভিন্ন কার্য‌ করছেন মাত্র। পরমেশ্বর শিবই বিষ্ণুরূপ ধরে বিষ্ণুরূপের জন্যেও কিছু ক্ষমতা, কার্য‌, সীমাবদ্ধতা নিশ্চিত করেছেন। পরমেশ্বর শিবই নন্দীরূপ ধরে নন্দীরূপের জন্যেও কিছু ক্ষমতা, কার্য‌, সীমাবদ্ধতা নিশ্চিত করেছেন। একই ভাবে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধরে তাদের জন্যেও কিছু ভিন্ন ভিন্ন ক্ষমতা, ভিন্ন ভিন্ন কার্য‌,ভিন্ন ভিন্ন সীমাবদ্ধতা নিশ্চিত করেছেন।

এই কারণে সবাই শিবের সাথে পরমার্থি‌ক ভাবে এক ও অভিন্ন হলেও, বাহ্যিক ভাবে সম্পূর্ণ এক ও সমান নন ।

তাই শাস্ত্রের যে যে স্থানে "হরি হর এক" বলা হয়েছে, তা মূলত শিবই যে হরি(বিষ্ণু) রূপে থাকবার কারণে বলা হয়েছে, বিষ্ণুর আত্মা শিব এই দৃষ্টিতে হরি কে হর (রুদ্র) সমান বা অভেদ বলা হয়েছে, কারণ শিবই আত্মা হিসেবে হরিরূপের মধ্যে রয়েছেন। 

 🔶 বিষ্ণু ও অনান্য সকল দেবতার রূপ পরমেশ্বর শিব‌ই ধারণ করেন, বেদ বলেছে এই কথা —

 প্রভু শিব‌ই শ্রীবিষ্ণুরূপ ধারণ করে পালন কার্য করছেন(অথর্বশির উপনিষদ/২/২),  

বিভিন্ন দেবতার রূপে প্রভু শিব‌ই প্রকাশমান(অথর্বশির উপনিষদ/২/১-৩৩)

🔶ব্রহ্মা বিষ্ণু চেয়েও শ্রেষ্ঠ একমাত্র পরমেশ্বর শিব, তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কেউ নেই, প্রমাণ —

পরাৎপরতরো ব্রহ্মা তৎপরাৎপরতো হরিঃ ।

তৎপরাৎপরতো হ্যেষ তন্মে মনঃ শিবসংকল্পমস্তু ॥ ১৮  

[ঋগ্বেদ/আশ্বলায়ণশাখা/১০/১৭১/শিবসংকল্পসূক্ত]

এবং (ঋগ্বেদ সংহিতা/খিল ভাগ /৪/১১)

অর্থ — সর্বোপরি হলেন ব্রহ্মা । তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হরি এবং এনাদের চেয়েও যিনি পরমতম তথা সর্বশ্রেষ্ঠ ‘ঈশ’ ( ঈশান/ঈশ্বর/সদাশিব), সেই শিবের প্রতি মন সংকল্পিত হোক ।


🔶সকল দেবতার রূপ পরমেশ্বর শিব ধারণ করলেও, তাদের চেয়েও একমাত্র প্রভু শিব‌ই   শ্রেষ্ঠ —

তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরং তং দেবতানাং পরমং চ দৈবতম্।

পতিং পতীনাং পরমং পরস্তাদ্ বিদাম দেবং ভুবনেশমীড্যম্  ॥ ৭

(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ/৬ষ্ঠ অধ্যায়/৭-৮নং মন্ত্র)

অর্থ —  সমস্ত ঈশ্বরপদ প্রাপ্তকারী দেবতাদের‌ থেকে পরম হলেন মহেশ্বর । সমস্ত দেবতাদের চেয়েও পরমদেবতা, তিনি সংসারের সমস্ত পতিদের‌ও পতি, তিনি সকল কিছুর মধ্যে পরমতম স্তর, সেই ভুবনের একমাত্র ঈশ্বর ভুবনেশ পরমেশ্বর শিব‌‌ই আরাধ্য, তাকেই নিজের অন্তরের আত্মাস্বরূপ বলে জানা উচিত ॥ ৭


কিন্তু এই হরি বা দেবতারা পরমেশ্বর শিবের অনিত্য রূপ ভেদ মাত্র। তাই এনাদের কখনোই অক্ষয় নিত্য পরমব্রহ্ম বলে স্বীকার করা হয়না, বেদ‌ই বলেছে শিব‌ই একমাত্র ধ্যেয়, বিষ্ণু সহ অনান্য সব দেবতা প্রকৃত ধ্যেয় বস্তু নন। দেখুন —

এক এব শিবো নিত্যস্ততোহন্যসকলং মৃষা ।

তস্মাৎসর্বাপরিত্যজ্য ধ্যেযান্বিষ্ণবাদিকান্সুরান্ ॥ ৩০

(শরভ উপনিষদ/৩০নং মন্ত্র)

অর্থ – শিবই একমাত্র নিত্য, অন্য সকল কিছুই মিথ্যা। এই কারণে বিষ্ণু সহ সকল দেবতাকে পরিত্যাগ করে শিবকেই ধ্যেয় বলে জানা উচিত ॥ ৩০


                  — উপরোক্ত বেদবানী থেকে প্রমাণিত হল যে, একমাত্র প্রভু শিব‌ই উপাসনার যোগ্য। তিনি ছাড়া অন্য কোনো দেবদেবীর রূপ নিত্য নয়, 

তাই  যারা বাহ্যিক ভাবেও এক - বলে দাবী করে তারা নরকগামী হন, এই নির্ণয় স্বয়ং শাস্ত্র দিয়েছে , সেই প্রমাণ উল্লেখ করে এবার মূল প্রসঙ্গের আলোচনা আরম্ভ করলাম । 


নিজের অজান্তেই যারা হরি হর এক বলছেন, শাস্ত্র বলছে তাদের জন্য নরকের শাস্তি অপেক্ষা করছে 


(১) শিবকে অন্য কোনো দেবতার সাথে তুলনা করার ফল —

চতুর্দশসু বিদ্যাসু গীয়তে চন্দ্রশেখরঃ।

বেদান্তা যঞ্চ গায়ন্তি মুনয়ঃ শংসিতব্রতাঃ ॥ ১৫ 

ব্রহ্মাদ্যা দেবতাঃ সর্ব্বা ইন্দ্রোপেন্দ্রাদয়স্তথা।

ন্যূনতাং তথ্য যো ব্রতে কৰ্ম্মচন্ডাল উচ্যতে ॥ ১৬ 

তেন তুল্যো যদা বিষ্ণুব্রহ্মা বা যদি গদ্যতে।

ষষ্টিবর্ষসহস্রাণি বিষ্ঠায়াং জায়তে কৃমিঃ ॥ ১৭

(সৌরপুরাণ/৪০ নং অধ্যায়/১৫-১৭ নং শ্লোক)

অর্থ  —  যে চন্দ্রশেখর মহাদেব চতুর্দশ বিদ্যায় অভিহিত, বেদান্ত, মুনিগণ সতত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র যার মাহাত্ম্য গায়নে, কীর্তনে তৎপর, সেই দেবাদিদেবের ন্যূনতা কীর্তন করেন যিনি, তিনি 'কৰ্মচণ্ডাল' নামে অভিহিত হন। কেউ যদি সেই দেবাদিদেব পরমেশ্বরের সাথে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুরও তুলনা করে সে ষাট হাজার বছর কৃমি হয়ে মল/বিষ্ঠায় বিচরণ করে।



(২) বিষ্ণু, ব্রহ্মা বা অন্য কোনো দেবতাকে পরমেশ্বর শিবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা সমান বলার ফল হল নরকের অগ্নিতে গমন —

বিহীনং বা সমং বাঽপি হরিণা ব্রহ্মণা হরম্‌ ।

যে পশ্যন্তি সদা তে তু পচ্যন্তে নরকানলে ॥ ২১

হরিব্রহ্মাদিদেবেভ্যঃ শ্রেষ্ঠং পশ্যন্তি যে হরম্‌ ।

তে মহাঘোরসংসারান্ম‌ুচ্যন্তে নাত্র সংশয়ঃ ॥ ২২

[তথ্যসূত্র — স্কন্দমহাপুরাণ সূতসংহিতা/যজ্ঞবৈভবখণ্ড/উপরিভাগ/সূতগীতা/৫ অধ্যায়]

অর্থ — যে ব্যক্তি হর কে হরি বা ব্রহ্মার সমান বা হীন ভাবেন, সেই ব্যক্তি নরকে পতিত হয়ে পচতে থাকবে ॥ ২১

যে ব্যক্তি হরি, ব্রহ্মা ও অনান্য দেবতাদের থেকে হর কে শ্রেষ্ঠ বলে বুঝতে পারেন, তিনি মহাঘোর সংসারসমুদ্র থেকে মুক্ত হয়ে যান, এতে কোনো সংশয় নেই  ॥ ২২


________________________________________________

যারা অজ্ঞান ব্যক্তি একমাত্র তারাই নিজের অজ্ঞানতার কারণে শিব ও বিষ্ণু কে সমান ভেবে থাকে, বা শিবের চেয়েও হরিকে শ্রেষ্ঠ ভেবে থাকে, প্রমাণ দেখুন —


পরমশিবঃ পরমেশ্বরঃ স্বতন্ত্রো যদি কুরুতে মনুজস্য বেদন হি তৎ।

পরমপদং বিমলং প্রয়াতি মর্যো যদি কুরুতে ন শিবঃ প্রয়াতি বন্ধম্ ॥ ৪৬

দিনকরকিরণৈর্হি শার্বরং তমো নিবিড়তরং ঝটিতি প্রণাশমেতি।

ঘনতরভবকারণান্তরং তমঃ শিবদিনকৃৎ প্রভয়া ন চাপরেণ ॥ ৪৭

হরিরহমপ্যপরে সুরাসুরাদ্যাঃ পরমশিবপ্রভয়া তিরস্কৃতাশ্বং।

রবিকিরণৈরখিলান্যহানি যদ্বৎ পরমশিবঃ স্বত এব বোধকারী ॥ ৪৮

শিবচরণস্মরণেন পূজয়া চ স্বকতমসঃ পরিমুচ্যতে হি জন্তুঃ।

ন হি মরণপ্রভবপ্রণাশহেতুঃ শিবচরণস্মরণাদৃতেঽস্তি কিঞ্চিৎ ॥ ৪৯

পরমশিবঃ খলু নঃ সমস্থহেতুঃ পরমশিবঃ খলু নঃ সমস্থমেতৎ

পরমশিবঃ খন্তু নঃ স্বরূপভূতঃ পরমশিবঃ খলু নঃ প্রমাণভূতঃ ॥ ৫০

পরমশিবঃ সকলাগমাদিনিষ্ঠঃ পরমশিবঃ পরমানুভূতিগম্যঃ

পরমশিবঃ পরমানুভূতিরূপঃ পরমশিবঃ পরমানুভূতিদশ্চ ৫১

পরমশিবসমুদ্রেঽহং হরিঃ সর্বদেবা মনুজপশুমৃগাদ্যাঃ শীকরা এচ সত্যম্

বিমলমতিভিরেবং বেদবেদান্তনিষ্ঠৈর্‌ হৃদয়কুহরনিষ্ঠং বেদিতুং শক্যতে হি ৫২

মায়াবলেনৈব হরিং শিবেন সমানমাহুঃ পুরুষাধমাশ্চ।

মোহেন কেচিন্মম সাম্যমাহুর্মায়া তু শৈবী খলু দুস্তরেয়ম্ ॥ ৫৩

খদ্যোতো যদি চণ্ডভানুসদৃশস্তুল্যো হরিঃ শম্ভুনা

কিম্পাকো যদি চন্দনেন সদৃশস্তুল্যোঽহমীশেন চ।

অজ্ঞানং যদি বেদনেন, সদৃশং দেবেন তুল্যা জনাঃ

কিং বক্ষ্যে সুরপুঙ্গবা অহমহো মোহস্য দুশ্চেষ্টিতম্ ॥ ৫৪

অতঃ শিবেনৈব সমস্তমেতদ্ভবত্যনন্তেন ন চাপরেণ।

শিবস্বভাবেন শিবঃ সমস্তং শিবপ্রভাবেন জগদ্বিচিত্রম্ ॥ ৫৫

তত্ত্বদৃক্সকলমদ্বয়ং সদা পশ্যতি স্ম পরিমোহিতঃ পুমান্।

কষ্টশিষ্টঘটকুন্ড্যরূপতঃ কষ্টমেৱ খলু তস্য বেদনম্ ॥ ৫৬ 

ইদং জগদিতি স্বতঃ সকলজন্তোঃ প্রতীতির্দৃঢ়া

পরং জগদিতি স্ফুরত্যমলবোধস্বভাবেন চ।

ইদং হি পরবেদনং বিমলচিত্তস্য পুংসঃ সদা ভবং

তরতি মানবঃ পরমবোধেন চৈতেন হি ॥ ৫৭

ছন্দোগশ্রুতিমস্তকে বিনিহিতং বিজ্ঞানমেতন্ময়া

জন্তূনামবিবেকিনামতিতরামজ্ঞানবিধ্বস্তয়ে।

কারুণ্যাদমরাধিপা অতিশুভব্রহ্মামৃতাবাপ্তয়ে

দেবানামধিপাধিপস্য বচনাদুক্তং মহেশস্য চ ॥৫৮॥

[তথ্যসূত্র — স্কন্দমহাপুরাণ সূতসংহিতা/যজ্ঞবৈভবখণ্ড/উপরিভাগ/ব্রহ্মগীতা/৬ অধ্যায়]

অর্থ — স্বতন্ত্র পরমেশ্বর পরমশিব যদি কৃপা করে কোনও মানুষকে সেই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান দান করেন, তবেই সেই মরণধর্মা জীব নির্মল পরমপদ লাভ করে। আর যদি শিব সেই জ্ঞান প্রকট করে না দেন, তবে তিনি বন্ধনের মধ্যেই আবদ্ধ থেকে যায় ॥ ৪৬


রাত্রির গভীর অন্ধকার সূর্যের কিরণেই সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়। ঠিক তেমনই, সংসারের কারণ যে অজ্ঞানের অন্ধকার, যা সাধারণ অন্ধকারের চেয়েও ঘন, তা শিবরূপ সূর্যের আলোর দ্বারাই নষ্ট হয় (অন্য কোনও শক্তিতে নয়) ॥ ৪৭
 

হরি, আমি (ব্রহ্মা) ও অন্য দেবতা সকলেই পরমশিবের প্রভায় ম্লান হয়ে পড়ি
যেমনভাবে দিনও যেন সূর্যের কিরণের তুলনায় নিষ্প্রভ হয়ে যায়। পরমশিবই স্বয়ং জ্ঞানের বোধ প্রদানকারী ॥ ৪৮ 

শিবচরণ স্মরণ ও পূজার মাধ্যমে জীব নিজের অজ্ঞান থেকে মুক্তি পেয়ে যায় । জন্ম ও মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তির অন্য কোনও উপায় নেই ॥ ৪৯ 

আমাদের এবং সকল কিছুর কারণ পরমশিব। যে সব কিছু আমাদের আছে — সেই সবই পরমশিব। তিনিই আমাদের অন্তর্নিহিত স্বরূপ এবং তিনিই আমাদের জন্য পরম প্রমাণস্বরূপ ॥ ৫০

সমস্ত আগম শাস্ত্রের চূড়ান্ত প্রতিপাদ্য পরমশিবই। তাঁকে কেবল পরম আত্মানুভবেই উপলব্ধ করা যায়। তিনিই সেই অনুভব স্বরূপ এবং তিনিই সেই অনুভব প্রদানকারী ॥ ৫১

পরমশিবরূপ মহাসমুদ্রে আমি, হরি, সকল দেবতা, মানুষ, পশু, মৃগ — সবাই কেবলমাত্র যেন এক একটি জলবিন্দু মাত্র। বেদের সিদ্ধান্তে নিষ্ঠা রাখেন যিনি, সেই নির্মল হৃদয়ের ব্যক্তিই শুধুমাত্র বুঝতে সক্ষম হন হৃদয়ের গুহাতে স্থিত সেই সমুদ্ররূপী শিব সম্পর্কে ॥ ৫২

 অজ্ঞানতার কারণে অনেকেই হরিকে বা আমাকেও (ব্রহ্মাকে) শিবের সমান মনে করে।

কিন্তু এই অজ্ঞান ভাবনা অতি কষ্টে দূর হয়।॥ ৫৩

জোনাকি যদি কখনও সূর্যের সমান হতে সক্ষম হয়, তবে হরি শম্ভুর সমতুল্য হতে পারে। যদি কিম্পাক নামক বিষাক্ত গাছ কখনও চন্দনের সমান হতে সক্ষম হয়, তবে আমিও ঈশ্বরের সমতুল্য হতে পারি। যদি অজ্ঞান কখনও জ্ঞানের সমান হতে সক্ষম হয়, তবেই সবাই মহাদেবের সমান হতে সক্ষম হবে। হে দেবতাগণ! মোহের এই দুর্জ্ঞেয় দুর্ভ্রান্তির বিড়ম্বনা সম্পর্কে আর কী বর্ণনা করব ? ॥ ৫৪

অতএব, এই সমস্ত কিছুই কেবলমাত্র অনন্ত শিব থেকেই উৎপন্ন হয়, অন্য আর কারও দ্বারা নয়। শিবের নিজের কল্যাণময় স্বভাব থেকে শিব নিজেই সব কিছু হয়ে যান। এই বিচিত্র জগত শিবের প্রভাবেই বিকশিত ॥ ৫৫

যিনি তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তি, তিনি সর্বদা সবকিছুতে অদ্বৈতই দেখেন। কিন্তু যিনি মোহাচ্ছন্ন ব্যক্তি অতি কষ্টে প্রাপ্ত হওয়া তত্ত্ব কে, তিনি কেবল গৃহ, ঘট, কুণ্ড প্রভৃতির মতো স্থূল বস্তুরূপকেই তত্ত্ব হিসেবে দেখেন। নিশ্চিতভাবে এই বিভ্রান্ত দৃষ্টিই তার গভীর দুর্দশার কারণ ॥ ৫৬

সমস্ত জীবেরই দৃঢ়ভাবে স্বতঃ এটিই প্রতীয়মান হয় যে — এটি হল জগৎ । কিন্তু যার চিত্তে নির্মল জ্ঞান - তার স্বভাবে পরিনত হয়, একমাত্র তখনই উপলব্ধি হয় যে,  —জগৎরূপে পরমাত্মাই আছেন। এই বিশুদ্ধ চৈতন্যই সেই পারমার্থিক জ্ঞান। এই জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ জন্ম-মৃত্যুর বেদনাসাগর পার হয়ে যায় ॥ ৫৭

হে শ্রেষ্ঠ দেবতাগণ! আমি, দেবতাদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ দেব মহেশ্বরের আদেশে এবং আমার (ব্রহ্মার) করুণার দ্বারা, এই গুপ্ত বিজ্ঞানকে এখানে ব্যক্ত করেছি— যা ছান্দোগ্য উপনিষদের অন্তে নিহিত, অবিবেকী জীবদের অজ্ঞান বিনাশের জন্য এবং পরম ব্রহ্মরূপ অমৃত লাভের জন্য ॥ ৫৮

[লক্ষ্য করুন, ৪৮ নং শ্লোকে শিব কে সূর্য আর হরি কে জোনাকি  বলে রূপক দিয়ে পার্থক্য নির্ণয় করে উদাহরণ দিয়েছে শাস্ত্র]


বিভিন্ন শাস্ত্রে বিষ্ণু  ও সংহার কর্তা রুদ্রদেব কে এক বলে ঘোষণা করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই "এক" শব্দটির প্রকৃত ব্যাখ্যা না জানলে যে নরক প্রাপ্তি হবে। পরমেশ্বর শিব তিন ভাবে নিজেকে স্থিত করেছেন, শিবের নিরাকার নির্গুণ সত্ত্বা - পরমশিব নামে, সাকার রূপ ধারণ করে সদাশিব নামে শিবলোকে অবস্থান করছেন, আবার সদাশিবরূপে মায়ার তিনটি গুণ দ্বারা ত্রিদেব ব্রহ্মা বিষ্ণু ও সংহারকর্তা রুদ্রদেব কে উৎপন্ন করছেন। এই রুদ্রদেব হল ত্রিদেবের মধ্যে একজন, এই রুদ্রদেব রূপে শিব সংহার করছেন কৈলাসে বসবাস রত থেকে। 

 তাই আমরা বলি যে, ত্রিদেবের মধ্যে লীলাবশত যেহেতু শিবতত্ত্বই স্থিত আছে তাই সেই আপাত  দৃষ্টিতে হরি ও হর(রুদ্র) এক। কিন্তু ঐ মায়ার গুণে আবদ্ধ হরি কখনোই গুণের প্রভাব থেকে মুক্ত সদাশিব/পরমশিবের সমান হতে পারেন না। কারণ, এইখানে গুণের তারতম্য রয়েছে।  তাই একমাত্র পরমশিব বা তার সাকাররূপ সাম্ব-সদাশিবই পরমব্রহ্ম, আর অন্য কেউ নয়, এই সিদ্ধান্ত আমাদের নিজস্ব নয়। এটি শাস্ত্রের বচন । প্রমাণ দেখুন --

স্কন্দপুরাণের সূতসংহিতার যজ্ঞবৈভবখণ্ডের উপরিভাগের অন্তর্গত সূতগীতার ২য় অধ্যায়ের ১৫নং শ্লোক থেকে ৫০নং শ্লোকে বলা হয়েছে 👇

অর্থ — ত্রিমূর্তি অর্থাৎ ত্রিদেব(ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্রদেব)-এর মধ্যে রুদ্রদেব হলেন তিনি, যার উপাধিগত বিশেষত্ব মূলত সত্ত্বগুণ , অর্থাৎ রুদ্রদেবের দিব্যদেহ সাত্ত্বিক, কিন্তু সংহারের কারণে তিনি তমোগুণকে ধারণ করেন মাত্র ॥১৫
কিন্তু যার নিজের শরীর স্বয়ং তমোগুণসম্পন্ন কিন্তু পালন করবার প্রয়োজনের কারণে সত্ত্বগুণ গ্রহণ করেন , ত্রিমূর্তির মধ্যে তিনি হলেন শ্রীবিষ্ণু ॥১৬
রজোগুণ যার শরীর তো বটেই বরং উৎপত্ত্যর্থ (সৃষ্টি করবার জন্য) -এর কারণেও রজোগুণ ধারণ করেন, তিনি হলেন ব্রহ্মা ॥১৭
ভোগ তথা মোক্ষ প্রদান করবার কারণে রুদ্রদেবের শরীর শুক্ল অর্থাৎ শ্বেত বর্ণ, বিষ্ণু হল কৃষ্ণবর্ণ আর ব্রহ্মা লাল বর্ণের — এভাবেই তাদেরকে স্মরণ করে ধ্যান করা উচিত ॥১৮ 
সত্ত্বগুণ থেকে শুক্ল অর্থাৎ শ্বেত বর্ণ উৎপন্ন হয়, রজোগুণ থেকে লালবর্ণ উৎপন্ন হয় আর তমোগুণ থেকে কৃষ্ণ/কালো বর্ণ হয় ॥১৯
বেদ শাস্ত্রে কোথাও কোথাও ব্রহ্মা বা বিষ্ণুকে পরমেশ্বর বলা হয়েছে কিন্তু সেটি তাদের ঔপাধিক রূপের দৃষ্টি তে নয় বরং তাদের অন্তরস্থ পরতত্ত্বকে বস্তুতঃ পরমেশ্বর বলা হয়েছে এই দৃষ্টিতে ॥২০-২১
কেবলমাত্র ব্রহ্মা-বিষ্ণু আদি উপাধি প্রধান রূপে তো মূলত ব্রহ্মা আদি দেবতা ই , পরমেশ্বর নয় ॥২২
কিন্তু উপাধিপ্রাধান্য দৃষ্টিতেও রুদ্রদেব সব থেকে উৎকৃষ্ট, কারণ উত্তম সত্ত্বগুণ কে একমাত্র তিনিই শরীররূপে গ্রহণ করেছেন ॥২৩
রজ এবং তম গুণের থেকে সত্ত্বগুণ শ্রেষ্ঠ, পর তথা অপর, সুখ তথা জ্ঞান সত্ত্বগুণ থেকেই প্রাপ্ত হয়ে থাকে ॥২৪
পরত্বের প্রকাশ রুদ্রদেবের মধ্যেই সর্বাধিক , ব্রহ্মা বা বিষ্ণু আদি দেবতার মধ্যে সেই সত্ত্বগুণের প্রকাশ তেমনটা নেই ॥২৫
রুদ্রদেব সর্বদাই নিজের পরতত্ত্বতা ই মানেন, এই বিষয়টি কখনোই ভুলে যান না। কিন্তু অন্য দেবতারা প্রায়শই নিজের ঔপাধিকরূপ কেই নিজে স্বয়ং বলে মানতে থাকেন। সেই হরি বা ব্রহ্মা‌ উভয়েই স্বয়ং কেই মানতে থাকেন, বাস্তবিক অর্থেও নিজের পরতত্ত্বতার প্রতি সজাগ থাকেন না, কিন্তু তারাও রুদ্রদেব কে পরতত্ত্ব রূপ‌ই মানেন, নিজেদের মতো ভাবেন না ॥২৬-২৭
কখনো কখনো সংহার আদি কার্যের জন্য রুদ্রদেব নিজেকে স্বয়ং ঔপাধিক রুদ্ররূপে ভেবে নেন, কিন্তু মুখ্যতঃ তিনি নিজেকে পরতত্ত্ব হিসেবে অবশ্যই অবগত থাকেন ॥২৮
ব্রহ্মা আদি দেবতারাও বিচার বিবেচনার দশাতে নিজের পরতত্ত্বতার নিশ্চয়কারী হয়ে যান, কিন্তু মুখ্যতঃ তাদের ঔপাধিক অভিমান এর সাথে বজায় থাকে। রুদ্রদেবের স্থিতি এনাদের চেয়ে বিপরীত — মুখ্যতঃ রুদ্রদেবের নিরূপাধিক প্রকাশ ই থাকে। প্রয়োজনে কখনো কখনো ঔপাধিক অভিমানী হন মাত্র । রুদ্রদেবের  তত্ত্বনিষ্ঠা স্বাভাবিক ই, হরি-ব্রহ্মার ঔপাধিক স্থিতি স্বাভাবিক ॥২৯-৩১
যে সমস্ত ব্যক্তিরা যথাশক্তি হরি ব্রহ্মা আদি দেবতাদের পূজা করে থাকে সে সমস্ত ব্যক্তিদের শীঘ্রই মোক্ষ লাভ হয় না , ধীরগতিতে ক্রমে ক্রমে শিবকৃপাপ্রাপ্তি হবার পর‌ই মোক্ষ লাভ হয় ॥৩২
যে ব্যক্তি যথাশক্তি রুদ্রদেবের পূজার্চনা করেন সেই ব্যক্তির অতি শীঘ্রই মোক্ষ লাভ হয়ে যায়, কারণ সেক্ষেত্রে কোনো ক্রমের আবশ্যকতা থাকে না ॥৩৩
রুদ্ররূপ এর দ্বারা রুদ্রদেব অন্য দেবতাদের চেয়ে বরিষ্ঠ — বড় — এইরকম ভাবনা নিশ্চিত ভাবেই মোক্ষদায়ক ॥৩৪
গুণ‌উপাধির মধ্যে অভিমানসম্পন্ন শ্রীবিষ্ণু আদি দেবতা রুদ্রদেবের থেকে বরিষ্ঠ(শ্রেষ্ঠ) — এমন ভাবনা করাটাই সংসারচক্রে আবদ্ধ হয়ে মোক্ষলাভ করতে অক্ষম হবার মূল কারণ হয় ॥৩৫
রুদ্রদেব, বিষ্ণু, পিতামহ ব্রহ্মার মধ্যে কাউকেই সাক্ষাৎ পরতত্ত্বের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভেবে নেওয়াটাই সংসারে আবদ্ধ হবার কারণ , রুদ্রদেব, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, স্বরাট্, সম্রাট, ইন্দ্র আদি সবাই আভ্যন্তরীণভাবে শিবরূপের দৃষ্টিকোণে সকলে এক ও অদ্বিতীয় পরতত্ত্ব , এরকম ভাবনা করলে অবশ্যই মোক্ষ প্রাপ্তি হয় ॥৩৬-৩৭
মন্ত্রীর মধ্যে রাজদৃষ্টি করলে দোষ নয় বরং মন্ত্রী প্রসন্নতা দ্বারা ফল প্রাপ্তির হেতু হয় । অতঃ সর্বত্র ব্রহ্ম(শিব)দৃষ্টি করা মুখ্য ভাবনা হওয়া উচিত, ইহা নিঃসন্দিগ্ধ ॥৩৮
তথাপি রুদ্রদেবের মধ্যে পরতত্ত্বদৃষ্টি সরলভাবে ই হয়ে যায় , কারণ - সত্ত্বময় হবার কারণে তার মধ্যে পরতত্ত্বের স্ফুর্তি প্রবাহমান থাকে । অন্যত্র সেই রকম দৃষ্টি হতে পারে না কারণ অসাত্ত্বিক হবার কারণে পরতত্ত্বের সেইরকম স্ফুর্তি তাদের মধ্যে হয় না ॥৩৯
রুদ্রদেবের “আন্তরিকতা-উপাধিশরীর” সত্ত্বগুণ যুক্ত আর তমগুণ এনার স্বরূপশরীর থেকে বহির্ভূত তথা পৃথকভাবে স্থিত । বিষ্ণু দেবের আন্তরিকতা তমগুণযুক্ত, সত্ত্বগুণ তার শরীর থেকে পৃথক হয়ে বহির্ভূত ভাবে স্থিত।
ব্রহ্মার আন্তরিকতা রজঃ আর সেই রজগুণ তার স্বরূপ থেকে বহির্ভূত হয়েও স্থিত । সত্ত্বগুণের সাথে ব্রহ্মার কোন সম্বন্ধ নেই । রুদ্রদেব ও শ্রীবিষ্ণুর মধ্যে সত্ত্বগুণের সহিত সম্বন্ধ হল — একজনের আন্তরিক আর আরেকজনের বহির্ভূত । অতঃ সত্ত্বগুণের দৃষ্টি কে নিয়ে  সাধারণ জীবেরা বিবাদ করে বলতে থাকে যে হরি শ্রেষ্ঠ নাকি হর ? ।
অহো ! মোহশক্তির  উপর ! আশ্চর্য হচ্ছি ! কতটা ক্ষমতা মোহশক্তির... !
আন্তরিক সত্ত্বগুণযুক্ত রুদ্রদেবের শ্রেষ্ঠতা নির্বিবাদ হবার পরেও, বাহ্যিক সত্ত্বগুণ যুক্ত বিষ্ণুকে দেখে জীবেরা ভ্রমে পড়ে যায় । সত্ত্ব-অসংবদ্ধ হবার কারণে ব্রহ্মা কে তো বরিষ্ঠ মানা যায় না ॥৪০-৪২
অনেক বার জন্ম গ্রহণ করে শ্রৌত-স্মার্ত ধর্ম অনুষ্ঠান
করে বুদ্ধি শুদ্ধ হয়ে যায় যে সমস্ত ব্যক্তিদের, একমাত্র তাদের‌ই মনে এই নিশ্চয় হতে পারে যে হরির থেকে হর শ্রেষ্ঠ ॥৪৩
মহাপাপ যুক্ত লোকেদের হরের থেকে হরিকে শ্রেষ্ঠ মনে হয়ে থাকে ॥৪৪
নির্বিকল্প পরমতত্ত্বতে যার শ্রদ্ধা হয়, তিনি বিনা প্রয়াস করেই মোক্ষ পেয়ে যান ॥৪৫
নির্বিকল্প পরম তত্ত্ব হলেন স্বয়ং প্রভু শিব , তিনি নিজের লীলাবিগ্রহ তে সাম্ব(অম্বা সহিত), ত্রিলোচন, চন্দ্রমৌলি রূপধারী ॥৪৬
নিজ আত্মরূপ, সুখাভিন্ন, স্ফুর্তিলক্ষণ প্রমোদ দ্বারা তিনিই তাণ্ডব প্রিয়, রুদ্রাদি গুণোপাধি মূর্তির‌ও তিনি(শিব‌ই) উপাস্য ॥৪৭
এরকম পরমমূর্তি যার তিনিই সাক্ষাৎ পরমতত্ত্ব, অন্য কেউ নয় ॥৪৮
ব্রহ্মাদি কে পরতত্ত্ব ভাবা মূলত অজ্ঞান, তাই এমন অজ্ঞানতার বিষয় ভাবতে থাকা ব্যক্তি কখনোই মুক্তি লাভ করতে পারে না ॥৪৯
অতঃ শিব , যার সাম্ব আদি মূর্তি বিশেষ রয়েছে তিনিই সচ্চিদানন্দরূপ সাক্ষাৎ পরমতত্ত্ব, অন্য আর কেউ নয় ॥৫০


যিনি পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর, তার জন্ম নেই-মৃত্যু নেই। যারা জীব তাদের জন্ম মৃত্যু হয়। পরমেশ্বর নিজেই বিভিন্ন জীব উৎপন্ন করেন, কিন্তু স্বয়ং পরমেশ্বর অন্য আর কারোর থেকে জন্ম হন না । পরমেশ্বর যিনি, তার মধ্যে এই লক্ষণ থাকে। আর এই একই লক্ষণ একমাত্র প্রভু শিবের মধ্যে দেখা যায়, ব্রহ্মা বিষ্ণু ইন্দ্রাদি সকল দেবতা জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবদ্ধ, প্রমাণ দেখুন মৎস পুরাণ থেকে 👇


ন জাতোঽস্যা পতিদেব্যা যন্মযোক্তং হিমাচল ।

ন স জাতো মহাদেবো ভূতভব্যভবোদ্ধবঃ ।

শরণ্যঃ শাশ্বতঃ শাস্তা শঙ্করঃ পরমেশ্বরঃ ॥১৭৮

ব্রহ্মবিষ্ণিবন্দ্রমুনয়ো জন্মমৃত্যুত্যুজরার্দিতা ।

তস্যৈতে পরমেশস্য সর্ব ক্রীড়নকা গিরে ॥১৭৯

আস্তে ব্রহ্মা তদিচ্ছাতঃ সম্ভূতো ভুবনপ্রভুঃ ।

বিষ্ণুর্যুগে যুগে জাতো নানাজাতির্মহাতনুঃ ॥১৮০

মন্যসে মাযয়া জাতং বিষ্ণুং চাপি যুগে যুগে ।

আত্মনো ন বিনাশোঽস্তি স্থাবরান্তোঽপি ভূধর ॥১৮১

সংসারে জায়মানস্য প্রিয়মাণস্য দেহিনঃ ।

নশ্যতে দেহ এবাত্র নাত্মনো নাশ উচ্যতে ॥১৮২

ব্রহ্মাদিস্থাবরান্তোঽয়ং সংসারো যঃ প্রকীর্তিতঃ ।

স জন্মমৃত্যুদুঃখার্তো হ্যবশঃ পরিবর্ততে ॥১৮৩

মহাদেবোঽচলঃ স্থাপুর্ন জাতো জনকোঽজরঃ ।

ভবিষ্যতি পতিঃ সোঽস্যা জগন্নাথো নিরাময়ঃ ॥১৮৪

[তথ্যসূত্র : মৎস্যমহাপুরাণ/অধ্যায় ১৫৪]

সরলার্থ : নারদজী বললেন - হে গিরিরাজ !

আমি যে বিষয়ে আপনাকে বললাম যে এই দেবীর পতি কখনো উৎপন্ন হননি, এ কথার অভিপ্রায় হল এই - যিনি ভূত ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান তিনকালই বর্তমান থাকেন, যিনি জীবের শরণদাতা, অবিনাশী, নিয়ামক, কল্যাণকর্তা এবং পরমেশ্বর, সেই মহাদেব কখনো উৎপন্ন হননি, অর্থাৎ তিনি অনাদি, ওনার কখনোই জন্ম হয় না। 

হে পর্বতরাজ !

ব্রহ্মা বিষ্ণু ইন্দ্র মুনি আদি সকলেই জন্ম-মৃত্যু এবং বৃদ্ধ অবস্থা গ্রস্থ হয়ে থাকেন। এনারা সবাই সেই পরমেশ্বর মহাদেবের খেলনা মাত্র। সেই পরমেশ্বর মহাদেবের ইচ্ছেতেই ত্রিভুবনের স্বামী ব্রহ্মা প্রকট হয়েছেন এবং প্রত্যেক যুগে শ্রীবিষ্ণু বিশাল শরীর ধারণ করে নানা প্রকারের জীব জাতিতে উৎপন্ন হয়ে থাকেন । 

হে পর্বতরাজ !

প্রত্যেক যুগে মায়ার আশ্রয় নিয়ে উৎপন্ন হওয়া বিষ্ণুকে তো তুমিও মান্য করে থাকো। স্থাবর যোনিতে জন্ম নেওয়ার পর শরীর অন্ত হওয়ার পরও আত্মার বিনাশ হয় না। সংসারে উৎপন্ন হয়ে মৃত্যুকে প্রাপ্ত করা প্রাণীর শুধু মাত্র শরীর নষ্ট হয়ে থাকে, আত্মার নাশ হয়না বলে জানা যায়। ব্রহ্মা থেকে শুরু করে স্থাবর পর্যন্ত যাকে সংসার বলে জানা যায়, তাতে উৎপন্ন হওয়া প্রাণী জন্ম-মৃত্যুর দুঃখ দ্বারা পীড়িত হয়ে পরাধীন হয়ে পড়ে, কিন্তু পরমেশ্বর মহাদেব স্থাণুর ন্যায় অচল(স্থির)। তিনি বৃদ্ধ অবস্থা রহিত তথা সকলকে উৎপন্নকারী, কিন্তু তিনি স্বয়ং অন্য কারোর থেকে কখনোই উৎপন্ন হন না। সেই পরমেশ্বর জগদীশ্বর শংকর কি এই কন্যা পার্বতী পতি হবেন।

________________________________________________

অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে যে,

 শাস্ত্রের মধ্যে হরি হর কে অভেদ না মানলে নরকে যেতে হবে আবার এই শাস্ত্রের মধ্যেই বলা হয়েছে যে হরি বা অন্য কোনো দেবতা কে যদি পরমেশ্বর শিবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা সমান বলা হয় তবেও নরক যেতে হবে বা শাস্তি পেতে হবে। তাহলে এখন কি করা উচিত ? 

উত্তর হল — শাস্ত্রের যে স্থানে হরি হর এক বা হরি হর কে অভেদ বা সমান বলা হচ্ছে - তা মূলত "পরমার্থিক দৃষ্টি তে - শিবই হরি রূপ ধারণ করে লীলা করছেন - এই দৃষ্টিতে। 

আপনি যদি এটি না মানেন তবে আপনি নরকে যাবেন। কারণ পরমেশ্বর শিবই সকলের আত্মা রূপে রয়েছেন, তা যদি আপনি স্বীকার না করেন তবে আপনি পাপ করছেন। পরমতত্ত্বের পরমত্ত্ব কে অস্বীকার করলে আপনার এই অজ্ঞানতা আপনার ভাবনা অনুসারেই আপনাকে আপনার উপযুক্ত গতি প্রদান করবেন।

এবার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিই,   

 এই শাস্ত্রের মধ্যেই আবার এটাও বলা হয়েছে যে হরি বা অন্য কোনো দেবতা কে যদি পরমেশ্বর শিবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা সমান বলা হয় তবেও নরক যেতে হবে। এর কারণ হল - পরমেশ্বর শিবের থেকে সকল দেবতা, জীব উৎপন্ন হন আবার শিবের মধ্যেই মিশে যান। অর্থাৎ শিব হল নিত্য সত্ত্বা, যার উৎপত্তি বা বিনাশ নেই, কিন্তু বিষ্ণু বা অনান্য দেবতারা শিব থেকে উৎপত্তি হয়ে শিবেই বিলীন হয়ে থাকে, তাই দেবতারূপ গুলি অনিত্য। তাই নিত্য সত্ত্বা আর অনিত্য সত্তা উভয়েই একই সত্ত্বা বললে তা কখনোই যুক্তিযুক্ত হয় না। কারণ, অনিত্য সত্ত্বার একটি সীমাবদ্ধতা আছে, তাদের ক্ষমতাও সীমিত হয়ে থাকে, তাদের আয়ুও অল্প কালের জন্য হয়ে থাকে। কিন্তু নিত্য সত্ত্বা শিবের কোনোরকম জন্ম মৃত্যু না থাকবার কারণে তার  ক্ষমতাও অসীম, তার আয়ু নিয়ে আর বলবার কোনো জায়গা থাকে না।

তাই এই দৃষ্টিতে যদি কেউ শিবের অনিত্য দেবতা রূপগুলির সাথে নিত্য শিবের তুলনা করে শিবের চেয়ে হরিকে বা অন্য কোনো দেবতাকে সমান বলে দাবী করে তবে তা কখনোই গ্রহণ যোগ্য হয় না, বরং ব্রহ্মতত্ত্বকে সাধারণ দৃষ্টি করবার পাপে জর্জরিত হয়ে সেই ব্যক্তি নরকে যায়  - এটি বলেছে শাস্ত্র।


শাস্ত্রের কথা কখনোই পরস্পর বিরোধী হয় না, সমস্যা তখন দেখা দেয় যখন মানুষ শাস্ত্রের উভয় বচনের মধ্যে থাকা সঠিক মীমাংসা সম্পর্কে জানতে পারে না। কৃপাময় গুরুদেব ও পরমেশ্বর শিবের কৃপায় আমি "হরিহর অভেদ না মানলে নরকে কেন যায়" আর "হরি বা অনান্য দেব-দেবীকে শিবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা শিবের সমান বলে দাবী করলেও মানুষ কেন নরকে যায়" - এই বিষয়ে মীমাংসা করে দিলাম।

যদি কোনো ব্যক্তির মনে হয় যে এই মীমাংসা যুক্তিযুক্ত নয়, তবে তিনি উপযুক্ত যুক্তি দিয়ে উভয় শাস্ত্রের বচনের মধ্যে সামঞ্জস্য করে দিন। যদি আমার দেওয়া মীমাংসা ছাড়া আর অন্য কোনো যুক্তিতে শাস্ত্রের এই উভয় বচনকে মীমাংসা করতে সক্ষম না হয়ে থাকে তবে এই মীমাংসাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য বলে জানবেন।  

 আরো দেখুন, এখানে ক্লিক করে 👇

________________________________________________

সিদ্ধান্ত

  যারা হরিহর এক বলে অদ্বিতীয় পরমেশ্বর শিব কে হরির সাথে সম্পূর্ণ সমান বা শিবের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করে থাকেন, বা অনান্য দেবতার সাথে সমান বা শিবের থেকেও শ্রেষ্ঠ মনে করেন তারা অজ্ঞানতার বশবর্তী হয়ে এমন প্রলাপ করেন মাত্র, এই ধরণের মানুষেরা নিশ্চিতভাবে নরকে যান - এই কথা শাস্ত্রের। সুতরাং, যারা এইভাবে পরমেশ্বর শিবের সাথে সবাইকে এক বা সমান বলেন তার সাবধান হোন। বিশেষ করে যারা আগে-পিছে না ভেবে, সঠিক ব্যাখ্যা না বুঝে "হরি হর সমান/অভেদ/এক" - বলে দাবী করেন, তারা আগেই সাবধান হোন। 

________________________________________________

এই প্রবন্ধটি এখানে সমাপ্ত হল ।


শৈব সনাতন ধর্ম সদা বিজয়তে 🚩 

হর হর মহাদেব 🚩 


সত্য উন্মোচনে —  শ্রী নন্দীনাথ শৈব আচার্য জী 

কপিরাইট ও প্রচারে — International Shiva Shakti Gyan Tirtha - ISSGT 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ